খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধশিক্ষামূলক

(নাসিরের বিয়ে নিয়ে) পাড়া-পড়শীর ঘুম কেন নাই?

লিখেছেনঃ দূরের পাখি

অতি উচ্চমাত্রার বামপন্থী, উত্তরাধুনিক, নৈরাজ্যবাদী কোনো এক দার্শনিক বলে গেছেন, “ব্যক্তিগত সমস্তকিছুই রাজনৈতিক”। ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা ঠিক কোন ধরনের চিত্রকল্প মাথায় রেখে এই বাণী দিয়ে গেছেন তা জানি না, তবে আমার মাথার মধ্যে এই বাক্য তৈরি করে সম্ভবত দার্শনিকের চিন্তার সম্পূর্ণ বাইরের আরেকটি চিত্রকল্প। ঢাকার বস্তির। না, বস্তির আলাপ , প্রান্তিক-এমনিতেই সম্মানহীন লোকজনের দুর্দশা ও যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে নিজের উঁচুজাত প্রদর্শনের জন্য পাড়ছি না। প্রথমত, কেবল মানুষের মধ্যেই নয় কোনোরুপ জীবনরুপের মধ্যেই অন্তর্গত উঁচু নীচু সম্মানের ধারণা হাস্যকর। দ্বিতীয়ত, নিজের শৈশব কৈশোরের একটা অংশও ওখানে কেটেছে। এটা ঠিক যে প্রথম নব্বইয়ের দিকের ঢাকার অন্যসব কিছুর মতোই বস্তিও এখনকার পোস্ট-এপোক্যালিপটিক-ডিসটোপিয়ান ঢাকার তুলনায় অনেকখানিই রোমান্টিক, অনেকখানিই গোছানো, অনেকখানি স্বপ্নময় ছিল। নব্বইয়ের সেই স্বপ্নালু দশকের কিশোর হিসাবে বরং একটু আদিখ্যেতা একটু নস্টালজিয়া নিয়ে বলতেই পারি যে সে-সময়ের বস্তি ধরনের পাড়া মহল্লাগুলোর যা অবস্থা ছিল তা এখনকার পোস্ট-এপোক্যালিপটিক-ডিস্টোপিয়ান ঢাকার বস্তির জনসাধারণের দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বা ভালো পরিবেশে যাওয়া নিয়ে যে স্বপ্ন অনেকটা তারই ছবি। আর পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক ঢাকার আনাচে কানাচে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটির অভিজ্ঞতা থেকে আরেকটু বাড়িয়ে বলা যায় এই ঢাকার উঁচু জাতের মধ্যবিত্তের যে বাঁচার ও জীবনধারণের পরিবেশ তার তুলনায় নব্বইয়ের স্বপ্নালু দশকের বস্তির পরিবেশ ও চারদিকের মানুষের মানবিকতা ও নৈতিক উৎকর্ষ অনেকখানিই উন্নত ছিল।

তবে কী ‘বস্তি’ বা ম্যানশন মূলত যতখানি ভৌত বাস্তবতা ও পরিবেশের বিষয়, তার চাইতে অনেক বেশি হচ্ছে মানসিক ও জীবনগত অবস্থার। সেই অবস্থার অনেকখানিই ঐ উত্তরাধুনিক বিপ্লবীর, ‘ব্যক্তিগত সমস্তই রাজনৈতিক’, এইটুকু কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায়। ঘটনা হচ্ছে জীবিকার তাড়না ও উন্নত জীবনের সন্ধানে গ্রামগুলো থেকে মানুষ যখন শহরে জড়ো হয় এবং অপরিচিত ও রক্তের সম্পর্কহীন অনেকগুলো মানুষের সাথে একসাথে ‘ব্যক্তিগত’ ভাগাভাগি করে বাস করতে বাধ্য হয়, তখন এ নতুন বাস্তবতার সাথে মানসিক বোঝাপড়ায় আসতে একেক ধাতের মানুষের একেক রকমের সময়ের দরকার হয়। কেউ কেউ আসার দ্বিতীয় দিন থেকেই পাশের ঘরের মানুষের আজ কী রান্না হলো, ভাইয়ে কী করেন, এইসব আলাপে চলে যেতে পারেন, কেউ কেউ সেই পর্যায়ে যেতে তিন মাস অথবা তিন বছর সময় নেন। গ্রামের জৈবিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে রক্তসম্পর্ক্তিত আত্নীয়দের মধ্যে এ ধরনের লেনাদেনা ও বোঝাপড়া তার সমস্ত সৌন্দর্য্য এবং ভিতরের সমস্ত কদর্যতা নিয়েই মানবিক, এই অর্থে যে মানব-জীবনরূপের অবশ্যাম্ভাবী বৈশিষ্ট্য এটাই। লাখ লাখ বছর আগের শিকারী-সংগ্রাহক পর্যায় থেকেই। মানুষের যা অভিযোজন ক্ষমতা তাতে রক্তে অপরিচিত কিন্তু নৈকট্যে একেবারে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলা মানুষের সাথেও গ্রামের মতোই দৈনন্দিন আচারে চলে যেতে পারে বেশিরভাগ মানুষই। পাশের ঘরে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে অসহায় বোধ করা শিশুসন্তানদের গোসল করে খাইয়ে সময়মতো স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন অনেকেই, ঠিক গ্রামের ভাইয়ের ঘরের বা চাচাত ভাইয়ের ঘরের গৃহবিদ্রোহে যেরকম, ওরকম করে।

ঝামেলা হলো বাংলাদেশে তথা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ একসময় ছোটছোট অজস্র প্রিন্সলি স্টেইটে বিভক্ত ছিল। মোঘলরা বা ব্রিটিশরা যারাই কেন্দ্রীয় একটা শাসনব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তারা মূলত এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র রাজ্যগুলোকে বিদ্যমান কাঠামোতে রেখেই শুধুমাত্র রাজার কোষাগার থেকে বাৎসরিক খাজনার দায় চাপিয়ে দিয়েই নিজেদের সাম্রাজ্য বানিয়েছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জগদ্দল থেকে মুক্ত হওয়ার আগে যখন এইসব রাজাদের সবাইকে ‘‌আজ থেকে আপনারা সাধারণ মানুষ’ বলে দেয়া হলো, তখন পাতৌদির সেই নরকের কীট ছাড়া বাকি কোটি কোটি রাজা উজির নাজির প্রথমবারের মতো একসাথে সাধারণ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেন। এই পটভূমিকার কারণে নব্বইয়ের সেই স্বপ্নালু দশকে এবং সম্ভবত এখনকার পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক-ডিস্টোপিয়ান ঢাকাতেও প্রতিটি বস্তিতেই দু’ঘর পরপর একজন প্রাক্তন রাজা, একজন নবাব, একজন সম্রাট, কাইযার, যার, ডিউক, ডাচেস, ব্যারন, ব্যারনেস, ফুয়েরার অথবা তার প্রথম ওয়ারিশ বসবাস করতেন, করেন। এদের জীবিকার উপায় বা জীবনধারণের মান যতটাই করুণ বা কদর্য হোক না কেনো ভিতরের রাজসিক রুচি ও সিলসিলার কথা প্রায় প্রতিটি মুহুর্তে চারপাশের লোকজনের যেন ভাবনা থেকে দূরে সরে না যায়, এ নিয়ে তারা যথেষ্ঠ সোচ্চার ছিলেন। ফলতঃ আমাদের নীচুজাত যেমন সহজে পাশের ঘরের তরকারি হকারের ছেলের সাথে গলাগলি ধরে আইসক্রিম খেতে পারতাম , বা অন্যের ঘরের বৈবাহিক কোন্দলে দুই পক্ষের মাঝে সহিংসতা যাতে না ছড়ায় তার জন্য দুইপক্ষকে দুইদিকে টেনে নিয়ে যেতে পারতাম, কাইযার ফুয়েরারদের তস্য ওয়ারিশগণ সেটা পারতেন না। তাদের বর্ণ-গোত্র ও ডিউকডোম-ব্যারনডোম তাতে খসে পড়তো। তাদের তৃতীয় প্রজন্মের বালক-বালিকারা লুকিয়ে আমাদের সাথে মিশতো বটে, তবে অনেকখানি ঝুঁকি মাথায় নিয়েই।

ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অভুতপূর্ব বিস্ফোরণের মধ্যে সত্যিকারের নতুনত্বের কিছু আমি দেখি না, কারণ এই মাধ্যম মূলত শৈশবের এবং এখনকার পোস্ট-এপোক্যালিপ্টিক ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলেরই একটা ইলেক্ট্রনিক রূপ। এখানেও তাই দুদিন পরপর ঘরে ঘরের নানান একান্ত ‘ব্যক্তিগত’ সার্বজনীন ‘রাজনৈতিক’ হয়ে ভেসে আসে ওয়ালে ওয়ালে। এবং অবশ্যাম্ভাবীভাবেই দুই পক্ষের কোনো না কোনো একটার সাথে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও আবেগীয় সংযোগ বোধ করে যথাযথ পক্ষের হয়ে দাঁড়িয়ে যায় প্রচুরসংখ্যক মানুষ বা তাদের ইন্টারনেট অবতার। মুকুটের মাঝখানের জ্বলজ্বলে হীরার টুকরার মতো আর থাকেন নবাব, মহারাজা, সম্রাট, কাইযার, ফুয়েরার, এডমিরাল জেনারেল ও তস্য উচ্চ-রুচিসম্পন্ন ওয়ারিসগন। এসব ওয়ারিশরা অন্যের ব্যক্তিগত নিয়ে ছোটজাতের লোকজনের এই আগ্রহ ও আদিখ্যেতায় তীব্র বিরক্ত হন। অত্যন্ত তীব্র নির্লিপ্ততার সাথে এরা বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকেন যে এ ধরনের নীচু বিষয় নিয়ে কথা বলা ও এতে সংযুক্ত হওয়া কি পরিমাণ কদর্য ও ছোটলোকি একটি ব্যপার। তীব্র নির্মোহ ও বিরক্তি নিয়ে এরা বারবার প্রশ্ন করে যেতে থাকেন অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে ছোটজাতের এত আগ্রহ কেনো?

জীববিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে কিছু ভয়ংকরা অল্পবিদ্যার কারণে আমার মনে হচ্ছে তাদের এই কঠোর পরিশ্রমসাধ্য নির্মোহ প্রশ্নের একটা নির্মোহ বৈজ্ঞানিক উত্তর দেয়ার চেষ্টা করা যায়। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যেও সবচে বিশাল যে সৌন্দর্য্য, অত্যন্ত সাধারণ দুএকটি স্বীকার্য বা প্রতিষ্ঠিত সূত্র দিয়ে কোটি কোটি একই ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া যায় যেভাবে, ঠিক সেভাবে এখানেও খুবই সাধারণ সর্বজনবিদিত দুইটা সাধারণ সূত্র থেকে মানুষের সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার কিছু জটিল ও বর্ণালী দিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করি। সূত্র দুইটা হচ্ছে ১- যেকোনো জীবের শারীরবৃত্তীয়, মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত সমস্ত কার্যকলাপের গভীরে একটাই উদ্দেশ্য, তার ভিতরে থাকা বংশগতির ধারকবাহক জিনগুলোকে কীভাবে সবচে বেশি সংখ্যায় প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া যায়। ২ – মানুষের লাখ লাখ বছরের বিবর্তনী ইতিহাসের নিরানব্বই শতাংশেরও বেশি সময় মানুষ কাটিয়েছে এমন পরিবেশ ও প্রতিপার্শের মধ্যে, যেখানে তার চারপাশের সব মানুষই তার জিন-সম্পর্কীয় আত্নীয়। আমাদের কিছু কিছু নগরের কয়েক শতাব্দী বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক সহস্রাব্দের ইতিহাস থাকার কারণে দ্বিতীয় মূলনীতিটি মানতে একটু দ্বিধা থাকতে পারে। কিন্তু শতাব্দ বা সহস্রাব্দ নামের সময় পরিক্রমাগুলো মানুষের ব্যক্তিজীবনের তুলনায় অনেকখানি দীর্ঘ হলেও পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের সময় পরিক্রমার তুলনায় এগুলো খুবই খুবই সংক্ষিপ্ত একটা পর্যায় ছাড়া কিছুই না। তার উপর নগরের বিকাশ শুরু হওয়ার পরেও মানুষের জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ এখনো গ্রামেই বসবাস করে যেখানে জিনগতভাবে আদতে প্রাচীন পৃথিবীর তুলনায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি। আমার নিজের যে গ্রামে জন্ম ও শৈশব কেটেছে সেখানে আশেপাশের এমন কোনো বাড়ী ছিল না যে বাড়ীর মানুষ কোনো না কোনোভাবে বাবার অথবা মায়ের দিক থেকে জিন-সম্পর্কিত নয়। গ্রামের অবস্থা এখনো সেরকমই আছে। অন্যান্য কিছু কিছু প্রাণী যেমন রাসায়নিক বা ভৌত কোনো না কোনো একটা চিহ্ন দিয়ে নিজের জিন-সম্পর্কিত ও অসম্পর্কিত সনাক্ত করতে পারে, মানুষের মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্য নেই। একারণে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও শারীরবৃত্ত তার জিন-সম্পর্কিত ও অসম্পর্কিতদের পার্থক্য করে ভৌত নৈকট্য দিয়েই। অর্থাৎ কাছাকাছি বসবাস করছে এমন ধরনের মানুষকে মানুষের মনস্তত্ত্ব ও শারীরবৃত্ত অবচেতনে নিজের জিন-সম্পর্কীয় আত্নীয় হিসাবেই দেখে।

প্রথম মূলনীতিটি যদি মানতে না পারেন তাহলে এই আলোচনা আপনার জন্য নয়। মূলত জীববিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান বিষয়গুলোই আপনার জন্য নয়। দ্বিতীয় মূলনীতিটি কাঠামোবদ্ধ পরীক্ষা থেকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে অনেকবার প্রমাণ করা হয়েছে। কিব্বুতজিম পরীক্ষণ, ইনসেস্ট বিষয়ক উপাত্ত, সৎ বাবা-মা সংক্রান্ত গবেষণা এরকম অনেক ক্ষেত্রে। সেগুলো অন্য বিষয়ের আলোচনা। বর্তমান ক্ষেত্রে ‘তামিমার বিয়া নিয়া পাড়া-পড়শির কেনো ঘুম নাই’ তার সুলুক সন্ধান উপরের দুইটি মূলনীতি থেকে প্রবাহিত চিন্তাস্রোত দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক।

এখন প্রথম মূলনীতি অনুযায়ী অন্যান্য সব জীবের মতো মানুষকেও তার ভিতরের জিনগুলো চালিত করবে এমনসব মানসিক অবস্থা, এমনসব আচরণ ও এমনসব ঝোঁকের দিকে যাতে সেসব জিনগুলো সম্ভাব্য সর্বোচ্চ পরিমাণে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর অবশ্যাম্ভাবী ফলাফল হচ্ছে মানুষ চাইবে বেশি সংখ্যক সন্তান উৎপাদন করতে ও উৎপাদিত সন্তানদের মধ্যে সম্ভাব্য সবচে বেশি সংখ্যককে প্রজনন উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত আগলে রাখতে ও বড় করতে। আধুনিক মানুষের নানান রকম সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও দার্শনিক ভারী ভারী প্যাঁচালের মধ্যেও এই প্রবণতা এখনো খুবই কাঁচা খুবই নগ্নভাবেই দেখা যায়। হোমো স্যাপিয়েন্সের ক্ষেত্রে যেহেতু নারী-পুরুষের মধ্যে প্রজনন সম্পর্কিত যন্ত্রপাতির পার্থক্য আছে যে কারণে সন্তান উৎপাদনে নারী ও পুরুষের নেয়া ঝুঁকি ও ঝুঁকি থেকে প্রাপ্ত জেনেটিক লাভের পার্থক্য আছে সেহেতু অবশ্যাম্ভাবীভাবেই নারী ও পুরুষের প্রজনন কর্মপদ্ধতিতে পার্থক্য তৈরি হয়। কর্মপদ্ধতির এ পার্থক্য থেকে যে আচরণটি সবচে দৃষ্টিগোচর হয় তা হচ্ছে হোমো-স্যাপিয়েন্সের পুরুষ চায় অধিক সংখ্যক নারীর কাছ থেকে প্রজনন সুবিধা, তাতে কম দায়িত্ব নিয়ে বেশি সংখ্যায় নিজের জিন ছড়িয়ে দেয়া যায়। অন্যদিকে নারী চায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গুনসম্পন্ন পুরুষের সাথে প্রজনন করতে যাতে তার সীমিত সুযোগের মধ্যে সবচে বেশি পরিমাণে সন্তান উৎপাদন এবং সেগুলোও যাতে পরবর্তী প্রজন্মে গিয়ে প্রজনন সাফল্য পেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। মানুষের শিশুকে যেহেতু অন্যান্য বেশিরভাগ প্রাণীর তুলনায় দীর্ঘ সময় ধরে দেখাশোনা করতে হয় এবং প্রজনন বয়স পর্যন্ত সফলভাবে নিয়ে যেতে অনেক বেশি পরিমাণের বিনিয়োগ করতে হয় সেহেতু কেবল জন্ম দিয়ে চলে যাওয়ার কর্মপদ্ধতিও পুরুষের জন্য খুব একটা বেশি সুবিধা দিতে পারে না। এজন্য পুরুষকে নিজের জিনগত কর্মপদ্ধতি একটু সংস্কার করে থিতু হওয়ার পরিকল্পনাও নিতে হয় অন্যদিকে নারীকেও জিনগত বৈশিষ্ট্যে সবচে লোভনীয় পুরুষ ছেড়ে সামাজিক অর্থনৈতিক অন্যান্য দিকও বিবেচনায় নিতে হয় প্রজননের জন্য অন্য অর্ধেক খুঁজতে গিয়ে। এই দুই দিকের টানাপোড়েনে মানুষের হযবরল প্রজনন ব্যবস্থায় তৈরি হয় অনেক ধরনের উদ্ভট, প্রায় অকল্পনীয়, বর্ণীল আচরণ। সেগুলোর আলাদা আলাদা অনেক ব্যাখ্যা থাকবে তবে বর্তমান আলোচনায় যেটুকু নির্যাস নেয়া যায় তা হচ্ছে সব রকমের কর্মপদ্ধতি ও সব রকমের আচরণের গভীর স্রোত মূলত একটা ঝর্ণা থেকেই প্রবাহিত। সেটা হচ্ছে নিজের বহন করা জিনগুলোকে কীভাবে সর্বোচ্চ সংখ্যায় ছড়িয়ে দেয়া যায় সময়ের অক্ষে।

নারী-পুরুষ এবং তাদের আলাদা আলাদা জৈবিক বৈশিষ্ট্য ও প্রজনন-যন্ত্রপাতির কারণে তৈরি হওয়া আলাদা আলাদা মনস্তত্ত্ব ও শারীরবৃত্তের আচরণে দুই পক্ষেরই বেশি সংখ্যক ‘যোগ্য’ উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে মশগুল থাকতে গিয়ে আমরা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মপদ্ধতির কথা প্রায় ভুলেই যাই। যৌন প্রক্রিয়ায় প্রজনন করার কারণে মানুষের একটা সন্তান তার জিনের মাত্র অর্ধেক কপি বহন করে। বাকি অর্ধেক অন্য সঙ্গীর। হিসাব অনুযায়ী নিজের জিনগুলোর পুরো একটা কপি রেখে যেতে হলে সন্তান উৎপাদন করতে হবে কমপক্ষে দুইটি। চারটি হলে নিজের দুই কপি, ছয়টি হলে তিন কপি। সো অন এন্ড সো ফোর্থ। কিন্তু এই সরল পথ থেকে অন্যদিকের বাঁকা পথগুলোর কথাও ভাবা যাক, যেহেতু জৈবিক চাপ বা বিবর্তনীয় কার্যপদ্ধতি কেবল সরল পথেই চলতে হবে এমন কোনো অমোঘ সূত্র প্রকৃতি চাপিয়ে দেয়নি। আপনার বাবার সাথে আপনার জিনের মিল যেমন অর্ধেক, তেমনি আপনার ভাইয়ের সাথেও অর্ধেক, বোনের সাথেও অর্ধেক (বাবার যে আধা আপনার তার অর্ধেক + মায়ের যে আধা আপনার তার অর্ধেক , ১/৪ + ১/৪ = ১/২)। তার মানে হচ্ছে ভাইয়ের একটা সন্তান হলে তাতে নিজের জিনের চারভাগের একভাগ (ভাইয়ের মধ্যে নিজের যে আধা তার অর্ধেক) থাকবে। এত হিসাবের মানে গিয়ে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে যে নিজে অনেক খাটাখাটনি করে একটা সন্তান উৎপাদন করলে নিজের আধাকপি যেমন রেখে যাওয়া যায় একইভাবে নিজের ভাইয়ের অথবা বোনের দুইটা সন্তান হইলেও তাতে নিজের আধাকপি রেখে যাওয়া হয়। এখন নিজের সন্তান উৎপাদন করতে গেলে তাতে প্রজনন সঙ্গী বাছাই করা, সেই প্রজনন সঙ্গীকে প্রলুব্ধ করা ও সন্তান উৎপাদনের পর তাকে লালন পালন করতে যে পরিমাণ ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে, তার চাইতে অনেক কম পরিশ্রমে, কেবল ভাইকে বা বোনকে বিয়া করিস না ক্যান, বিয়া করিস না ক্যান এই ঘ্যানঘ্যান চালিয়ে, বিয়ার পরে বাচ্চা নিস না ক্যান বাচ্চা নিস না ক্যান এই ঘ্যানঘ্যান চালিয়ে, জিনগত লাভের পুরোপুরিই অংশীদারীত্ব নেয়া যায়।

একই মূলনীতিতে নিজের সন্তানদের প্রজনন সঙ্গী খুঁজে নিতে চাপ দেয়া, প্রজনন সঙ্গী পাওয়ার পর বেশিসংখ্যক বাচ্চা নিতে চাপ দিয়ে , একইভাবে নিজের প্রজননযোগ্য সময় পার হয়ে যাবার পরেও নিজের জিনগত উত্তরসূরীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রবণতাও বিবর্তনের বাঁকা সূত্র মোতাবেক মানুষের মধ্যে চলে আসার কথা। আবার নিজের সরাসরি সন্তান বা ভাই-বোনের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের পর তাদের লালন-পালনের ক্ষেত্রে একেবারে নির্ভেজাল পুরোপুরি থাকা যায় না। সার্থকভাবে উৎপাদনশীল পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করতে গেলে সেখানেও কিছুটা সময়, শ্রম ও সম্পদের বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু আরেকটু দূরে যদি যাওয়া যায় , নিজের চাচাতো ভাই বা বোনের ক্ষেত্রে , তখন কি দেখা যায় ? বাবার সাথে নিজের জিনের মিল অর্ধেক। চাচার সাথে বাবার মিল অর্ধেক। অর্থাৎ চাচার সাথে নিজের মিল চারভাগের একভাগ। চাচাত ভাইয়ের সাথে চাচার মিল যেহেতু অর্ধেক, সেহেতু চাচাত ভাইয়ের সাথে নিজের মিল হচ্ছে আটভাগের একভাগ। সেই হিসাবে চাচাতো ভাই বা বোনের সন্তানের সাথে নিজের জিনের মিল হচ্ছে ষোলভাগের একভাগ। অর্থাৎ চাচাতো ভাই বা বোনের সন্তানদের মধ্যে নিজের জিনের কপি হচ্ছে ষোল ভাগের একভাগ। অর্থাৎ নিজের একটা সন্তান আর চাচাত ভাই বা বোনের আটটা সন্তান জিনগতভাবে সমান (১/১৬ x ৮ = ১/২)। একই হিসাব প্রযোজ্য খালাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাই বোনদের ক্ষেত্রেও। এসব প্রথম কাজিনদের সন্তানদের ক্ষেত্রে যেহেতু নিজের বিনিয়োগ নিজের ভাই বা বোনের সন্তানদের তুলনায় আরো অনেক কম, সেহেতু এখান থেকে প্রাপ্ত লাভের প্রায় পুরোটাই ফাও। লাভ বাড়াতে গেলে অবশ্য সন্তান উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবেও অনেক বেশি।

জিনগত উত্তরাধিকারের এইসব হিসাব আরো কয়েক ধাপ পরের আত্নীয়স্বজনের ক্ষেত্রেও পূংখানুপুঙ্খভাবে করা সম্ভব। W D Hamilton নামে এক জীববিজ্ঞানী এইসব হিসাব নিকেশ করে গেছেন অনেক আগেই। সুতরাং গাণিতিক হিসাবের পাঠ এতটুকু পর্যন্ত রেখেই এই হিসাব থেকে উদ্ভুত মানুষের আচরণগত ও মনস্তাত্ত্বিক ঘটনাগুলোতে যাওয়া যাক। এইসব হিসাব থেকে মোটাদাগে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে , জিনগত উত্তরাধিকার বাড়ানোর তাড়নায় মানুষ নিজে যেমন প্রজনন-সঙ্গী খুঁজতে উদ্বুদ্ধ হবে এবং সেসব সঙ্গীর সাথে সবচে কম বিনিয়োগ দিয়ে সবচে বেশি সংখ্যক নিজের কপি রেখে যেতে চাইবে, একই সাথে সাইড-বিজনেস হিসাবে নিজের সন্তান, নিজের চাচাতো-ফুপাতো-মামাতো-খালাতো ভাইবোন তাদের প্রজনন জীবন নিয়ে কি করছে, কীভাবে তাদের আরেকটু উদ্বুদ্ধ করা যায় সন্তান উৎপাদনে সেই চিন্তাও মানুষের মধ্যে সরাসরি জৈবিক তাড়না হিসাবেই থাকবে। এই মোটাদাগের বাইরেও মানুষের সামাজিক জীবনের আচরণ মিথস্ক্রিয়ার অনেক সূক্ষ্ণ ঘটনার বিশ্লেষণ দেয়া যায় এই মূলনীতি অনুযায়ী খুব চমৎকারভাবে। একটা হচ্ছে নিজের ভাই-বোন ও কাজিনদের সন্তান বিষয়ে মানুষের মধ্যে যে টান দেখা যায় তা নিয়ে। ভাতিজা-ভাতিঝি ভাগিনা-ভাগনিদের নিয়ে। দুইটা ভাতিজা/ভাতিঝি যেহেতু নিজের একটা পূত্র/কন্যার সমান এবং নিজের পূত্র-কন্যাকে যেমন সফলভাবে প্রজনন পর্যন্ত নিয়ে যেতে না পারলে বিনিয়োগ এবং লাভ পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়, একইভাবে ভাতিজা/ভাতিঝি ভাগিনা/ভাগনিকেও প্রজনন পর্যন্ত নিজে যাওয়ার চেষ্টা বা প্রবণতা থাকবে মানুষের মধ্যে। সেই প্রবণতা থেকেই তাদের প্রতি টান ও মায়া। এই টানের আরেকটু সূক্ষ্ণ দিকে গেলে দেখা যাবে পুরুষদের চাইতে নারীদের মধ্যে এই টান বেশি থাকবে। কারণ পুরুষ তাত্ত্বিকভাবে নিজের প্রজনন ক্ষমতা দিয়েই অসীমসংখ্যক নিজের জিনের কপি রেখে যেতে সক্ষম। তাত্ত্বিকভাবে। নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই পুরুষের চাইতে নারীর ক্ষেত্রে এইসব সেকেন্ডারি উৎসের গুরুত্ব জিনগতভাবে বেশি। আবার মানুষের নারীর গোপন ডিম্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে পুরুষ কখনোই নিজের সন্তান সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারে না জিনগতভাবে। দুইশটা সন্তানের কাগজে কলমে বাপ হয়েও দুইটার মধ্যেও নিজের জিনের কপি না থাকতে পারার সম্ভাবনা কম নয়। তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু নারীকে তার জিনগত উত্তরাধিকার থেকে ঠকানোর কোনো উপায় নাই। তার গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানের (সারোগেট বাদ দিয়ে) ক্ষেত্রে সে নিশ্চিত এর মধ্যে তার নিজের জিনের অর্ধেক কপি আছে। একই চিন্তাপ্রক্রিয়া প্রযোজ্য ভাইয়ের/পুরুষ কাজিনের, বোনের/নারী কাজিনের সন্তানদের ক্ষেত্রেও। ভাইয়ের দশটা সন্তানের সবগুলোই কোকিলায়িত হতে পারে, তাত্ত্বিকভাবে। কিন্তু বোনের সন্তান একটা হলেও সেটা নিশ্চিত। উল্টোদিকে আছে ভাইয়ের বা বোনের ছেলে নাকি মেয়ে সেই হিসাব। ছেলে হলে তাত্ত্বিকভাবে অসীমসংখ্যক পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যেতে পারার সম্ভাবনা থাকবে। মেয়ে হলে সেটা সীমিত কিন্তু আবার নিশ্চিতি বেশি। এই দুই উল্টোস্রোত থেকে হিসাব করলে পুরুষের ক্ষেত্রে মায়া বা টানের ক্রমান্বয় হবে এরকম সবচে বেশি ভাগিনার জন্য, দ্বিতীয় ভাগনির জন্য, তৃতীয় ভাতিজার জন্য, চতুর্থ ভাতিঝির জন্য। নারীর ক্ষেত্রে সবচে বেশি বোনের ছেলের জন্য, দ্বিতীয় বোনের মেয়ে, তৃতীয় ভাইয়ের ছেলে, চতুর্থ ভাইয়ের মেয়ে। স্বাভাবিকভাবে এই ক্রম মোটামুটি সঠিক মনে হলেও কোকিলায়নের ভয় আর সংখ্যার প্রাচুর্য নাকি সংখ্যার স্বল্পতা কিন্তু গর্ভের নিশ্চয়তা এই বিষয়ে মানুষে মানুষে প্রবণতার ভিন্নতার জন্য সবক্ষেত্রে সম্ভবত এই ক্রম ঠিক থাকবে না। কিন্তু যদি প্রচুর সংখ্যক মানুষ নিয়ে কোন ধরনের পরীক্ষণ ডিজাইন করা যায় গড়পড়তা সম্ভবত এই ক্রমই উঠে আসবে ফলাফল হিসাবে। বলাবাহুল্য একই ক্রম, একই প্রবণতা একইভাবে কিন্তু আরেকটু কম শক্তিমত্তার সাথে সাথে কাজিনদের সন্তানদের বেলায়।

একইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় ভাই/বোন কাজিনরা নিজেদের প্রজননসঙ্গী কীভাবে বাছাই করছে সেবিষয়ে ব্যক্তিমানুষের আগ্রহ ও নাক গলানোর বিষয়ে। নিজের প্রজনন সঙ্গী বাছাই করা নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন দেখা যায় , লাভ-ক্ষতির বিশ্বাস-অবিশ্বাসের হিসাব নিকেশ, সেগুলো হুবহু একইভাবে, নিজের চাইতে একটু কম মাত্রায় নিজের সন্তানদের ক্ষেত্রে, আরেকটু কমমাত্রায় ভাই-বোনদের ক্ষেত্রে, তার চাইতে একটু কম মাত্রায় কাজিনদের ক্ষেত্রে, আরো কম মাত্রায় আরেকটু দূর-সম্পর্কের কাজিনদের ক্ষেত্রে দেখা যাবে। কিন্তু মূলস্রোত সম্পূর্ণ একই। পুরুষের ক্ষেত্রে যেহেতু একটা একক সঙ্গী বাছাই করাই এন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড নয় কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে একটা সঙ্গীর সাথে একটা প্রজনন মোট সম্ভাব্য বিনিয়োগের একটা বিশাল অংশ, সেহেতু হোমো-স্যাপিয়েন্সের পুরুষদের মধ্যে সঙ্গী বাছাইয়ে গুনগত দিকের চাইতে সংখ্যাগত আধিক্য নিয়ে মনোযোগ বেশি থাকবে। নারীর মধ্যে থাকবে গুনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটু বেশি পরিমাণ মনোযোগ। একই সূত্রধরে ভাইয়ের নারী সঙ্গী কেমন হচ্ছে তার চাইতে বোন কাকে পুরুষ সঙ্গী হিসাবে বাছাই করছে এটা নিয়ে চিন্তা বেশি থাকবে নারী পুরুষ দুইয়ের ক্ষেত্রেই। একই ভাবে কাজিন এবং তৎপরবর্তী কাজিনদের ক্ষেত্রেও।

জিনগত নিকটাত্নীয়দের প্রজনন সঙ্গী বাছাই করা নিয়ে ব্যক্তিমানুষের অধিকার চর্চার আরেকটি সূক্ষ্ণ প্রবণোতার ব্যাখ্যা দেয়া খুব চমৎকার ভাবে এই একই মূলনীতি দিয়ে। পুরুষের ক্ষেত্রে জিনগত উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কোকিলায়নের ভয়। অর্থাৎ নারী প্রজনন সঙ্গীটি নিজের সম্পদ ও সময় ব্যবহার করে অন্যের প্লাস নিজের জিনগত উত্তরাধিকারকে লালন করে পুরুষটিকে বলদ বানিয়ে যাবে এই ভয়। একক ব্যক্তি পুরুষের ক্ষেত্রে এই ভয় যেমন তাকে সঙ্গীর সতীত্ব নিয়ে অত্যধিক মর্মোত্যাচার করে, ভাই বোন কাজিনদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য সমানভাবে। মাত্রায় ক্রমহ্রাসমান হলেও। অন্যদিকে নারী যেহেতু নিজের উত্তরাধিকার নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত সেহেতু তার বিচার ও মর্মোত্যাচারের মূল উৎস হচ্ছে সঙ্গী হিসাবে বাছাই করা পুরুষটি যথেষ্ঠ পরিমাণ ও যোগ্য ও সমর্থ কিনা পরবর্তী প্রজন্মের লালনে। এই হিসাবে ভাইয়ের নারী সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হোমো-স্যাপিয়েন্সের পুরুষ নাক গলাবে বউটি যথেষ্ঠ সতী কিনা , নারী পুরুষ দুইজনই। অন্যদিকে বোনের পুরুষ সঙ্গীটি যথেষ্ঠ যোগ্য এবং সামর্থ্যবান কিনা এই নিয়ে নাক গলাবে ব্যক্তি , নারী পুরুষ দুইজনই। একই প্রক্রিয়া একইভাবে মাত্রার ক্রমহ্রাসমানভাবে প্রযোজ্য হবে কাজিন এবং দূরবর্তী কাজিনদের ক্ষেত্রেও।

মানুষের আরেকটি চমকপ্রদ প্রজনন আচরনের ব্যাখ্যা দিয়ে এই আলোচনার ধারা শেষ করা যাক। মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন তার নিজের যখন প্রজনন বয়স শেষ হয়ে যায় একই ভাবে তার সন্তানদের তার কাজিনদের এবং কাজিনদের সন্তানদেরও প্রজনন বয়স বা প্রজনন সঙ্গী যাচাই-বাছাইয়ের সময় শেষ হয়ে যায় তখন তার সরাসরি বা দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রায় জিনগত উত্তরাধিকার আছে এমন কারো বিষয়ে তার আর করার কিছু থাকে না। কিন্তু এরকম সময়েও তার বৃহত্তর সমাজের মধ্যের প্রজনন বয়সের লোকজন সবই মূলত কোনো না কোনো লতায় পাতায় তার নিজেরই জিনগত উত্তরাধিকার বহন করে চলছে। এমন বয়সে গিয়ে নিজের জিনগত উত্তরাধিকার বাড়ানোর আর কোনো নিশ্চিত কাছাকাছি উপায় থাকে না। তখন মানুষ মূলত নতুন প্রজন্ম ঠিকমতো বিয়ে-শাদি করে সন্তান উৎপাদনে নিযুক্ত হচ্ছে কিনা এইটুকু নিশ্চিত করতেই লেগে যায়। কারণ তার নিজের জিনগত উত্তরাধিকারের হিসাব পাতলা হয়ে গেলেও তরুণ বয়সের সবাই মনোযোগের সাথে প্রজনন করলে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কোনো না কোনোভাবে তার জিনেরই একটা নতুন কপি তৈরি হবে। সেটা দুই হাজার নতুন শিশুর মধ্যে ভাগ করে হলেও।

প্রথম মূলনীতি থেকে পাওয়া মানুষের মনস্তত্ত্ব ও আচরণের সাথে এবার দ্বিতীয় মূলনীতির পাওয়া অনুস্বিদ্ধান্ত মেলানো যাক। মানুষ যেহেতু লাখ লাখ বছরের বিবর্তনীয় ইতিহাসের কারণে বসবাসের নৈকট্য আর ভৌত নৈকট্যকে , জিনগত নৈকট্যের সাথে আলাদা করতে পারে না , সেহেতু অবশ্যাম্ভাবীভাবেই কাছাকাছি বসবাস করা লোকজনের প্রজনন-সঙ্গী ও সন্তান লালন-পালন নিয়ে সে একই ধরনের আচরণ, একই ধরনের তুমুল আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখাবে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে এখন সেই ভৌত নৈকট্যও যেহেতু অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে, ভার্চুয়াল নৈকট্যকেই মানুষের শারীর-রসায়ন জিনগত নৈকট্য বলে ধরে নিচ্ছে। ফলতঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কার বিয়া, কার হাংগা, কার বাচ্চা হলো এই নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ ও উদ্দীপনা। সমস্তই জীব হিসাবে মানুষের জেনেটিক গড়নের ফল।

এই ধরনের লেখাতে বারবার একই কৈফিয়ত দিতে দিতে আমি ক্লান্ত। মানুষের উদ্ভট, অযাচিত, খ্যাতুড়ে অনেক অনেক আচরণের ব্যাখ্যাই তার জিনগত ও জৈবিক উত্তরাধিকার দিয়ে দেয়া যায়। এর মানে কোনোভাবেই সেইসব আচরণকে মানুষের সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক বিচারের বর্তমান পর্যায়ে এসে সমর্থন দেয়া নয়। যেমন মানুষের কেন শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাবার পছন্দ বেশি তার জীববিজ্ঞানগত ও বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা খুঁজার চেষ্টা কোনোভাবেই এই নয় যে সবাইকে নিজেদের শরীর স্বাস্থ্যের চিন্তা বাদ দিয়ে ইচ্ছামতো শর্করা আর চর্বি খেয়ে ফুল ঢোল হয়ে হার্ট এটাকে অল্পবয়সে মরে যাওয়ায় উৎসাহ দেয়া। আমার বরং আস্থা ঐদিকে যে মানুষ তার আচরণ ও প্রবণতার উৎসকে যতখানি নির্মোহ, যতখানি সত্যতার সাথে বুঝতে পারবে ততটাই খারাপ আচরণ খারাপ প্রবণতাকে প্রতিরোধ করার সামর্থ্য অর্জন করবে। অন্যের একান্ত ‘ব্যক্তিগত’ নিয়ে আমাদের স্বভাবজাত অযাচিত অনাকাঙ্ক্ষিত কদর্য আগ্রহ ও উদ্দীপনার চোরাস্রোতকে যত বুঝা যাবে ততই দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির পথে আমাদের আরেকটু অগ্রসর হওয়া হবে বলে মনে করি।

………..
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment