খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটগল্পঃ পরিযায়ী কারিকা

লিখেছেনঃ কিরণ এস কুণ্ডু

কিরণ এস কুণ্ডু

রাশেদের ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শুরু করবে, কিন্তু নিজ জেলাতে আবার বলতে গেলে জন্মভূমিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রভাষক পদে আবেদনটা করেছিল। একাডেমিক রেজাল্টের কারণে চাকুরিটা পেতে বেগ পেতে হয়নি। ইতোমধ্যে কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএচডির জন্য অফার লেটারও পেয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এথনিক মাইগ্রেশন হয়ে আমেরিকার কয়েকটি অঞ্চলে বিশেষ করে কানাডার নোভা স্কোশিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে, তারপর বিছিন্নভাবে অনান্য এলাকায় ছড়িয়ে যায়, এই বিষয়ের ওপর যে রিসার্চ প্রপোজালটা সে পাঠিয়েছিল সেটাতে বিশ্ববিদ্যালয় বেশ আগ্রহ বোধ করে এবং রাশেদকে পিএচডির সুযোগ দেয়। মাস চারেকের মধ্যেই তাকে যোগ দিতে হবে।

একপুরুষ আগেও পুরোপুরি কৃষক ছিল রাশেদের পরিবার। ওর দাদা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে কিছুদিন পড়েছিল। অভাবের সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা ছাড়তে হয়। কিন্তু রাশেদের বাবাকে তিনি পড়াশোনা করিয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর তিনি কৃষি অধিদপ্তরে চাকুরিও পান। সারাজীবন গ্রামে থেকেই চাকুরিটা করেছেন। রাশেদ দেশের প্রথম সারির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়। নৃবিজ্ঞান এ ভর্তি হয়ে প্রথমে মন খারাপ হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল অর্থনীতি কিংবা সমাজবিজ্ঞানে পড়ার কিন্তু মেধাক্রম অনুসারে সেটা জোটেনি। ভর্তি হওয়ার অবশ্য আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার।

নদীর পারে সরকারি খাস জমিতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। জমিটি ছিল অত্র এলাকার প্রভাবশালী জমিদার যোগেন চৌধুরির। অত্যাচারী হিসেবে কুখ্যাতি ছিল তাঁর। পাকিস্থান হওয়ার পরও এই দেশে তাঁর বংশধরেরা ছিল। পরে ধীরে ধীরে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে চলে যায়। শোনা যায় কেউ কেউ ইউরোপ আমেরিকাতেও থাকে। সহায় সম্পত্তি নিতে না পারলেও অলংকারাদি, বাসনপত্র এবং পারিবরিক ছবি-চিত্রকর্ম কিছু নিয়ে গিয়েছিল শোনা যায়। জমিদার বাড়িটি বর্তমানে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই কিলোমিটার দূরে। মূল ভবনটি এখনো ভগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ জায়গা অবশ্য দখল হয়ে গেছে। কিছুদিন যাবৎ সেখানে ছোট্ট একটি জাদুঘর করা হয়েছে, জমিদার বাড়ির সংগ্রহশালা দিয়ে। যোগেন চৌধুরির ছেলে রমানাথ চৌধুরি চরিত্রিকভাবে বাবার ঠিক বিপরীত স্বভাবের ছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। এলাকায় স্কুল স্থাপন, বাজার প্রতিষ্ঠা, কূপ খনন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের কারণে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

প্রশাসনের উদ্যোগে জাদুঘর স্থাপন করা হলেও এর সংগ্রহশালার বেশিরভাগ সরঞ্জাম দিয়েছে জমিদার বাড়ির তৎকালীন কর্মচারী বৃদ্ধ মেরাজ সর্দার। সর্দার বংশ বংশানুক্রমিকভাবে জমিদার বাড়িতে লাঠিয়াল এর কাজ করে এসেছে। জমিদারদের সাবেক কর্মচারীর সূত্রে তিনি এলাকার বেশ ভূ-সম্পত্তিওয়ালাদের একজন। জাদুঘর এর উদ্যেগে তার কাছে থাকা পুরাতন বাক্স-পেটরা, কিছু ভাঙাচুরা চেয়ার-টেবিল, পরিত্যক্ত থালা-বাসন, পুরাতন বেশ কিছু চিত্রকর্ম আর সাদকালো কিছু ছবি সংগ্রহশালার জন্য দিয়েছিলেন। তাছাড়া প্রায় পরিত্যক্ত বাড়িটির কয়েকটি ঘর একসময় ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সুবাদে কিছু মালামাল পাওয়া গিয়েছে। যা কিছু সংগ্রহশালায় এসেছে, সবই ভগ্নপ্রায় দশা এবং নিতান্তই পরিত্যক্ত বলে জমা দিয়েছে। ভালো বলতে আছে কিছু হাতে আঁকা চিত্রকর্ম। মেরাজ সর্দার হজ্ব করে এসেছেন বেশ আগে, হাজী বাড়িতে মানুষের ছবি থাকলে লোকজন মন্দ বলে, তাও মেয়ে মানুষের, এজন্য ছবিগুলো সরিয়ে আলাদা করে বেধে রেখেছিলেন। হাজার হোক এই জমিদার বাড়িতে কাজ করেই তার বংশের এই শান-শওকত। ছবিগুলো ফেলে দিতেও খারাপ লাগছিল, আবার কাউকে দেয়ার মোটেও ইচ্ছা ছিল না।

নতুন শিক্ষক হিসেবে রাশেদের ভালোই লাগছে। ক্লাস নেয়া, সহকর্মীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে তর্ক জুড়ে দেয়া, আবার কিছু ছাত্র-ছাত্রী জুটে গেছে পাঠচক্র করার জন্য। বেশ আড্ডামুখর সময় চলে যাচ্ছে রাশেদের।

একদিন বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী এসে আবদার করলো জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখবে, সাথে তাদের স্যারকেও যেতে হবে। রাশেদও রাজি হয়ে গেল। তার নিজের এদিকে আসা হয়নি তেমন। মাধ্যমিকের পর থেকেই গ্রামের বাইরে পড়াশোনা; ফলে ঠিকভাবে বাড়িতে থাকা হয়ে ওঠেনি তার। দাদির সাথে একবার এসেছিল, সেটাও প্রাইমারি স্কুলে থাকতে। দাদির বাবার বাড়ি ছিল এই গ্রামে, এরপর বার কয়েক সে এসেছে বর্ষায় নৌকা বাইচ দেখতে।

ঠিক হলো সামনের শনিবার সকলে জমিদার বাড়ি দেখতে যাবে, সাথে নদীর পাড়ের হোটেলে দুপুরে খাওয়া দাওয়া হবে। আর যেহেতু ছোট হলেও এটাকে একটা শিক্ষাসফর বলা যায়, তাই সবাইকে এটার উপরে একটা এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে ফেরার পরে। রাশেদ আরও দুজন সহকর্মীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য। মিমি ম্যাডামকে তার ভালোই লাগে, বিশেষ করে যখন হাসে। তাই ওনাকে সঙ্গে নেয়ার জন্য কায়দা করে অনির্বাণকে দিয়ে বলিয়েছে। তাছাড়া ছাত্রীদের মাঝেও কেউ কেউ বিশেষ আগ্রহ দেখাচ্ছে। পাশে সহকর্মীরা থাকলে এগুলো এড়ানো যাবে।

বেশ সুন্দর জমিদার বাড়ির মূল ভবনের নকশা। নদী থেকে সিঁড়ি উঠে এসেছে ভবনের বাহির দিকের মূল দরজায়, যদিও নদী এখন বহু দূরে চলে গেছে। নদীর পাশের অংশটি প্রায় পুরোটাই ধ্বসে গেছে। অবশ্য উল্টো দিকে দোতলা ভবনটা কোনরকম টিকে আছে। আর ওটারই বড় একটি কক্ষ এখন জাদুঘর। সংগ্রহশালার রুমটি চৌকোণা। বিস্তর জায়গা জুড়ে দোতলা ভবনটি টিকে থাকলেও দূর্ঘটনা এড়াতে উপরে ওঠা নিষেধ। ছাত্র-ছাত্রীরা যত আগ্রহ করে এসেছিল, পুরাতন ভাঙাচুড়া আসবাবপত্র দেখে খুব মজা পাচ্ছে না বোঝা যাচ্ছে। সাথে ছবি বা সংগৃহীত বস্তুগুলোর সাথে কোন বর্ণনা না থাকায় তাদের চোখে মুখে বিরক্তিভাব স্পষ্ট। ওদিকে মিমি ম্যাডাম ব্যস্ত অনির্বাণকে দিয়ে ছবি তোলাতে। হঠাৎ হাতে আঁকা একটি ছবির দিকে তাকিয়ে রাশেদের দৃষ্টি আটকে গেল। নাচের পোশাক পরিহিত এক নারী ছবির মুখের অবয়ব ঠিক তার মৃত দাদির মতো! মনে হচ্ছে অল্প বয়সে তার দাদিকে ঠিক এমনই লাগতো, বিশেষ করে নাকের গড়ন, যেটা রাশেদ নিজেও পেয়েছে । নাকের এই গড়নটা অন্যদের থেকে আলাদা। নিজের চেহারার সাথে মিল থাকার জন্য দাদি হয়তো রাশেদকে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসতেন। দাদি মারা গিয়েছেন আজ তাও বছর বারো হলো।

ঘুরতে ঘুরতে রাশেদ আরও একটা ছবিতে একই মহিলাকে দেখতে পেল। এই ছবিটা আগেরটার তুলনায় কিছুটা অস্পষ্ট, কিন্তু অবয়বটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে। রাশেদ আনমনা হয়ে হয়ে নিজের নাকে হাত দিয়ে কী যেন বোঝার চেষ্টা করছিল, আর ভাবছিল এত মিল কিভাবে সম্ভব! হঠাৎ তার খেয়াল হলো মিমি ম্যাডাম পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন – এতক্ষণ ছবি না তুলে দেয়ার জন্য উপেক্ষা করছিল, এখন আবার নিজেই উপযাজক হয়ে কথা বলতে এসেছেন। কিন্তু রাশেদের কেন জানি ভালো লাগছে না। এরপর আর কোন আয়োজনে সে অংশগ্রহণ করতে পারলো না।

ফিরে গিয়ে ঘটনাটি ভুলে যাওয়ার চেষ্ট করলো রাশেদ। নিজের ক্লাস আর পিএইচডি স্কলারশিপ নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্ট করলো। কিন্ত ছবিগুলোর কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অবিকল তার দাদির চেহারার সাথে সে নিজেও যেন ওখানে আছে। বেশ কয়েকদিন যাওয়ার পরে রাশেদ আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, আবার গেল জমিদার বাড়ির জাদুঘরে।

ছবিগুলো যত দেখে, ততই অবাক হয় রাশেদ। এই চেহারার সাথে অন্য কোন ছবির মিল নেই। ছবি দেখে ধারণা করা যাচ্ছে যে এই নারী নাচতে জানতো। না হলে এরকম নাচের পোশাকে দেখতে পাওয়ার কথা না। ইনি কি জমিদার বাড়ির কেউ নাকি কোন নাচনেওয়ালী? কার কাছ থেকে জানা যাবে এসব তথ্য? জাদুঘরের দারোয়ান রামচরণ দাস কে জিঞ্জাসা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু সরাসরি তো বলা যাবে না। কিভাবে বলা যায়? যা হোক বিভিন্নভাবে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে রামচরণকে জিজ্ঞাসা করলো এই ছবিগুলো যাদের তাদের সে চেনে কিনা। রামচরণ জানালো শুধু জমিদার রমানাথ চৌধুরি ছাড়া আর কাউকেই সে চেনে না। তার বাপ-দাদারা এই বাড়িতে কলাপাতা কাটতো, সেই সুবাদে চেয়ারম্যান সাহেব তাকে এই চাকরিটা দিয়েছে, অবশ্য এর জন্য ৩০ হাজার টাকাও দিতে হয়েছে, বেতন নাই বললেই চলে, আশা একটাই চাকরি নাকি একসময় সরকারি হবে।

রাশেদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য পাওয়া গেল; হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক আমিন মাস্টার এই জাদুঘর তৈরিতে কাজ করেছেন। তিনিই জমিদার বাড়ির সাবেক কর্মচারী মেরাজ সর্দারকে বলে আসবাবপত্রসহ ছবিগুলো আনার ব্যবস্থা করেছিলেন।

রাশেদ আবার ভাবলো বাদ দেই। কী দরকার এসব করার? কিন্তু ভিতরে কোথায় যেন একটা অস্বস্তি কাজ করে যাচ্ছে। মিমি ম্যাডাম ইদানিং বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছেন, ফেসবুক মেসেঞ্জারে নিয়মিত গান, কবিতা পাঠান। রাশেদও উত্তর দেয়, কিন্তু ভিতরে সেই আগের মতো আবেগটা অনভূত হয় না। সব মিলিয়ে সে সিন্ধান্ত নেয় নাচের পোশাক পরিহিত ছবির সেই নারীর পরিচয় তার জানতেই হবে। তাকে জানতেই হবে ঐ নাচনেওয়ালীর সাথে তার চেহারার মিলটা নিছকই কাকতালীয়, নাকি এর পিছনে কোন কারণ রয়েছে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব পরিচয় জানা? জমিদার বাড়ির কেউ তো নেই, পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলের তথ্য পাওয়া যাবে, এমন জানাশোনাও কেউ নেই। যতটুকু জানা যাবে আমিন মাস্টার আর মেরাজ সর্দারের কাছ থেকে। আদৌও কি তাদের পক্ষে বেশি কিছু জানা সম্ভব? আবার সরাসরি জানতে চাইলে তারা সন্দেহ করবে না কি? পাগল ভাববে না তো!

রাশেদ একটা বুদ্ধি বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্প হিসেবে কয়েকজন ছাত্র নিয়ে হাজির হয় মেরাজ সর্দারের বাড়িতে । জমিদার বাড়ির গল্প তুলতেই মেরাজ সর্দার তাঁর বাপজানের গল্প তোলেন – কিভাবে তাঁর বাবা জমিদার রমানাথ চৌধুরীকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, বাবার মুখে শোনা সেই গল্প বলা শুরু করলেন। জমিদাররা আজ থাকলে চেয়ারম্যানের মত লোকেরা তাদের সামনে মাথা তোলার সাহস পেতো না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর গল্পের মধ্য থেকে যেটুকু জানা গেল, জমিদার যোগেন চৌধুরী আমুদে মানুষ ছিলেন, তিনি নিয়মিত বাইজী নাচাতেন, এমনকি লক্ষ্নৌ থেকেও গানের দল নিয়ে আসতেন।

রাশেদের উত্তেজনা কিছুতেই কমছে না। আর কয়েক মাস পরেই দেশের বাইরে যাবে, কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে সে মেতে আছে জমিদার বাড়ির সেই চিত্রকর্ম নিয়ে। এভাবেই একদিন সে গেল আমিন মাস্টারের বাড়িতে। তিনি রমানাথ চৌধুরীকে চিনিয়ে দিলেন। বাকি ছবিগুলো না চিনলেও সেই নারীর ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। জানালেন রমানাথ চৌধুরীর বাবা যোগেন চৌধুরী দিলশাদ বেগম নামের লক্ষ্নৌয়ের এক বাইজীকে আটকে রেখেছিলেন, তাকে খুব পছন্দ হয়েছিল বলে। এরকম কত ঘটনাই তো থাকে জমিদারদের! তবে তিনি আরো জানালেন, মহলে কোন এক বাইজী মারা যাওয়ায় কিছু পুলিশি ঝামেলা হয়েছিল। এর বেশি কিছু তাঁর জানা নেই। তৎকালীন জেলা সদরের রেকর্ডরুমে আরও কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

উদ্বিগ্ন রাশেদ ভাবলো আর কিছুই কি আদৌ জানা সম্ভব? মোবাইলে ছবিটা দেখছিল আর চিন্তা করছিল অন্তত নামটা তো জানা গেল। কিন্তু এটুকুতে সন্তুষ্ট হতে পারলো না সে। ঐ নারীর সাথে আসলে কি কোন সম্পর্ক তার পরিবারের রয়েছে? হঠাৎ খেয়াল হলো ছবিটার নিচের দিকে হিন্দি হরফে চার অক্ষরে কিছু একটা লেখা। বহু কষ্টে অক্ষরগুলো বের করে গুগল সার্চ দিয়ে দেখে লেখা শব্দটি হচ্ছে ‘দিলখুশ’।

ছবির মানুষটির ইতিহাস বের করার জন্য রাশেদ যেন পাগল হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড় ভাই এডিসি, যিনি তার শ্যালিকাকে দেখানোর জন্য বেশ কিছুদিন যাবত যোগাযোগ রাখছিলেন। তার মাধ্যমে সাবেক জেলার রেকর্ড রুমে একদিনের জন্য ঢোকার অনুমতি জুটে যায়।

এত এত কাগজপত্রের ভিতরে কোথায় খুঁজবে দিশেহারা হয়ে যায় রাশেদ। পুরাতন এক কর্মচারী এক কোণায় উপরের দিকের তাকের ওপর একটা বস্তা দেখিয়ে বলে ব্রিটিশ আমলের যা রিপোর্ট ওখানেই আছে। রাশেদ বস্তা খুলে দেখে টাইপ রাইটারে লেখা সেসবের বেশিরভাগই পড়ার মতো অবস্থায় নেই। হঠাৎ একটি কাগজের উপর এসে দৃষ্টি আটকে যায় তার। তৎকালীন মহকুমা বর্তমান জেলার থানার নামে ইস্যুকৃত একটা চিঠিতে যোগেন চৌধুরীর নাম লেখা। চিঠিটা সম্ভবত কলকাতা পুলিশ থেকে পাঠিয়েছিল। ওটার সাথেই লেপ্টে থাকা আরেকটা কাগজ খুলতে গেলে প্রায় ঝরে পড়ে। প্রথম চিঠিটার ভিতরে একটা তারিখ আছে। পরে পাঠানো চিঠিটার সাথে তারিখের পার্থক্য প্রায় এক বছর! ইংরেজিতে লেখা সেই প্রতিবেদন থেকে যা উদ্ধার করা গেল, প্রসবজনিত জটিলতায় দিলখুশ বেগমের মৃত্যু হয়। কাাঁপা হাতে মোবাইলের ক্যামেরায় দুটি ছবি তুলে নেয় রাশেদ।

এ কয়দিনে পড়াশোনা করে যতটুকু সে জেনেছে, এই বিনোদন শিল্পীরা সাধারণত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতেন না, বিশেষ করে যতদিন এই শিল্পচর্চার মাঝে থাকতেন। তাহলে কে ছিল দিলখুশ বেগমের সন্তানের পিতা? জমিদার যোগেন চৌধুরী নাকি অন্য কেউ?  আরও রাজ্যের প্রশ্ন রাশেদের মনকে ঘিরে ধরে। দিলখুশ বেগম কি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন? সেই সন্তান কি বেঁচে ছিল? কী হয়েছিল সেই সন্তানের? কী সম্পর্ক সেই সন্তানের সাথে তার দাদির? এমনকি তার নিজের সাথেও! তাকে জানতে হবে। দরকার হলে সে কলকাতা যাবে, লক্ষ্নৌ গিয়ে খোঁজ করবে। আরও কত দিলখুশ বেগমরা বাংলায় ছড়িয়ে আছে, তাকে জানতে হবে। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আমেরিকায় মাইগ্রেশন-এর ইতিহাস জানার আগে তাকে নিজের ইতিহাস জানতে হবে। পরিযায়ী কারিকাদের ইতিহাস রাশেদকে জানতে হবে। নইলে তার তৃষ্ণা মিটবে না।

…………………..
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment