খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধরাজনীতি

ট্রাম্প, মোদি, জনসনদের বিজয় কি জনগণের বোকামী?

আমাদের পাঠচক্রের ৭৩তম আড্ডায় লিবারেলিজম ও কনজার্ভেটিজম নিয়ে কিছু মজাদার আলোচনা হয়েছে। এখানে যা লেখা হয়েছে, পুরোটা এভাবে হুবহু আলোচনায় আসেনি। সামান্য কিছু আমি সংযোজন করেছি।

কনজার্ভেটিভিজম ও লিবারেলিজমের মূল পার্থক্য হলো, লিবারেলিজম মনে করে মানুষ সমাজ বা গোত্র যেখানেই বাস করুক সে আসলে ইন্ডিভিজুয়াল, আর কনজার্ভেটিজম মনে করে মানুষ সামাজিক প্রাণী, তাই ব্যক্তির আগে সমাজ বা গোত্রকে স্থান দিতে হবে।

এ দুটির আরেকটি পার্থক্য হলো, লিবারেলিজম মনে করে মানুষ ‘ফেরেশতা’; কিছু ব্যক্তি মানুষ বা সমাজ তাকে খারাপ পথে পরিচালনা করে। ওদিকে কনজার্ভেটিজম মনে করে মানুষ আসলে ‘শয়তান’ (অন্য প্রাণীদের মতই হিংস্র), সমাজ/গোত্রের নিয়ম/কানুন তাকে ভাল পথে পরিচালনা করে।

সমস্যার কথা হলো, আমরা যতই লিবারেল হওয়ার চিন্তা করি না কেন নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক এবং অধুনা জীববৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে জৈবিক মানুষের ক্ষেত্রে কনজার্ভেটিভরাই ঠিক কথা বলছে। মানুষ ফেরেশতাও নয়, ইন্ডিভিজুয়ালও নয়। প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ আলাদা বটে, কিন্তু সে যা করে তা মূলত সমাজে বা নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে তার পদ, অবস্থান, সম্মান, ইত্যাদির আশায়। ফলে মানুষ পুরোপুরি লিবারেল হতে পারে না; তার ভিতর দেশ, রাষ্ট্র, ভাষা, ধর্ম, ইত্যাদি ফিরে ফিরে আসে এবং মানুষ বিভাজিত হয়।

লিবারেলিজমের আরেকটা সমস্যা হলো, এটি যে ‘ব্লাংক স্লেট’ তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটি এখন বাতিলের খাতায় চলে গেলেও তারা এটিকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতে চাইছে। এই তত্ত্ব মতে প্রতিটি শিশু শূন্য জ্ঞান নিয়ে জন্মায়, তারপর পরিবেশ থেকে যে শিক্ষা পায়, তার ওপর ভিত্তি করেই সে ব্যক্তি মানুষ হয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তি মানুষের অপরাধের দায় সে যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছে সেই সমাজের। এজন্যই তারা মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করে, কঠিন শাস্তির বিরোধিতা করে, অপরাধীর পূনর্বাসনে বিশ্বাস করে।

সত্যি বলতে ব্লাঙ্ক স্লেট তত্ত্ব সমাজ থেকে লিঙ্গ বৈষম্য ও রেসিজমের মত সমস্যা দূর করতে বড় ধরণের সাহায্য করেছে। কিন্তু এই তত্ত্ব এখন আর বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য কোন তত্ত্ব নয়। কিন্তু লিবারেলিজম মনে করে ওটি হারালে তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। সমাজে রেসিজম, লিঙ্গ বৈষম্য, ইত্যাদি পুরোমাত্রায় ফিরে আসবে; এমনকি ধর্ষণের মত অপরাধেও দোষী ব্যক্তি শাস্তি থেকে মুক্তির পথ খুঁজবে। এর ফলেই লিবারেলিজম ব্লাঙ্ক স্লেট তত্ত্বকে ধর্মের মত আঁকড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা করছে। যা আসলে লিবারেলিজমের সংজ্ঞার সাথেই মানানসই নয়। রেডিক্যালিজম কোনভাবেই লিবারেলিজম ‍হতে পারে না।

সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কনজার্ভেটিজম যেভাবে পুরোপুরি মিথ্যার ওপরে প্রতিষ্ঠিত ধর্মকেও গুরুত্ব দেয়, আর যেভাবে পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, তাতে লিবারেলিজম অবশ্যই কনজার্ভেটিজমের চেয়ে ভাল পন্থা। কিন্তু যখন সে কনজার্ভেটিজমের মত কোন কিছু আঁকড়ে ধরতে চায়, তখন আর দুটোর মধ্যে ফারাক থাকে না। পুরোনো কিছু বাতিল হওয়া মানে সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়া নয়। নতুন জ্ঞানের আলোকে যদি কোন সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে সেই সমস্যাকে সমাধানের পথ খুঁজেই তবে সমাজকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে।

পৃথিবীজুড়ে বর্তমানে যে কনজার্ভেটিভদের জয়-জয়কার চলছে, এর পিছনে কারণানুসন্ধান করাটা জরুরী। গত কয়েক দশক ধরে লিবারেলিজমের জয়-জয়কার চলার পরে এভাবে বিপরীতমুখী টার্ন নেবার কারণ কি তাহলে আমাদের রক্তেই বহমান?

আমার তো মনে হয় সেরকমই। এতদিন ধরে পৃথিবীর মূল মিডিয়াগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো লিবারেলরা। আর শিক্ষিত মানুষের চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রিত হতো মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরাখবর ও তৎসংশ্লিষ্ট বিশ্লেষণ দিয়ে। কিন্তু এই ইন্টারনেটের যুগে মিডিয়ার সেই প্রভাব আর নেই। মানুষ এক অবাধ ও (আপাত) অসীম তথ্য প্রবাহের যুগে প্রবেশ করেছে। ফলে লিবারেলিজম পূর্বে যেভাবে তাদের মিডিয়া ব্যবহার করে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, তার অনেকটাই অবসান ঘটেছে এখন।

আরেকদিকে বিপরীত তথ্য মানুষের প্রাকৃতিক কনজার্ভেটিজমকে জাগিয়ে তুলছে। মানুষ নিজেকে ইন্ডিভিজুয়াল ভাবা থেকে গোত্র বা সমাজের অংশ ভাবতে শুরু করেছে। ফলে বাড়ছে জাতীয়তাবোধ এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মবোধ। পরাজিত হচ্ছে লিবারেল চিন্তা-চেতনা। এমতাবস্থায় যারা ট্রাম্প, বরিস জনসন, মোদিদের তুমুল বিজয়কে ঐসব দেশের মানুষের বোকামী ভাবছেন, তারা নিজেরাই আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

পরিবর্তিত বিশ্বে লিবারেলিজমকে নতুন পথ খুঁজতে হবে। পুরোনো তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরে না থেকে নতুন তত্ত্বের সাথে মানানসই কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। নইলে সভ্যতার দ্বন্দ্বে হান্টিংটন যা বলে গেছেন সেটাই ঘটতে থাকবে। অবশ্য তিনি যা বলেছেন তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে অনেক আগে থেকেই।

Leave a Comment