খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধ

বাণী বসুর চোখে দেখা মহাভারত

লিখেছেনঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল

দীপাঞ্জনা মণ্ডল

মহাকাব্য স্থান-কাল ও চরিত্রের বিরাট ব্যাপ্ত পরিসর জুড়ে থাকে। এর ফলে কবির উপলব্ধিজাত দর্শন উপস্থাপনের যে উদ্দেশ্যমূলকতা তা ঘটনার সজ্জা ও ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব যতটা দেয়, মানবমনের সূক্ষ্ম গতিধারার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ততটা নয়। মহাকাব্যে ঘটনা মুখ্য, চরিত্র গৌণ। ঘটনার প্রয়োজনে চরিত্রের বিন্যাস। ফলে আধুনিক মন যা এই দর্শন ও কাহিনির ভেতরের মানবিক চরিত্রায়ণের যাথার্থ্যের অভিলাষী, তা মহাকব্যের ঘটনার পারম্পর্যের মধ্যে চরিত্রায়ণের পারম্পর্যকেও খুঁজে পেতে চায়। বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, যিনি প্রকৃতঅর্থেই আধুনিকতার সাক্ষরবাহী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধের অনুশীলন করেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে, তিনি রামায়ণের মূল রাজনৈতিক অভিমুখের রূপান্তর ঘটালেন তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ। বাংলা সাহিত্য প্রথম মহাকাব্যের প্রতিনায়ককে নায়কের ভূমিকায় পেল সেখানে। তারপরে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় মহাকাব্যের নবনির্মাণ ঘটেছে, ঘটছে। কোথাও সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে মহাকাব্যিক দর্শনের প্রয়াসকে, তো কোথাও নতুনতর ব্যাখ্যায় উপস্থাপিত হয়েছে মহাকাব্যের কোনও পরিণতি।

এই ২০১৭-এর ‘শারদীয়া বর্তমান’ ও ‘শারদীয়া সংবাদ প্রতিদিন’ আখ্যানের শেষে যখন বাণী বসুর মতো অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিক ঘোষণা করেন,

এই উপন্যাস আসলে একটি বৃহত্তর উপন্যাসের পঞ্চম পর্ব। স্বয়ংসম্পূর্ণই। তবু কিছু জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। যার উত্তর পাঠক এই পর্বগুলিতে পাবেন। ১ম পর্ব : কালিন্দী, ২য় : কৃষ্ণ, ৩য় : ক্ষত্তা, ৪র্থ : ক্ষত্রবধূ, ৫ম : সুযোধন দুর্যোধন, ৬ষ্ঠ : পাঞ্চালকন্যা কৃষ্ণা।

শেষোক্ত দুটি এ বছর প্রকাশিত।

তখন সজাগ সন্ধানী পাঠক ছাড়াও কৌতূহলের বশবর্তী হয়েও বাণী বসুর পাঠক অন্য উপন্যাসগুলির স্বাদ নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যদিও যারা নিয়মিত খোঁজ রাখছেন তারা ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ২০১৫-তে আর এর পরে ২০১৬-এর পূর্বোক্ত দুটি শারদীয়ার অভিজ্ঞতায় অপেক্ষা করেই আছেন বাণী বসুর লেখনীতে আবার মহাভারতের কোনও চরিত্রের হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষদর্শী হতে। সেখানে এই তৃতীয় বছরে লেখিকার নিজের বক্তব্য পাঠককে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, খুব পরিকল্পিত ভাবেই ঔপন্যাসিক মহাভারতের চরিত্রদের নবনির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। এ কথাও পাঠক অনুধাবন করে ফেলেন যে কয়েকটি চরিত্রের বিচ্ছিন্ন রূপায়ণ নয়, আসলে কয়েকটি চরিত্রকে অস্ত্র করে মহাভারত নামক বিপুল আকরের ভিতরে ঢুকে তার থেকে নিজের জীবনবোধের উপকরণ তুলে আনতে চান তিনি।

বাণী বসু

মহাকব্যিক পরিসরের মধ্যে ঘটনার ঘনঘটার ওপরে ভাসিয়ে আনতে চান খড়কুটো আশ্রয় করে ভেসে চলা মানবজীবনকে। সেখানে কোথায় এক স্বাবলম্বী প্রকৃতিকন্যা, কোথায় এক সুযোগ্য রাজকুমার, কোথায় রাজনীতির ঘুঁটি হয়ে যাওয়া রাজপুত্রীরা, আর কোথায় বা এক সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিয়ে চির অতৃপ্তিতে ছারখার হতে থাকা রাজপুত্র – সকলেই কোনও না কোনও ভাবে পরিস্থিতির স্বীকার। একমাত্র স্থিত হয়ে নিজের অবস্থান স্বীকার করে আপাত নির্লিপ্ত সাধারণ নিয়ন্ত্রিত জীবন কাটিয়েছেন ক্ষত্তা ধৃতবীর্য বিদূর। নচেৎ ঘটনাপ্রবাহের তালে তাল মিলিয়ে না চলতে পেরে কখনও অহমিকার তোড়ে ভেসে, কখনও মহত্ত্ব বা দৃষ্টান্ত তৈরি করতে গিয়ে জীবনের মাধুর্যকে বলি দিয়েছেন মহাকাব্যের চরিত্রেরা। আসলে তাদের মহাকাব্যিক হয়ে ওঠার পিছনে কাজ করে চলেছে এই আলাদা হয়ে ওঠবার চেষ্টা, এক দুর্বলতা যা প্রকৃতপ্রস্তাবে। মানুষীদুর্বলতাতেই  তাঁরা সাধারণকে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসী। সাধারণত্বকে মহৎ করে তুলবার স্পর্ধা তাঁদের কারোর-ই নেই।

লেখিকার উল্লিখিত ক্রম অনুযায়ী তাঁর পরিকল্পিত বৃহৎ উপন্যাসের প্রথম পর্ব ‘কালিন্দী’। না, এ কালিন্দী রাধা-কৃষ্ণের নর্মভূমি যমুনার অন্য নামের অনুষঙ্গী নয়। যমুনার তীরে বড় হয়ে ওঠা এক অ-শ্বেত মেয়ের নাম। এ নামকরণ লেখিকার। মনুষ্যসমাজে নবাগতের নামকরণে যে স্বাভাবিক যুক্তি কাজ করে তাদের মাধ্যমেই এ নাম নির্বাচন করেছেন তিনি। প্রথমত, কালিন্দীতীরবর্তী জেলেপাড়ার মেয়ে, দ্বিতীয়ত গায়ের রং তার কালো হলেও নদীর মতোই পরমা সে আর মহাকাব্য অনুসারে ওই নদী-ই তার উৎস। উপরিচর রাজার বীর্য ওই নদীর মাছ খেয়ে ফেলে ও এক মেয়ের জন্ম দেয়, যাকে বড় করে জেলে পাড়ার নিঃসন্তান সর্দার ও তার স্ত্রী। এ যুগের যুক্তিতে এ গল্পের মানে খুঁজতে গিয়ে ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন, জেলে পাড়ার তুলনামূলক শিথিল জীবনে কোনও এক ক্ষত্রিয় পুরুষের কামনার শিকার সর্দারনীর গর্ভে যে শিশুর আগমন তা বৈধ করতে এমন গল্পের আবরণ-সন্ধান। মহাভারতের বিরাট সব ঘটনার পিছনে অনেক সময়েই এরকম অবৈধ সন্তান উৎপাদনের ঘটনা আছে। যেখানে শাস্ত্রের মোড়কে তাদের বৈধতা দেওয়া গেছে সেখানে সরাসরি তার উল্লেখ থাকলেও, যেখানে শাস্ত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনও নিদান সেখানে মহাকবি এরকম রূপকের আড়াল নিয়েছেন, ভবিষ্যৎ পাঠক তাদের যুক্তিবোধ দিয়ে রহস্য উদঘাটন করে নেবে এই হয়তো ছিল তাঁর অভিপ্রায়। অতীতের আখ্যানকারের সেই অভিপ্রায়কেই রূপায়িত করতে চেয়েছেন আজকের আখ্যানকার তাঁর এই বৃহৎ উপন্যাস পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে।

নদীর কুলে পাওয়া কালো মেয়ের নাম কালিন্দী। যে নামে মহাকাব্য তাঁকে কখনও ডাকেনি। ক্ষত্রিয়ের জাতিকাকে মেনে নিলেও জেলে পাড়ার সর্দার কিন্তু ক্ষত্রিয় ও অন্ত্যজের স্বভাববিরুদ্ধতাকে ভোলেনি। আর ভোলেনি বলেই বৃদ্ধ রাজা শান্তনুর উত্তরাধিকারে স্থায়ী করে দিতে চেয়েছে জেলে পাড়াকে। যা হওয়া স্বাভাবিক ছিল শান্তনুপুত্র দেবব্রতের মহত্বের আকাঙ্খা তাতে বাধ সেধেছে। যে মেয়ে তার স্ত্রী হলে মানাত সে হয়েছে তার পিতার দ্বিতীয়া স্ত্রী। এই অসংগতি কুরু বংশকে ভেতর থেকেই ফাঁপা করে তুলেছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি পদ্ধতি দিয়ে আজকের ঔপন্যাসিক বুঝতে চেয়েছেন শান্তনুর প্রথমা স্ত্রী গঙ্গা ও শাপভ্রষ্ট অষ্টবসুর প্রচলিত কাহিনিকে। দেবী গঙ্গা তাঁর যুক্তিক্রমে পার্বত্য কন্যা, যিনি দুর্বলবীর্য শান্তনুর মৃত সন্তানদের নদীতে ভাসিয়েছেন একে একে। আর সবল-সুস্থ অষ্টম সন্তান দেবব্রতকে করে তুলেছেন কুরুকুলের যোগ্য রক্ষক। সত্যিই তো, অভিশাপের ঘটনা শোনালেও একথা মানতে কি মন চায় কখনও যে মা হত্যা করছেন তাঁর সদ্যজাত সন্তানদের একের পরে এক! বাণী বসু এরকম অতি-অসম্ভবদের ছেদ করে, উপন্যাসের যা বর্ণনীয় সেই হলেও হতে পারত বাস্তবকে পুনর্নির্মাণ করেছেন তাঁর আখ্যানে।

   শান্তনুর দুর্বলস্বাস্থ্যের উত্তরাধিকারেই চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের জন্ম, কারণ সক্ষম যুবতী কালিন্দী কন্যাকালেই জন্ম দিয়েছে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের যে সুরূপ না হলেও দৈহিক ও মস্তিস্কের সামর্থ্যে অতুলনীয়। যথাক্রমে দ্বিতীয় আর প্রথম রিপুর প্রকোপে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু কুরুকুলকে নির্বংশ করে। হ্যাঁ, লেখিকা চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন কুরুকুলের নামে এর পরে যে বংশ বাহিত হবে তা আসলে কালিন্দী সত্যবতীর কানীন সন্তান মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাসের বংশ। ফলত সমগ্র মহাভারতের কুলের উত্তরাধিকার রক্ষা ও ক্ষয়ের যে বিবরণ ধারণে আমরা অভ্যস্ত তা আমূল নাড়া খায়। পাঠক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ভাবতে বাধ্য হন যে কুরুকুলের ধ্বংসের বীজ ঠিক কবে কোন সময়ে প্রোথিত হল আর কবে ঘটল কুরুক্ষেত্র! যা জানা দিয়ে চলছিল আর আজ যা স্পষ্ট করে দেখালেন ঔপন্যাসিক সেই দুই সময় দুই স্থান আর তাদের পাত্রপাত্রীরা যে একেবারেই আলাদা।

‘কালিন্দী’ আর ‘কৃষ্ণ’ এই দুই পর্বে বোঝা গেল কুরুবংশ আসলে এক অন্ত্যজ কন্যা আর তার কানীন সন্তানের উত্তরপুরুষদের আধারে বাহিত হতে থাকল। যে দেবব্রতকে মহাভারত চিনিয়েছিল কুরুবংশের রক্ষকরূপে, অন্তত বাণী বসুর পাঠকের সে বিশ্বাস টিকল না। সে পাঠকের মনে গেঁড়ে বসে নিজেকে ত্যাগী ও মহৎ প্রমাণের জন্যই নিজের প্রাথমিক কর্তব্যে কখনও মন দিলেন না দেবব্রত। তাঁর ত্যাগ আসলে কুরুবংশকে দ্রুত পতনের দিকে ঠেলে দিল। দুই বৈমাত্র ভায়ের নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুর পরে কি তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে পারতেন না! স্বয়ং সত্যবতী তাঁকে সেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

— এতগুলো মানুষের ভালোমন্দের চেয়ে তোমার প্রতিজ্ঞা বড় হল? অল্প বয়সে ঝোঁকের মাথায় আমিও একটা ভুল করেছি, তুমিও একটা ভুল করেছ কুমার। তার মধ্যে কোনও প্রজ্ঞা নেই।

 কিন্তু তিনি নিজের ভীষ্ম-ইমেজ ছেড়ে বেরনোর ঔদার্য দেখাতে পারলেন কই, বন্দী হয়ে রইলেন নিজের সর্বত্যাগী ভাবমূর্তিতে। তাতে দেশের ও দশের যে বিপুল ক্ষয় তার দিকে তিনি যেন চেয়েও দেখলেন না। মানুষ তা সে মহাকাব্যের চরিত্র হলেও আসলে এভাবেই বাঁধা পড়ে যায় নিজের গণ্ডিতে। অতএব ডাক পড়ে ঋষি পরাশরের ঔরসজাত কৃষ্ণের। এক সম্পন্ন গুরুকুলের প্রধানের ক্ষণিক মোহ ও বংশরক্ষার প্রয়োজনে যার জন্ম, পিতার আশ্রয়ে ও নিজের মেধায় তার জন্মে কোনও কলঙ্ক লাগে না। এ নিদর্শ রেখে যায় মহাকাব্য নিজেই, রাখতে বাধ্য হয় তার সংকলকের অস্তিত্বের খাতিরেই। জন্ম যে ভাবেই হোক কর্মে দ্বৈপায়ন কৃষ্ণ স্মরণীয় ও বরণীয়। তাই ভারতবিখ্যাত কুরুবংশে তাঁর নিয়োগে বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে আসে তিন সন্তান। মৃত রাজার দুই বৈধ স্ত্রী জন্ম দেন দুই অক্ষম সন্তানের। আর রাজার এক দাসীর গর্ভে জন্ম নেন ধৃতবীর্য বিদূর। এই ‘ক্ষত্তা’ সর্বাঙ্গসুন্দর ও যোগ্য হয়েও দাসীপুত্র হবার কারণে রাজপুত্রের স্বীকৃতি পায়না। এযাবৎ প্রকাশিত বাণী বসুর ছয়টি পর্বের মধ্যে এই একমাত্র চরিত্র যে জন্মের কারণে বঞ্চিত হয়েও নিজের প্রজ্ঞার গুণে মঙ্গলকারী ইতিবাচকতার অনুগামী হতে পেরেছেন।

‘ক্ষত্তা’ পর্বে আমরা দেখব এক বিচক্ষণ রাজপুরুষের হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। আরও দেখব প্রয়োজনে নিয়ম করে আবার ভাঙে। তাদের নিয়মপালন বাস্তবসংস্পর্শশূন্য ও নিয়মভঙ্গ প্রবৃত্তির অনুসারী। তাই রাজা শান্তনু বিবাহযোগ্য পুত্রের চিরকৌমার্যের বিনিময়ে অন্ত্যজ বিবাহ করেন ও দাসীপুত্র হবার শাস্তিতে সক্ষম যোগ্য বিদূর রাজ্যাধিকার পান না। হীনমন্যতা ও সন্দেহের বিষে জর্জরিত শরীরে শুধু নয় মনেও অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ক্ষমতালোভী হয়ে বাঁচেন। পুরুষত্বহীন পাণ্ডু কেবলই পালিয়ে বেড়ান রাজপুরীর সংস্রব ছেড়ে। মৃগয়া থেকে ফেরেন কিমিন্দম মুনির অভিশাপের কাহিনি নিয়ে। এতদূর যে পাঠক বর্তমান ঔপন্যাসিককে অনুসরণ করেছেন তিনি বোঝেন এ অভিশাপ আসলে রাজা পাণ্ডুর অক্ষমতার একটি আড়াল। রাজ্যভার ধৃতরাষ্ট্রকে দিয়ে অনুগামিনী দুই যুবতী স্ত্রীকে নিয়ে হিমালয়ে ঋষিদের কাছে চলে যান পাণ্ডু। বাণী বসুর আখ্যান বলে এ যাত্রা কোনও অঘটনপটীয়সী ওষুধের সন্ধানে যাত্রা। কিন্তু তাকেও শেষ পর্যন্ত নিয়োগের পথ নিতে হয়। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বাণী বসুর বয়ানে হয়ে ওঠেন বিচক্ষণতা ও সততায় ধর্মস্বরূপ বিদূরের সন্তান। অপুত্রক ভায়ের ক্ষেত্রে পুত্র উৎপাদনের জন্য ভাই-ই প্রশস্ত। সত্যবতী একসময়ে দেবব্রতকেই বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদন করতে বলেছিলেন বলে উল্লেখ করে যান লেখিকা। তাঁর সত্যবতীর বাস্তববোধ এমন সিদ্ধান্তগ্রহণের উপযুক্ত। দেবব্রতকে রাজি না করাতে পেরে বিচিত্রবীর্যের অন্য সহোদর পরাশরপুত্র কৃষ্ণকে নিয়োগের জন্য আহ্বান করা হয়েছিল। অর্থাৎ সেই দিক থেকে ভাবলে পাঠকও বুঝতে পারেন পাণ্ডুর ক্ষেত্রে সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রথম বিদূরকেই স্মরণ করবার কথা। যেহেতু দেবব্রত ধার্তরাষ্ট্রদের রাজপদে দেখতে অনিচ্ছুক ছিলেন তাই তাঁর ও দ্বৈপায়ন কৃষ্ণের সম্মতি ও অনুরোধে বিদূর ও কুন্তির পুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্ম। যেখানে স্পষ্ট করে বললে প্রাকৃত মানুষের জন্য দ্বিধা সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা সেখানে ইঙ্গিতপূর্ণ আড়াল নিয়েছেন মহাকাব্যের কবি। এমনই উপলব্ধি থেকে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ও স্বয়ং ধর্মের অবতাররূপে মহাভারতে চিহ্নিত বিদূরের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন লেখিকা। এখান থেকেই তিনি যুধিষ্ঠিরের প্রতি বিদূরের বিশেষ দৃষ্টি ও স্নেহের উত্তরও খুঁজে নিতে পেরেছেন সন্দেহ নেই।

কুরুকুলের উত্তরাধিকারীদের জন্মের দৈব ঘটনাগুলি প্রত্যেকটিকে আজকের যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন লেখিকা। দেবব্রতর ও তার সহোদরদের জন্ম, বিচিত্রবীর্য-চিত্রাঙ্গদের পরিণতি, পরবর্তী প্রজন্ম ও তাদের উত্তরাধিকারীদের জন্মে যা কিছু ধোঁয়াশা সব কিছু নতুন করে অনুসন্ধান করেছেন লেখিকা। ‘ক্ষত্রবধূ’ পর্বে গান্ধারী, কুন্তী ও মাদ্রীর স্ত্রী ও মা হবার ঘটনাগুলিকে আজকের ব্যাখ্যায় বুঝতে চেয়েছেন লেখিকা। দুর্বল রাজ্যের রাজকুমারী বলে অন্ধ কুরুপুত্রকে স্বামীত্বে মেনে নিতে বাধ্য হন গান্ধারকন্যা, যাকে অনঞ্জনা নাম দিয়েছেন লেখিকা। অর্থাৎ চোখ তার এতই সুন্দর যে তাকে সাজাতে অঞ্জন লাগে না। স্বামীর মতো অন্ধত্ব, স্বেচ্ছায় তিনি বরণ করলেও তা ততোটা সশ্রদ্ধ নয় যতোটা অভিমানে। তাই গোটা মহাকাব্য জুড়ে তিনি কোথাও প্রেমিকা স্ত্রী বা স্নেহময়ী মা নন, যেন সর্বদায় উচ্চ আসনে দূরে উপবিষ্টা এক বিচারকর্ত্রী।

পাণ্ডুর প্রথম সন্তান জন্ম পর্যন্ত কুন্তীর কানীন পুত্রের জন্ম সম্বন্ধে লেখিকার ব্যাখ্যা আমাদের প্রয়োজনে লাগে না। সূর্যের মতো আগুনে রাগী ঋষি দুর্বাসাকেই তিনি কর্ণের পিতা বলে উল্লেখ করেন। ঋষিদের সুন্দরী নারীদের কামনা করার ঘটনা এই একটি মাত্র নয়। পরাশরের ঘটনা অন্তত ‘কালিন্দী’ বা মহাভারতের পাঠকের মনে পড়বে। সুতরাং সেবাপরায়ণা কুন্তীর প্রতি দুর্বাসার সন্তুষ্টির প্রকাশ যে কর্ণ হওয়া খুবই সম্ভব তা মানতে আধুনিক পাঠকের সমস্যা হয়না। এই বৃহত্তর অর্থে সেবা যা কুন্তীর গুণ, তাই দুর্বাসার আশীর্বাদ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে হয়তো মহাকাব্যে। এই আকর্ষক গুণেই হিমালয়ের উচ্চ অংশের বাসিন্দা যাদের সমতলের মানুষ দেবতা বলে, তাদের তুষ্ট করে ভীম ও অর্জুনকে পান কুন্তী। স্মরণ্য ঔপন্যাসিক কিন্তু পার্বত্য কন্যা গঙ্গাতেও একই কারণে দেবীত্ব আরোপ করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। পাণ্ডুর অনুরোধে মাদ্রীকেও অনুরূপে সন্তানধারণের উপায় বাতলে দেন কুন্তী। পাণ্ডুর মৃত্যুর পরে মাদ্রী সহমৃতা হলে কুন্তী ফিরে আসেন হস্তিনাপুরে।

কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ সন্তানের পিতা হবার জন্য অধীর ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের জন্মসংবাদে অস্থির হয়ে পড়েন। এই ধারাবাহিক আখ্যানে আমাদের লেখিকা কেবল গান্ধারীর দুইবছরের গর্ভধারণের কোনও বর্তমান অনুমোদিত ব্যাখ্যা শোনান না। গান্ধারীর আঘাতে তার গর্ভ থেকে নির্গত হয় এক মাংসপিণ্ড। মহাকাব্যের এ কাহিনির আজকের বিস্তার আমরা পাইনি বাণী বসুর কাছে। কিন্তু শতপুত্রের জন্ম সম্পর্কে লেখিকা যে ব্যাখ্যা করেছেন তা যুক্তিযুক্ত। জোর করে সন্তান ভূমিষ্ঠ করতে গিয়ে গান্ধারী হতে পারে গর্ভধারণের ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। তাই দাসীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের বিধান দেন বেদব্যাস। তাতে তাঁর মুখনিঃসৃত গান্ধারীর শতপুত্রবতী হবার আশীর্বাদ আক্ষরিক সত্য হয়ে ওঠে। স্বামীর ঔরসজাত সন্তানদের মায়ের পরিচয় পান গান্ধারী। কিন্তু মা হয়ে ওঠেন না কখনও।

মহাকাব্যের প্রায় সমস্ত অলৌকিক-অতিলৌকিককে যুক্তিগ্রাহ্য একটা ব্যাখ্যায় নিয়ে আসেন লেখিকা। ফলে মহাকাব্যের চরিত্রগুলির যে কার্যকলাপের পরিচয় পাওয়া যায় তার একটা পূর্বেতিহাস তৈরি হয়, চরিত্রগুলি বাণী বসুর লেখনীতে রক্ত-মাংসের হয়ে ওঠে। ক্ষত্তা বিদূরের জীবনে যে অস্বীকৃতি তা বাণী বসুর দেখায় তাঁর সন্তান যুধিষ্ঠিরের নেই। এই পুত্রকে কুরুকুলের সর্বেসর্বা করে তোলাতেই তাই বিদূরের যে স্থিরলক্ষ্য থাকা তাকেও যুক্তিক্রমে বিন্যস্ত করেন লেখিকা। আবার নিজের মধ্যে মাতৃত্বের গৌরব না অনুভব করতে পেরেও শতপুত্ররে জননী হবার যে পরিচিতি তা গান্ধারীকে আরও দূরবর্তী করে। মাতৃস্নেহের অভাব আর পিতার থেকে পাওয়া রাজ্যাধিকারী হবার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা দুর্যোধনকে নির্মাণ করে। ফলত ছলে-বলে-কৌশলে সে পাণ্ডবদের উপেক্ষা আর বঞ্চনা করতে চায়। কিন্তু সামর্থ্যে ও সাহচর্যে পাণ্ডবরা এগিয়ে যায় অবলীলায়। অস্ত্রশিক্ষাতেও পারদর্শীতা প্রকাশ করে তারা পাঞ্চালরাজ দ্রূপদকে হারিয়ে গুরু দ্রোণের গুরুদক্ষিণা মেটায়। সুতরাং দুর্যোধনকে নামতে হয় আরও নিচে। বারাণবতের জতুগৃহে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে পুড়িয়ে মারার বন্দোবস্ত করে সে। হ্যাঁ, অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সম্মতিতেই। বিদূরের বিচক্ষণতায় রক্ষা পায় পাণ্ডবেরা।

এদিকে পাঞ্চালরাজ দ্রূপদ দ্রোণের ওপরে প্রতিশোধ নিতে অর্জুনকে দলে পেতে চায়। তায় তাকে হাতের মুঠোয় আনতে হাতিয়ার করে নিজের কন্যা কৃষ্ণাকে। আর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে তৈরি করে দ্রোণের হন্তারকরূপে। যজ্ঞাগ্নি থেকে পুত্র বা কন্যার জন্ম সম্ভব নয় সে কথা বাণী বসুর পাঠক জানে। তাই লেখিকা এই ঘটনাকে এইভাবে দেখেন,  ধৃষ্টদ্যুম্ন ও কৃষ্ণা দ্রূপদের কোনও অন্ত্যজ স্ত্রীর গর্ভজাত, তাদের সামর্থ্য বুঝতে পেরে রাজা তাদের রাজপুরীতে নিয়ে এসে উপযুক্তভাবে প্রতিপালন করেন নিজের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য। কন্যার স্বয়ম্বর এমনভাবে পরিকল্পনা করেন তিনি যাতে একমাত্র অর্জুন-ই পারে কৃষ্ণাকে পেতে। কিন্তু বাকি সব প্রতিবন্ধকতা জয় করলেও এক ব্রাহ্মণকুমার কৃষ্ণাকে জয় করে নিয়ে যান। ক্রমশ প্রকাশ পায় তিনি ছদ্মবেশি অর্জুন। কিন্তু ‘পাঞ্চালকন্যা কৃষ্ণা’তেও তার জীবনও তার পূর্ববর্তী ক্ষত্রবধূদের মতোই রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। পঞ্চপতির মধ্যে বিভাজিত হয় সে। এখানে মহাকাব্যের ভালোমানুষ যুধিষ্ঠিরকে কিছু চতুর করে চিত্রিত করেছেন লেখিকা। তার চেষ্টাতেই কৃষ্ণা পঞ্চভ্রাতার স্ত্রী যেমন হয়, তেমনই যেন তারি চাতুর্যে বারো বছরের জন্য পরিজন ত্যাগ করে চলে যেতে হয় অর্জুনকে। ফলে অর্জুন ও কৃষ্ণার কাঙ্খিত মধুযামিনী আসতে অনেক বিলম্ব ঘটে যায়। নিয়তি ও পরিস্থিতির এমন শিকার যে মেয়ে মহাকাব্য তাকে এঁকেছে বীরাঙ্গনা ক্ষত্রিয়াণী করে। কিন্তু সত্যি কি কৃষ্ণা এত প্রখরা! তিনি তো আগাগোড়া তার পিতার, তার হবু শাশুড়ির, তার পঞ্চস্বামীর আজ্ঞানুবর্তিনী হয়েই চলেছেন। কৃচ্ছসাধন করেছেন, বনবাসে সমস্ত পরিজন ও অতিথিকে খাইয়ে তারপরে নিজের আহার করতে পেরেছেন। তবে কোথায় পরিচয় আছে সেই অধিকারসচেতন ব্যক্তিত্বশালিনী কৃষ্ণার! দ্যূতসভায় তার অপমানে প্রার্থিত প্রতিক্রিয়া না পেয়েও সে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তার স্বামীদের মুক্তি-ই চেয়েছে। অজ্ঞাতবাসের শেষেও যুদ্ধবিমুখ পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রামের প্রার্থনায় তার অপমানে প্রতিশোধের কথা বিস্মৃত হয়েছে সবাই। কিন্তু সূচ্যগ্র ভূমি দিতেও যখন দুর্যোধন রাজি হয়নি তখন নিঃস্ব পাণ্ডবদের যুদ্ধই হয়েছে একমাত্র উপায়। কৃষ্ণা তখন স্মরণ করাতে পেরেছে তার অপমান প্রসঙ্গে পাণ্ডবদের প্রতিজ্ঞার কথা। কৃষ্ণার চরিত্রে যে গুণ আরোপ করেছে মহাকাব্যিক পরিসর , বাণী বসু দেখিয়েছেন তা তার ক্রিয়ায় উপস্থিত নয়।

মহাকাব্যের উপস্থাপনার মধ্যে থেকেই তার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা সন্ধানে প্রয়াসী হয়েছেন লেখিকা। সেই ব্যাখ্যার সন্ধানের উদ্দীপনা তিনি পেয়েছেন ‘পুরাণপ্রবেশকার’ গিরীন্দ্রশেখর। লেখিকার উল্লেখে –এঁদের অতিশয়োক্তিগুলোরও একটা মানে আছে মেথড ইন ম্যাডনেস।

বলেছেন প্রাচীনতম মহাকাব্যের কথা, কিন্তু মন আর যুক্তি তাঁর আজকের দিনের। তাই ভাষাভঙ্গিও হয়েছে অনুরূপ। সব মিলে বাণী বসুসুলভ সুখপাঠ্য ও মননের আধার হয়ে উঠছে তাঁর এই বৃহৎ উপন্যাস পরিকল্পনা। তাঁর রচনার এই ধারা পাঠককেও আরও অনুসন্ধিৎসু ও বোধসম্পন্ন করে তুলবে আশা করা যায়।

তথ্যসূত্রঃ
১. বাণী বসু, সুযোধন দুর্যোধন, শারদীয়া সংবাদ প্রতিদিন ১৪২৪, পৃ:২৬৩
২. বাণী বসু, কালিন্দী, শারদীয়া বর্তমান ২০১৫, পৃ: ৯২
৩. বাণী বসু, সুযোধন দুর্যোধন, শারদীয়া সংবাদ প্রতিদিন, ১৪২৪ পৃ: ২৪৬
……………….
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment