গল্প

দ্বৈরথ – হোর্হে লুইস বোর্হেস

মূল গল্পের শিরোনাম: El encuentro (স্প্যানিশ)
ইংরেজি শিরোনাম: The Encounter
অনুবাদ: সন্ন্যাসী রতন

মানুষ সংবাদপত্র পড়ে আসলে ভুলে যাওয়ার জন্য, শুধু সান্ধ্য আসরে তর্কের রশদ সংগ্রহের উদ্দেশে, আর ঠিক এ কারণেই আমি আশ্চর্য হইনি যে এক সময়ের বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত মানেকো উরিয়ার্তে ও দুনকানের কথা তারা বিলকুল ভুলে গিয়েছে, ঠিক যেভাবে সকাল হতেই তারা ভুলে যায় রাতের স্বপ্ন।

ঘটনাটা ১৯১০ সালের, সেই যেবার আকাশে ধূমকেতুর আবির্ভাব হয়েছিল, আর তারপর ঘটে গেছে নানাবিধ ঘটনা … মূল চরিত্রগুলো এখন মৃত। যারা সেই ঘটনার সাক্ষী ছিল, তারা মুখ না খোলার আনুষ্ঠানিক শপথ নিয়েছিল। নয় বা দশ বছর বয়সী আমিও এক রোমান্টিক গাম্ভীর্য অনুভব করে ও তাদের আচারের গুরুত্বকে অনুধাবন করে শপথের জন্য হাত তুলেছিলাম। তবে এখন ঠিক মনে নেই মুখে কিছু বলেছিলাম কিনা, আর এ ব্যাপারেও আমার জানা নেই যে অন্যরা তাদের কথা রেখেছিল কিনা। যাই হোক, কালের অনিবার্য অবচয় ও ভালো (অথবা মন্দ) সাহিত্যিক উপস্থাপনায় আমার গল্পটা ঠিক এই।

সেই সন্ধ্যায় আমার কাকাত ভাই লাফিনুর আমাকে গ্রামাঞ্চলের দিকে লাউরেলেস নামে একটা ছোটো শহরে তাদের এক ভ্রাতৃসংঘের আড্ডায় নিয়ে গিয়েছিল। এরকম আড্ডায় সাধারণত কয়েকজন যুবক একত্রিত হয়ে চর্বিযুক্ত বাছুরের মাংসের (অথবা ভেড়ার মাংসের, যেমনটা সেদিন সেখানে দেখা গিয়েছিল) রোস্ট করে ও গল্পগুজব করে। স্থানটার ভূপ্রকৃতির সঠিক বর্ণনা আমি দিতে পারব না; আপনার সুবিধার জন্য আপনি দেশের উত্তরাঞ্চলের কোনো ছোটো বন্দরকে কল্পনা করে নিতে পারেন-শান্ত, ছায়ানিবিড় ও ধীরে ধীরে নদীর দিকে ঢালু হয়ে নেমে গিয়েছে এমন কোনো জায়গা-কোনোভাবেই বিস্তৃত ও সমতল শহর নয়। ট্রেনে আমাদের যাত্রাপথটা বেশ ভালোই দীর্ঘ ছিল, অন্তত আমার পক্ষে বিরক্তিকর হওয়ার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ, তবে কে না জানে শৈশবের সময়গুলো খুব ধীরে প্রবাহিত হয়। মূল ফটক পেরিয়ে সেই বিশাল গ্রাম্য বাড়িটাতে যখন আমরা ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। বাড়িটাতে ঢুকতেই কিছু আদিম আধিভৌতিক বিষয় নজরে পড়েছিল আমার: লাল টকটক আগুনে টাস টাস শব্দে ঝলসানো মাংস থেকে উদ্গত গন্ধ, গাছ, কুকুর, শুকনো ডালপালা এবং আগুন, যাকে ঘিরে বসেছিল কয়েকজন পুরুষ।

এক ডজনের বেশি অতিথি ছিল সেখানে এবং তাদের সবাই-ই ছিল প্রাপ্তবয়স্ক। তবে সবচেয়ে বেশি বয়সী লোকটারও বয়স, পরে আমি জেনেছিলাম, ত্রিশ পেরোয়নি, আর কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝতে পারলাম যে তারা সবাই একেকজন এমনসব বিষয়ে বিজ্ঞ যেগুলোতে আমি আজও অযোগ্য রয়ে গিয়েছি: ঘোড়দৌড়, দর্জির কাজ, গাড়ি ও বহুমূল্য নারী। আমার লাজুক মনকে বিব্রত করার মতো কেউ কিছু করেনি, আসলে কেউ আমাকে সেভাবে খেয়ালই করেনি। এস্টেটের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত এক পিওন ধীর দক্ষতার সঙ্গে ভেড়ার মাংস প্রস্তুত করল, যা আমাদেরকে বেশ লম্বা সময় ধরে খাবার ঘরে অপেক্ষায় রেখেছিল। আলোচনার বিষয়বস্তুর একটা ছিল ওয়াইনের বয়স। ঘরে একটা গিটার ছিল, এবং আমার যতটুকু মনে পড়ে খাবার শেষে আমার কাজিন এলিয়াস রেহুলেসের লা তাপেরা ও এল গাউচো এবং লুনফার্দো থেকে কয়েক লাইন গেয়েছিল। লুনফার্দো তখন পরিচিত ছিল ডি রিগুর নামে এবং বিষয়বস্তু ক্যালে হুনিনের কোনো এক বাড়িতে ছুরির লড়াই। অতিথিদেরকে কফি ও সিগার সরবরাহ করা হলো।

বাড়ি ফেরার নামটা পর্যন্ত উচ্চারণ করছিল না কেউ। এদিকে আমি, যেমনটা লুগনস একবার আমাকে বলেছিল, ‘দেরি হওয়ার আশঙ্কা করছিলাম।’ ঘড়ির দিকে তাকানোরই সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। এতগুলো উঁচু, লম্বা পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মাঝে একটা ছোটো ছেলে হিসেবে নিজেকে আমার একা লাগছিল। একাকীত্বকে ঢাকতেই, তেমন একটা ভালো না লাগলেও, এক বা দুই গ্লাস ওয়াইন খেলাম। হঠাৎ উরিয়ার্তে দুনকানকে পোকার খেলায় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল, খেলাটা হবে কেবল দুজনের মধ্যে এবং হাতে হাতে। কেউ একজন আপত্তি জানাল যে দুই হাতে পোকার খেলা খুবই বিরক্তিকর, তার চেয়ে বরং চারজনের একটা টেবিল বসানো হোক। দুনকান তাতে রাজি হয়েছিল, কিন্তু উরিয়ার্তে গো ধরে বসল যে খেলা হবে কেবল তাদের দুজনের মধ্যে। তার এই গো ধরার বিষয়টা আমার ছোটো মাথায় ধরছিল না (অবশ্য ধরানোর চেষ্টাও ছিল না)। ট্রুকো ও সলিটারি ছাড়া তাসের আর কোনো খেলাই আমাকে কোনোদিন টানেনি, আর এগুলোও খেলতাম মাঝে মধ্যে সময় কাটানোর জন্য। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কেউ খেয়ালও করল না যে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।

একটা বালকের কাছে আগে-কখনো-আসা-হয়নি এমন একটা বিশাল বাড়ি ও তার অন্ধকার ঘরগুলো (একমাত্র খাবার ঘরেই আলো ছিল) একজন পরিব্রাজকের কাছে অনাবিষ্কৃত দেশের চেয়েও বড় কিছু। আমি ধাপে ধাপে বাড়িটাতে আমার অনুসন্ধান কার্য শুরু করলাম; আমার মনে পড়ে আমি একটা বিলিয়ার্ড রুম দেখেছিলাম, একটা আয়তাকার ও রম্বসাকৃতির শার্সি দিয়ে নির্মিত কাঁচঘর, এক জোড়া রকিং চেয়ার এবং একটা জানালা যেটা দিয়ে ওপাশে একটা অবকাশ ঘর দেখা যাচ্ছিল। আবছায়া আলোয় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি পথ হারিয়ে ফেললাম। আমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন বাড়ির মালিক, যার নামটা এতগুলো বছর পরে আমার সঠিক মনে নেই, আচেবেদো বা আচেবাল জাতীয় কিছু একটা হবে। দয়াপরবশ হয়ে, অথবা একজন সংগ্রাহকের আত্ম-অহঙ্কারে গর্বিত হয়ে, তিনি আমাকে তাঁর জাদুঘরের সংগ্রহশালা দেখাতে নিয়ে গেলেন।

ঘরের আলো জ্বালানো হলে আমি দেখলাম সেখানে অনেকগুলো ছুরি রয়েছে, বিবিধ আকার ও প্রকারেরই নয় কেবল, রয়েছে সেগুলোর ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত মর্যাদাপ্রাপ্তির তালিকা। তিনি আমাকে জানালেন যে পেরগামিনোর কাছে তাঁর একটা ছোটো বাড়ি আছে, বছরের পর বছর ধরে সেখানে আসা-যাওয়া করে করে তিনি তাঁর সংগ্রহশালাকে সমৃদ্ধ করেছেন। শোকেসটা খুলে প্রতিটা ছুরির পাশে রাখা বর্ণনামূলক কার্ডগুলোর দিকে না তাকিয়েই তিনি আমার কাছে সেগুলোর ইতিহাস বলতে শুরু করলেন, স্থান ও তারিখের পার্থক্য ছাড়া যা আসলে প্রায় একই। আমি জানতে চাইলাম তাঁর ছুরিগুলোর মধ্যে মোরেইরার ডেগারটা রয়েছে কিনা (মোরেইরা ছিল তখনকার দক্ষিণ আমেরিকার কাউবয়দের আদর্শ, যেমনটা পরে হবে মার্তিন ফিয়েররো ও দন সেগুন্দো সোমব্রা)। তিনি জানালেন যে নেই এবং বললেন সেরকমই একটা ছুরি তিনি আমাকে দেখাবেন যেটাতে ঠিক মোরেইরার ছুরির মতোই ইউ-আকৃতির ক্রস গার্ড রয়েছে। ওপাশ থেকে ভেসে আসা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর তাঁর কাজে বাঁধা দিলো। তিনি দ্রুত তাঁর সংগ্রহশালাটা বন্ধ করলেন এবং আমি তাঁর পিছু পিছু অন্যদের কাছে উপস্থিত হলাম।

উরিয়ার্তে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করছিল যে দুনকান খেলায় প্রতারণা করছে। অন্যরা তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। যতদূর মনে পড়ে দুনকান ছিল সবার চেয়ে লম্বা। বলিষ্ঠ ও ভাবলেশহীন চেহারা এবং কিছুটা ভারী কাঁধের দুনকানের চুলগুলো এতটাই সোনালী ছিল যে সেগুলোকে দেখে সাদা মনে হতো। ভীরু অঙ্গভঙ্গি ও দ্রুত গতিবিধির মানেকো উরিয়ার্তের গায়ের রং ছিল মলিন, কিছুটা ভারতীয় রক্তের ইঙ্গিতবহ, এবং তার একটা পাতলা ও ধৃষ্ট গোফ ছিল। এটা বোঝা যাচ্ছিল যে তারা সবাই-ই যথেষ্ট ওয়াইন পান করেছে; আমি ঠিক মনে করতে পারছি না মেঝেতে দুই কী তিনটা ওয়াইনের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেছিলাম, নাকি সিনেমার পরিচালকরা আমার ভিতরে এ ধরনের একটা মিথ্যা স্মৃতি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। উরিয়ার্তে একাটানা প্রখর (বর্তমানে অশ্লীল) বিদ্রুপ করে চলছিল। দুনকানকে দেখে মনে হচ্ছিল সে তার কথায় কান দিচ্ছে না। অবশেষে ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে এবং উরিয়ার্তের মুখে একটা ঘুষি মারল। উরিয়ার্তে মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল এবং সেখানে শুয়ে শুয়েই হুঙ্কার দিলো যে সে তাকে ছেড়ে দিবে না। সে দুনকানকে লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো।

দুনকান মাথা নাড়ল। ‘সত্যি বলতে আমি তোকে ভয় পাই,’ তার মনোভাব জানিয়ে দিতে বলল সে।

একটা গনহাসির বিস্ফোরণ স্বাগত জানাল তাদেরকে।

‘তোর এখনই আমার সঙ্গে লড়তে হবে,’ জবাব দিলো উরিয়ার্তে, তারপর এক লাফে উঠে দাঁড়াল।

কেউ একজন (ঈশ্বর তাকে ক্ষমা করুক) টিপ্পনি কাটল যে ঘরে অস্ত্রের অভাব নেই।

আমি নিশ্চিত না কে সেই কাঁচের অস্ত্র সংগ্রহশালাটা খুলেছিল। মানেকো উরিয়ার্তে বাছাই করল সবচেয়ে দীর্ঘ ও বাহারি ছুরিটা, যেটাতে একটা ইউ-আকৃতির ক্রসগার্ড ছিল; যে-কোনো একটা হলেই চলবে, এমন ভাব নিয়ে দুনকান তুলে নিলো একটা কাঠের হাতলবিশিষ্ট ছুরি, যেটার ব্লেডে একটা ক্ষুদ্র গাছের ছবি খোদাই করা। কেউ একজন বলল যে মানেকোর ছুরি বাছাই করাটা ঠিক মানেকোর মতোই হয়েছে। এরকম মুহূর্তে মানেকোর হাত কাপবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না, কিন্তু সবাই অবাক হয়েছিল যে দুনকানের হাতও কাপছিল।

ঐতিহ্য দাবি করে যে যখন দুজন পুরুষ দ্বৈরথে লড়বে, তারা কোনো ঘরকে নোংরা করবে না, বরং লড়াইয়ের জন্য তারা বেছে নিবে বাইরের কোনো খোলা জায়গা। কিছুটা মজায় ও কিছুটা গাম্ভীর্য নিয়ে আমরা সবাই সেই আর্দ্র রাতে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি মদ খেয়ে মাতাল ছিলাম না, তবে রোমাঞ্চ আমাকে মাতাল করে তুলেছিল; কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম যেন তাদের দুজনের একজন আরেকজনকে মেরে ফেলে, যাতে পরবর্তীতে আমি ঘটনাটার স্মৃতিচারণ করতে পারি ও মানুষের কাছে গল্প করতে পারি। সম্ভবত সে-সময়ে সেখানে উপস্থিত সবাই-ই আমার মতো শিশু হয়ে গিয়েছিল। আমি আরো অনুভব করলাম যে আমরা একটা ঘূর্ণিচক্রের মধ্যে পড়েছি, যেটা আমাদেরকে টেনে ক্রমশ নিচে নামাচ্ছে, এবং আমাদের কারো শক্তি নেই যে সেই টানকে প্রতিরোধ করে। ঘূর্ণিচক্রটার মধ্যে আমরা হারিয়ে যাচ্ছিলাম। মানেকোর অভিযোগকে সত্যিই কেউ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি; সবাই ধরে নিয়েছিল যে এর পিছনে রয়েছে তাদের পুরোনো দ্বন্দ্ব, আজ রাতে ওয়াইন পান করে তার প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র।

অবকাশ ঘরের বাইরে বাগানের মধ্য দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। আমাদের আগে আগে চলছিল উরিয়ার্তে ও দুনকান; তারা যেভাবে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিল, সেটা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকছিল, যেন প্রত্যেকেই ভয়ে আছে এই বুঝি আরেকজন তার ওপর অস্ত্র ধরল। বাগান পেরিয়ে আমরা এক টুকরো ঘাসি জমিতে গিয়ে উপস্থিত হলাম।

‘এটাই মনে হয় ঠিক আছে,’ মৃদু কর্তৃত্বের সঙ্গে বলল দুনকান।

দ্বিধাজড়িত দৃষ্টি নিয়ে মাঝখানে দাঁড়াল তারা দুজন।

‘এইসব ছুরি-টুরি ফেলে দে। এগুলো শুধু শুধু বাধা হয়ে দাঁড়ায়। রিয়েল কুস্তি হোক!’ একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে উঠল।

কিন্তু ততক্ষনে তারা লড়াই শুরু করে দিয়েছিল। প্রথমে বেশ এলোমেলোভাবে, যেন দুজনেই আহত হওয়ার ভয় করছে; প্রথমে তারা একে অন্যের ব্লেড খেয়াল করছিল, তারপর দেখছিল প্রতিপক্ষের চোখ। উরিয়ার্তে তার রাগ ভুলে গিয়েছিল; দুনকান ভুলে গিয়েছিল তার উদাসীনতা অথবা অবজ্ঞা। বিপদ তাদের রূপান্তর ঘটিয়েছিল; এখন যারা লড়াই করছিল, তারা আর বালক নয়, পুরুষ। আমি এতদিন ভেবে আসছিলাম ছুরির লড়াই বুঝি ইস্পাতের ঝনঝনানি, কিন্তু যখন তাদেরকে লড়তে দেখলাম ও বুঝলাম বা প্রায় বুঝতে চেষ্টা করলাম, আমার কাছে মনে হলো এ যেন দাবা খেলা। সেদিন আমি যা দেখেছিলাম, সময় তাকে মহিমান্বিত কিংবা ম্লান করতে পারেনি। আমার ঠিক মনে নেই তাদের লড়াই ঠিক কতক্ষণ স্থায়ী হয়েছিল; কিছু কিছু ঘটনা সময়ের তুচ্ছ এককে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।

যেহেতু তারা প্রতিপক্ষের আঘাত প্রতিরোধ করছিল বাহু দিয়ে এবং তাতে কোনো প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, তাদের জামার হাতাগুলো খুব শীঘ্রই কেটে ফিতার মতো হয়ে গিয়েছিল এবং ফিতাগুলো তাদের রক্তে ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছিল। যে বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হলো, আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে তারা ছুরি চালনার সঙ্গে আদৌ পরিচিত নয়। আমি খেয়াল করে দেখলাম তাদের দুজনের অস্ত্র পরিচালনায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। দুজনের অস্ত্রের দৈর্ঘ্য সমান ছিল না; এই অসুবিধা লাঘবের জন্য দুনকান তার প্রতিপক্ষের যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছিল, যখন উরিয়ার্তে বারবার চেষ্টা করছিল পিছিয়ে গিয়ে দূর থেকে আঘাত করার।

‘আরে, ওরা তো একটা আরেকটারে খুন করে ফেলবে! কেউ ওদেরকে থামা!’ চিৎকার করল সেই কণ্ঠ, যে প্রথমে অস্ত্রের শোকেসটার কথা উল্লেখ করেছিল।

তাদের লড়াইয়ে হস্তক্ষেপ করার সাহস করে উঠল না কেউ। উরিয়ার্তে বেকায়দায় পড়ে যেতেই দুনকান তার ওপর চড়াও হলো। তাদের দুজনের শরীর একে অপরকে প্রায় স্পর্শ করছিল। দুনকানের মুখটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল উরিয়ার্তের ব্লেড। হঠাৎ মনে হলো সেটা খাটো হয়ে গিয়েছে; সেটা ডুবে গিয়েছে দুনকানের বুকের মধ্যে। দুনকান ঘাসের ওপর ধ্বসে পড়ল এবং প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল: ‘কী অদ্ভুত! সবকিছু মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন।’

চোখ খোলা রেখেই শুয়ে রইল সে, সামান্য নড়ল না, আর আমি একটা লোককে খুন করতে দেখলাম।

মানেকো উরিয়ার্তে দুনকানের মৃতদেহের ওপর ঝুঁকে তার কাছে ক্ষমা চাইল। সে প্রকৃতই কাঁদছিল। সবেমাত্র যে কাজটা সে করল তাতে অভিভূত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সে। এটা এখন আমি জানি যে, একটা অপরাধ করা নিয়ে সে যতটা অনুতপ্ত ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল একটা নির্বোধের মতো কাজ করার জন্য।

আমি আর দেখতে পারছিলাম না। যা ঘটতে দেখার জন্য একসময় কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম, তা ঘটল, এবং যখন ঘটল, আমি বিধ্বস্ত বোধ করছিলাম। লাফিনুর পরে আমাকে জানিয়েছিল যে দেহ থেকে ছুরিটা বের করতে তাদের কষ্ট হয়েছিল। এর পরপরই একটা সভা ডাকা হলো এবং সেখানে সিদ্ধান্ত হলো যে তারা যতটা সম্ভব কম মিথ্যা বলবে; ছুরির লড়াইকে তলোয়ারের দ্বৈরথে উন্নীত করা হবে। আচেবালসহ চারজন দাবি করবে যে এই দ্বৈরথ যাতে সম্মানের সঙ্গে সম্পন্ন হয়, তার দায়িত্ব ছিল তাদের চারজনের ওপর। রাজধানী থেকে সবকিছু দেখা হবে; এসব ব্যাপার দেখার জন্য সবসময়ই কারো না কারো কেউ না কেউ থাকে…

তাস ও কেনাকাটার রশিদগুলো এলোমেলো পড়ে রইল মেহগনি টেবিলে, কেউ সেগুলোর দিকে তাকানো বা স্পর্শ করার মতো মনোবল জুগিয়ে উঠতে পারছিল না।

পরবর্তী বছরগুলোতে আমি বেশ কয়েকবার ভেবেছি যে ঘটনাটা আমার কোনো এক বন্ধুর কাছে প্রকাশ করে দিব, কিন্তু আমার মনে সবসময়েই একটা সন্দেহ এসে ভিড় করত যে আমি সম্ভবত ঘটনাটা কাউকে বলার চেয়ে এর গোপনীয়তাটাকেই বেশি উপভোগ করছি। ১৯২৯ সালে একটা খুচরো আলাপ আমাকে দীর্ঘ নীরবতা ভাঙতে প্ররোচিত করেছিল। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ প্রধান হোসে ওলাবে আমার কাছে রেইতিরোর আশেপাশে এল বাজো ও ওখানকার ডক এলাকায় ঘোরাঘুরি করা ছুরি লড়িয়েদের গল্প করছিলেন। তিনি বলছিলেন যে এ ধরনের মানুষ তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যে-কোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে-অ্যাম্বুশ, বেইমানি, ছলচাতুরিসহ কুখ্যাত সব অপকর্ম-এবং মন্তব্য করলেন যে ঐ এলাকায় আগে খুব কমই ছুরির লড়াই হতো, যা হতো তা হাতাহাতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমি তাঁকে বললাম যে আসলে আমি একবার এরকম একটা লড়াইয়ের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম, এবং তারপর এত বছর পরে সেই রাতের গল্পটা বললাম।

পেশাগত মনোযোগ নিয়ে তিনি আমার কথা শুনলেন, এবং তারপর একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন: ‘আপনি নিশ্চিত যে উরিয়ার্তে ও অন্য লোকটা এর আগে কখনো লড়াইয়ে ছুরি ব্যবহার করেনি? তাদের এলাকার কেউ কখনো তাদেরকে শিখায়নি?’

‘না,’ বললাম আমি। ‘সে রাতে সেখানে উপস্থিত সবাই পরস্পরকে চিনত এবং কেউই তাদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।’

উলাবে তাড়াহুড়ো না করে, যেন নিজের মনেই নিজে কথা বলছেন, সেভাবে বললেন, ‘আপনি বলছিলেন যে ড্যাগার দুটোর একটাতে ইউ-আকৃতির ক্রস গার্ড ছিল। এরকম দুটো বিখ্যাত ড্যাগারের খবর আমি জানি, একটা ব্যবহার করত মোরেইরা, আরেকটা ছিল হুয়ান আলমাদার, তাপালকেনের ওদিকে।’

হঠাৎ একটা বিষয় আমার স্মৃতিতে আলোড়ন তুলেছিল।

‘অন্য ছুরিটাতে কাঠের হাতল ছিল, তাই তো?’ ওলাবে বললেন, ‘এবং ব্লেডে একটা ছোটো গাছের মার্ক? এরকম ছুরি হাজার হাজার পাওয়া যাবে। যে কোম্পানি তৈরি করত, ওটা তাদের ট্রেডমার্ক। কিন্তু একটা আছে…’

এক মুহূর্তের জন্য তিনি থামলেন, তারপর বলে চললেন: ‘আচেবাদো নামে এক লোক ছিল যার পেরগামিনো প্রদেশের ওদিকে একটা বাড়ি ছিল। এই শতাব্দীর শুরুতে হুয়ান আলমাঞ্জা নামে আরেকজন মোটামুটি খ্যাতিমান ছুরি লড়িয়ে ঐ এলাকায় তার সদর দপ্তর স্থাপন করেছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম খুন করার পর থেকে সে সবসময় ঐ ছোটো ছুরিটাই ব্যবহার করত, ওটা নাকি তার জন্য লাক বয়ে এনেছিল। হুয়ান আলমাঞ্জা ও হুয়ান আলমাদার মধ্যে শত্রুতা ছিল, কারণ মানুষ তাদের নাম উল্টা-পাল্টা করে ফেলত, দেখতেই পাচ্ছেন… দীর্ঘ সময় ধরে তারা দুজন একে অপরের ওপর নজর রাখতো, কিন্তু সামহাউ তাদের দুজনের মধ্যে কখনো বিবাদ লাগেনি। হুয়ান আলমানজা মারা গিয়েছিল কোনো এক ইলেকশন বা এরকম কিছুতে ছুটকো গুলির আঘাতে। আর অন্যজন, আমার যতদূর মনে পড়ে, মারা গিয়েছিল বুড়ো বয়সে, লাস ফ্লোরেসের এক হাসপাতালে।’

সেই বিকেলে আমাদের মধ্যে আর কথা হয়নি; আমরা দুজনই বসে বসে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম।

যে নয় অথবা দশজন লোক সেদিন আমার সঙ্গে ঐ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল, তারা সবাই এখন মৃত। একটা লম্বা ছুরিকে বুক বরার ছুটে আসতে ও দুনকানের দেহটাকে আকাশের নিচে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে যেতে দেখেছিল তারা, কিন্তু সেইসঙ্গে তারা আরো একটা সমাপ্তিকে প্রত্যক্ষ করেছিল, একটা প্রাচীন গল্পের সমাপ্তি। মানেকো উরিয়ার্তে দুনকানকে খুন করেনি। মানুষ নয়, সেদিন যুদ্ধ করেছিল দুটো অস্ত্র। মানুষের হাত তাদেরকে না জাগানো পর্যন্ত তারা একটা ক্যাবিনেটের মধ্যে পাশাপাশি ঘুমিয়ে ছিল। সম্ভবত ঘুম ভাঙার পরে তারা মোচড়ামুচড়ি করছিল; সম্ভবত সেজন্যই উরিয়ার্তের হাত কেঁপেছিল, কেঁপেছিল দুনকানেরও। তারা জানত কীভাবে লড়াই করতে হয়-আমি বলতে চাইছি যে ছুরিগুলো জানত কীভাবে লড়াই করতে হয়, মানুষগুলো নয়, তারা ছিল কেবলই ছুরিগুলোর হাতের যন্ত্র হয়ে-এবং সেই রাতে তারা একটা জমপেশ লড়াই করেছিল। দীর্ঘ প্রদেশীয় রাস্তায় দীর্ঘদিন ধরেই তারা একে অúরকে খুঁজছিল এবং অবশেষে খুঁজে পেয়েছিল পরস্পরকে; ততদিনে তাদের মালিকেরা ধুলোয় মিশে গিয়েছে। ছুরিগুলোর ব্লেডের ডগায় ঘুমিয়ে ও লুকিয়ে ছিল মানবিক ক্ষোভ।

বস্তু মানুষের চেয়ে দীর্ঘজীবি হয়। কে জানে এই গল্পের এখানেই সমাপ্তি কিনা। কে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারে যে তাদের ফের কখনো সাক্ষাৎ হবে না?

Leave a Comment