লিখেছেনঃ দূরের পাখি

একেশ্বরবাদী বা পৌত্তলিক বা জগাখিচুড়ী, যেই ব্যঞ্জনেই রান্না করা হোক, ধর্মতত্ত্বের তথা ধর্মের মৌলিক সমস্যা একটাই । অবশ্য সমস্যার কারণও একটাই । কারণ হচ্ছে ধর্ম যেহেতু সম্পূর্ণ নির্জলা বাটপারির উপর দাঁড়ানো, সেহেতু তার সমস্যাও সেই প্রমাণে । অর্থাৎ আল্লা বা ঈশ্বর বা ভগবান যে আমার প্রার্থণা শুনছেন তার প্রমাণ কী ? আদি বাটপারের অবশ্য উত্তর আগে থেকেই তৈরী করা থাকে । মরার পরে সব দেবেনে । মরার পরে কবর থেকে তো কেউ উঠে এসে বলতে পারছে না, তা আমি এখন তুমি ঠগের কথা বিশ্বাস করবো কেনো ?

প্রথম শ্রবণে বেশ হঠকারী মনে হলেও ধর্মের বিরুদ্ধে মানুষের সন্দেহের এবং সেসব সন্দেহের জবাব দেবার জন্য অত্যন্ত ক্ষুরধার মস্তিষ্কের লাখে লাখে ধর্মতাত্ত্বিকের বয়ান করা সমস্ত কিছুর গোড়াতে কেবল এইটুকু সারবস্তুই নিহিত । এই এক প্রশ্ন থেকেই কান টানতে মাথা চুল আর গোটা শরীরের মত সমস্ত কিছুই উঠে আসে । ঈশ্বরের কাছে কায়মনোবাক্যে তুমি ধর্মগুরু যেমনে যেমনে বলছো তার সবকিছু মেনেই চাইলাম, কিন্তু ফল পাইলাম না কেনো? ধর্মতাত্ত্বিক তখন বুঝায় ঈশ্বর গোটা দুনিয়ার সমস্ত কিছু দেখভাল করছেন, তিনি সর্বজ্ঞানী, তিনি চাইলেই তোমাকে যে কোন কিছু দিতে পারেন, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি জানেন কোথায় কার জন্য কোনটা মঙ্গল, সবার সবচে বেশী মঙ্গল যাতে হয় সেভাবেই তিনি সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করবেন ।

কোনটা রেখে কোনটা ধরি!

এই লাইনে যাওয়ার পরে ধর্মতাত্ত্বিকের জন্য ঝামেলা কমে না বরং আরো বেশী বাড়ে । তৈরী হয় আরো শত শত প্রশ্ন । সেইগুলোকে পাশ কাটানোর জন্য মোটামুটি প্রায় সব ধর্মের ধর্মতাত্ত্বিকরাই আলাদা আলাদাভাবে আলাদা আলাদা শব্দচয়নে নিজেদের ধর্মীয় মহাবিশ্বের মডেল তৈরী করেছেন । এর ভিতরে খুবই কঠোর দুইটা হচ্ছে একটা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের ক্যালভিনিস্ট ধর্মতত্ত্ব, আরেকটা ইসলামের আশ’আরী-গাজ্জালি ধর্মতত্ত্ব । পরিপ্রেক্ষিত ও খুঁটিনাটিতে পার্থক্য থাকলেও দুইটার মূল কথা একই । ঈশ্বর বা আল্লাহ গোটা মহাবিশ্বের সমস্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণ কুটিকুটিকুটিকুটি বছর আগে থেকে ঠিক করে রেখেছেন । তুমি কোথাকার কোন ছদরুদ্দি কার্পেটে ঘইষা কপাল ছেদা কইরা ফ্যাললা বা তুমি কোন আবদুল্লা ডিরোজিও কস্তা বিশ বছর ধইরা ঈশ্বরের কাছে কিছুটা একটা চাইলা বলেই নিখিলের অধিপতি তার কুটিকুটি বছর আগের পরিকল্পনা পাল্টাবেন ?

এই ধমক খেয়ে আপাতত সাধারণ বিশ্বাসী ভয়েডরে চুপ মেরে গিয়ে নাওয়া খাওয়ার মত একটা অভ্যাসের বিষয় হিসাবে ধর্মকে মেনে নেয় । কারণ কুটিকুটি বছরের পরিকল্পনার কথা পাড়লে, সেই লাইনে চিন্তা করতে গেলে আরো বড় বড় সমস্যা দেখা দেয় ধর্মতাত্ত্বিকের মহাবিশ্ব মডেলের মধ্যে । কিন্তু সাধারণের চাইতে একটু গভীরভাবে একটু ভালোভাবে ধর্মকে নিতে চাওয়া লোকজন ধর্মতাত্ত্বিকের জন্য আবার ঝামেলা নিয়ে আসে নিরন্তর । এই যে সমস্ত কিছু কুটি কুটি বছর আগে ঠিক হওয়া নিয়ে । এই মডেল অনুয়ায়ী তো তাইলে কে দোযখে যাবে কে জান্নাতে যাবে সেটাও কুটিকুটি বছর আগে থেকে ঠিক করা । তাইলে আমার কাজের বা বিশ্বাসের কী মূল্য সেই প্রশ্নে না গিয়েও অন্য দিকে গেলেও সমস্যা । যেমন সবই যদি ঠিক করা থাকে তাইলে অন্য ধর্মের লোকও কি স্বর্গে যাইতে পারে ? সেটা মানতে গেলে আবার ধর্মতাত্ত্বিকের সমস্যা । ধর্মতাত্ত্বিক তাই বলে, না ইমান না থাকলে কেউ স্বর্গে যাইতে পারবে না । কিন্তু অন্য ধর্মের ভালো লোকও তাইলে দোযখে যাবে? ধর্মতাত্ত্বিক বলেন, হ্যাঁ, যাবে । আল্লাহ তারে বিচারবুদ্ধি দিছেন, যে অন্য ভালো কাজ করলেও ইমানের অভাবে দোযখে বা খ্রিস্টানদের মত যিশুর উপর বিশ্বাসের অভাবে অনন্ত নরকে যাবে । এবার তাইলে বিচার বুদ্ধির কথাই যেহেতু আসলো, তাহলে অন্য ধর্মের বা নিজের সঠিক ধর্মের ভিতরেও যেসব বাচ্চা-কাচ্চার এখনো নিজের কাজের দায় নেয়ার মত বয়স হয় নাই তারা যদি মারা যায় ? তখন কী হবে ?

শিশুদের নিয়া মানুষ যেহেতু প্রাণী হিসাবে খুবই সংবেদনশীল তাই ধর্মতাত্ত্বিক এখানে আর মারমারকাটকাট ভাব নিয়ে থাকতে পারেন না । এজন্য মোটামুটি প্রায় সব বড় ধর্মের ধর্মগুরুরাই শিশুদের বিশেষ মূল্যহ্রাস দিয়ে থাকেন । আচ্ছা ঠিক আছে, শিশুরা সব বিনা বিচারেই পার পেয়ে যাবে । সত্য ধর্মের ঘরে জন্ম হোক বা মিথ্যা ধর্মের বাপ মায়ের ঘরে । শিশুদের এই বিনা বিচারের রায় নিয়ে বেঁকে বসেন একজন । প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ধর্মের একটা বড় শাখা ক্যালভিনিজমের গুরু ক্যালভিন । তার কথা হচ্ছে ঈশ্বর যেহেতু সমস্ত কিছু কুটিকুটি বছর আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন, সেটা শিশুদের ক্ষেত্রেও সত্য । শিশু হিসাবে জন্ম নিয়ে মারা গেছে বলেই সে বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে এমন কথা নাই । ক্যাথলিকদের নষ্টামির সময়ে নতুন জাগরণের বিপ্লবী ক্যালভিনের বড় একটা গোত্র থাকলেও ভাগ্যের অনড়তা, বিশেষ করে শিশুদের ব্যাপারে এইরকম কঠোর মনোভাবের কারণে ধীরে ধীরে ক্যালভিনের অনুসারীর সংখ্যা কমতে থাকে । প্রটেস্ট্যান্টরা ভাগ হয়ে যায় আরো অনেকগুলো চার্চে ।


কিন্তু ক্যালভিন কি আসলেই কেবল রুক্ষ্ণ স্বভাবের কাঠখোট্টা মোল্লা ছিলেন বলেই শিশুদেরও মধ্যেও নরকগামী হিসাবে জন্মের আগেই ঠিক হয়ে যাওয়া দল আছে এটা নিয়ে গোত্তা মেরে বসে ছিলেন ? নাকি শিশুদের বিনা হিসাবে বিনা বিচারে স্বর্গে পাঠানোর তত্ত্ব দিলে আনুসঙ্গিক যে আরো ঝামেলার কিছু প্রশ্নের উদ্ভব ঘটতে পারে, সেটা নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক ছিলেন বলেই এমন ফতোয়া দিয়েছিলেন, সেটা জানা যায় না । একটা ঝামেলা ঘটতে পারে এরকম যে বিনা বিচারে যদি স্বর্গেই চলে যায় তাহলে কঠোর বিশ্বাসী বাপ-মায়ের পক্ষে রোগাক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা না করে তারে মরতে দিলেই ভালো এমন বিশ্বাসে কাজ করতে পারে কেউ কেউ, অথবা আরো চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে নিজের শিশুদের ভালোর জন্য তাদের খুন করতেও উদ্যত হতে পারে কেউ কেউ । এমন চিন্তা কি ক্যালভিনের মাথায় খেলেছিলো ? অথবা আরো ভয়ঙ্কর, নিজের ধর্ম শতভাগ সত্য এমন কঠোর বিশ্বাসী কেউ অন্য ধর্মের শিশুদের খুন করে সেটাকে ওদের ভালোর জন্য করেছি বলে যুক্তি দিলে ধর্মতাত্ত্বিক ঠিক কোন বিচারে তাকে থামাতে যাবে ? মানুষের ভিতর অনেক উদ্ভট চিন্তার লোকজন থাকে যারা কল্পকাহিনীর উদ্ভটতাকেও হার মানায় । তবে শিশুদের নিয়ে এইধরণের চিন্তার কথা তেমন কোথাও দেখা যায় না সৌভাগ্যক্রমে । সবার জন্যই মঙ্গল তাতে । ক্যালভিন হয়তো একটু বেশি সিরিয়াস চিন্তক ছিলেন । সম্ভাব্য সব রকমের ফাঁকফোকর জোড়া দেয়ার জন্যই হয়তো এমন কর্কশ ধর্মতত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন ।

বিনা বিচারে শিশুদের বেহেশতে বা স্বর্গে যাবার ফায়সালার মধ্যে আরেকটা বড় ফাঁদ লুকিয়ে আছে যেটা নিয়ে এদিক সেদিক একটু আধটু আলোচনা দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু কেউ-ই আটঁঘাট বেঁধে তলা দেখে নেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে এই সমস্যা ঘাঁটতে যান নাই । কারণ তা করতে গেলে ইমান নিয়েই আবার টানাটানি লাগবে । ফাঁদটা হচ্ছে, শিশুরা বিনা বিচারে জান্নাতে না হয় গেলো, কিন্তু কদ্দূর বয়স পর্যন্ত শিশু ? কেউ কেউ কোনরকম দলিল-দস্তাবেজ বা আল্লা বা ঈশ্বরের কোনরকম বাণী ছাড়া নিজের যা মনে হইছে সেই অনুযায়ী বলে দিয়েছেন শিশুর বয়সসীমারেখা তথা বিনা বিচারের সীমারেখা । কেউ বলেন ৭ বছর, কেউ বলেন ১২ বছর, বা আরো অনেক রকম । সংখ্যাটা আদতে এখানে মূখ্য সমস্যাও নয় । ধরে নিলাম ১২ বছরই । ১২ বছরের নীচের বয়সের শিশু নিজের কৃতকর্মের দায় নিতে বাধ্য নয়, কারণ তার তখনো বিচার-বুদ্ধি বিকশিত হয়নি । ভালো কথা। তাহলে মানসিক-ভাবে প্রতিবন্ধকতার শিকার অনেকে আছে তাদের কী হবে ? ধর্মতাত্ত্বিকের তখন উত্তর বিচার বুদ্ধি না থাকলে বয়স যতই হোক সমস্যা নাই, বিনা বিচারে বেহেশত । তখন উল্টা আবার তাহলে একটা বয়সে দাগ কেটে দেয়ার অর্থ থাকে না । বিচার বুদ্ধি হইছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় । আবার উল্টা সমস্যা। বিচার-বুদ্ধি হইছে কিনা সেই বিচার কে করবে ? আমারতো ১২’র পরে আরো দুইটা বারো পার হওয়ার পরেও মনে হইতাছে আল্লাখোদা এইসব কিছু হাস্যকর ঠাকুমার ঝুলির চাইতেও নিম্নমানের রুপকথা । আপনার এত সিরিয়াস কঠোর তপস্যার বিষয়রে আমার এমন থার্ডক্লাস বালছাল মনে হওয়াটা কী আসলে ? আপনার যদি আপনার বিশ্বাসে আস্থা শতভাগ থাকে তাহলে কি ধরে নিতেই হয় না যে আমার বিচার-বুদ্ধিই আসলে এখনো গজায় নাই ? সেই হিসাবে বিনা-বিচারে বেহেশতের দাবী কি আমিও করতে পারি ? তখন ধর্মতাত্ত্বিক আবার বলবেন, না সেটা সম্ভব না, তোমার এমন শয়তানীর কারণ হচ্ছে আল্লা তোমার কলিজার মধ্যে মোহর মাইরা দিছে । কোন কিছুতেই তোমার লাভ নাই । ওমা, এইটা যদি মানা যায় তাহলে শিশুদের মধ্যেও কেউ কেউ আগে থেকেই দোযখের জন্য নির্ধারিত এইটা মানতে আর সমস্যা কীসে ? দুইক্ষেত্রেই তো নিজের কাজের দায় নিজের না, ঈশ্বরের কুটিকুটিবছর আগের পরিকল্পনা ।

আচ্ছা এত কঠিন দিকে না গিয়ে আরেকদিকে ধরি । ঠিকাছে ১২ বছরই ধ্রুব ধরলাম । ১২ বছর পার হওয়ার পরে কাউকে নিজের কাজের জন্য, ইমানের জন্য জবাবদিহি করতে হবে । অবস্থাটা চিন্তা করেন । পাঁড় বিধর্মীর ঘরে জন্ম হওয়া একটা শিশু, ১২ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রমাগত ভুল ধর্মে দীক্ষিত হয়ে এখন ১২ বছর ১ দিন বয়সে মারা গেছে । আপনার কি দাবী যে এই এক দিনের মধ্যে কেনো সে আপনার সত্য ধর্মের, সত্য খোদার প্রতি আস্থা আনলো না, অতএব অনন্ত কাল দোযখের আগুনে পোড়া তার জন্য উচিত বিচার ? আরেকবার মাথার মধ্যে ব্যাপারটা খেলান । ১ টা মাত্র দিন বাড়তি । আরো প্যাঁচাই । ১২ বছর বয়সের উপরে আর নীচে ঠিক কখন ভাগ হবে ? আমাদের ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটাই যেহেতু সবচে ছোট তাহলে ধরলাম ১১ বছর ১১ মাস ৩০ দিন ২৩ ঘণ্টা ৫৯ সেকেন্ড, আর ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে বিনা বিচারের এইপাশ ঐপাশ । এও কি কম উদ্ভট । অবশ্যই ধর্মতাত্ত্বিক এখানে বলতে পারেন যে, ১২ বছর বয়সের পরে যেটুকু সময় সে পাইছে সেটাতে কি করছে না করছে তার উপর বিচার হবে । ভালো কথা । তাহলে ইমান না থাকলেও কি জান্নাতে যাওয়া যাবে ? সেইটা মানতে আবার মোচড়ামুচড়ি শুরু করেন ধর্মতাত্ত্বিক । কারণ তখন তার গোটা ব্যবসাতেই টান লাগে । তোমার আল্লার কথা যে জানে না তেমন ভালোমানুষরে তাইলে দাওয়াত না দেওয়াটাই মঙ্গল হয়, এই লাইনে চিন্তা করতে গেলে । আবার গাট্টিবোঁচকাসমেত সমস্ত কিছু নিয়ে টান ।


বিলাইতো আর কম সোদনে কয়নাই যে “আল্লা নৌজ বেস্ট” ।

Leave a Comment