খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটোগল্পঃ মন পাথরের আস্তরণ

লিখেছেনঃ জাকিয়া সুলতানা মুক্তা

জাকিয়া সুলতানা মুক্তা

(১)

ধুলোর ঝড়ে গায়ে কয়েক প্রস্থ ময়লার স্তর জমেছে। গায়ে গায়ে লাগানো সার দেয়া সারিতে স্যাঁতস্যাঁতে ঘামের পুরু আস্তরণ। ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠা সাইকেলের শব্দ। পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে নারকেল গাছের দিগন্ত বিস্তৃত পাতারা। তারা ফিসফিসিয়ে ঝঙ্কার তোলে বাতাসে। আজকের দুপুরটা ভীষণ সুনসান, ঘুমন্ত কোমল। পাশের এবড়োখেবড়ো ইটের রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ পাড়ার লোকেদের আসা-যাওয়া। ঘরের ভেতরে টুং টাং থালা-বাটি গোছানোর আওয়াজ। বাড়ির সবার খাওয়া-দাওয়া এই বেলা সম্পন্ন।

অটোটা বেশ আচমকাই এসে থামল, বাড়ির কাছে। ইটের রাস্তা দেবে গিয়ে ধুলোয় ধূসরিত থাকে সারাপথ। পথে চলতে গিয়ে অটোর গায়েও ধুলোর কয়েক ধাপ প্রলেপ লেগেছে। বাহারি পোশাকের একজন নেমে এল ভেতর থেকে। সাথে মলিন পোশাকে আরও একজন। জানালার পর্দার ফাঁক গলে চোখে পড়ছে সবই। সদর দরোজার ওপাশ থেকে আরও ভেতরে অন্দরমহলের দিকে সঞ্জীবন মাকে ডেকে জানাল,

-মা, দাদার অফিসের ম্যানেজার সাহেব এসেছেন। বাড়ির সারাইয়ের কাজগুলো করানোর জন্য আসার কথা ছিল। সে ব্যাপারেই এসেছেন বোধ হয়।

দুপুর গড়ানো আলস্যে ফের ব্যস্ত উৎসাহ।

-আমি বেরুচ্ছি ওনাদের অভ্যর্থনা জানাতে। চা বসাতে বলো বিনিকে।

(২)

উঠোনজুড়ে রৌদ্রের খেলা। মৃদুমন্দ বাতাসে রোদজ্বলা দুপুর ফিকে হয়ে আসছে।

বিকেলের ঘনঘটা।

– আসতে কষ্ট হয়নি তো কোনো?

-না, না। সব ঠিকই ছিল। মাঝে রাস্তার কয়েকজনকে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করতে হয়েছে। ওনারা ঠিকঠাকই দেখিয়ে দিয়েছেন। তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি।

-দাদা কি সব বলেছেন? কী কী ঠিক করাতে চাচ্ছেন?

-বলেছেন। আপাতত ইট-বালির অনুমানটা নিয়ে যেতে বললেন। আজকে মাপ নিয়ে যাব, আগামীকাল ওসব সব চলে আসবে। কাজ সপ্তাহখানেকেই তোলা যাবে, যদি বৃষ্টি না আসে।

-দাদা বলছিলেন দুপুরের খাবার খেয়েই আসবেন। তবুও মা আপনাদের জন্য খাবারের আয়োজন করে রেখেছেন। টেবিল সাজাতে বলছি।

-না, না। উজ্জীবন স্যার আর আমি একসাথেই খেয়েছি। আপাতত কিছু খেতে চাই না।

-তবুও। এই প্রথম বাড়ি এলেন।

-পেটে এখন আর কিছু ঢোকানো সম্ভব না। খেয়েই বের হয়েছি। আসতে আর কতক্ষণ? চল্লিশ মিনিটেই চলে আসলাম।

-কিছু তো খাবেন?

-এখন আর খাব না। আরেকদিন।

-আচ্ছা, তাহলে আর জোর করছি না। চা খাবেন তো?

-হুম্মম! চা চলবে। চা খেতে অসুবিধা নাই।


(৩)

বাইরের ঘরে অতিথি আপ্যায়ন শেষে বাড়ির খোলা উঠোনে এসে দাঁড়াল সঞ্জীবন। ম্যানেজার বিল্টু সাহেব বুঝে নিলেন কোথায় কোথায় সারাইয়ের কাজ করতে হবে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে প্রয়োজনীয় অনুমানটুকু করতে বেশি বেগ পেতে হল না। কাজ তো খুব বেশি কিছু নয়। আপাতত বাড়ির বাইরের দিকের সীমানা প্রাচীর, অনুষ্ঠান শেষে মূলভবনের কাজে হাত দিতে হবে। তখন প্রকৌশলী নিয়ে এসে যাবতীয় কাজের হিসাব করে নিতে হবে। তাও তো পাঁচ-ছয় মাস পরের হিসাব।

বিষণ্ণ বিকেল নেমে এল চারপাশে। সময় গড়িয়ে গেল টিনের চালে জমে থাকা বৃষ্টির টুপটুপ ফোঁটার মতন। সন্ধ্যে নেমে অন্ধকার এল। রাতের জোনাক পোকারা নিশ্চয়ই সজাগ হয়েছে, তবে এই পথে আসে না তারা বহুদিন। প্রস্তর আর পাথরের ক্লান্ত চোখে বিষাদের ঘন আন্দোলন। তাদের মাঝে এইটুকু ফাঁক। শিশির জমেছে হৃদয়ে, ভাবনাগুলো জাগ্রত। এক লহমায় জীবন চলে গেল ত্রিশ বছর পেছনে। ভাঙা ইটের পথ থেকে একেবারে মেঠো পথের সীমানায়। এই ফাঁকা দূরত্বে প্রেম জমেছিল সেই সময়ে বিস্তর, প্রতিদিন।

(৪)

সাইকেলটা ঠিক এভাবেই দাঁড়ানো থাকত, ঠিক যেমন আজকে সকালেও ছিল। তবে তার মডেল ছিল ভিন্ন, আরোহীও বিভিন্ন। কিন্তু অনুভূতিগুলো?

আজ রাজেশের চাকরি নিশ্চিত হয়েছে। তাই সে বাড়ির অন্দরমুখী গতিতে ধাবমান। যদিও এ বাড়িতে বহুবার সে এসেছে, তবে বারবাড়িতে; সত্যটা হলো প্রাচীরের বাইরে এসেই থেমেছে।

আজকের আসাটা একেবারেই ভিন্ন। অথচ ঈপ্সিতার সাথে দেখা করতে, কতদিনই তো এই বাড়ির সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজিয়েছে সে। কিন্তু আজ আর বাজাল না। আজ সে ওর বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, ওকে তার ঘরের বৌ করে নিয়ে যেতে চায়। এখন তো আর তাতে উদয়ন কাকার অমত থাকবার কোনো কারণ নেই নিশ্চয়ই।


(৫)

ধুমধাম বিয়ের বাদ্যের মাঝেই এক ফাঁকে, ধোঁয়া খাবার বাতিক পেয়ে বসল রাজেশের। এসে দাঁড়াল উঠোনের একপাশের জারুল আর জামরুল গাছটার মাঝে। পাশাপাশি তিনটে মাঝারি আকৃতির নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে আগুনটা ধরাল রাজেশ। সিদ্ধান্তটা কি ঠিক হল? বাবা-মায়ের অমতে শুধু ঈপ্সিতাকে পাওয়ার জন্য, উদয়ন কাকার গোঁয়ার্তুমিতে; এ বাড়ির ঘরজামাই থাকতে রাজি হওয়া। বন্ধুরা কেউ খুশি হয়নি, বাবা-মা কাঁদছে, ভাইয়েরা ক্ষুব্ধ। কিন্তু এই মেঠোপথটা, এই মায়ায় জড়ানো প্রেমের বেড়াজাল তো তার জন্য অভেদ্য ছিল। বের তো সে হতে পারল না। অন্ধকারটাই কেবল আরও গভীর হয়ে নামল।

(৬)

বিনির বয়স এখন পঁচিশ। সামনেই ওর স্নাতকোত্তরের ফলাফল প্রকাশিত হবে। মেয়েকে নিয়ে ঈপ্সিতার অনেক চিন্তা। তার ছোটো ছেলে সঞ্জীবনের বৌ কয়েকদিন আগে বেশ রাগারাগি করল। বাড়িটার কী শ্রী করে রাখা! অন্তত বারবাড়িটার একটু সংস্কার তো করা যায়, এই তার অভিযোগ। সঞ্জীবনের উদাসীন জীবন-যাপন বৌয়ের নিতান্তই অপছন্দের। ওদিকে তারই বড়দা উজ্জীবন আর বৌদি থাকেন মূল শহরে, যদিও মফস্বলের শহর।
মফস্বলের যা হয়। চারপাশের পরিবেশ বেশ চাকচিক্যবিহীন, কিন্তু শান্ত সুনিবিড়। তবুও আধুনিকতার ছাপ প্রতিটি বাড়িতেই লেগেছে আজকাল। মূল শহর থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বের এই ভেতরের এলাকাতেও কম-বেশি অনেক পরিবর্তন এসেছে। কেবল আধুনিকতার কোনো ছাপ পড়েনি উদয়ন বিশ্বাসের আদি এই বাড়িতে। এই বাড়িতে তাদের কষ্ট করে থাকতে হয়। যদিও খুব যে আলিশান হয়েছে তেমনটাও নয়। তবুও আশেপাশের বাড়িগুলোর সীমানা প্রাচীর আর দালানের উচ্চতর বহরের কাছে ম্লান এই বাড়ি। বিশেষ করে দীর্ঘ হয়েছে প্রাচীর আর সঙ্গ কমেছে লোক থেকে লোকালয়ের। বিচ্ছিন্ন চারপাশ। যা দুদণ্ড খোলা হাওয়া, তা যেন জমাট বাঁধে এ বাড়ির উঠোনেই। তবুও যুগের তালে পিছিয়ে পরা বদ্ধ হাওয়াও আর যে ভালো লাগে না বৌমা প্রিসিলার, অন্যদেরও। অন্যদের তুলনায় তাদের সামর্থ্যও যদি কম থাকত, তবুও তারা মেনে নিতে পারত হয়তো। বড়দা তো ভালো ব্যবসা করছেন। সঞ্জীবন কেন পারে না? ইচ্ছেটাই যেন নেই। আদতে মায়ের অনিচ্ছাই তাকে পরিবর্তনের দিকে চালিত করে না। এই ক্ষোভের তুষেই প্রিসিলাসহ বড় বৌ সুস্মিনের নিত্য হুতাশ। প্রিসিলাই ক্ষুব্ধ বেশি, এটা বোঝে ঈপ্সিতা।

(৭)

জীবনসঙ্গী রাজেশের মৃত্যুর আজ পাঁচ বছর। সে চায়নি তাই আজতক ঈপ্সিতাও বাড়ির কোনো পরিবর্তন করতে দেয়নি। কিন্তু মেয়ের বিয়ের এই ঘনঘটায় তো তার উপর পরিবারের অপরাপর সদস্যদের চাপ বাড়ছে। এদিকে আজকাল বখাটেদের আনাগোনাও বেড়েছে এই পথে। বিনি ইদানীং বারবাড়িতে আসতেই চায় না। আগে কী সুন্দর বারবারান্দায় বসে মুড়ি মাখাত আর হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে সবার সাথে গল্পে মেতে উঠত! দিনগুলো সব আবছায়া মনে হয়। এমনকি রাতে মাঝেমধ্যে সীমানা প্রাচীরের আশেপাশে নাকি, নেশা-টেশা করার গন্ধও পেয়েছেন প্রতিবেশীদের কেউ কেউ। শোনা যাচ্ছে খুব শীঘ্রই এই রাস্তাটাও ঢালাইয়ের রাস্তা হয়ে যাবে, এমনই সিদ্ধান্ত প্রশাসনের।

রাতগুলো কেন এত নিষ্ঠুর? জ্যোৎস্নালোকিত এই রাতেও মনটা কেন এত উদগ্রীব? পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের সেই লুকোচুরি প্রেমের সময়টা! কেন আজ বারবার মনে পড়ছে তার? সীমানা প্রাচীরে তার প্রেমিকের রেখে যাওয়া প্রাচীরের ফাঁকে সেইসব চিরকুট। শুকনো নুড়ি পাথরে ঢাকা দেয়া চিঠিগুলো আর সাইকেলের টুংটাং ভালোবাসার আহ্বান।

(৮)

প্রস্তর আর পাথরের আজকের দিনটা কেমন যেন অন্যরকম। আশেপাশের সারি সারি দালান-কোটার ইট-সুড়কির পলেস্তারা দেয়া দেয়ালগুলোর উচ্চতা ছাপিয়ে, সেই পুরোনো দিনের মিষ্টি প্রেমগুলো আর শব্দে-নিশব্দে আসা-যাওয়ার পথে কোনোভাবেই ঢুকতে পারে না। তবে একসময়ে যেত। বালকসুলভ কত আম-জাম-নারকেল চুরির কৈশোরীয় আনন্দের সাক্ষী তারা। কত প্রেম আর অপ্রেমের হাসি-কান্নার জমাট আখ্যান, সংসারের মিলমিশ আর ঝগড়া-বিবাদের নীরব সাক্ষী। পথিকের ক্লান্ত চলার মাঝে পরিচিত হাসিখেলার অভিবাদন, আর পরক্ষণেই অভ্যর্থনার আহ্বান ভেতরবাড়ি থেকে। সবই তো তারা দেখেছে, শুনেছে একমনে, জেনেছে কত কথকতা নিরুত্তরে। সময় ক্ষয়েছে, ক্ষয়েছে তাদের গায়ের পলেস্তারাও। শুধু বাড়েনি দূরত্ব, শ্যাওলার ভালোবাসায় বুজেছে দুজনের ভেতরকার দূরত্ব। জীবন পেয়েছে নিত্য সবুজের প্রেম। আজ তাদের প্রাচীরে সঙ্গী বাড়ছে, গাঁথুনিতে বাড়ছে সামর্থ্য অন্যসব সীমানা প্রাচীরের দেয়ালের মতন। ইটের পর ইট বিছিয়ে বালির প্রলেপে বাধ বাড়ন্ত উর্ধ্বমুখে। জীবন থেকে জীবনের স্পন্দনে বাড়তে যাচ্ছে পার্থক্যের ডামাডোল। সক্ষমতার জোর বাড়ছে, প্রেমেও কি সমানতালে? দেয়াল বাড়ায় মুঠো মুঠো প্রেমের রুদ্ধতা এখন, পড়ায় শেকল সামাজিক পারস্পরিকতায়। আজ সেই বিরুদ্ধতার পক্ষেই তাদের শক্তি বাড়ছে। পুরোনো পলেস্তারা খসে পড়ে, প্রাণের শ্যাওলা সরিয়ে দিয়ে নতুনের আবাহন। দূরত্ব ঘুচে যাবে আজ বালির বাধে, স্বপ্নকথার ছন্দমাতাল শ্যাওলাবিহীন।

(৯)

ইটের পথ ঢালাই হবে, প্রাচীর হবে রাজসিক; প্রস্তর আর পাথরের সঙ্গী ইটেদের দেখা হবে বন্ধু নারকেল গাছের পাতাদের সঙ্গে। একসময় যখন তারা ছিল মাটির কাছাকাছি। কত কথা, কত ব্যাথায় পারস্পরিক নিথর দাঁড়িয়ে থেকেই পাশে আছে বুঝে নিত। আজ তো তারা মাথায় অনেক ওপরে, মাটি ছোঁয়া প্রস্তর আর পাথরের মাঝে প্রেমের চিরকুট এসেছে বহুবার, কিন্তু উঁচু দেয়ালের এই প্রাচীরে ঈস্পিত স্মৃতির পায়রা চিরকুট হবে কি আরবার? হাত ছুঁয়ে যে সে প্রাচীরের উচ্চতা স্পর্শে আসে না এখন আর। প্রস্তর আর পাথরের গায়ে রঙের আস্তর লেগেছে। ভেতরে নয়, গায়ে শ্যাওলা জমবে সামনের বর্ষায়। কিন্তু মেঠোপথের কোনো কিশোর ছেলে কোনো কিশোরীকে প্রেমের আহ্বান করবে না তাদের গা ছুঁয়ে, হবে না সেই দৃষ্টি বিনিময়। প্রাচীর উঠেছে ঊর্ধ্বমুখী, এই অপ্রেমের রাজ্য মেঘ ছোঁবে একদিন। হারাবে মাটির সোঁদা গন্ধ, প্রস্তর আর পাথরের হবে না কথা নারকেল পাতাদের সাথে। পাখি-ডাকা ভোরে প্রস্তর আর পাথরের ফাঁকে ঈপ্সিতার আর হাত বুলিয়ে যাওয়া হবে না হয়তো।

Leave a Comment