খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধশিক্ষামূলক

গিবত বিষয়ক নিন্দামন্দ

লিখেছেনঃ দূরের পাখি

পৃথিবীজোড়া মানুষ ধর্ম, সংস্কৃতি, দেশ, জাত আর রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবাদর্শের ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে যতই ভেদরেখা আর পার্থক্যের দেয়াল তুলে দিক না কেন, আদতে কোষের গভীরে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ খুবই কম। জিন বিজ্ঞানীদের মধ্যে এই নিয়ে একটা প্রচলিত প্রবচন শুনেছিলাম কোথাও – আফ্রিকার কংগো নদীর দুই পাড়ের, কিন্তু একই জংগলের শিম্পাঞ্জিদের ভেতর যতখানি জিনগত পার্থক্য আছে, সেইটুকু পার্থক্য আইনস্টাইন আর দক্ষিণ আমেরিকার পোশাকহীন, প্রাচীন জীবন যাপন করা শিকারী সংগ্রাহকের মধ্যেও নাই। এর কারণ হচ্ছে হোমো স্যাপিয়েন্সের বিবর্তনের পরিক্রমায় কয়েকবারই মানুষ এমন ধ্বংসাত্নক সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে যে পুরো ভূগোল মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা নেমে গিয়েছিল দশ হাজারেরও নীচে। আজকের পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ সেইসব অল্পসংখ্যক পূর্বপ্রজন্মের উত্তরাধিকারী বলে তাদের ভিতরে অন্তত কোষের গভীরে এতখানি মিল, এতখানি বৈচিত্রহীনতা।


বর্তমানের বর্ণীল দুনিয়ায় মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে এত পার্থক্যের ব্যাপারটি তাই জিন বিজ্ঞানীদের কাছে একটি উদ্ভট ঘটনা যা অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যার দাবী রাখে। সেই অনুসন্ধানে নেমে গিয়ে দেখা গেলো বাইরের এত সব বৈচিত্রময়তার এক পরত ভিতরেই মানুষের আসলে সমস্ত কিছুই একইরকম। একই ধাঁচের চৌচালা ঘরের কেবল বাইরের রংটাই কোথাও নীল কোথাও লাল কোথাও সাদা । পৃথিবীর বিভিন্ন ভূগোলে বিভিন্ন সংস্কৃতির আপাত আকাশ-পাতাল পার্থক্যের ভিতরের মনস্তত্ত্ব যে আদতে একই রকম, এই সত্য দেখানোর জন্য সৃষ্টি হয়েছিলো ‘মানবিক সার্বজনীন’ বা ইংরেজিতে ‘Human Universals’ নামক তালিকার। শুরু করেছিলেন উইনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান্তা বারবারার নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ডোনাল্ড ব্রাউন। কালে কালে এই তালিকা অনেকদূর বড় হয়েছে। বের হয়ে এসেছে মানুষের আপাত বৈচিত্রের ভিতরেও কত খুঁটিনাটি বিষয়ে গভীর মিল।

এই মিলের ব্যাপারটি অবশ্যই মানুষের জিনগত মিলের সরাসরি ফলাফল হিসাবে দেখা যায়। আবার অন্যদিকে এইসব মিল যেহেতু লাখ লাখ বছরের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার পরেও ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভিন্ন ভিন্ন সমাজের ভিতরে রয়ে গেছে, সেই দিক থেকে এইসব মিল নিশ্চয়ই সেইসব সমাজের টিকে থাকা ও বিকশিত হওয়ার পিছনে কোন না কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে বলা যায়। অন্তত নির্মোহ বিবর্তনীয় দৃষ্টিতে। এইসব মিলের একটা তালিকা পাওয়া যাবে স্টিভেন পিংকারের The Blank Slate বইয়ের পরিশিষ্টে। এই তালিকায় রয়েছে রান্না, অলংকারের ব্যবহার, বয়সের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ, বিমূর্ততার ধারণা, শিল্পের সৌন্দর্য্যচেতনার মত অনেক বিষয়; নিতান্ত আটপৌরে ব্যাপার থেকে শুরু করে বিমূর্ত ও দার্শনিক বিষয়াবলী। তালিকার মধ্যে আছে গসিপ বা পরচর্চা নামক বিষয়, যার বিশাল একটি অংশ হচ্ছে পরনিন্দা তথা গিবত।

গসিপ বা পরচর্চাকে অনেক আগে থেকেই অনৈতিক ও ঝামেলার একটি ব্যপার বলে বহুবিধ নিন্দা করা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক নীতিমালায়। সময়ের অপচয়, পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে বিষ ঢুকে যাওয়া, সুসংগত একটা দলের মধ্যে কোন্দল ও ভাঙ্গন এবং মিত্রতার মানচিত্রের নতুন বিন্যাস তৈরী হওয়া এরকম অনেকগুলো খারাপ দিকের কথা তুলে আনা যায় পরচর্চা ও পরনিন্দার বিরুদ্ধে। সেগুলো আপাতঃত বাদ দিয়ে, এত অনিষ্ঠের পরেও কেন পরচর্চা নামক বিষয়টি মানুষের সমাজে একটি সার্বজনীন বিষয় হয়ে সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে টিকে আছে তা নিয়ে ভাবা যাক। আগে যেমন বললাম, যেসব সার্বজনীন বিষয় ভূগোল ও সংস্কৃতির ব্যাপক দূরত্ব স্বত্তেও পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের সমাজে দেখা যাচ্ছে সেগুলোকে স্রেফ একটি পরজীবি বদভ্যাস বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নাই। সমাজের তৈরী হওয়া ও টিকে থাকার পিছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন এক ধরণের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অনতিক্রম্য অবদান থাকার ফলেই এইসব অভ্যাস ও আচার এত বছর ধরে টিকে আছে। এখানে প্রথমেই মাথা থেকে নৈতিক ও অনৈতিকতা বা ভালোমন্দের ধারণাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা দেখতে হবে। মানুষের সমাজের তৈরী হওয়া ও টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত ব্যাপার আমাদের নৈতিকতার দৃষ্টিতে ভালো হতে হবে এমন কোন কথা নাই। আবার এও নয় যে ব্যাপারটা খারাপ কিন্তু মানুষের সমাজের গড়ে উঠা ও টিকে থাকার পিছনে তার অবদান রয়েছে, এই বলে সেই আচরণকে আমি সমর্থন করছি। সমাজের অবস্থার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা আর সেই অবস্থাকে সমর্থন করা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এই সহজ ব্যাপারটি অনুধাবন করানো বিশাল কষ্টকর।

অতি সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইড এর একটা গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, পরচর্চার সবচে বড় অংশ পরনিন্দা নয়। চার ভাগের তিনভাগই মূলত কেবল অবজারভেশন। বাকীটুকুর মধ্যে অবশ্য প্রশংসার তুলনায় নিন্দার ভাগ দ্বিগুণ। পরনিন্দার অংশটুকুর বড় অবদান রয়েছে মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি গঠনে। সেই দিকটা নিয়েই আমাদের আলোচনা।

মোটা দাগে পরনিন্দার তিনটি বড় অবদান রয়েছে মানুষের সমাজে। প্রথমটি হচ্ছে সংস্কৃতি গঠনে শাস্তি দেয়ার অযোগ্য কিন্তু সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য (উন্নতি বলতে বংশবৃদ্ধির উন্নতি, আত্নিক বা শিল্পকলার উন্নতি নয়) ভালো নয় এমন সব কাজের পরিমাণে লাগাম টেনে ধরায়। সবচে জ্বলজ্বলে উদাহরণ হচ্ছে যৌন নৈতিকতার।

মানুষ খুনের জন্য, চুরির জন্য, ধর্ষণের জন্য, লুটের জন্য সমাজ অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে, নির্মম বা কম নির্মমভাবে। কিন্তু অবিবাহীত নর-নারীর গোপন মেলামেশার জন্য, দায়িত্বহীন যৌনতার জন্য সেইভাবে শাস্তি দেয়া যায় না। দেয়ার চেষ্টা করেছে কোন কোন সমাজ, কিন্তু সেগুলো টিকেনি। অন্যদিকে আবার দায়িত্বহীন যৌনতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে আবার সমাজের মৌলিক সিলসিলা টিকবে না বেশিদিন। সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্যের বাইরের যৌনতা ব্যক্তির জন্য যতই শান্তিময় বা লোভনীয় বা অন্যের নাক গলানোর বিন্দুমাত্র অধিকারবিহীন ব্যাপার হোক না কেনো, কোন উন্নয়নশীল (জনসংখ্যায়, অন্য কিছুতে নয়) সমাজ এই আচরণ নির্বাধভাবে চলতে দিতে পারে না। তাহলে সন্তান উৎপাদন ও পরবর্তী প্রজন্ম তৈরীর কাজ বাধাগ্রস্থ হয় চরমভাবে। আবার এই আচরণ একেবারে নির্মূল করাও সম্ভব নয়, মানুষের ভিতরে হরমোনের অদম্য প্রবাহের কারণে। তাহলে এখন উপায় কী? উপায় হচ্ছে এমন একটা সাম্যাবস্থায় আসা যাতে অবদমিত যৌনতা সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করেও না দেয়, আবার অবাধ দায়িত্বহীন যৌনতাও যেন এমন পর্যায়ে না যায় যাতে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের মানুষকে যৌন-আনন্দের জন্য সন্তান উৎপাদন ও লালনে বাধ্য হতে হয়। এই ভারসাম্য বিন্দুতে আসার উপায় হচ্ছে পরনিন্দা। যৌনতা নিয়ে নিন্দার ভয় এমন একটা পর্যায়ে রাখা যাতে দূকুলই রক্ষা হয়।

যৌনতা ছাড়াও অনেক আচরণ রয়েছে যেগুলো শারিরীক শাস্তির ভয় দিয়ে প্রয়োগ করা যায় না, কিন্তু সমাজের টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আপনার সৎ উপায়ে অর্জিত আয় দিয়ে আপনি পেট পুরে খেলেন কিন্তু আপনার প্রতিবেশী অভুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজ আপনার প্রতিবেশীকে সাহায্য না করার অপরাধে আপনাকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারে না, আবার প্রতিবেশী অভুক্ত থেকে মরে যাক, এটাও চেয়ে চেয়ে দেখতে পারে না। ত্রাণকর্তা আবার সেই পরনিন্দা। নিজের মহানুভবতা থেকে না হোক অন্তত নিন্দার ভয়ে যদি প্রতিবেশিকে একটু উচ্ছিস্ট দান করেন, তাতেই সমাজে চলে । সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি, তার বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এইসব আচার, যেগুলো মূলত নিন্দার ভয়ের মাধ্যমে সমাজের বড় একটা অংশকে মেনে চলতে বাধ্য করা হয়।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে অন্যের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা ও একই সাথে মুখরক্ষা করা নিয়ে অবদান। শিশুদের ভিতরে সাধারণত পরনিন্দা খুব বেশী পরিমানে দেখা যায় না। এর কারণ আপনি শিশুরা স্বর্গের ফেরেশতা বলে আপনি মনে করতে পারেন, কিন্তু আদতে শিশুরাও এক একটি প্রাণী, যারা তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যায় আরসব জীবনরূপের মতই। এই চেষ্টায় তাদের পরনিন্দার সাহায্য নিতে হয় না বলেই কেবল তারা পরনিন্দা করে না। তাদের মুখরক্ষার ভয় নাই। সাধারণভাবে শিশুদের কথাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া না বয়স্করা। বেফাঁস কিছু বলে ফেলে দীর্ঘমেয়াদি ঝামেলার মুখে পড়ার সম্ভাবনা তাদের নিতান্তই কম। কিন্তু প্রাপ্তবয়ষ্ক আপনাকে অনেক রকমের কসরৎ করে যেতে হয় সমাজের অন্তত একটা অংশের সাথে এমন সম্পর্ক বজায় রাখতে যাতে একেবারে একঘরে হয়ে মরে যেতে না হয়। যা বলার সামনাসামনি বলো, কিন্তু পিছন থেকে ছুরি মেরো না, এই কথাটা মিমে যতটা সুন্দর ও ড্যাশিং মনে হোক, বাস্তব জীবনে প্রয়োগ বেশ কষ্টকর । বড় হতে হতে আপনি অবাক বিষ্ময়ে খেয়াল করে দেখবেন, গোটা দুনিয়ার সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে এমন একটা মানুষও নেই যার সমস্ত কিছু আপনি বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতে পারেন ও উপভোগ করতে পারেন। প্রতিটি মানুষের ভিতরে আছে অনেক অস্বস্তিকর দিক, অনেক অন্ধকার দিক । সবাইকে মুখের উপর সত্য বলতে গেলে কিছুদিনের মধ্যেই আর বলার মত কোন মানুষ থাকবে না আপনার।


ব্যক্তিগত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক সহকর্মীর গায়ে ও মুখে ভয়াবহ দুর্গন্ধ। ভয়াবহ মানে একেবারে কেবল বিশ্ববিধাতা জানেন কোন পরিবেশে সে থাকে, কী খায় ও কী কী মুখে দেয় পর্যায়ের দুর্গন্ধ। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে তার নিত্যকার অফিস নয়। অন্য অফিস থেকে সপ্তাহে একবার কি দুইবার আসে আমাদের সমন্বিত কাজ বিষয়ক আলোচনার জন্য। যেহেতু এই অফিসে তার নিজস্ব ডেস্ক নাই, সেহেতু আমি অন্য একটা অব্যবহৃত ডেস্ক খালি করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখি তার জন্য। কারণ আমার চেয়ারের পাশে বসে আমার কম্পিউটারের ডেটা দেখিয়ে আলোচনা করতে গেলে দশ সেকেন্ডের মধ্যেই আমার পেটের ভিতরের সমস্ত কিছু বিদ্রোহ করে বাইরে চলে আসার জন্য। দুই তিন মিনিট পরপর কোন না কোন একটা অজুহাত দেখিয়ে আমি এদিক সেদিক চলে যাই, চলে যেতে হয় একটু সাধারণ বাতাসে কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। সেও নাছোড়বান্দা। কাজ যেহেতু আমার সাথে সমন্বিত, সে দূরের ডেস্কে বসবে না। আমার ডেস্কের সামান্য খালি জায়গাতে নিজের কম্পিউটার রেখে সে আলোচনা করবেই করবে। একই বছরে নতুন গ্রাজুয়েট হয়ে একইসাথে কোম্পানিতে ঢুকেছি আমরা। পেশাগত ও ব্যক্তিগত আচরণে তার বিরুদ্ধে বলার মত বিন্দুমাত্র কিছু নাই। যে কোন কাজে একটু সাহায্য চাইলে তার দ্বিগুণ তিনগুণ করে দেয়। সময়ের ব্যাপারে চরম নিয়মানুবর্তী। কোন বিষয় তার উপর ন্যস্ত করা যায় শতভাগ আস্থার সাথে। যত ঝামেলাই হোক, যত সময় লাগুক কোন না কোন একটা ব্যবস্থা সে করবেই। কিন্তু আবার গায়ের ও মুখের গন্ধের ব্যাপারটিও তো অনতিক্রম্য এক বাস্তবতা আমার জন্য। কী করতে পারি আমি? এই ধরণের নিতান্ত ব্যক্তিগত ও ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো তার নিজের করারও কিছু নাই এমন ধরণের ব্যাপার নিয়ে মুখের উপর তাকে আমি বলতে পারি না যে তোর গায়ে আর মুখে দুর্গন্ধ, দূরে গিয়ে বস। সামাজিকভাবে দক্ষ প্রাণী যারা, তারা এইক্ষেত্রে পরোক্ষ নিন্দার আশ্রয় নিয়ে দুইকূল রক্ষা করতে পারেন। অন্য কারো মাধ্যমে তাকে হয়তো এই বার্তাটি পৌঁছে দেয়া যেতো। আমি নিতান্ত অদক্ষ বলে পারি নাই।


সামাজিক আরো অনেক সম্পর্কের মধ্যে এতখানি প্রকট না হলেও আরো অনেক প্রচ্ছন্ন অসামঞ্জস্যের ব্যাপার থাকে যেগুলো মুখের উপর বলে দিলে কোন সমাধান আসে না, বরং সম্পর্ক চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। ধরা যাক একজনের সংগ আপনি উপভোগ করেন, তার সাথে তাস খেলতে পছন্দ করেন, সপ্তাহান্তের বিনোদন ও আড্ডায় তার সংগ পছন্দ করেন। কিন্তু তার বাসায় যেতে গেলে একটা সন্ত্রাস আপনাকে তাড়া করে ফিরে – সে বেশ আগ্রহ নিয়ে তার রান্না করা কুখাদ্য খেতে বাধ্য করে; জোর দিয়ে নয়, ইমোশনাল ব্লাকমেইলিং এর মাধ্যমে। অনেকখানি ভালো সময়ের জন্য হয়তো আপনি একটু কষ্ট মেনে নিতেই পারতেন, কিন্তু তার রান্না খাওয়া আপনার মুখকে ধর্ষণের সমতুল্য। বিষয়টাও অত তুচ্ছ নয়। কী করতে পারেন আপনি? সামাজিকভাবে দক্ষ লোকজন তাই অন্য কোন গণ্ডিতে তার রান্নার নিন্দা করবেন। অবশ্যই এমনভাবে যাতে কয়েক কান ও মুখ ঘুরে তার কানে কথাটা পৌঁছায়, এবং পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই বার্তার উৎপত্তিস্থলের ব্যাপারটা ঘোলাটে হয়ে উঠে। অথবা কমপক্ষে এতখানি ঘোলাটে হয়ে উঠে যে সেও একই অস্বস্তি ও লজ্জায় পড়ে আপনাকে সরাসরি কথাটি জিজ্ঞেস করতে না পারে। উইন-উইন।

এরকম আরো শতশত উদাহরণ দেয়া যায় যেসব ক্ষেত্রে মানুষ পরনিন্দার মাধ্যমে একে অপরের ভালোটুকু উপভোগ করে খারাপটুকুর প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সমাজে চলতে পারে। মানুষের সমাজ বলতে আমরা যা বুঝি তার বিশাল অংশ মূলত এই পরোক্ষ বার্তার চালাচালি। এমন পর্যায়ে যে এইসব পরোক্ষ বার্তার চালাচালির হিসাব রাখতে গিয়েই আসলে হোমো স্যাপিয়েন্সের মস্তিষ্ক তার শরীরের তুলনায় এমন ঢাউস সাইজে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন অনেক নৃতাত্ত্বিক। পরচর্চাই হয়তো এর একমাত্র কারণ নয়, কিন্তু বড় একটা কারণ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কারো।

তৃতীয় এবং সম্ভবত সবচে গুরুত্বপূর্ণ যে অবদানটি পরনিন্দার, তা হচ্ছে আইন ও নৈতিকতার শক্তির বিপরীতে প্রবাহ। ব্যাপারটা কীরকম? ধরুন আপনি সমাজের একজন প্রজা। আপনি কিভাবে চলতে পারবেন, কী করতে পারবেন, কী করতে পারবেন না, কী করলে আপনাকে শাস্তি দেয়া হবে, কী করলে আপনাকে তিরস্কার করা হবে, এগুলো ঠিক করে দেয় সমাজের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী। এইসব আইনের প্রয়োগও হয় মূলত সহিসংতার ভয়ের মাধ্যমে।

অনেক ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মানুষ বুঝেছে যে সমাজ তৈরী ও টিকিয়ে রাখতে গেলে একটা অংশকে শাসনের ভার নিতেই হবে। সেই অংশটিকে গোটা সমাজ মিলেই এমন পরিমান ক্ষমতা ও তার প্রয়োগের উপকরণ দিয়ে দেয় যাতে অল্পস্বল্প কিছু লোক মিলে তার বিরুদ্ধাচারণ করতে না পারে। কিন্তু একইভাবে আমরা বারবার দেখেছি যে ক্ষমতা সাধারণত মানুষকে পাগল করে দেয় । সহিংসতা প্রয়োগের একচ্ছত্র অধিকার যার হাতে থাকে অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতা প্রয়োগ করে যেসব আইন ও নৈতিকতা সে অন্যদের মানতে বাধ্য করে সেগুলো নিজেই আবার লংঘন করে। অল্পস্বল্পে হয়তো এটা তেমন কোন সমস্যা তৈরী করে না, কিন্তু লাগামহীনভাবে চলতে দিলে এই ধরণের ক্ষমতার চর্চা গোটা সমাজকেই ধ্বংস করে দেয়। তাহলে উপায় কী? ক্ষমতাহীন হয়ে ক্ষমতাবানকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করার উপায় কী? উপায় সেই পরনিন্দা, পরচর্চা। প্রবল পরাক্রমশালী স্বৈরশাসকও কিন্তু তুচ্ছ প্রজার নিন্দাকে ভয় করে। সমস্ত স্বৈরশাসক ও একনায়কের শাসন দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝা যায়। নিরন্তর ভাবমূর্তির প্রচারণা, সুবিশাল গোপন পুলিশ বাহিনী, সংবাদপত্র ও মিডিয়ার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা, সময়ে সময়ে দিলদরিয়ার মত প্রজাদের উপর অনুগ্রহ বণ্টন, এর সমস্তই তো নিন্দার ভয়ে। স্বৈরশাসক হোক বা একনায়ক বা কসাই ভিতরের হোমো স্যাপিয়েন্সের কোষের মধ্যে ঢুকে আছে লাখ লাখ বছরের সামাজিক বিবর্তনের ফলে পাওয়া অন্যের নিন্দার ভয়। অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বিশাল সামরিক বাহিনীও এই গোপন ভয়কে পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারে না।

তবে ক্ষমতার বিপরীতে নৈতিকতা ও আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কেবল নিন্দার মানবিক ভয়টাই একমাত্র অনুষঙ্গ নয় পরচর্চা ও পরনিন্দার। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে স্বৈরশাসকের নিন্দা থেকেই শুরু হয় তার বিরুদ্ধে বিপ্লবের প্রথম বীজের অংকুরোদগম। কালে কালে অনেক হঠকারী মানুষ হয়তো ভেবে এসেছে মানুষের ক্ষমতা আসে তার বুদ্ধি, সম্পদ, শক্তি অথবা অস্ত্র থেকে। আদতে এর কোনটাই মানুষের আসল ক্ষমতার উৎসের ধারেকাছেও যেতে পারে না। মানুষের ক্ষমতার আসল উৎস হচ্ছে অন্য মানুষ। অন্য মানুষকে নিজের ইচ্ছামত চালনা করতে পারাই হচ্ছে সমস্ত স্বৈরশাসক বা জনপ্রিয় শাসক বা দিগ্বিজয়ী সম্রাটের ক্ষমতার মূলকেন্দ্র। যত বড় স্বৈরশাসক হোক বা হোক যত সম্পদশালী যেই মুহুর্ত থেকে অধীনস্তরা তার আদেশ পালন বন্ধ করে দেবে সেই মুহুর্ত থেকে একটা ধূলিকণার সমানও মূল্য থাকবে না তার। এখন অত্যাচারী স্বৈরশাসকের অনাচারকে প্রতিহত করার জন্য সাধারণের হাতে একমাত্র উপায় থাকে তার এই ক্ষমতা কেড়ে নেয়া। অন্য মানুষ যেন তার কথা না শুনে। প্রথম যে বিপ্লবী এই প্রক্রিয়া শুরু করবে, সে কিভাবে আগাবে? হঠাৎ করে কোথাও সে শোষকের নিন্দাও শুরু করতে পারে না। গোপন পুলিশ আর ‘সহমুত্র’ ভাইদের চাপাতির কোপে তার গর্দান চলে যাবে চোখের পলকে। এজন্য তাকে প্রথমে শুরু করতে হয় পরচর্চার মাধ্যমে। নিঃশ্বাসের বাতাসে ৭৮ ভাগ নিষ্ক্রিয় নাইট্রোজেন যে কাজ করে, শরীরকে অতি অক্সিজেনে পুড়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো, পরচর্চার ভিতরের ৭৫ ভাগ নিরপেক্ষ কথাও মূলত একই কাজ করে। এইসব নিরপেক্ষ পরচর্চার মধ্যে একেক জনের বিভিন্ন সূক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া যাচাই বাছাই করেই প্রথম বিপ্লবীকে ঠিক করতে হয় কার সাথে আসল জিনিস অর্থাৎ নিন্দা করা যাবে শোষকের বিরুদ্ধে। এইসব নিন্দাকারীরার জমা হয়েই একসময় বিপুল পরাক্রমশালী শোষককে ক্ষমতার মসনদ থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। যেসব সমাজ তাদের ক্ষমতার দম্ভে পাগল হয়ে যাওয়া শাসককে টেনে নামাতে পারে নাই তারা ধ্বংস হয়ে গেছে, ধ্বংস হয়ে যাবে। ঠিক এ কারণেই পরনিন্দা ও পরচর্চার সমস্ত উপযোগের মধ্যে এটিই সবচে গুরুত্বপূর্ণ উপযোগ। এবং ঠিক এক কারণেই ক্ষমতাবান গুরুদের মধ্যে পরনিন্দার বিরুদ্ধে এতখানি বিষ। কালে কালে সেই বিষ সাধারণের মধ্যেও কিছুটা সংক্রমিত হয়ে তাদের শিক্ষায় আমরাও পরনিন্দা ও পরচর্চাকে দেখি অনেকটা তাদের চোখেই।

অবশ্য পরচর্চা ও পরনিন্দার বিরুদ্ধে উদগীরিত বিষের পুরোটাই কেবল ক্ষমতাবানের নিজের ভয় থেকে উৎসারিত প্রচারণার ফল বলাটা ভুল হবে। আমাদের দৈনন্দিনেও আমরা পরনিন্দার অনেক খারপ দিক দেখি বৈকি। কিছু মানুষ তাদের অসুস্থ ধর্ষকামের রাগমোচন করে অন্যের বিরুদ্ধে অনাহুত নিন্দা করে। অনেকে ধুরন্ধর এই নিন্দাকে ব্যবহার করে আশেপাশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ইচ্ছামত। এগুলো অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু ভেবে দেখুন শেষবার কবে দেখেছেন পরম পবিত্র, পরম শুদ্ধ কিছুকে মানুষ অপব্যবহার করে নাই, পঁচিয়ে গলিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত নরকের আবর্জনায় পরিণত করে নাই? আর গিবত তো শুরু থেকেই একটু ঝামেলামুক্ত ব্যাপার।

………………..
অনলাইনভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় পঠিত।

Leave a Comment