খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধ

জীবনানন্দের কাব্যে নারী ও নিসর্গের স্বরূপ

লিখেছেনঃ লিটন শীল

লিটন শীল

(এক)     
“…. বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” (১)
অথবা,
“সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো, সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;”… (২)

বাংলা সাহিত্য পাঠকরা এমন কোনো পুরুষ খুঁজে পাবেন না যে নাটোরের বনলতা সেন বা সুরঞ্জনার নাম শুনেননি। প্রিয়তমাকে, নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় পরপুরুষের সাথে চলতে দেয়া না-দেয়া – এমন মানসিক চাওয়া-না চাওয়ার বিবর্তনীয় দর্শন, বিজ্ঞানমনস্ক কবিতা যিনি আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, তিনি বাংলা সাহিত্যের-       
জীবন পলাতক;
প্রকৃতির কবি;
নির্জনতম কবি;
রূপসী বাংলার কবি;
চিত্ররূপময় কবিতার কবি;
ইতিহাস ও ঐতিহ্য সচেতনতার কবি;
ধূসরতার কবি;
তিমির হননের কবি;
বিপন্ন মানবতার নীলকণ্ঠ কবি;
পরাবাস্তবতার কবি;
এক আচ্ছন্ন করা বিষন্নতার জনক কবি;
শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)।

যুগে যুগে পুরুষ তার পিপাসার গান গেয়েছে। আর পুরুষের সেই সৌন্দর্য পিপাসার আধার নারী। তাই আমরা দেখি প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ, সব যুগেই কবি সাহিত্যিকরা নারীর রূপে মুগ্ধ। নানা উপমায় ফুটিয়ে তুলতে চায় তার মানস প্রিয়াকে। মধ্যযুগের কবি আলাওলের প্রিয়তমার বর্ণনা হার মানায় সব উপমা অলঙ্কারের সৌন্দর্যকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কল্পনা ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে মানস প্রিয়াকে সাজিয়ে হয়ে উঠেন দারুণ এক রোমান্টিক কবি পুরুষ। কিন্তু কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয়ার রূপের বর্ণনা পাঠ করলে আমি ভুল করে ফেলি – নারী নাকি প্রকৃতিকে আঁকড়ে আমি পাঠ করি কবির রূপসী বাংলার, ‘বনলতা সেন’-এর, ‘ঝরা পালক’-এর, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র অমূল্য প্রাকৃতিক পংক্তি। স্তবকের চরণে চরণে চোখের গতির সাথে আমার মনের গতি কখনো নারী, কখনো প্রকৃতির স্থুল থেকে সমুদ্র, সমুদ্র থেকে শূন্যের আকাশ, নক্ষত্র, সূর্য বা কখনো আবার ভূমির নদী-মাঠ-বৃক্ষ, জোছনার ছায়ায় ছুটে। এ ছুটে চলা যেন আমার – “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে” (৩) – এর মত ছুটে চলা। তবু ভুল করে ফেলি, ব্যর্থ হই বারবার, নারী ও প্রকৃতিকে আলাদা করতে। কারণ কবির কবিতা নারী ও প্রকৃতির সংমিশ্রণে এক অপরূপ সৃষ্টি।

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)

জীবনানন্দ দাশ বাস্তব জীবনে যেমন সকলকে এড়িয়ে চলেছেন সবসময়, তেমনি এড়িয়ে চলেছেন লেখনিতে প্রচলিত ব্যাকরণরীতি ও পদের ব্যবহার, শব্দ মিশ্রণের বাচ-বিচার। তবুও কবির কবিতা শুদ্ধতায়, প্রকৃতির সরূপ সম্ভারে ভরপুর। ড. হুমায়ুন আজাদের মতে- “জীবনানন্দ দাশ অভিধান নির্ভর হননি, শব্দপুঞ্জকে তিনি তুলে এনেছিলেন হৃদয়লোক থেকে, রূপসী বাংলার নিসর্গ থেকে, সাম্প্রতিকতা থেকে। তাঁর কবিতা পরম পিপাসী স্বপ্নচারিতা, এ স্বপ্নচারিতায় যা সহায়ক সে-শব্দ তিনি আহরণ করেছেন, সৃষ্টি করেছেন, ভেঙ্গেছেন, পুনর্সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে গঠিত হয়েছে তাঁর একান্ত নিজস্ব শব্দসৌরলোক, নিসর্গের প্রতিটি সম্ভার তাঁর, বিশেষণের মোহনীয়তাও তাঁরই।” (৪)

জীবনানন্দ এমন এক কবি যার মানসে নারী, প্রকৃতি, মৃত্যুচেতনা, পারবাস্তবতা, বিজ্ঞান-বিবর্তন, ইতিাহস সবকিছুই ঠাঁই পেয়েছে, তা জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করলেই বুঝতে পারা যায়। কারণ তাঁর কবিতার পংক্তিতে, শব্দের গাঁথুনীর ভীড়ে চিত্রাকরে ফুটে উঠেছে দৈহিক ও মনজাগতিক চিত্রকল্প।

কাম একটি বিবতর্নীয় বিজ্ঞান। এই কাম নারী বিনে পুরষের বৃক্ষে পুষ্প না ফুটার মতো। কবি জীবনানন্দ দাশ এই কামকে ‘বরফ গলিয়ে জলের মতো করে’  প্রকৃতিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। তাই তাঁর কাব্য অশ্লীলতার অভিযোগে দ্ষ্টু হয়, কিন্তু জল ও বরফের উপাদান এক হয়েও জল ও বরফ যেমন এক নয়, তেমনি এ যুগের কবির কাম কাব্য ও জীবনানন্দের কাব্যের কাম এক নয়। জীবনানন্দের কাম প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে হয়ে যায় একাকার। ১৯৩২ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ‘ক্যাম্পে’ কবিতা প্রকাশ হলে কবিকে তাঁর কলেজ কর্তৃপক্ষ অশ্লীলতার অভিযোগে কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত করেছিল। যদিও সে অভিযোগ পুরোপুরি সত্য কিনা তা অমিমাংসিত।

এই ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় নারী ও নিসর্গ মিলে-মিশে একাকার। নারীকে কবি প্রকৃতির সাথে এমনভাবে মিশিয়েছেন যার জন্য হরিণী নারী হয়ে উঠে আর নারী হয়ে উঠে হরিণী। কবিতায় শিকারীর শিকার নারীর প্রতীক হরিণী নয়, শিকার হচ্ছে প্রকৃতি যা কবি হৃদয়ে পরিবেশ সচেতনতার পরিচয় বহন করে। কবিকে এক সচেতনতার ঘোর আছন্ন করে। কবির ভাষায়-
“একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে,
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে
দাঁতের নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বনের কাছে অই
সুন্দরী গাছের নীচে-জোছনায়!-
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়ে মানুষের কাছে
হরিণেরা আসিতেছে।

“আমার হৃদয় এক পুরুষ হরিণ-
পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে
চিতার চোখের ভয়-চমকে কথা সব পিছে ফেলে রেখে
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?

এ ব্যথা; এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে,-
কোথাও ফড়িঙ্গে-কীটে, মানুষের বুকের ভীতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।” (৫)

(দুই)

“হৃদয়ে তুমি সেই নারীকে ভালোবাস তাই
আকাশের ঐ অগ্নিবলয় ভোরের বেলা এসে
প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে অমেয় কাল হৃদয়সূর্য হবে
তোমার চেয়েও বেশি সেই নারীকে ভালোবেসে।
বাসুক তবু সবের চেয়ে আলোর কথা এই:
আমি তাকে সময় পরিক্রমার পথে আবছায়াতে দেখে
নিজের মূল্যে রয়ে গেছে বলেই ভালোবাসি।” (৬)

প্রত্যেকটি পুরুষ তার মানস প্রিয়াকে খুঁজে ফিরেন, এটাই স্বাভাবিক, এটাই চিরায়ত। প্রকৃতির কবি, অর্ধনারীশ্বর জীবনানন্দ দাশও তাঁর জীবনে নারী মগ্নতায় ডুবে ছিলেন। তবে তা শরীরী ছিলনা, ছিল মানসের; যা সৃষ্টিশীলতার প্রতীক। বাস্তব জীবনে কবি চারজন নারীকে মনের মধ্যে সর্বদাই লালন করতেন। এই তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারী তাঁর স্ত্রী, কিন্তু কেউ তাঁকে কোনোদিন আপন করেও চায়নি। বাকি তিনজন নারীই ছিল জীবনানন্দের একপাক্ষিক ভালোলাগার-ভালোবাসার মানুষী। এরা হলেন কবির প্রথম জীবনের ভালো লাগা বান্ধবী-কিশোরী ‘মনিয়া’, মামা প্রিয়নাথ দাশের অবিবাহিত মেয়ে ‘খুন্তি’ যার আসল নাম ‘লীলাময়ী’ এবং কাকা অতুলানন্দের দ্বিতীয় কন্যা ‘শোভনা’ যার ডাক নাম বেবী।

তিনজন নারীর মধ্যে কবি জীবনে দীর্ঘকাল হৃদয়-মানসে ঠাঁই পাওয়া নারী শোভনা তথা বেবী; এটা কবির ‘লিটারেরি নোটস’  থেকে বুঝা যায়। তাই হয়তো কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭) কবি উৎসর্গ করেছিলেন শোভনাকে। যদিও সেখানে শোভনার নাম ছিলনা তবুও এটা বুঝতে করোরই ভুল হয় না।

কবি উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন – “কলাণীয়াসু” – এবং ডাকযোগে এক কপি শোভনাকে পাঠিয়েছিলেন যা শোভনা তার বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে দীর্ঘদিন লুকিয়ে রেখেছিল। এই তিন নারীই কবির কবিতায় বারবার ফিরে আসে প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যতা নিয়ে, কখনো কখনো নাম বদলের মধ্যে দিয়ে। তাই তাঁর কাব্যে পাওয়া যায়- বনলতা সেন, সুরঞ্জনা, অরুণিমা সান্যাল, সুর্দশনা, শ্যামলী, সরোজিনী, শঙ্খমালা, সুচেতনা (সু-চেতনা না হলে), সবিতা (গায়েত্রী মন্ত্রের সবিতা বা পুরাণের কশ্যপ অদিতির বারো পুত্রের একপুত্র সবিতা না হলে), উৎপলা, আকাশলীনা প্রভূতি নামে।

কাব্যে ‘উৎপলা’ নামটি ব্যবহার করার জন্য কবিকে অনেক বিরূপ সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। আর ‘আকাশলীনা’ কবিতার পূর্বনাম ‘ও হৈমন্তিকা’ থেকে পরিবর্তিত রূপ। ‘ও হৈমন্তিকা’ কবিতার জন্যও বিরূপ সমালোচনার শিকার হলে কবি কবিতাটি ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যে অর্ন্তভূক্ত করার সময় আকাশলীনা নামকরণ করেন এবং কবিতার ভিতরে ‘হৈমন্তিকা’র স্থানে ‘সুরঞ্জনা’ নাম ব্যবহার করেন। এ কবিতাটি ‘কবিতা’ পত্রিকায় ১৯৩৮ সালে প্রথম প্রকাশ পায়।

শুধু কি নামে? নাম ছাড়াও সর্বনামের ব্যবহারে কবির কবিতায় নারীকে পাওয়া যায়; পাওয়া যায় নারীর সমার্থক প্রকৃতিকে।

কবি জীবনানন্দের এমন কোনো কবিতা হয়তো পাওয়া যাবেনা যেখানে প্রকৃতির উপস্থিতি নেই। কবি জীবনানন্দের প্রেমের কবিতা প্রায় সবসময় হয়ে উঠেছে নিসর্গের আলোকে। নিসর্গলোকে আশ্রয় নিয়ে কবি প্রেমের কবিতা লিখেছেন, যে প্রেমের মূলে আড়ালে-আবডালে প্রেরণা যুগিয়েছে নারী। কখনো বা বিরহ ব্যথায় আছন্ন করেছে।

কবির কবিতায় এই নারীরা কখনো মানবীরূপে আর কখনো হরিণী, বাঘিনী রূপে এসে ভিড় করেছে। এক্ষেত্রে ডা. পি.এম. সফিকুল ইসলাম কবির কবিতায় নিসর্গ চেতনার তিনটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন-

“জীবনানন্দ দাশ নারী ও নিসর্গের কবি, নারী ও নিসর্গকে তিনি একাকার করে ফেলেছেন তাঁর কাব্যে। জীবনানন্দ দাশের নিসর্গ চেতনার মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রেমের কবিতা, মৃত্যুচেতনা ও নারী ও নিসর্গ একাত্ম হয়ে যাওয়া।” (৭)

কবির “ধূসর পাণ্ডুলিপি” (১৯৩৬), “রূপসী বাংলা” (১৯৫৭), “বনলতা সেন”(১৯৪২), “মহাপৃথিবী” (১৯৪৪), “বেলা অবেলা কালবেলা” (১৯৬১) প্রায় সব কাব্যগ্রন্থই প্রকৃতির বৈচিত্রতায় ভরপুর। তথাপি, ধূসর পাণ্ডুলিপি, রূপসী বাংলা, বনলতা সেন এক আছন্ন করা সুরের, স্পর্শের, গন্ধের। কবি ও পাঠক মনকে আছন্ন করে।

কবি হৃদয়ে বাস করা প্রিয়াকে কবি কখনোই পাননি। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন প্রিয়াকে ভেবে, খুঁজে। প্রিয়ার জীবন সঙ্গী হচ্ছে অর্থবিত্তের পুরুষ এ ভাবনা বা বাস্তবতা কবিকে ব্যথা দেয়, প্রিয়াকে চোখের দৃষ্টিতে বারবার দেখে নেয়। কিন্তু তবু সব প্রেম মরিচীকার মতো মিছে হয়ে  যায় কবির। কবি তাই বলেন-
“আঁখি দুটি তার জৌলস রাঙ্গা হয়ে গেছে রাতারাতি!
কোন যেন এক জিন সর্দার সেজেছে তাহার সাথী।
কোন যেন পরী চেয়ে আছে দুটি চঞ্চল চোখ  তুলে
পাগলা হাওয়ায় অনিবার তার ওড়না যেতেছে দুলে। (৮)

মৃত্যুচিন্তা আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য কবিকে ভর করতো প্রায় সময়ই। তাই কখনো কখনো মৃত্যুচিন্তার মাঝেও খেলা করতো কবির মানস প্রিয়া, প্রিয়সীর ছলানার চুড়ি। কবির ভাষায়-
“ কোন কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
পেয়ালা তাদের থেকে বেজে যায়
বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
সারা জনমের শুষে নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
পাণ্ডুর দুটি ঠোঁটে
ডালিম ফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে। (৯)

এ সমাজের সকল মানুষই মানুষ। মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থা কোনোটাই মানুষের সৌন্দর্য পিপাসাকে মেরে ফেলতে পারেনা। বেদের মেয়ে যখন প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে পাখি বা ময়ূরের পালক, বনের ফুল দিয়ে নিজেকে সাজায়, সূর্যছটা খেলা করে, শিশির কণা ঝলমল করে, সারি সারি পাহাড়-পবর্ত-এর ছায়া কুÐলীর মতো ছেড়ে যায় তখন বেদে মেয়ের হাসি সূর্যের আলোর ছটাকেও হার মানায়। নারী প্রকৃতির কাছে সৌন্দর্যের উপাদান পেয়ে প্রকৃতিকেই যেন হার মানায়। এ এক অভিনব সৌন্দর্য পিপাসা। কবির ভাষায়-
“যত্ন করিয়া পালক কুড়ায়, কানে গোঁজে বনফুল,
চাহে না রতন মণিমঞ্জুষা হীরে মানিকে দুল,
তার চেয়ে ভালো অমল উষার কনক রোদের সীথি,
তার চেয়ে ভালো আলো ঝলমল শীতল শিশির বীথি,
তার চেয়ে ভালো সুদূর গিরির গোধূলি-রঙিনজটা,
তার চেয়ে ভালো বেদিয়া বালার ক্ষিপ্র হাসির ছটা!” (১০)

নারীর রূপ অঙ্গের বর্ণনায় প্রকৃতির উপমা ছাড়া কবি যেন কোনো কিছুই পায় না-
“ননীর কলস আছে রে তার কাঁচা বুকের কাছে
আতার ক্ষীরের মতো সোহাগ সেথায় ঘিরে আছে।” (১১)

“চিনিমাখা ছায়া ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
লুকিয়ে আছে সে-কোন মধু মৌমাছিদের ভিড়ে।” (১২)

“নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধু-
চুরি করে পেয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!” (১৩)

“ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল,
ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার, রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল,
চুল যার শাওনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন,
আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কতদিন।” (১৪)

“চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীলামার! (১৫)

(তিন)

“কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতর থাকবে ইতিহাস চেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।” (১৬) জীবনানন্দ দাশ ছোট-বেলায় তাঁর বাবার কাছে শুনতেন ধর্মগ্রন্থের কাহিনী, উপনিষদের কাহিনী, মায়ের কাছে শুনতেন প্রার্থনার বাণী। ধর্মগ্রন্থগুলো যেমন কালের সাক্ষী তেমনি ইতিহাসের। কবিও তার কাব্যে নারী ও কাল চেতনাকে এক করে ফেলেছেন কবিতার পাতায় পাতায়। কবির ভাষায় নারী ও কালের চিত্র-
“সুচেতনা, তুমি এক দুরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে; …
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ; …
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়-
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়।” (১৭)

“শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন
কাল কিছু হয়েছিল, হবে কি শাশ্বত কাল পরে।” (১৮)

“তোমার সৌন্দর্য নারী, অতীতের দানের মতন।
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মালতী সৌরভ।” (১৯)

ইতিহাস চেতনা কবি জীবনানন্দ দাশকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল বলেই কিছু কবিতা ইতিহাসের আদ্যোপান্তকে রসহীনতা থেকে পাঠের উপযোগী রসময় করে তুলেছে যদিও কবিতা রস আস্বাদনের সহজ বিষয় নয়। আর এ কাজ, রসবোধ, কাব্যের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ দাশ অদ্বিতীয়। কবির ভাষায় নারী ও ইতিহাসের চিত্র-
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকার মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।” (২০)

“যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় মরে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে
কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনার গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য (২১)

“সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো;
গ্রীক হিন্দু ফিনিশীয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন
শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা নগরীর গায়ে
কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? গিয়েছে হারায়ে।” (২২)

(চার)

কবি জীবনানন্দ দাশ নারীকে প্রত্যক্ষ চিত্রে কাব্যে ফুটিয়ে তোলার জন্যই হয়তো প্রাচীন পুরাণ, লোককথা, রূপকথার জগতে বিচরণ করেছেন বারবার। তাই তাঁর কবিতায় বারবার ফিরে আসে মধ্যযুগীয় কাব্যের মানবীয় নারী চরিত্র বেহুলা, লহনা, সন্কা, চম্পা, দেবীরূপী মনসা, শ্যামা, লক্ষী, দূর্গা প্রভৃতি নাম –
“আমারে দিয়েছে তৃপ্তি; কোনদিন রূপহীন প্রবাসে পথে
বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন
কাটাইনি দিন মাস, বেহুলার লহনীর মধুর জগতে
তাদের পায়ের ধুলো মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন
বাঙালী নারীর কাছে, চাল-ধোয়া স্নিগ্ধ হাত; ধান-মাখা চুল,
হাতে তার শাড়িটির কস্তাপাড়; ডাঁশা আম কামরাঙ্গা কুল।” (২৩)

‘জাম-বট-কাঁঠালের-হিজলের অশ্বত্থের করে আছে চুপ;
ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে;
মধুকর ডিঙ্গা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে
এমনই হিজল-বট তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ।” (২৪)

“পৃথিবীর পথ ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে
ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে,
যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে”। (২৫)

“এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন-এ আকাশ নয় আজিকার;
ফণীমনসার বনে মনসা রয়েছে না কি? আছে; মনে হয়,
এ নদী কি কালীদহ  নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার
সনকার মুখ আমি দেখি না কি? বিষন্ন মলিন ক্লান্ত কি যে
সত্য সব;- তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে।” (২৬)

“সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর
শঙ্খমালা নাম তার; এ বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালক্ষী দিয়েছিল বর
তাই সে জন্মিছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।” (২৭)

(পাঁচ)

“আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো-কিশোরীর-ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়;” (২৮)

বাংলা ষড়ঋতুর বৈচিত্রতায় ভরপুর। ছয়টি ঋতুর মধ্যে কবির সবচেয়ে প্রিয় ঋতু হেমন্ত। হেমন্ত ঋতুতে ফসলে পাঁক ধরে, কৃষকেরা নতুন ফসল ঘরে তুলে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। শীতের আগমনের বার্তা নিয়ে আসা কুয়াশার মধ্য দিয়ে শুধু কবি নয়, কবির মানস প্রিয়াও এসে ভিড় করে। কবি  ও কবির মানস প্রিয়া মিলে রয় একসাথে। যথা-
“হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আবার বুকের পরে শুয়ে রবে?” (২৯)

“চারিদিকে ছায়া রোদে খুদ কুঁড়ো-কার্তিকের ভিড়;
চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এইখানে, এখানে, হতেছে স্নিগ্ধ কান,
পাড়াগায়ে আজ লেগে আছে রূপশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ।” (৩০)

“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায় মাঠের ভিতরে!” (৩১)

(ছয়)

‘বাংলার সব কবিই নিসর্গ প্রেমিক, নিসর্গের আহ্বান কেউ এড়াতে পারেননি। সবাই নিসর্গ থেকে আহরণ করেছেন জোছনা, নিসর্গের সহায়তা ব্যতীত নিজেকে ভেবেছেন অসহায়। তাই বাংলা কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে অনুভব করা যায় নিসর্গের নিশ্বাস।” (৩২)

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতপক্ষে বাংলার প্রতিটি বৃক্ষ, লতা, ফুল, পাতা, পশু-পাখির রূপে জন্ম-মুত্যুর খেলায় মগ্ন। কবির ইতিহাস চেতনা ও কালের সচেতনতায় অতীত বর্তমান-ভবিষ্যত মিশে গেছে নারী ও প্রকৃতিতে। তাই কবির মানস প্রিয়া বনলতা, শঙ্খমালা, সুরঞ্জনা, শ্যামলী, সুচেতনা বা অক্ষয় ইতিহাসের লক্ষী, বিশালাক্ষী, শ্যামা, সনেকা, বেহুলারা সকলে এসে ভিড় জমায় কখনো প্রিয়সীরূপে, কখনো মাতা, ভগ্নি, দেবী আবার কখনো শুধুই বাংলার নারী রূপে। এই নারী জীবনানন্দ দাশের কাব্যে সময়ের প্রবাহে প্রকৃতির নানা উপাদানে গড়া। কবির মানস প্রিয়া প্রকৃতির বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন সময়ে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে ভিড় জমায় কবি কর্মে। ভার্জিনিয়া উলফ-এর ভাষায় – “এটার ‘মতো’ ওটার ‘মতো’ কিংবা সেটার ‘মতো’ কিন্তু কী সেই বস্তু; যা বিষয়ের সাদৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে?”

জীবনানন্দ পাঠে প্রশ্নসূচকটি থাকেনা, পাঠক খুঁজে পায় তার উত্তর কারণ নারী ও নিসর্গের লীলাভূমিতেই যে জীবনানন্দের বাস।

তথ্যসূত্রঃ
১।       জীবনানন্দ দাশ; বনলতা সেন, বনলতা সেন।
২।       জীবনানন্দ দাশ; আকাশলীনা; সাতটি তারার তিমির।
৩।       জীবনানন্দ দাশ; বনলতা সেন; বনলতা সেন।
৪।       ড. হুমায়ুন আজাদ; ‘শব্দের প্রকৌশল; বনলতা সেন, আধার ও অধেয়, আগামী প্রকা: ৩য় মুদ্রণ ২০১৪।
৫।       জীবনানন্দ দাশ; ক্যাম্পে, ধূসর পান্ডুলিপ।
৬।       জীবনানন্দ দাশ; হৃদয় তুমি, অপ্রকাশিত কবিতা।
৭।       ডি. পি.এম. সফিকুল ইসলাম; জীবনানন্দ দাশের কাব্যে নিসর্গ চেতনা ও ভাষা প্রসঙ্গ’, সাহিত্যিকী, জীবনানন্দ দাশ সংখ্যা, ১৪০৪ বঙ্গাব্দ, বাংলা গবেষণা সংসদ, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,
৮।       জীবনানন্দ দাশ; মরীচিকিার পিছে, ঝরা পালক।
৯।       জীবনানন্দ দাশ; জীবন মরণ দুয়ারে আমার, ঝরা পালক।
১০।      জীবনানন্দ দাশ; বেদিয়া, ঝরা পালক।
১১।      জীবনানন্দ দাশ; বনের চাতক-মনের চাতক, ঝরা পালক।
১২।      জীবনানন্দ দাশ; বনের চাতক-মনের চাতক, ঝরা পালক।
১৩।     জীবনানন্দ দাশ; অস্তচাঁদে, বনের চাতক-মনের চাতক, ঝরা পালক।
১৪।      জীবনানন্দ দাশ; ডাকিয়া কহিল মোরে রাজার দুলাল, “ঐ”
১৫।      জীবনানন্দ দাশ; শঙ্খমালা, বনলতা সেন
১৬।     জীবনানন্দ দাশ; ইতিহাস চেতনা, সমগ্র প্রবন্ধ, প্রতিক্ষণ প্রকাশনা, ২০০৯, কলকাতা।
১৭।     জীবনানন্দ দাশ; সুচেতনা, বনলতা সেন।
১৮।     জীবনানন্দ দাশ; শ্যামলী, বনলতা সেন।
১৯।      জীবনানন্দ দাশ; মিতভাষণ, বনলতা সেন।
২০।     জীবনানন্দ দাশ; বনলতা সেন, বনলতা সেন।
২১।      জীবনানন্দ দাশ; হাওয়ার রাত, বনলতা সেন।
২২।     জীবনানন্দ দাশ; সুরঞ্জনা, বনলতা সেন।
২৩।     জীবনানন্দ দাশ; সেদিন সরিয়া যাব, রূপসী বাংলা।
২৪।     জীবনানন্দ দাশ; বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, রূপসী বাংলা।
২৫।     জীবনানন্দ দাশ; যতদিন বেঁচে আছি, রূপসী বাংলা।
২৬।     জীবনানন্দ দাশ; কোথাও দেখিনি আহা, রূপসী বাংলা।
২৭।     জীবনানন্দ দাশ; এই পৃথিবীতে এক, রূপসী বাংলা।
২৮।     জীবনানন্দ দাশ; আবার আসিব ফিরে, রূপসী বাংলা।
২৯।     জীবনানন্দ দাশ; নির্জন সাক্ষর, ধূসর পান্ডুলিপি।
৩০।     জীবনানন্দ দাশ; অবসরের গান, ধূসর পান্ডুলিপি।
৩১।     জীবনানন্দ দাশ; কুড়ি বছর পর,বনলতা সেন।
৩২।     হুমায়ুন আজাদ; ‘শব্দের প্রকৌশল: বনলতা সেন, আধার ও আধেয়।
৩৩।     এ্যাডেলাইন ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১) একজন ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতাবদী সাহিত্যিক।

………………..
একটি খাপছাড়া আড্ডা পরিবেশনা।

Leave a Comment