গল্পস্যাটায়ার

একটি আষাঢ়ে গল্প

সোয়াজি তরুণী ইবসুকার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল একটি পানশালায়।

প্রতি শুক্রবারের মতো সেদিনও আমি বিবলিওথেক বারের বাম কোণের একটি টেবিলে এক গ্লাস ‘হেনিকেন’ নিয়ে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছিলাম, গান শুনছিলাম আর ফেসবুকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। পানশালাটিতে তখনও ভিড় জমেনি; বেশিরভাগ টেবিলই ফাঁকা। আমার মতোই এক গ্লাস বিয়ার হাতে মেয়েটি যখন আমাকে ‘হাই’ দিয়ে আফ্রিকান উচ্চারণে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো আমার বিপরীত চেয়ারটিতে বসতে পারে কিনা, তখন আমি মেসেঞ্জারে এক বন্ধুর পাঠানো বাংলাদেশের একটি লোমহর্ষক শিশু হত্যার খবর পড়ছিলাম। মেয়েটির কথায় মোবাইল থেকে মুখ তুলে বললাম, “নিশ্চয়ই। ইউ আর ওয়েলকাম।”

Photo: Shutterstock

কালো মুখাবয়বে এক ঝাঁক সাদা দাঁতের হাসি দিয়ে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসে পড়লো মেয়েটি। আমি মোবাইলটা টেবিলে রেখে একটু নড়েচেড়ে বসলাম। না, তাকে ইমপ্রেস করার কোন চেষ্টা ছিল না আমার মধ্যে। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সহজাত আকর্ষণ থাকলেও এবং নিজের গায়ের রং প্রায় আফ্রিকানদের মতো হলেও, কেন জানি আফ্রিকান মেয়েদেরকে আমি এখনও নিতে পারি না। দুই বছরের বেশি ইউরোপে বাস করেও নিজের ভিতরে থাকা এই অবচেতন-রেসিজমের বীজকে আজও উৎপাটন করতে পারিনি। আমি আমার গ্লাসটিকে একটু উঁচু করে ‘স্কল’ বলে চুমুক দিলাম। মেয়েটিও তাই করলো।

শুক্রবারের সন্ধ্যাগুলোতে পানশালায় আমার গতায়ত মূলত মানুষ দেখতে। ইউরোপে মানুষ চেনার সবচেয়ে সঠিক সময় হলো শুক্র ও শনিবার সন্ধ্যা। সপ্তাহের বাকি পাঁচ দিন তারা খুব গম্ভীর। একদম মেপে মেপে কথা বলে। ভুলেও তারা ভুল করে না; ভুলেও তাদের মুখ থেকে একটা সমালোচনার বাক্য বের করা যায় না। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় আর ওসব মাপামাপির বালাই থাকে না; পান করবে এবং অনর্গল কথা বলবে সবাই। যে বাসে-ট্রামে অন্য দিনগুলোতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে গেলেও টু-শব্দটি শোনা যায় না, সেই যানবাহনগুলোতেই এই দু’দিন সন্ধ্যায় দশ জন থাকলে মনে হবে বাংলাদেশের মাছ বাজার। আমি এগুলোই উপভোগ করি। কান পেতে তাদের কথা শুনি, আর বারে বসে খুঁচিয়ে এবং খুঁটিয়ে তাদের ভেতরটাকে দেখার চেষ্টা করি।

পান করার জন্য আমি অবশ্য খুব বেশিসংখ্যক পানশালায় যাই না। বেশিরভাগ সময়েই বিবলিওথেক পানশালাটিতেই আসা হয়। এটি বেছে নেয়ার কারণ পানশালাটির সাথে জড়িত ইতিহাস। নরওয়েজিয়ান ভাষায় বিবলিওথেক অর্থ গ্রন্থাগার। না, পানশালাটিতে কোন গ্রন্থাগার নেই, আদৌ কোন বই আছে কিনা তাও জানা নেই। এককালে এই শহরের গণ-গ্রন্থাগারটি ছিল এই দালানটিতে। গ্রন্থাগারটি স্থানান্তরিত হয়ে অন্য দালানে চলে গেলে এখানে এই পানশালাটি স্থাপিত হয়। বিবলিওথেক নাম দিয়ে তারা দালানটির ইতিহাসকে ধরে রেখেছে। পানশালার এমন অদ্ভুত নাম আমি আর কোথাও দেখিনি।

এটা অবশ্য এখানকার মানুষের সংস্কৃতি; তারা কোনকিছুকেই সহজে মুছে যেতে দেয় না। আমরা যেমন হুট-হাট নতুন ফ্যাশন দিয়ে পুরোনোকে হাওয়া করে দিই, এখানকার মানুষ তা করে না। পুরোনোটাকে ভেঙে নতুন কিছু গড়ে না সহজে; সেটাকে সংস্কার করে কিংবা তাকে ঘিরে চারপাশে আরো নতুন কিছু গড়ে তোলে। আর একেবারেই যদি অপরিহার্য হয়, তখন পুরোনোটাকে ভেঙে ঐ স্থানে ঠিক ওটার মডেলেই গড়ে তোলে নতুন আরেকটা কিছু।

আমরা দু’জন দু’জনার মতো করে পান করে যাচ্ছিলাম; কেউ কোন কথা বলছিলাম না। আমি পাঁচ-দশ মিনিট পরে পরে এক চুমুক দিলেও মেয়েটি বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে পান করছিলো। পনের মিনিট পার না হতেই দ্বিতীয় গ্লাস নিতে হলো তাকে। সেটাও প্রায় অর্ধেক শেষ করার পরে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। প্যাকেটটাতে একটাই সিগারেট। পানশালাটিতে ততক্ষণে বেশ জমজমাট ভিড় লেগে গিয়েছে; দু’দফায় একটি কলেজ ছাত্রের দল ও একটি আরব অভিবাসীর দল এসে পুরো বারটি ভরে ফেলেছে।  সিগারেট টানতে বাইরে বের হলে আসনটি হারাতে হতে পারে, সম্ভবত এই ভেবে মেয়েটি আমার দিকে তাকালো।  তার চোখের ভাষা বুঝে সে কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “ইটস ওকে। তুমি নির্ভয়ে বাইরে যেতে পারো।”

মিনিট দু’য়েক বাদেই বাইরে থেকে বেশ হন্তদন্ত হয়ে হাত ঘষতে ঘষতে ফিরে এলো মেয়েটি। বেশ কাটা-কাটা আফ্রিকান উচ্চারণে বললো, “উফ! কী ঠাণ্ডা বাইরে! জ্যাকেটটা না নিয়ে গিয়ে খুব ভুল করেছিলাম।”

আমি মুচকি হেসে বললাম, “তুমি বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলে এটা নরওয়ে।”

মেয়েটি তার সুন্দর সাদা হাতে একটা প্রশস্ত হাসি দিলো। “বাই দ্য ওয়ে, আমি ইবসুকা। ফরম সোয়াজিল্যান্ড।”

আমিও আমার পরিচয় দিলাম। তার নামটা উচ্চারণে আমাকে অবশ্য আরো দুবার শুনতে হয়েছিল। তারপরও যে ঠিক পেরেছি, তা বলা যাবে না। আমার উচ্চারণে সেটা ইবসুকা হলেও সোয়াজি ভাষার উচ্চারণে ঠিক ইবসুকা নয়। উ-কারটার এমন এক উচ্চারণ যা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। আমি মজা করে বললাম, “আমি কি তোমাকে ইভ ডাকতে পারি?”

বেশ উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো ইবসুকা। “ডেফিনিটলি। আই’ল লাভ ইট।” তারপর দীর্ঘ এক চুমুক বিয়ার গিলে হাসতে হাসতে বললো, “ভাগ্যিস তোমার নামটা কঠিন না। নইলে আমাকে হয় তো এ্যাডাম ডাকতে হতো!”

আমরা দুজনই হেসে গড়াগড়ি খেলাম।

এরপরে আমাদের কথা গড়ালো বিভিন্ন দিকে। ইবসুকা জানালো সে পড়াশুনা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর করে কী একটা স্কলারশিপ নিয়ে এখানে মাস্টার্স করতে এসেছে। নরওয়ের আবহাওয়ায় আমাদের মানিয়ে নেয়ার সংগ্রাম, এখানে আমাদের জীবন ও তার পড়াশুনা, ইত্যাদি নিয়ে আমরা অনর্গল কথা বলছিলাম আর বিয়ার পান করছিলাম। আমি পরিবার ও কাজ নিয়ে কথা বললেও আমার নরওয়ে আসার কারণটা কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। ইবসুকা যেমন ঝর্ণার মতো কলকলিয়ে কথা বলছিলো, ঠিক তেমনই একের পরে এক বিয়ার নিচ্ছিলো; তার যখন চতুর্থটা চলছে, আমি তখন কেবল প্রথমটা শেষ করে দ্বিতীয়টার অর্ধেক শেষ করতে পেরেছিলাম।

ইবসুকার সিগারেট নেই বলে তাকে এর মধ্যে আমার থেকে দু’বার ধার নিতে হলো। এটা এই দেশী ভাষায় ধার বলে পরিচিত হলেও আমি এটাকে ধার বলতে রাজি নাই, কারণ এগুলো শোধ করতে হয় না; শোধ করার সুযোগও নেই। নরওয়ের এই একটা বিষয় খুবই অদ্ভুত লাগে। আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছেন, এমন সময়ে কেউ একজন এসে বলবে, “দয়া করে একটা সিগারেট ধার দিবেন কি?” ভাবটা এমন যেন আজ-কাল-পরশুই আবার আপনার সাথে তার দেখা হবে এবং সে আপনার সিগারেটটা ফিরিয়ে দিবে। আমি বেশিরভাগ সময়েই মিথ্যা বলি। ছয় ক্রোনারের বেশি দামের একটা সিগারেট অনায়াসে দিয়ে দিতে খুব কষ্ট হয়। ইবসুকার ক্ষেত্রে অবশ্য সে ধরণের মনঃকষ্ট হয়নি, আমিই উল্টো তাকে অনুরোধ করেছিলাম। ইবসুকা নিতে চাইছিল না; বার কাউন্টার থেকে কিনে নিতে চেয়েছিলো। আমি তখন মজা করে বলেছিলাম, “আরেকদিন শোধ করে দিও।”

“সেই সুযোগ কি আমাকে দিবে?” সে বললো। “তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল এখানে আমার বসা তোমার পছন্দ হয়নি। হয় তো ভেবেছিলে কোন সাদা মেয়ে এসে বসবে, খাতির জমাবে, তারপর…।”

আমি আমার ভিতরে বাস করা রেসিজমের বীজকে চেপে গেলাম। ইবসুকাকে ওদিকে আগাতে না দিয়ে বললাম, “দেখো, তুমি এতক্ষণে জানো যে আমার স্ত্রী আছে। সেরকম কিছু…”

আমাকে থামিয়ে দিল ইবসুকা। “ওসব ঢের দেখেছি,” সে বললো। “আমি ইউরোপে এসে যাদের সাথে শুয়েছি, তাদের সিংহভাগই বিবাহিত। আমার ওতে এ্যালার্জি নেই।” একটু থেমে আবার বললো, “এইসব শোয়াশুয়িতে এতোদিনে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝে গেছি।”

“কী?” আমি বেশ আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করলাম।

“বেশিরভাগ সাদা পুরুষরা আমার সাথে শুয়েছে সাদা মেয়েদের সাথে কালোদের ভিন্নতা পরীক্ষা করার জন্যে। তারা বুঝতে পারে না যে এটাও এক প্রকার রেসিজম।  মদে মাতাল তারা মনের কথাটা লুকাতে পারে না। আমিই অবশ্য খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করি। তারা ধরতেও পারে না যে আমি তাদের ভেতরটাকে পরখ করে দেখতে চাই।”

আমি তাকে বললাম না যে, এই খোঁচানোর কাজটা আমিও করি। তবে তার মতো শুয়ে নয়, পানের আড্ডায়।  আমার কী বলা উচিত তাই ভাবছিলাম। তখনই ইবসুকা আবার বলে উঠলো, “যাদের মধ্যে এই ধরণের রেসিজম পাই, তাদের সাথে পরে দেখা হলেও আর কথা বলি না। ইদানিং অবশ্য সব ধরণের সাদাদেরই এড়িয়ে চলছি।” তারপর প্রায় অট্টহাস্য দিয়ে বললো, “আর সেজন্যই তোমার টেবিলে আসা। এখন তো দেখছি তুমি এক স্ত্রৈণ পুরুষ।”

আমাকে স্ত্রৈণ বলায় আমার গায়ে লাগেনি। তবে তার যাতে একটু গায়ে লাগে, সেভাবে বললাম, “দুঃখিত। তুমি চাইলে অন্য কোন টেবিলে যেতে পারো।” ওপাশে আরবদের একটা টেবিল দেখিয়ে বললাম, “ওখানে গেলে ওরা তোমায় সাদরে গ্রহণ করবে।”

“আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি।” ইবসুকা প্রায় আঁতকে উঠে বললো। তারপর মুখে বেশ একটা কঠোর ভাব এনে বললো, “ওরা তো আরো রেসিস্ট। ওদের অনেকে ইউরোপে আসেই সাদা মেয়েদের বিছানায় নিতে পারবে, এই ভেবে।”

আমি দেখলাম এই আলোচনাটা আর আগাতে দেয়া উচিত হবে না। এক চুমুকে গ্লাসের সবটুকু বিয়ার মুখে দিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, “আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। কন্যাটা আমার পথ চেয়ে থাকবে। আমি না ফিরলে ঘুমাবে না। গুড লাক! দেখো আমার বা তোমার গায়ের রংয়ের মতো অন্য কাউকে হয় তো পেয়ে যাবে।”

আমাকে দাঁড়াতে দেখে ইবসুকাও দাঁড়ালো। “আমি সত্যিই দুঃখিত। আই মিন, তোমাকে ব্যথা দিয়ে থাকলে,” সে বললো। “তবে তোমার এই শেষ কথাটায় আমিও একটু ব্যথা পেলাম।”

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললাম, “সেরকম হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত। কিন্তু কেন ব্যথা পেয়েছো বলবে কি?”

“এমন না যে প্রতি সপ্তাহান্তেই আমার বিছানায় কাউকে দরকার,” ইবসুকা বললো। “আজ তোমার সাথে কথা বলে যে আনন্দ পেয়েছি, সেটা ভিন্নরকম। আমি বরং এরকম কাউকে বন্ধু পেলেই বেশি খুশি হতাম। এরকম কেউ নেই বলেই হয় তো শরীরে সুখ খুঁজি। কিন্তু সুখ যে কী, দিনশেষে সেটাই বুঝতে পারি না।”

আমাকে ফের বসতে হলো। ইবসুকাও বসলো আমার সাথে সাথে। আমাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো আমার জন্য সে একটা বিয়ার কিনতে পারে কিনা। আমার আর বিয়ার প্রয়োজন ছিল না। স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে আমি একাধারে দুই গ্লাসের বেশি বিয়ার নিই না। কিন্তু ইবসুকাকে ফিরাতে পারলাম না। সে কাউন্টার থেকে দুই গ্লাস বিয়ার নিয়ে এসে হেসে বললো, “তুমি হয় তো বিশ্বাস করবে না। নরওয়েতে এই প্রথম আমি কোন পুরুষকে বিয়ার কিনে দিলাম।”

আমি ধন্যবাদ দিলাম, এবং সাথে যোগ করলাম, “তাহলে কি আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবো?”

“না, তেমনটি মনে করার প্রয়োজন নেই। তবে বন্ধু মনে করতে পারো।”

আমি এতোটা আশা করিনি। বললাম, “থ্যাংক ইউ ফর অফারিং ফ্রেন্ডশিপ। ইট’স এ্যাকসেপ্টেড।”

আমরা হাত মিলালাম। তারপর কথায় কথায় ইবসুকা ফের আমার বিদেশে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলো। এবার আর আমি এড়াতে পারলাম না। বেশ বিস্তারিতই বললাম। সব শুনে ইবসুকা একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বেশ গম্ভীর মুখে তার ঠাকুরদার কাছে শোনা একটা গল্প বলতে শুরু করলো।

কালাহারি মরুভূমির বতসোয়ানা অংশে ওলিয়াগ মিআ নামে একটা বিরাট গোত্র ছিল। নামে গোত্র হলেও জনসংখ্যা ও আয়তনে এটি ছিল ছোট ছোট প্রায় গোটা বিশেক গোত্রের একটি রাজ্য বা মহাগোত্র। বতসোয়ানা নামটাই তখনও হয়নি। জার্মানরা ও বৃটিশরা ভাগ করে দেশ পরিচালনা করলেও ওলিয়াগ মিআ গোত্রটির বাস ছিল যে দুর্গম এলাকায়, সেখানে তখনও কোন ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকদের প্রবেশ ঘটেনি। ফলে ওখানকার রাজ্যগুলো তখনও নিজেদের শাসনব্যবস্থায় চলতো। দেড়শ বছর আগে নারীপ্রধান এই মহাগোত্র বা রাজ্যটিতে সিহানা ওলিয়াগ নামে এক রাণী ছিলেন। (গোত্রটির নিয়মানুসারে নারীদের নামের সাথে গোত্রের নামের প্রথম অংশ মানে ওলিয়াগ এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে শেষাংশ মানে মিআ যোগ করার বিধান ছিল। মিআ ঠিক বাংলা ‘মিয়া’-এর মতো নয়, ইবসুকা যেভাবে উচ্চারণ করে তাতে খুব ক্ষুদ্র মি এবং একটা লম্বা আ-এর মতো শুনায়, যাকে মিআ লিখলে কোনরকমে বুঝানো যায় বলে আমি মিয়া না লিখে মিআ লিখেছি।)

রাণী সিহানা ছিলেন খুব বদরাগী। যে কোন তুচ্ছ কারণে গোত্রের লোকদের শাস্তি দিতেন। তবে গোত্রের প্রাচীন নিয়মানুযায়ী সে শাস্তি কখনোই মৃত্যুদণ্ড ছিল না, ছিল সমাজচ্যুত করে গোত্র থেকে বহিষ্কার। সমস্যা হলো, যাদের ভাগ্যে বহিষ্কারাদেশ জুটতো, তারা কেবল গোত্রছাড়া হয়েই পার পেতো না; অনেকেকেই দেশছাড়া হতে হতো, কারণ অন্য মহাগোত্রগুলোর সাথে ওলিয়াগ মিআ মহাগোত্রটির সম্পর্ক ছিল শত্রুতামূলক। কেউ গোত্রছাড়া হলে তাকে অন্য কোন গোত্র আশ্রয় দিতো না; হয় তাকে শহরে গিয়ে বেমানান জীবনযাপনে অভ্যস্থ হতে হতো, নয় দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দিয়ে শ্রমের নামে ইংরেজদের দাসত্বে বন্দী হতে হতো। কালাহারির সিংহ, চিতা এবং হায়েনার পেটেও যেতে হতো অনেককে। এজন্য রাণী সিহানাকে খুব ভয় করে চলতো তার প্রজা, কর্মচারী ও অনুচরবর্গ।

লোকে বলাবলি করতো রাণীর এই দুর্ব্যবহারমূলক আচরণের পিছনে দায়ী তাঁর কামহীন জীবন। প্রায় এক যুগ আগে রাণীর স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই রাণী এভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ওলিয়াগ মিআ গোত্রের নিয়মানুযায়ী কোন রাণীর স্বামী মারা গেলে তিনি কেবল তখনই বিয়ে করতে পারবেন, যদি রাজ্যের শাসনভার অন্য কোন রাণীর হাতে তুলে দেন।

এরকম অত্যাচারী হয়েও রাণী নির্বিঘ্নে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারতেন তাঁর একদল অনুগত, নিবেদিতপ্রাণ ও সুবিধাভোগী আমাত্য থাকার সুবাদে। এই আমাত্যবর্গ রাণীর সব কাজে চোখ বুঁজে সায় দিতেন। গোত্রের সাধারণ প্রজারা এতোটাই শক্তিহীন ছিল যে, তারা এতে আপত্তি তুলতে পারতো না। তাদের আপত্তির কারণও খুব একটা ছিল না অবশ্য; কোন ব্যক্তিবিশেষকে নির্বাসিত করলে সেই ব্যক্তিটিই কেবল গোত্রছাড়া হতো না, পুরো পরিবারটিকেই গোত্রত্যাগ করতে হতো। এতে গোত্রের সম্পদের ভাগ কমে যেতো।

এভাবেই চলছিলো ওলিয়াগ মিআয় রাণী সিহানার শাসনকার্য। কিন্তু এক বসন্তে সব কিছু ওলট-পালট হয়ে গেলো।

প্রায় প্রতিদিনকার মতো সেদিনও বিকেলে রাণী তাঁর কিছু সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন। এদিক-সেদিক কিছুক্ষণ হাঁটার পরে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য তাঁরা একটি এ্যাকাশিয়া গাছের তলায় বসলেন। সেখানে বসতেই রাণী খুব ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পেলেন।

কালাহারির ক্যাকটাসের বিচিত্রসব গন্ধ হয়। সে-বছর তুলনামূলক বেশি বৃষ্টি হওয়ায় ক্যাকটাস গাছগুলোতে খুব ফুল এসেছিল। রাণী সিহানা ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই কোন নতুন প্রজাতির ক্যাকটাস হবে। তিনি ফুলটা দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

রাণী সিহানার ইচ্ছের মূল্য তাঁর সাঙ্গ-পঙ্গদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। তারা সেই বিশ্রী তীব্র গন্ধটাকে শুঁকে শুঁকে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করে করে হয়রান হয়ে গেলেন, কিন্তু গন্ধটার কোন উৎসই খুঁজে বের করতে পারলেন না। রাণী তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গদের আচ্ছামত বকলেন। তিনি তাদের ভয় দেখালেন যে, তারা যদি আজই এই গন্ধের উৎস খুঁজে বের করতে না পারে, তবে সবাইকে গোত্রছাড়া করবেন।

রাণীর সঙ্গীরা ভয়ে ভয়ে আরো কিছুক্ষণ গাছের, ফুলের, পাতার, কাণ্ডের গন্ধ শুঁকলেন এবং যথারীতি ব্যর্থ হলেন। রাণী বুঝলেন যে তারা কোন সমাধান দিতে পারবে না। তিনি তাঁর প্রিয় কুকুর লিশপুকে আনতে নির্দেশ দিলেন। সাভানাতে পশু শিকারের জন্য রাণীর বেশ বড় একদল পোষা কুকুর ছিলো। রাণীর নির্দেশমতো লিশপু দুই মিনিটের মধ্যেই একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে গন্ধের উৎস বের করে ফেললো। সে উৎস আর কিছু ছিল না, ছিল কোন এক ব্যক্তির বিষ্টা।

গল্পের এই পর্যায়ে আমি ইবসুকাকে আর না থামিয়ে পারিনি। “বল তো ইভ, তুমি যা বলছো, এটা কী সত্যিই তোমার ঠাকুরদা তোমাকে বলেছে, নাকি এ্যালকোহলের প্রভাবে তুমি বাজে বকছো?”

ইবসুকা হেসে দিলো। “সে তুমি যা ভাবো। তবে জেনে রাখো, এই সাড়ে চার পার্সেন্টের চার-পাঁচ গ্লাস বিয়ারে আমার ঠিক ধরে না। আমি হার্ড ড্রিংক করার মানুষ। এখানে আসি কেন সে তো তোমাকে বলেছি।”

আমি আর কথা বাড়াতে চাইছিলাম না। কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন খোঁচাতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম। “তুমি যেভাবে বলছো, তাতে মনে হচ্ছে তোমার গল্পের দেশে মানুষ মলত্যাগ করে না। আর করলেও দেড়শ বছর আগে ঐ মরুভূমিতে স্বাস্থ্যসম্মত ঢাকা পায়খানা ছিল।”

ইবসুকা আমাকে একটু ধমকের সুরেই বললো, “আগে গল্পটা তো শেষ করতে দাও। তোমার প্রশ্নের জায়গাতে আসছি।” এই বলে সে ফের তার গল্প শুরু করলো।

বিষ্টার যে এমন তীব্র দুর্গন্ধ হতে পারে, এটা রাণী সিহানা কোনদিন কল্পনাও করেননি। আসলে একসময় ছিলেন রাজকন্যা, পরে হয়েছেন রাণী। নিজের বিষ্টা ছাড়া অন্যদের বিষ্টা তিনি খুব কমই দেখেছেন। ওলিয়াগ মিআতে পাকা পায়খানা না থাকলেও যেখানে সেখানে পায়খানা করার বিধান ছিলো না। সিহানার মায়ের পূর্বে একজন সুন্দরী ও শুচিবায়ুগ্রস্থ রাণী ছিলেন। তিনি এই বিধান চালু করে যান। রাণী সিহানা বিষ্টাটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন এবং প্রাণভরে গন্ধ শুকলেন। তাঁর কুকুর লিশপু বারবার বিষ্টাটা খেতে চাচ্ছিলো, তিনি তাও প্রতিরোধ করলেন। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরে তাঁর মধ্যে এক ভিন্নরকম প্রতিক্রিয়া হতে শুরু করলো। বিষ্টার তীব্র দুর্গন্ধে তাঁর ভিতরে এক হরমোনাল বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। দীর্ঘ কামহীন রাণী বিষ্টার দুর্গন্ধে অর্গাজমের মতো এক তীব্র সুখ অনুভব করলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, এর চেয়ে সুখকর আর কিছু হয় না; পৃথিবীতে এর চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই।

পরদিনই রাণীসভায় রাণী ঘোষণা দিলেন যে, তাঁর রাজ্যে আবার পূর্বের নিয়ম চালু হবে; মানুষ আবার যেখানে সেখানে মলত্যাগ করতে পারবে।

কয়েকদিন পরে রাণী পথে বেরিয়ে দেখলেন, কোন জায়গা থেকে সামান্যতমও বিষ্টার গন্ধ আসছে না। প্রজা ও আমাত্যবর্গ তার কথা শুনছে না দেখে তিনি মনে মনে খুব রেগে গেলেন। রাণীসভায় পরদিন তিনি আইন জারি করলেন এই বলে যে, সবাইকে বাধ্যতামূলক বাইরে মলত্যাগ করতে হবে, এবং রাণী যে পথে হাঁটতে বের হন, সেই পথের পাশে মলত্যাগ করে রাখতে হবে। রাণীর সুবিধাভোগী আমাত্যবর্গ্য মুহূর্তের মধ্যেই তা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দিলো।

পরদিন বিকেলে রাণী আবার বের হলেন। তাঁর চলার পথে বিষ্টা ছড়ানো দেখে এবার তিনি খুব খুশী হলেন। তিনি প্রাণভরে গন্ধ শুঁকলেন এবং আবারও অর্গাজমের তীব্র সুখ অনুভব করলেন। এরপর থেকে তিনি প্রতিদিনই বের হতে শুরু করলেন এবং সুখানুভবে ডুবে যেতে থাকলেন।

এভাবে কয়েকদিন চলার পরে রাণী দেখলেন, কারো কারো বিষ্টা থেকে খুব একটা দুর্গন্ধ আসে না, আবার কারো বিষ্টা থেকে খুব বেশি দুর্গন্ধ আসে। তিনি তাঁর সুবিধাভোগী আমাত্যবর্গকে নিয়ে আবার সভা ডাকলেন। কিভাবে প্রজাদের বিষ্টা থেকে দুর্গন্ধ বাড়ানো যায়, তার উপদেশ চাইলেন সভাসদ ও সভাপণ্ডিতের কাছে। তারপর সে অনুযায়ী রাজ্যে প্রচার করে দিলেন।

ইবসুকা যখন গল্পের এই পর্যায়ে এলো, আমি বমি বমি বোধ করছিলাম। সে যে এতো বিশ্রী কোন বিষয় নিয়ে গল্প ফাঁদবে, এটা বুঝলে আমি গল্প শুনতেই রাজি হতাম না। একবার ভাবলাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে যাই; আরো দেরি হলে আমার মেয়ে অপেক্ষা করে করে ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু গল্পের বাকিটুকু না শুনে গেলে মনের ভিতর খোঁচাতে থাকবে। তাই যত অস্বস্তিই হোক, আমি পুরোটা শুনে যাওয়া মনঃস্থ করলাম। ইবসুকা আমার মনের অবস্থা সম্পর্কে কিছুই টের পায়নি। সে তার মতো করে বলে যাচ্ছিল।

কিছুদিন পরে রাণী দেখলেন যে আমাত্যবর্গ ও পণ্ডিতের সুপারিশে বিষ্টার গন্ধের খুব একটা রকমফের হলো না। তিনি রেগে গিয়ে এক নতুন আদেশ জারী করলেন- তিনি সবার বিষ্টার গন্ধ পরীক্ষা করবেন এবং যার বিষ্টা থেকে একটা নির্দিষ্টমাত্রার কম দুর্গন্ধ আসবে, তাকে গোত্রছাড়া করবেন।

যেই কথা সেই কাজ। পরদিন তিনি নিজেই তাঁর আমাত্যবর্গের বিষ্টা পরীক্ষা করলেন, এবং কেবল তাদেরই আমাত্য হিসেবে রাখলেন যাদের বিষ্টার দুর্গন্ধ সম্পর্কে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলেন। বাকিদের কপালে জুটলো নির্বাসন। প্রজাদের মধ্য থেকে কিছু অধিক দুর্গন্ধযুক্ত লোক নিয়োগ দিয়ে তিনি একটি নতুন অনুগত আমাত্য পরিষদ গঠন করলেন। ক্রমে তিনি তাঁর রাজ্যের সব কর্মক্ষম প্রজাদের মধ্যে তাঁর পরীক্ষাকার্য বিস্তার করলেন। অনেক প্রজাই হাবিজুবি খেয়ে কোনরকমে পরীক্ষা পাশ করলেও কিছু প্রজা কোনভাবেই রাণী সিহানার মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারলো না। তাদের কপালেও জুটলো গোত্রত্যাগ।

রাণী সিহানা এতেই থামলেন না। তিনি মাঝে মাঝেই প্রজাদের বিষ্টার দুর্গন্ধ পরীক্ষা করতে লাগলেন এবং আইনানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত রাজ্যে শিশু ও বৃদ্ধ ছাড়া এমন কোন লোক ছিল না, যাদের বিষ্টায় দুর্গন্ধ আসে না, এমন কোন স্থান ছিল না যেখানকার বাতাস বিষ্টার দুর্গন্ধে ভরপুর ছিলো না। এর ফল হলো এই যে, পুরো ওয়ালিগ মিআর মানুষ রাণীর মতোই দুর্গন্ধ-ফ্রিকে পরিণত হলো। কোন কারণে যদি তারা বিষ্টাহীন কোন জায়গায় শিকারে বা অন্য কাজে যেতো, তাদের কাছে মনে হতো তারা বুঝি শ্বাসবন্ধ হয়ে সেখানেই মারা যাবে।

এভাবে ভালোই চলছিল ওয়ালিগ মিআ গোত্রে রাণী সিহানার শাসন। আশেপাশের রাজ্য থেকে তাদের গোত্রের এই আচরণের সমালোচনা করা হলেও রাণী সিহানা বা তাঁর রাজ্যের লোকদের কিছু যেতো-আসতো না; ওয়ালিগ মিআকে কারো মুখাপেক্ষী হতে হতো না; তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু রাণী সিহানার জন্য সমস্যা আসলো তাঁর রাণীপ্রাসাদের অভ্যন্তর থেকে। এক সভায় একজন আমাত্য কথাপ্রসঙ্গে বললেন, “আমরা যারা এই রাজ্যে বাস করি, সবার মল থেকেই খুব দুর্গন্ধ আসে। কিন্তু আমাদের রাণীর মল থেকে কেমন গন্ধ আসে, সেটা কিন্তু আমরা কেউই জানি না।”

তার কথায় সবাই সায় দিলেন। তারা রাণী সিহানার বিষ্টার দুর্গন্ধের মাত্রা পরীক্ষা করার দাবী তুললেন। রাণী প্রথমে কিছুটা চেষ্টা করলেন সবাইকে নিবৃত্ত করার। কিন্তু দুর্গন্ধ-ফ্রিক আমাত্যরা এবার আর রাণীর কথায় পাত্তা দিলেন না। সুতরাং রাণীকে সেদিনই পরীক্ষায় বসতে হলো, এবং তাতে তিনি তাঁর নিজের নির্ধারিত মানদণ্ডে অকৃতকার্য হলেন।

ফলাফল যা হবার তাই হলো। অন্যদের মতো রাণীর ভাগ্যেও জুটলো গোত্রত্যাগ।

ইবসুকা যখন গল্পটি শেষ করলো, তখন রাত প্রায় দশটা। নরওয়েজিয়ান শীতকালের বিচারে সন্ধ্যার পরেও প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। আমি তার আষাঢ়ে গল্পটি শুনে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এমন বিশ্রী কোন গল্প হতে পারে, তা আমি কোনদিন কল্পনাও করিনি। ইউরোপীয় সভ্যতায় বাস করছি, এই বিবেচনায় গল্প শুনানোর জন্য তাকে ধন্যবাদ দিলাম এবং বললাম, “ইভ, এবার যদি বিদায় দাও, তাহলে উঠবো।”

ইবসুকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ নিঃস্পৃহভাবে বললো, “তুমি আমার গল্পটা বিশ্বাস করোনি, তাই তো?”

আমি এবার আর মনের কথাটা চেপে রাখতে পারলাম না। “সত্যি কথা বলতে কী, আমি বোধ হয় তোমার মতো অতোটা ‘গালিবল’ নই যে তোমার ঠাকুরদার বলা এই গাঁজাখুরী গল্পটাকে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।”

ইবসুকা পূর্বের মতোই নিঃস্পৃহভাবে বললো, “তুমি যা ভাল বোঝ।”

আমার আর কোন কথা ছিল না। তবু বের হবার আগে বললাম, “আজ তুমি আমাকে বিয়ার খাওয়ালে। আমাকেও যদি একদিন খাওয়ানোর সুযোগ দাও, তাহলে ধন্য হবো।”

ইবসুকা বেশ প্রশস্ত এক হাসি দিলো এবং বললো, “অন্য পুরুষদের মতো ভান না করে মোবাইল নম্বরটা চাইলেই পারতে।”

আমি কথা বাড়াতে চাইলাম না। অনেকটা তাকে অনুকরণ করেই বললাম, “তুমি যা মনে করো।”

ইবসুকা তার পার্স থেকে একটা কলম ও কাগজ বের করে তার নম্বরটা লিখে আমার হাতে দিলো। কাগজটা হাতে নিয়ে মানিব্যাগে ঢুকাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো তার নামের শেষাংশে। আমি থমকে গেলাম। “তুমি…”

“হ্যাঁ, আমি … আমি রাণী সিহানার বংশধর,” মুচকি হাসি দিয়ে বললো ইবসুকা।

আমি আর পানশালা থেকে বের হতে পারলাম না। “মানে তুমি কি সরাসরি সেই রাণীর বংশধর, নাকি একই গোত্রের অন্য কোন বংশের?”

ইবসুকা আবারও মুচকি হাসলো। “সেই রাণীর বংশধর,” সে বললো। “রাণী সিহানা দেশ ছেড়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিয়েছিলেন। তারপর সেখান থেকে সোয়াজিল্যান্ড। আমার জন্ম সোয়াজিল্যান্ডে। আমার বাবা-ঠাকুরদার জন্মও সেখানে।”

“আর সেই গোত্র, মানে ওয়ালিগ মিআ গোত্রের অন্যদের কী হলো? মানে যারা ওখানে ছিলো, তারাও নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে এখন?” আমি বললাম।

“তারা নেই।“

“মানে?”

পানশালার আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম ইবসুকার মুখে মেঘের মতো এক টুকরো দুঃখের ছায়া ছড়িয়ে পড়লো। তবে কণ্ঠে সেটা আমাকে বুঝতে দিলো না। উদাসীনতার ভাব এনে বললো, “ঠাকুরদার কাছে শুনেছি একবার কলেরা লেগে পুরো ওয়ালিগ মিআ গোত্রটাই নাকি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।”

Leave a Comment