গল্প

ছোটোগল্পঃ সমীকরণ

চুন্নু মোল্লার পানের বরজের পাশ দিয়ে করিম মোল্লার বাঁশ বাগানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটা বরজে দিনমজুরের কাজে রত আবদুল গনিকে দেখে ভেউ করে ডাক পাড়লে আবদুল গনির মনে পড়ে যায় তার স্ত্রী করিমনের আজ মাসিক চলছে।

আপনারা যারা ইতোমধ্যেই মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তার ঘেউয়ের সাথে আবদুল গনির বউয়ের মাসিকের কথা মনে পড়ার কারণ খুঁজতে লেগে গেছেন তাদেরকে বলছি, এই দুইয়ের মধ্যে কেবল সূক্ষাতিসূক্ষ নয়, বেশ বড়সড় একটা কারণ রয়েছে। আজ সকালে আবদুল গনির ঘুম ভাঙে করিমনের উচ্চকণ্ঠ গালাগালিতে। সে তার স্বামীর কাছে মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটার অপকর্মের বিচার চেয়েই ক্ষান্ত হয় না, সে কুত্তাটাকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেয় এবং শাপ-শাপান্ত করতে থাকে মজনু মিয়ার মরণ চেয়ে। না, আবদুল গনির কাছে করিমনকে কুত্তাটার অপকর্মের ফিরিস্তি দিতে হয় না; সে জানে কুত্তাটা কী করেছে।

নইহাটা গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই কুত্তা থাকলেও মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটার মতো এমন পাজি কুত্তা আর একটাও নাই। ওটার কাজই হলো সারা গ্রাম জুড়ে মাইয়া মানসের মাসিকের ত্যানা চুরি করে এনে তার মালিকের কাছে সরবরাহ করা। শোনা যায়, মজনুই নাকি কুত্তাটারে এই ট্রেইনিং দিয়েছে। আরো গুজব রয়েছে, বছর দুয়েক আগে কোনো এক বৃষ্টিস্নাত শরৎ সন্ধ্যায় মজনুর বউ তাকে ছেড়ে এক নাকের নথ-কানের দুল বিক্রি করতে আসা ফেরিওয়ালার গয়নার বাক্সের সাথে ঝুলে পড়ে গ্রাম ছাড়ার পর থেকেই নাকি গ্রামের মাইয়া মাইনসের মাসিকের ত্যানা চুরি হতে শুরু করে। গ্রামের মানুষকে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে একটুও সমস্যা হয় না। গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি রটে যায়, মজনু তার বাদামী কুত্তা দিয়ে চুরি করানো সেইসব ত্যানা শুকে শুকে যৌনতার সুখ মিটায়।

এসবই শোনা কথা। মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাকে কেউ কোনোদিন কোনো প্রকার ত্যানা মুখে নিয়ে যেতে দেখেনি। তবে গ্রামের মানুষ কোনো কথাকেই অবিশ্বাস করে না। যা কিছু রটে, তা কিছু ঘটে, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী করিমনও বিশ্বাস করে মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাই তার ত্যানা চুরি করেছে। না, সে মোটেও কবির সেই ‘কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে’ বাণীতে আস্থা রাখতে পারে না। সকাল বেলায়ই সে একেবারে তেড়েফুঁড়ে মারদাঙ্গা রূপে আবির্ভূত হয় আবদুল গনির কাছে। “তুমি যদি আইজ এই কুত্তাটার একটা বিহিত না করো, তাহলে তোমার সাথে আড়ি।”

করিমনের আড়ি মানে যে কিসের সাথে আড়ি, আবদুল গনি তা ভালো করেই জানে। করিমন যদি সত্যি সত্যিই তার সাথে ঐ বিষয়ে আড়ি দেয়, তাহলে তার পক্ষে বাইচা থাকারই কোন মানে থাকবে না। এমনিতেই তার হর্স পাওয়ার একটু বেশি। একটু বেশি বললে আসলে কমই বলা হবে। সে নিজে মনে করে তার পক্ষে শরিয়াহ মোতাবেক এক হালি বউ অনায়াসে সামলানো সম্ভব। কিন্তু সরকারী আইনের ফ্যাকরায় পড়ে সে একটার বেশি বিয়া করতে পারতেছে না। বিয়ার মাসখানেক পর্যন্ত তাও যা চলছিল, করিমন রোজ তিন-চারবার তার যন্ত্রনা সহ্য করেছে, কিন্তু এখন আর কিছুতেই একবারের বেশি রাজি হয় না। আর মাসিকের তিন দিন তো একদম ছুঁতেই দেয় না। আবদুল গনি বুঝতে পারে না, আল্লায় তারে এত হর্স পাওয়ার দেলে কীজন্য; আর দেলেই যহন, তহন এমন সরকারের দেশে তার জন্ম হইলো না ক্যান যেহানে সে অন্তত শরিয়াহ নির্ধারিত কোটা পূরণ করতে পারত।

না, বিয়ের আগে আবদুল গনি তার এমন হর্স পাওয়ারের অধিকারী হওয়ার অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। করিমনের সংস্পর্শেই তার পাওয়ার জেগে ওঠে। এখন করিমন যদি এই ত্যানা ইস্যুতে ধর্মঘট ডেকে বসে তাহলে তাকে উপোস থাকতে হবে। না, সেটা সে থাকতে পারবে না। তাকে কিছু একটা করতেই হবে। এই ভেবে আবদুল গনি নিড়ানিটা হাতে নিয়ে চুন্নু মোল্লার পানের বরজ থেকে হুড়মুড় করে বের হয়। মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাকে আজ কুপিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিবে সে।

যে সাহস ও উত্তেজনা নিয়ে আবদুল গনি চুন্নু মোল্লার পানের বরজ থেকে বের হয়ে মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাকে ধাওয়া করেছিল, কুত্তাটা তার দিকে ঘুরে দাঁত খিঁচুনি দিতেই তা উবে যায়। একটুখানি নেড়ি কুত্তার যে এত বড় দাঁত হতে পারে, সেটা সে ভাবতেও পারেনি। মুহূর্তেই তার মনে পড়ে যায় এখন ভাদ্দর মাস চলছে, এই মাসে কুত্তায় কামড়াইলে পেটের মধ্যে বাচ্চা হয়। আর কুত্তায় কামড়ানোর চিকিৎসার জন্য যে সাতটা না চৌদ্দটা ইনজিকশন নেয়া লাগে, সেই পয়সাও তার নাই। আবার এইখানে কুত্তায় কামড়াইলে এমন কোনো সাক্ষীও থাকবে না যে সে তার চিকিৎসার খরচ মজনু মিয়ার কাছ থেকে আদায় করবে। ভয়ে সে প্রথমে পিছনে দৌড় দেবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু কুত্তাটা যেভাবে সামনে এগুতে থাকে, তাতে সে দৌড় দেবার সাহস পায় না। সে নিড়ানিটাকে ছুড়ে মারে কুত্তাটার দিকে। কিন্তু এত চালাক কুত্তা, যেটা কিনা গোপনে মাইয়া মাইনসের মাসিকের ত্যানা চুরি করে বেড়ায়, সেটাকে কি নিড়ানি ছুড়ে ঘায়েল করা যায়? কুত্তাটা লাফ দিয়ে সরে যায় এবং একেবারে তেড়েফুঁড়ে তার দিকে ছুটে আসে। নিরস্ত্র আবদুল গনি প্রথমে কিছুক্ষণ রাস্তায় দৌড়ায়, তারপর ঢুকে যায় করিম মোল্লার বাঁশ বাগানে। সে দৌড়ায়, মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাও দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা দুজনেই একসময় করিম মোল্লার বাঁশ ঝাড়ের কাছে চলে আসে। তারপর দ্রুত বাঁশের কঞ্চিতে পা ফেলে ফেলে কয়েক হাত ওপরে গিয়ে আশ্রয় নেয় আবদুল গনি, আর কুত্তাটা বার কয়েক ঘেউ ঘেউ ডেকে চুপচাপ শুয়ে পড়ে নিচে।

আবদুল গনি ভেবেছিল কুত্তাটা কিছুক্ষণ পরে চলে যাবে এবং তখন সে নেমে পানের বরজের কাজে ফিরে যাবে। কিন্তু তা হয় না; কুত্তাটা গোয়াড় মানুষের মতোই বাঁশতলায় গেড়ে বসে থাকে আর বারবার ওপরে উঁকি দিয়ে তাকে দেখে। আবদুল গনির রাগ ধরে যায়। এই ভর দুপুরে বাগানে কোনো মানুষ যে আসবে না, এটা সে ভালো করেই জানে। তবুও ভুল করেও যদি কেউ এসে যায়, তার অপেক্ষা করে সে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে থাকলে পেটের কৃমিগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করে। তবে ক্ষুধার চেয়েও এই মুহূর্তে সে তার তলপেটে পেচ্ছাপের চাপ অনুভব করে বেশি। না, পেচ্ছাপ করার জন্য তাকে বাঁশের ঝাড় থেকে নামার প্রয়োজন নেই, কিন্তু সে পেচ্ছাপ করছে আর নিচে কুত্তাটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, এটাতে সে অস্বস্তি বোধ করবে।

তলপেটে চাপ বাড়ার সাথে সাথে রাগটাও বাড়তে থাকে আবদুল গনির। একসময় সে সিদ্ধান্ত নেয় সে কুকুরটার গায়েই পেচ্ছাপ করে দিবে। কিন্তু কুত্তাটা যা চালাক, ওটার গায়ে তাক করে পেচ্ছাপ করাও এত সহজ হবে না। সে অপেক্ষা করে কখন ওটা ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর চনচনিয়ে কুত্তাটার একেবারে মাথা বরাবর ছেড়ে দেয় তলপেটে জমে থাকা লবনাক্ত জলের ধারা। কুত্তাটা লাফ দিয়ে উঠে মাথায় ঝাকুনি দিয়ে গা থেকে খানিকটা পেচ্ছাপ ঝেড়ে ফেলে, তারপর গায়ে-পায়ে লেগে থাকা পেচ্ছাপগুলো চেটে চেটে পরিস্কার করে।

আবদুল গনি শান্তি পায়। এ শান্তি কেবল তলপেটের চাপ কমানোর শান্তিই না, কুত্তাটাকে তার পেচ্ছাপ খাওয়ানোর মধ্যেই বরং বেশি শান্তি পায় সে। বউকে অন্তত সে এটা বলে তার বাহাদুরি দেখাতে পারবে। কিন্তু তাতে কি করিমনের ধর্মঘট ভাঙবে?

কুত্তাটাকে তার পেচ্ছাপ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে আবদুল গনির মনে যে খুশী খুশী ভাব এসেছিল, তা পরক্ষণেই হারিয়ে যায় এটা মনে করে যে, পেচ্ছাপ তো পেচ্ছাপ, কুত্তা তো গু-ই খায়। পেচ্ছাপ আর এমন কী হলো! করিমন নিশ্চয়ই তার এই বীরত্বের পাত্তা দিবে না।

খিদেয় পেটের মধ্যে ছুঁচো ডন মারতে শুরু করে একসময়। কিন্তু নামার কোনো উপায় খুঁজে পায় না আবদুল গনি। মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তার কামড় খেয়ে পেটে কুত্তার বাচ্চা হওয়ানোর চেয়ে এই বাঁশঝাড়ে বসে থাকা উত্তম মনে করে সে তার কঞ্চির ওপর দাঁড়ানোটাকে আরেকটু আরামদায়ক করতে খানিকটা ওপরে উঠে অন্য একটা বাঁশের সাথে হেলান দেয়।

আবদুল গনি এখন যেখানে অবস্থান করছে, সেখান থেকে কুত্তাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সে ধরে নেয় তাকে না দেখতে পেলে কুত্তাটা একসময় চলে যাবে। তবে এ ব্যাপারেও সে নিঃসন্দেহ হতে পারে না – সে না দেখতে পেলেও কুত্তাটা নিশ্চয়ই তাকে দেখতে পাচ্ছে। কুত্তার চোখ তো যেমন-তেমন চোখ না, রাইতের আন্ধারেও দেখতে পায়। তার মনে পড়ে যায় একবার তার বড় চাচা এই কুত্তার জন্যই একটা চোর ধরতে পেরেছিল। রাইতের ঘুটঘুটে আন্ধারে কলাবাগানে লুকিয়ে থাকা সেই চোরটাকে তার চাচা না দেখতে পেলেও তাদের পোষা কুত্তাটা ঠিকই দেখতে পাইছিল। তারপর সেই চোরটাকে উঠানে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করার খুঁটিতে বেঁধে তারা সবাই কী মারাটাই না মারল! আবদুল গনির বয়স তখন সাত কি আট হবে। তার হাতেও চাচা একটা লাঠি তুলে দিয়েছিল। সে অবশ্য দুটোর বেশি পিটান দিতে পারেনি; চোরটার জন্য তার মায়া লেগেছিল। তাছাড়া চোরটা ছিল তাদের বাড়ির কাছেরই পরিচিত এক লোক। তাকে সে এবং তার ভাইয়েরা চাচা বলেই ডাকত। সেও তাদের ভাইস্তার মতোই আদর করত। সেই আহমদ চাচা তাদের বাড়িতে কেন চুরি করতে এসেছিল, এটা আজও ভেবে পায় না আবদুল গনি। তবে সেই চুরিতে ধরা খাওয়ার পর থেকে আহমদ চাচা ধর্ম-কর্ম শুরু করে। এখন তো সে আহমদ পীর। প্রতি বছর তার বাড়িতে বেশ বড়সড় ওরশ হয়। সেখানে হাজার হাজার মানুষ আসে। হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মের লোকই আসে। এটা অবশ্য বেশ ভাল লাগে আবদুল গনির।

চোরের কথা মনে পড়তেই আবদুল গনির মনে পড়ে যায় তাদের সে-সময়কার পারিবারিক ঐশ্বর্য ও ধন-সম্পত্তির কথা। চোর আসবেই না কেন, তাদের বাড়িতে তখন গোলায় গোলায় ধান উঠত। তারা শিশুরা সেইসব ধানের গোলায় উঠে লাফ দিয়ে পড়তো উঠানে। আবদুল গনি তখন স্কুলে যেত। তার আব্বা বলত, “এই সব ধন-সম্পদ কিছুই না রে গনি। যদি ঠিকমতো পড়াশুনা করিস, তাইলে শহরে যাইতে পারবি। মোটর গাড়িতে চড়তে পারবি।”

তখন পর্যন্ত মোটর গাড়ির নামই শুনেছে গনি, সেটা কেমন তা চোখেও দেখেনি। তার বাবাও দেখছে কিনা, সেই সন্দেহ ছিল তার। তবে সে দেখতেও পারে। জমির একটা মামলায় হাজিরা দিতে সে মাঝে মাঝেই বাকেরগঞ্জ যেত, বড় বাজার করার জন্য ঝালকাঠিতেও যাওয়া লাগত। সেখানে দু-চারটা গাড়ি না থাইকা পারে না।

অবচেতনেই আবদুল গনির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কোথায় সেইসব জমি এখন! বিষখালি নদীর বিষে তলিয়ে গেছে সবকিছু। সেই চোর ধরার বছর তিনেক বাদেই বিষখালী তার বিষ নিয়ে সাপের মতো বাঁক ফিরতে শুরু করে। বিষখালির বাঁক ফিরাতে কত ঝাড়-ফুঁক-নামাজ-রোজা চলল, কিন্তু বিষখালি কিছুতেই থামল না। পরপর দুই বর্ষায় তাদের বাড়ি তো বাড়ি, জমি-জমা এমনকি আশেপাশের গোটা দুয়েক মসজিদ পর্যন্ত গ্রাস করে নিল। গনির পড়াশোনা উঠল চুলোয়। তার বাবা প্রথমে কিছুদিন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করল। তাতে ব্যর্থ হয়ে শুরু করল অন্যের বাড়িতে কামলা দেয়া। কিন্তু যে-লোক জীবনে হালের লাঙ্গল ধরেনি, সে কী করে অন্যের বাড়িতে কামলা খাটবে। মানুষ তাকে কামলা নিত কেবল অতীতে তাদের অর্থ-জৌলুসের কথা বিবেচনায় নিয়ে। তার আয়ে ছেলে-মেয়েদের পেটে ভাত জোটে না দেখে আবদুল গনির মা-ও গোপনে অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করল। সেটা যেদিন তার বাবা জানতে পারল, তার পরের দিন সে যে বাড়ি থেকে বের হলো, আর ফিরে এল না। কারো কাছেই আর কোন খবর পাওয়া গেল না তার। কেউ বলে তাকে নিয়ামতির দিকে যেতে দেখেছে, কেউ বলে নলছিটির দিকে। কিন্তু আবদুল গনির মোটেই তা বিশ্বাস হয়নি। তার মনে হয়েছে তার বাবা বিষখালির কাছে আত্মসমপর্ণ করেছে। তার জমি-বাড়ি যেখানে, সেখানেই তো যাওয়ার কথা তার!

না, আবদুল গনি এখন সেসব চিন্তা করতে চায় না। আরো একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে আরেকটু নিচে নেমে দেখে মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটা এখনও সেখানে বসে আছে কিনা। গোয়াড় কুত্তাটাকে এখনও ঠায় শুয়ে থাকতে দেখে সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় কুত্তাটাকে একদিন ইঁদুর মারার বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। কিন্তু সে না হয় পরে হলো, এখন তাকে চিন্তা করতে হবে কী করে কুত্তাটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

কিছুটা নিচে নামতেই তার নাকে তীব্র গুয়ের গন্ধ আসে। সে বুঝতে পারে না কেন হঠাৎ করে এই গন্ধটা আসছে; একটু আগেও সে যখন এখানে বসে ছিল, তখন তো গন্ধটা আসেনি। আর গন্ধটা কেমন তাজা, বাসি গুয়ের গন্ধ এতটা তীব্র হয় না। গন্ধটা তার নাক দিয়ে শ্বাসনালী হয়ে ফুসফুসে পৌঁছেই থামে না, খানিকটা ঢুকে যায় পাকস্থলীতে। তারপর অনায়াসে শূন্য পাকস্থলী পার হয়ে ক্ষুদান্ত্রে তীব্র মোচড় দিয়ে বৃহদান্ত্রে জমে থাকা স্বগোত্রীয় বর্জ্যে ঢুকে পুট পুট আওয়াজ তুলতে শুরু করে।

পেটের আওয়াজটাকে দমিয়ে দিতে বাঁশ থেকে একটা হাত ছাড়িয়ে পেট চেপে ধরে ধরে আবদুল গনি। কিন্তু তাতে কাজ হয় না। গুয়ের গন্ধ থেকে বাঁচতে তাই পেটের মধ্যে অনবরত সেই পুট পুট আওয়াজ নিয়েই বাঁশের কঞ্চিতে পা রেখে রেখে ওপরে উঠতে থাকে সে। একটা সময় গন্ধটা মরে আসে। সেখানে উঁচুতে দাঁড়িয়ে সে পেট ভরে শ্বাস নেয়, কিন্তু পেটের পুট পুট আর থামে না। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসা ঢোল-করতালের শব্দে কান পাতলে আবদুল গনির আর পেটের পুট পুট আওয়াজের কথা খেয়াল থাকে না।

পুব পাড়ায় মহেন্দ্র হালদারের বাড়িতে কীর্তন চলছে। ষোল প্রহরব্যাপী কীর্তনের আজ শেষ দিন। গত রাতে সে সেখানে গিয়েছিল। আসলে করিমনের আবদার মিটাতেই তাকে কীর্তনে যেতে হয়েছিল; সে নাকি আগে কখনো কীর্তন দেখেনি। এর আগেরবারও করিমন একই দাবী জানিয়েছিল, কিন্তু পারিপার্শ্বিক ও সমাজ বিবেচনায় আবদুল গনি গতবারে তাকে কীর্তনে নিয়ে যেতে পারেনি। তখন তাদের বিয়ের বয়স ছিল মাত্র দুই মাস। “নতুন বউ লইয়া আদোর কতো!” মাইনসের এরকম কথা শুনতে সে ভয় পায়। তবে এবারে করিমনকে আর ফিরানো যায়নি। আর ওতেই ঘটে গেছে বিপত্তি। মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটা টের পেয়ে গিয়েছিল যে আবদুল গনির ঘরে আজ কেউ নেই। আর সেই ফাঁকেই সে করিমনের মাসিকের ত্যানা চুরি করে নিয়ে গেছে। আর সেই ত্যানার প্যাঁচে পড়ে কুত্তা তাড়াতে গিয়ে আবদুল গনি এখন বাঁশঝাড়ের মাথায় উঠে কাঁচা গুয়ের গন্ধে পুট পুট করা পেট নিয়ে ঢোলের বাদ্য শুনছে।

করিমনের ত্যানার কথা মনে পড়তেই তার শরীরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই বাঁশঝাড়ের মাথায় বসে এভাবে শরীর জাগার কোন মানে খুঁজে পায় না সে। এমনিতেই আজ তার শরীরকে উপোষ দিতে হবে। শুধু আজই নয়, আরো অন্তত দুই দিন। করিমনের ওপর খুব রাগ হয় তার। রাগ হয় আল্লাহর ওপরও। কী দরকার ছিল মাইয়া মাইনসেরে মাসে তিন-চারদিন এভাবে পচা রক্ত-টক্ত দিয়ে মাখিয়ে রাখার। আল্লাহ চাইলে কি অন্য কোন বিধান করতে পারতে না!

শরীরটাকে থামাতে আবদুল গনি বাঁশ পাতার ফাকা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। পুরো আকাশে মাত্র দুই টুকরো মেঘ, বাকিটা নীল। তার চোখে মেঘের টুকরো দুটো করিমনের স্তনের রূপ নিয়ে চোখের সামনে ঝুলতে থাকে। ঝুলতে ঝুলতে সেগুলো তার ঠোঁটের কাছে চলে আসে। তার আলতো স্পর্শে আবদুল গনির চোখ দুটো বুঁজে আসে। এবার পুরো আকাশটাই হয়ে যায় করিমনের শরীর। সে চোখ বুজে করিমনের শরীরকে অনুভব করতে থাকে। বাতাসের দুলুনিতে বাঁশ ঝাড়ের কাপুনিকে মনে হয় করিমনের শিহরণ। সে-শিহরণে অনুরণিত হয়ে সে কখন যে দু’হাতের মুঠোয় ধরা বাঁশ চাটতে শুরু করেছিল সেটা খেয়াল হয় বাঁশ ঝাড়ের গোড়ার দিক থেকে আসা থপথপ শব্দে।

আবদুল গনি ভেবেছিল ওটা হয়তো মজনু মিয়ার বাদামী কুত্তাটাই হবে। সম্ভবত ওটা ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু শব্দটা কিছুতেই থামে না, যেন আরো বেড়েই চলে ক্রমাগত। আর সেই সাথে কেমন মানুষের গোঙানির শব্দও আসতে থাকে। নিচের দিকে মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে তার শরীরটা থেমে যায়। লুঙ্গিটাতে কাছুটি দিয়ে সে আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকে। বাঁশ ঝাড়ের গোড়াটা এবং এর চারপাশ তার নজরে আসতেই সে দেখে নেয় কুত্তাটা কোথাও আছে কিনা।

না, কুত্তাটাকে কোথাও দেখা যায় না। এরপরে সে চোখ ফেলে যেদিক থেকে শব্দটা আসছে সেদিকে। সে যা দেখতে পায়, তাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না তার। পাশের আরেকটা বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে কামরত চুন্নু মোল্লার মেয়ে জান্নাতুন ও করিম মোল্লার শ্যালক রুবেল। দুজনের এক জোড়া পা তোলা ও এক জোড়া মাটিতে। আর ভাদ্রের ভেজা মাটিতে তাদের পায়ের ওঠানামায় শব্দ হচ্ছে থপ থপ থপ।

আবদুল গনির শরীরটা ফের মোচড় দিয়ে ওঠে। বাঁশ বেয়ে ছড়ছড় করে নেমে নিচে নেমে আসতে থাকে সে। বাঁশের কঞ্চিতে বুকের গেঞ্জিটা ছিড়ে চামড়াও খানিকটা ছিলে যায়, সেদিকে হুশ থাকে না তার। তার চোখে জান্নাতুনের শরীর ছাড়া আর কিছু থাকে না। আরো নিচে নামতে থাকলে মাটি থেকে কয়েক ফুট ওপরে এসে তার পলেস্টারের লুঙ্গিটা বাঁশের কঞ্চিতে আটকে যায় এবং আবদুল গনি সেখানে ঝুলে থাকে। তার গলা থেকে বেরিয়ে আসে, “ধুর্বাল!”

ওপাশের বাঁশঝাড়ে ওপর থেকে মানুষের কণ্ঠ শুনতে পাওয়ায় রুবেল ও জান্নাতুনের পায়ের থপথপ থেমে যায়। দুজনেই সেদিকে তাকায়। বাদুরের মতো একটা মানুষকে ঝুলতে দেখে পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে তারা ভূঁত ভূঁত বলে চিল্লাতে চিল্লাতে দৌড় দেয় বাড়ির দিকে।

সন্ধ্যায় আবদুল গনির গায়ে মলম লাগাতে লাগাতে করিমন জানতে চায় তার এই অবস্থা কী করে হলো। গনি প্রথমে ভেবেছিল সে করিমনের কাছে কুত্তাটার কথা বলবে না। কিন্তু কুত্তাটাকে পেচ্ছাপ খাওয়ানোর কথা মনে পড়তেই শুরশুর করে বলে দেয় সব। বিজয়ীর হাসি হাসে। আবদুল গনির সাথে হাসিতে যোগ দেয় না করিমন। সে মলম লাগানো বন্ধ করে উঠে ঘরে চলে যায়। ঘরে গিয়ে গনির ছেড়া লুঙ্গিটাকে বটিতে ফেলে কুঁচিকুঁচি করে, তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।

পরদিন সকালে মজনু মিয়া ও তার বাদামী কুত্তাটাকে নইহাটার কোথাও দেখা যায় না। সাথে খুঁজে পাওয়া যায় না করিমনকে।

Leave a Comment