লেখকঃ দূরের পাখি

ধর্মীয় উপকথা ও উপাখ্যানগুলোর সবগুলোরই শুরু তো কোন না কোন একটা আজগুবি কাহিনী থেকেই। কিন্তু এইসব আজগুবি কাহিনীর ভিতরে কিছুটা হলেও ঐতিহাসিক সত্য থাকে। অন্ততপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম যেই ঠগবাজ প্রথম যে নির্বোধের দেখা পেয়েছিলো তাদের কাহিনীগুলো কিছুটা হলেও দলিলপত্রের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করা যায়। আর সব প্রাচীন ধর্মগুলোর তুলনায় নিতান্ত শিশু বয়সের মর্মন ধর্ম বা আহমদিয়া ধর্ম বা সায়েন্টোলজির প্রবর্তকদের রক্তমাংসের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় তাদের সমকালীন বিভিন্ন দলিলপত্র থেকে। বিশ্বাসীদের লেখা উপাখ্যান বাদ দিয়ে সরকারী নথিপত্র, তৃতীয় পক্ষের কারো লেখা স্মৃতিকথা বা অনেক ক্ষেত্রেই মামলার ধারাবিবরনী থেকে।

প্রাচীন ধর্মগুলোর মধ্যে এখনকার ঐতিহাসিকদের বৈজ্ঞানিক কাঁটাছেড়ার নীচে সত্যিকারের রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছেন খুব কম সংখ্যক ধর্ম প্রবর্তকই। গ্রিক, মিশরীয়, নর্ডিক ও ইন্ডিয়ান রূপকথার আগডম বাগডম অবতারদের কথাতো বলাই বাহুল্য, গৌতম বুদ্ধ ও বাইবেলের আদিপুস্তকের মুসা, আব্রাহামকেও হালের বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চাকারীরা কল্পিত চরিত্রের বাইরে কিছু বলে স্বীকার করেন না। অবশ্য এইসব বিচার যে আপাত সময়ের জন্য সেটা মানতে তাদের দ্বিধা নেই। নিদেনপক্ষে এইটুকু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারেন যে, স্বিদ্ধার্থ বা আব্রাহামের রক্তমাংসের, ঐতিহাসিক অস্তিত্বের কোন প্রমাণ আমাদের কাছে নাই।

শৈশবের ধর্মীয় মগজধোলাইয়ের কারণে পরিণত বয়সে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক ভিতরে প্রবেশ করে গিয়েও যারা ধর্মীয় চুলচামড়ার ব্যাপারে নিজেদের মাথাকে ঠিকমত প্রয়োগ করতে পারেন না এমনসব ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক আছেন যারা এখনো খড়কুটোর মত ধরে আছেন প্রাচীন পুঁথির লেখাকে তাদের ঈশ্বর বা অবতারের অস্তিত্বের দলিল হিসেবে। অথচ মানুষের সামগ্রিক সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের বিকাশ এবং সংস্কৃতির প্রবাহ দেখলে খুব প্রকটভাবেই দেখা যায় মানুষ কত রকমের দৈত্য ও দেবতা ও অতিমানব বারবার তৈরী করেছে গল্পে, নাটকে, পুঁথিতে। এই যে গত দুই তিন শতাব্দী ধরে কোটি কোটি আনিমে, কার্টুন, কমিক্স চরিত্র তৈরী করেছে মানুষ – ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, চাচা-চৌধুরী, দোরাএমোন, হাল্ক – আরো কয়েক শতাব্দী পরে কি তাহলে ধরে নিতে হবে একসময় এরাও রক্তমাংসের মানুষের সাথে পৃথিবীতে দৈনন্দিনের জীবনযাপন করে গিয়েছেন? প্রশ্নই আসে না ।


এমনতর দুনিয়ায় প্রাচীন পৃথিবীর রূপকথার মানবদের মধ্যে প্রমত্তা নদীর ভাঙগনের তোড়ে অস্তিত্ব ভেসে যেতে যেতে কোনরকমে এখনো টিকে আছেন দুইজন। যিশু ও মোহাম্মদ। যিশুর ঘর এরই মধ্যে প্রায় যায় যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডের কিছু অতিমানবীয় প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী ধর্মতাত্ত্বিকরা (David Strauss , Rudolf Bultmann) শুরু করেছিলেন যিশুর সত্যিকারের রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে যাচাই বাছাই। অবশ্য তারা আসলে ঠিক এই জায়গা থেকে শুরু করেননি । তারা শুরু করেছিলেন বাইবেলের নতুন পুস্তকে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিচার। কান টানলে একসময় না একসময় মাথা যেহেতু আসেই, সেই অমোঘ নিয়মে তাদের যুগে তারা যে প্রশ্ন খুব বেশি জোর দিয়ে তোলেননি, সেই প্রশ্ন এখনকার আরো তাঁতানো, আরো সিদ্ধ ধর্মতাত্ত্বিকরা তোলা শুরু করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে নতুন পুস্তকের বেশিরভাগ ঘটনাই যদি হয় রূপকের মাধ্যমে নৈতিকতা ও জীবন নিয়ে গভীর কোন জ্ঞান দেয়ার চেষ্টা, তাহলে সেই একই বিচারে কেন যিশু রূপক গল্পের একটা চরিত্রের চাইতে বেশি কিছু হবেন?


ঘটনার শুরু ধর্মতত্ত্বেও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত নিছক সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির প্রয়োগ থেকে। ধর্মগ্রন্থের পাতায় পাতায় বর্ণিত যেসব রূপকথা ও অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, বিজ্ঞানের যুগে এসে দেখা গেলো শত রকমের চেষ্টা করেও সেসবের ধারেকাছের কিছুও পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধির অধিকারী যে কারো কাছে তখন মনে হওয়ারই কথা যে এইসব উদ্ভট ঘটনা কেনো কেবলই সূদূর অতীত ছাড়া আর কোথাও ঘটে না। ঐতিহাসিকের কাছে যদি টাইম মেশিনের মত কোন যন্ত্র থাকতো তাহলে তিনি হয়তো ধর্মপুস্তকে উল্লেখিত ঘটনার সময় ও স্থানে যথাযথভাবে হাজির হয়ে দেখে আসতে পারতেন সত্যিকার অর্থে কী ঘটেছিলো ঐখানে, ঐদিনে। সাতমণ ঘি এর যেহেতু যোগাড় সহসা হচ্ছে না, সেহেতু যৌক্তিক ধর্মতাত্ত্বিকেরা তখন সরে আসলেন সে পথ থেকে। নিশ্চয়তার পথ। ঐতিহাসিকের জন্য এখন কেবল বিচারের অবসর আছে কোন ধরণের ঘটনা ঘটার সম্ভাবণা বেশি। বড়জোর এইটুকু বিচার দেয়া যেতে পারে । যেহেতু বর্তমানে কোন অলৌকিকতার বিন্দুমাত্র পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু অতীতের বর্ণীত সব উদ্ভট রূপকথাকে প্রায় অসম্ভব বলেই ধরতে হচ্ছে।


বর্ণীত অলৌকিক ঘটনা বাদ দিলে ধর্মীয় পুস্তকের বর্ণনাগুলোতে বাকি থাকে কি? বাকি থাকে ধর্মপ্রবর্তকের বা যার নামে ধর্ম প্রবর্তীত হয়েছে তার কিছু নিতান্ত সাধারণ আটপ্রহরের জীবনের কাহিনী আর কিছু নৈতিক ও জীবনধারণের পদ্ধতি সংক্রান্ত শিক্ষা। এইসব শিক্ষা এমন কোন অতি ক্ষুরধার চিন্তা ও দর্শনের গভীর থেকে উদ্ভুত, এমন কিন্তু নয়। মানুষের সামাজিক বিকাশের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কথিত যিশু, বুদ্ধ, মুহাম্মদের অনেক আগে থেকেই মানুষ ঐ সব জানে। এইসব শিক্ষা যিশুর নাম করে কেউ প্রচার করলেই সেটা যিশুর আবিষ্কার হয়ে যায় না। উল্টো দিকে আবার এও ঠিক যে মানুষের সমাজে প্রচলিত জ্ঞান ও নৈতিকতাকে নতুন করে একটু সংস্কারের বা সবাইকে সেইসব শিক্ষা মেনে চলতে বলা নেতা বা বিপ্লবীর আবির্ভাব হামেশাই হয়েছে, হচ্ছে । অর্থাৎ চর্বিত চর্বন শিক্ষা দিয়েছে বলেই যিশু বলে কেউ ছিলো না এটা বলার উপায় নাই।


তাহলে কেনো যিশুর রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে? একেবারে গভীরে এর কারণ হচ্ছে প্রশ্নটি খুবই কৌতুহলউদ্দীপক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইন্টারেস্টিং। কে না জানে যে মানুষ কেবল কৌতুহল আর বুদ্ধির চ্যালেঞ্জের জন্য প্রায়োগিক দিক থেকে বিন্দুমাত্র কোন উপযোগ না থাকা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে জীবনকে জীবন ব্যয় করেছে অবলীলায়। যিশুর পার্থিব অস্তিত্বের বিষয়টি নিয়ে এক শতাব্দীরও আগে যখন যৌক্তিক ধর্মতাত্ত্বিকরা আলোচনা শুরু করেছিলেন তখনও এই প্রশ্নের প্রায়োগিক উপযোগীতা ছিলো অনেকখানি। ধর্ম তখনো মানুষের জীবনের বিশাল বড় একটা অনুসঙ্গ হিসেবে ছিলো । বর্তমান শতকে এসে খ্রিষ্টান ধর্মের যে রূপরেখা দাঁড়িয়েছে তাতে প্রশ্নটির প্রায়োগিক উপযোগীতা খুব একটা নাই । বিশেষত বর্তমান পোপের আগমনের পরে। তবু এতে তার বুদ্ধিবৃত্তিক গুরুত্ব বিন্দুমাত্র কমেনি ।

যিশুর জাগতিক অস্তিত্বের একটা সুরাহা করার উদ্দেশ্যে প্রথম ধাপে ঐতিহাসিকরা ও নৃতাত্ত্বিকরা শুরু করলেন বাইবেলের প্রাচীন পুঁথিগুলোর সন্ধান। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রথম শতকের শুরুর দিকে যিশুর জন্ম ও মোটামুটি মধ্য ত্রিশের দিকে তার ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়ার কথা প্রচলিত কাহিনী অনুসারে। এখন যিশুর জীবন ও কর্মের যে উপাখ্যান আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে সেগুলোর প্রধান উৎস হচ্ছে বাইবেলের নতুন পুস্তকের চারটি আলাদা বিবরণী। ম্যাথিউ, মার্ক, লুক এবং জন। যদিও এই চারটি বিবরণী বর্তমান বাইবেলের নতুন পুস্তকের প্রথম চারটি অধ্যায় হিসেবে আছে, খোঁজ করতে করতে জানা গেলো এগুলোর সবচে প্রাচীন পুঁথিটিও প্রথম শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে প্রথম আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ প্রচলিত কাহিনীর যিশুর মৃত্যুর প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর পরে। তার আগের কোন কিছু নাই। অন্যদিকে দেখা গেলো খ্রিষ্টান ধর্মের আদি কালের সবচে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, অনেকের মতে খ্রিষ্টান ধর্মের আসল আদি পিতা, সন্ত পল (Saint Paul) এর তেরটি চিঠি, যেগুলো এপিসল (Epistle) নামের একটি অধ্যায়ের ভিতরে জড়ো করা হয়েছে, ঐতিহাসিকভাবে সেগুলোই খ্রিষ্টান ধর্মের সবচে প্রাচীন দলিল। এগুলোর আবির্ভাবের সময়কাল মোটামুটি মধ্য প্রথম দশকের দিকে, কথিত যিশুর মৃত্যুর ত্রিশ চল্লিশ বছর পরে।


সন্ত পলের তেরটি চিঠি থেকে যিশুর মানবিক জীবনের কোন কাহিনী পাওয়া যায় না। বরং সবগুলো চিঠি থেকে প্রতীয়মান হয়, পল যে যিশুরু কথা বলছেন সেই যিশুরু জন্ম ও মৃত্যু সবই মূলত প্রথম আসমানে, এবং তার সাথে পলের যোগাযোগও কেবল আধ্যাত্নিক মাধ্যমেই। কেবল একটা জায়গায় পাওয়া যায় জেরুজালেমে গিয়ে পল যিশুর ভাই জেমসের সাথে দেখা করেছেন। সেই বর্ণনাতেও পল জেমসকে “যিশুর ভাই”, ঠিক এইভাবে বলছেন না, বলছেন আমাদের প্রভুর ভাই। যিশুকে যারা সত্যিকারের ইতিহাসের মানুষ বলতে চান তাদের বড় একটা যুক্তি হচ্ছে এই প্রভুর ভাই এর সাথে দেখা করার কথা উল্লেখ করার যুক্তি। যেকোন ধর্মেই সমধর্মের মানুষকে ভাই বলার অথবা ধর্মের পথে জীবন উৎসর্গ করে দেয়া লোকজন একে অপরকে ভাই বলে ডাকার প্রচলন দেখা যায় খ্রিষ্টান ধর্মেরও আগের থেকে। পলের নিজের বর্ণনাতেই যিশুর জীবন ও কর্মের কোন অংশ তার নিজের দেখা এমন যেহেতু নাই, সেহেতু এই যুক্তি খুবই দুর্বল।


অন্য দিকে ঘটনা আরো ঘোলাটে হয়ে উঠে যখন খ্রিষ্টান ও অখ্রিষ্টান দুই দিকেরই যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক ও ভাষাগত বিবর্তনের মাধ্যমে পলের চিঠিগুলো নিয়ে গবেষণা করা তাত্ত্বিকরা দেখালেন যে পলের নামে প্রচলিত চিঠিগুলোর অন্তত ছয়টি পুরোপুরিই জোচ্চুরি। অন্য কেউ লিখে পলের নামে চালিয়ে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে বাকী সাতটি চিঠিও ঠিক কিভাবে পল নামে কারো নিজের হাতে লেখা বলে নিশ্চিত হওয়া যায়? হওয়া যায় না। বর্তমান যুগের বৈপ্লবিক তাত্ত্বিকদের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ রবার্ট প্রাইস (Robert M Price) বলেন পলের নামে প্রচলিত ১৩ টি চিঠির সবগুলোই বানোয়াট । রবার্ট প্রাইস নিজে ধার্মিক হিসেবে জীবন শুরু করে, বাইবেলের ইতিহাস ও নতুন পুস্তকের উপর দুইবার পিএইচডি করে এখন নিজে নাস্তিক এবং যিশু যে পুরোপুরিই রূপকথার চরিত্র এই মতবাদের সবচে ভারী ও প্রধান শিক্ষক। এছাড়াও আছেন রিচার্ড ক্যারিয়ার(Richard Carrier) ও হেক্টর আভালস (Hector Avalos), আর্ল ডুহার্টি (Earl Doherty) সহ আরো একঝাঁক নতুন যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ইতিহাসের অনুসন্ধানকারী যিশু গবেষক। এরা প্রথম শতাব্দীর আশেপাশের ইতিহাস ও বাইবেলের পুরাতন সব পুঁথির সূক্ষ্ণ ও চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে দেখিয়েছেন যিশু নামের সত্যিকারের কারো অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সন্দেহ করার যথেষ্ঠ কারণ কাছে এবং খ্রিষ্টান ধর্মের মত একটা ধর্মের উৎপত্তির জন্য আসলে সত্যিকারের যিশুর কোন দরকারও নাই।

সন্ত পলের নামে প্রচলিত চিঠিগুলোর পরে আসে যিশুর জীবন কর্ম ও মৃত্যু বিষয়ক বাইবেলের নতুন পুস্তকের চারটি অধ্যায় – ম্যাথিউ, মার্ক, লুক ও জন এর বর্ণীত ঘটনার কথা। একই লোকের চারটি আলাদা আলাদা জীবনী হলেও এই অধ্যায়গুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখা যায় একেকজনের কাহিনীতে নতুন নতুন উদ্ভট সংযোজন, বিয়োজন, বিচ্যুতি, গোঁজামিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে একজনের বর্ণনার সাথে আরেকজনের বর্ণনার বিস্তর অমিল । খ্রিষ্টান ধর্মতাত্ত্বিকরা মনে করেন ম্যাথিউ ও মার্ক দুইজনেই আরো প্রাচীন একটা হাইপোথেটিকাল সোর্স থেকে নিজেদের মত করে যিশুর জীবনী লিখেছেন। এই তাত্ত্বিক সোর্সকে নাম দেয়া হয়েছে সোর্স কিউ(Q)। এই সোর্সের সত্যিকারের কোন অস্তিত্ব কোথাও পাওয়া যায় নাই। যিশুকে যারা সত্যিকারের ঐতিহাসিক চরিত্র বলতে চান, তাদের মত হচ্ছে আগের যুগে মানুষ যেহেতু মুখে মুখে ঘটনা মনে রাখতো, সেহেতু ম্যাথিউ মার্ক লুক এবং জন এর লেখককদের কেউই সত্যিকারের যিশুকে না দেখলেও তাদের কথা বিশ্বাস করা যায়। অথচ এই মুখে মুখে প্রচলনের অন্য কোন সোর্স এরা দেখাতে পারেন না।


ঘটনার আরো ইন্টারেস্টিং দিক হচ্ছে কথিত যিশুর জন্ম জীবন ও মৃত্যুর কথিত সময়ের আগের, ঐ সময়ের এবং তার অব্যবহিত পরের অনেক ঐতিহাসিক বিবরণ, চিঠি, বই পাওয়া যায় যেগুলোতে তৎকালীন রোমান প্রদেশ জুডায়ার (বর্তমান ইজরায়েল ও তার আশেপাশের অঞ্চল) রাজনৈতিক, দৈনন্দিন অনেক ঘটনার বিবরণ আছে, কিন্তু এগুলোর কোনটিতে যিশু নামে কারো কথার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। সবেধন নীলমণি একটা অনুচ্ছেদ পাওয়া যায় জোসিফাস (Flavius Josephus) নামে এক প্রাচীন ইহুদি ঐতিহাসিকের লেখা এক বইয়ে, তাও প্রথম শতাব্দীর ৯৩-৯৪ সালের দিকে। এই প্যারাগ্রাফ অবশ্য পরের যুগের কোন খ্রিষ্টান পাদ্রীর নিজস্ব সংযোজন হিসেবে এখন সর্বজনস্বীকৃত। কারণ হচ্ছে জোসিফাসের নিজের আদর্শ, তার লেখা বইয়ের ভাষা ও বিবরণীর মধ্যে হুট করে এমন একটা প্যারাগ্রাফ খুবই বেখাপ্পা। জিনিসটা দাঁড়ায় অনেকটা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মধ্যে হুট করে একটা প্যারাগ্রাফে রাজতন্ত্রের চমৎকার সুফল সম্পর্কে একটা বর্ণনা পাওয়া গেলে যেরকম হবে তার মত। এর আরও পরে ট্যাসিটাস(Tacitus) নামে আরেক ঐতিহাসিকের বর্ণনায় যিশুর ব্যাপারে কিছু কথা আসে, কিন্তু ততদিনে খ্রিষ্টান ধর্মের কয়েকটা প্রজন্ম পার হয়ে গেছে । সেই বর্ণনা থেকে খ্রিষ্টানরা কী বিশ্বাস করে সেটাই পাওয়া যাবে, সত্যিকারের ইতিহাস না।


আবার অবতার হিসেবে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়া একজন ঈশ্বরের জীবন, সঙ্গী ও বিশ্বাসীদের শিক্ষা দেয়া এবং দুষ্টদের হাতে মারা যাওয়া, কিন্তু পরে মৃত্যুকে জয় করে আবার পূনঃরুত্থিত হওয়া, এই ছাঁচে তৈরী করা কাহিনীর অভাব ছিলো না সমসাময়িক মধ্যপ্রাচ্য ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। প্রায় প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভার্সন ছিলো একই গল্পের। মিশরীয়দের ওসাইরিস, জরোয়াস্ট্রিয়ানদের আহুরা মাজদা, সুমেরীয়দের এনকি-ডুক। সেই দিক থেকে যিশুকে ইহুদিদের এই অবতার গল্পের চরিত্র হিসেবে দেখাটাই যৌক্তিক, যেহেতু ঐতিহাসিক সত্যিকারের অস্তিত্বের কোন আধা-শক্তিশালী প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। বর্তমান তাত্ত্বিকদের আরো বেশ কয়েকটা ব্যাখ্যা আছে যিশু নামের একজনের কাল্পনীক অস্তিত্ব তৈরী হওয়ার পিছনে । এগুলোর কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা হয়তো কখনোই জানা যাবে না । কিন্তু সত্যিকারের যিশু বলে যদি কেউ থেকেও থাকে, তার কাছে পৌঁছানোর কোন রাস্তা অন্তত এখন আমাদের নাই।

……….

অনলাইনভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় পঠিত।

Leave a Comment