খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধশিক্ষামূলক

কত কথা বলে রে! – নর ও নারীর আড্ডা বিষয়ক আলোচনা

লিখেছেনঃ সন্ন্যাসী রতন

কয়েকদিন আগে এক বাঙালি পরিবারে ডিনারের নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা ছাড়াও আরও তিন/চারটি পরিবার। তা বাঙালি পরিবারে ডিনারের নিমন্ত্রণে গেলে যা হয় আর কী, এত আইটেম থাকে যে খেয়ে শেষ করা মুশকিল হয়ে যায়। আমি তারপরও খাই – এত এত আইটেম তো নিত্য খাওয়া হয় না, তাই কোন কিছুই না খেয়ে আসি না। আরেকটা ব্যাপার হলো, এখানকার বাঙালি ভাবি-বৌদি-আপারা এত ভাল রান্না করেন যে কিছু না চেখে আসতে ইচ্ছে করে না। ফলে খাওয়া-দাওয়ার পরে নড়াচড়া করা একটু মুশকিল হয়ে যায়। তা নড়ার দরকারটাই বা কী। তখন সবাই মিলে গল্প-গুজব করে পেটটাকে একটু খালি করা হয় যাতে ডেজার্টের কোন আইটেম মিস না হয়। সাথে কফি তো থাকেই।

ছেলেদের আড্ডার প্রধান বিষয় অর্থ ও বিনোদন।
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট

তো যা বলছিলাম, সেদিন ডিনারের পরে যখন সবাই গল্প-গুজব করছিলাম তখন খেয়াল করলাম সেখানে আমরা পুরুষরা একটা আলাদা দলে ভাগ হয়ে গিয়েছি। নারীরা খাবার শেষে ডাইনিং টেবিলে বসে গল্প করছেএবং আমরা পুরুষরা লিভিং রুমে সোফা ও চেয়ার পেতে গল্প করছি। ঠিক গল্প-গুজব নয়; আমরা রীতিমত উচ্চৈঃস্বরে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বাংলাদেশ ও বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা করছিলাম। আমার মনে তখন একটা প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা দেখি তো আমাদের নারীরাও কি আমাদের মত বেহুদা রাজনৈতিক তর্ক করছে?

না, নারীরা আমাদের মতো বাংলাদেশ বা বহির্বিশ্ব নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাচ্ছিল না। তারা বরাবরের মত তাদের ঘরোয়া বিষয় নিয়েই কথা বলছিল। শেষের দিকে তারা আমাদের দলে যোগ দিলেও তাদের মতামত ততটা অংশগ্রহণমূলক ছিল না বা পুরুষরা তাদের কথায় তেমন একটা পাত্তা দেয়নি।

আমার আজকের প্রবন্ধটি নারী ও পুরুষের আড্ডার কথোপকথন নিয়ে। কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ, এই বিতর্ক তোলার কোন প্রচেষ্টা থাকবে না এখানে, কেবল পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করা হবে। প্রবন্ধের শুরুতেই আরো যেটা বলতে চাই তা হলো, কথোপকথন বিষয়ে পুরুষ-নারী কোন পক্ষের কার্যক্রমকেই স্টেরিওটাইপ হিসেবে দেখার ঝুঁকি নিবেন না। যে কোন পপুলেশনেই কোন নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য সকলে ধারণ করে না; অধিকাংশ যেটি ধারণ করে সেটিকেই ঐ পপুলেশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধরা হয়।

নারী ও পুরুষের আড্ডায় আলোচিত বিষয়বস্তুগুলো যে ভিন্ন, সেটা আমরা নিজ নিজ জীবনাভিজ্ঞতায়ই টের পাই বা ধরতে পারি। তবে এ বিষয়ে প্রথম সিস্টেমেটিক গবেষণাটি করেন হেনরি মুর। তিনি ১৯২২ সালে কয়েক সপ্তাহ ধরে নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটার এলাকায় কান পেতে নারী-নারী ও পুরুষ-পুরুষ কথোপকথনগুলো শোনেন এবং সেগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করেন। মুর দেখেন যে নারীরা যখন নারীদের সাথে কথা বলে তখন তাদের কথোপকথনের প্রধান বিষয় বিপরীত লিঙ্গ তথা পুরুষ। এছাড়া রয়েছে পোশাক, বাড়ি, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। অন্যদিকে পুরুষ-পুরুষ কথোপকথনের প্রধান বিষয় ব্যবসা, অর্থ ও বিনোদন (স্পোর্টস, থিয়েটার, ইত্যাদি)।

মেয়েদের আড্ডার প্রধান বিষয় ছেলে হলেও ছেলেদের ক্ষেত্রে তা নয়।
ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট

মুরের এই গবেষণা আমাদের বর্তমান মানুষের কাছে খুব একটা গুরুত্ব বহন করবে না, কেননা ১৯২২ সাল বহুত দূর কি বাত, এরপরে গঙ্গা-যমুনায় বহুত জল গড়িয়েছে, বিশেষ করে সত্তর দশকের সাম্যবাদী চিন্তার জোয়ারের কথা না বললেই নয় যখন মনে করা হতো ছেলে ও মেয়ে শিশুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, তাদেরকে একই পরিবেশে একই সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বড় করলে পূর্ণবয়স্ক হয়ে তাদের আচরণে কোন পার্থক্য হবে না। ঐ জোয়ারের ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে সত্তর ও আশির দশক ছিল সন্তানদের ওপর বাবা-মায়ের এক্সপেরিমেন্টের সময়। কিন্তু সেসব এক্সপেরিমেন্ট সাম্যবাদীদের কাম্য ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। ছেলেদের আচরণ ছেলেদের মতোই রয়ে গেলো, আর মেয়েদের আচরণ মেয়েদের মতোই। তখনও অবশ্য লিবারেলরা বাবাদের দোষারোপ করতে লাগলেন এই বলে যে যে তারা তাদের ছেলেদের আলাদা করে পৌরুষোচিত বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে লিবারেলদের ছেলে ও মেয়ে শিশুর পার্থক্যহীনতা তত্ত্ব একেবারেই মাঠে মারা গেলো।

এখানে বলে রাখি, ট্রান্সজেন্ডাররা বাইরে যে লিঙ্গ ধারণ করে, হরমোনজনিত কারণে শরীরে অনুভব করে তার বিপরীতটি। ফলে শিশ্ন থাকা সত্ত্বেও এবং ছেলেদের পোশাক-আশাক পরেও একজন ট্রান্সজেন্ডার অনুভব করে যে সে আসলে মেয়ে। সে সাজপোশাকে মেয়ে সেজে থাকতে চায়। অথবা ঠিক এর বিপরীতটি। এ প্রসঙ্গে এ সপ্তাহেরই (১৪ জানুয়ারী ২০২০) একটা খবর শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না। নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত মেকআপ ইউটিউবার নিকি, যার প্রায় ১৩ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার আছে, তিনি দীর্ঘ এগার বছর ইউটিউব চ্যানেল চালানোর পরে ১৩ জানুয়ারি একটা ভিডিওতে জানিয়েছেন যে তিনি আসলে ট্রান্সজেন্ডার; শৈশব থেকেই তিনি মেয়েদের সাজপোশাক পছন্দ করতেন; পরে বাবা-মায়ের সহযোগীতায় হরমোন চিকিৎসা নিতে শুরু করেন এবং ১৯ বছর বয়সে অপারেশনের মাধ্যমে পুরোপুরি নারীতে রূপান্তরিত হন।

যাই হোক, ধান ভানতে শীবের গীত বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। ১৯৯৩ সালে Sex Roles জার্নালের ২৮ নম্বর ভলিউমে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ক্যাথেরিন বিশপিং (Katherine Bischoping)-এর একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিল Gender Differences in Conversation Topics, 1922-1990। ক্যাথেরিন তাঁর প্রবন্ধে মুরের গবেষণার পর থেকে ১৯৯০ অবধি এ বিষয়ে আরো যেসকল গবেষণা হয়েছিল সেগুলো তুলে ধরে গত সাত দশকে পুরুষ ও নারীর কথোপকথনের ধারায় যে পরিবর্তন এসেছে সেদিকে আলোকপাত করেন। উল্লেখ্য সর্বশেষ গবেষণাটি করা হয় তাঁর নিজের তত্ত্বাবধানে।

এতে তিনি দেখতে পান যে পুরুষ ও নারীর কথোপকথনের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ঠিকই, তবে পার্থক্য এখনও বিরাট। পুরুষ-পুরুষ কথোপকথনে বিপরীত লিঙ্গ বিষয়টি এখনও আগের মতোই অবহলিত – মুরের গবেষণায় ছিল ৯%, ক্যাথেরিনের গবেষণায় তা ৬.৪%। নারীদের ক্ষেত্রে বিপরীত লিঙ্গ বিষয়টি পুরুষদের থেকে প্রায় চার গুণ হলেও মুরের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের অর্ধেকে নেমে এসেছে। মুর – ৪৮%, ক্যাথেরিন ২৪%। নারীদের কথোপকথনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে অর্থ, চেহারা ও বিনোদন বিষয়ে। মুরের গবেষণায় যা ছিল যথাক্রমে ৪, ২৬ ও ৪ শতাংশ, ক্যাথেরিনের গবেষণায় তা যথাক্রমে ৩৮, ৪ ও ২৫ শতাংশ। পুরুষদের কথোপকথনের ট্রেন্ডে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি বললেই চলে – অর্থ বিষয়টি থেকে কিছু কমে সেটা যোগ হয়েছে বিনোদন সক্রান্ত বিষয়ে।

এখানে উল্লেখযোগ্য হলো দুই গবেষকের টার্গেট স্যাম্পল ছিল আলাদা। ক্যাথেরিন গবেষণাটি করেছিলেন নিজ ক্যাম্পাসে কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রদের ওপরে; পক্ষান্তরে মুরের স্যাম্পল পপুলেশন ছিল র‍্যান্ডম (পুরোপুরি র‍্যান্ডম অবশ্য বলা যাবে না এজন্য যে ঐ সময়ে যারা ব্রডওয়ে থিয়েটারে যেতেন বা এর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতেন তারা একেবারে সাধারণ জনগণ ছিলেন না)। এটি এবং আরো কিছু কারণে ক্যাথেরিন মনে করেন না যে কথোপকথনের বিষয়ে পুরুষ ও নারীর পার্থক্য খুব একটা কমেছে। ১৯২২ থেকে ১৯৯০ অবধি এ বিষয়ে যতগুলো গবেষণা হয়েছে তার মধ্যে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটি ছাড়াও আরো চারটি করা হয়েছিল কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর। সেই বিশ এবং ত্রিশের দশকের গবেষণাগুলোতেও এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীর কথোপকথনের বিষয়ে পার্থক্য খুব কম ছিল। কিন্তু বাকি গবেষণাগুলো, যেগুলো কলেজের বাইরে করা হয়েছিল সেগুলোতে বেশ বড় ধরণের পার্থক্য পাওয়া গিয়েছে।

মুর তাঁর প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে সময়ের পরিবর্তন হবে কিন্তু নারীরা সবসময়ই পুরুষ, পোশাক ও সাজসজ্জা বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করবে এবং পুরুষরা অর্থ ও বিনোদন বিষয়ে কথা বলবে। অর্থনীতিতে নারীর সংযুক্তি ও অবদান অনেক বাড়ার ফলে এ বিষয়ে নারীদের কথোপকথনে বেশ পরিবর্তন হয়েছে বটে, তবে এখানে যে বিষয়টি খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনাযোগ্য তা হলো, নারী-নারী কথোপকথনে কাজ বিষয়ক আলোচনাও শেষ পর্যন্ত কর্মস্থলের ব্যক্তি সম্পর্কিত আলোচনায় পর্যবসিত হয়। পক্ষান্তরে পুরুষ-পুরুষ কথোপকথনে কর্মস্থল খুবই সীমিত স্থান দখল করে।

You Just Don’t Understand: Men and Women in Conversation বইয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ও ভাষাবিদ Deborah Tannen বলেন, নারী ও পুরুষের কথোপকথনের বিষয়ই যে কেবল আলাদা তা নয়, তাদের কথা বলার ধরণও আলাদা। তিনি নারী ও পুরুষের কথোপকথনকে যথাক্রমে rapport talk ও report talk হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে র‍্যাপোর্ট শব্দের অর্থ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, বিশেষ করে যে সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহমর্মিতা যোগাযোগকে সম্ভব ও সহজ করে তোলে।

দেবোরার মতে, কথোপকথনে নারীর ভাষা ব্যবহারের লক্ষ্য অন্তরঙ্গতা বৃদ্ধি। একটি মেয়ে শিশু শৈশবেই শেখে কথোপকথন হলো সেই আঁঠা যা সম্পর্ককে জুড়ে রাখে। তাই বয়স্ক নারীদের কথোপকথন হলো ঘনিষ্ঠতার জন্য সন্ধিস্থাপন’ (negotiations for closeness) যার মাধ্যমে তারা একে অপরকে সহযোগীতা ও আশ্বাস প্রদান করার চেষ্টা করে এবং একটি সম্মতিতে পৌঁছাতে চায়। অন্যদিকে পুরুষের কাছে কথোপকথন হলো তথ্য আদান-প্রদান। কথোপকথনে তার লক্ষ্য নারীর ঠিক বিপরীত। সে সচেষ্ট থাকে তাকে টপকে কেউ যেন ওপরে না চলে যায়। ছেলেরা শৈশবে অন্য ছেলেদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে প্রধানত খেলাধুলা বা এ ধরণের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। সুতরাং পূর্ণবয়স্ক পুরুষের কথোপকথন হলো একেকটি প্রতিযোগীতা যেখানে তার অবদান নির্ধারণ করে দেয় সে এক ধাপ ওপরে উঠবে কি এক ধাপ নিচে নামবে।

(এই প্রবন্ধের জন্য অসম্পর্কিত হলেও দেবোরার বইয়ের একটি তথ্য এখানে তুলে ধরছি। তাঁর মতে যে কোন কথোপকথনের জন্য ওভারল্যাপিং মানে একজনের কথার মধ্যে আরেকজনের কথা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটি ছাড়া কোন কথোপকথন চলতে পারে না। ওভারল্যাপিংগুলো যে একটি বা দুটি পূর্ণ বাক্য হতে হবে এমন নয়; একটি বা দুটি শব্দ দিয়েও হতে পারে। অনেকক্ষেত্রে সেটা কেবল সমর্থন বা বিস্ময় প্রকাশ। আবার এমনও হতে পারে, একজন কথা বলে যাচ্ছে, তার মধ্যে আরেকজন বললো ‘একমত নই’। এটি থেকেই কথোপকথনটি পরে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হতে পারে। যে কোন কথোপকথনে থেমে যাওয়াটা সবাইকে অপ্রস্তুত করে। কোন কোন কালচারে এভাবে থেমে যাওয়াকে বন্ধুত্বের ঘাটতি হিসেবে দেখা হয়।)

মূল প্রবন্ধে ফিরে যাই। শুরুতেই যে ডিনারের নিমন্ত্রণে আড্ডার কথা বলেছিলাম সেখানে একটা বিষয় উল্লেখ করেছিলাম- আমাদের পুরুষদের আড্ডায় নারীরা দু’একটা মত জানালেও তাদের মতামত ততটা অংশগ্রহণমূলক ছিল না বা পুরুষরা তাদের কথায় তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।

আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, প্রায় সব সমাজেই নারী ও পুরুষের কথোপকথনের বিষয় আলাদা। তবে এটা যেহেতু অলঙ্ঘনীয় কোন আইন নয়, তাই সবখানেই কিছু মানুষ থাকে যারা বিপরীত লিঙ্গের আলোচিত বিষয়গুলোকে পছন্দ করেন। সমস্যা হলো তাদেরকে দুই তরফ থেকেই আঁড়চোখে দেখা হয়। একটা উদাহরণ দিয়ে পরিস্কার করা যাক।

আমেরিকান ফুটবল বিষয়টা একতরফাভাবেই পুরুষদের উপভোগ ও আলোচনার বিষয়। আমেরিকান নারীরাও নারী ফুটবল দেখে না। (এটা অবশ্য সব খেলার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নারীরা যতটা নারীদের স্পোর্টস উপভোগ করে, তার চেয়ে বেশি করে পুরুষদের স্পোর্টস। আর পুরুষরা যতই খেলা পাগল হোক, তারাও নারীদের স্পোর্টস নিয়ে আদৌ উৎসাহী নয়।) আমেরিকান ফুটবল নিয়ে কোন নারী ক্রেইজি হবে, এমনটা ভাবাটাই যেন বোকামী। কিন্তু কেউ যদি সত্যিই হয়, তাহলে তার জন্য এ বিষয়ে কারো সাথে কথা বলা বিরাট মুশকিল। প্রথমত, তার বান্ধবী মহলে সে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবে না, কারণ তারা কথা বলা তো দূরের কথা ঐ খেলার নিয়মই জানে না। দ্বিতীয়ত, সে যদি ফুটবল বিষয়ে পুরুষদের কথোপকথনের মাঝে গিয়ে কথা বলা শুরু করে, তাহলে পুরুষরা ভাববে সে বুঝি ভাব নেয়ার জন্য দু’চারটা দল ও খেলোয়াড়ের নাম এবং স্পোর্টস সেন্টার থেকে কিছু তথ্য মুখস্থ করে এসেছে। বাস্কেট বলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। এ ব্যাপারে হাফপোস্টে এক নারী বাস্কেট বল ফ্যান খেলা-বিষয়ক আড্ডা সম্পর্কে বলেছেন, “আমি স্কুলে বাস্কেট বল খেলতাম। মায়ামি বাস্কেট বল টিম প্রতি সিজনে যে ৮২টা গেইম খেলে আমি প্রতিটা দেখি। কিন্তু কোন বারে গিয়ে যখন পুরুষদের সাথে এ বিষয়ে পরিসংখ্যান ও অন্যান্য তথ্যাদি দিয়ে কথা বলা শুরু করি, তারা আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন আমি অন্য গ্রহের প্রাণী।“

উক্ত নারীর সাথে পুরুষদের যে আচরণ তাকে সবাই এক বাক্যে সেক্সিস্ট বলে আখ্যায়িত করবে। কিন্তু যদি আমরা মনে করি যে মানুষ যে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তার যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতাকেই ব্যবহার করে, তখন এটাকে কতটা সেক্সিস্ট বলা চলে তা তর্কসাপেক্ষ।

নারীরা তাদের কথোপকথনে পুরুষদের অংশগ্রহণ কিভাবে নেয়, এ বিষয়ে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে আমার নিজ অভিজ্ঞতায়, মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার দুই বন্ধুকে দিয়ে, যেটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে, কেউ যদি তাদের দলে গিয়ে ভিড়তে চায় তাহলে নারীরা খুব সহজেই তাকে আপন করে নেয়, পুরুষদের মতো সন্দেহের চোখে দেখে না। পুরুষদের কাছে সে মেয়েলি পুরুষ হিসেবে আখ্যা পায় বটে, কিন্তু নারীদের সাথে মিশতে তাকে আদৌ বেগ পেতে হয় না। সম্ভবত দেবোরার বইয়ে উল্লেখিত ‘র‍্যাপোর্ট টক’ই এর প্রধান কারণ।

পুরুষ ও নারীর আড্ডার কথোপকথন বিষয়ে রেডিটে এক নারীর পোস্ট ও সেই পোস্টের কয়েকটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি। ‘What do guys talk about?’ শিরোনামে তিনি লিখেছেনঃ আমার বয়ফ্রেন্ড তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় ঠিকই, কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় তার বন্ধুদের জীবনে কী ঘটছে, সে বিষয়ে তার ন্যুনতম ধারণা নেই। তাকে যদি জিজ্ঞেস করি তোমার বন্ধুরা কাজে কেমন করছে, অথবা তাদের গার্লফ্রেন্ডরা কেমন আছে, অথবা তারা কী করছে, সে শুধু কাঁধ ঝাকায়। সে এমন ভাব করে যেন আমি তাকে মার্স রোভারের বয়স কত অথবা এ জাতীয় কোন ফালতু বিষয় জিজ্ঞেস করেছি। আমার বাবা ও ভাইদের অবস্থাও দেখি এরকমই। আমি যখন আমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই, তখন আমরা আমাদের জীবন ও ভবিষ্যতের কথা আলোচনা করি। আমি ঠিক বুঝতে পারি না what the fuck do guys talk about?

তার পোস্টের উত্তরে একজন লিখেছেন, “কৌতুক হিসেবে নিবেন না। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় আমরা আমাদের চাকুরি ও সাংসারিক জীবন নিয়ে আলোচনার চেয়ে ঢের বেশি পছন্দ করবো মার্স রোভার নিয়ে কথা বলতে। আলোচনার জন্য মহাকাশ খুবই আকর্ষণীয় (fascinating), পরিবার ও কাজ খুবই ক্লান্তিকর (boring)।“ আরো দু’জনের মন্তব্য একত্র করলে যা দাঁড়ায় তা হলোঃ ‘ব্যক্তিগত বিষয় বাদে সবকিছুই আমরা আলোচনা করি। ব্যক্তিগত বিষয় শুধু তখনই আসে যখন কেউ সমস্যার মধ্য দিয়ে যায়। তবে সেক্ষত্রেও তেমন কিছু বলার থাকে না। লাইফ সাক্স, ওয়ার্ক সাক্স, গার্লফ্রেন্ড সাক্স, ঐ পর্যন্তই। আর যদি সমস্যা না থকে তাহলে কাজ বা পরিবার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ফাইন, ওকে- এ জাতীয় উত্তরের পরে আর কিছু জিজ্ঞাসা করার থাকে না।‘ তৃতীয় আরেকজনের মন্তব্যঃ আপনি কোন্ মার্স রোভারের কথা বলছেন? স্প্রিট, অপরচুনিটি নাকি কিউরিওসিটি?

পুরুষ ও নারীর আড্ডার কথোপকথনের বিষয় আলাদা, কিন্তু তাই বলে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কোনটা অহেতুক, এরকম ভাবার কারণ নেই। আমাদের মাঝে এরকম একটি ধারণা রয়েছে যে নারীরা তাদের আড্ডায় যেসব বিষয়ে নিয়ে কথা বলে তা খুবই তুচ্ছ। সত্যি বলতে কি আমি নিজেও এরকম ধারণা পোষণ করতাম। আমার মা যখন আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে আসা মহিলাদের সাথে পান খেতে খেতে এ বাড়ির সে বাড়ির বউদের নিয়ে আলোচনা করতেন, তখন মনে মনে রাগ করতাম। মা যদিও এসব বিষয়ে খুব সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন না, কেবল অন্যদের সাথে হা হু করে যেতেন, তারপরও কখনও কখনও এ নিয়ে পরে মাকে বকতাম। “তোমার ঠেকছে টা কী বলো! কোন্ বাড়ির বউ কী করলো তাতে তোমার কী আসে যায়? তোমার ঘরে যখন বউ হবে, তখন দেখবা তাদেরও এরকম সমালোচনা হবে। সেটা শুনতে কি তোমার ভাল লাগবে?” মা বলতেন, “আমি কী কমু ক। তারা আয়, একটু পান খায় আর গল্প করে। আমি কি হেগো (তাদের) কইতে পারি যে তোমরা আর আবা না? আমাগো বাড়ি আয়। সব বাড়ি তো তারা যায়ও না।“ তখন না বুঝলেও এখন মায়ের কথাগুলোর গুরুত্ব বুঝি। আর যেদিন এই আড্ডাতেই মানুষের সামাজিক বিবর্তনে পরচর্চার গুরুত্ব নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করা হলো, সেদিন থেকে মানুষের ঋণাত্মক দিকগুলো নিয়ে আরো বেশি করে ভাবতে শুরু করেছি।

নারী যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলে সেগুলোতে পুরুষের আলোচিত বিষয়ের মতো পৌরুষ (machoness) না থাকতে পারে, কিন্তু সমাজে নারীর সার্ভাইভাল তথা সামাজিক বিবর্তনে যে সেগুলো তাকে সাহায্য করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার এই প্রশ্ন যদি রাখা হয়, পুরুষরা যে তাদের আড্ডায় খেলা, রাজনীতি, বিজ্ঞান, মহাকাশ নিয়ে আলোচনা করে, তাতে কার কী লাভ হয়? দুটোরই ফল কিন্তু একই। সমাজ বা গ্রুপে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে সার্ভাইভ করা। নারী যেটা করে সমঝোতা ও সহমর্মিতা দিয়ে, পুরুষ সেটা করে প্রতিযোগীতা দিয়ে।
……..
এই প্রবন্ধটি অনলাইন পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’র ৭৭তম আসরে পাঠ করেন সন্ন্যাসী রতন। লেখাটি ফেসবুকে প্রকাশিত হলে তানবিরা হোসাইন মন্তব্য করেন যে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে। তখন আমি তাকে এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে অনুরোধ করি। আমার অনুরোধে তিনি ‘ঘর মন জানালা’ শিরোনামে নিম্নোক্ত লেখাটি লিখেন। আমি মনে করি তাঁর লেখাটির মাধ্যমে আমার লেখাটির পূর্ণতা পেয়েছে।
……….

প্রবাসে উইকএন্ড আড্ডা একটা খুব কমন প্র্যাক্টিস। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততার পর, একটু আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা প্রায় সবারই আরাধ্য থাকে। প্রবাসীরা সাধারণতঃ নিজেদের কমিউনিটির সাথে আর অ-প্রবাসীরা নিজেদের পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে। প্রবাসী আড্ডার বিষয়বস্তু লিঙ্গভেদে ছেলেদের আর মেয়েদের ভিন্ন হয় এই নিয়ে বন্ধু-ভাই লেখক বিভিন্নি মনোবিদের উদাহরণ সহ খুবই সুখপাঠ্য একটি লেখা লিখেছেন যার লিঙ্ক আমি মন্তব্যের ঘরে দিয়ে দেবো। আমি আমার স্বভাবনুযায়ী বলেছি, এ প্রসঙ্গ নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ আছে আর তাতে অনুরোধ এসেছে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি নিয়ে লিখতে, যাতে দুটো লেখা যোগ করে খানিকটা পরিপূর্ণ চিত্র উঠে আসে। প্রথমেই বলে রাখছি, এই লেখাটি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ আর অভিজ্ঞতা থেকে যেহেতু লেখা হবে, এটা ইউনিক কিছু হবে না আর নেট ঘেঁটে বিভিন্ন তত্ত্ব তুলে আনতে গেলে, আলসেমীতে লেখাই হবে না, এটা নিতান্তই “অনুরোধের ঢেঁকি গেলা” টাইপ লেখা যেহেতু দ্বিমত পোষণ করেই ফেলেছি।

শুরুতেই খুব ছোটবেলার একটি ঘটনা শেয়ার করছি, আমরা সবে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে পা রেখেছি, স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলার আনন্দে, প্রজাপতি পাখায় উড়ে বেড়াচ্ছি। ক্লাশ হোক আর না হোক আমরা মোস্ট অবিডিয়েন্ট স্টুডেন্টদের মত রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, ফাঁকা ক্লাশরুমে বসে থাকি, ইলেক্ট্রিসিটি নেই, ফ্যান ঘোরে না আর ঘুরলেও বাতাস কই যায় আমরা তা জানি না। গরমে সেদ্ধ হতে হতে ক্লাশে আড্ডা, সেটা শেষ করে সামনের এক ফালি মাঠে আড্ডা, তারপর টিএসসির মাঠে আড্ডা, সোজা কথায়, দুপুর না গড়ালে বাসায় ফেরাফেরি নেই। কিন্তু মেয়েরা এক দল আর ছেলেরা আলাদা দল। ঝগড়া নেই আমাদের, সবাই সবার নাম টাম জানি, হাই-হ্যালো হয় কিন্তু আড্ডা দেই আলাদা। তার হয়ত কারণ ছিলো, সদ্য তারুণ্যে পা রাখা আমরা সবাই যারা অভিভাবকদের মুঠো থেকে বেরিয়ে সবেমাত্র স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি, অনেক কিছুতেই আমরা তখন খানিক দিশেহারা। আমাদের গল্পসল্পও হয়ত খানিক বেপোরোয়া। যেহেতু কো-এড থেকে আমরা আসিনি, স্বাভাবিক সংকোচ কাটেনি আমাদের।

তো একদিন আমাদের এক আহ্লাদী বান্ধবী বললো, আচ্ছা ছেলেরা কি নিয়ে গল্প করে?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্য বান্ধবী বললো, আমরা যা নিয়ে গল্প করি ওরাও হয়ত তাই নিয়েই গল্প করে
আহ্লাদী বান্ধবী মুখ লাল করে বলে উঠল, ছিঃ ছেলেরা কি অসভ্য।

আমরা সবাই হো হো হেসেই ক্ষান্ত হই নি, অনেকদিন আমাদের মধ্যে এই বাক্যটি সাংকেতিক প্রবাদ-প্রবচণ হিসেবে কাজ করেছে।

উইকএন্ড আড্ডায় সাধারণতঃ মেয়েরা রান্না-বান্না, জামা-কাপড়, বাচ্চাদের নিয়ে আলোচনা করে, যেটা হয়ত অনেকের দৃষ্টিতেই তেমন প্রডাক্টিভ কিছু না। কিন্তু কেন?

রান্না-বান্না শুধু মেয়েরা করে বলেই কি এই অবজ্ঞার চিন্তা? শুধু বাঙালি কিংবা বাংলাদেশ সমাজ দিয়েই কি সব বিচার করা যায়? আর সেটাও যদি মেনে নেই, মানুষের মৌলিক যে প্রেষণা তারমধ্যে খাদ্য গ্রহণ প্রথম আর প্রধাণ। বাঙালি বাবুরা নিজেরা রান্না না করলেও, রান্না ঘরে সাহায্য না করলেও, ভাল-মন্দ খেতে তারা পেছান না এবং রান্না ভাল না হলে অসন্তুষ্টি জানান দিতেও ছাড়েন না। তাহলে এই নিয়ে আলোচনা কি করে অগুরুত্বপূর্ন হতে পারে! বিভিন্ন জেলার, বিভিন্ন মানুষ একসাথে হয়, অনেকেই অনেক কিছু আলাদা রকম ভাবে রেঁধে খায়, আবার অনেক কিছু যেমন এক পরিবারে খুব সাধারণ খাবার অন্য পরিবার সেটা জানেই না, নতুন কত কি জানা, শেখা হয়। অনেকেই আমরা দেশে থাকার সময় সেভাবে রান্নাবান্না করি নি, প্রবাসে এসেই শিখেছি তাদের জন্যে বড়দের কাছ থেকে কিংবা অন্যদের কাছ থেকে, নানা টেকনিক জানা তো আমার দৃষ্টিতে দারুণ সাহসের কাজ। খাবার ছাড়া যেকোন অনুষ্ঠান যেখানে অচল সেখানে এই নিয়ে আলোচনা উপহাসের বিষয় হতে পারে কি!

মেয়েরা শাড়ি-কাপড়, সাজগোজ নিয়ে মেতে থাকে। হ্যাল্লোওওও – কথায় আছে, প্রথমে দর্শনচারী তারপরে গুনবিচারী, লুক মানুষের খুবই একটা জরুরী ব্যাপার। এই সমাজের প্রত্যেক জায়গায় মানুষের সাজ-পোষাক দিয়ে তার সামাজিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধার্মিক অবস্থান সম্পর্কেও একটা ধারনা করা হয়ে থাকে। এবং ধারনা খুব কমই ভুল প্রতীয়মান হয়। ইউরোপের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ড্রেস কোড দেয়া থাকে। অফিসের মীটিং, পার্টি, বিজনেস ট্যুরের মেইলে, ড্রেস কোড উল্লেখ থাকে। বলতে পারেন, ঘরোয়া আড্ডায় এটা নিয়ে আলোচনা করার কি আছে? অবশ্যই আছে, আলোচনা না হলে, একজন আর একজন থেকে শিখবে কিভাবে? বিশাল একটা ইন্ড্রাষ্ট্রি দুনিয়া জোড়া কাজ করছে, ব্যাপারটি কি এতই হেলাফেলার? কত ডিজাইনার, কত ইনভেসমেন্ট। আর এটা নিয়ে সমালোচনা না করে বরং এভাবে দেখা যেতে পারে, পুরুষরা নিজেরাও এ নিয়ে একটু সচেতন হোন, সুন্দর – সুবেশী মানুষ দেখতে সবারই ভাল লাগে, হোক সে নারী কিংবা পুরুষ।

লেখক রিচার্ড ওয়াটার্স বলেছেন, “It Takes a Village to Raise a Child”. একটা বাচ্চার বিভিন্ন বয়সের সাথে তার মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন চাহিদা ও সমস্যা মোকাবেলা করে তাকে স্কুল, বাড়ি, বন্ধু বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সামলে বড় করে তোলা কি খুব সহজ ব্যাপার? বাচ্চাদের আচার আচরণ, খাদ্যভাস এগুলো নিয়ে পরিচিতদের মধ্যে আলোচনা, পরামর্শ নেয়া, আইডিয়ার আদান-প্রদান খুব স্বাভাবিক নয় কি? এখানে তো মা-শাশুড়ি কেউ পাশে নেই, বুদ্ধি পরামর্শ দেয়ার জন্যে। ছোট বাচ্চারা অনেক সময় অনেক কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না, ডাক্তারের কাছে সব এক্সপ্লেইন করা কঠিন সেসব ক্ষেত্রে স্বজনদের ছোট পরামর্শ তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। “বাচ্চা বড় করা” হেলাফেলার ব্যাপার কি এটা? এটা নিয়ে উন্নাসিকতা কিংবা তাচ্ছিল্য কি করে আসতে পারে? বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মায়েরাই যেহেতু দায়িত্ব নেয়, সিনসিয়িয়ারলি ব্যাপারগুলো পর্যবেক্ষণ করেন, সন্তানের মংগল কামনায় তারা অস্থির হতে পারেন বইকি।

জীবনের এই মৌলিক-পারিবারিক ব্যাপার গুলোই তো বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। ঘর-পরিবার হলো প্রতিটি মানুষের ভিত্তি। ভিত্তি নড়বড় করলে বাকি কাজ চলবে কি করে? সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বরং বলতে হয়, পেট পুরে খাওয়ার পর আড্ডায় বসে, বিশ্বরাজনীতির এই আলোচনা ট্রাম্প আর পুতিন, হাসিনা-খালেদা, শফি হুজুর কিংবা ক্রিকেট খানিকটা মুখে মুখে রাজা-উজির মারা অথবা গুলতানি করার মতই নয় কি? (নো অফেন্স মেন্ট টু এনিওয়ান) পৃথিবীর কোন প্রান্তের লিভিং রুমে বসে ভরপেট খেয়ে পিয়ে কারা কি নিয়ে আলোচনা করছে তাতে কোন দেশের রাজনীতি কবে বদলেছে নাকি বদলায়? কিংবা ফেসবুকে লিখলামই খুব জ্বালাময়ী কিছু আর তাতে? আনপ্রোডাক্টিভ ইস্যু কোন গুলো সেগুলো এখন বিশ্লেষণ করা সময়ের দাবী নয় কি? রকবাজি আর কদিন!

আমার দৃষ্টিতে আড্ডা ব্যাপারটার “বিষয়বস্তু” নির্ভর করে অনেকটাই জীবনের কোন পর্যায়ে আছি আর কোন পরিস্থিতিতে আছি তার ওপর। যারা নতুন আসে, সেটেলিং ডাউন পজিশনে থাকে তাদের আড্ডার বিষয় থাকে বেশির ভাগ, বাড়ি কেনা, কোন কোম্পানীতে সেকেন্ডারি বেনেফিট কি কি আছে তার খোঁজ আর হিসেব-নিকেশ করা, নেদারল্যান্ডসে যেহেতু বেশিরভাগ এক্সপার্ট ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষকেই বেতনের বায়ান্ন শতাংশ কর দিতে হয়, তার থেকে কি কি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির আলোচনা, বাংলাদেশি মাছ কোথায় পাওয়া যাবে, হালাল মাংসের দোকান, মসজিদ, কোথায় রোজকার দিন যাপনের জিনিসগুলো একটু সস্তায় পাওয়া যাবে (বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে আসামাত্র এক ইউরো=প্রায় নব্বই থেকে একশো টাকার পার্থক্য) ভাষা শিক্ষা কিংবা ভাষা সমস্যা ইত্যাদি। একসময় কাগজপত্র ছাড়া ইউরোপে এসে কাগজ বানানোর একটা স্ট্রাগল ছিলো, সে ব্যাপারটা এখন অনেকটাই কমে গেছে তাই সে প্রসঙ্গ বাদ।

বয়স আর একটু বাড়লে এরপরের ধাপে থাকে, কেনা বাড়িতে কি কি ধরনের কাজ করানো হবে, সেই কাজের জন্যে কোথায় কাকে পাওয়া যাবে সেসব নিয়ে আলোচনা, এর মধ্যে ট্যাক্স দিতে দিতে যেহেতু অভ্যস্ত হয়ে যায়, সেই ব্যথা কিছু তখন কমে আসে, জিনিসপত্রের দামের সাথেও এডজাস্ট করে ফেলে নিজেকে সেই প্রসঙ্গ ও আর আর্কষনীয় নয়, বরং দেশীয় খাবার দাবার মিস করাটা বেড়ে যায়। বাচ্চাদের প্রি-স্কুল, স্কুল ইত্যাদি নিয়ে কিছু তত্ত্ব ও তথ্যের আদান প্রদান। আগে সস্তায় দেশে ফোন করা, বাবা-মাকে বেড়াতে নিয়ে আসার ভিসা প্রসিডিউর, বাংলাদেশে টাকা পাঠানোর সহজ ও সস্তা উপায়, সুপারমার্কেটে কোন জিনিসটা কি নামে পাওয়া যাবে এসবও আলোচনায় আসতো। এখন ওয়েব সাইট আর গুগল ট্রান্সলেশনের কারণে এই আলোচনাটা কমে এসেছে।

অনেক বড় অনুষ্ঠান হলে আলাদা কথা কিন্তু ছোট ঘরোয়া আড্ডায় ছেলেরা- মেয়েরা সবাই এক সাথেই বসি, আজকাল অনেক ছেলেই নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করতে ভালবাসে, আড্ডায় তাদের নিজেদের তৈরী করা ডিশ আসে, রান্নার রেসিপি ও ট্রিক এন্ড টিপস নিয়ে আলোচনা হয়, যারা ড্রিঙ্কস ভালবাসে সে নিয়েও আলোচনা হয়, মুভি লাভাররা এক সাথে সিনেমা দেখা হয় কিংবা নাটক, অনেক সময় বিভিন্ন রকম গেম খেলি, অনেকেরই হবি ফটোগ্রাফি, সেই নিয়ে গল্প হয়, অবশ্যই প্রফেশনাল লাইফের নানা ঝঞ্ঝাট, প্রমোশন, সুবিধা-অসুবিধা সব নিয়ে আলাপ চলে, অনেকেই বাড়ি বড় করার নানা প্ল্যানিং বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে, আইডিয়া দেয়-আইডিয়া নেয়, ইউরোপের একটা সুবিধা, তিন বা চারদিনের ছুটিতেও টুক করে গাড়ি নিয়ে পাশের দেশে বেড়াতে যাওয়া যায় সেসব নিয়ে গল্প আর এর ফাঁকে ফাঁকে গান এবং ডিস্কো তো আছেই। আর বাংলাদেশে যেহেতু কিছু না কিছু ঘটতেই থাকে তাই ধর্ম, রাজনীতি এসব কমন ফ্যাক্টর তো আলোচনাতে থাকেই। নেট ও ফেসবুকের কারণে আজকাল এগুলো মেয়েদের খুবই হাতের নাগালের ব্যাপার, তাই আলোচনা কিংবা তর্কে তাদের পিছিয়ে থাকার কোন কারণ তো নেই!

আড্ডা আলোচনা ব্যাপারটা যেহেতু খুবই পারিপ্বার্শিক আর পারস্পরিক বোঝাপরার মধ্যে পরে, সুতরাং মেয়েরা কি নিয়ে আলোচনা করে কিংবা করে না’র ছকে ফেলে দেয়াটা আজকের প্রেক্ষাপটে হয়ত আর বাস্তবসম্মত নয়। আজকাল বেশির ভাগ মেয়েরই নিজের ক্যারিয়ার আছে এই প্রবাসেও। এই আধুনিক সমাজ কাঠামোতে বেশির ভাগ বাঙালি মেয়েই যেহেতু সারাদিন, “জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ” পেরিয়ে আসে, তাদের লাজুকলতা হয়ে আড্ডায় পিছিয়ে থাকার কোন কারণ তো নেই। বরং মেয়েরা সাহসী, বাস্তববাদী, যেসব ক্লান্তিকর, ক্লিশে, একঘেয়ে ব্যাপার থেকে ছেলেরা সারাবেলা পালাতে চায়, মেয়েরা বিনোদনের মুহূর্তেও তার থেকে পিছপা হয় না, সেটাকে প্যারালাল রেখেই আড্ডা, আনন্দ চালিয়ে যায় কিংবা তার মধ্যে থেকেই আনন্দ খুঁজে নেয়।

…………
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা ৭৭তম আসর।

One Response

Leave a Comment