লিখেছেনঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল

ফেলুদার এত পসার প্রচার দাপট সমস্ত কেমন একমেটে! এদিকে সেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যুগেই এ দেশের সংসারী, সন্ন্যাসী সমস্ত মহামানবরাই বুঝেছিলেন ও ঘোষণা করেছিলেন যতকাল মেয়েদের পূর্ণ মানুষের স্থান না দেওয়া হবে ততদিন পুরুষের মানবকল্যাণমুখী যে কোনও সৎ চেষ্টাই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ, সমাজে নারীর প্রকৃত মানুষের স্থান পাওয়া তাই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানবিকতার কাছে তাই অত্যাবশ্যক; ওদিকে বিশ শতকের বাংলার আলোকিত প্রাগ্রসর পরিবারগুলির অন্যতমটিতে জন্ম নিয়ে বাংলার জনপ্রিয়তম এক গোয়েন্দার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় কিন্তু তাঁর কাহিনিগুলিকে নারীস্পর্শরহিতই রাখলেন প্রায়। প্রায় বলতে হচ্ছে তার কারণ তাঁর ফেলুদাকেন্দ্রিক কাহিনিগুলির এক দশমাংশে নারীচরিত্র স্থান পেয়েছে। বাকি অংশের কথা বলাই বাহুল্য।

দুখণ্ড ফেলুদা সমগ্রে কালানুক্রমিক প্রকাশ অনুযায়ী কাহিনিগুলি বিন্যস্ত। প্রকাশক্রম বলতে কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশের ক্রম, আলাদা বই হিসেবে প্রকাশের ক্রমে নয়। এই প্রবন্ধে ফেলুদা কাহিনির তথ্যাদি ও সমস্ত উল্লেখ, দু খণ্ডে আনন্দ প্রকাশিত ‘ফেলুদা সমগ্র’ থেকে নেওয়া হয়েছে।

meghdhut_1248571036_1-satyajit_ray
ফেলুদার স্রষ্টা লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়

মোট পঁয়তিরিশটি ফেলুদা কাহিনির মধ্যে কোথাও ফেলু বা তোপসেকে নিয়ে তপেশের মায়ের উৎকণ্ঠার কোনও পরিচয় পাঠক হিসেবে আমরা পাইনি। ফেলুর মা বা তপেশের মেজো জেঠিমা ছেলেবেলায় ফেলুর বাবারও আগে মারা যান। পিতৃমাতৃহীন ফেলু তাই ন’বছর বয়স থেকেই তপেশের বাড়িতে কাছে বড় হয়েছে। (রয়েল বেঙ্গল রহস্য)। তপেশ তাদের হঠাৎ বাইরে যাবার খবর অফিস ট্যুরে থাকা বাবাকে জানিয়ে তাঁর অনুমতি নিয়েছে (সোনার কেল্লা) কিন্তু বাড়িতে থাকা মায়ের বিষয়ে সে নিশ্চুপ। প্রথমে ফেলুদা ছিল তপেশের মাসতুতো দাদা, পরে সেটি হয়ে যায় খুড়তুতো দাদা, লক্ষ্যণীয় যে মায়ের দিকের সম্পর্ক এড়িয়ে ফেলু-তপেশের তুতো সম্পর্ক বাবার দিকে ঢলে যায়। হয়তো এটা খুব বেখেয়ালে ঘটা ঘটনা নয়। তাহলে প্রথমদিকের কাহিনির মাসতুতো সম্পর্ক পরে ফিরে আসতেও পারতো। সেটা কিন্তু আর হয়নি। বরং বংশগতভাবেই যে ফেলুদার মধ্যে দুঃসাহস ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা আছে তাও তপেশের বড়জ্যাঠার শিকারী হওয়া ও মেজোজ্যাঠার শরীরচর্চা করার উল্লেখের থেকে স্পষ্ট। (রয়েল বেঙ্গল রহস্য)। ফেলুও যে নিয়মিত শরীরচর্চা করে (পরের দিকে তপেশও করে) আর তার হাতের গুলির লক্ষ্য নির্ভুল এমন উল্লেখ ফেলুদা কাহিনির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই প্রসঙ্গে পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকারের উল্লেখ ফেলুদা কাহিনিকে টিপিক্যাল পিতৃতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও ফেলে দেয় বইকি। বিস্তারিত দেখে নেওয়া যাক কীভাবে সেখানে ফেলুদার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটা মোটা অংশ তার পৈতৃক উত্তরাধিকার বলে দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

জঙ্গলে যাবার কথা শুনে ফেলুদার মন যে নেচে উঠবে, আর সেই সঙ্গে আমারও, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ আমাদের বংশেও শিকারের একটা ইতিহাস আছে। বাবার কাছে শুনেছি বড় জ্যাঠামশাই নাকি রীতিমতো ভালো শিকারি ছিলেন। আমাদের দেশ ছিল ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার সোনাদীঘি গ্রামে। বড় জ্যাঠামশাই ময়মনসিংহের একটা জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। ময়মনসিংহের উত্তরে মধুপুরের জঙ্গলে উনি অনেক বাঘ হরিণ বুনো শুয়োর মেরেছেন। আমার মেজো জ্যাঠা – মানে ফেলুদার বাবা – ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে অঙ্ক আর সংস্কৃতের মাস্টার ছিলেন। মাস্টার হলে কী হবে – মুগুর ভাঁজা শরীর ছিল তাঁর। ফুটবল ক্রিকেট সাঁতার কুস্তি সব ব্যাপারেই দুর্দান্ত ছিলেন। উনি যে এত অল্প বয়সে মারা যাবেন সেটা কেউ ভাবতেই পারেনি। আর অসুখটাও নাকি আজকের দিনে কিছুই না। ফেলুদার তখন মাত্র ন বছর বয়স। মেজো জেঠিমা তার আগেই মারা গেছেন। সেই থেকে ফেলুদা আমাদের বাড়িতেই মানুষ। (রয়েল বেঙ্গল রহস্য)

এখান থেকে ফেলুদার শারীরিক সক্ষমতা, নিয়মিত শরীরচর্চা করা, একাধিক পরস্পর সম্পর্কহীন বিষয়ে চর্চা ও ব্যুৎপত্তি – এ সবের একটা পূর্বেতিহাস পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে উত্তরাধিকারে তো বটেই এমনকি দৈনন্দিন অভ্যাসেও মায়ের ন্যুনতম প্রভাবের সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া গেল।

এমত আটঘাট বেঁধে ফেলুদার কাহিনি লিখতে বসেও যে গুটিকয় কাহিনিতে মহিলারা এলেন, এসেই গেলেন সে অনেকটা আশ্চর্যের বিষয় সন্দেহ নেই। প্রথমে আমরা দেখে নি ফেলুদা-কাহিনির কোথায়-কীভাবে নারীদের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ফেলুদার দুটি কাহিনি ‘গোঁসাইপুর সরগরম’ ( সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৮৩)  আর ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ ( সন্দেশ শারদীয়া ১৩৯০) দুজন বৃদ্ধাকে পাই আমরা যারা সরাসরি ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিকে প্রভাবিত করেন। প্রথমে আসি ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এর কথায়, এখানে ফেলুদার মক্কেল জীবনলাল মল্লিক; কাহিনিতে তার বিধবা ঠাকুমা কিছু স্থান পেয়েছেন। তবে তাতে কিছু অসংগতিও যে নেই তা নয়। মল্লিকবাড়ির প্রাচীনতম সদস্য ‘আশি বছরের বুড়ি’ এই মহিলা। বয়সের কারণেই তাঁর চোখে দেখার ও কানে শোনার ক্ষমতা কমেছে। এ কথার স্পষ্ট উল্লেখও কাহিনিতে আছে,

‘আপনার ঠাকুমার দৃষ্টিশক্তি কেমন?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

‘খুবই কম’, বললেন জীবনবাবু, ‘এবং তার সঙ্গে মানানসই শ্রবণশক্তি’  (গোঁসাইপুর সরগরম)

এরপরেও কাহিনি অনুসরণ করলে দেখা যায় এই কাহিনির মূল অপরাধসংঘটনস্থান বাগান এবং ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতেও যেটি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে লোকজনের সন্দেহজনক গতিবিধি সম্বন্ধে এই ঠাকুমা ওয়াকিবহাল এবং ফেলুদাও তার ফন্দি খাটাতে এই ঠাকুমার দেখে ফেলাকে ‘ম্যানেজ করে’। যে চরিত্র বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত এবং যার ক্ষীণ শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির কথা উল্লেখিত তার ছড়ানো বাগানে লোকজনের ঘোরাফেরা দেখা ও নাতির দ্রুত চলে যাওয়াকে নির্ভুল চিনে ফেলা ফেলুদার ভাবনা অনুযায়ী-ই খটকার বিষয়। এই চরিত্রের উপস্থিতি কাহিনিকে কেমন আলগা করে দেয়, কাহিনিকারের আরেকটু মনোযোগ পেলে ঘটনা বিপরীত হতে পারতো না কি!

পরবর্তী যে গল্পে আমরা এরকম ভীমরতি ধরা আরেকজন মহিলাকে পাব সেটি হল ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’। সেখানে ফেলুদার মক্কেল শঙ্করবাবুর খুড়িমার বর্ণনা প্রসঙ্গে পাই,

‘আমরা বাড়ির পশ্চিমদিকের বিরাট চওড়া বারান্দায় গিয়ে বসলাম। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে চলেছে, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। অমরাবতীর প্রাইভেট ঘাটও দেখতে পাচ্ছি সামনে ডান দিকে। একটা তোরণের নিচ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে জল অবধি।

‘ওই ঘাট কি ব্যবহার হয়?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘হয় বইকী,’ বললেন শঙ্করবাবু। ‘আমার খুড়িমা থাকেন তো এখানে। উনি রোজ সকালে গঙ্গাস্নান করেন।’

‘উনি একা থাকেন এ বাড়িতে?’

‘একা কেন? আমিও তো দু বছর হল এখানেই থাকি। টিটাগড় আমার কাজের জায়গা। কলকাতায় আমহার্স্ট ষ্ট্রিটের বাড়ির চেয়ে এ বাড়ি অনেক কাছে হয়।’

‘আপনার খুড়িমার বয়স কত?’

‘সেভেনটি এইট। আমাদের পুরনো চাকর অনন্ত ওঁর দেখাশোনা করে। এমনিতে মোটামুটি শক্তই আছেন, তবে ছানি কাটাতে হয়েছে কিছুদিন হল, দাঁতও বেশি বাকি নেই, আর মাথায় সামান্য ছিট দেখা দিয়েছে। নাম ভুলে যান, খেতে ভুলে যান, মাঝরাত্তিরে পান ছাঁচতে বসেন – এই আর কী। ঘুম তো এমনিতে খুবই কম – রাত্তিরে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি নয়। আসলে চার বছর আগে কাকা মারা যাওয়ার পর উনি আর কলকাতায় থাকতে চাননি। এখানে থাকাটা ওঁর কাছে একরকম কাশীবাসের মতো।’ ’

এই খুড়িমার ঘরেই থাকে শঙ্করবাবুর প্রপিতামহের দামি কিছু জিনিস যা তিনি তাঁর নবাব-তালুকদার মক্কেলদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। খুড়িমা ঘর ছেড়ে কোথাও যাননা বলে তাঁর ঘরেই সিন্দুক নিরাপদ এবং শঙ্করবাবুর কাছে ছাড়া আর তাঁর কাছেই থাকে ওই সিন্দুকের চাবি। কাহিনির শেষে এই খুড়িমার ঘুমের কিছু ব্যতিক্রম এবং তাঁর মাঝরাত্তিরে পান ছাঁচতে বসার অভ্যেস যা অপরাধীরা নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তা ব্যর্থ করে দেয় ফেলুদা তার মগজাস্ত্র দিয়ে। ফলত এই চরিত্রটির যথাযথভাবেই বিন্যস্ত ও কাহিনির মূল সংঘটনের সঙ্গে স্বমর্যাদায় সংযুক্ত বলা যায়।

ফেলুদার তিনটি কাহিনিতে আমরা তিন বুদ্ধিমতি বালিকা চরিত্র পাব যারা সবাই ফেলুদার একনিষ্ঠ ভক্ত; মজার কথা হল এই তিন কাহিনির মধ্যে দুটিতেই দুই বালিকার মায়েদেরও আমরা কমবেশি জায়গা নিতে দেখব। কাহিনি তিনটি হল, ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’ (দেশ, শারদীয়া ১৩৮৫), ‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’ (আনন্দমেলা, ১৯৮৩খ্রি.), ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’ (সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৯২)। এর মধ্যে ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ রাঁচি থেকে হাজারিবাগের পথে হঠাৎ আলাপ হওয়া প্রীতীন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী ও মেয়ে কাহিনিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান নেয়। প্রীতীন্দ্র চৌধুরীর নিমন্ত্রণে তাদের বাড়ি থেকে তার বাবা মহেশ চৌধুরীর জন্মদিনে রাজরাপ্পা গিয়ে মহেশ চৌধুরীকে ঘিরে যে রহস্য ঘনিয়ে উঠল তার পর্দা তুলতে প্রীতীন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী নীলিমাদেবীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কাহিনিটিতে আপাতভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা স্রোত একসঙ্গে মিলেমিশে যায়। মহেশ চৌধুরীকে ঘিরে ঘটা দুর্ঘটনাটির ওপর থেকে সমস্ত অন্ধকার দূর করে প্রীতীন্দ্রবাবুর পাখির ডাক রেকর্ড করবার যন্ত্রটি। আর সেটি মনের জোর বজায় রেখে ফেলুদার হাতে তুলে দেবার কাজটি করেন নীলিমাদেবী-ই।

নীলিমা দেবী। তিনি ঘরে ঢুকতেই প্রীতীনবাবুর মুখ শুকিয়ে গেছে সেটা লক্ষ্য করলাম।

‘আপনাকে একটা কথা বলার ছিল, মিঃ মিত্তির। সেটা আমার স্বামীরই বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু উনি বলতে চাইছেন না।’

প্রীতীনবাবু তাঁর স্ত্রীর দিকে কাতরভাবে চেয়ে আছেন, কিন্তু নীলিমাদেবী সেটা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি বলে চললেন, ‘সেদিন বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার স্বামীর হাত থেকে টেপ রেকর্ডারটা পড়ে যায়। আমি সেটা তুলে আমার ব্যাগে রেখে দিই। আমার মনে হয় এটা আপনার কাজে লাগবে। এই নিন।’

প্রীতীনবাবু আবার বাধা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। ফেলুদা ধন্যবাদ দিয়ে চ্যাপটা ক্যাসেট-রেকর্ডারটা কোটের পকেটে পুরে নিল।

প্রীতীনবাবুকে দেখে মনে হল তিনি একেবারে ভেঙে পড়েছেন।’

অন্যদিকে নীলিমা-প্রীতীনের বছর পাঁচেকের মেয়ে দাদুর ন্যাওটা বিবি যে কি না তার দাদুর শব্দ নিয়ে খেলার সঙ্গী তার কাছে পাওয়া তার দাদুর ইঙ্গিতপূর্ণ কথার প্যাঁচ খুলে দিয়ে সম্পূর্ণ রহস্য উদ্ধার করেন গোয়েন্দা।

‘অম্বর সেন অন্তর্ধান রহস্য’-তে ফেলুদার এক খুদে ভক্ত রুনার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে ফেলুদাকে জব্দ করার মতলব করেন অম্বর সেন ও তার পরিবার। এ গল্পেও রুনার মাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় পাই আমরা। অম্বর সেনের উধাও হয়ে যাওয়াকে যথেষ্ট রহস্যময় করে তুলতে রুনার মায়ের জেরার সময়ে তিনি পূর্বপরিকল্পনা মতো ফেলুদাকে তার ভাশুরের একটি বিস্মৃতপ্রায় দুর্ঘটনার কথা বানিয়ে বলেন। ফেলুদা পরে সব রহস্যই ধরে ফেলে, তবে রুনা ও তার মা কাহিনিতে নারীচরিত্র হিসেবে জায়গা করে নেয়। একথা বিশ্বাসযোগ্যরূপেই লেখক প্রতিষ্ঠা করেন যে অনেকদিন আগেকার ভুলতে বসা ঘটনা অনেকসময়ই বাড়ির মহিলাদের মনে পড়ে, যেমন তাদের সংসারের অনেক খুঁটিনাটি বেশি মনে থাকে তাদের অভ্যাসের ও জীবনযাপনের ধরণের কারণেই। সেই সাধারণ নারীমনস্তত্বের প্রকাশ এই কাহিনিতে দেখা যায়।

‘যেটাতে মনে হয় সত্যি করে কাজ হল, সেটা হল অম্বুজবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তায়। রীতিমতো সুন্দরী মহিলা, তার উপর যাকে বলে ‘ব্রাইট’। বয়স চল্লিশের উপর হলেও দেখে বোঝার জো নেই। দোতলার একটা ছোট বৈঠকখানায় বসে কথা হল।

ফেলুদা প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিল ভদ্রমহিলাকে বিব্রত করার জন্য। ‘তাতে কি হয়েছে,’ বললেন মিসেস অম্বুজ সেন, ‘গোয়েন্দাকে যে এভাবে জেরা করতে হয় সে তো ফেলুদার গল্প পড়েই জেনেছি। খুব ভালো লাগে পড়তে গোয়েন্দার কাহিনী।’

এরপরেই তিনি বলেন সেই ভুলতে বসা অ্যাকসিডেন্টের মনগড়া গল্প। কাহিনির শেষে অবশ্য ফেলুদা সব বুঝে ফেলেছে দেখে রুনা আহ্লাদিত হয়ে ওঠে আর অম্বরবাবু স্বীকার করেন এ তাদের একটি পারিবারিক নাতকে প্রায়, ফেলুদাকে জব্দ করবার জন্য।

‘কারণ আমার ওই খুদে ভাইঝিটি। সে আপনাকে বলতে গেলে একরকম পুজোই করে। তার ধারণা আপনি ভুলভ্রান্তির উর্ধ্বে। তাই ওকে আমি সেদিন বললাম যে, তোর ফেলুদাকে আমি জব্দ করতে পারি। ব্যস- ওই একটি উক্তি থেকেই সমস্ত ফন্দিটির উৎপত্তি। এতে আমাদের সকলেরই ভূমিকা আছে।’

‘অর্থাৎ এও আপনাদের একটা ফ্যামিলি নাটক।’

‘ঠিক তাই। সবাইকে সব কিছু আমিই শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলাম। আপনি কী জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দেবে, সব লিখে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলাম – এমনকী ড্রাইভার ও চাকরকে পর্যন্ত। প্রধান নারীচরিত্র অবশ্য বউমা, যাঁকে দিয়ে মনগড়া অ্যাকসিডেন্টের কথাটা বলানো হয়েছিল। আমি নিজে ভাবিনি যে, আপনি ব্যাপারটা ধরে ফেলবেন – ইন ফ্যাক্ট, এই নিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে একশো টাকা বাজিও ধরেছিলাম। এ ব্যাপারে রুনার উৎকণ্ঠাই ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ তার হিরো যদি ফেল করত, তাহলে তার দুঃখের সীমা থাকত না। এই ঝুঁকিটা অবশ্য আমাকে নিতেই হয়েছিল, কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্ত।’

আর ‘বোসপুকুরে খুনখারাপি’-তে আমরা পাব লীনাকে, যে ফেলুদার মক্কেল ও খুন হয়ে যাওয়া ইন্দ্রনারায়ণ আচার্যের মেজোদাদার মেয়ে। সে জানিয়েছে যে সে ছিল তার কাকার বন্ধুর মতো। তার কাকা যে কোনও যাত্রাপালা লিখে বা জ্ঞান লিখে সুর করে তা অবশ্যই লীনাকে শোনাতেন। ইন্দ্রনারায়ণের লেখাপত্তরের হিসেব ফেলুদা লীনার কাছ থেকেই পান। রহস্যের যবনিকা উত্তোলনের সময়ে লীনার দেওয়া তথ্যের গুরুত্বের কথাও বলে ফেলুদা।

‘এখানে আরেকটা তথ্য আমাদের খুব কাজে লাগে। আমরা লীনার কাছে জানতে পারি যে, ইন্দ্রনারায়ণের কাছে তাঁর লেখা পাঁচটি নতুন নাটক ও খান কুড়ি জ্ঞান ছিল। যাত্রার বাজারে যে এ জিনিসের দাম অনেক সেটা আর বলে দিতে হবে না।’  

আগের তিনটি গল্পে তিনজন শিশুকিশোর মহিলাচরিত্র ও দুজন মা যেমন বিশেষ গুরুত্বের হয়ে উঠেছেন তেমনই আবার ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ (দেশ, শারদীয়া ১৩৯৫) ‘ডাঃ মুনসীর ডায়রি’ (সন্দেশ, শারদীয়া ১৩৯৭) এই দুটি পরপর রচিত কাহিনিতে দুটি বেশ জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’-এ শকুন্তলা দেবীর বহুমূল্য হারের উত্তরাধিকারী ছোট মেয়ের একমাত্র মেয়ে শীলা তার দিদিমার হারটিকে বিক্রির হাত থেকে বাঁচাতে নিজে দুঃসাহসের সঙ্গে লুকিয়ে রাখে।

‘শীলা হারটাকে আর সিন্দুকে তোলেনি। সে সেটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল। এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু কারণটা বুঝিনি। পরে রাত্রে সে সেটাকে একটা ফুলের টবে মাটির মধ্যে পুঁতে রাখে।’

শীলা এরকম করে হারটিকে তাদের পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতেই। কারণ স্বামীর অর্থাভাবে স্বামির প্ররোচনায় শীলার মা সুনিলা দেবী তার মা শকুন্তলা দেবীর হারটি বিক্রি করে দিতে মনস্থ করেন। বাবা-মায়ের এই আলোচনা শুনেই কলেজ পড়ুয়া বুদ্ধিমতী গুণী শীলা হারটিকে রক্ষা করবার সংকল্প করে। এর মধ্যে তার ব্যক্তিস্বার্থ বড় বেশি ছিল না বলেই তার অপরাধ হয় না যদিও চরিত্রটির জটিলতা এতে কমে না।

আর ‘ডাঃ মুনসীর ডায়রি’-তে তো মিসেস মুনসী নিজে একজন অপরাধপ্রবণ জটিল মানুষ। নিজের যমজ অকর্মণ্য ভায়ের প্রতি তার সমস্ত মনোযোগ ও ভালবাসা। স্বামীর প্রতি তার কোনও আকর্ষণই নেই। স্বামী তাকে নিজের লেখা ডায়রি উৎসর্গ করেন, সেই ডায়রি তাকে পড়ে শোনান অথচ স্বামীর উইলে তার সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হওয়া মাত্র তিনি ভাইকে দিয়ে স্বামীকে খুন করান। এরকম ভয়াবহ নারী চরিত্র খুব কম গোয়েন্দা গল্পে পাওয়া যায় সে দেশি হোক বা বিদেশি।

শেষে আলোচিত দুটি কাহিনিতেই নারী চরিত্রের অপরাধ মনস্তত্ব, বেপরোয়া হবার প্রবণতা, লক্ষ্যে স্থির হয়ে কাজ করার মত দৃঢ় মনের জোর – এসব পাওয়া যায়। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সবশেষে আমরা বলব এমন একটি কাহিনির কথা যেখানে কাহিনি পাকিয়ে উঠেছে দুই নারী যারা সম্পর্কে পিসিমা-ভাইঝি তাদের একজনের চিঠি আর একজনের ডায়রি থেকে। আরও উল্লেখযোগ্য এবং মজার বিষয় হল এরা কেউই বর্তমান নন। অনেকে হয়তো অনুমান করতে পারছেন, হ্যাঁ, ‘গোরস্থানে সাবধান’(দেশ, শারদীয়া ১৩৮৪ )-এর কথাই বলছি। কলকাতার দুই প্রান্তে থাকা টমাস গডউইনের দুই উত্তরাধিকারী পরিবার যাদের একজনের অধিকারে আছে টমাসের মেয়ে শার্লটের ডায়রি অন্য পরিবারের হাতে আছে শার্লটের ভাইঝি ভিক্টোরিয়ার চিঠি। শার্লটের ডায়রি উদ্ধার করে পড়ে ফেলুদা কারণ তার আগেই ভিক্টোরিয়ার চিঠি থেকে টমাসের বহুমূল্যবান পেরিগাল রিপিটার ঘড়িটি হাতাতে সক্রিয় হয়েছে অপরাধীরা। অবিবাহিতা শিক্ষিতা সহানুভূতিশীল শার্লটের তার বাবার প্রতি কর্তব্যবোধ আর নেটিভ খ্রিস্টানকে ভালবেসে দাদুকে আঘাত করা ভিক্টোরিয়ার দাদুর ক্ষমার জন্য অপেক্ষা করা চরিত্র দুটিকে জীবন্ত রক্তমাংসের করে তোলে। ফেলুদা মূলত তাদের লিখে যাওয়া তথ্যাদি জড়ো করে সমস্যার মূলে পৌঁছয় ও অপরাধীদের ধরে। তাই ফেলুদার কাহিনিতে নারী চরিত্রের আলোচনার প্রসঙ্গে এদের কথা না বললেই নয়।

এখন এই নারী চরিত্রের সর্বসাকুল্য উপস্থিতির পরে আলাদা করে বলে দিতে হয়না যে খুব স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় ফেলুদার কাহিনিতে নারীরা আসেনি। এসেছে খুব কম সংখ্যায়। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত। অর্থাৎ মূল চরিত্র বিপত্নীক বা তার মেয়েদের দূরদেশে বিয়ে হয়েছে এরকম প্রায় সব জায়গায়। নারী চরিত্র সম্বন্ধে যে লেখকের সম্যক ধ্যানধারণা ছিল সে কথা বলাই বাহুল্য। তার দুটি ফেলুদা কাহিনিনির্মিত ছায়াছবিতেই কিন্তু নারীরা প্রয়োজনে এসেছেন। ‘সোনার কেল্লা’ চলচ্চিত্রে শুধু নয়নের মা নয় সেই সঙ্গে তোপসের মায়ের উৎকণ্ঠাও (উপন্যাসে নেই এমন কোনও তথ্য) মনোযোগী দর্শকের মনে পড়বে। আর মনে পড়বে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ -এ উমানাথ ঘোষালের তার স্ত্রীর সঙ্গে মছলিবাবার দর্শনে যাবার স্বাভাবিক প্রত্যাশিত দৃশ্যের কথা ও সেই সঙ্গে মছলিবাবার দরবারে মহিলা গায়িকার ভজনও সিনেমায় আছে (উপন্যাসে নেই), যা ভোলবার নয়। এই ধান ভানতে শিবের গীতের অর্থ এটাই যে অন্যান্য সিনেমার কথা ছেড়ে দিলেও শুধুমাত্র ফেলুদা কাহিনি, যার চলচ্চিত্রায়নের জন্য যথেষ্ট রদবদল ঘটেছে স্রষ্টার হাতে, সেখানেও নারীদের স্বাভাবিক উপস্থিতির কথা অগ্রাহ্য করেননি তিনি। তাহলে ফেলুদার কাহিনিতে নারী চরিত্র সংখ্যায় এত কম কেন!

‘সন্দেশ’-এর পাতা ভরাতেই একসময় ফেলুদার আবির্ভাব ঘটেছিল। আর ছোটদের পত্রিকা সন্দেশে সম্ভবত জটিল নারী পুরুষের মনস্তত্ব রাখতে চাননি সত্যজিৎ, সেই জটিলতার মূলোচ্ছেদ করতে গিয়েই নারীচরিত্রের স্বাভাবিক স্বতস্ফুরত উপস্থিতিতে একটা বড়সড় কোপ পড়েছে সন্দেহ নেই। পরে সেটাই ফেলুদা কাহিনির একটা অপরিত্যাজ্য বৈশিষ্ট্য হয়ে পরে। ফেলুদা যে আর শুধুমাত্র ছোটদের থাকছে না। মূলত ছোটদের হয়েও তাকে বড়দের পছন্দ-অপছন্দের দাবি-দাওয়া মেটাতে হচ্ছে সে চাপের কথা ‘নয়ন রহস্য’ (দেশ, শারদীয়া ১৩৯৭)-তে ফেলুদার জবানিতে স্পষ্ট বলেছেন লেখক। আবার তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তিনি জানাচ্ছেন

‘বয়স্ক উপাদান না থাকলে ছোট-বড় সকলেই ফেলুদার গল্প পড়ত না। আমার যদি কোনও কৃতিত্ব থাকে তবে সে হল এই দুই উপাদানের সংমিশ্রণ। তবে এমন কোনও ফেলুদা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আমার নেই যাতে শুধু বয়স্কদের জন্য উপাদান থাকবে।’

[সাক্ষাৎকারটি শুধুমাত্র ফেলুদা সম্পর্কে নেওয়া একমাত্র সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন পূষণ গুপ্ত। এটি ১৯৯০তে ফেলুদার ২৫বছর উপলক্ষে নেওয়া, যেটি ২০১৩তে ‘এখন সত্যজিৎ’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত]

ফেলুদার জনমোহিনী ক্ষমতা সম্বন্ধে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিলেন সত্যজিৎ। এ কথা স্বীকার করতেও হয় যে নতুন ফেলুদা কাহিনির জন্য পাঠক একসময় সাগ্রহে অপেক্ষা করত। বই পড়ার এই দুর্দিনেও ফেলুদা পড়েনি এমন বাঙালি পাঠক খুব কম পাওয়া যাবে। তবু যত দিন যাবে যতবার বহুপঠিত হবে ফেলুদা তত বেশি ধরা পড়বে তার ত্রুটিবিচ্যুতি, আর তার মধ্যেই সবচেয়ে ওপরে থাকবে নারী চরিত্রের প্রতি লেখকের বিমুখতার প্রসঙ্গ।

………….

মেসেঞ্জারভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’র জন্য প্রবন্ধটি লিখেছেন দীপাঞ্জনা মণ্ডল। প্রবন্ধটি ১২ জুলাই ২০১৯ পাঠচক্রে পাঠ করা হয়।

Leave a Comment