খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধরাজনীতিশিক্ষামূলক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

লিখেছেনঃ দূরের পাখি
সুদীর্ঘ এই প্রবন্ধটি লেখক শুরু করেছেন বেশ কাব্যিক সুরে। ধাপে ধাপে লেখা প্রবন্ধটিতে তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের পিছনের ইতিহাস থেকে শুরু করে প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকে তুলে ধরেছেন। সাথে রয়েছে এই যুদ্ধের সাথেই সংশ্লিষ্ট আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা যা পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রই পাল্টে দেয় – আর্মেনিয়াতে অটোমান সাম্রাজ্যের গণহত্যা এবং রাশিয়াতে বলশেভিক বিপ্লব। একটু সময় নিয়ে পড়লে পুরোটাই উপভোগ করতে পারবেন আশা করি।

The Allies attempt to fight back the German monster. Photo: gallica.bnf.fr / Bibliothèque nationale de France

সার্বিয়া

২৮শে জুনের দীর্ঘ ছায়া যেন কিছুতেই সার্বিয়ার পিছু ছাড়ে না। এই ছায়ার  শুরু এমন সময়ে যখন দিনটিই ২৮শে জুন ছিলো না। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে দিনটি  ছিলো ১৫ ই জুন। গ্রেগরিয়ান সংশোধনে ১৫৮২ সালের ৪ঠা অক্টোবরের পরের দিনটি  ১৫ই অক্টোবর হয়ে গেলে, সার্বিয়ার ইতিহাসে সবচে যন্ত্রণাদায়ক, সবচে দুঃখের  পবিত্র দিনটিও ১৫ই জুন থেকে সরে গিয়ে ২৮শে জুন হয়ে যায়। শিয়া মুসলিমদের  ইতিহাসে কারবালার ১০ই মহররম যেমন, সার্বিয়া ও স্লাভ নৃগোষ্ঠীর ইতিহাসে ২৮শে জুন তেমন। ১৩৮৯ সালে অটোমান আগ্রাসী বাহিনীর কাছে মহাপরাজয়ের আগে দিনটি  ছিলো সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চের পবিত্রপুরুষ সন্ত ভাইটাস (st. Vitus)  দিবস। ১৩৮৯ সালের এই দিনে কসোভোতে প্রিন্স লাযার (Prince Lazar) এর  বাহিনীর সাথে অটোমান সম্রাট মুরাদের (Murad Hüdavendigâr) বাহিনীর ভয়াবহ  যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ এতটাই সর্বব্যাপী ও ধ্বংসাত্নক ছিলো যে দুই পক্ষের  পুরো সৈন্যবাহিনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যুদ্ধে নিহত হন সম্রাট মুরাদ এবং প্রিন্স লাযার দুইজনেই। অটোমানদের পিছনে তুরস্কে তাদের পরাক্রমশালী  সাম্রাজ্য তখনো অক্ষত। কিন্তু সার্বিয়ার প্রিন্সের নিজের বাহিনী ও তাঁর আহবানে জড়ো হওয়া বসনিয়ার বাহিনী ধ্বংস হয়ে গেলে ধীরে ধীরে লাযারের পরাক্রমশালী মোরাভিয়ান সার্বিয়া ও বসনিয়ার একের পর এক প্রদেশ অটোমানদের  অধীনে চলে যায়। সেই থেকে সার্বিয়ান অর্থোডক্স চার্চ এই দিনটিকে পালন করে আসছে আত্নত্যাগ ও পরাজয়ের গভীর ক্ষতের স্মৃতি হিসাবে।

পরাজয়ের  গ্লানি ও পরাধীনতার যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পুষে রেখে শোকাবহ এই দিনটিকে সার্বিয়ার জনগণ সেই ১৩৮৯ থেকে প্রায় অসম্ভব স্বপ্নপূরণের প্রতিজ্ঞা নেয়ার  উপলক্ষ্য হিসাবে পালন করে আসছে। পুরনো মোরাভিয়ান সার্বিয়া আবার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু অটোমানদের নৃশংস জানিসারী বাহিনী চার শতাব্দী ধরে সার্বিয়ার  কোথাও কোন প্রতিরোধ বা স্বাধীনতার বীজকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। অবশেষে  উনবিংশ শতাব্দীর শুরু (১৮০৪) থেকে শত যুদ্ধ, রক্তপাত, আত্নত্যাগ ও  অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৮৬৭ সালে স্বাধীনতার মুখ দেখে সার্বিয়া। তবু এই  স্বাধীনতা সার্বিয়ার জনগন, বিশেষ করে তার সামরিক অভিজাত গোষ্ঠীকে, খুব বেশি  তৃপ্তি দেয়নি। তাদের স্বপ্নালু চোখে ছিলো পুরাতন মোরাভিয়ান সার্বিয়া,  কিন্তু পাওয়া গেলো খণ্ডিত সার্বিয়া। এমনকি বসনিয়া হার্যেগোভিনাকেও ১৮৭৮  সালের বার্লিন কংগ্রেসে দিয়ে দেয়া হলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সামরিক অধিকৃত অঞ্চল হিসাবে।

কাফকার The Castle উপন্যাসের মত অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান  সাম্রাজ্য ছিলো এক অনন্ত গোলকধাঁধা। তার হাজার পাকে বাঁধা আমলাতন্ত্রের জাল পেরিয়ে সাম্র্যাজ্যের গভীরে যাওয়া বা তার কার্যপ্রণালী বুঝা সাধারণ কোন  মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। এমনকি সেই সাম্রাজ্যের ভিতরের ক্ষমতাধররাও ভালোভাবে বুঝতো না এমন একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে টিকে আছে। ক্ষমতার কার্যত কেন্দ্রে থাকা ভিয়েনার অস্ট্রিয়ান অভিজাতরা হাঙ্গেরিকে পুরোপুরি কব্জা করতে না পেরে তাকে স্বীকার করে নেয় সমকক্ষ হিসাবে। কিন্তু নিজেদের ভিতরে তারা হাঙ্গেরিকে কেবল উপনিবেশ হিসাবেই ভাবতো। ভিয়েনার এই অভিজাতরা ছিলো একসময়ের বিপুল বিস্তৃত হাউজ অফ হ্যাবসবার্গের একটা ছোট শাখার উত্তরাধিকারী। হাউজ অফ হ্যাবসবার্গের বিপুল সাম্রাজ্য তাদের সামরিক সাফল্য বা অভিযাত্রা দিয়ে আসেনি, এসেছিলো শত রকমের সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল ও শত শত আন্তঃবিবাহ ও চুক্তির মাধ্যমে। ফলস্বরুপ সেই সিলসিলাতে পাওয়া অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যেও ছিলো ডজনে ডজনে ছোটখাট রাজত্ব, ডিউকডোম, ব্যারোনডোম। সাথে ছিলো বহুধাবিস্তৃত বৈবাহিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক ও সামরিক সমঝোতা চুক্তি। আর ছিলো ডজনে ডজনে ছোট ছোট নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। এইসব  গোষ্ঠীর অনেকেই বুঝতো না তাদের রাজত্ব কিভাবে চলছে, কে তাদের উপর আসল ক্ষমতার অধিকারী। এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো বলকানের বিভিন্ন অঞ্চলে। বলকানের  বিশাল একটা অংশ ১৩৮৯ সালের যুদ্ধের পর থেকে অটোমানদের অধীনে, কিন্তু  ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সেসব অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বাধীনতা চিন্তা, ধর্মীয় পার্থক্য ও নৃতাত্ত্বিক পরাধীনতার যন্ত্রণাকে উস্কে দিয়ে, হাওয়া দিয়ে, মাঝেমাঝেই সেখানে অস্থিরতা তৈরী করে নিজেদের সাম্রাজ্যকে বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টায় ছিলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরি।

অন্যদিকে উত্তরের  সুবিশাল রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও তার রোমানভ শাসক-গোষ্ঠীরও চোখ ছিলো বলকান অঞ্চলের দিকে, বিশেষত কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোর দিকে। কারণ কৃষ্ণসাগর  থেকে মর্মর সাগর ও এইজিয়ান সাগর পার হয়ে ভূমধ্যসাগরে অভিগমন সুবিধা (access) পাওয়া রাশিয়ার  জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার বিশাল ভূমির অন্যদিক থেকে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে রাশিয়ার উপায় কেবল বরফ শীতল উত্তর মহাসাগরের মধ্যে দিয়ে হাজার হাজার মাইল ঘুরে আসা। এই অভিগমন সুবিধার জন্য তাকে অটোমান তুরস্কের সাথে দেনদরবার করতেই হবে, কারণ মর্মর সাগরের সাথে কৃষ্ণসাগরের সংযোগকারী প্রণালীটি  চলে গেছে একেবারে ইস্তাম্বুলের পাশ দিয়ে এশিয়া ও ইউরোপের মাঝখান দিয়ে। রাশিয়ার লক্ষ্য ছিলো বুলগেরিয়াকে নিজের নিয়ন্ত্রণভুক্ত করতে পারলে হয়তো একসময় রুগ্ন অটোমান সাম্রাজ্যর কাছ থেকে এই প্রণালীটি কেড়ে নেয়া যাবে। রাশিয়া তাই কৃষ্ণসাগর তীরবর্তী বুলগেরিয়া ও রোমানিয়াকে স্লাভিক ভ্রাতৃত্বের কারণ দর্শিয়ে অটোমান শাসনের জোয়াল ভাঙতে সাহায্য করে। ১৮৭৭-১৮৭৮ সালের রাশিয়া-তুরস্ক যুদ্ধে রাশিয়া জয়ী হয়ে সান স্তেফানো চুক্তির মাধ্যমে (Treaty  of San Stefano) রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে স্বাধীন দেশ হিসাবে তৈরী করে।

 সান স্তেফানো চুক্তির বিস্তার ও ফলাফলে বলকানের ঐসব অঞ্চলকে নিজেদের উত্তরাধিকার বলে মনে করে আসা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভিতরে আলোড়ন শুরু হয়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরির শক্তিশালী বন্ধু ছিলো হঠাৎ করে ইউরোপে প্রবল পরাক্রমশালী ক্ষমতা হিসাবে আত্নপ্রকাশ করা জার্মানি। ইউরোপের অন্যান্য  ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যথা ফ্রান্স, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, স্পেন, ইতালি,  ইংল্যান্ড যেমন শত শত বছর ধরে জাতিরাষ্ট্র হিসাবে সংঘবদ্ধ ছিলো, জার্মানির  অবস্থা তেমন ছিলো না। পূর্বে ছিলো শক্তিশালী প্রুশিয়া (Prussia), আর  পশ্চিমে ক্ষয়িষ্ণু হোলি রোমান সাম্রাজ্যের মৌখিক অধীনস্ত ছোট ছোট কিন্তু উন্নত ও শক্তিশালী অনেকগুলো খণ্ডরাজ্য। ১৮৭১ সালে  ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে প্রুশিয়া ও এইসব ছোট ছোট খণ্ডরাজ্যের মিলিত শক্তি মিলে প্যারিস অবরোধ করে পরাক্রমশালী ফান্সকে টুঁটি চেপে ধরে পরাজিত করলে ভার্সাই প্রাসাদ থেকে সম্মিলিত জার্মানী আত্নপ্রকাশ করে। প্রুশিয়া  আগে থেকেই সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি ও শিল্পোন্নতির দিক থেকে শত শত বছরের  পুরাতন সাম্রাজ্যগুলোকে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলো। এখন সম্মিলিত জার্মানি এগিয়ে  চলছে আরো দুর্বার গতিতে। তাই হঠাৎ করেই জার্মানি হয়ে উঠে ইউরোপের রাজনৈতিক  জীবনের বড় মোড়ল। সান স্তেফানো চুক্তির ফলে নিজেদের উত্তরাধিকার মনে করা অঞ্চলগুলো রাশিয়ার ছত্রছায়ায় চলে যাওয়া নিয়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির ক্ষোভ, নতুনভাবে স্বাধীন হওয়া কিন্তু চারশ বছরের পুরাতন মোরাভিয়ান সাম্রাজ্যের স্বপ্নদোষে ভোগা সার্বিয়ার আশা-আকাংখা ও বলকান অঞ্চলে হঠাৎ করে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়া ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও তুরস্কের  মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার এইসব আশংকাকে প্রশমণ করার লক্ষ্যে নিরপেক্ষ ও নিঃস্বার্থ মধ্যস্থতাকারী হিসাবে জার্মানি ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের  আয়োজন করে।

 বসনিয়া-হার্যেগোভিনা

ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব আশা-আকাংখা ও  জাতীয় চেতনা নিয়ে নিজেদের ইচ্ছে মতো ছিনিমিনি খেলা বিশাল শক্তিধর সাম্রাজ্যগুলোর কাছে বলকানের এইসব ঝামেলা ছিলো তুচ্ছ উপদ্রবের মত। বার্লিন কংগ্রেসে প্রতিনিধি পাঠায় এইসব ছোটছাট অঞ্চলের অনেকেই, কিন্তু কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ও মধ্যস্থতাকারী জার্মান চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্ক এদের সবার  দাবী-দাওয়াকে উড়িয়ে দেন এটা বলে যে ‘এই যুদ্ধের আগে এসব জায়গার নামও কেউ কোনদিন শুনেনি’। একমাসব্যাপী চলা এই সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ স্বিদ্ধান্তগুলো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো বড় শক্তিগুলো। কংগ্রেস থেকে কেবল ঘোষণা দিয়ে সেগুলো  দাপ্তরিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কংগ্রেসের স্বিদ্ধান্তে সবচে বেশি আশাহত ও  ক্ষুব্ধ হয় রাশিয়া ও সার্বিয়া। সান স্তেফানো চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে ঘাড় চেপে ধরে আদায় করা বিশাল বুলগেরিয়াকে কেটে ছেটে অনেক ছোট করে ফেলা হয়। অনেকগুলো অঞ্চলের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয় তুরস্কের কাছে। অন্যদিকে সার্বিয়ার তুমুল বিরোধীতার মুখেও বসনিয়া-হার্যেগোভিনাতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সামরিক অধিকৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। শর্ত দেয়া হয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরি কেবল  সামরিকভাবেই অধিকৃত করে রাখবে বসনিয়া-হার্যেগোভিনাকে, নিজেদের সাম্রাজ্যের  অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না। এই একটি প্রায় তুচ্ছ স্বিদ্ধান্তই বিপুল  রক্তক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্নক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার সরাসরি ফলাফলে ঘটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের প্রথম ট্রিগার হিসাবে কাজ করে।

কেবল প্রাচীন মোরাভিয়ান সার্বিয়ার স্বপ্নকে বাদ দিলেও বসনিয়া-হার্যেগোভিনাকে নিজেদের বলে দাবী করার আরেকটি বড় কারণ ছিলো সার্বিয়ার। এই ডুয়াল প্রিন্সিপালিটির জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ ছিলো সার্বিয় বা স্লাভ নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকারের। বসনিয়া হার্যেগোভিনার জনগণের কোন ইচ্ছা ছিলো না অটোমান বা অস্ট্রো-হাঙ্গেরির অধীনে থাকার, অনেকটা বর্তমান কাশ্মীরের মত  অবস্থা। জনগণের একটা অংশ চাইতো স্বাধীনতা, আরেকটা অংশ চাইতো সার্বিয়ার সাথে একীভূতকরণ।

মিলন অথবা মৃত্যু

রুমেলিয়া, বোহেমিয়া, সোফিয়া, ভজভোডিনা, মোরাভিয়া, প্রিস্টিনা, বসনিয়া, সারাইয়েভো, ডলমাটিয়া, জাগরেব, স্কোপিয়া, সিরমিয়া। বলকান ও পূর্ব-ইউরোপীয় অঞ্চলের নামগুলোর মধ্যে কেমন যেন এক ধরণের স্বপ্নময় ভাবালুতা আছে। নাম শুনে এসব অঞ্চলকে রূপকথার একেকটা রাজ্যের মত ভ্রম হলেও মধ্যযুগ থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর শক্তিধর রাজনীতির ঐসব দিন পর্যন্ত এসব জায়গার জনগনের দৈনন্দিন জীবন ছিলো নামগুলোর স্বপ্নময় ভাবালুতার ঠিক বিপরীত। বাইরের শক্তির শাসন, সেটা নৃশংস অটোমানদের হোক আর গোলকধাঁধার  অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আমলাতন্ত্রের হোক, এসব অঞ্চলের মানুষের সুখ অথবা  অবকাঠামোর উন্নতির জন্য কিছুই করেনি। অটোমান তুর্কীদের কাছে এইসব জায়গা ছিলো নীলচোখের সাদা চামড়ার যৌন-দাসী ধরে আনার জায়গা, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান অভিজাতদের কাছে ছিলো নিজেদের সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রফল কত বড় সেটা নিয়ে একে অপরের কাছে গর্ব করার বিষয়। বসনিয়া হার্যেগোভিনার রুক্ষ্ম পাহাড়ী প্রকৃতি, তীব্র ও আত্না-হিম-করে-দেয়া শীত ও অভাব-নিঃসঙ্গতার মধ্যে নিজেদের জীবন পার করে দেয়া বয়স্কদের একটা অংশের কাছে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির অধীনস্ততা উল্টো কিছুটা সুখবর হয়েই এসেছিলো। মৃতপ্রায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য তখন কিছুটা আধুনিক হতে চেষ্টা করছিলো। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রত্যন্ত  অঞ্চলগুলোতে শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে কিছু কাজও শুরু করেছিলো।  সেই উন্নয়নের কিছুটা ছোঁয়া এসে লাগে বসনিয়া হার্যেগোভিনার রাজধানী সারাইয়েভোতে । কিন্তু স্বপ্নালু ও আদর্শবাদী তরুণদের মাঝে এই উন্নয়ন ছিল আসলে স্বাধীনতাচেতনা ও জাতিগত আদর্শকে ভোঁতা করে দেয়ার চক্রান্ত। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সামরিক শাসনের অধীনে তাই গোপনে জড়ো হতে থাকে স্বাধীনচেতা তরুনদের বিভিন্ন সংগঠন। এইসব সংগঠনকে আদর্শগত ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে আসছিলো সার্বিয়ান সামরিক বাহিনীর কিছু অভিজাত অফিসারদের দল। এদের ভিতরে সেই পুরনো মোরাভিয়ান সার্বিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ১৯০৩ সালে এরা সার্বিয়ার অস্ট্রো-হাঙ্গেরিপন্থী রাজা আলেক্সান্দর অব্রেনোভিচ (Aleksandar Obrenović) ও রাণী দ্রাগাকে (Queen  Draga) প্রাসাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হত্যা করে, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে রাশিয়াপন্থী কারাদজরজেভিচ (Karađorđević dynasty) পরিবারকে।

সার্বিয়ান সামরিক অভিজাতদের ছত্রছায়ায় বসনিয়া হার্যেগোভিনার আদর্শবাদী ও  সার্বিয়ার সাথে একীভূতকরণপন্থী তরুণদের একটি সংগঠনের নাম ছিলো মিলন অথবা মৃত্যু (Unification or Death) মিলন মানে হচ্ছে সার্বিয়ার সাথে একীভূতকরণ। একটা খুনের মাধ্যমে দুইটা বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাচক্রের সূচনা করে দেয়া গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ ছিলো এই দলের সদস্য। গ্যাভ্রিলো বড় হয়েছে পাহাড়ী  রুক্ষতা ও তীব্র নিঃসংগতা ও দারিদ্র্যের বসনিয়ায়। মেধার জোরে শিক্ষাবৃত্তি  নিয়ে সে চলে আসে সারাইয়েভোতে উচ্চতর শিক্ষার জন্য। সারাইয়েভোতে  অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শাসনের ও উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে তৈরী হওয়া বিলাসিতা ও জাঁক-জমকে তার রুক্ষ নিঃসঙ্গ আদর্শবাদী মন বিদ্রোহ করে উঠে। এর মধ্যে বার্লিন কংগ্রেসের শর্ত অগ্রাহ্য করে ১৯০৮ সালে বসনিয়া হার্যেগোভিনাকে নিজেদের সাম্রাজ্যের মধ্যে অধিভুক্ত করে নেয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরি। এই  অধিভুক্তির বিরুদ্ধে বড় শক্তিগুলোর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন কার্যকর  প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে পারেনি সার্বিয়া। রাশিয়াও তখন ১৯০৫ সালের  রুশো-জাপান যুদ্ধে জাপানের হাতে পরাজিত ও নাস্তানাবুদ হয়ে নিজেদের ক্ষত শুকানোতে ব্যস্ত। এই ক্ষোভ ও যন্ত্রণাকে প্রশমিত করার উপায় হিসাবে সার্বিয়ার সামরিক অভিজাতদের চক্র ও বসনিয়ার আদর্শবাদী তরুণরা তাই সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়।

সার্বিয়ার কাটা ঘায়ে লবণ ও লেবুর ছিটা দেয়ার জন্যই অথবা কাকতালীয়ভাবেই ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন সারাইয়েভোতে সামরিক প্রদর্শনী দেখতে আসেন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভাবি সম্রাট যুবরাজ আর্কডিউক ফ্রানয্ ফার্দিনান্দ (Archduke Franz Ferdinand)। প্রায় ছয়  শতাব্দী ধরে পুষে রাখা পরাজয় গ্লানি ও পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে কিছু একটা করতে চেয়েছিলো সার্বিয়ার সামরিক অভিজাতরা ও তাদের আদর্শে ও অর্থে লালিত বসনিয়া হার্যেগোভিনার আদর্শবাদী তরুণরা। ঠিক করা হয় আর্কডিউককে খুন করা হবে। আততায়ী দলকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্য করে Unification or Death এর সহায়ক সার্বিয়ান মিলিটারি অফিসার, ১৯০৩ সালের রাজহত্যার মূল নায়ক দ্রাগুতিন দিমিত্রিয়েভিচ (Dragutin Dimitrijević) আপিস স্বয়ং। কিন্তু যে আততায়ীর দল ঠিক করা হয় সেই দলের কেউ-ই সামরিকভাবে তেমন দক্ষ না; দারিদ্র ও নিঃসঙ্গতা ও শীতের কষাঘাতে বড় হওয়া কিন্তু অসম্ভব আদর্শবাদী কিছু রুগ্ন তরুণ। ফ্রানয্ ফার্দিনান্দের ২৮শে জুন সফরের সময়ক্রম, কোন রাস্তা দিয়ে কখন  যাবেন, কোথায় কী দেখবেন এইসব তথ্য ও পিস্তল, গ্রেনেডসহ বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহ করা হয় গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ ও তার দলের কাছে। দেয়া হয় সায়ানাইড ক্যাপসুল, যাতে ধরা পড়লে সাথে সাথে আত্নহত্যা করতে পারে। কিন্তু আততায়ীর দল প্রথমেই ভুল করে বসে – ফার্দিনান্দের গাড়িতে গ্রেনেড ঠিকমত  ছুঁড়তে পারে না; গ্রেনেড গিয়ে পড়ে পিছনের গাড়িতে। সেখানে কয়েকজন নিহত ও  আহত হলেও ফার্দিনান্দ নিজে ও তাঁর স্ত্রী অক্ষত থাকেন। গ্রেনেড যে  ছুঁড়েছিলো সে সায়ানাইড বের করে মুখে দিতে দেরী করে ফেলে, ফলে সায়ানাইডের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। পুলিশ তাকে ধরে ফেলে; অন্য আততায়ীরাও তাই মিশন বাদ দিয়ে যে যার মত পালিয়ে যায়। এর মধ্যে ফার্দিনান্দ হোটেলে ফিরে না গিয়ে আহতদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার স্বিদ্ধান্ত নেন। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একেবারেই দৈবভাবে মিশন বাতিল করে একটা রেস্তোরায় খেতে বসা গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপের সামনে পড়ে যায় ফার্দিনান্দের গাড়ি । গ্যাভ্রিলোর পকেটে তখনো  আপিসের দেয়া পিস্তল। সে পিস্তল বের করে গুলি চালায়। নিহত হন ফার্দিনান্দ ও  তার স্ত্রী সোফি। পূর্বের জনের মতো এবারও সায়ানাইড মুখে পুরতে দেরী করে ফেলে গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপ এবং পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। 

দুইটা বিশ্বযুদ্ধে কমপক্ষে ৮ কোটি মানুষের মৃত্যু, আরো অন্তত ১০ কোটিরও বেশি মানুষের পঙ্গু ও বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া, অবর্ণনীয় ক্ষতি, দুঃখ, স্বজন হারানোর ব্যথা, অশ্রু ও রক্তগঙ্গা,  এর সমস্ত শুরু হয়েছিলো কেবল এই একটা হত্যা দিয়ে। এই মৃত্যুর মাধ্যমে কার্যত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হলেও, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিজস্ব মানব-ক্ষয়ের পরিমাণ ছিলো প্রায় দুই কোটির মত। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ইতিহাস, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শত রকমের কারণ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে দ্বন্দ থাকলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপীয় অংশের সরাসরি ও সবচে প্রত্যক্ষ কারণ যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সেটা নিয়ে তেমন কোন  মতবিরোধ নাই। সেইদিক থেকে অনেক ইতিহাসবিদ দুইটা বিশ্বযুদ্ধকে আলাদা করে না দেখে বরং একটা দীর্ঘ, রক্তক্ষয়ী একক বিশ্বযুদ্ধ হিসাবেই দেখেন; মাঝখানের  বিশ বছর কেবল সাময়িক বিরতি ও রসদ সংগ্রহের অবসর। এমনকি রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও পরবর্তীতে স্টালিন এর গণহত্যার বীজও রোপিত হয়েছে  প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই। সে হিসাবে সোভিয়েত রাশিয়ার অধিভুক্ত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া গণহত্যাও সেই একটি গুলি থেকেই শুরু বলে ধরা যায়।

 ভিয়েনা

সার্বিয়া নিয়ে বিরক্তি ও ভয় দীর্ঘদিন ধরে দানা বেঁধে আসছিলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ভিতরে। ২৮ শে জুনের ঘটনার অনেক আগে থেকেই বলকান অঞ্চলে সার্বিয়ার আগ্রাসী মনোভাবের জবাবে সার্বিয়াকে দখল করে তার ভিতর থেকে পুরনো মোরাভিয়ান সার্বিয়ার স্বপ্নের বীজ পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা ছিলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান জেনারেলদের, বিশেষত সামরিক  বাহিনী প্রধান Count Franz Conrad von Hötzendorf এর। ভয় ছিলো কেবল  রাশিয়াকে নিয়ে। কিন্তু ২৮ শে জুনের ঘটনার পরে ভিয়েনা হতভম্ব ও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে। সার্বিয়া যদিও মুখে মুখে এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে আসছিলো কিন্তু গ্রেফতার হওয়া আততায়ীদের জেরার মাধ্যমে ভিয়েনা খুব সহজেই বুঝতে পারে যে পুরো ঘটনার পরিকল্পনা প্রশিক্ষণ ও রসদ সরবরাহ হয়েছে সার্বিয়ান সামরিক বাহিনীর অফিসারদের মাধ্যমে।

ঘটনার জবাবে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের ব্যবস্থা নেয় অস্ট্রো-হাঙ্গেরি। কিন্তু রাশিয়া সার্বিয়ার রক্ষক হিসাবে থাকায় এবং রাশিয়ার সাথে ফ্রান্সের কার্যত খোলামেলা কিন্তু কাগজে কলমে গোপন সহযোগীতার চুক্তি থাকায় হুট করে কোনপ্রকার কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণা করাটা বিশাল যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরী করবে দেখে ভিয়েনা প্রথমে সার্বিয়ার প্রতি আল্টিমেটাম দেয়ার স্বিদ্ধান্ত নেয়। এই  আল্টিমেটামের শর্ত তৈরী করতে জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সাথে কূটনৈতিক যোগাযোগ চালাচালি করতে গিয়ে দেরী করে ফেলে তারা। জার্মানির মধ্যে একপক্ষ বড় ধরণের যুদ্ধাবস্থা তৈরীর বিপক্ষে ছিলো। তাই তারা অস্ট্রো-হাঙ্গেরিকে যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে সবুজ বাতি দিলেও বলে দেয় যে দ্রুত ও আঞ্চলিকভাবে যুদ্ধ শেষ করে ফেলতে। কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন এটা মূলত ভিয়েনাকে জার্মানির দেয়া ব্ল্যাংক চেকের মত ব্যাপার। অর্থাৎ সার্বিয়াকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা হোক, যে কোন বিপদে জার্মানি পাশে থাকবে। জার্মানির সবুজ বাতি পেয়ে এবং ফ্রান্স এবং রাশিয়ার দুর্বলতার কথা  আন্দাজ করতে পেরে ভিয়েনা ১২-১৩টি শর্তের এক আল্টিমেটাম তৈরী করে সার্বিয়ার জন্য । এই আল্টিমেটাম ঘোষণা করা হয় ২৩শে জুলাই। আর্কডিউকের খুনের ২৫ দিন পর। প্রথম ও প্রধান শর্ত থাকে সার্বিয়ার ভিতরে বলকান অঞ্চলে অস্ট্রো-হাঙ্গেরির শাসনের বিরুদ্ধে সব রকমের প্রচার-প্রচারণা ও সর্ব-স্লাভিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করা এবং ফ্রানয ফার্দিনান্দের হত্যার সাথে জড়িত সব সামরিক বেসামরিক লোকজনকে বিচারের আওতায় আনা। এগুলো ছাড়াও এমন সব শর্ত জুড়ে দেয়া হয় যেগুলো কোন স্বাধীন জাতির পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। সার্বিয়া কোনভাবেই মানতে পারবে না এমনভাবেই শর্তগুলো তৈরী করা হয়। আরো অসম্ভব করে তোলার জন্য সার্বিয়াকে সময় দেয়া হয় মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সার্বিয়া রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ করে। রাশিয়া তখনও রুশো-জাপান যুদ্ধের ক্ষত সারিয়ে  তুলতে পারেনি। তাই রাশিয়া সার্বিয়াকে পরামর্শ দেয় শর্তগুলো মেনে নেয়ার  জন্য। সার্বিয়া শেষ পর্যন্ত মোটামুটিভাবে সবগুলো শর্তই মেনে নেয়, কেবল  একটি ছাড়া। শর্তটি ছিলো আর্কডিউক ফ্রানয্ ফার্দিনান্দের হত্যার বিচার সংক্রান্ত কাজে সার্বিয়ার ভিতরে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান পুলিশকে স্বাধীনভাবে তদন্ত চালানোর কাজ করতে দিতে হবে।

সার্বিয়া হয়তো আশা করেছিলো এই  শর্তটির অসারতা তথা অসম্ভাব্যতা অন্য বড় শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো সবাই বুঝবে; এটুকুর জন্য আর সর্বব্যাপী বড় যুদ্ধের ঝুঁকি কেউ নিবে না। কিন্তু  জার্মানির ভিতরে বিশেষত পুরনো প্রুশিয়ার সামরিক অভিজাতদের অনেকেই মুখিয়ে ছিলো বড় যুদ্ধের জন্য; তাদের স্মৃতিতে ছিলো ১৮৭১ এর ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ যাতে মাত্র দেড় মাসের মধ্যে পরাক্রমশালী ফ্রান্সকে চিড়িয়াখানার জন্তুর মত খাঁচায় পুরে ফেলেছিলো প্রুশিয়া। এবারের যুদ্ধের সুযোগে যদি নিজেদের সাম্রাজ্য আরো বিস্তৃত করে নেয়া যায় তাহলে ক্ষতি কী। এর মধ্যে ২৪শে জুলাই থেকে একটি ক্ষণস্থায়ী স্থানীয় যুদ্ধের সম্ভাবনা দ্রুত ফিকে হতে শুরু করে। ফ্রান্স তার সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি শুরু করে। রাশিয়াও শুরু করে তার বাহিনীর  পূর্বপ্রস্তুতি। ব্রিটেন স্বল্প সময়ের জন্য চেষ্টা করে সকল পক্ষকে ঠান্ডা করার কিন্তু দ্রুতই ব্যর্থ হয়। ভিয়েনাতে, বার্লিনে, প্যারিসে, মস্কোতে সবজায়গায় যুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। ২৮ শে জুলাই, আর্কডিউকের হত্যার ঠিক এক মাস পর ভিয়েনা সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই জার্মানি, রাশিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, সার্বিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গ ও ব্রিটেন এক জটিল বহুমুখী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

শ্লিফেন প্ল্যান (Schlieffen Plan)

প্রুশিয়ার সাথে পশ্চিম জার্মানীর ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর একীভূতকরণের মাধ্যমে বড় জার্মানি তৈরী হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রুশিয়ার চ্যান্সেলর অটো ভন বিসমার্কের নীতি ছিলো ইউরোপে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরী রেখে যুদ্ধ থেকে বেঁচে থেকে ফ্রান্সকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা রাখার। বড় জার্মানি তৈরী হয়ে গেলে ক্ষমতা ও সামরিক শক্তির দম্ভে জার্মানি বিসমার্কের সেই নীতি থেকে সরে আসে। এর প্রথম লক্ষণ দেখা যায় ১৮৭৮ এর বার্লিন কংগ্রেসে। সেখানে অনেকের দাবী-দাওয়া মেনে নিলেও এককভাবে সমস্ত কিছু রাশিয়ার কাছ থেকে আদায় করে  রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করতে দ্বিতীয় চিন্তা করেননি বিসমার্ক। তখন থেকেই জার্মান সামরিক বাহিনীর ভিতরে ভিতরে জানা হয়ে গেছে ইউরোপে কখনো যুদ্ধ লাগলে রাশিয়া জার্মানির বিপক্ষেই যাবে। অন্যদিকে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে ফ্রান্সের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া আলসাস-লোরেইন  (Alsace-Lorraine) অঞ্চল ফেরত পাওয়ার জন্য ফ্রান্স যেকোন যুদ্ধের সুযোগে জার্মানির উপর হামলে পড়বে এটা ধ্রুব সত্য ছিলো। জার্মানি তাই অনেকদিন ধরেই রাশিয়া ও ফ্রান্সের সাথে দুই  রণাঙ্গনে একত্রে যুদ্ধ চালানোর জন্য পরিকল্পনা করে আসছিলো। ১৮৯১ থেকে ১৯০৬  পর্যন্ত জার্মান সামরিক বাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আলফ্রেড ভন শ্লিফেন  (Field Marshal Alfred von Schlieffen) এই যুদ্ধের জন্য তাত্ত্বিক পরিকল্পনা তৈরী করেন ১৯০৫-৬ সালের দিকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী জার্মানি ফ্রান্সকে আক্রমণ করবে বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে। দক্ষিণে আলসাস-লোরেইন বা তারও  দক্ষিণে সুইজারল্যান্ডের ভিতর দিয়ে করা যাবে না, কারণ ঐসব অঞ্চলের ভূমি পাহাড়ী ও দুর্গম। অন্যদিকে বেলজিয়ামের ভূমি প্রায় পুরোপুরি সমতল। আর ফ্রান্সও ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে আলসাস-লোরেইন  দিয়ে ঢুকা জার্মান বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হওয়ার শিক্ষা থেকে সেখানকার  সীমান্তে ভয়ংকরভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্যসামন্তে সজ্জিত অনেকগুলো দূর্গ  তৈরী করে রেখেছে।

পুরো পরিকল্পনাটির অবশ্য একটি দূর্বলতা হচ্ছে এটা তৈরী করা হয়েছে রাশিয়ার সামরিক অদক্ষতা ও প্রস্তুতির দীর্ঘসূত্রীতাকে ধরে নিয়ে। ইউরোপের সামরিক হিসাব-নিকেশে তখন সবাই সাধারণ জ্ঞান হিসাবেই ধরে রেখেছিলো যে রাশিয়া একটু নড়াচড়া করতেই এক মাসের উপরে লেগে যাবে। শ্লিফেনের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিলো – রাশিয়া নড়াচড়া শুরু করার আগেই বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে ঘিরে ধরে ফেলতে হবে। বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে জার্মানির পুরো সৈন্যবাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে। ঘিরে ধরতে হবে এমনভাবে যাতে জার্মান বাহিনীর লাইন একেবারে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সেখানে জার্মান বাহিনীর প্রায় সমস্ত সৈন্য জড়ো থাকবে। প্যারিস দখল হয়ে গেলে ফ্রান্সকে নিস্ক্রিয় করে, সৈন্যসামন্ত পূর্ব  রণাঙ্গনে জড়ো করে রাশিয়াকে নিস্ক্রিয় করা হবে।

 ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট

শ্লিফেনপ্ল্যান  অনুযায়ী জার্মানি অগাস্টের ২ তারিখ লুক্সেমবার্গ দখল করে নেয় এবং বেলজিয়ামকে আল্টিমেটাম দেয় তার ভিতর দিয়ে জার্মান বাহিনীকে বিনা বাধায় পার হতে দেয়ার জন্য। বেলজিয়াম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জার্মানি ৪ তারিখ যুদ্ধ ঘোষণা করে  বেলজিয়ামে ঢুকে পড়ে। এই ঢুকে পড়াতে ইংল্যান্ডকেও তখন এগিয়ে আসতে হয়, কারণ  ১৮৩৯ সালের লন্ডন চুক্তি অনুযায়ী বেলজিয়ামকে চিরদিনের জন্য নিরপেক্ষ রাখার স্বিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো মূলত ব্রিটেনের চাপেই। আগ্রাসনের মাধ্যমে এই  নিরপেক্ষতা কেউ ভাঙলে ব্রিটেন সহ অন্যান্য পক্ষ আগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে বলে চুক্তিতে লেখা ছিলো। ব্রিটেন তাই ৪ তারিখেই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দেয়। এমনিতেও জার্মানি যখন  ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ৩ তারিখ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, ব্রিটেন তখনই নৌ-সাহায্য দিয়ে ফ্রান্সের উপকূল রক্ষা করার ঘোষণা দিয়েছিলো। সেই হিসাবে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা দেয়ার কিছু ছিলো না, কিন্তু জার্মানি আশা করে ছিলো ব্রিটেন যেহেতু মূলত নৌ-শক্তি, সেহেতু স্থলযুদ্ধের ময়দানে লন্ডন আসবে না। শ্লিফেনপ্ল্যানও তৈরী করা হয়েছিলো এই অবস্থা ধরে নিয়েই যে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও মূলত নৌশক্তি হওয়ায় ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের যুদ্ধে ব্রিটেন আসবে না ও বেলজিয়াম-লুক্সেমবার্গে জার্মান বাহিনী কোন প্রতিরোধের মুখে পড়বে না।  কিন্তু যুদ্ধ শুরুর প্রথম সপ্তাহেই জার্মানি দুই তিক্ত বাস্তবতার মুখে পড়ে। শ্লিফেনপ্ল্যান  কাগজে-কলমে চমৎকার এক আইডিয়া ছিলো। জার্মানির বাহিনীতে  শ্লিফেনের সুনামও ছিলো এমন চমৎকার কৌশল ভেবে রাখার জন্য। কিন্তু ময়দানে এই  প্ল্যানের বাস্তবায়নের সময় জেনারেল শ্লিফেন প্রায় এক যুগে ধরে অবসরপ্রাপ্ত  ও বয়োবৃদ্ধ। তাঁর প্ল্যান বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে জেনারেল ভন মল্টকার (Von Moltke the younger) ঘাড়ে। একে তো ব্রিটেন উৎসাহের সাথেই ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের যুদ্ধে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়, তার উপর বেলজিয়ামও অবিশ্বাস্য রকমের প্রতিরোধ দেখায় প্রথমেই। কারণ লন্ডন চুক্তিতে বড়  রাষ্ট্রগুলো বেলজিয়ামের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা স্বীকার করে নিলেও এবং সেগুলো রক্ষা করার জন্য দায়বদ্ধতা মেনে নিলেও, বেলজিয়াম জানতো কাগজের  চুক্তি আর মাঠের নোংরা রাজনীতি তথা রিয়েলপলিটিকের (Realpolitik) মধ্যে  পার্থক্য আছে। বেলজিয়াম তাই অনেকদিন ধরেই ঘোরতর বিপদের সময় নিজেদের রক্ষা  করার জন্য যথাসম্ভব করা যায় এমন শক্তি অর্জন করে আসছিলো।

Western Front Map

জার্মানির বিরুদ্ধে সাথে সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিলেও ব্রিটেনের স্থল সামরিক শক্তি বলতে তেমন কিছুই ছিলো না। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের  বিভিন্ন যুদ্ধের ভেটেরানদের বেসামরিক জীবন থেকে নতুনভাবে ডাকা হয় যুদ্ধে যাবার জন্য। তৈরী করা হয় ব্রিটিশ অভিযাত্রী বাহিনী (British Expeditionary  Force) বা বিইএফ। সব বয়সের সবাইকে ডেকে ব্রিটেন যখন গর্বভরে ঘোষণা দেয় যে তারা ৭০ হাজার অভিজ্ঞ ও পোড়-খাওয়া সৈনিকের বিশাল অভিযাত্রী বাহিনী  পাঠাচ্ছে তখন জার্মান জেনারেলরা নিশ্চয় তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন ব্রিটেনের এই বাহিনীর কথা শুনে। ফ্রান্স আর বেলজিয়ামও নিশ্চয় হতাশ হয়েছিলো, কারণ ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে স্থল যুদ্ধ ও সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত শত শত বছরের প্রথা ও সাধারণ জ্ঞান সব উলোট-পালোট হয়ে গেছে আরো একশ বছর আগে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উত্থানের সময়েই। ফরাসি বিপ্লবের পরে ফ্রান্স রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণীর অনেককে নৃশংসভাবে হত্যার কারণে একসাথে প্রায় পুরো ইউরোপ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। তখনকার ইউরোপে দেশ, রাজ্য ও প্রজা ভিন্ন হলেও রাজ-পরিবার ও অভিজাত শ্রেনী ছিলো সবাই মূলত একই  দলের। ব্রিটেনের রাজা ফ্রান্সের রাণীর চাচাতো ভাই, ফ্রান্সের রাণী রাশিয়ার  জারের খালাতো বোন, স্পেনের রাজা আবার জার্মানির কাইযারের ফুপাতো ভাই এই  ধরণের সব সম্পর্ক । অবস্থা এমন যে পূর্ব ইউরোপ ও বলকানের বিভিন্ন অঞ্চল যখন অটোমান তুরস্ক ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান শাসনের জোয়াল ভেঙে স্বাধীন হচ্ছে তাদেরও দেখা যেতো কোন না কোন একটা রাজ-পরিবার থেকে চুক্তিতে রাজা এনে নিজেদের সিংহাসনে বসাতে হতো। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে জাত্যাভিমান এতটাই নগ্ন ছিলো যে নতুন কোন জাতিগোষ্ঠী নিজেদের ভিতর থেকে নেতা তৈরী করে স্বাধীন হলে সেই স্বাধীনতা কেউ মানবে না; স্বাধীনতার কিছুদিনের মধ্যেই বড় কোন শক্তি সেই নতুন রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নেবে। এজন্য এবং বড় রাজপরিবার থেকে কাউকে  আনলে তার আত্মীয়তার সূত্রে অনেকগুলো বন্ধু রাজ্য পাওয়া যাবে, এই ভাবনা থেকে নতুন রাষ্ট্রগুলো সব ঘুরেফিরে অল্প কয়েকটা অভিজাত পরিবার থেকেই রাজা নিয়ে  আসতো । এরকম অবস্থায় ফ্রান্সের রাজপরিবার ও অভিজাত শ্রেণীকে যখন হত্যা করা হয়েছিল তখন সেইসব নিহতদের মধ্যে ইউরোপের সব রাজপরিবারেরই ঘনিষ্ঠ আত্নীয়স্বজন ছিলো। আর তাছাড়া বিশৃংঙ্খলার সুযোগে শত শত বছরের পুরাতন ও দুর্ভেদ্য  ফ্রান্সকে দখল করে নিজেদের রাজত্ব বাড়ানো যাবে এই চিন্তা থেকে ফরাসি  বিপ্লবের পরেই পুরো ইউরোপ প্রায় একসাথে ফ্রান্সকে আক্রমণ করে।

 এইসব আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ফ্রান্স তখন এক অকল্পনীয় কাজ করে বসে। গোটা ফ্রান্সের সমস্ত জনগনকে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে নিয়োজিত করে দেয়। অর্থাৎ ফ্রান্সের জীবনযাত্রার সমস্ত কিছু চলবে যুদ্ধকেন্দ্রিক। চাষবাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খেলা থেকে শুরু করে বেডরুমের ভালোবাসা পর্যন্ত। ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী শক্তিগুলোর কাছে এটা এক অকল্পনীয় ব্যাপার ছিলো। তারা সবাই চাইতো অস্ত্র, যুদ্ধ ও রাজনীতি নিয়ে সাধারণ প্রজাদের যত কম জড়ানো যায়। নিজেরা বসে ছিলো পারিবারিক সূত্রে নিজেদের ঘোষণা দেয়া অভিজাত রক্তের দোহাই  দিয়ে জনগণের ঘাড়ের উপর। সেই বসে থাকাকে নির্বিঘ্ন করতেই মূলত পেশাদার  সৈন্যবাহিনীর দরকার ছিলো। সাধারণ জনগণের মধ্যে যদি অস্ত্র যুদ্ধ আর  রাজনীতির জ্ঞান ঢুকে পড়ে, তাহলে সবাইকেই সিংহাসন ছেড়ে পালাতে হবে। ফরাসি  বিপ্লবের পরে ফ্রান্স যেহেতু জনগণেরই রাষ্ট্র ছিলো, তাই ফ্রান্সের এই ভয়  ছিলো না। এজন্য ইউরোপের অন্যান্য শক্তিগুলোর যেখানে ছিলো দশ-বিশ-চল্লিশ হাজারের ঘরের প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত বাহিনী, সেখানে ফ্রান্সের ছিলো স্বল্প-প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জায় দুর্বল হলেও সংখ্যার দিক থেকে লাখে লাখে এমনকি সময়ে মিলিয়নেরও ওপরের বিশাল বাহিনী। এই বিশাল বাহিনীর সংখ্যার  ধাক্কাতেই নেপোলিয়ন দুর্বার গতিতে ইউরোপের বিশাল অংশ দখল করে নিয়ে তাঁর সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। নেপোলিয়নের বাহিনীর মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তখন থেকেই  ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের সমরনায়করা নিজেদের রাজা, সম্রাট, কাইযার, জারের কাছে বাহিনী বড় করার আবেদন করতে থাকেন। ফলস্বরুপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোরও সৈন্যবাহিনীর আকার চলে যায়  লাখ থেকে মিলিয়নের ঘরে। তার ওপর আবার ছিলো রিজার্ভ ফোর্স। সে-জায়গায়  ব্রিটেন তার সত্তর হাজারের বিইএফ নিয়ে বেলজিয়ামকে রক্ষা করতে এলে এদের বাঁধাকে জার্মানি তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভাবেনি। এই বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে অভিজ্ঞ ও দক্ষ খুনী হলেও জার্মান বাহিনী প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ আর অস্ত্রে অন্য সমস্ত বাহিনীর তুলনায় উচ্চমানের ছিলো। অবশ্য ব্রিটেনও যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে যায় তার প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ক্ষুদ্র বাহিনী দিয়ে কাজ হবে না; নিজের দেশে কনস্ক্রিপশন ও ভলান্টিয়ার নিয়ে নিজের বাহিনী বড় করার কাজে লেগে যায়। যুদ্ধের শেষের দিকে গিয়ে দেখা যায় ব্রিটিশ বাহিনীর সংখ্যা পৌঁছে যায় বিশ লাখে।

 বেলজিয়াম

বেলজিয়ামের তীব্র প্রতিরোধ আর  ব্রিটিশ অভিযাত্রী বাহিনীর আগমনের কারণে জার্মানির শ্লিফেনপ্ল্যান বাস্তবায়নে প্রথমেই দুটো ধাক্কা লাগলেও সেগুলোকে মোটামুটি তুচ্ছ করেই দুর্বার গতিতে বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে দক্ষিণে ফ্রান্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো বিশাল জার্মান বাহিনী। ইতিহাসবিদদের মধ্যে সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও প্রায় ৭ থেকে ১০ লাখ সৈন্য ফ্রান্সকে ঘিরে ধরার উদ্দেশ্যে প্যারিসের দিকে আগাতে থাকে। অগাস্টের মাঝামাঝিতে ফ্রান্স-জার্মানি সীমান্ত থেকে শুরু করে বেলজিয়াম পর্যন্ত বিশাল ফ্রন্ট জুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হতে থাকে। এইসব  সংঘর্ষকে একত্রে ব্যাটল অফ দ্য ফ্রন্টিয়ার্স নাম দেয়া হয় – দুই বাহিনীর  মুখোমুখি অবস্থানের জায়গা ঠিক হওয়ার যুদ্ধ। ১৮৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকেই ফ্রান্সের দূর্গগুলো ও সামরিক শক্তি মূলত কেন্দ্রীভূত ছিলো জার্মানির সাথে সীমান্তবর্তী অঞ্চলেই। অগাস্টের তিন তারিখ জার্মানি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্স প্রথমেই সেই দিক থেকে আগাতে  থাকে আলসাস-লোরেইনের দিকে। প্রথম অগ্রযাত্রাতেই জার্মান বাহিনীর তীব্র  বাধার মুখে পড়ে ফ্রান্সের পদাতিক বাহিনী। জার্মানির ভিতরে আর্টিলারি বা  গোলন্দাজ বাহিনীর প্রযুক্তি কী পরিমাণ উন্নত হয়েছে, সে সম্পর্কে ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর জ্ঞান ছিলো খুবই কম। ফ্রান্সের নিজেরও গোলন্দাজ বাহিনী  ছিলো, কিন্তু জার্মানির আর্টিলারি শক্তি ছিলো ভয়াবহ রকমের নিখুঁত ও বিধ্বংসী। ফ্রান্স আর্মি সাহসে ও স্বদেশপ্রেমের চেতনায় বলীয়ান ছিলো। কিন্তু এই যুদ্ধেই প্রথমবারের মত প্রায় প্রতিটি বড় শক্তিই প্রথম কয়েক  সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে যায় শত শত বছরের পুরনো এইসব গুণ দিয়ে এখনকার যুদ্ধে  আর কোন লাভ হবে না। জার্মান সীমান্তের দিকে অগ্রসর হতে চাওয়া ফ্রান্সের  বাহিনী তাই শুরুতেই জার্মান আর্টিলারির শেলের আঘাতে কচুকাটা হতে থাকে। একেকদিনের যুদ্ধেই ফ্রান্স হারাতে থাকে হাজারে হাজারে সৈন্য। পঙ্গু, বিকলাঙ্গ আর জার্মান বাহিনীর হাতে বন্দী হয় আরো অসংখ্য ।

দক্ষিণ দিকে খুব বেশি সুবিধা করার উপায় না দেখে ফ্রান্সের সমরনায়ক জোসেফ জফরা তাই  দক্ষিণের বাহিনীকে কেবল জার্মান বাহিনীকে যতটা সম্ভব ব্যস্ত রাখা যায় সেই দায়িত্ব দেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে উত্তরে বেলজিয়ামে ও লুক্সেমবার্গের কাছে জার্মান অগ্রসরমান বাহিনীতে যাতে জার্মানি তার সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা। কিন্তু বেলজিয়ামের ভিতরে জার্মানি ঠিক কী পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আর কতটা ব্যাপ্তি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এই ধারণা কারো ছিলো না। শ্লিফেন প্ল্যানের খবর তো আর সবার কাছে ছিলো না। প্ল্যানটা গোপন নথি  হিসাবেই ছিলো জার্মানির কাছে। উত্তরের ফরাসি বাহিনীর অধিনায়করা জফরার  কাছে বারবার খবর পাঠাচ্ছিলো যে বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে অকল্পনীয় সংখ্যায় জার্মান সেনা ফ্রান্সকে ঘিরে ধরার জন্য আগাচ্ছে। জফরা জার্মানির প্ল্যান বুঝে উঠতে পারেন না। এখনকার দিনের মত স্যাটেলাইট, এরোপ্লেন এইসব প্রযুক্তি  তখন ছিলো না। টেলিগ্রাফ, টেলিফোনের মাধ্যমে ময়দান থেকে পাওয়া রিপোর্ট  দেখে তাঁর মনে হয় দক্ষিণেও যদি জার্মান বাহিনীর শক্তি বিশাল হয়, আবার  উত্তরেও যদি বিশাল হয় তাহলে নিশ্চয়ই মাঝখানে কোথাও না কোথাও দুর্বলতা আছে।  জফরা তাই জার্মান বাহিনীকে মাঝখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্য তার বাহিনীকে পাঠান জার্মান লাইনের মধ্যবর্তী অঞ্চলের দিকে। কিন্তু জার্মানি আঁটঘাঁট বেধেই নেমেছিলো। জার্মানির পুরো শক্তি ও এমনকি রিজার্ভ ফোর্সকেও নামানো হয়েছিলো যুদ্ধে। ফলে মাঝখান দিয়ে আক্রমণ করতে গিয়ে অগাস্টের শেষের দিকে ফরাসি বাহিনী আবার বিশাল ধাক্কা খায়। অগাস্টের শেষের সংঘর্ষগুলোতে অগ্রসর হতে গিয়ে হাজারে হাজারে সৈন্য হারিয়ে ফরাসি বাহিনী তাই  শেষ-পর্যন্ত নিজেদের দূর্গায়িত অঞ্চলে আত্নরক্ষামূলক অবস্থানে চলে যেতে  বাধ্য হয়।

এদিকে উত্তরে ব্রিটিশ অভিযাত্রী বাহিনীর সাথে জার্মান  বাহিনীর প্রথম সংঘর্ষে অভিজ্ঞ ব্রিটিশ পুরাতন বাহিনী প্রায় সফলভাবে জার্মান বাহিনীকে আটকে দিতে সক্ষম হলেও তাদেরও কোন ধারণা ছিলো না যে পিছনে মহাসাগরের বিশাল ঢেউয়ের মত জার্মান বাহিনী আসছে। তাদের বাধাকে তুচ্ছ করে জার্মান বাহিনী যখন আগাতে থাকে তখন বিইএফ পিছু হটতে থাকে প্যারিসের দিকে। শুধু তারা একা পিছু হটতে থাকলে ফেঞ্চ লাইনের সাথে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন হয়ে গেলে ঘেরাও হয়ে পড়ার আশংকা থাকায় তাদের সাথে সাথে ফরাসি বাহিনীও পিছু হটতে থাকে। এই ঘটনাকে দ্য গ্রেট রিট্রিট (the great retreat) বলা হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসে। জার্মান বাহিনীর শক্তি দেখে ব্রিটিশ বাহিনী এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে এক পর্যায়ে এইসব যুদ্ধটুদ্ধ ফেলে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ব্রিটেনে পালিয়ে যাওয়ার উপায়ও খুঁজতে থাকেন বিইএফ এর জেনারেল স্যার জন ফ্রেঞ্চ। কিন্তু ফ্রান্স ও ব্রিটেনের উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক দর-কষাকষির  মাধ্যমে বিইএফকে বিরত করা হয় পালিয়ে যাওয়া থেকে।

এদিকে জার্মানি সামনের দিকে প্যারিসকে লক্ষ্য করে ছুটে যেতে থাকলে সৈন্যদের মধ্যে দীর্ঘ  যুদ্ধ ও ক্রমাগত যাত্রা ক্লান্তি ভর করতে থাকে। তখনকার সমস্ত যাত্রাই  ছিলো প্রায় পুরোটাই পায়ে হেঁটে; নিজেদের দেশ না বলে রেলওয়ে ব্যবহার করার  উপায় নাই, গাড়ী বা বিমানের প্রযুক্তি তখনও কেবল নতুন। এত বিপুল সংখ্যক  সৈন্য পরিবহনের কোন উপায় নাই। তার উপর পথে পথে প্রতিপক্ষের বাধাতো আছেই। জুলাইয়ের শেষে রাশিয়া এরই মধ্যেই অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সার্বিয়া আগ্রাসনের  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছিলো। জার্মান  বাহিনীর বেলজিয়ামের ভিতর দিকে প্যারিসের দিকে আগানোর সুযোগে রাশিয়া পূর্ব  দিক থেকে পুরনো প্রুশিয়ার ভিতরে ঢুকে যেতে থাকে। জার্মান জেনারেল ভন মল্টকাকে তাই বাধ্য হয়ে পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে বিশাল সংখ্যক সৈন্য পাঠাতে হয় পূর্ব দিকে। শ্লিফেনপ্ল্যানের ধরে নেয়া আরেকটি ধ্রুব সত্য, রাশিয়া কিছুতেই  কয়েক মাসের আগে আক্রমণ করার মত অবস্থায় যেতে পারবে না, সেটাও মিথ্যা হয়ে  যায়। রাশিয়া মূলত ১৮৭৮ সালের বার্লিন কংগ্রেসের পর থেকেই জার্মানির উপর  ক্ষুব্ধ ছিলো। এর উপর আবার রুশো-জাপান যুদ্ধে নাস্তানাবুদ হয়ে বড় শক্তিগুলোর হাসির পাত্রে পরিণত হওয়ায়, তার গৌরব ধরে রাখার জন্য রাশিয়া গোপনে অনেক দিন থেকেই বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। পোল্যান্ড তখনো  রাশিয়ান সাম্রাজ্যের একটা অঙ্গরাজ্য। সেখানে রাশিয়ার বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে ধীরে ধীরে অন্যদের প্রায় অগোচরে জড়ো করে আসছিলো অনেক দিন থেকেই।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার দায়ে অপরাধী হিসাবে সাধারণভাবে জার্মানি, সার্বিয়া, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে দোষারোপ করা হলেও এইসব কারণে অনেক ইতিহাসবিদ রাশিয়াকেও এই দোষের একটা বড় অংশ নিতে হবে বলে মনে করেন। কারণ রাশিয়া ভিতরে ভিতরে নিজের গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য একটা যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে  ছিলো অনেক দিন ধরেই। পূর্ব দিক থেকে প্রুশিয়া আক্রমণ করে কিছুটা প্রাথমিক  সাফল্য পেলেও প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্রে অনেকগুনে উন্নত জার্মান বাহিনীর হাতে কচুকাটা হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়া তার বাহিনী গুটিয়ে প্রুশিয়া থেকে পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই কিছুদিনের ক্যাম্পেইনেই  জার্মানিকে আদি ও আসল শ্লিফেন প্ল্যান  থেকে সরে আসতে বাধ্য করে রাশিয়া।

পূর্ব রণাঙ্গনে সেনাবাহিনীর একটা অংশকে পাঠাতে বাধ্য হওয়ায় ও সৈন্যদের  ভিতরকার ক্লান্তি এবং বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও বিইএফএর অভাবনীয় দৃঢ় প্রতিরোধের মুখে তাই প্যারিসের দিকে অগ্রসর হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে জার্মান বাহিনী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। আরো দূর থেকে ফ্রান্সকে ঘিরে ধরার চিন্তায় জার্মানি তার বাহিনীকে আরো উত্তরের দিকে সরে যেতে নির্দেশ দেয়। এই সুযোগে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের বাহিনী এবার নিজেদের পলায়ন পথ থেকে ঘুরে জার্মান বাহিনীর  মুখোমুখি হওয়ার জন্য দাঁড়ায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে যায় যে জার্মানি এবার  উল্টো তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ফ্রান্সের বাহিনীর হাতে ঘেরাও হওয়ার আশংকায় পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ব্রিটেন ফ্রান্সও জার্মান বাহিনীকে তাড়া করে। শুরু হয় ব্যাটল অফ মার্ন। মার্ন নদীর তীর ঘেঁষে জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত  প্রতিরোধ গড়ে তুলে ফ্রান্স আর ব্রিটেন। এই যুদ্ধে প্রযুক্তি প্রস্তুতি ও  দক্ষতায় অনেক পিছিয়ে থেকেও ব্রিটেন ফ্রান্সের মিত্রবাহিনী জার্মানিকে পিছু হঠতে বাধ্য করতে পারা প্রায় অবিশ্বাস্য রকমের এক সাফল্য। অনেক জায়গায় তাই এই যুদ্ধকে মিরাকল অফ মার্নও বলা হয়। বিশেষত ফ্রান্স ও ব্রিটেনের নিজস্ব বয়ানে। জিতে যাবার পর নিজেদের গৌরবগাঁথা ছাড়া ভাগ্য, জার্মানির পরিকল্পনার  পরিবর্তন বা রাশিয়ার সাহায্যের কথা কেই-বা ভাবতে চাইবে?

কসাইখানা – ভারডান ও সম

মার্নের যুদ্ধে সফলতা পাবার পর উজ্জীবিত  ব্রিটেন ও ফ্রান্স বাহিনী জার্মানিকে তাড়া করতে থাকলে জার্মান অগ্রসর বাহিনী পিছু হটে, কিন্তু পেছনে থাকা বিশাল জার্মান বাহিনীকে উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেয়া হয় এইন (River Aisine) নদীর উত্তর তীরে ট্রেঞ্চ খুড়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হতে। এদিকে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বাহিনী জার্মান বাহিনীকে ঘিরে ধরার জন্য আর উল্টোদিকে জার্মান বাহিনী ফ্রান্স ব্রিটেনের বাহিনীকে ঘিরে ধরার জন্য কেবল উত্তরের দিকে সরতে থাকে শত্রুপক্ষের লাইনের সর্বশেষ প্রান্ত খুঁজে পাবার লক্ষ্যে। দুই পক্ষই ব্যর্থ হয়। ফল দাঁড়ায় যে একেবারে ইংলিশ চ্যানেলের তীর থেকে শুরু করে দক্ষিণে  সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল বড় এক ফ্রন্ট ধরে দুই বাহিনী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, কেউ কাউকে ঘিরে ধরার সুযোগ ছাড়াই। শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি, তখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে রক্তক্ষয়ী ও সবচে ভয়াবহ স্থির যুদ্ধ। চার বছর ধরে হাজার হাজার খণ্ডযুদ্ধ, হাজার হাজার ছোটখাট  পরিবর্তন হয়, কিন্তু প্রায় একই ফ্রন্ট থেকে বেশীদূর আগাতে পারে না কোন  বাহিনীই। রণাঙ্গনে দুই পক্ষের অবস্থানের তেমন বেশী পরিবর্তন না হলেও এই  চার বছর ধরে পশ্চিম রণাঙ্গনে চলতে থাকে ভয়াবহ রকমের মানব ক্ষয় ও বিপর্যয়।  এতটাই ভয়াবহ ছিল এই পশ্চিম রণাঙ্গন যে এর নাম হয়ে যায় দ্য মিট গ্রাইন্ডার  (The Meat Grinder) বা মাংসের কিমা বানানোর যন্ত্র। অবশ্যই মানুষের মাংস। এই ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হচ্ছে দুই পক্ষেরই আর্টিলারি প্রযুক্তির অবিস্মরণীয় উন্নতি। দুইদিক থেকে ক্রমাগত দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, রাত-দিন চলতে থাকে আর্টিলারি শেল এর আক্রমণ। ট্রেঞ্চের ভিতরে সৈন্যদের অবস্থা খুব দ্রুতই  বিপর্যয়ের দিকে যেতে থাকে। ট্রেঞ্চের বাইরে একটা আংগুল উঠালেই নিমিষেই সেটা উড়ে যায় অন্য পক্ষের শেলের আঘাতে। এই যুদ্ধের এক জার্মান সৈনিক পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নাম দেন ইস্পাতের ঝড় (a storm of steel)।  ইস্পাতের এই ঝড় থেকে বাঁচতে তাই দুইপক্ষের সৈনিকদের খাওয়া-দাওয়া, প্রকৃতির  ডাকে সাড়া দেয়া, আহতদের সেবা, নিহতদের লাশ রাখা সমস্ত কিছু একই জায়গায় ঘটে।  দুর্গন্ধে, রোগে, তার উপর দিনরাত আর্টিলারি শেলের ধাঁধা লাগানো শব্দে অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তখন পর্যন্ত যুদ্ধের ইতিহাস ও সামরিক সাহিত্যে সৈনিকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু ছিলো না। এই তীব্র ভীতিকর ও অসুস্থ্য পরিবেশে পাগল হয়ে কেউ ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে পালিয়ে গেলে তার বিচার করা হতো পক্ষ-ত্যাগকারী হিসাবে। শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

Photo: AP

দীর্ঘমেয়াদে এই অচলাবস্থা ভাঙতে দুই পক্ষই শতশতবার চেষ্টা করেছে শত্রুপক্ষের লাইনের মধ্যে কোথাও একটা ছিদ্র বের করতে। এর মধ্যে সবচে  রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ ও প্রায় অতিপ্রাকৃতিক দুইটা হচ্ছে ভারডানের যুদ্ধ (Battle  of Verdun) ও সমের যুদ্ধ (Battle of the Somme)। ভারডান ছিলো ফ্রান্স-জার্মানি সীমান্তে ফ্রান্সের সবচে কঠোর ও অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত  দূর্গায়িত অঞ্চল, সেই ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর থেকেই।

মার্নের  যুদ্ধের সময়ে পশ্চিম রণাঙ্গণের জার্মান জেনারেল ফন মল্টকা স্নায়ুবৈকল্যে পড়লে নতুন জেনারেল হিসাবে দায়িত্ব নেন এরিক ভন ফল্কেনহাইন (Erich von  Falkenhayn)। ভারডান নিয়ে ফল্কেনহাইনের চিন্তা ছিলো শত্রু ফ্রন্টে ছিদ্র তৈরী করা নয়, বরং ফ্রান্সের যত বেশি ক্ষতি করা যায়, সেটা নিশ্চিত করা। ফল্কেনহাইন ধরে নিয়েছিলেন ফ্রান্স তার ঐ অঞ্চলকে রক্ষা করতে সর্বশক্তি  নিয়োগ করবে। ভারডানের ল্যান্ডস্কেইপ ছিলো দুর্গম, পাহাড়ী জংগলে ভরা।  সেখানে ১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিটি জংগলে,  প্রতিটি টিলায় লাখে লাখে আর্টিলারি শেল আর মেশিনগানের গুলিতে পুরো অঞ্চলকে চষে ফেলে দুই বাহিনীই। এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি এতই উদ্ভট ও বিশৃংখলাপূর্ণ ছিলো যে কেবল সেখানকার একেকটা খণ্ডযুদ্ধ নিয়েও আস্ত বই লেখা হয়েছে সামরিক ইতিহাসে। একেকটা টিলা, একেকটা জঙ্গল হাত বদল হয়েছে কয়েকবার, কয়েক ডজন বার  করে। আর ট্রেঞ্চের ভিতরের অবর্নণীয় অবস্থাতো রয়েছেই। এখনো, এই এক  শতাব্দী পরেও, ভারডানে বাড়ী করার জন্য মাটি খুঁড়তে গেলে নাম না-জানা  সৈনিকদের হাড়গোড় পাওয়া যায়।

১৯১৬ সালেরই জুলাই থেকে নভেম্বরের  মধ্যে ব্রিটেন ও ফ্রান্স পরিকল্পনা করে Somme নদীর তীরে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে অচলাবস্থা ভাঙ্গার। প্রথমে দ্বৈতভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা থাকলেও ভারডানে  ফ্রান্সের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি এমন পর্যায়ে চলে যায় শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনই  আক্রমণের মূল অংশ পরিচালনা করে। কিন্তু ততদিনে জার্মান বাহিনী তাদের দিকে  কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে, ট্রেঞ্চের অবস্থা অনেক উন্নত করেছে।  অন্যপাড় থেকে তারা শত্রুপক্ষের যুদ্ধ-প্রস্তুতির সবকিছুই দেখেছে। তারা শতবার প্র্যাক্টিস করে রেখেছে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর কিভাবে প্রতিরোধ করা হবে। কিন্তু ব্রিটিশ জেনারেলদের দাবী ছিলো আর্টিলারি আক্রমণে কাঁটাতারের বেড়া উড়ে যাবে। সেই অনুযায়ী আক্রমণ শুরুর প্রথম সপ্তাহ কেবল ক্রমাগত  আর্টিলারি শেল ছুঁড়ে ব্রিটেন, এত বিশাল পরিমাণে যে পূর্বের সমস্ত রেকর্ড  ভেঙ্গে প্রায় দুই কোটি শেল ছুঁড়া হয় মাত্র এক সপ্তাহে। কিন্তু পদাতিক  বাহিনীকে যখন পাঠানো হয়, মাঠে নেমে তারা দেখে তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি কাঁটাতারের বেড়ার। কারণ আর্টিলারি শেলগুলো ব্যবহার করা হয়েছে পদাতিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ছোট ছোট স্প্লিন্টারে ভরা যেসব শেল সেগুলো দিয়ে। ফলে  অগ্রসর হতে চাওয়া ব্রিটিশ বাহিনীকে জার্মান বাহিনী নিজেদের সুরক্ষিত অবস্থান থেকে মেশিনগানের গুলিতে কচুকাটা করতে থাকে। এই আক্রমণে ক্ষয়ক্ষতি এমন পর্যায়ে যায় যে কয়েক ব্যাটেলিয়নকে কচুকাটা হতে দেখে অনেক ব্যাটেলিয়ন পরিকল্পনা পরিবর্তন করে থেমে যায়। কিন্তু নির্বোধের মত ব্রিটিশ জেনারেলরা  লাখে লাখে সৈন্য পাঠাতে থাকে কচুকাটা হওয়ার জন্য। সমের যুদ্ধের ব্রিটিশ জেনারেল স্যার ডগলাস হেইগকে (Douglas Haig ) ব্রিটেনে কসাই নাম দেয়া হয়, বুঝতে পারার পরও অনর্থক লাখে লাখে সৈন্যকে মাংসের কিমা বানানোর যন্ত্রে ঠেলে পাঠানোর জন্যে। এখনও ব্রিটেনে এই ইস্যুতে ঐতিহাসিকদের মধ্যে তুমুল  তর্কবিতর্ক ও ক্ষোভ প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়।

মারণ গ্যাস, সাবমেরিন এবং জার্মান যুদ্ধাপরাধ

পশ্চিম রণাঙ্গনের অচলাবস্থা ভাঙার জন্য জার্মানি একবার পরীক্ষামূলকভাবে ক্লোরিন গ্যাস আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের আগে থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন সম্মেলনে যুদ্ধের অনেক আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন ঠিক করা হয়, আদতে হাস্যকর হলেও। তার  মধ্যে একটা ছিলো আর্টিলারি আক্রমণে কোনপ্রকার মারণ-গ্যাসের ব্যবহার করা যাবে না। জার্মানির ভিতরে বিরোধীতার মুখেও কিছু সূক্ষ্ম বুদ্ধির আইনজীবি পরামর্শ দেয় আর্টিলারি আক্রমণে ব্যবহার না করে বাতাস যখন জার্মান দিকে থেকে  মিত্রশক্তির দিকে থাকবে তখন কেবল গ্যাস-সিলিন্ডারের মুখ খুলে রাখার জন্য। ১৯১৫ সালের এপ্রিলে বেলজিয়াম ফ্রন্টে ভয়াবহ ক্লোরিন গ্যাসের আক্রমণে বিপর্যয়ের মুখে প্রায় ছয় মাইলব্যাপী ছিদ্রও তৈরী হয় মিত্রশক্তির লাইনে,  কিন্তু জার্মানি খুব বেশি সিরিয়াস পরিকল্পনা করেনি এই আক্রমণ নিয়ে, তাই  দ্রুতই এই ছিদ্র মেরামত করে ফেলে মিত্রশক্তি। কিন্তু এমন ভয়াবহ ও এমনিতেই নিষ্ঠুর বর্বর যুদ্ধে আরো বর্বর এই গ্যাস আক্রমণ পুরো বিশ্বে জার্মানির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জাগিয়ে তুলে।

জার্মানি আরেকটি যুদ্ধাপরাধ করে তার সাবমেরিন  দিয়ে। যুদ্ধের আগে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে নৌশক্তির তীব্র প্রতিযোগীতা যুদ্ধের একটা কারণ হিসাবে অনেকে উল্লেখ করলেও জার্মান বাহিনীর আসলে তেমন  নৌশক্তি ছিলো না। সেই শক্তিতে তখনকার গোটা পৃথিবীতে বৃটেনই ছিলো একচ্ছত্র অধিপতি। যুদ্ধ ঘোষণার প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো পৃথিবীর সাথে  জার্মানির নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন করে দেয় বৃটেন তার নৌবাহিনী দিয়ে। ফলে  পশ্চিম রণাঙ্গনের অচলাবস্থা মূলত হয়ে উঠে war of attrition বা অর্থনৈতিকভাবে চেপে ধরার যুদ্ধে। জার্মান নৌবাহিনী পৃথিবীর সাগরে বের হতে না পারলেও তাদের ছিলো ভালো সাবমেরিন প্রযুক্তি। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে তাই ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য জার্মানি শুরু করে নির্বিচার সাবমেরিন আক্রমণ – সামরিক বেসামরিক  পণ্যবাহী যে কোন জাহাজকে ডুবিয়ে দেয়া। এ কাজ করতে গিয়ে অবশ্য জার্মানি কোন সুবিধা করতে তো পারেনি উল্টো তার পতন ত্বরান্বিত করে। এর আগে ১৯১৫ সালেই ১২০ জন আমেরিকান যাত্রীসহ ব্রিটিশ জাহাজ লুসিটেনিয়াকে ধ্বংস করার জন্য  আমেরিকার ক্ষোভ ছিলো জার্মানির বিরুদ্ধে। কিন্তু ইউরোপের যুদ্ধে  অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া ও কিছুটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের শান্তিবাদী নীতির জন্য আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে ধৈর্য্য ধরে থাকলেও  নির্বিচার সাবমেরিন হামলা শুরু করার পরে আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ  ঘোষণা করে।

পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ

পূর্বদিকে যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে রাশিয়া সফলভাবে জার্মানির শ্লিফেনপ্ল্যানের বাস্তবায়নকে ভণ্ডুল করে দেয়ার পরে আর তেমন বেশি কোন সাফল্য পায়নি। তবে মিত্রশক্তির জয়ের জন্য  রাশিয়ার একটা বড় অবদান হচ্ছে জার্মান বাহিনীর একটা অংশকে ক্রমাগত এই দিকে ব্যস্ত রাখা যাতে পশ্চিমে ব্রিটেন আর ফ্রান্স মিলে কোনরকমে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। এই ব্যস্ত রাখায় অবশ্য রাশিয়া নিজে অবর্ণনীয় পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করে নেয়। আর সব বাহিনীর মত রাশিয়ার বাহিনী প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ অস্ত্র বা  দক্ষতা কোনদিক থেকেই জার্মানির সমপর্যায়ের ছিলো না। লাখে লাখে সৈন্য দিয়ে মানবঢাল তৈরী করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো তার সফলতা। রাশিয়ার একমাত্র সফল  আক্রমণ ছিলো জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভের (Aleksei Brusilov) নামে খ্যাত  ব্রুসিলভ অফেন্সিভ । ১৯১৬ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্তমান  ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্তের বিশাল একটা অংশজুড়ে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির  সীমান্তের ভিতরে ঢুকে বেশ কিছুদূর অগ্রসরও হয় ব্রুসিলভের সৈন্যরা। এই  আক্রমণের সবচে বড় সাফল্য হচ্ছে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির বাহিনীকে প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। যুদ্ধ শুরুর প্রথম মাসের মধ্যে দুর্বল সার্বিয়াকে  পুরোপুরি ধ্বংস করে দিলেও যুদ্ধের জন্য উম্মুখ থাকা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির  সামরিক শক্তি বলতে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না। ডজনের উপরে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিয়ে তৈরী তাদের সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা যদিও বেতন আর সুবিধার জন্য চাকরি করতো, কিন্তু গোলকধাঁধার ভিয়েনা নীতি নিয়ে আগে থেকেই সন্তুষ্ট ছিলো না। এখন এইসব স্লাভিক সৈন্যদের কাছে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পক্ষ থেকে তাদের  জাতিগত ভাই রাশিয়ান স্লাভদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা উদ্ভট ও অনৈতিক লেগেছিলো। কারণ এই অনর্থক দোযখের মত যুদ্ধের অবস্থা তৈরী হয়েছে এইসব  সৈন্যদেরই জাতিগত ভাই স্লাভ গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপের হাতে তাদের বিদেশী শাসক  আর্কডিউক ফ্রানয্ ফার্দিনান্দের খুনের কারণে। এই খুনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য  নিজের জাতভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবে কি, অনেকে উল্টো খুশিই হয়েছিলো গ্যাভ্রিলো প্রিন্সিপের কাজে। ব্রুসিলভ অফেন্সিভের সময়ে অনেক স্লাভিক সৈন্য তাই রাশিয়ান বাহিনীর দেখা পাওয়া মাত্র বিনা বাধায় আত্নসমর্পণ করে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাথে সাথেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে। জার্মানি পড়ে যায় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে নিয়ে উল্টো মহা সমস্যায়। গলায় বাঁধা পাথরের মত তাদেরকে টেনে নিতে হয় জার্মানিকে। ভারডানের কসাইখানা থেকে বিপুল পরিমাণ সৈন্য পাঠাতে হয় পূর্ব রণাঙ্গনে। ফলে পশ্চিম রণাঙ্গনে  ভারডানে জার্মানির উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়।

Eastern Front Map

এদিকে ইংল্যান্ডের  আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চলমান যুদ্ধ নিয়ে দুইটা ভাগ দেখা যায়। একপক্ষের কথা হচ্ছে যুদ্ধ যদি জিততে হয় তাহলে পশ্চিম রণাঙ্গনের কসাইখানাতেই জিততে হবে।  যত জীবন যায় যাক অথবা যত ধরণের নতুন পদ্ধতির চেষ্টা করে দেখা হোক। আরেক  পক্ষের তত্ত্ব ছিলো পশ্চিম রণাঙ্গনে মিট গ্রাইন্ডারে কেবল লাখে লাখে  তরুণদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দিয়ে বরং অন্য জায়গাগুলোতে জার্মানি ও  তার মিত্রদের ধ্বংস করে দিলে পশ্চিম রণাঙ্গনে জার্মানি নিজে থেকেই পিছু  হঠতে বাধ্য হবে। এই পক্ষের সবচে বড় প্রবক্তা ও সমর্থক ছিলেন উইনস্টোন চার্চিল (Winston Churchill)। চার্চিলের পরামর্শ ছিলো শুরু থেকেই জার্মানির পক্ষে থাকা ও ১৯১৪’র অক্টোবরে অফিশিয়ালি যুদ্ধ ঘোষণা করা অটোমান তুরস্ককে  আগে পরাজিত করা। এর মধ্যে অবশ্য কিছুটা ব্রিটেনের একান্ত নিজস্ব স্বার্থও ছিলো। কারণ ১৯১৪’র অক্টোবরে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সাথে সাথে অটোমান তুরস্কের খেলাফত থেকে এই যুদ্ধকে ধর্মীয় জিহাদ বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণা ব্রিটেনের জন্য ঝামেলার। কারণ ব্রিটেনের তখনকার উপনিবেশের মধ্যে ভারতে ও মিশরে বিপুলসংখ্যক মুসলিম প্রজা আছে। এই সমস্ত  প্রজার একটা ছোটখাট অংশও যদি তুরস্কের ধর্মগুরুদের কথায় ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দেয় তাহলে সেটা সামাল দিতেই ব্রিটেনের বিপুল পরিমাণ শক্তি ও মনোযোগ ব্যয় করতে হবে। চার্চিলের ধারণা ছিলো তুরস্ক একটা নরম প্রতিপক্ষ  হবে, কারণ এরও এক শতাব্দী আগে থেকেই অটোমান তুরস্ককে ইউরোপের রাজনীতিতে  মৃতপ্রায় সাম্রাজ্য বলে ধরা হতো। চার্চিলের যুক্তিতে ব্রিটেনের শাসকগোষ্ঠী সন্তুষ্ট হয়ে গ্যালিপোলি ক্যাম্পেইন শুরু করে। উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষ্ণসাগর  থেকে মর্মর সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত নৌ-যোগাযোগের জন্য খুবই  গুরুত্বপূর্ণ চ্যানেলগুলো দখল করা। কিন্তু বাস্তবে গ্যালিপোলিতে যুদ্ধে নেমে দেখা গেলো অটোমান তুরস্ককে বাইরে থেকে সবাই যতটা দুর্বল ভেবেছিলো আত্নরক্ষার ক্ষেত্রে তারা আসলে তত দুর্বল নয়। গ্যালিপোলিতে তুমুল  প্রতিরোধের মুখে পড়ে তাই শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনকে এই অপারেশন বাদ দিতে হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে চেষ্টা করে আসা ব্রিটেনের সামরিক গোয়েন্দারা ১৯১৭-১৮তে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব গোত্রকে নিজেদের জাতীয়তাবাদী চেতনায়  উদ্বুদ্ধ করে অটোমান তুরস্কের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলতে সফল হয়। এই অভিযানের একজন বড় নায়ক ছিলেন টি ই লরেন্স (T. E. Lawrence), যিন লরেন্স  অফ এরাবিয়া নামে বিশ্বখ্যাত। এমনকি ১৯১৭’র ডিসেম্বরে প্রায় পাঁচ শতাব্দী  পরে পবিত্র নগরী জেরুজালেমেরও দখল নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। পূর্ব রণাঙ্গনে এক  পর্যায়ে রোমানিয়া মিত্রপক্ষের কাছ থেকে পুরস্কারের আশ্বাসে জার্মানির  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু জার্মান বাহিনী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় রোমানিয়াকে পরাজিত করে বুখারেস্ট দখল করে নেয়।

তুরস্ক ও আর্মেনিয় গণহত্যা

বলকানে এক শতাব্দী ধরে  দখল হারাতে থাকা অটোমান-তুরস্ক তার জেদ মেটায় অন্য সব বর্বর অথর্ব  কূপমন্ডুক সাম্রাজ্যের মতই নিজ সীমানার ভিতরের ক্ষুদ্র ও দুর্বল গোষ্ঠীর ওপর। অটোমান তুরস্ক এ কাজের জন্য পায় আর্মেনীয়দের।

অটোমান সাম্রাজ্যের  জোয়াল ভেঙে রোমানিয়া বুলগেরিয়া ও সার্বিয়ার স্বাধীনতা চাওয়ার একটা বড় কারণ ছিলো ধর্মীয়। অটোমানদের শাসনে মুসলিম ছাড়া বাকী সব ধর্মের লোকজন ছিলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। ইহুদি খ্রিস্টান বা প্যাগান কারো পক্ষে কোন মুসলিমের হাতে নির্যাতিত বা ক্ষতির শিকার হয়ে বিচার চাওয়ারও উপায় ছিলো না, কারণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই স্বীকৃত ছিলো ইহুদি খ্রিস্টান প্যাগানের স্বাক্ষ্য মুসলিমের স্বাক্ষ্যের চাইতে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। ফলে বাস্তব  ক্ষেত্রে অবস্থা কেমন ছিলো সহজেই বোধগম্য।

রাশিয়া সহ পশ্চিমা দেশগুলো অটোমানদের সাম্রাজ্যের ভিতরে তাদের খ্রিস্টান ধর্মীয় ভাইদের অবস্থা নিয়ে বারবার অভিযোগ করেও কোন ফলাফল পায়নি। শুধু মুখে মুখে সংস্কারের হম্বিতম্বিই সার। বাস্তবে ভালো কোন সংস্কার করেনি তুরস্ক। মূলত সংস্কার  করতে গেলে তার বিশাল মুসলিম জনগণই এতদিনের আরাম ছেড়ে দিতে বললে ক্ষেপে যাবে এই ভয় ছিলো অটোমানদের। শেষমেশ তাই যুদ্ধের ময়দানেই এসবের মীমাংসা হয় – জন্ম নেয় রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও সার্বিয়া। কিন্তু তুরস্কের ভিতরে থেকে যায়  আর্মেনীয়রা। তারা তুরস্কের ভিতরে থেকেই নিজেদের অবস্থার উন্নতি ও আইনগত  অধিকার চেয়েছিলো অটোমানদের কাছে।

বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে ধ্বংস হয়ে এসে অটোমান তুরস্কের খেলাফত তাই নিজেদের ঝাল মেটায় এবার একটু অধিকার চাওয়া এইসব আর্মেনীয়দের উপর গণহত্যা চালিয়ে। সবচে হাস্যকর ট্র্যাজিক ব্যাপার হচ্ছে, যে তরুণ তুর্কীদের ইসলামি বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনার  অগ্রগামী বলে ধরা হয়, পশ্চিমা বিশ্ব পর্যন্ত যাদের আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারণার প্রতীক হিসাবে দেখে সেই তরুণ তুর্কীরাই বরং ব্যাপক উৎসাহ ও  প্রাতিষ্ঠানীক দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছে এই আর্মেনীয় গণহত্যা। ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় আড়াইশর মত আর্মেনীয় কবি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবিদের  ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আংকারায়। এদের বেশিরভাগকেই খুন করা হয়। বাদবাকী  আর্মেনীয় পুরুষদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে নিদারুণ পরিবেশে জোরপূর্বক  অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। অনেককে গুলি করে, আগুনে পুড়িয়ে,  বিষাক্ত গ্যাসের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। নারী শিশু ও বৃদ্ধদের সরাসরি খুন না করে তাদের একযোগে নিজেদের বাসভূমি থেকে বের করে সিরিয়ার মরুভূমির দিকে তাড়া করে নিয়ে যায় তরুণ তুর্কীর সেক্যুলার সামরিক অফিসাররা। পথে পথে লুট,  ধর্ষণ, খুন, মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে নির্যাতন। হত্যার এই উৎসবে খুন করা হয় প্রায় দশ থেকে পনের লাখ আর্মেনীয়কে। বাকীদের অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দিকে পালিয়ে বাঁচে। সবচে ভয়ংকর বর্বরতার ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো গণহত্যা ছিলো সরকারীভাবে পরিকল্পনাকৃত, সুশৃংখলভাবে ধাপে ধাপে অর্গানাইজড ও ঠাণ্ডা মাথায়  পৈশাচিক হিসাব-নিকেশের মাধ্যমে চালিত। এ কারণে হিটলারের ইহুদি হলোকাস্টের  প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত গুরু বলা যায় অটোমান তুরস্ক ও প্রগতিশীল তরুন তুর্কীদের। দক্ষিণ এশিয়ায় জামায়াতে ইসলামি নামক রাজনৈতিক আদর্শের অনেক গভীর ও মৌলিক বিষয়ের উৎপত্তি সেই তুরস্ক, অটোমান খিলাফত আর তরুন তুর্কীদের দর্শন। বাংলাদেশের জন্মের সময়ে ১৯৭১ এর ১৪ ই ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবি হত্যায় এর একটা চিহ্ন পাওয়া যায়।

পতনের শুরু, রাশিয়া ও বলশেভিক বিপ্লব

একভাবে দেখলে  পশ্চিম রণাঙ্গনে শ্লিফেন প্ল্যানের বাস্তবায়ন অসম্ভব ভেবে সেখান থেকে সরে  আসা থেকেই হয়তো জার্মানির পতনের শুরু। কিন্তু ১৯১৭’র এপ্রিলে জার্মানির  বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার আগ পর্যন্ত যে কোন সময়ে জার্মানির জয় তেমন অসম্ভব কিছু ছিলো না। এমনকি আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার পরেও, আমেরিকান বাহিনীর  প্রস্তুতি ও জাহাজে করে পশ্চিম রণাঙ্গনে পৌঁছানো পর্যন্ত সময়ের মধ্যে, জার্মানির পক্ষে এই যুদ্ধে জিতে যাওয়া সম্ভব ছিলো। ১৯১৭-১৮’র শেষ সময়েও পূর্ব রণাঙ্গনে রোমানিয়া ও ইতালির বিরুদ্ধে অভিযানে সফলতা পায়  জার্মানি। কিন্তু নিজেদের উন্নততর সামরিক প্রযুক্তি, দক্ষতা, নিজ দেশের  ভিতরের শিল্পোন্নত অর্থনীতির দম্ভে জার্মানির অভিজাত শ্রেণী যেটা বুঝেনি সেটা হচ্ছে এই যুদ্ধ আসলে ১০০ মিটারের দৌড় ছিলো না, এটা ছিল ডাবল-ট্রিপল ম্যারাথনের মত একটা ব্যাপার। জার্মানির নিজস্ব উন্নত শিল্পব্যবস্থা আর প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত ও দক্ষ সামরিক বাহিনীর বিপরীতে মিত্রশক্তির ব্রিটেন আর ফ্রান্সের ছিলো বিশাল বিস্তৃত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য। দীর্ঘমেয়াদের  যুদ্ধে টিকে থাকার ক্ষেত্রে বৃটেন আর ফ্রান্সের লোকবল আর সম্পদের সরবরাহ  ছিলো প্রায় অফুরন্ত। বৃটেন আর ফ্রান্স এশিয়া, ওশেনিয়া, আফ্রিকার উপনিবেশ থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে ব্যবহার করতে পেরেছিলো। কিন্তু জার্মানির ছিলো কেবলমাত্র নিজেদের জনগণ। লাখে লাখে মৃত্যুতে একটা  প্রজন্ম প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেলে জার্মানির আর কিছু করার ছিলো না। তার মিত্র দুই রুগ্ন ও মৃতপ্রায় সাম্রাজ্য থেকেও সাহায্য পাওয়ার কিছু ছিলো না। অটোমান তুরস্ককে নিজভূমির বাইরের অঞ্চল থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো বৃটেন। আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির তো কোন নিয়ন্ত্রণই ছিলো না নিজ  সাম্রাজ্যের ডজন ডজন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর উপর। যুদ্ধের জন্য রসদ সরবরাহ করতে গিয়ে জার্মানির এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে তার দেশের ভিতরের সাধারণ জনগণ, যারা তার শিল্পোন্নত অর্থনীতির চালিকা শক্তি ছিলো তারা ঠিকমত খেতেই পারছিলো না। কোটি কোটি আর্টিলারি শেল মেরে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য যেই পরিমাণ ধাতুর সরবরাহ দরকার হতো সেটা করতে গিয়ে জার্মানিকে শেষ পর্যায়ে  গির্জার ঘণ্টা, লোকজনের দরজার হাতল এইসবের দিকে হাত বাড়াতে হয়।

অবশ্য মিত্রশক্তির দেশগুলোর অবস্থাও তেমন একটা সুবিধার ছিলো, তা নয়। জার্মানির অভ্যন্তরে যেমন একটা পুরো প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে পশ্চিমের কসাইখানায়, তেমনি ব্রিটেন ফ্রান্সের ভিতরেও একটা প্রজন্ম প্রায় নিশ্চিহ্ন।  যুদ্ধের রসদ ও লোকবল সরবরাহ করতে গিয়ে আভ্যন্তরীণ বেসামরিক জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত, বিশেষত রাশিয়া ও ফ্রান্সের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই আর সামান্য একটা ছোট অথচ দৃঢ় আঘাতেই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে এমন অবস্থায়। ভারডানকে রক্ষা করতে গিয়ে ফ্রান্স তার সেনাবাহিনীকে পর্যায়ক্রমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠিয়ে, কিছুদিন অন্যত্র রেখে তারপর আবার ভারডানের দোযখে পাঠাচ্ছিলো। ফলে ঘটলো এক অপ্রত্যাশিত টুইস্ট। ভারডানে যে সৈন্যে একবার গিয়েছে তার ভয়াবহ  অভিজ্ঞতা তাকে অভিজাতদের এইসব যুদ্ধ, রাজনীতি, সরকার সমস্ত কিছুর বিরুদ্ধে  বিদ্রোহী করে তোলে। চক্রাকারে ঘুরাতে গিয়ে দেখা গেলো পুরো বাহিনীর প্রত্যেকেই কখনো না কখনো ভারডানের দোযখে যুদ্ধ করে এসেছে। ফলে গোটা ফরাসি সেনাবাহিনীর মধ্যেই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব এবং সামরিক ও রাজনৈতিক অভিজাতদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। হুহু করে ছড়িয়ে পড়েছে নৈরাজ্যবাদী, মার্ক্সবাদী আদর্শ। সামরিক আদালতে বিচার, মৃত্যুদন্ড ও অপমান, কোনকিছুই দিয়ে  জাতীয়তাবাদী আদর্শে ধরে রাখা যাচ্ছে না। ব্যাপ্তিতে কম হলেও ব্রিটেনের অবস্থাও অনেকটা একইরকম। সবচে ভয়াবহ অবস্থা রাশিয়াতে। রাশিয়ায় মার্ক্সবাদী  আদর্শের ইতিহাস এমনিতে বেশ পুরনো। তার উপর অদক্ষতা ও মানুষের জীবনের  প্রতি চরম অবহেলা করে চালানো বিভিন্ন যুদ্ধে সাধারণ জনগণের মধ্যে শাসক শ্রেনীর প্রতি ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে। এর ভিতরে আবার জার নিকোলাস (Nicholas II) আর  জারিনা আলেক্সান্দ্রার (Alexandra Feodorovna) কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাসের কারণে সাইবেরিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা মদ্যপ ও লম্পট পাদ্রী রাশপুতিন (Grigori Rasputin), যাকে অভিজাত ও অনভিজাত দুই শ্রেণীর কেউ-ই দেখতে পারতো না, সে বসে আছে ক্ষমতার প্রায় কেন্দ্রে। কারণ রাশিয়ান সেনাদের মধ্যে যুদ্ধের উদ্যম আনতে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা জারিনার হাতে দিয়ে জার চলে গেছেন রণাঙ্গনে, আর জারিনা পুরোপুরি রাশপুতিনের কব্জায়; জারিনার  বিশ্বাস তাদের একমাত্র সন্তান হিমোফিলিয়ার রোগী নিকোলাইভিচকে (Alexei  Nikolaevich) বাঁচাতে পারবে একমাত্র রাশপুতিনই।

পূর্ব আর পশ্চিম  রণাঙ্গনে দুইভাবে যুদ্ধ করতে গিয়ে কোনদিকেই ভালোমত চাপ দিতে না পারা  জার্মান বাহিনীর শেষ সময়ের জেনারেল লুডেনডর্ফ (Erich Ludendorff) তাই রাশিয়ার আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার কৌশল তৈরি করেন। রাশিয়ার ভিতরে তখন চলছে গণবিদ্রোহ ও অসন্তোষ। এই  বিদ্রোহ ও অসন্তোষকে দমন করতে রাশপুতিনের পরামর্শে জারিনা তখন সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে দিয়ে বিদ্রোহী জনগণের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এরকম চরম বিশৃংখল অবস্থায় জার্মান জেনারেল লুডেনডর্ফ সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত রাশিয়ান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা ভ্লাদিমির লেলিনকে (Vladimir  Lenin) রাশিয়ায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জার্মান বাহিনীর দেয়া এক কামরার  কালো কাপড়ে ঢাকা ট্রেনে করে সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানির ভিতর দিয়ে লেলিন গিয়ে উপস্থিত হন রাশিয়ায়। সাম্রাজ্যবাদী, পূঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বহারার স্বতস্ফুর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ইতিহাসের স্বাভাবিক পরিক্রমাতেই সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে, এই ভবিষ্যতবাণী করা মার্ক্সের তত্ত্বের প্রতি সবচে নিদারুণ উপহাস করে ইউরোপের সবচে বেশি জাত্যাভিমানী, যুদ্ধংদেহী, সবচে বেশি পূঁজিবাদী সমাজের প্রত্যক্ষ সহযোগীতা নিয়ে মার্ক্সের অনুসারী লেলিন রাশিয়াতে পৌঁছান মার্ক্সের স্বপ্নের সমাজ তৈরীতে। গণবিদ্রোহে জারের শাসনের অবসান ঘটে। গঠন করা হয় অন্তর্বতীকালীন সরকার। সেটাও লেলিনের এক ইশারাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। রাশিয়ায় শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক সর্বহারার শাসন। শুরুতেই প্রাক্তন জাত্যাভিমানী, সাম্রাজ্যবাদী রাজত্বের নিজেদের লোভ ও গৌরবের কারণে চালানো যুদ্ধ থেকে রাশিয়া নিঃশর্তভাবে নিজেদের সরিয়ে নেয়। পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। জার্মানি মুক্ত হয় দুইদিকে একসাথে যুদ্ধ চালিয়ে নেয়ার বোঝা থেকে। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে কিছু করতে গেলে জার্মানিকে পদক্ষেপ নিতে হবে খুব দ্রুত, কারণ যেই বিদ্রোহের আগুন রাশিয়াতে জ্বালিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধ থেকে সরানো হয়েছে সেই বিদ্রোহের আদর্শ ও তত্ত্ব ধীরে ধীরে জার্মানিকেও আক্রমণ করা শুরু করেছে ততক্ষণে। জার্মানির জনগণ ও সৈন্যদের দুঃখ দুর্দশা ক্ষোভ ও অবস্থার সাথে রাশিয়ার জনগণের ক্ষোভ ও দুরাবস্থার তেমন কোন পার্থক্য নাই।

 কাইযারশ্লাখট , উড্রো উইলসন, ভার্সাই চুক্তি

বিপুল সংখ্যায়  আমেরিকান বাহিনী আসা ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আগুনে ঐতিহ্যবাহী জার্মানি পুড়ে যাবার আগেই জার্মান সামরিক হাই কমান্ড তার সর্বশেষ মরণকামড় দেয়ার চেষ্টা করে পশ্চিম রণাঙ্গনের কসাইখানায়। এই শেষ চেষ্টার নাম দেয়া হয় কাইযারশ্লাখট (kaiserschlacht) বা রাজ-যুদ্ধ। পরিকল্পনা ছিলো জার্মানি তার  সর্বশেষ শক্তি দিয়ে চার-পাঁচটি বিশাল মরণ-কামড় দিবে পশ্চিম রণাঙ্গণে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মরণকামড়গুলো দেয়াও হয়। মাইকেল, জর্জেট, ব্লুশের-ইয়র্ক,  নিসিয়েনু, ফ্রিডেনস্টার্ম। কিন্তু ফলাফল সেই মাঝামাঝি। জার্মান বাহিনী  বহুদূর এগিয়ে যেতে পারে পশ্চিম রণাঙ্গণে, লাখে লাখে মৃত্যু ও পংগুত্ব উপহার  দেয় মিত্রবাহীনিতে, কিন্তু নিজেও সেই লাখে লাখে মৃত্যু ও পংগুত্ব নিয়ে প্রায় নিশ্চল ও স্থবির হয়ে পড়ে। আমেরিকার বিপুল পরিমাণ সৈন্য পৌঁছে গেলে  একশ দিনের আক্রমণে সমস্ত লাভ, সমস্ত অগ্রসরতা, সমস্ত তেজ ছেড়ে দিয়ে জার্মান বাহিনীকে পালাতে হয় নিজেদের সীমান্তের ভিতরে। ঘাড় ধরে জার্মানিকে বাধ্য করা হয় ভার্সাই শান্তি চুক্তিতে। কিন্তু ক্ষীণ শান্তনার মত জার্মানির সামান্য অহংকার তখনো অটুট থাকে যে তাকে কেউ জয় করতে পারে নাই, কেবল যেটুকু  জায়গা বাড়তি দখল করেছিলো সেটুকু ছেড়ে দিয়েছে ।

শেষ হয়েও হইলো না শেষ

ভার্সাই চুক্তিতে  জার্মানির জন্য কঠোর ও অপমানজনক সব শর্ত রাখা হয়। জার্মানির যুদ্ধের দোসর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির  অধিকৃত অঞ্চলগুলোর অনেকগুলো চলে যায় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রোমানিয়া ও সার্বিয়ার হাতে। অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি নিজেরা আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অটোমান তুরস্কের অধিকৃত অঞ্চলগুলো বৃটেন ও ফ্রান্স নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় যত দ্রুত সম্ভব স্থানীয় লোকজনের কাছে নিজস্ব শাসন ফিরিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতিসহ। কিন্তু সম্ভবত সবচে বড় ভুলটি হয়  জার্মানিকে নিয়ে। জার্মানিকে কঠোর ও অপমানজক অনেক শর্ত দিয়ে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করা হয়, কিন্তু জার্মানি যেমন ছিলো অনেকটা সেরকমই থেকে যায়। কাইযারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয় বটে, জার্মানির শাসন ব্যবস্থায় আভিজাত্যবাদের বিপরীতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয় বটে, কিন্তু জার্মানি থেকে যায় তার পুরো শিল্পোন্নত অর্থনীতি ও ভয়াবহ জাতীয়তাবাদী  জনগোষ্ঠীসমেত। এই এক ভুলের কারণেই একুশ বছরের মাথাতেই জার্মানির ভিতরকার সেই পুরনো ধ্বংসাত্নক বীজ মহীরুহে পরিণত হয়ে এই ভয়াবহ রক্তগঙ্গার চাইতে পাঁচগুণ বেশি ধ্বংসাত্নক আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ তৈরী করে।

শুনতে  এখনকার মানবিকতার বিচারে ভয়াবহ শোনা গেলেও জার্মানিকে তিনভাগ করে বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়া উচিৎ ছিলো কম করে হলেও পঞ্চাশ বছরের  জন্য, তার পুরো সামরিক বাহিনীকে দ্বীপান্তর ও দেশান্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে এবং কোনরকম সামরিক শিল্পের যাতে  বিন্দুমাত্র আত্নপ্রকাশ না হয় সেটা কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর ধরে পুরো বিশ্ব মিলে কঠোরভাবে চোখে চোখে রেখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানি সভ্য, আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে তৈরী করতে পেরেছে ঠিক এই কারণেই।  তার দুই অংশকে দুটি আলাদা শক্তি ব্লকের অধীনে কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখা  হয়েছিলো ৪৫ বছর ধরে, বিশেষ করে ঐতিহ্যগতভাবে যুদ্ধংদেহী ও জাত্যাভিমানী পূর্বাঞ্চল, পুরনো প্রুশিয়া, কঠোর সোভিয়েত চোখের সামনে ছিলো বলেই; জার্মানির আত্মোপলব্ধী ও আত্ম-অনুশোচনা এইসব আসলে গৌণ ব্যাপার।

তবে সমস্যা হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভুতপূর্ব গণধ্বংস ও রক্তগঙ্গার পরে এমন  ব্যবস্থা তৈরী করার মত শারীরিক মানসিক কোন শক্তিই অবশিষ্ট ছিলো না বৃটেন ফ্রান্স বেলজিয়াম বা রাশিয়ার। রাশিয়া তো আগেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর একপাক্ষিকভাবে যুদ্ধ থেকে বিদায় নিয়েছিলো। জার্মানির বিরুদ্ধে কঠোর কোন  বাস্তবিক পদক্ষেপ নেয়া না যাওয়ার আরেকটা বড় কারণ ছিলো আমেরিকা। যুদ্ধের মাঝামাঝি থেকেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলে আসছিলেন এই যুদ্ধ, এত  রক্ত, এত অপচয়ের পরে যেন সেই পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী উপায়ে এই দেশ দখল, ঐ  দেশ ভাগ, এইভাবে যেনো সমাধান না করা হয় যাতে যুদ্ধের বীজ আবার থেকে যায়।  তার কথা ছিলো সব পক্ষকেই জয়-পরাজয় ছাড়া শান্তিতে আসতে হবে। যুদ্ধের  শেষদিকে যেহেতু মিত্রশক্তির অন্য দেশগুলোর পক্ষে আমেরিকার সাহায্য ছাড়া জেতা অসম্ভব ছিলো তাই যুদ্ধের পরে শান্তিপ্রক্রিয়ায় আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দাবীও তাদের মানতে হয়। কিন্তু জয়-পরাজয় ছাড়া এই শান্তিই মূলত আরো বিশাল বড় অশান্তি ও আরো পাঁচগুণ বেশি খুন ও ধ্বংসের বীজ বপন করে দিয়েছিল।

প্রাচীন এশিরিয় সম্রাট আশুরবানিপল (Assurbanipal) তার সাম্রাজ্যের ভিতরে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী ইলামাইটদের দমন করার ব্যাপারে দম্ভোক্তি করে গেছেন এভাবে – “এক মাস পঁচিশ দিনের যাত্রায় যতদূর যাওয়া যায় ততদূর জুড়ে আমি ইলাম এর বিভিন্ন অঞ্চলগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের জমিতে আমি লবণ আর সিহলু (এক ধরণের কাঁটাজাতীয় মরু উদ্ভিদ) ছিটিয়ে দিয়েছি (যাতে আর কখনো  সেখানে অন্য কিছু না জন্মাতে পারে)। সুসা, মাদাক্তু, হালতেমাশ-সহ আরো যত শহর ছিলো তাদের ধূলোয় মিশিয়ে দিয়ে সেই ধূলা আমি এশিরিয়াতে নিয়ে এসেছি। তাদের ভূমি থেকে মানুষের কোলাহল, গবাদিপশুর বিচরণ আর আনন্দ উচ্ছাসকে আমি  চিরতরে বিলীন করে দিয়েছি। তাদের জমিকে আমি পরিণত করেছি জংগলে,  যেখানে  বনগাধা, হরিন আর অন্যসমস্ত বন্যপ্রাণী নির্ভয়ে বিচরণ করে।”

আশুরবানিপলের যুগের মত করে না হোক, কোনভাবে জার্মানির যুদ্ধদেংহী মনোভাব, জাত্যাভিমান ও আত্নবিশ্বাসের মূলোৎপাটন করতে পারলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামের মহাকেয়ামত এড়ানো যেতো।

………………….
অনলাইন পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় পঠিত।

Leave a Comment