খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধবই পর্যালোচনা

যেথায় তোমার পায়ের চিহ্ন আছে – কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের গদ্য পর্যালোচনা

   

লিখেছেনঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল

দীপাঞ্জনা মণ্ডল

পায়ে চলার যোদ্ধারা দুই ধারার; এক চেনেন পথ অন্যে চেনেন মঞ্জিল। যিনি পথের পরিচয়ে নির্ভর তিনি কেবলই আলপথ ধরে ধরে, বা কংক্রিটেই কেউ অথবা নভোশ্চর কিংবা জলই মাত্র বেয়ে চলা কার, নান্যপন্থা। যিনি গন্তব্য জানেন তিনি পায়ের তলার মাধ্যমে নিবিষ্ট নন। তাঁর অভিনিবেশ চাঁদের পাহাড়ে পৌঁছনোয় সূর্যের কোনও এক ভোরে। পথিক সে যে পথেই বাসা, তার যেমন যাওয়া তেমনি আসা। আমাদের ভাষায় এক কবি ছিলেন এমনই পথিক, স্বধর্মে তিনি ছিলেন স্থিত। প্রথম কবিতার বইয়ের নামই পরে বাংলা সাহিত্যে তাঁর অভিজ্ঞান হয়ে ওঠে, পদাতিক কবি, রাস্তাই ছিল যাঁর একমাত্র রাস্তা। তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি কবি, অথচ ‘বলা যায় তাঁর গদ্যে কাব্য গদ্যের হর-পার্বতীর মিলন হয়েছে, কবিতায় গদ্য ও কাব্যের।’ কিন্তু একজন শব্দশিল্পী কি কেবলই কিছু উপমার ইন্দ্রজালে সীমায়িত! কোনও এক বিশিষ্ট সমালোচক ও তাঁর যথার্থ অনুকরণকারীদের গড়ে দেওয়া ধারণাতেই চিরস্থির! তাহলে একটি পাঠ কেন থাকে? যে মানুষ সতত তার অস্তিত্বের কারণ খোঁজে সে তো একটি পাঠ থেকে কিছু পাওয়ার কারণ খুঁজে পেলে আর সহসা পাঠের মুখোমুখি হবে না। অর্থাৎ একবার যদি নির্দিষ্ট হয়ে যায় কেউ কিশোরের কেউ নারীর কেউ বিপ্লবের কেউ প্রেমের তবে বিচিত্র রসসন্ধানীরা কেন যাবেন তাঁদের সবার কাছে? আস্বাদনের আগেই অধিকাংশ স্বাদ তো ত্যাজ্য হবে। কিন্তু তা হয় না। হয় না বলেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশ শুধু প্রকৃতি বা নির্জনতার হয়ে রয়ে যান না; ‘পুঁইমাচা’ বা ‘সুচেতনা’ অন্য কোনও কথাকার ও কবিকে প্রতিষ্ঠা করে।

মানুষের যে কোনও অবস্থান ও কাজ তার রাজনীতিজ্ঞাপক। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক মহোদয় মানুষকে রাজনৈতিক প্রাণী বলে গেছেন সেই কবেই। সুতরাং বাংলা সাহিত্যের দিকপালেরা যদি কেউ প্রথাগত রাজনৈতিক কর্মী নাও হন, তবুও তাঁদের অরাজনৈতিক হওয়া অসম্ভব। বাংলা সাহিত্য অত্যন্ত শ্লাঘাবোধ করতে পারে এই ভেবে যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখরা প্রত্যক্ষ সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন এক সময়ে আর পরে কালের পরিবর্তনের প্রভাবেই তারাশঙ্কর, মাণিক, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা ব্যক্তিগত জীবনে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীর কাজ করে গেছেন। এখন আমরা পাঠক সাধারণ কীভাবে পড়ব একজন লেখকের পাঠ যিনি কিনা একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী! আমরা কি কেবলই তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনাত্মকভাবে পড়ব তাঁর সমস্ত পাঠ অথবা পাঠের মাধ্যমে আমরা বুঝে নেব তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান যা কেবল একজন মানুষের রাজনৈতিক মতবাদের ধারণায় সীমাবদ্ধ নয়। একজন মানুষের রাজনৈতিক অবস্থান মানে তাঁর সমস্ত জীবনচর্যা, তাঁর বিশ্বাস ও আচরণ, তাঁর বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া সমস্তই। যদি এভাবেই বুঝতে চাই তাহলে তো রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ গল্প আর তাঁর নিজের কন্যাদের বাল্যবিবাহের আয়োজন ও বিবাহে যৌতুক দেওয়া বিষয়ে খটকা তৈরি হয়। একই খটকা কি তৈরি হয় একজন বামপন্থায় বিশ্বাসী লেখকের দক্ষিণপন্থী দলকে সোচ্চারে সমর্থন করার মধ্যে?

সুভাষ মুখোপাধ্যায়

অথচ এমন ঘটনা ঘটল বাংলা সাহিত্যে; এক নয় একাধিক জনের ক্ষেত্রে, আমরা দু -একটি নাম স্মরণ করতেই পারি, মনে পড়ে মহাশ্বেতা দেবী এবং সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথা। এঁদের আজীবনের রাজনৈতিক চর্যা কী বদলে গেছিল দক্ষিণপন্থী দলের প্রতি এঁদের সমর্থনের কারণে? না কি নিজেদের অবস্থানে অবিচলিত থাকবার প্রয়োজনেই দলীয় পতাকার আশ্রয় বদলে ফেলেছিলেন তাঁরা! এ নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চাপান-উতোর উত্তরোত্তর চলুক। আমরা শুধু পদাতিক কবির পাঠকে সামনে রেখে বুঝতে চাইব কী করতে চেয়েছেন তিনি, কোন পথে চেয়েছেন এবং কেন।

একশো বছর আগে জন্মানো কবির শৈশব প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের। পরাধীন দেশের মানুষ হিসেবে এক অগ্নিযুগের তিনি সাক্ষী। চরম ও নরমপন্থার দ্বন্দ্ব তাঁর অদেখা নয়। অর্থাৎ কিনা বিরুদ্ধ মত যারা এক লক্ষ্যে কাজ করে তাদের টানাপড়েন অচেনা নয় তাঁর। সেই সময়ে বড় হয়ে উঠবার কালে স্কুলছাত্র সুভাষের সাহিত্যরচনার সূত্রপাত, এবং উল্লেখ প্রয়োজন সেই লেখা গদ্যে, কথিকা। প্রথম থেকেই বামপন্থী পার্টির কর্মী সুভাষ। আর শুরুর সময়ে খিদিরপুরের ডক শ্রমিকদের মধ্যে আনাগোনার সূত্রে যে টানের সুরুয়াত, শ্রমিকদের প্রতি তাঁর সেই টান বজায় ছিল আজীবন। সমর সেনের হাতে ‘পদাতিক’-এর খসড়া পাণ্ডুলিপি দেওয়ার সূত্রে পেয়েছিলেন ‘হ্যান্ডবুক অফ মার্ক্‌সিজ্‌ম্‌’। বছর কুড়ির আশপাশেই তিনি সিপিআই ঘনিষ্ঠ। কিন্তু লেবার পার্টির বিভাজন তাঁকে পীড়া দিয়েছিল, পার্টি ছিল তাঁর কাছে পরিবারের মতো। পরবর্তীকালে আবারও তাঁকে পার্টির নীতির আমূল বদলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব নীতি সমর্থন না করলেও তিনি থেকেছেন তাঁর পরিবারের পাশেই। ১৯৪৮-এ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান হয়ে গেলে সুভাষ জেলে গেছেন, দুবার। পরে পার্টিলাইনের ভুল নিয়ে তর্কের সময়ে তিনি চলে যান বজবজের চটকলের মজুরদের মধ্যে। বারবার তত্ত্বের আকচাআকচির সংকটে তিনি পৌঁছে গেছেন প্রকৃত সর্বহারাদের মাঝে। তত্ত্বের দুরূহতা কর্মী সুভাষকে মরমী সুভাষকে প্রতিহত করতে পারেনি কখনও।

এই অবদি জানবার পরে মনে হতে পারে কেন এই চর্বিতচর্বণ! কারণ চোখ কান খোলা বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহী সকলেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনের এই সমস্ত ঘটনা জানেন। তবুও এই পুনরুল্লেখের কারণ আমাদের বর্তমানে ব্রেকিং নিউজও মুহূর্তজীবী। ক্রমেই আমাদের স্মৃতিকে এক সংকটের মধ্যে বেশি করে ঢুকে পড়তে হচ্ছে, আর তা হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বিভ্রান্তিকর নানা মুহূর্তের তথ্যাদির অনাবশ্যক ভার। এই কারণেই সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর চর্যা সামান্য আউড়ে নেওয়া গেল আরও একবার। এবার আমরা একটু একটু করে পাঠ করব সুভাষের রিপোর্টাজগুলির অন্যতম ‘যখন যেখানে’। বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে সুভাষ প্রধানত কবি। অথচ যেমনটা এই লেখায় আগে বলা হয়েছে, তাঁর লেখার শুরু গদ্য মাধ্যমেই। পরে কবি সুভাষের গদ্য লেখা হয়ে ওঠে সোমনাথ লাহিড়ীর নির্দেশ ও পরামর্শে। সে কথা কবি নিজেই মুক্তকণ্ঠে বলেছেন। ‘যখন যেখানে’ বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন সোমনাথ লাহিড়ীকেই। এতে সংকলিত হয়েছে মোট এগারোটি গদ্য। গদ্যগুলি বইতে বিন্যস্ত হয়েছে কালানুক্রমিক প্রকাশের ক্রমে। এগারোটি গদ্যের মধ্যে অবশ্য তিনটির প্রথম প্রকাশ সংক্রান্ত কোনও প্রামাণ্য তথ্য নেই, সেই লেখা তিনটি গ্রন্থে সংকলিত গদ্য সমূহের শুরু, শেষ ও মাঝখানে রাখা হয়েছে। ‘যখন যেখানে’-এর নাম থেকে যে ধারণা তৈরি হয় গদ্যগুলি ঠিক সেই ভাবেরই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অবস্থায় থাকাকালীন বিভিন্ন বিষয় বা বলা ভালো না-বিষয় নিয়ে গদ্যগুলি লেখা। স্বল্পায়তনে লেখকের মনের ভাব ও অবস্থা এখানে গদ্যরূপ লাভ করেছে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৬ -এর কালসীমায় গদ্যগুলি লেখা, অন্তত যেগুলির প্রথম প্রকাশ জানা গেছে তা এই সময়ের মধ্যেই লেখা।  আর ‘যখন যেখানে’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৬০-এ। গদ্যগুলি লেখার আগে আমরা জানি, সুভাষের দুই পর্বের কারাবাস ঘটে গেছে। স্বাধীনতার পরে পরেই পি সি যোশীর শোধনবাদী লাইনের পরিবর্তে বি টি রনদিভের কড়া লাইনের দিকে ঝোঁকে পার্টি। পার্টির নীতি নির্ধারণে মতানৈক্যের সংকটকালে সুভাষ চলে গিয়েছেন বজবজে চটকলের শ্রমিকদের কাছে। এই যাওয়া ছিল তাঁর সঞ্জীবনী সুধা। মানুষকে ঘিরে নেওয়া নীতিতে সমস্যা হলেই তিনি মানুষের পাশে চলে যেতেন। লেবার পার্টি থেকে সিপিআই তৈরির সময়ে সুভাষ পরিবার ভেঙে যাবার যন্ত্রণা পেয়েছিলেন। পরে ১৯৬৪ তে সিপিআইএম তৈরির সময়ে সেই আঘাতই পান তিনি। যদিও সদস্য হিসেবে একমাত্র সিপিআই-তেই ছিলেন তিনি। নকশাল আন্দোলনের সময়ে আবার ভাঙে বামদল, তৈরি হয় সিপিআইএমএল। যন্ত্রণা বয়েছেন তিনি। কংগ্রেস বা পরবর্তীতে তৃণমূল কংগ্রেস দলের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন, এ কথা আড়াল করবার চেষ্টাও তাঁর ছিল না। কিন্তু সিপিআই ছাড়া অন্য কোনও দলের সদস্যপদ তিনি কখনও নেননি।

অতএব ‘যখন যেখানে’ কখনই ‘যখন যেমন তখন তেমন’ নয়। যখন যেখানে থেকেছেন সুভাষ যার পাশে থেকেছেন আসলে চেয়েছেন মানুষেরই পাশে থাকতে। তাই কোনও ভণ্ডামি দিয়ে গড়া ভাবমূর্তির কাছে দাসখত তিনি লিখে দেননি। কাকতালীয়ভাবে এই বইয়ের ভূমিকাতেও লেখক ‘পায়ের ধুলোয় অমিলের মিল’ পাবার আশা রেখেছেন। বইয়ের শুরু ‘এইটুকু’ শীর্ষক গদ্য দিয়ে। নেবুতলার এক গলিকে তাঁর সকালের ঘুম ভাঙিয়ে প্রসাধন সারিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট করে তুলেছেন পাঠকের কাছে। কি অনুপুঙ্খ সেই বর্ণনা। শব্দ, গন্ধ, ধোঁয়া, রোদ সব মিলিয়ে সে জীবন্ত এক টুকরো অভিজ্ঞতা।

‘পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িই পুঁয়ে-পাওয়া ক্ষয়াটে। চোয়ালের হাড় বার করা গাড়ি-বারান্দাগুলোর জন্যেই বোধ হয় বাড়িগুলোকে কেমন যেন একটু কোল-কুঁজো কোল-কুঁজো বলে মনে হয়।

পাঠক নিজেই কখন বেখেয়ালে সেই গলিতে ঢুকে পড়েন নিজেরও অজান্তে। আর রচনার শেষে গিয়ে পাঠক নিজেও এককালে তার কোনও অতীত বাসভূমের কথা মনে করে যেন এইটুকু হয়ে যায়।

‘আসমান জমিন’ ও ‘কাঁটাতারের বেড়ায়’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বক্সার জেলজীবনের অভিজ্ঞতার কথা আছে। ভারত ইংরেজ অধীনতা মুক্ত হবার পরে এদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হয় ১৯৪৮ সালে। সুভাষ তখন দুবার জেলবন্দি হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারে তাঁকে কিছুটা সময় কাটাতে হয়েছিল বক্সারে। ‘আসমান জমিন’-এ বক্সারে পৌঁছনোর পরের প্রাকৃতিক দৃশ্য ওই বন্দী অবস্থাতেও তাঁকে মুগ্ধ করে।

‘কতদিন খোলা আকাশ দেখিনি। মনে হচ্ছিল ঝোপজঙ্গল ভেঙে ছুটে পালিয়ে যাই যেদিকে দু চোখ যায়। গুলি যদি করে করুক।‘

কত নিবিড় এই দেখা। অতীতে যা দেখেছেন খুব কাছ থেকে তাকে যেমন ভুলতে পারেননি তেমনই নতুনকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কোথাও আটকায়নি তাঁর। এভাবে বুঝলে সুভাষ হয়তো আর ততোটা ধাঁধা হয়ে থাকেন না আমাদের কাছে।

    একটি অঞ্চলকে আন্তরিকভাবে চিনেছেন লেখক, সেই সঙ্গে পথে চলেছেন অবিরাম। তাই তাঁর যে কোনও রচনাতেই পায়ে চলার পথ এসে যায় কোনও না কোনও অনুষঙ্গে। ‘এইটুকু’-তে পাঠক খেয়াল করবেন নেবুতলার রাস্তা তার ওপরে এসে পড়া রোদ পর্যন্ত কেমন জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠছে লেখকের বর্ণনায়। আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক কংক্রিটে বন্দী থাকার পরে বক্সার জেলে যাবার সময়ে পাহাড়ি পথ লেখককে দিয়েছে নান্দনিক তৃপ্তি ও অপার আনন্দ। যদিও সেই দেখা কণ্টকিত হয়েছে পুলিস প্রহরায় ক্রমাগত সার বেঁধে এগোতে হয়েছে বলে। একজন মানুষ তাঁর জীবনের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গে কতটা সম্পৃক্ত হতে পারলে তবে ওই অবস্থাতেও এমন ভালো লাগার উৎসার ঘটে ওঠে তা সহসা কল্পনা করা যায় না।

    আবার ‘বাবর আলির চোখের মত আকাশ’-এ ধ্বস্ত মানুষকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধপ্রবণ হয়ে উঠতে দেখে নিজের লেখা বদলের কথা তিনি ভেবেছেন। আর একটা রাস্তাকে তার ওপর দিয়ে চলে জনস্রোতের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে বলছেন,

‘চড়িয়ালের যে-রাস্তাটাকে আমি এতদিন দুশ্চিন্তায় কপাল কুঁচকে থাকতে দেখেছি, আজ তাকে দেখে মনে হয় হাত-মুঠো করে সে যেন কী একটা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।‘

পথকে এমন প্রাণবান সত্ত্বায় দেখতে ও দেখাতে পারেন আমাদের পদাতিক কবি-ই। যিনি আহ্বান জানাবেন ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ অথবা ঘোষণা করবেন ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’। সারাজীবন একটি লেখাই লেখেন একজন লেখক। সুভাষ মুখোপাধ্যায় শুধু একটি লেখা লেখেননি, তিনি স্বয়ং যাপন করেছেন সেই জীবন তাঁর সমস্ত জীবন জুড়ে। তাই এত মায়া এত নিষ্ঠায় তিনি দেখেন তিনি দেখানও।

তাঁর রাস্তা শুধু রাজপথ নয়, মেঠো পথ, ধুলো ঢাকা মাঠ এমনকি তস্য গলির আবছায়াও। গলির কথা বলতে বলতে আসে গলির মানুষের কথা। ‘এইটুকু’ পরিসরে তিনি একটা গোটা অঞ্চলের মানুষকে স্কেচ করেন। নেবুতলার ময়রা, কবিরাজ, কাবলীওয়ালা, নিবারণবাবু সবাই লেখকের মায়াভরা চোখ আর মমত্বের লেখনীতে সজীব। কখনও অতীতচারণে আগের সহযোদ্ধাদের প্রসঙ্গ আছে। বিনা বিচারে মিথ্যে অভিযোগে আটকে রাখা বন্দীদের অবস্থা, পরিণতি ও ক্ষোভ ‘আসমান জমি’ রচনার প্রতি পরতে। আর ‘কাঁটাতারের বেড়ায়’ বক্সার জেল জীবনের কিছুটা থিতু হয়ে যাবার পরের সময় উঠে এসেছে। এখানে জেলের সঙ্গীদের বর্ণনা। বিচিত্র মানুষের মুখ সেখানে। সবাই স্বখেত্র থেকে সাময়িক বিচ্ছিন্ন। তবু তার মধ্যেই কৌশলে পড়বার উপায় বের করেন চিন্মোহন সেহানবীশ। অন্য বন্দীদের হাসির গল্প শুনিয়ে মাত করিয়ে তিনি নিজে সেই ফাঁকে দশপাতা পড়ে নেন। জেলে বসে নিজের চেষ্টায় বাংলা শিখেছে ‘রামদেও’। হিন্দিভাষী ‘রামদেও’ ‘‘এখন কারোর সাহায্য না নিয়েই ‘পরিচয়’ পড়ে এবং অধিকাংশই বোঝে”। সুভাষ কী অনায়াসে ইতিহাসের দলিল তৈরি করে রাখেন পাঠকের জন্য!

যেমন তাঁর জেল জীবনের কথা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর লেখায়, তেমনই বারবার তাঁর লেখায় এসেছে বজবজের চটকল শ্রমিকদের কথা। ‘বজবজের যে কোনও সকাল’ মনে করিয়ে দেবে সদ্য পড়া ‘এইটুকু’ গদ্যের কথা। একটা দিনের শুরু কেমন করে একটি অঞ্চলের চরিত্র হয়ে ওঠে এই রচনাগুলি তারই নিদর্শন। বজবজের চটকল শ্রমিক ও তাদের পরিবার এবং পাড়া সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কত আপনার ছিল সে কথা এই রচনা বলে দেয়। আজীবন মার্কসবাদের মূল তত্ত্বে বিশ্বাসী সুভাষের আকাঙ্ক্ষা এই রচনার শেষ অংশে স্পষ্ট,

‘এ গাঁয়ের আরো অনেক কিছু দরকার। যা চেয়ে পাওয়া যাবে না। ছিনিয়ে নিতে হবে।‘

এখন পাঠক দেখবেন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য ওই অঞ্চলের দৈনন্দিন দুর্দশাকে খুব যেন নির্বিকারভাবে বর্ণনা করেছেন লেখক। এদিকে শেষে এসে পাড়ার সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে ‘ইমানী’-কে এনেছেন, যে অর্থের অসম বণ্টন নিয়ে নানা ছড়া কাটে, সম্পন্ন চাষির ছেলে হয়েও চাষে ক্ষতি হওয়ায় তার বাবা সর্বস্ব খোয়ালে পাশের বাড়ির হাঁড়ি থেকে চাল চুরি করতে যায়। তাঁর প্রসঙ্গেই পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন লেখক। পাঠকের মনে পড়তে পারে আরেক সমমতবাদে বিশ্বাসী লেখকের ‘ছিনিয়ে খায়নি কেন’ গল্পের কথা। বজবজকেন্দ্রিক এ বইয়ের পরের রচনা, ‘বাবর আলির চোখের মত’; সুভাষের পাঠক বাবর আলিকে কাছ থেকেই চেনে-জানে ‘সোলেমানের মা’ নামে অতিখ্যাত কবিতার মধ্যে দিয়ে। সেই বাবর আলির উন্মাদ দৃষ্টি লেখকের চোখে পুঞ্জীভূত ক্রোধ হয়ে উঠেছে। যা যা পাওনা, যা কিছু অর্জিত হয়েও নাগালের বাইরে তার জন্য পাগলামি নয়, আক্রোশ প্রয়োজন। সেই দৃষ্টি বাবর আলির চোখে দেখেছেন লেখক। তাঁর মনে হয়েছে নিজের কবিতাগুলো এবার বদলে ফেলবেন। বর্তমান প্রবন্ধের পাঠকের দৃষ্টি এইখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ মানস প্রবণতার দিকে আকর্ষণ করতে চাই। একজন কবি তাঁর বহু পঠিত কবিতার পাঠ পরিবর্তন করতে চাইছেন মানুষকেন্দ্রিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে! এ বড় সহজ কথা নয়। কে না জানে এক একটি প্রিয় পাঠকৃতি একজন লেখকের কত গভীর মমত্বের জায়গা জুড়ে থাকে। এখানে কোনও তথ্যগত ভুল নেই যা তিনি বদলাতে চেয়েছেন, পরন্তু তিনি বদলে ফেলতে চেয়েছেন কবিতার ভাবের আধারকেই। তিনি একটি কবিতার কথা নয়, বলছেন ‘কবিতাগুলো’ বদলানোর কথা। অর্থাৎ সর্বহারা মানুষের স্বার্থে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এত বড় কিছুকেও বদলে ফেলতে পারেন।

রিপোর্টার হিসেবে তাঁর কাজ করবার স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন ‘খবরের খোঁজে’। সেখানেও বিচিত্র মানুষ। বা বলা ভালো তাঁর অন্বিষ্ট বিচিত্র সর্বহারা মানুষের দল এখানেও উপস্থিত। খবরের খোঁজে বেরিয়ে নিদারুণ দৈন্য আর দুর্দশা দেখেছেন তিনি, পেয়েছেন মানুষের অকপট নৈকট্য। শহরের বাবুদের কৃত্রিম আন্তরিকতায় তিতিবিরক্ত মানুষ তাঁকে পরখ করেছে এঁদো পুকুরের জল খেতে বাধ্য করে। তারপরে তাকেই কাছের মানুষ বুঝে আপ্যায়ন করতে ত্রুটি করেনি এবং কোনোভাবেই বোঝেনি যে খবর কাগজে ছাপিয়ে কোনও কাজ হয়। আবার শহরের বুকে আসা গ্রামের এক বুড়ি তাঁকে উজাড় করে জানিয়েছিল নিজের জীবন অভিজ্ঞতা। কথায় কথায় বলেছিল, ভগবান নেই। এই উপলব্ধি লেখককে প্রাণিত করেছে। তাঁর মনে হয়েছে,

‘হয়ত অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে তবেই পৃথিবীতে আগামী দিনের খবর দেওয়া সম্ভব।‘

এখানেও সেই একই সুভাষকে পাব আমরা; যিনি মানুষের জন্য মানুষের হয়ে মানুষের পাশে থেকে যাওয়াকেই শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেন।

‘একুশের সুরে বাঁধা’ রচনাটি শুরু হয়েছে ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে চারজন লেখকের চারটি রচনার উদ্ধৃতি দিয়ে। ১৯৫৪-তে ঢাকা শহরে ২১-শে যাপন নিয়ে এই রচনা সুভাষের। সেখানে তিনি লক্ষ্য করেন এপার বাংলার মানুষ অনেক বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। যে মানুষ দেশের মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে শত্রুপক্ষে হাত মিলিয়েছিল, সেই নুরুল আমিনের বাসস্থানে ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে হবে বাংলাভাষার আকাদেমি। বাংলা বইয়ের ব্যাপক চাহিদা সেখানে টের পেয়েছেন লেখক। এই ভাষাদিবসকে কেন্দ্র করেই তাঁর পরের রচনা ‘লিখতে বারণ’; একটি দীর্ঘ কবিতাই যেন এটি। বাংলার নিজস্ব স্বাদে গন্ধে লেখাটি অনুপম। স্পষ্ট কথায় লিখবার অনুমতি না মিললে তো এরকম সন্ধ্যাভাষার আশ্রয় একজন ভাষার যাদুকর নেবেনই। কিন্তু সেই আড়াল নেবার মধ্যেও বলেছেন ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া সেই বীরদের কথা। একাত্ম হতে চেয়েছেন তাদের সঙ্গে। প্রতিবাদী মানুষ বারবার তাঁর লেখায় এসেছে, আসতেই ত্থেকেছে কেবল।

‘একটি অমানুষিক কাহিনী’ আবার মনুষ্যেতর দুটি প্রাণীকে ঘিরে লেখক ও তাঁর স্ত্রীর মমত্বের গল্প। ‘মহেশ’, ‘আদরিনী’, ‘কালাপাহাড়’ এদের সমগোত্রীয় রচনা এটি। বন্ধুরা কোনও জিনিস কিনে ঠকলে তা অবধারিত জোটে লেখকের কপালে। এমনি করেই বিলিতি ভেবে কেনা দেশী কুকুর এসে পড়ে লেখকের কাছে। ঘরের সদস্যের মতোই বড় হয় সে। বিলিতি ছেঁটে বিলি নামের মেয়ে কুকুরটি এক সময়ে বাড়ির মায়া কাটায়। হতকুচ্ছিত গোটা কয় বাচ্চাও হয় তার। কিন্তু তেমন সহবৎ না জানা এই বিলি কসাইদের শুকোতে দেওয়া দামি চামড়া কেটে বেধড়ক মার খায়। কোনোমতে হাড়গোড় ভেঙে কঙ্কালসার হয়ে কদিন বেঁচে থাকে সে। অবশেষে যেদিন তার কষ্টের শেষ হয় সেদিনই লেখকের আরেক পুষ্যি মেনি বেড়াল রুসি দুটো ফুটফুটে ছানার জন্ম দেয়। রচনা এখানেই শেষ করেছেন লেখক। এটি একটি নির্ভেজাল ছোটগল্প বলা যেতেই পারে। যার শেষ করেছেন লেখক খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। বিলির মরে যাওয়া নিয়ে কোনও আক্ষেপ না করে সহজ নিয়মে রুসির বাচ্চাদের সৌন্দর্য দেখেছেন তিনি। অর্থাৎ পাঠক এখানেও সেই এক মানুষ সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে পাবেন যিনি বারবার আগুনের পথ পেরিয়ে পেয়েছেন নতুন জীবন।

‘আমাদের গাড়ি’ রচনাটি নকশালবাড়ি অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে। এক বন্ধু বলে যার কথা লেখক এখানে বলেছেন তিনি চারু মজুমদার। তাঁর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে লেখক বন্ধুর বাড়ির সামনে একটি জিপ দেখলেন যার রক্ষণাবেক্ষণ ওই বন্ধু করে চলেছেন কিন্তু তাঁর আর্থিক অবস্থার সঙ্গে জিপ থাকা সংগতিপূর্ণ নয়। এই রচনাটিও ছোটগল্পের গুণবিশিষ্ট। প্রথমেও একটি আপাত অসংলগ্ন অংশে এই গাড়ি থাকার প্রসঙ্গ এসেছে। পরে আবারও সেই গাড়ি। রচনার শেষে রহস্য উদ্ধার হয়। চা শ্রমিকদের ইউনিয়ন থেকে কেনা গাড়ি ওটি, কোনও ব্যক্তিগত মালিকানার নয়। তাই হাতে স্টিয়ারিং পেলেই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো সেটির ব্যবহার সম্ভব নয়। কথাগুলো স্পষ্ট করে কোথাও বলেন না লেখক, কিন্তু সচেতন পাঠকের চোখে এ বক্তব্যের আভাস পড়বেই। এ লেখাটি খানিকটা ইঙ্গিতে সমাজে শোষক-শোষিতের অবস্থান ও তার থেকে উত্তরণের দিকে যাত্রার কথা বলে।

এই বইয়ের শেষ রচনা ‘একটি প্রতিবাদ পত্র’। এই লেখটিও একটি নিখুঁত ছোটগল্প বলা চলে। এক কবি কোনও এক সম্পাদককে চিঠি লিখছেন এখানে। কবি জানতে পেরেছেন সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে যে, আগামী পুজো সংখ্যায় কবি ওই পত্রিকায় গল্প লিখবেন। এ সংখ্যায় কবিতা না ছাপানোকে চাপা দিতে সম্পাদকের এই কৌশল কবির কোনও এক ব্যথার জায়গায় আঘাত করে। কৈশোরে লেখকের সঙ্গে থাকতেন তার পিসতুতো দাদা শম্ভু। তার সঙ্গে পাড়ার মেয়ে বিজুর সম্পর্কের কথা লেখকের অনবধানতা না কি ইচ্ছাকৃত ভুলের জন্যই জনাজানি হয়। ফলে সে সম্পর্ক টেঁকেনা। আসলে এই বিজুদির প্রতি আকর্ষণে তার সব মনোযোগ একা পেতে চাইত সেই কিশোর। আট বছর পরে বিজুদির সঙ্গে দেখা হয় তার এবং সে খবর দেয় শম্ভুদার বিয়ে হয়ে গেছে। এর আগেও তার জন্যই বিজু এবং শম্ভুর সম্পর্ক মাঝপথে থেমে গেছিল। বিজুর সেই কষ্টের জন্য কথক কবি দায়ী হয়েও তিনি দায়ী ভেবে নিয়েছেন শম্ভুকে। পরেও শম্ভু বিয়ের খবরে বিজুর কষ্টের কারণ হিসেবে শম্ভুকেই মনে মনে দায়ী করেন কবি। এদিকে বিজু বলে যায় লেখককে তার কথা শুনে গল্প লিখে দিতে হবে। একদিন এই বিজুদির কথাতেই কৈশোরে গদ্য ছেড়ে কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন কবি। আজ আবার গল্প লেখার ফরমাশ। কবি বিজুদিকে পেলেও তার গল্প পাননি বা পেলেও সে জোলো জিনিস গল্প বলে চালানো যায় না। তাই বিজুদির মৃত্যুর খবর সম্পাদককে দেওয়াটাই উচিৎ মনে হয়েছে তার। বিজুদির কথাতেই একমাত্র গল্প লিখতে পারতেন কবি। কিন্ত সে অসম্ভব। বাকি দশটি রচনার মধ্যে কোথাও সর্বহারা সমাজের শোষণ ও তার থেকে উত্তরণের চেষ্টা প্রকাশের সমঞ্জস প্রকাশ থাকলেও শেষ লেখাটি সম্পূর্ণ আলাদা স্বাদের। বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক জটিলতা ও বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অদম্য আকর্ষণ এ রচনার মূল। কিন্তু তার সঙ্গে বিজুদিকে দেখা লেখকের সেই মানুষ দেখার আগ্রহের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

তবে বইয়ের নাম স্মরণে রেখে এগারোটি রচনাকেই লেখকের মানস সংলগ্নতার বিভিন্ন প্রকাশ বলে ধার্য করা যায়। জেলে সহবন্দীদের সঙ্গে, বজবজে চটকল শ্রমিকদের সঙ্গে, খবর খোঁজার সূত্রে নিরন্ন মানুষের সঙ্গে, ঢাকা গিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূত্রে সেখানকার শহিদ ও বীরদের সঙ্গে, পোষ্য কুকুর বেড়ালের সঙ্গে একইরকম মমত্বের আকর্ষণে বাঁধা পড়েন লেখক। তাই তো পাঠক হিসেবে আমরা পাই ‘যখন যেখানে’—র মতো স্বাদু রচনাসম্ভার। এই রচনাগুলিকে মাথায় রাখলে আমরা দেখব লেখকের অসাধারণ সহমর্মী হবার ক্ষমতা। আদর্শের দিক থেকে আজীবন তিনি শোষিত-বঞ্চিত-সর্বহারাদের পক্ষে। নিজের দলকে তিনি মনে করেছেন পরিবার। প্রত্যেকবার সেই দল ভেঙে যাওয়ায় তিনি যন্ত্রণা পেয়েছেন। একমাত্র সিপিআই ছাড়া অন্য কোনও দলের সদস্যপদ নেননি। যদিও সব ক্ষেত্রেই আলাদা পথ ও মতের পথিক হওয়া বন্ধুদের প্রতি বজায় রেখেছেন সদ্ভাব। ‘যখন যেখানে’-এর লেখাতেও যে লেখককে আমরা পাই তাঁর কাছে রাজনীতির প্রথম ও প্রধান শর্ত অবস্থাবৈগুণ্যে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সঙ্গে থাকা। সুতরাং সেই লক্ষ্যে যাঁর চলা তাঁর পথ বদলালেও মত তো বদলায় না। বদলায় না বলেই পরিবারের মতো দল ভেঙে যাওয়ায় তাঁর অন্তরের সায় থাকে না; বদলায় না বলেই কোনও সরকার অথবা দল মানুষের পাশে আছে বুঝলে তিনিও তাদেরই পাশে থাকেন নির্দ্বিধায়। আসলে যাঁর একমাত্র স্বার্থ সমস্ত মানুষের এক যোগে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ব্যক্তিক লাভালাভের কড়ি গোনা তাঁর জন্য নয়। নির্ভেজাল সততার সঙ্গে মানুষের সঙ্গে তিনি থেকেছেন বলেই তাঁর আশপাশের নেতৃবর্গ পরিবর্তিত হওয়া তাঁকে মানুষের থেকে দূরে সরাতে পারেনি।

মার্কসবাদের মূলে যে তত্ত্ব, যা মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনও শ্রেণিভেদে বিশ্বাস করে না, তারই সাধনা করে গেছেন সুভাষ। বারবার তাঁর আশপাশে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছে। কখনও কেন তিনি আনন্দবাজারে লিখছেন তাই নিয়ে, তো কখনও দক্ষিণপন্থী দলকে তাঁর সমর্থনের প্রসঙ্গে। কিন্তু মানুষের সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখা থেকে কখনও চ্যুত হননি তিনি। তিনি তো প্রথমত একজন লেখক। তারপরে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা। সে নিয়ে কোনও ভণ্ডামি তিনি করেননি। কিন্তু তিনি তো পোক্ত রাজনীতিক নন। ফলে রাজনীতির জটিলতা-কুটিলতা তাঁর জন্য নয়। তিনি তাঁর ধ্রুবপদে অবিচল থেকেছেন। থেকেছেন রাস্তায়। অপেক্ষা করেছেন উত্তরের; ছেড়ে যাননি, সরে থেকেছেন এক পাশে। সে সরে থাকায় প্রশ্ন আছে, দ্বিধা আছে, হয়তো বা আছে অভিমানও। কিন্তু সেই সরে থাকার মুল্যে আসলে তিনি সেই সব মানুষদের পাশেই থেকেছেন আজীবন পথে পথে তিনি যাদের পাশে থাকতে চেয়েছেন। তাঁর সমস্ত লেখা সমস্ত জীবন কেবল পথে পথে পথ চিনে ফেরা, কেবল সর্বহারাদের সঙ্গে পা মেলানোর প্রয়াস।

Leave a Comment