খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধ

ফাইট ক্লাবঃ পুরুষ প্রজাতির প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির পূনর্জাগরণ?

লিখেছেনঃ দূরের পাখি

বিনোদন ও সময় কাটানোর মাধ্যম হিসাবে বা চারপাশের হুজুগের কারণে উৎসাহী হয়ে অথবা জাত রক্ষা বা জাতে উঠার জন্য নির্দিষ্ট কোন সিনেমা দেখা লোকজনের কথা বাদ। আমার আগ্রহ মূলত দুইশ্রেণীর সিনেমা দর্শকদের নিয়ে। প্রথম শ্রেণী হচ্ছে যারা জীবনে কত অযুত নিযুত পরিমাণ সিনেমা দেখেছে তার সংখ্যা কেউ জানে না। বাংলা, ইংরেজি, তামিল, তেলেগু, হিন্দি, ভোজপূরী, নেপালি, কোরিয়ান, টার্কিশ এমন অনেক অনেক ভাষা এবং প্রায় সমস্ত প্রকরণের (genre) অসংখ্য মুভি এরা প্রতিনিয়ত দেখে থাকেন। বাস্তব জীবনের আড্ডায় আশেপাশে এরকম একজন থাকলে অন্তত “ঐযে কী যেনো মুভিটার নাম” এই ভেজালে পড়তে হয় না কখনো। আমার পরিচিত গণ্ডির ভিতরেই এরকম দুএকজন আছেন এনসাইক্লোপিডিয়া পর্যায়ের। এর মধ্যে একজন আছেন যার জ্ঞানের ব্যাপ্তি কেবল সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ নেই, সিরিয়াল, নাটক, বিজ্ঞাপন এইসবের ব্যাপারেও কয়েকটি ভাষাতে বিস্তারিত তার জ্ঞান। এ ধরণের সিনেমা দর্শকদের প্রতি এক ধরনের সমীহা জাগানো ভালোলাগা কাজ করে।

দ্বিতীয় যে আগ্রহের সিনেমাদর্শক শ্রেণীটি, দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার একমাত্র সদস্য বলে নিজেকেই মনে করতাম। কিছুটা অজ্ঞতাপ্রসূত আত্নঅহমিকা থেকে, কিছুটা অজ্ঞতাপ্রসূত নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতা বোধ থেকে। এ এক অদ্ভূত ব্যাঞ্জন। বলে হয়তো বুঝানো যাবে না। জীবনের কোন না কোন এক পর্যায়ে নিজে থেকে অনুধাবন করতে না পারলে অক্ষরের মারফৎ এই ভাবের আদান-প্রদান কষ্টকর। পৃথিবীতে পদচারণার দিনের সংখ্যা একটু বাড়লে আত্ন-অহমিকা যেমন ভোঁতা হয়ে আসে তেমনি হীনমন্যতার বোধও দূর্বল হয়ে আসে দূর থেকে জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মত দেখা অনেক কুতুবকে কাছ থেকে দেখে তাদের নিতান্ত জল-সর্দি-কাঁদার আটপৌরে ও চাকচিক্যহীন খুবই খেলো খুবই হ্যাংলা ভিতরটা দেখার পর থেকে। এখন তাই আর নিজেকে একমেবাদ্বিতীয়ম ভাবার মনোবৈকল্য নাই। তাই এখন আর নিজেকে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর একমাত্র সদস্য বলে মনে করি না, যদিও দ্বিতীয় কারো সাথে এখনো সাক্ষাত হয় নাই তবু আল্লার এই দুনিয়ায় আসলে নতুন বলে কিছু নাই।

দ্বিতীয় এই শ্রেণীর দর্শক হিসাবে আমার সিনেমা দেখার ধরণ হলো বছরে হয়তো বড়জোর চার-পাঁচটা নতুন মুভি দেখা এবং তার মধ্যে একটা কী দুইটার একেবারে গভীরে ঢুকে যাবার পর সেগুলোকে বারবার দেখা – হিসাব হারিয়ে যাওয়া পরিমাণে দেখা। প্রতিটা সংলাপ মুখস্ত হয়ে যাওয়ার মত করে দেখা। তারপরও চল্লিশতম বার দেখতে গিয়ে আগে আরো চল্লিশ বার দেখা কোন একটা সংলাপের ভিতরে আরো এক পরতের গভীর কোন ভাব বুঝতে পেরে বিহ্বল হয়ে গিয়ে আরো দুইবার দেখা।

দুই লিটার মদ খাবার পর অবশ্যই দেখতে হবে এরকম তিন-চারটা মুভি থাকা। চারপাশের জীবনের উপর একট বিতৃষ্ণার ভাব আসলে অফিস থেকে ফিরে উনিশশো তিপ্পান্নতম বারের মত দেখার লিস্টে তিন-চারটা মুভি থাকা। দৈনন্দিনের আলোচনায় কোন একটা প্রেক্ষিতে নিজের কাছে মোক্ষম মনে হওয়া কোন একটা সিনেমার কোন একটা সংলাপ দিয়ে নিজে বিশাল কিছু করে ফেলেছি মনে করে, আশেপাশের লোকজনের সবার না-বুঝা ভাবলেশহীন মুখ দেখে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মাসে একবার করে রুটিনমাফিক পড়া। আছে না এই ধরণের সিনেমা-দর্শক ? অবশ্যই আছে।

এই শ্রেণীর দর্শক হিসাবে দুই লিটার মদ পেটে পড়ার অবশ্যই দেখতেই হবে, পুরোটা না হলেও অন্তত যেই অংশটুকু দেখে মোটামুটি শইল্যে একটা ভাব আসে সেইটুকু দেখতেই হবে, সেই ক্যাটাগরিতে আমার নিজের লিস্টে মুভি আছে চারটা। আমেরিকান বিউটি (American Beauty), কুংফু পান্ডা ২ (Kung Fu Panda 2), দ্য বিগ লেবাওস্কি (The Big Lebowski), আর আজকের এই বিশাল প্যাচালের মূল মনজিল, ফাইট ক্লাব (Fight Club)। অবশ্য কালেভদ্রে শইল্যে অন্য কোন ধরণের ভাব থাকলে দ্য ব্রেকফাস্ট ক্লাব (The Breakfast Club) অথবা সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস (Silence of the Lambs ) অথবা দি ম্যাট্রিক্স রেভোল্যুশন (The Matrix Revolution) থেকে দুএক ছত্রও দেখা যেতে পারে। সেগুলো অন্য পরিসরের আলোচনা।


ফাইট ক্লাবের মূল আলোচনায় প্রবেশ করার আগে আরেকটি ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখা ভালো। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর সিনেমা দর্শকরা নিজেদের আত্নার কাছাকাছি যেসব মুভিকে নিয়ে যায়, তার ভিতরকার দর্শনের যে ধরণের অর্থ তারা তৈরী করে সে অর্থ সেই সিনেমার নির্মাতা বা কাহিনী রচয়িতা হয়তো ঘূণাক্ষরেও ভাবেননি। নির্মাতা বা পরিচালক বা কাহিনীকার কোন ধরণের দার্শনীক অর্থের কথা মাথায় রেখে সিনেমা বানিয়েছিলো সে বিবরণ এই দর্শকদের কাছে একেবারেই মূল্যহীন । এনারা নিজেদের জীবন থেকে, নিজেদের জীবনের সাথে সমাজ ও সভ্যতার মিথস্ক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণ নিজেদের মত করে এইসব সিনেমার অর্থ ও দর্শন তৈরী করেন। হতে পারে ফাইট ক্লাবের কাহিনীকার ও নির্মাতা কেবলমাত্র অনিদ্রার রোগীর হ্যালুসিনেশন ও ধোঁয়াটে মানসিক অবস্থা থেকে তৈরী হওয়া কিছু অসামঞ্জস্যই দেখাতে চেয়েছিলেন, যেমন চেয়েছিলেন ‘দ্য মেইশিনিস্ট’ সিনেমার কাহিনীকার ও পরিচালক।

ফাইট ক্লাব সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র, যাকে নায়ক ও বলা যায় আর খলনায়কও বলা যায় সে কঠিন অনিদ্রার রোগী। মাসের পর মাস ঘুমাতে পারে না। ঘুম আর জাগরণের মধ্যেকার এক ধরনের ভাবের জগতে সে আসে আর যায়। সেই ভাবের জগতেও সে স্থির থাকতে পারে না , যেমন করে সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত ঘুমের জগতের ভিতরে সে স্থায়ীভাবে যেতে পারে না। অনিদ্রার নীল বিষে জর্জরিত হয়ে সে ডাক্তারের কাছে আবেদন করে ঘুমের ওষুধের জন্য। কিন্তু ডাক্তার স্বাভাবিক কিছু চুলচামড়ার কথা বলে বিদায় করে দেয়। শরীরচর্চা করো, ওমুক গাছের তমুক অংশ চিবিয়ে রস গিলে দেখো। তার যন্ত্রণা বুঝার চেষ্টার আবেদনকে তাচ্ছিল্য করে সত্যিকারের যন্ত্রণা বুঝতে চাইলে মৃত্যুপথযাত্রীদের সাপ্তাহিক সম্মেলনে গিয়ে সেইসব লোকজনের যন্ত্রণা দেখতে বলে।


দূরারোগ্য ও কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রীদের সাপ্তাহিক সম্মেলনে গিয়ে ফাইট ক্লাবের নায়ক আঁটকে যায় আরেক নেশার দুনিয়ার মায়াজালে। আধুনিক, স্বচ্ছল ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনকারী মানুষের বাস্তবতায় মৃত্যু মূলত টয়লেট অথবা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা অথবা উদ্ভট সিরিয়াল কিলারদের পিছু ধাওয়া করা গোয়েন্দা পুলিশের জীবনের রক্তকাঁদামাখাপচাগলা দৈনন্দিন অথবা পর্ন নায়িকাদের ক্যারিয়ার স্ট্রাগলের মত এক ধরণের অন্যবাস্তবতা – অপরবাস্তবতা। আধুনিক, স্বচ্ছল, উন্নত বিশ্বের সমাজ রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে ফাইট ক্লাবের নায়কের মত কর্পোরেট যুগল দাস-মালিক কর প্রদানকারী সদস্যকে মৃত্যুর মত দগদগে ঘাওয়ালা বাস্তবতা থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখা যায় ততটা বা তার চেয়েও বেশী দূরে রাখতে চায়। কেউ জানলো না, কেউ শুনলো না এমনভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দ্বারে থাকা লোকজনকে রেখে মরে গেলে তাদের দেহ সৎকার ও অন্যান্য সামাজিক প্রক্রিয়াকে মৃত লোকের নিতান্ত কাছের লোকজনের বাইরে বাকী সবার দৃষ্টী ও জীবনের থেকে যতটা সম্ভব অথবা তার চাইতেও বেশি আড়ালে রেখে রাষ্ট্র ও সভ্যতার মূল সূরে যাতে বিন্দুমাত্র ছেদ না পড়ে সেইভাবে প্রক্রিয়াজাত করে রাখতে চায় আধুনিক সমাজ। মৃত্যু নামক অমোঘ, কঠিন, দগদগে বাস্তবতা যেন সমাজের সমস্ত কিছুকে তোলপাড় করে দিয়ে আধুনিক মানুষের সমস্ত জীবন প্রস্তাবনা ও দর্শনকে এলোমেলো করে দিতে না পারে তার জন্য এত পরতের বিচ্ছিন্নতার ব্যবস্থা।


কিন্তু অণ্ডকোষের ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, জন্মগতভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর দৃশ্যপট তৈরী করে রাখা রক্তশূন্যতার মত জটিল কঠিন ও মৃত্যুই একমাত্র শেষ গন্তব্য এমনসব রোগীদের সাপ্তাহিক সম্মেলনে গিয়ে, তাদের জীবন ও দৈনন্দিনের নানান তুচ্ছাতিতুচ্ছ নিরাশা, সর্বশেষ হতাশার সহস্র কাহিনীর ভিতরে ঢুকে গিয়ে ফাইট ক্লাবের যুগল নায়ক ও খলনায়ক আবিষ্কার করে জীবনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরেক জীবনের স্রোত। বিবর্তনীয় বাস্তবতায় অত্যাশ্চার্য্য যে ঘটনা হাজার হাজার অপরিচিত মানুষকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে নিজের দৈনন্দিন যাপনের মত ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে যে সমাজ, অন্যসব মানুষের মৃত্যু, যন্ত্রণা ও হতাশাকে কেবল আবহসংগীত ও পটভূমিকার মত মনোযোগের প্রয়োজনবিহীন তুচ্ছতায় পরিণত করেছে যে সমাজ, সেই সমাজের একজনও যখন একজন সত্যিকারের মৃত্যুপথযাত্রীর দগদগে বাস্তবতার সাথে পরিচিত হয়, তখন সেও সমাজ রাষ্ট্র ও সভ্যতার এতদিনের শেখানো অনুভূতিহীনতা, সংবেদনহীনতা ভুলে গিয়ে কেবল আদিম ও প্রাচীন প্রাণীজ আগ্রহ ও ঔৎসুক্য ও সংবেদনের ফেরে পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মৃত্যুপথযাত্রীর দৈনন্দিন তুচ্ছতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার মত করে উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। এই বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার আধ্যাত্মিক বোধ ও এর তোড়ে নিজস্ব দার্শনিক মুখোশ ও সমাজের শেখানো অনতিক্রম্যতার দেয়াল ভেঙ্গে ফেলে যখন আবেগের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে শিখে যায় যে, তখনি কেবলমাত্র তার দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।


নিজে সত্যিকারের মৃত্যুপথযাত্রী না হয়েও অন্যসব সত্যিকারের মৃত্যুপথযাত্রীদের কাঁচা ও আদিম সততার মুখোমুখি হয়ে জীবনের গভীর অর্থ ও মৌলিকতাকে আস্বাদন করার মত সৌভাগ্য দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে না ফাইট ক্লাবের নায়ক। তার মিথ্যার অচলায়তনে ভাগ বসাতে হাজির হয় মার্লা সিংগার নামের আরেক পরিব্রাজক। সভ্যতার রংচঙে হাস্যোজ্জল বাইরের চেহারা থেকে লুকিয়ে রাখা মৃত্যু ও ক্ষয়ের এই দুনিয়ায় ঢুকে পড়ার উদ্দ্যেশ্য ও পথপরিক্রমা ফাইট ক্লাবের শত ছদ্মনামের নায়ক আর মার্লা সিংগারের ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও, এক জায়গায় গিয়ে দুইজনেই মূলত এক হয়ে যায়। দুজনেই মৃত্যু ও ক্ষয় সম্পর্কিত নিজেদের বাস্তবতাকে লুকিয়ে, মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্যদের গভীর গহনে ঢুকে পড়েছে। মার্লার জন্য ব্যাপারটা মৃত প্রতিবেশীর নামে আসা দানগোষ্ঠীর সাহায্যের খাবার খেয়ে জীবনধারণের মত আটপৌরে বাস্তবতা হলেও রুপার্ট ওরফে কর্নেলিয়াস ওরফে নামহীন নায়কের জন্য এইটুকু অভিনয় মানুষের সত্যিকারের ভিতরের হতাশা ও দুঃখের ফোয়ারার ভিতরে এইটুকু অবগাহন ছিলো জীবন ও সভ্যতার একঘেঁয়ে বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে যাবার একটুখানি জানালা। একদিক থেকে দেখলে কেবল শুভ দিনক্ষণের অপেক্ষায় থাকা ফাঁসির আসামীর নিদারুণ নিঃসঙ্গতার মধ্যে একটু বাইরের আলোছায়ার অবসর ছিলো এই মিথ্যে আবেগের ফল্গুধারা। কিন্তু একইভাবে আরেকজন এই মিথ্যা ধরে ফেলছে এই বোধ জেগে উঠলে পুরো ব্যাপারটা আর কোনভাবেই বিন্দুমাত্র জীবনের আধ্যাত্মিকতার বোধ জাগাতে পারে না তার মধ্যে।

মানুষের হতাশা ও মৃত্যুচিন্তার মত কঠোর সরল ও মৌলিকতার ভিতরে ডুবে যাবার সামান্য একটু অবসরের মধ্যে মার্লার শ্যেনদৃষ্টির প্রখরতা পড়লে ফাইট ক্লাবের নায়ক সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে। দুই মিথ্যুক যেন একসাথে একই দিনে একই রঙ্গমঞ্চে হাজির না হয় সেইভাবে নিজেদের মধ্যে তারা ভাগ করে নেয় মৃত্যুপথযাত্রীদের সম্মেলনে যাওয়ার সন্ধ্যাগুলো। কিন্তু জীবন ও সভ্যতার সর্বোময় অন্তসারঃশূন্যতা নায়ককে ঘিরে ধরেছিলো, তাকে বিচলিত করে চলেছিলো আরো অনেক আগে থেকেই, আরো অনেক রকমের মাত্রায়। বীমা কোম্পানির চাকরি ও তার আবর্তে থেকে ধীরে ধীরে সাজানো নিজের ফ্ল্যাট ও জীবনের অন্যান্য উপকরণ যেগুলো মূলত সভ্যতার এক ধরণের বহুধাবিস্তৃত অক্টোপাশের মত শতপায়ে তাকে জড়িয়ে ধরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো নিজের প্রাণীজ মৌলিক সত্তা থেকে অনেক দূরে, সেগুলো একদিন উড়িয়ে দিয়ে সে শিকারী সংগ্রাহক আদিম পূর্বপুরুষের জীবনে ঢুকে পড়ে। যে পূর্বপুরুষের মধ্যে স্থায়ী ঠিকানা নামক বিভ্রান্তির জন্য কোন জায়গা ছিলো না। যার কাছে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু ঠিক বস্তু হিসাবেই বিবেচিত হতো। আলাদা কোন সত্তা নিয়ে নয়। জীবনের জন্য বিনিময়-অযোগ্য কিছু হিসাবে নয়। উদ্ভটভাবে এই নতুন আলোর স্ফূরণ, এই নতুন জীবনদৃষ্টি তাকে নারীর কাছে নিয়ে যায় নতুনভাবে। সত্যিকারের পুরুষ হিসাবে। এই নতুন আলোর ঝর্ণাধারায় পরিপূর্ণ নিমজ্জিত হবার পরেই সে প্রাণী হিসাবে, বিশেষত পুরুষ প্রাণী হিসাবে তার আসল আধ্যাত্মিক অবস্থান বুঝতে পারে। নারী ও যৌনতার ভিতরের যেসব অন্ধকার গলিঘুপচিকে সে এতদিন বুঝতে পারেনি সেগুলো তার কাছে এখন ক্ষুধার সিগন্যালে খাদ্য খোঁজার, তৃষ্ণার সিগন্যালে জলাধারের নিকটবর্তী হওয়ার ইচ্ছার মত প্রবৃত্তিগত সরল বাস্তবতা হিসাবে আবির্ভূত হয়।

এই নতুন আলোকায়ন ফাইট ক্লাবের নায়কের ভিতরে সভ্যতার সূদীর্ঘ সর্বব্যাপী নষ্টামির অন্তরালে চাপা পড়ে যাওয়া আরেকটি প্রাণীজ বাস্তবতাকে নিয়ে আসে ভিতর খুঁড়ে। পুরুষ প্রাণী হিসাবে, বিশেষত গ্রেইট এইপ হিসাবে একক জীবনরূপ হিসাবে নিজের বাঁদর জীবনের আদি ও আসল যে রূপ, যা সে ভুলতে বসেছিলো জীবন-বীমা ও সংরক্ষণমূলক সভ্যতার যাঁতাকলে পড়ে, সেই রূপ এখন রাতের অন্ধকারের মত পরিষ্কার হয়ে আসে। হোমো স্যাপিয়েন্সের যে প্রজনন ব্যবস্থা, তাতে একক পুরুষের প্রান্তিক মূল্য আসলে শূন্য। প্রজনন ও প্রজাতির ধারাবাহিকতা হাজার লাখ এমনকি কোটি পুরুষের জীবনের বিয়োগেও খুববেশি নড়চড় হওয়ার কথা নয়। হোমো স্যাপিয়েন্স এবং তারও আগের গ্রেট এইপদের মধ্যে পুরুষ মূলত এক ধরণের দাবার ঘুঁটি, বায়ান্ন তাসের মধ্যে আটচল্লিশটি অর্থহীন, মূল্যহীন তাসের একটি মাত্র। এই অর্থহীনতা একদিকে যেমন কঠোর বাস্তবতা তেমনি ঠিক তার উল্টোপিঠেই এক মহান মুক্তিদাতা। প্রকৃতির রাখঢাকহীন খেলায় পুরুষ মূলত প্রতি হাজারে বা প্রতি লাখে একজন সুবিশাল সফলতা পাওয়ার চেষ্টা করে যাবে এমন ধরণের এক হঠকারী অস্তিত্ব। এই অস্তিত্ব তার সফলতার চেষ্টায় নিজেকে অপচয় ও বিলীন করে দিতে পারে কোন রকমের পিছুটান ছাড়া। অন্তত স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে নারীর পক্ষে এই জুয়ায় যাওয়া অসম্ভব অথবাঅর্থবহ নয়। প্রতিটি নারী জীবনের আধার। জীবনের আধার যেহেতু সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যবান, অন্তত বিবর্তনীয় বাস্তবতায়, সেহেতু রক্ষণশীলতার ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবার মত রাসায়নিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া হোমো স্যাপিয়েন্সের ভিতরে সেভাবেই বিকশিত হয়েছে। প্রজাতির অভ্যন্তরে নারী ও পুরুষের যে আলাদা আলাদা প্রয়োজন ও খরচের সূত্র, সেই সূত্রমতে পুরুষ হোমো স্যাপিয়েন্সের শরীরের রাসায়নিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া তাকে তৈরি করেছিলো সেভাবেই। কোটি কোটি অপ্রয়োজনীয় লটারির টিকেটের মত করে। তার মধ্যে একটি হয়তো বিলিয়ন ডলারের স্বর্গ উম্মুক্ত করলেও করতে পারে। কিন্তু একটি একক টিকেট, একটি একক পুরুষ মূলত দ্বিধাহীন, ভয়হীন, রক্ষণশীলতাহীনভাবে হেলায় নিজেকে বিলিয়ে দিবে অনন্ত শূন্যতার ভিতরে।

এই প্রক্রিয়ায় যাওয়ার জন্য মানুষের আদিপুরুষের ভিতরে নিজেকে একটি মহাসৌভাগ্যবান জয়ী টিকেটে পরিণত করার প্রক্রিয়া ছিলো মূলত প্রদর্শনের আচার – শক্তি ও সৌর্য্যের। ফাইট ক্লাবের নায়ক তাই দুনিয়া ঘুরে ঘুরে সভ্যতার অসহ্য রক্ষণশীলতার মধ্যে দিনান্তে নিজের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টায় প্রাণীজ উত্তরাধিকারের আধ্যাত্মিকতাকে নিঃশেষ করে দিয়ে যেতে থাকা পুরুষদের মধ্যে পুরনো সেই প্রদর্শনের আচারকে নতুন করে চালু করতে গিয়ে তৈরী করে জায়গায় জায়গায় আলাদা আলাদা ফাইট ক্লাব। এইসব ফাইট ক্লাবে পুরুষরা তাদের শক্তির প্রদর্শনের আয়োজন করে। সহিংসতার প্রদর্শনের আয়োজন করে। সভ্যতার অশ্লীল উল্টোগাধার পিঠে চড়ে বসার ফলে হোমো স্যাপিয়েন্সের মধ্যে প্রদর্শন নামক আধ্যাত্মিক আচার পরিণত হয়েছে নারীর শরীর প্রদর্শনের উদ্ভট আচারে। এমনকি পুরুষের শরীর প্রদর্শনের যেটুকু আচার চালু রয়েছে তা-ও গিয়ে আটকেছে কেলভিন ক্লাইন আর টমি হিলফিগারের দেখানো মেকি, উদ্ভট পথে। ফাইট ক্লাবের নায়ক তার সভ্যতার জালে আটকা পড়া পুরুষদের মধ্যে আদিম পুরুষের প্রদর্শন আচারের পুনর্জীবন নিয়ে আসতে চায়। এই প্রদর্শনের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ বা বৈষয়িক লাভ আদায়ের মত অশ্লীলতা নেই। ফাইট ক্লাবের ফাইট কোন ধরণের সমস্যা সমাধানের উপায় নয়। ব্যক্তিগত দ্বন্দের হিস্যা মেটে না এসব মারামারিতে। মারামারিতে জয়ী হওয়া পুরুষ আলাদা কোন উচ্চতায় উঠে না। পরাজিত পুরুষ কোন আলাদা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় না। এই মারামারি, এই ফাইট মূলত সেই ভুলতে বসা আদিম আধ্যাত্মিকতার নতুন উদ্গীরণ মাত্র, নতুন অনুভব মাত্র ।

সমস্ত কিছু ছাপিয়ে ফাইট ক্লাবের ফাইট বা লড়াইগুলো মূলত নিজের জীবনকে যথেচ্চ অপচয় করার যে আদিম ও কাঁচা প্রাণীজ স্বাধীনতা পুরুষের ছিলো, কোটি কোটি বছর ধরে ছিলো, সভ্যতা ও নাগরিক অক্টোপাশের অশ্লীল জুলুমের সাম্রাজ্য তৈরী হওয়ার আগে, সেই অধিকারকে পুনরায় দাবী করে। ঠিক এই আধ্যাত্মিকতাই ফাইট ক্লাব নামের সিনেমা ঘিরে একধরণের ঘোর, একধরণের মোহ তৈরী করেছে সভ্যতার জালের ভিতর নিজেদের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাবিহীনভাবে জীবনকে অপচয় করে যাওয়া কোটি কোটি গৃহপালিত, বিষবিবর্জিত, কিন্তু গভীরে ক্ষোভের অনন্ত আগ্নেয়গিরি বয়ে নিয়ে চলা পুরুষের মধ্যে। জীবনকে অপচয় করার সমস্ত অধিকার আমার আছে। কিন্তু সেই অপচয় নিজের মত করে, নিজের আধ্যাত্মিক দ্রাঘিমার সাথে মিলিয়ে; অন্যের দেখানো পথে নয়। সহিংসতা ও শক্তি প্রদর্শনের চর্চা, অন্যের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। নিজের বৈষরিক ফায়সালার জন্যও নয় । বরং এই চর্চা এক ধরণের আধ্যাত্মিক রিচুয়াল। পুরুষের জন্য। অপচয়ের জন্মগত অধিকার পাওয়া প্রাণীর জন্য। হতে পারে ফাইট ক্লাবের লেখক বা পরিচালক বা কলাকূশলীরা কেবল এক অনিদ্রার রোগীর হ্যালুসিনেশনের উদ্ভটতা নিয়েই গল্প বলতে চেয়েছিলেন। হতে পারে তাদের চিন্তাসূত্র ও দর্শন মতে সভ্যতার অবিচার ও উদ্ভটতা অনিদ্রার বিষে জর্জরিত হওয়া কারো মধ্যে কিভাবে সমস্ত কিছুকে ধ্বংস করে দেবার মত দ্রোহ তৈরী করে সেই পথ দেখাতে চেয়েছেন তারা। কিন্তু নিজেদের প্রাণীজ উত্তরাধিকার ও প্রবণতা থেকে বহুদূর ঘুরে রক্ষণশীলতার বেঁনোজলে আটকে যাওয়া আমার মত হাজার হাজার দর্শকের মধ্যে ফাইট ক্লাবের লড়াই অন্য এক অর্থ ও আধ্যাত্মিকতা তৈরী করেছে যা হয়তো কবি পুরন্দর ভাটের মত একটি কামান আর দুইটি কামানের গোলার অধিকারী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে অনুধাবন করে উঠা সম্ভব নয়।

…………………..
অনলাইন পাঠচক্র খাপছাড়া আড্ডায় পঠিত।

Leave a Comment