খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধবই পর্যালোচনা

বই আলোচনা – বুলশিট জবস, লেখক – ডেভিড গ্রেবার

লিখেছেনঃ দূরের পাখি

লেখকের ছবি নাই

মহামতি হুমায়ুন আজাদ বলে গেছেন, “বেতন বাংলাদেশে এক রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, এক মাস খাটিয়ে এখানে পাঁচ দিনের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়” । এর বিপরীতে যদি আপনাকে এক রূপকথার দেশের কথা বলি, “তিন দিনের কাজের জন্য এখানে দুইমাসের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়” , তাহলে কি আপনার কাছে এই দেশটাকে স্বর্গ তথা স্বপ্নের দেশ বলে মনে হবে ? বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মারমার কাটকাট উন্নয়নের দেশে বসে হয়তো সেটাই মনে হবে, কিন্তু বাস্তবতা রূপকথাকে নকআউট করে দিনে চারবেলা, তিনশ পঁয়ষট্টি দিন, আর চারবছরে একবার তিনশ ছেষট্টি দিন । তিন দিনের কাজের জন্য দুই মাসের পারিশ্রমিকের প্রথম কয়েকটি মাস যদি আপনার কাছে স্বর্গের মত মনে হয়, তবে সেটা নরকে পরিণত হতে খুব বেশি যে সময় নেবে না, এই অলৌকিক ও আধ্যাত্মিক পরম জ্ঞানের সন্ধান পাওয়ার জন্য আপনাকে বুলশিট জবস নামক বইটি পড়তে হবে । না, এই বই পড়লে আপনি কোনও তিন ধরনের নারী জান্নাতি হবে, কোনও আমল করলে আমলকারীর জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে এমন কিছু জানতে পারবেন না । তবে যা জানতে পারবেন সেটা এসবের তুলনায় বিন্দুমাত্র কম উদ্ভট, কম রহস্যময়, কম অলৌকিক মনে হবে না ।

বইটি গল্পের নয় । যদিও মানুষের সমস্ত আলোচনাই মূলত গল্প, আপাতত সেই অমোঘ সত্যের বাইরে গিয়ে ফিকশন আর নন-ফিকশনের যে দুই ধারা হালের বইয়ের ক্ষেত্রে আলাদা করা হয়, সেই হিসাবে বইটি ‘নন-ফিকশন’ । অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের সন্নিবেশের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও আবেগাক্রান্ত বিচারের বাইরে গিয়ে সার্বজনীন ও গাণিতিক এক ধরনের অভিজ্ঞান খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এতে । তবে এই বিচারে একটি দুর্বলতা রয়ে গেছে বইটির । নিজের তত্ত্ব উপস্থাপন ও প্রতিপাদনের জন্য লেখক যেই ধরনের তথ্য ব্যবহার করেছেন তার সবটাই মূলত বিভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপাখ্যান । সামান্য কিছু পরিসংখ্যানগত তথ্যকে বিশ্লেষণ ও সেই অনুসারে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানর চেষ্টা করা হয়েছে বটে, তবে আদতে বইয়ের বিশাল বড় বপুর প্রায় পুরোটারই ভিত্তি মূলত বিভিন্ন উদ্ভট চাকরিতে চাকরিরত অনেক মানুষের অভিজ্ঞতা ও বিশ্লেষণের ব্যাক্তিগত উপাখ্যান ।

সেই দিকটি মাথায় রেখে প্রথমে আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার জায়গাটি আলোচনা করি । নামীদামী একখান ডিগ্রি, ‘মাস্টার্স ইন ইঞ্জিনিয়ারিং’ অর্জনের পরে আমি নামীদামী একটি কোম্পানিতে (আচ্ছা ঠিকাছে, মেনে নিলাম আমার চিপাগলির এলাকাতে নামীদামী) ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে প্রথম ফুলটাইম চাকরিতে যোগদান করি । প্রথম তিনমাসের অলৌকিক, উদ্ভট, অনির্বচনীয়, এবস্ট্র্যাক্ট প্রশিক্ষণের পরে আমাকে স্থানান্তরিত করা হল ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা ও উন্নয়নের বিভাগে । সেখানে সারাদিন ঝিমানো ও মাঝে মাঝে দু-একটা কাজে দু-একজন অধীনস্থদের হাতে কাজ ন্যস্ত করে দিয়ে শেষে আমার নিজের দায়িত্ব দাঁড়াল সেইগুলোকে কিছু একটা রিপোর্ট হিসাবে দাঁড় করানোর, যেইসব রিপোর্ট তৈরির পরে সেগুলোর গতিবিধির উপর আমার নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ বলতে আর কিছু থাকল না । এর কিছুদিন পরে আমার বিভাগের প্রায় সবাই চলে গেল অন্য একটা দেশে নতুন কারখানার কাজে । ভিসার জটিলতায় আমি পড়ে রইলাম । পড়ে থাকা আমার জন্য অন্য দেশ থেকে মাঝেমধ্যে কিছু পরীক্ষা পরিচালনার কাজ আসে বটে, তবে সেসব এমন পরিমাণে যে তিন সপ্তাহ সময় দিয়ে যে কাজ আমাকে দেওয়া হচ্ছে সেটা করার জন্য আমার লাগছে এক দিন । বাকি সময় আমি সকালে গিয়ে টাইম কার্ড পাঞ্চ করে, আধাঘন্টাখানেক মেইল দেখে আবার বাসায় ফিরে আসি । রাতের অসমাপ্ত ঘুম পরিষ্কার করে দুপুরে খাবার খেয়ে, দুপুর-ঘুমে দুইঘণ্টা কাটানোর পরে চারটার দিকে আবার অফিসে গিয়ে কম্পিউটারে কিছুক্ষণ দেশ বিদেশের ব্লগ ঘাঁটাঘাঁটি করার পরে আবার টাইম-কার্ড পাঞ্চ করে বাসায় ফেরত আসি । সঙ্গে করে নিয়ে আসি রাজ্যের হতাশা, ক্লান্তি আর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে এক উদ্ভট ধরনের উপলব্ধি ও অসহায়ত্ব । জীবন ও জগৎকে বুঝতে না পারার অসহায়ত্ব । এই অর্থে বুঝতে না পারা যে, কেন আমাকে এইসব উদ্ভট রাইচুয়ালের জন্য মাসে পাঁচ হাজার ডলার করে দেওয়া হচ্ছে ।

হয়তো ভাবা যেতে পারে, ভিসা জটিলতায় আমি আটকে গেছি বলে সাময়িক একটা বিচ্যুতি এইসব । সেটাও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল । ছয় মাসের মত পরে ভিসার জটিলতা কেটে গেলে আমিও পাড়ি জমাই অন্য দেশে যেখানে আমার বিভাগের অন্যান্যরা দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নতুন কারখানার প্রতিষ্ঠা করছেন । সেখানে গিয়ে চারদিন দিনের বেলা তারপর দুইদিন ছুটি তারপর চারদিন রাতের বেলা আটটা থেকে আটটা পর্যন্ত নব্বই ভাগ সময় ঝিমানো ও এদিকসেদিক ঘুরাঘুরি ও ব্যস্ততার ভান করার কাজ করার জন্য মাসে ছয় হাজার ডলার করে আমার একাউন্টে জমা হতে থাকলো । হোটেলের খরচ ও অন্যান্য ব্যাপার বাদ দিয়েই । এই রাইচুয়াল অবশ্য বেশিদিন টিকল না । তিন মাসের মাথায় আবার প্যাভিলিয়নে ফেরতে গেলাম । এবার ফেরত গিয়ে নতুন প্রজেক্টে, নতুন বিভাগে নবোদ্যমে কাজে লেগে গেলাম । নবোদ্যম টিকল মাত্র মাসখানেক । তার পরেই শুরু হল অন্য ধরনের শূন্যতা । দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকার ভান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আমি এসবের শেষ সীমারেখা দেখার জন্য আকুল হয়ে উঠলাম । সকালে যখন ঘুম ভাঙে, যেদিন যতটায়, তখন অফিসে যাই । নিত্যকার অবশ্যকরণীয় কাজ এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে করা শেষ হয়ে গেলে বিভিন্ন সুপার মার্কেটের পার্কিং লটে গিয়ে গাড়িতে ঘুমাই । সন্ধ্যায় টাইম-কার্ড পাঞ্চ করে বাসায় ফিরে আসি এক ধরনের উদ্ভট শূন্যতাবোধ নিয়ে । মাঝে মাঝে দুপুরের পরে বের হয়ে চলে যাই লং ড্রাইভে । তিন-চার ঘণ্টার জন্য ।

এতকিছুর মাঝখানে একটা প্রমোশনও হল । মাসে পাঁচ-সাড়ে পাঁচ হাজার ডলারের মত করে জমাও হচ্ছিল । কিন্তু কোনদিক থেকে যেন কোনো একটা কিছু জীবনীশক্তিকে ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে, ফিল্টার ও পাম্প দিয়ে শুষে বের করে নিচ্ছিল আমার ভিতর থেকে । এই ক্রমশ, দুর্নিবার শোষণ সহ্য করতে না পেরে পাঁচ বছর পাঁচ মাসের মাথায় সমস্ত রংতামাশা সাঙ্গ করে ইস্তফা দিয়ে ফেলি । ভবিতব্য সম্পর্কে কিছু না ভেবেই । মনে হচ্ছিল ভবিতব্য যত অসহ্য হোক, এইসব নরকের দিনগুলির চাইতে খারাপ কিছু হবে না ।

বাংলাদেশে বসে এসবকে হয়তো আপনার ভূতে কিলানো উপকথা মনে হচ্ছে । অস্বাভাবিক কিছু নয় । আমার একান্ত ব্যক্তিগত এই হৃদয়নিংড়ানো উপাখ্যানকে আপনার ঢং মনে হতে পারে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজের ও পরিবারের শুধুমাত্র খাদ্যসংস্থানের জন্য জীবন ও শরীরকে ক্ষয় করে চলা শ্রমজীবী মানুষের জীবনের প্রতি চরম উপহাস মনে হতে পারে । সেইসব অভিযোগ আমি বিনা শর্তে মেনে নিচ্ছি । তবে অন্তত এইটুকু আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতে পারি , এই ধরনের বাস্তবতা নিজের জায়গা থেকে না দেখলে এর সত্যিকারের বোধের জায়গাটি উপলব্ধি করা যায় না । ঐদিকেও সম্পূর্ণ আত্মসচেতনতা আমার আছে যে, এই ধরনের প্রহসনমূলক সমস্যায় পড়তে পারার ব্যাপারটি নিতান্তই ভাগ্যের হঠকারিতা । এমন কোন সম্পদশালী, সামন্ত পরিবারে আমার জন্ম নয় যে ছোটবেলা থেকে এইধরনের বিলাসী সমস্যার মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে এসেছি । সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনগত কাঠামো নিয়েই যেহেতু জন্ম, সেহেতু সেইসব ভাগ্যের উপর ভর করেই এমন ধরনের বিলাসী সমস্যার ভিতরে পড়ে গেছি জীবনের এক পর্যায়ে এসে । তবে, ঐ যে, পৃথিবীতে প্রতিদিন ক্ষুধার জ্বালায় যে অসংখ্য মৃত্যু ঘটে, তার বিপরীতে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ ও তার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হওয়া বিভিন্ন জটিলতায় ঘটা মৃত্যুর সংখ্যাও যেমন নগ্নভাবে পৃথিবীতে মানুষের বৈচিত্র্যের এক চরম উদাহরণ হয়ে থাকে , তেমন করে কর্মজীবন নামক সংগ্রামমুখর বাস্তবতার বিপরীতে করার মত কাজের অভাবের যন্ত্রণাটিও অস্বীকার বা তাচ্ছিল্য করে বাদ দিয়ে দেওয়ার মতো সমস্যা নয় । অন্তত শিল্পোন্নত দেশগুলোর বাস্তবতায় ।

বুলশিট জবসের লেখক শিল্পোন্নত দেশগুলোর এইসব উদ্ভট বাস্তবতার উপাখ্যানই নির্মাণ করেছেন তার বইয়ে । বইটির যাত্রা শুরু হয় মূল বই লেখার বছর পাঁচেক আগের এক অনলাইন সংবাদপত্রের একটা রচনার মাধ্যমে । সেই রচনায় লেখক বর্তমানের শিল্পোন্নত দেশগুলোতে অর্থহীন চাকরি ও তার কারণে ধীরে ধীরে জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা একটা বড়সড় গোষ্ঠীর মনোযন্ত্রণা এবং এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণের উপর একটা তত্ত্ব দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন । সেই রচনার বিপরীতে আমার মত অনেক ভুক্তভোগীর অবিশ্বাস্য পরিমাণে সাড়া পাওয়ার পরেই কেবলমাত্র পুরো বিষয়টিকে এক ধরনের কাঠামোগত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন লেখক । এই তত্ত্বের প্রস্তাবনার আগে আমার মত সৌভাগ্যের জাঁতাকলে পিষ্ট লোকজন নানানভাবে নিজের উদ্ভট দূরাবস্থার ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিল । আমি নিজে নানানভাবে নিজের এই উদ্ভূত হাস্যকর সমস্যার ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি । কখনো মনে হয়েছে এ আমার মধ্যজীবন সংকট । শৈশব ও কৈশোরের দুনিয়া পাল্টে দেওয়ার ফ্যান্টাসিগুলো মূর্ত বাস্তবতা হিসাবে দেখা দেয়নি বলে হয়তো আয়েশ ও স্বচ্ছলতার জীবনের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতাবোধ হচ্ছে । কখনো কখনো নিজের একান্ত অস্তিত্ব ও ব্যাক্তিগত নির্মাণকে ভুল মনে হয়েছে । মনে হয়েছে হয়তো আমার নিজের ভিতরই নিজেকে ধ্বংস করে দেওয়ার এক ধরনের ভ্রান্তি , এক ধরনের অমোচনীয় গলদ রয়ে গেছে , যার জন্য এই ধরনের আরাম ও শান্তির একটা চাকরিতে কাড়ি কাড়ি টাকা পেয়েও সমস্ত কিছু উচ্ছন্নে দেবার জন্য পাগল হয়ে গেছি । মনে হয়েছে এই হয়তো মানুষ নামক পুরো প্রাণীটির গঠনের মধ্যে এক অমোঘ গলদ । এই প্রাণীটি হয়তো যন্ত্রণা ও দুঃখ ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে জোরদার করে উপলব্ধি করতে পারে না বলে কেবল খারাপ জিনিসের জন্য ছোঁকছোঁক করে । আবার কখনো মনে হয়েছে এই আধুনিক নগরসভ্যতা, সর্বগ্রাসী নতুন পুঁজিবাদের অর্থনীতি আর যন্ত্রের অমানবিক, বিমানবিক আগ্রাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার এই প্রবণতা হয়তো অবশ্যাম্ভাবী প্রতিক্রিয়া । সেই প্রতিক্রিয়ার নানান দিকের আলোচনা করতে গোটা গোটা থান ইটের সমান প্রস্থের একখানা উপাখ্যানও (সানডে নাইট ব্লুজ) আমি রচনা করে ফেলি ।

সমস্ত কিছুকে তুচ্ছ করে যখন প্রহসনের উপাখ্যানকে অস্বীকার করে আমি অনিশ্চিত ভবিতব্যের উপর ভরসা করে অর্থহীন স্বচ্ছলতার জীবনকে বিদায় বলে পা বাড়াই তখন আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব আর শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিহ্বলতার মুখে, সর্বোপরি সেইসব অর্থনীতিবিদদের বিহ্বলতার মুখে, যারা পুরো একটা মানব-জ্ঞানের শাখা এই ভিত্তিতে তৈরি করেছেন যে, হোমো ইকোনোমিকাস, অর্থাৎ অর্থনৈতিক মানুষের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান একমাত্র মঞ্জিলে মকসুদ হচ্ছে , ‘যত সামান্য ব্যয় করে যত সর্বোচ্চ নিজের জন্য লাভ করা যায়’ , আমার একমাত্র প্রতিক্রিয়া ছিলো, ‘ I wish I was the monster the proverbial economist think I am’ , অর্থাৎ তাদের মনোমত আচরণ করতে পারলে, সেই আচরণে নিজেকে মানাতে পারলেই আমি বরং সুখি হতাম । এই ধরনের আরো অনেক বিভ্রান্তি, নিজেকে নিয়ে উদ্ভট রহস্যময়তায় ভোগা, যন্ত্রণাদগ্ধ মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত মনোযন্ত্রণার উপাখ্যানে ভরপুর বুলশিট জবস নামের বইটি ।

সত্যিকারের অর্থবহ কাজ করতে না পারার মনোযন্ত্রণা যে নিতান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে বড়ো হওয়া মানুষের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছলতার মোহের চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে, এই ধরনের উদ্ভট নতুন জ্ঞানের পাশাপাশি, বর্তমানের দুনিয়াতে জীবিকা, চাকরি ও অর্থনীতি নিয়ে প্রচলিত আরো কিছু নিতান্ত সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তি ভেঙে দেয় এই বই । এর মধ্যে দ্বিতীয়টি হচ্ছে , এই ধরনের অর্থহীন, অদরকারী চাকরি ও কর্ম কেবল সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় । বর্তমানের উদ্ভট নতুন উদারপন্থী অর্থনীতির বাস্তবতায় বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এই ভয়াবহ অবস্থার কমতি নেই তেমন একটা । বইয়ের পিছনের যে মূল উপাত্ত, শত শত মানুষের নিজ চাকরি ও কর্মজীবনের হতাশার উপাখ্যান, সেখানে সরকারি চাকরির লোকজনের তুলনায় বেসরকারি চাকরিতে অবস্থানরত লোকজনের কাহিনিই বরং অনেক বেশি । এর কারণ ও গভীর সামাজিক ও দার্শনিক ভিত্তির ব্যাপারটিও লেখক পরবর্তীতে আলোচনা করেছেন বিশদভাবে । তৃতীয় যে সার্বজনীন সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিকে চুরমার করে দেয় এই বইটি ও এই সম্পর্কিত আলোচনা তা হচ্ছে, পুঁজিবাদের মারমার কাটকাট অর্থনৈতিক কর্মদক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা আসলে এই ধরনের অর্থহীন উদ্ভট কর্মসংস্থানকে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনে বলে অর্থনীতিবিদরা দাবি করে এসেছেন বাস্তবক্ষেত্রে তার ফলাফল বরং পুরোপুরি উল্টো । এই ধরনের কর্মসংস্থানের রমরমা বাজার বরং নতুন পুঁজিবাদের, নতুন উদারনৈতিক অর্থব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ফলাফলেই জন্ম নেয় ও ফুলেফেঁপে উঠে ।

তবে বুলশিট জবসের প্রাথমিক প্রতিপাদ্য বিষয় কিন্তু ঠিক আমার ও আমার মত অনেক অভিজ্ঞতার চাকরিগুলো ছিল না । প্রাথমিকভাবে লেখক মূলত আলোচনাটি শুরু করেছিলেন এমন সব কর্মসংস্থান ও চাকরিগুলো নিয়ে যেগুলোর পুরো শতভাগই অর্থহীন ও অনেক ক্ষেত্রেই বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর । অর্থহীনতার যেহেতু কোনো সঠিক মানদন্ড নাই তাই বাধ্য হয়েই চাকরিরত লোকজনের নিজস্ব মূল্যায়নকেই সর্বোচ্চ ধরে নিতে হয় । এই দিকটি মাথায় রেখে লেখক বুলশিট জবসের সংজ্ঞাও তৈরি করেন সতর্কতার সাথে । যেসব সবেতন চাকরি এতটাই অর্থহীন, উদ্দেশ্যবিহীন ও অপচয়মূলক যে সেসব চাকরিতে চাকরিরত লোকজন নিজেরা মনে করে তাদের কাজের কোন উদ্দেশ্য নাই, সমাজের কোন উপকারে আসে না অথবা উল্টো ক্ষতি করে সেই ধরনের চাকরিই হচ্ছে বুলশিট জবস । এই প্রস্তাবনা নিয়ে লেখকের প্রথম আর্টিকেলটি মূলত তার নিজস্ব ভাবনার উন্মোচন হলেও, প্রকাশের পরে ইন্টারনেট দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখকের কাছে অনেকের কনফেশন জমা হয় । সেইগুলোকে বিন্যস্ত করে বইটি লেখা । পারিসংখ্যানিক উপাত্ত যতটুকু আছে তা হচ্ছে নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কে অনলাইনে পরিচালিত দুইটা জরিপ । সেই জরিপের ফলাফল থেকে দেখা যায় মোটামুটি শতকরা চল্লিশ ভাগ কর্মজীবি নিজেরা মনে করে যে তাদের কাজের কোন উদ্দেশ্য বা অর্থ নাই এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজের জন্য ক্ষতিকর অর্থাৎ উন্নত বিশ্বে মোটামুটি দশজনে চারজন বিভিন্ন বুলশিট জবে নিয়োজিত থেকে তাদের জীবিকা অর্জন করে ।

পরবর্তী পর্যায়ে লেখক বুলশিট জবগুলোর মোটামুটি পাঁচটি প্রকরণ তৈরি করেন , যদিও কিছু কিছু চাকরিকে কোন প্রকরণেই বিন্যস্ত করা যায় না, আবার কিছু কিছু চাকরি একসাথে একাধিক প্রকরণের মধ্যে পড়ে । পাঁচটি প্রকরণ হচ্ছে , flunky, goon, duct-taper, box ticker এবং taskmaster ; যেগুলোর ঠিক বাংলা প্রতিশব্দ বের করা অনেকখানি গবেষণা ও সমন্বয়ের ব্যাপার বলে আপাততঃ তাদের মূল ইংরেজি শব্দেই চালানো যাক । ফ্লাঙ্কি হচ্ছে এমন ধরনের চাকরি যেগুলো মূলত ঐতিহ্য ও অলংকরণের জন্য রাখা হয় কোন অফিসে । যেমন অনলাইন পত্রিকা অফিসের জন্য রিসেপশনিস্ট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসারের জন্য প্রশাসনিক টিম যেখানে একজন লোক দরকার কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে পাঁচ থেকে দশজন । এসব চাকরিতে নিয়োজিত লোকজনের সারাদিন বসে বসে বিরক্ত ও ক্লান্ত হওয়া ছাড়া তেমন কোন কাজ থাকে না । goon বা গুন্ডা হচ্ছে বিভিন্ন কনসাল্টিং কোম্পানি ও টেলিমার্কেটিং কোম্পানিতে কর্মরত লোকজন যাদের পুরো চাকরির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ক্লায়েন্টদের বিভ্রান্ত করে বিভিন্ন অর্থহীন ও ক্ষতিকর চড়া দামের সার্ভিস নেওয়ার জন্য বাধ্য করা । ডাক্ট টেইপার বা জোড়াতালি বিশারদ হচ্ছে এমন সব কর্মজীবি তাদের পুরো অবস্থানই তৈরি হয়েছে প্রতিষ্ঠানের কোনো একটা গলদের জন্য যেখানে প্রতিষ্ঠান সেই গলদ না শুধরে বরং অন্যদের দেখানর চেষ্টা করে যে এই গলদ নিয়ে আমরা কিছু একটা করছি । এ ধরনের কাজের মধ্যে আছে বিভিন্ন রকমের কমিটি, কাউন্সিলর , কাস্টমার রিলেশন অফিসার এইসব । বক্স টিকার হচ্ছে এমন ধরনের চাকরি যেখানে কোনো একটা প্রতিষ্ঠান সামাজিক বা রাজনৈতিক চাপের কারণে অন্যদের দেখাতে বাধ্য হয় যে তারা কোনো একটা বিষয়ে, ধরা যাক পরিবেশের ক্ষতিরোধে অথবা অবৈধ বাণিজ্যের প্রতিরোধে সচেতন এবং এই বিষয়ে তারা কিছু একটা করছে । এটা দেখানর জন্য তারা অনেকগুলো লোককে নিয়োগ দেয় যারা সারাদিন বসে বসে কোনো অর্থবহ কাজ করে না, বরং বলা ভালো যে তাদের বিশেষ সতর্কতার সাথে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না , কিন্তু বছর শেষের কোনো একটা সম্মেলনে প্রতিষ্ঠান গর্ব নিয়ে ঘোষণা দিয়ে পারে পরিবেশের রক্ষায় অথবা অবৈধ বাণিজ্যের প্রতিরোধে তাদের দুইশ সদস্য বিশিষ্ট বিভাগ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে । সর্বশেষ টাস্কমাস্টার হচ্ছে দ্বিতীয় ঘাতের বুলশিট জবস । এদেরকে রাখা হয় বিভিন্ন বুলশিট কাজে নিয়োজিত টিমের ব্যবস্থাপনায় । পুরো টিমের কাজেরই যেখানে কোনো অর্থ ও সামাজিক উপযোগ নাই সেখানে এরা অধীনস্থদের মধ্যে বিভিন্ন কাজের ভাগবাটোয়ারা করে , এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই নিজেদের কাজের প্রয়োজনীয়তা প্রমাণের জন্য উদ্ভট সব বুলশিট কাজে ব্যস্ত রাখে তাদের ।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো ঠিক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় নাই যে এই ধরনের বুলশিট জব খোলামেলাভাবে অন্তত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিতরে দেখা যাবে । উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে অবশ্য পরিবেশ ভিন্ন । লেখকের কাছে জমা হওয়া শত শত লোকের কনফেশন ও আত্ম-অনুসন্ধানের চিত্র থেকে এইসব কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি সম্পর্কে একটা ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে । সবচে কৌতুহলোদ্দীপক ও বিভ্রান্তিকর ব্যাপার হচ্ছে নিওলিবারেল অর্থনীতির সবচে মারমার কাটকাট আমলে কেনো এই ধরনের অপচয়মূলক অর্থহীন কাজের রমরমা বাজার তৈরি হয়েছে সেটা । লেখক নিজে নৃতাত্ত্বিক হিসাবে সমাজের গভীরতর দার্শনিক ও রাজনৈতিক স্রোতগুলো থেকে এই প্রশ্নের একটা উত্তর তৈরি করার চেষ্টা করেছেন বটে, তবে রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি স্বঘোষিত লিবারেল এলিট এবং নৈরাজ্যবাদী (anarchist) হবার কারণে সমস্ত ব্যাখা ঠিক আমাদের সাধারণ সচেতনতা ও জ্ঞানে পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য না হলেও মোটের উপর তার ব্যাখ্যা ও চিন্তায় খুব বেশি ভুল নাই ।

হয়তো নিজের নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে ব্যাংকিং এবং অর্থায়ণ (finance) খাতের উপর লেখক অনেক বেশি পরিমাণে খড়গহস্ত । তার কাছে জমা হওয়া কিছু কিছু কনফেশনের লেখক নিজেরা ব্যাংকিং ও অর্থায়ণ খাতে জড়িত । এদের ভাষ্যমতে এই খাতের প্রায় নব্বইভাগ চাকরিই মূলত অপ্রয়োজনীয় এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর । শতকরা নব্বইভাগ হয়তো অতিরঞ্জন, কিন্তু উন্নত বিশ্বে ক্রেডিট কার্ড, সাব-প্রাইম ঋণ ও মর্টগেজের ছড়াছড়ি আর বড়ো বড়ো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের (জেপি মর্গ্যান, গোল্ডম্যান স্যাক্স , ইত্যকার) আয়ের সবচেয়ে বড় অংশটি যে আসে ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা সাধারণ মানুষের উপর ধার্যকৃত পেনাল্টি এবং সুদ থেকে, এ থেকে ধারণা করা যায় এইসব খাতে নিয়োজিত কর্মজীবীদের বিশাল বড় একটা অংশের গোটা কর্মজীবনই আসলে বুলশিট । আরেকটি কৌতুহলোদ্দীপক গভীর জ্ঞান পাওয়া যায় লেখকের বিশ্লেষণে । তা হচ্ছে শিল্পোন্নত বিশ্বের অর্থনীতি বর্তমানে এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে এক সময়ের বড়ো বড়ো উৎপাদক কোম্পানিগুলোর বর্তমান আয়ের সবচেয়ে বড়ো অংশটি উৎপাদন থেকে আসে না , বরং বিভিন্ন ধরনের সরকারি ও বেসরকারি নীতিমালার ফাঁক-ফোকর থেকে শুষে নেওয়া লুটের মাল থেকে আসে । বাজার অর্থনীতির ভাঙা ঢোল ক্রমাগত পিটিয়ে যাওয়া অর্থনীতিবিদের মতে অর্থনৈতিক উন্নতির অবশ্যাম্ভাবী ধাপ হিসাবে সব উন্নত অর্থনীতিই একটা পর্যায়ে এসে উৎপাদন অর্থনীতি থেকে সরে সেবার অর্থনীতিতে পৌঁছায় । এটাই সবার অমোঘ নিয়তি । এতে দোষের বা আশঙ্কার কিছু নাই । বাস্তবের দুনিয়ায় ঘটনা এমন ফুলশয্যার মত নয় আসলে । বাস্তবের দুনিয়ায় যা ঘটছে তা হচ্ছে বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে নিজেদের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের জন্য মুক্ত করে দিলে দুই দিন পরে হোক বা আগে, এরা আবিষ্কার করে নিবে সেই পথ যা লাখ লাখ বছরের জৈব-বিবর্তন আর খাদ্যচক্রের ধারণা আমাদের শিখিয়েছে । অন্যের উপার্জনের উপর লুটপাট ।

লুটপাটভিত্তিক অর্থনীতির একটা চোখ ছানাবড়া করে দেওয়া উদাহরণ লেখকের কাছে জমা হওয়া একটা কনফেশন থেকে পাওয়া যায় । যুক্তরাজ্যের পেইমেন্ট প্রটেকশন ইন্সুরেন্স (PPI scandal) নিয়ে তৈরি হওয়া একটা ঝামেলার পর ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার । ক্ষতিগ্রস্তদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে । বরাদ্দ করা হয় মোটা অঙ্কের একটা বাজেট । কিন্তু এইসব প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃতভাবে অদক্ষ লোক নিয়োগ দিয়ে, নিয়োগকৃত লোকজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল প্রশিক্ষণ দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটিকে দীর্ঘায়িত করতে থাকে । যত দীর্ঘায়িত করা যায় তত বেশি সম্পূরক বাজেট , তত বেশি আয় । সরকারের নিজের যেহেতু এই কাজ করার লোকবল ও জ্ঞান নাই সেহেতু এইসব প্রতিষ্ঠান যেভাবে বুঝিয়েছে , সেই অনুযায়ী সরকার কেবল বরাদ্দ দিয়ে গেছে । প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দ্রুত কাজ শেষ করা বরং তাদের সোনার ডিম পাড়া হাসকে জবাই করে দেওয়ার মতো । ফলে কাজ দীর্ঘায়িত করার জন্য নতুন নতুন বুলশিট জবের উৎপাদন । আরেকটি জ্বলন্ত উদাহরণ দেখা যায় আমেরিকাতে ও তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি করা ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক ধ্বসের সময় । যেসব প্রতিষ্ঠান অন্যের আমানতের টাকা নিয়ে উদ্ভট সব জুয়া খেলে গোটা অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলো তাদেরকে টু বিগ টু ফেইল বলে আখ্যায়িত করে সরকারের রাজস্ব থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ও ক্ষেত্রবিশেষে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ঢেলে তাদের পতনের হাত থেকে রক্ষা করা হয় । প্রতিষ্ঠানগুলো যখন জানল যে তারা যত রকমের নষ্টামিই করুক , রক্ষাকর্তা হিসাবে সরকার আছে তখন তারা কোন দুঃখে মিতব্যায়িতা আর দক্ষতার সাথে কাজ করার দিকে মনোযোগ দিবে ? ফলত আবার সেই নতুন নতুন বুলশিট জব আর বুলশিট প্রজেক্টের উৎপত্তি ।

তবে অর্থনীতির এই বুলশিটকরণের ব্যাপারটি আসলে দুই একটা উদাহরণে সীমাবদ্ধ ব্যাপার নয় । ওরকম হলে এই দুই-একটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ব্যাখ্যা করে দেওয়া যেত । গভীরতর যে ব্যাপারটি কিছুদিন পরপর এরকম রোগের লক্ষণ দেখাচ্ছে সেটার সন্ধানও জরুরি । লেখক প্রায় অকল্পনীয় ধরনের একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এই অবস্থার । তিনি বলতে চাচ্ছেন বর্তমানের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি আসলে শিল্প-বিপ্লব, শ্রমিকের যথাযথ অধিকার, সার্বজনীন মানবাধিকার এইসব স্টেশন স্পর্শ করে আবার ঘুরেফিরে সেই পুরাতন যুগের জমিদার জোতদার বা ইউরোপের পটভূমিতে ডিউক, আর্ল, ব্যারন, নাইট এইসবের সামন্ত যুগের কাঠামোতে ফেরত গেছে । সামন্ত যুগের অর্থব্যবস্থায় সার্বিক অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন করত মূলত কৃষক এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র কর্মজীবি, কুমার, কামার এইসব লোকজন । এদের উৎপাদনের বিশাল একটা অংশ সামন্ত প্রভুরা নিয়ে যেত খাজনা হিসাবে । সামন্ত প্রভু তার খাজনার একটা অংশ আবার জমা দিত তার উপরের পর্যায়ের প্রভুর কোষাগারে । এইভাবে ধাপে ধাপে জমা হয়ে শেষ পর্যন্ত রাজা অথবা সম্রাটের কোষাগার ভরত কৃষক ও কর্মজীবিদের শ্রমের ফসলে । এইসব উৎপাদকের উৎপাদিত ফসল ও পণ্যের উপর ভর করে চলা পরবর্তী প্রতিটা পর্যায়ের সামন্ত প্রভুর নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামোর পুরোটাই মূলত বুলশিট জবের আওতায় পড়ে । সামন্তপ্রভু তার কাঠামো বজায় রাখার জন্য তার চারপাশে পাইক, পেয়াদা, বরকন্দাজ, মালি, বাবুর্চি এরকম আরো শতশত লোককে নিয়োজিত রাখত । জনগনের একটা অংশকে এইসব কাজে ব্যস্ত না রাখলে গোটা সুখের সিস্টেম ধরে টান দেওয়ার মত বৈপ্লবিক অবস্থার উৎপত্তি হওয়ার সম্ভাবনাকে এড়ানর জন্য মধ্যস্বত্বভোগীদের একটা বিশাল বাহিনী অনেকটা বাধ্য হয়েই পুষতে হতো সমস্ত ডিউক, ব্যারন, জমিদার, জোতদার, রাজা, মহারাজাকেই । লেখকের মতে অনেক অন্তর্বর্তী পর্যায় অতিক্রম করে উন্নত বিশ্বের বর্তমান অর্থনীতি ফেরৎ গেছে ঠিক ঐ অবস্থাতেই । সত্যিকারের পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে ক্ষুদ্র কর্মজীবি, কৃষক ও বিশালভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে, সত্যিকারের সেবার উৎপাদন হচ্ছে ছোট ছোট রেস্তোরা, সেলুন, পার্লার, হাসপাতাল, পরিবহন ও বিতরণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের দিয়ে । যদিও এই ব্যাপারটি লেখক এড়িয়ে গেছেন , তবু সহজেই আন্দাজ করা যায় বিশ্বায়নের কারণে যন্ত্রের চাইতেও কম খরচে অনুন্নত বিশ্বের হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে কোনরকমে পেটের সংস্থান করা শ্রমিকরাও আসলে উন্নত বিশ্বের আধুনিক সামন্তপ্রভুদের সমাজ কাঠামোর চালিকাশক্তি সরবরাহ করে যাচ্ছেন । লেখক এই নতুন তৈরি হওয়া উদ্ভট ব্যবস্থার নাম দিয়েছেন managerial feudalism বা ম্যানেজারভিত্তিক সামন্ততন্ত্র । পার্থক্য কেবল আগের জমিরদার জোতদার ডিউক ব্যারন রাজা মহারাজারা এখন জুনিয়র ম্যানেজার মিডল ম্যানেজার সিইও, সিএফও , স্ট্র্যাটেজিক ভিশন ম্যানেজার এইসব নামে পরিচিত । সারবস্তুতে তেমন কোন পার্থক্য নাই । আগের যুগের সামন্ত প্রভু যেমন নিজের গুরুত্ব ও বিশালত্ব বোঝানোর জন্য চারপাশে পাইক পেয়াদা দেহরক্ষী রাখতো , এখনকার যুগের ম্যানেজার তার ডিপার্টমেন্টের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একইধরনের বুলশিট জবে নিয়োজিত ব্যক্তিগত সহকারী, দেহরক্ষী , প্রশাসনিক সহকারী এইসব লোকজন রাখে ।

এতকিছুর পরেও যে প্রশ্ন তবু থেকে যায় তা হচ্ছে ঠিক কী কারণে এইরকম উদ্ভট একটা অর্থব্যবস্থা এত দীর্ঘসময় ধরে টিকে থাকে । লেখকের মতে এই ধরনের ব্যবস্থার উৎপত্তি মূলত গত শতকের সত্তর দশক থেকে । অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে এই ধরনের একটা উদ্ভট অর্থনীতি তৈরি হয়েছে এবং টিকে আছে পরম প্রতাপে । একটা কারণ হয়তো বলা যায়, যেটা লেখক এড়িয়ে গেছেন নিজে স্বঘোষিত লিবারেল এলিট হওয়ার কারণে যে উন্নত বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশের বর্তমান সরকারব্যবস্থা মূলত তথাকথিত কল্যাণ রাষ্ট্রের কাঠামোর উপর নির্মিত । এই কাঠামোতে দেশের সবচেয়ে বড়ো বিনিয়োগকারী, সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সেই দেশের সরকার । সরকার বিভিন্ন ক্ষুদ্র উৎপাদকদের কাছ থেকে চড়া হারে ট্যাক্স আদায় করে লাখে লাখে বুলশিট জবে সরকারি ও বেসরকারিভাবে জনগণের বিশাল একটা অংশকে নিয়োজিত রাখে মূলত লাজলজ্জার জলাঞ্জলি দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সরকার বলে নিজেকে ঘোষণা দিতে না পারার কারণে । আরেকটা কারণ হিসাবে ধরা যায় যন্ত্রব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়াতে মানুষের অংশগ্রহণের প্রয়োজন নগণ্য পরিমাণে সীমিত হয়ে আসার পরেও জনগণের বিশাল একটা অংশকে কোনো না কোনো একটা কাজে ব্যস্ত রেখে পুরো দুনিয়া উল্টে দেবার হঠকারী চিন্তা থেকে দূরে রাখার উদ্দেশ্য । অন্যদিকে ঠিক সত্তরের দশক থেকে কল-কারখানার বিভিন্ন কাজে কম্পিউটারের অভূতপূর্ব সাফল্যের কারণে আদতে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়া জনগণের বিশাল একটা অংশের রুটি রুজির ব্যবস্থা করার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সরকারকে সচেতনভাবেই হয়তো এই ধরনের একটা অর্থব্যবস্থার দ্বারগ্রস্থ হতে হয়েছে । আরেকটা কারণ আন্দাজ করা যায় অর্থব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন থেকে । উন্নত বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশ টাকার সৃষ্টির জন্য পুরনো স্বর্ণ মজুদ ব্যবস্থা থেকে সরে এসেছে । নতুন ব্যবস্থায় টাকা তথা মুদ্রা তৈরির জন্য কোন দেশকেই আর সমপরিমাণ মূল্যবান কিছুর উৎপাদন করতে হয় না । কেবল কেন্দ্রিয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেই চলে । টেকনিক্যাল বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৈমিত্তিক আলোচনা বাদ দিয়ে সারকথা যা বলা যায় তা হচ্ছ শূন্য থেকে ডলার পাউন্ড ইউরোর মত বনেদি মুদ্রার তৈরি করা যায় এবং সেইসব মুদ্রা ব্যবহার করে অনুন্নত বিশ্ব থেকে সত্যিকারের সারবস্তু তথা বিভিন্ন কাঁচামাল ও সেবা কিনে নেওয়া যায় । এই ব্যাপারটিও লেখকের বিশ্লেষণে উঠে আসে নি কিন্তু উন্নত বিশ্বে বুলশিট চাকরির বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে এটাকেও একটা বড়ো কারণ হিসাবে দেখা যেতে পারে । সরকার যেখানে চাইলেই মুদ্রা তৈরি করে অনুন্নত বিশ্ব থেকে কাঁচামাল আর সেবা নিতে পারে সেখানে কষ্ট করে উৎপাদন আর সৃষ্টির দরকার আসলে নাই ।

গভীরতর কারণ আর দার্শনিক সামাজিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যেমনই হোক , বুলশিট জব আর তার প্রতিক্রিয়া অন্তত উন্নত বিশ্বের ব্যক্তি কর্মজীবির উপর যেসব প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে সেগুলো জাজ্ব্ল্যমান সত্য ।

ব্যক্তি ও সমাজের উপর বুলশিট জবগুলোর প্রভাব প্রতিক্রিয়ার আলোচনায় যাওয়ার আগে , বইয়ের আলোচনাক্রমের বিপরীতে হলেও অন্য একটি দিক আলোচনা করে রাখা জরুরি । তা হচ্ছে বুলশিট জবের পাশাপাশি সাধারণ অর্থবহ, করার মত কাজ থাকা চাকরিগুলোতে ব্যয়কৃত সময়ের বিশাল একটা অংশ অনর্থক ব্যয় হওয়ার প্রক্রিয়া । লেখক একে বলছেন অন্য জবগুলোর বুলশিটাইজেশন । আমার অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যিকারের বুলশিট জবের চাইতে এই দিকটা আরো অনেক বেশি বিস্তারিত ও অনেক বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর । বুলশিট জবে কর্মরত কর্মজীবীর পুরো চাকরিই অর্থহীন ও উপযোগহীন কাজে ব্যয় হয় । যেহেতু এই অর্থহীনতার বিচারের ক্ষেত্রে লেখক ব্যক্তির নিজের বিচারকেই সর্বোচ্চ ধরে নিয়ে উপাত্ত তৈরি করেছেন , সেহেতু বলা যায় নিজের বিচারে যে আনুমানিক শতকরা চল্লিশ ভাগ কর্মজীবী নিজেদের কাজকে বুলশিট বলছেন সেখানে মোটামুটি দৃষ্টিগ্রাহ্য একটা অংশ থাকবে ভুল বিচারের । আধুনিক অর্থনীতিগুলো অনেক জটিল হয়ে উঠাতে অনেক ক্ষেত্র পাওয়া যাবে যেখানে ব্যাক্তি নিজে হয়তো এমন ক্ষুদ্র একটা ব্যাপ্তিতে কাজ করছে যে পুরো পটভূমি তার কাছে ঘোলাটে থেকে যাবার কারণে ভুলভাবে নিজের কাজকে বুলশিট বলে মনে করছে । আবার লেখকের কাছে জমা হওয়া কনফেশনগুলো থেকে দেখা যায় নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তার কারণে অনেকে অর্থনীতির পুরো কোনো একটা খাতকে ঢালাওভাবে অর্থহীন বা ক্ষতিকর বলে বাদ দিয়ে দিচ্ছে, এবং সেই খাতে নিয়োজিত সমস্ত কর্মজীবীর কাজকে বুলশিট বলে দাবি করছে । এগুলো সত্যিকারভাবে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে মূল্যায়ন করার সুযোগ নাই বলে হয়তো কখনোই পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যাবে না, তবে ব্যক্তির নিজের বিচারের সংখ্যার চাইতে কিছুটা কম হয়তো হবে । অথবা হয়তো সেটাও হবে না কারণ উল্টোদিকে অনেকে থাকবে যারা আসলে বুলশিট চাকরিতে নিয়োজিত, কিন্তু ভ্রান্তভাবে মনে করে বসে আছে সে তার কাজ অর্থবহ ।

অন্যদিকে সাধারণ অর্থবহ কাজের বুলশিটাইজেশন যে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে অন্তত উন্নত বিশ্বে, এবং সরকারি চাকরিগুলোর ক্ষেত্রে প্রায় গোটা দুনিয়াতেই, এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য । একেক গবেষণায় একেক রকম সংখ্যা উঠে আসলেও ফুলটাইম কাজে নিয়োজিত চাকরিজীবীদের সেই ফুলটাইমের একটা বিশাল অংশ যে বুলশিট কাজ করে ব্যয় হয় সেটা নিয়ে সন্দেহ নাই । বুলশিট জবের চাইতে অর্থবহ জবের বুলশিটাইজেশন বেশি ক্ষতিকর হওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ হচ্ছে এই যন্ত্রণার ভুক্তভোগীর সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমের বিশাল ফলতঃ এই খাতে অপচয়কৃত মানব-সম্পদ আর মানব-প্রচেষ্টার পরিমাণও মহাবৈশ্বিক স্কেলে বিশাল । আরো ভয়ংকর বড়ো কারণ হচ্ছে পুরোপুরি বুলশিট জব থেকে কেউ কেউ মুক্তি পায় । লেখকের কাছে জমা হওয়া কনফেশনগুলোর কয়েকটা থেকে দেখা যায় কেউ কেউ অনেক বেশি বেতনের অনেক আরামের বুলশিট জব ছেড়ে কম বেতনে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্থবহ কাজে ফেরত গেছেন । এমন অবিশ্বাস্য একটাও পাওয়া গেছে যেখানে ফাইন্যান্সিয়াল ক্ষেত্রের ছয় সংখ্যার বেতন ছেড়ে আক্ষরিক অর্থে ঝাড়ুদারের কাজে গেছেন একজন । কিন্তু অর্থবহ চাকরির বুলশিটাইজেশনের ক্ষেত্রে মরণ অথবা সব ছেড়েছুড়ে সসে চলে যাওয়া ছাড়া কোন মুক্তি নাই । এক চাকরি পাল্টে জীবন-জীবিকা আর নিজের পরিবারের জন্য উপার্জন ঠিক রাখতে গিয়ে আরেক চাকরিতে গেলে দেখা যাচ্ছে সেখানেও সেই একই বুলশিটাইজেশন । সেই একই রুটিন । সপ্তাহে পাঁচ-দশ ঘণ্টার অর্থবহ কাজ আর বাকি ত্রিশ-চল্লিশ ঘণ্টা অর্থহীন বুলশিট এবং মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্যদের কাছ থেকে মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিয়ত নিজেকে ব্যস্ত রাখার ভান করার নরক-যন্ত্রণা ।

বুলশিট জবের তৈরি হওয়ার কারণ যেমন অর্থনীতির বিশাল একটা অংশ সামন্ত যুগের লুটপাট মডেলে চলে যাওয়া, সাধারণ চাকরির বুলশিটাইজেশনের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য । তবে সাধারণ চাকরির বুলশিটাইজেশনের ক্ষেত্রে আরো বড় অনেকগুলো ব্যাপার জড়িত । একেবারে গভীরে গেলে ঠিক মানুষের জীবন আর কাজের মৌলিক কী সম্পর্ক সে সম্পর্কিত গোটা সমাজের দীর্ঘদিনের সংস্কার ও দর্শন জড়িত রয়েছে এ ক্ষেত্রে । এমনিতে উপরিতলে যে কারণ তা হচ্ছে উনিশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত অনেক অনেক অর্থনীতিবিদ , এমনকি তারও আগে মার্ক্স যে প্রযুক্তির উন্নয়নের ভবিষ্যতবাণী করে গেছেন, তার প্রায় পুরোটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে । যন্ত্রায়ণ আর প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে এখন আসলে পুরো সমাজের প্রয়োজন মেটানোর মত উৎপাদন চালু রাখার জন্য এত লোকের দরকার নাই কর্মক্ষেত্রে । অথবা লোক সবাইকে রাখলেও মোট কর্মঘণ্টা আসলে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেইনসের ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী সপ্তাহে পনের ঘণ্টার মতই দরকারি । অর্থাৎ সপ্তায় দুই দিন । অথচ কর্মক্ষেত্রগুলো এখনো উল্টো । যেখানে হওয়া দরকার দুই দিন কাজ পাঁচদিন ছুটি, সেখানে আমরা করছি পাঁচদিন কাজ দুইদিন ছুটি । সত্যিকারের করণীয় কাজের পরিমাণ কম হলেও প্রায় সবাইকে কিছু না কিছু একটাতে ব্যস্ত রাখার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ব্যাপারটি বোধগম্য । বুলশিটের জবের ক্ষেত্রে যেমন এক্ষেত্রেও তেমনভাবে সবাইকে ব্যস্ত না রাখলে এতশত মানুষ কি করে ফেলবে এই নিয়ে ক্ষমতাবানরা তটস্থ থাকে । লেখক তার বইয়ে আমেরিকার বিগত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন , যা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে হলেও ঠিক এই কথাটাই বলে । আমেরিকার উদ্ভট বিতিকিচ্ছিরি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে আর সব সাধারণ-জ্ঞানওয়ালা উন্নত বিশ্বের মত সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমার ব্যবস্থা করলে সমস্যা কি এই প্রশ্নের জবাবে ওবামা বলছিলেন, ওরকম করা যায় এবং সেটা অনেক বেশি পরিমাণে কর্মদক্ষ ও উন্নত একটা ব্যবস্থা হবে বটে, কিন্তু তা করতে গেলে এখন এই খাতে নিয়োযিত বিশ-ত্রিশ লাখ লোক কর্মহীন হয়ে যাবে । ডান-বান দুইপক্ষই যেহেতু হুট করে বিশ-ত্রিশ লাখ লোকের চাকরি চলে যাবার ব্যাপারটি মানতে পারবে না , তাই চালাও এই অদক্ষ উদ্ভট ঠেলাগাড়ি , যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ ।

সেটা না হয় মানা গেল । তাহলে যেটুকু কাজ আছে সেটুকু কাজ সবাই দক্ষভাবে করে একইরকম বেতনে , একই কাজ করে সপ্তায় পাঁচদিন ছুটি আর দুইদিন খাটলে অথবা দিনের প্রথম অংশটা কাজ করে দুপুর থেকে সবাই ফ্রি হয়ে গেলে কী সমস্যা ? এখানেই আসে মানব-জীবন ও কাজ সংক্রান্ত সার্বজনীন সংস্কার ও আধ্যাত্মিক দর্শনের ব্যাপারটি । সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের ব্যবস্থায় সুখি মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে । ঐ যে কোনো একজন পিউরিটানিজমের একটা চমকপ্রদ সংজ্ঞা দিয়েছিলেন, ‘Puritanism: The haunting fear that someone, somewhere might be happy., অর্থাৎ পিউরিটানিজম হচ্ছে সেই দুর্বার , দুঃস্বপ্ন যে কোথাও , কেউ একজন সম্ভবত সুখে আছে । লেখক এখানে সামন্ততন্ত্রের পর থেকে ইউরোপের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ও কর্মজীবনের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন জীবন সম্পর্কে একটা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস কীভাবে প্রায় গোটা বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অসুস্থ্, অর্থহীন ক্ষতিকর একটা কর্মব্যবস্থা একঘেয়ে গোঁয়ারের মত টেনে নিয়ে যাচ্ছে । শিল্পবিপ্লবের পরে যে উৎপাদন ব্যবস্থা যে কর্মব্যবস্থা এখন মোটামুটি পুরো উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রথমদিকের নকশাকারীরা প্রায় সবাই ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী , আরেকটু সঠিকভাবে ধর্মতাত্ত্বিক বিশ্বাসে ক্যালভিনিস্ট খ্রিস্টান । সেই ধর্মীয় কল্পকাহিনির প্রথম পুরুষ আদম ও ইভকে তাদের অবাধ্যতার জন্য, সীমাতিক্রমণের জন্য স্বর্গের কাজহীন আনন্দময় জীবন থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল । তাদের শাস্তি ছিল খেটে খেতে হবে । সেই আদিগল্পের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে পিউরিটানদেরও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস হচ্ছে কাজ আসলে আনন্দের কিছু তো নয়ই এমনকি মৌলিকভাবে জীবিকা অর্জনের উপায়ও নয় । কাজ মূলত পাপের প্রায়ঃশ্চিত্ত । তাই কাজ করতে হবে ঐভাবেই যাতে এটা কোনোভাবেই উপভোগ্য কিছু না হয়ে উঠে । সামন্ততন্ত্রের ভাঙন থেকে শুরু করে শিল্প বিপ্লবের সময়কার বড় বড় দার্শনিক, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত যেই কার্লাইল তাদের লেখা প্রবন্ধ থেকে স্পষ্টভাবেই উঠে আসে এই আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে কেন্দ্রে রেখে তারা কীভাবে কাজকে সংজ্ঞায়িত করছেন, কেমন কর্মজীবনের উপদেশ দিচ্ছেন সাধারণের জন্য । কয়েক শতাব্দী ধরে এইসব আধ্যাত্মিকতায়, সাধারণের জীবন কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে এসব বিশ্বাস নিয়ে গড়ে উঠা আমাদের নতুন সামন্তপ্রভুরাও এই ব্যবস্থাকেই ধরে নিয়েছেন জন্মমৃত্যুজরার মতো অপরিবর্তনীয় অমোঘ প্রাকৃতিক সত্য হিসাবে । সবচেয়ে হতাশাপ্রদ সবচেয়ে ক্রোধ-উদ্রেককর ব্যাপার হচ্ছে শত শত বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদের গোটা জীবন ব্যয় করে দেওয়া কাজের ফলাফলে যেই প্রযুক্তির ইউটোপিয়া এক শতাব্দী আগের মানুষ ভেবে গেছে সেই ইউটোপিয়াতে পৌঁছে গিয়েও উদ্ভট কিছু কুসংস্কারের কারণে কোটি কোটি মানুষকে ভুগতে হচ্ছে । ব্যাপারটা এমন যে ঘরে পর্যাপ্ত খাবার থাকার কারণেও ঘাস লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করছি গোটা বিশ্ব মিলে ।

কাজকে আনন্দ অথবা জীবিকা অর্জনের উপায় হিসাবে না দেখে যন্ত্রণা ভোগের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক পাপক্ষয়ের উপায় হিসাবে দেখার কারণে আরেকটি উদ্ভট অশ্লীল প্রবণতা দেখা যায় কর্মজীবন নিয়ে উন্নত বিশ্বে । এইসব দুনিয়ায় যখনই অপচয় রোধ করার জন্য বা কর্মদক্ষতা বাড়ানর জন্য কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় তার প্রথম আঘাতটি আসে এমন সব কাজের জন্য যেগুলোর নির্দিষ্ট অর্থ ও উপযোগ আছে, যেগুলো থেকে ব্যক্তির আত্মতৃপ্তি অর্জনের পথ রয়েছে । সরকারি ক্ষেত্রে ব্যয়-সংকোচন মানে হচ্ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষকের বেতন কমাও, নার্স, ক্লিনারদের বেতন কমাও, ছাঁটাই কর । আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মেশিন অপারেটরের , সত্যিকারের হাত পা শরীর ব্যবহার করে উৎপাদন পরিচালনা করা শ্রমিকের বেতনভুক্ত ঘণ্টা কমাও, ছাঁটাই কর । সচেতনে বলতে না চাইলেও অবচেতনে যেন এই বার্তাই দেওয়া হচ্ছে যে তোমাদের কাজের অর্থ আছে, কাজ থেকে তোমরা যেহেতু জীবনবোধ পাচ্ছ, আত্মমর্যাদার বোধ পাচ্ছ সেহেতু তোমাদের কাজের বেতন এসবের মাধ্যমেই অনেকটা অংশ দেওয়া গেছে । টাকা কম দেওয়াই দরকার তোমাদের । অথচ কাতারে কাতারে বুলশিট জব , মিডল-ম্যানেজার আর সারাদিন বুলশিটে নিয়োজিত আপার-ম্যানেজারদের বেতন বাড়াও । তারা যেহেতু অর্থহীন কাজে সময় ও মানসিক শ্রম দিয়ে যন্ত্রণার নরকে আছে, তাই তাদের পাপের-প্রায়ঃশ্চিত্ত ভালোভাবে করার জন্য তাদের আরো বেশি টাকা দাও । লেখকের এই ব্যাখ্যা যদিও আমাদের সাধারণ চিন্তায় বেশ অতিকল্পনার মতো মনে হয়, কিন্তু অন্তর্বর্তী কারণ যা-ই হোক ঘটনা তো সত্য । ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হত উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে যেসব কাজ কীভাবে করতে হবে সেটা যতটা স্পষ্ট সেসব কাজে বেতন তত কম । আর যেসব কাজে সারাদিন উদ্ভট মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হয় যে আমার কাজ কী, আমার উদ্দেশ্য কী, আমাকে রাখার উদ্দেশ্য কী, নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজন বুঝানোর চেষ্টায় সারাদিন বুলশিটে ডুবে থাকতে হয় সেগুলোতে বেতন তত বেশি । সত্যিকারের সত্য হয়তো আমাদের আধুনিক সামন্তপ্রভুরাও জানেন না ।

বইয়ের বর্ণনা-পরিক্রমের উল্টোতে হলেও , ব্যক্তির উপর , সমাজের উপর বুলশিট জব এবং অর্থবহ কাজের বুলশিটাইজেশনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি এখন সম্ভবত ব্যাখ্যা করা কিছুটা সহজতর । এই প্রভাবগুলোকে লেখক নাম দিয়েছেন কর্মজীবীর উপর চালানো স্পিরিটুয়াল ভায়োলেন্স(Spiritual violence) বা আত্মিক সহিংসতা । শুনতে অতিরঞ্জন মনে হলেও আমার মতো লাখে লাখে ভুক্তভোগীর কাছে ব্যাপারটি মোটেই অতিকথন বা দূরকথন নেই । ব্যাপার হচ্ছে , বৃহত্তর অর্থে যেকোন চেতনাশীল জীবন-রূপের জন্য, লেখকের ব্যাখ্যার সীমিত-পরিসরে মানুষের জন্য নিজের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার সবচেয়ে বড়ো সবচেয়ে মৌলিক উপায় হচ্ছে চারপাশের পরিবেশের উপর নিজের কৃতকর্মের প্রভাব দেখা ও পরিকল্পনামাফিক প্রতিবেশকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা । মানব-শিশু ছোটোবেলা থেকে এই খেলার মাধ্যমে নিজের জীবনের রুহানি অস্তিত্বকে অনুধাবন করে । অকারণে চিৎকার দিয়ে বাবামার মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে নিজের কাজ দিয়ে অন্যের অবস্থান পরিবর্তন থেকে শুরু করে লতাপাতাঘাস খেলনা আর নিত্যব্যবহার্য হাবিজাবি দিয়ে কিছু একটা তৈরি করা, নিজের ক্ষমতা দিয়ে কিছু একটা করতে পারার মাধ্যমে সে যে ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের আস্বাদ পায় সেটাই তাকে বুঝায় পৃথিবীতে সে একেবারে অর্থহীন, মূল্যহীন প্রভাবহীন কিছু নয় । এই চিন্তা বড়ো হতে হতে খেলা থেকে প্রশিক্ষণে, প্রশিক্ষণ থেকে কর্মজীবনে তার আত্মিক উপলব্ধির সবচেয়ে বড়ো অনুষঙ্গ, সবচেয়ে মৌলিক বোধ হিসাবে কাজ করে । যে ভালো কাজে ব্যবহার করতে চায় প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে নিয়ন্ত্রণের এই ক্ষমতা সে ভালো দিকে যায়, সমাজের উন্নতি করতে চায়, আশেপাশের মানুষদের উন্নতি করতে চায়, যে খারাপ করতে চায় সে খারাপ দিকে পরিবর্তন করতে চায়, ধর্ষকামী আনন্দ লাভ করতে চায় । দুইদিকের ফলাফল ভিন্ন হলেও মৌলিক চিন্তাস্রোতটি একই । অস্তিত্বের একটা আস্বাদন, দয়ামায়ামোহাগ্রহহীন পরিবেশের সাথে একটা অর্থবহ কথোপকথন । বুলশিট জবগুলো কর্মজীবীদের অস্তিত্বের একেবারে সেই মূলে আঘাত করে । আধুনিক মানুষের জাগ্রত জীবনের সবচেয়ে বড়ো সময়টা যে কাটে কর্মক্ষেত্রে , সেই সবচেয়ে বড়ো সময় জুড়ে তাকে ক্ষমতাহীন, প্রভাবহীন জড়বস্তু করে রাখা হয় । কেউ কেউ হয়তো এই জড়বস্তু হয়ে থাকার পরেও এর ফলে প্রাপ্ত আয় দিয়ে নিজের পরিবার ও স্বজনদের জীবিকা ও সুখে ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কিছুটা ভুলে থাকতে পারে প্রভাবহীনতা তথা গভীরে অস্তিত্বহীনতার যন্ত্রণা । কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছুদিনের মধ্যেই ঐটুকু প্রলেপেও কাজ হয় না । মানুষ ক্ষয়ে যেতে থাকে ভিতর থেকে । আক্ষরিক অর্থেই । জেলখানার কয়েদিদের দীর্ঘদিন সলিটারি কনফাইনমেন্টে রাখার পরে দেখা যায় তাদের মস্তিষ্কের একটা অংশ ধীরে ধীরে মরা শুরু করেছে । অথচ বর্বর অর্থনীতিবিদের মতে সলিটারি কনফাইনমেন্ট তথা কাজ নাই শাস্তি নাই কিন্তু নিশ্চিত জীবিকা আছে এই অবস্থা হওয়ার কথা ছিলো হোমো ইকনোমিকাসের অর্থনৈতিক স্বর্গের একটা সীমিতরূপ । আর কত জায়গা থেকে বিরুদ্ধ প্রমাণ পাওয়ার পরে হোমো ইকোনোমিকাসের অশ্লীল ধারণা থেকে অর্থনীতি সরে আসবে !

বুলশিট জবের এই আত্মিক সহিংসতার প্রভাব ব্যক্তিভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকে বলে লেখক মনে করেন । কিছু কিছু লোকের কনফেশন থেকে লেখক মনে করেন সাধারণত যারা ছোট থেকে অন্যের শ্রমের উপার্জনের উপর লুঠপাঠ-স্বত্বভোগের মাধ্যমে বড়ো হয় তাদের ক্ষেত্রে কিছু না করে মোটা অংকের বেতন নেওয়াটা অতখানি বড়ো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না বা কেউ কেউ এই অবস্থাকে একটা ধাপ হিসাবে ব্যবহার করে আরেকটু উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে । কিন্তু যারা ছোটকাল থেকে কর্মজীবী পরিবারে, পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেদের জীবিকা অর্জন করে নেওয়ার পরিবেশে বড়ো হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বুলশিট জবের আধ্যাত্মিক সহিংসতা প্রভাব ফেলে বেশি । গভীরতর কারণের সন্ধানে লেখক বেশিদূর আগাননি । উপরিতলে হয়তো এ ধরনের অবস্থান তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের নৈতিকতার বিরোধী বলে বুলশিট জবে তাদের অস্বস্তি ও মনোযন্ত্রণা হয় । সেটা সত্য, কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় কারণটি আরো গভীর । দারিদ্র্য ও পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে নিজের মূল্য অর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বড়ো হওয়া আমার মত লাখে লাখে ভুক্তভোগীর কাছে বুলশিট জব মূলত আমাদের জীবন-বীক্ষার মূলে আঘাত । পৃথিবী যেভাবে কাজ করে বলে আমরা ছোটোবেলা থেকে জেনে এসেছি, যেভাবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে হয়, জীবন ও জগতের কার্যপদ্ধতি নিয়ে যে মডেল আমরা আত্মস্থ করে নিয়েছি সেটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এই ধরনের চাকরির মধ্যে কিছুদিন থাকলে । কোন সময়ে নিজেকে প্রতারক, বাটপার, লুটেরা বলে মনে হতে থাকে । আবার জীবন ও দুনিয়ার নিজস্ব মডেল অনুযায়ী যেহেতু পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের জীবিকা উপার্জন করে নিতে হয়, সেহেতু বিনা কাজে মোটা অংকের বেতন আমাদের ক্রমাগত অস্বস্তি ও যন্ত্রণার মধ্যে রাখে । মনে হতে থাকে গোটা ব্যাপারটাই একটা নির্দয় উপহাস আমাদের উপর । যে কোনো একদিন, যে কোনো ক্ষণে হয়তো ঘাড় ধরে বের করে দিয়ে বলবে দুইন্যা এত রঙ্গলীলার জায়গা নয় রে নির্বোধ । এই উপহাসের পাত্র হওয়ার অমোঘ, অটুট ভয় জীবনের অন্য কোন কিছুতেও একটা মূহুর্তের জন্য শান্তি দেয় না । কাজের মধ্যে শুরু হওয়া এই যন্ত্রণা কাজের বাইরেও ভয়াবহ অস্তিরতার তৈরি করে । তাই একটু গভীরে ভেবে দেখলে ‘আত্মিক সহিংসতা’ আসলে অতিকথন না বরং বড়ো যন্ত্রণাকে ছোটো করে দেখান বলে মনে হবে ।

বুলশিট জবের চাইতে সাধারণ অর্থবহ চাকরীর বুলশিটাইজেশনকে আমার কাছে আরো বেশি ক্ষতিকর আরো বেশি ভয়াবহ মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে , এই ক্ষেত্রে বুলশিট জবের যে আত্মিক সহিংসতা ও যন্ত্রণা তার পুরোটাই ভোগ করার পাশাপাশি আরো নতুন কিছু অত্যাচার, নতুন কিছু যন্ত্রণা যোগ হয় এখানে । গড়পড়তা বুলশিট জবের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মজীবীকে মোটামুটি নিজের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় । উদ্দেশ্যই যেহেতু এখানে একটা লোক নিয়োজিত আছে সেটা দেখান সেহেতু তার কাজ যে কীভাবে করছে , কী করছে এগুলো না ঘাঁটানোই ভালো উপরস্থদের জন্য । বরং কোনো কাজ দিতে গেলেই উল্টো ঝামেলা বাঁধার সম্ভাবনা থাকে । কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যে কাজ , যেখানে সত্যিকারের কাজ , অর্থবহ কাজ একটা অংশ থাকে , মোট ব্যয়কৃত সময়ের পাঁচ থেকে দশ পার্সেন্টের মতো, আর বাকি নব্বই-পঁচানব্বই ভাগ সময় ব্যয় হয় উটকো ঝামেলাতে । এই অঢেল বুলশিট সময় উপরস্থ আর অধীনস্থের মধ্যে একধরনে ধর্ষ-মর্ষকামী সম্পর্ক তৈরি করে । উপরস্থও তার পিউরিটান ধারণার কারণে মনে করে নব্বই-পঁচানব্বইভাগ সময় কিছু না করে ঘুরাঘুরি করলে বা কোথাও বসে নিজস্ব কোনো কৌতূহলের চর্চায় সময় কাটালে ব্যাপারটি অফিসের মোরালে সমস্যা তৈরি করবে । তাই এই সময়টাতে এমন কিছু কাজ দেওয়া হয় যেগুলোর আসলে কোন সঠিক আকার নাই, লক্ষ্য নাই, উত্তর নাই । ফলে এগুলো কোনদিন মাথার উপর থেকে সরেও যায় না । নিজের দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য কী করা যাবে সে সম্পর্কে আইডিয়া প্রেজেন্টেশন বানাও, অফিসের উন্নতির জন্য কী করা যে সম্পর্কে ধারণা দাও, জটিল যে সমস্যার কোনো সমাধান সম্ভব নয় অন্তত আইনিস্টাইন-নিউটনের মিলিত ব্রেনের চাইতে কম ব্রেনপাওয়ারের কারো জন্য , সেগুলোর জন্য সমাধান প্রস্তাবনা কর ; অর্থাৎ ধীরভাবে বসে যন্ত্র-সভ্যতার উন্নতির সুফল যাতে বিন্দুমাত্র সময়ের জন্য উপভোগ না করা যায় সেই ব্যবস্থা । বুলশিট জবের আত্মিক সহিংসতার গোদের উপর এভারেস্ট সাইজের নির্যাতনের বিষফোঁড়া । এই নির্যাতন বুলশিটাইজড জবে কর্মরত কর্মজীবীর থেকে ধীরে ধীরে সৃজনশীলতা শুষে নেয়, আর ড্রেইন করে ফলে উইলপাওয়ার বা আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি । ক্রমাগত নির্যাতনের ভিতরে থাকার ফলে অস্থিরতায় যেটুকু অর্থবহ কাজের সময় আসে সেটুকুতেও মনোনিবেশ করা যায় না ঠিক মতো । ভুল হয়, উদ্ভট দুর্ঘটনা ঘটে । কর্মজীবনের বাইরে যেসব সুকুমার বৃত্তির চর্চা করতে পারতাম সেগুলো থেকেও ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকি । আপাতভাবে অনেকখানি কাজবিহীন সময় থাকার কারণে সৃষ্টিশীলতা ও সৃষ্টিশীল ভাবনার জন্য সুবিধা হবে মনে হলেও, লেখকের কাছে জমা হওয়া কয়েকটি কনফেশনে এবং নিজের উদাহরণেও বুঝেছি ঘটে আসলে উল্টো । অন্যদিক ক্রমাগত নিজেকে ব্যস্ত ও প্রয়োজনীয় মনে করানোর চেষ্টায় যে উইলপাওয়ার বা আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি ব্যয় হয় সেটা কাজের বাইরের জীবনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে । এই ব্যাপারটিও লেখক তার বইয়ে আলোচনা করেননি কিন্তু মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা থেকে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি সীমিত । এক ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করলে অন্যক্ষেত্রে ঝামেলা তৈরি হয় । উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে জুয়ায় আসক্তি, মদে আসক্তি , খাদ্যাভ্যাসের অসুস্থতা, জীবনাচারণের অনিয়মের মহামারীর পিছনে এই উইলপাওয়ার ড্রেইন হয়ে যাবার বিষয়টি জড়িত বলে মনে । কাজের বুলশিটাইজেশনের কারণে কর্মেক্ষেত্রেই গাঁটের সবটুকু আত্মনিয়ন্ত্রণশক্তি ব্যয় হয়ে যায় । ফলে পরিমিত ও সুস্থ্ জীবনাচারণের অভ্যাস করার জন্য প্রয়োজনীয় ইচ্ছাশক্তি আর থাকে না । ফলে খাবারে অনাচার, ঘুমে অনাচারে, পানে অনাচার, টাকা ব্যায়ে অনাচার ।

এখন সর্বশেষে যে ন্যায্য প্রশ্ন থেকে যায় তা হচ্ছে এই থেকে মুক্তির উপায় কী ? লেখক নিজে রাজনৈতিক বিশ্বাসে নৈরাজ্যবাদী ও বামপন্থী বলে খুব সচেতনভাবেই সমাধান প্রচেষ্টার ব্যাপারটি যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া যায় সে চেষ্টা করেছেন । কারণ তিনি জানেন তার বিশ্লেষণকে অস্বীকার করা না গেলেও, সমাধান প্রস্তাবনাকে আমাদের নতুন সামন্তপ্রভুরা ‘নৈরাজ্যবাদী’ এই এক শব্দেই উড়িয়ে দিবে । ফলস্বরুপ উল্টো তার বিশ্লেষণকেও গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হবে না । তবে একেবারে পুরোপুরি হতাশার সাগর দিয়ে লেখক বই শেষ করেননি । লেখক ঠিক সমাধান নয়, তবে আশার আলো দেখিয়েছেন যন্ত্রায়ণের আরো প্রভুত উন্নতি ও তার ফলে আজ হোক কিছু বছর পরে হোক যা অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠবে, ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম বা সার্বজনীন মৌলিক আয়ের ধারণা নিয়ে । এভাবে আগে হয়তো তেমন কেউ ভেবে দেখেনি তবে সমাজের সবাইকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিনা শর্তে যদি দেয়া হয় অর্থাৎ গভীরতর অর্থে জীবিকা অর্জনের জন্য সবরকমের আত্মিক-সন্ত্রাস, সবরকমের বুলশিটাইজেশন , সবরকমের নির্যাতন সহ্য করে কাজ করে যেতে বাধ্য হতে হবে না , এমন অবস্থা যদি তৈরি করা যায় তাহলে এগুলোরে লাগাম টেনে ধরা সম্ভবত সম্ভব হবে । ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের ক্ষেত্রে সামন্তপ্রভুদের কাছ থেকে সব বড়ো দুইটা অভিযোগ, এত টাকা আসবে কোথা থেকে, আর পেটের দায় না থাকলে কেউ কাজ করবে না সবাই মদ খেয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকবে এই দুইটা আসলে একেবারেই ভিত্তিহীন । এটা লেখক যেমন বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন তেমনি এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা সিস্টেমগুলো থেকেও সেই চিত্রই উঠে এসেছে । প্রথমত এত টাকা বা তার চাইতেও বেশি টাকা সরকারগুলো এরই মধ্যে ব্যয় করছে । পার্থক্য হচ্ছে এখনকার ব্যবস্থায় এইসব টাকা মূলত বিভিন্ন বুলশিট জব আর বুলশিট ইন্ড্রাস্টি মিলে লুট করে নিচ্ছে । দ্বিতীয়ত যেসব সামন্তপ্রভুরা বলছে পেটের দায় না থাকলে কেউ কাজ করবে না , তারা নিজেরা যে চৌদ্দগোষ্ঠীর পেটের দায় না থাকার পরেও দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রতিযোগীতা করে যাচ্ছে টাকা আরো বাড়ানোর জন্য আরো উন্নতি করার জন্য তারা তো কোন ভিনগ্রহের এলিয়েন নয় । তারা যদি পেটের চিন্তার বাইরে থেকেও কাজ করতে পারে তাহলে একই মস্তিষ্ক, একই শরীরের সাধারণ মানুষ কেন করবে না । অবশ্যই কিছু কিছু মানুষ যে এমন করবে না তা নয় । কিন্তু সেটা কি বর্তমানের সমাজেই বিশাল একটা অংশ করছে না ? যেসব জায়গায় পরীক্ষা চালানো হয়েছে সেখান থেকেও একই ফলাফল উঠে আসছে । ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম পেয়ে কেউ কাজ বন্ধ করে দেয়নি । বরং আরো উন্নতি জন্য, নিজেদের দক্ষতার উন্নতির জন্য সোপান হিসাবেই ব্যবহার করা হয়েছে এই বেসিক ইনকাম । এই চিত্রই পাওয়া গেছে সব জায়গায় । আমার নিজের কাছেও মনে হয় সৃষ্টিশীলতার উৎকর্ষের জন্য মানুষকে জীবিকার অনন্ত ইঁদুর-বিড়াল দৌড় থেকে মুক্তি দেওয়াই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা । ইউরোপের রেঁনেসা বা মুসলিম স্বর্ণযুগের বড়ো কৌশলীদের জীবন ইতিহাস দেখলে এটা স্পষ্টই বুঝা যায় । আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করা ইউরোপের আলোকায়ণ যুগের বড়ো বড়ো বিজ্ঞানী বড়ো বড়ো চিন্তকদের বেশিরভাগই ছিলেন এমন একটা শ্রেণীর সদস্য যাদের জীবিকার জন্য কোন কাজের দরকার ছিল না । তারাই অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের আজকের যন্ত্র-ইউটোপিয়ার যুগের শুরু করে দিয়ে গেছেন । একে মহাবৈশ্বিক ইউটোপিয়াতে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের যুগেও দরকার ঐরকম একটা বিশাল বড় মানব-গোষ্ঠী । হয়তো আজকের বিশ্বের যেসব সমস্যা নিয়ে আমরা পুরো মানবজাতির অস্তিত্বের ভবিষ্যত নিয়ে সন্দিহান , সেগুলোর চমৎকার সব সমাধান বের হয়ে আসবে ইঁদুর-বিড়ালদৌড় থেকে মুক্তি পাওয়াদের মাধ্যমেই ।

Leave a Comment