খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটগল্পঃ কাগুজে প্রাণীর আস্তানা

মূলঃ কেন লিউ
অনুবাদঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল

ছোট্টবেলার সবচেয়ে পুরনো যে কথাটা আমার মনে আসে সেটা আমার ফোঁপাতে থাকার। মা আর বাবার শত চেষ্টাতেও আমি শান্ত হচ্ছিলাম না।

বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে শোবার ঘর ছেড়ে চলে গেল, কিন্তু মা আমায় রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলের ওপরে বসিয়েছিল।

“দেখ, দেখ,” বলতে বলতে মা ফ্রিজের ওপর থেকে একটা মোড়কের কাগজ তুলে নিল। মা সেগুলো বছরের পর বছর বড়দিনের উপহার যত্ন করে খুলে খুলে পুরু থাক করে জমিয়ে তুলেছে ফ্রিজের ওপর।

মা কাগজটা পেতে দিয়েছিল, মোড়কের উল্টো পিঠটা ওপরে রেখে, আর সেটা ভাঁজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। আমি কৌতূহলবশত কান্না থামিয়ে মাকে লক্ষ করছিলাম।

মা কাগজটা ঘুরিয়ে আবার ভাঁজ করল। কাগজটা মুঠোর মধ্যে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত মা সেটাকে পাট করল, মোড়াল, জোড় দিল, ঘোরাল আর পাকাল। তারপরে মা সেই মোড়ানো কাগজ মুখের সামনে তুলে তাতে বেলুনের মতো ফুঁ দিল।

“দেখ,” মা বলেছিল “বাঘু”। মা হাত টেবিলের ওপর রেখে সেটা ছেড়ে দিল।

একটা ছোট কাগজের বাঘ, দুমুঠো পরিমাণ, টেবিলের ওপরে দাঁড়িয়েছিল। বাঘটার গায়ের রং মোড়কের কাগজের সোজা পিঠের ছাঁদে, সাদা জমির ওপরে লাল ক্যান্ডি আর সবুজ ক্রিসমাস-ট্রিওয়ালা।

আমি মার এই সৃষ্টিকর্মের কাছে গেলাম। এটা লেজ নাড়াচ্ছিল আর আমার আঙুলের ওপর খেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল।

“হুউম,” এটা গর্জন করল। আওয়াজটা বিড়ালের মিউ আর খবরের কাগজের খচমচের মাঝামাঝি।

আমি উল্লসিত হলাম, সচেতনভাবে তর্জনী দিয়ে এর পিঠে টোকা দিলাম। কাগজের বাঘটা আমার আঙুলের নিচে আদরে গুরগুর করতে থাকল।

“এটা হল কাগজ ভাঁজ করে বিশেষ আকার দেবার প্রক্রিয়া।” মা বলল। অর্থাৎ একে বলে অরিগ্যামি।

তখন এটা আমি জানতাম না, কিন্তু মা’র প্রক্রিয়া ছিল বিশেষ আলাদা। মা এগুলোর মধ্যে ফুঁ দিয়ে প্রাণসঞ্চার করত, আর মায়ের জীবনের অংশ বহন করে সেগুলো হয়ে উঠত সজীব। এটা ছিল মা’র জাদু।

#

বাবা মাকে পাত্রীদের একটা তালিকা দেখে নির্বাচন করেছিল।

আমি যখন হাইস্কুলে পড়ছি, তখন এক সময়ে, আমি বাবার কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলাম। বাবা সে সময়ে আমি যাতে মা’র সঙ্গে আবার কথা বলি, তারই চেষ্টা করছিল।

১৯৭৩-এর বসন্তে বাবা আবার ইন্ট্রোডাকসন সার্ভিসে ফিরে যায়। একদিন বাবা কয়েক সেকেন্ড করে প্রতি পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে পত্রিকার পাতা উলটে যাচ্ছিল এবং মায়ের ছবিতে এসে থেমে যায়।

আমি এই ছবিটা কখনও দেখিনি। বাবা বর্ণনা দিচ্ছিল: মা একটা চেয়ারে বসেছিল, ক্যামেরার দিকে পাশ ফিরে, একটা সবুজ সিল্কের টাইট গাউন* পরে। তার মাথা ছিল ক্যামেরার দিকে ফেরানো যাতে তার লম্বা কালো চুল খুব নান্দনিকভাবে কাঁধ আর বুকের ওপর দিয়ে ফেলা যায়। মা বাবার দিকে ওই ছবির মধ্যে দিয়ে এক শান্ত নিষ্পাপ শিশুর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল ।

“ আমি দেখেছিলাম ওটাই ছিল ওই তালিকার শেষ পাতা,” বাবা বলল।

তালিকার তথ্য অনুযায়ী মায়ের তখন বয়স আঠারো, নাচতে ভালবাসে, এবং যেহেতু সে হংকং-এর তাই ভালো ইংরেজি বলতে পারে। এই তথ্যাদির একটাও সত্যি ছিল না।

বাবা মাকে চিঠি লিখল, এবং কিছুদিন ওই পাত্রী নির্বাচনের কোম্পানি মারফৎ দুজনের চিঠির আদানপ্রদান চলল। তারপর বাবা হংকং-এ মাকে দেখতে উড়ে গেল।

“ ওই কোম্পানির লোকেরা মায়ের উত্তরগুলো লিখছিল। মা ‘হ্যালো’ আর ‘গুড বাই’ ছাড়া কোনও ইংরেজি জানতো না।

কোন ধরনের মহিলা নিজেকে বিক্রি হবার জন্য এক তালিকাভুক্ত করতে পারে? হাই ইস্কুলে পড়া আমি ভাবছিলাম আমি সব বিষয়ে সমস্ত কিছু জানি। মৃদু নেশার মতো ভালো লাগছিল এই ভাবতে পারা।

সব জেনে ঝড়ের মতো আছড়ে টাকা ফেরত চাওয়ার বদলে বাবা টাকা দিয়ে একজন দ্বিভাষী পরিচারিকাকে হোটেলে রাখলেন যে তাদের কথা পরস্পরের জন্য অনুবাদ করে দিতে পারবে।

“আমি যখন কথা বলছিলাম, তখন তোমার মায়ের চোখে যুগপৎ আতঙ্ক আর আশা খেলা করছিল।  আর যখন ওই পরিচারিকা আমার কথা তাকে বুঝিয়ে বলতে থাকল তোমার মা ধীরে ধীরে হাসতে শুরু করলেন।”

বাবা আবার নিজের শহর কানেক্টিকাটে উড়ান দিলেন আর মায়ের তার কাছে আসতে পারার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের যোগাড় শুরু করলেন। আমি এক বছর পরে জন্মালাম, সেটা ছিল বাঘের বছর।

#

আমার কথায়, মা ওই সব মোড়কের কাগজ দিয়ে একটা ছাগল, একটা হরিণ, একটা মোষ তৈরি করে দিল। যখন বাঘু এদের গর্জন করে তাড়া করত এরা বসার ঘর জুড়ে দৌড়ে বেড়াত। যখন বাঘু এদের ধরে ফেলত তখন ততক্ষণ অব্দি চেপে থাকত যতক্ষণ না এরা সব বাতাস বেরিয়ে গিয়ে একেবারে চ্যাপ্টা ভাঁজ করা কাগজের টুকরোমাত্র হয়ে যায়। আমাকে তারপর এদের মধ্যে বাতাস পুরে দিতে হত যাতে এরা আবার ফুলে ওঠে আর আরও কিছুটা দৌড়ঝাঁপ করতে পারে।

কখনও প্রাণীগুলো পড়ত বিপদে। একবার, মোষটা ডিনার টেবিলের ওপরের একটা সয়া-সসের ডিসে লাফ দিল।(সে একটা সত্যিকারের মোষের মতই কাদাজলে গড়াগড়ি দিতে চেয়েছিল।) আমি খুব তাড়াতাড়িই তাকে তুলে ফেললাম কিন্তু কৈশিক ক্রিয়ার প্রভাবে তার মধ্যেই মোষটার পায়ের অনেকটা ওপর পর্যন্ত ওই ঘন কালো তরল উঠে পড়েছিল। সসে ভেজা তার নরম পা-গুলো আর তাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারছিল না, আর মোষটা টেবিলের ওপর মুষড়ে পড়ল। আমি বাইরে রোদে ওকে শুকলাম, কিন্তু তার পা কুঁকড়ে গেল আর সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়তে থাকল। অবশেষে মা তার পা স্বচ্ছ পলিথিন মোড়কে মুড়ে দিল যাতে সে তার মনের ইচ্ছেমতো গোলায় গড়াগড়ি দিতে পারে (শুধু সয়া সসে নয়)।

আমরা যখন পিছনের বাগানে খেলতাম বাঘু তখন চড়ুইদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত। কিন্তু একবার, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া একটা পাখি মরিয়া পাল্টা আক্রমণে বাঘুর কান ছিঁড়ে দিল। বাঘু তাতে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকল এবং মা যখন তার কানের ছেঁড়া অংশটা টেপ দিয়ে জুড়ে দিল আর আমি তাকে ধরে থাকলাম সে কুঁকড়ে থাকল । এরপর থেকে সে পাখিদের এড়িয়ে চলত।

এরপরে একদিন আমি হাঙরদের নিয়ে টিভিতে একটা তথ্যচিত্র দেখলাম, এবং মায়ের কাছে আমার নিজের একটা হাঙরের জন্য বায়না করলাম। মা হাঙর তৈরি করল, কিন্তু সেটা খুব অখুশিভাবে টেবিলের ওপরে পাখনা নেড়ে বেড়াতে থাকল। আমি সিংকে জল ভর্তি করে হাঙরটাকে তার মধ্যে দিলাম। সে এদিক সেদিক সাঁতার কেটে বেড়াতে থাকল। অল্প পরেই সে ভিজে স্বচ্ছ হয়ে গেল, এবং ধীরে ধীরে জলের তলায় ডুবে গেল। তার কাগজের তৈরি শরীরের ভাঁজগুলো খুলে গেল। আমি তাকে উদ্ধার করতে পৌঁছলাম, কিন্তু শেষ অব্দি হাতে উঠল এক টুকরো ভেজা কাগজ।

বাঘু সামনের পা দুটো সিংকের কিনারে তুলে তাদের ওপরে নিজের মাথাটা রাখল। কান দিল ঝুঁকিয়ে, চাপা গলায় সে গরগর করতে থাকল আর তাতে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হল।

 মা আমার জন্য একটা নতুন হাঙর তৈরি করে দিল, এবারে টিনের ফয়েল দিয়ে। এই হাঙরটা খুব আনন্দে একটা গোল্ডফিশের পাত্রে থাকতে লাগল। বাঘু আর আমি ওই পাত্রটার সামনে বসে দেখতে পছন্দ করতাম আর দেখতাম যে কেমন করে হাঙরটা গোল্ডফিশটাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বাঘটা পাত্রের উল্টোদিকে মুখটা এমন চেপে ধরত যে এপাশ থেকে আমি তার চোখ প্রায় কফির কাপের মতো বড় আকারে দেখতাম যা পাত্রের ওপার থেকে আমার দিকে চেয়ে আছে।

#

যখন আমার দশ বছর বয়স তখন আমরা শহরের অন্য দিকে একটা নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম। দুই প্রতিবেশী মহিলা আমাদের স্বাগত জানাতে এলেন। বাবা তাদের পানীয় দিলেন তার পরে ক্ষমা চেয়ে জানালেন তাকে বাড়ির টাকা মেটানোর জন্য  বেরতে হবে। “আপনারা এখানে স্বচ্ছন্দে থাকুন। আমার স্ত্রী ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না, ফলে আপনারা মনে করবেন না উনি খুব দাম্ভিক বলে আপনাদের সঙ্গে কম কথা বলছেন।“

আমি যখন খাবার ঘরে বসে পড়ছিলাম আমার মা তখন রান্নাঘরে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন। আর প্রতিবেশীরা বসার ঘরে বেশ উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন।

“মনে তো হচ্ছে উনি বেশ স্বাভাবিক মানুষ। তাহলে এরকম করলেন কেন?”

“এরকম মিলমিশে কিছু না কিছু গণ্ডগোল হয়-ই। বাচ্চাটাকে দেখলে মনে হচ্ছে কেমন আধখ্যাঁচড়া। চীনেদের মতো বাঁকানো চোখ, সাদা মুখ, একটা ছোট দৈত্য যেন।”

“ও ইংরেজি বলতে পারে, তোমার কি মনে হয়?”

মহিলা চাপা গলায় বললেন। খাবার ঘরে আসার একটু পরে।

“এই যে শুনছ? তোমার নাম কী?”

“জ্যাক,” আমি বললাম।

“এটা তো খুব একটা চীনেদের নামের মতো নয়।”

মা এরপরে খাবার ঘরে এলেন। মা ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তিনজনে আমায় ঘিরে ত্রিভুজের মতো দাঁড়িয়ে, হেসে পরস্পরকে নমস্কার করছেন, মুখে কিছুই বলছেন না কেউ, যতক্ষণ না বাবা ফিরে এলেন।

#

প্রতিবেশী এক ছেলে, মার্ক, এল তার স্টার ওয়ার-এর সব চরিত্রের খেলনা প্রতিরূপ নিয়ে। খেলনা অবি-ওয়ান কেনোবির আলোর তরবারি জ্বলে এবং সে তার হাত নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে, “শক্তি ব্যবহার করো!” আমার কিন্তু একে মোটেই আসল অবি-ওয়ানের মতো দেখতে মনে হয়নি।

আমরা দুজনে এই খেলনাটাকে পরপর পাঁচবার তার ক্রিয়াকলাপ করতে দেখলাম কফি-টেবিলের ওপরে। “এটা কি অন্য কিছুও করতে পারে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

মার্ক আমার প্রশ্নে বিরক্ত হল। বলল, “ওকে খুঁটিয়ে দেখ।”

আমি দেখলাম খুঁটিয়েই। ঠিক বুঝলাম না কি বলা উচিৎ আমার।

আমার প্রতিক্রিয়ায় মার্ক হতাশ হল। “আমাকে তোর খেলনা দেখা।”

কাগজের তৈরি প্রাণীগুলো ছাড়া আমার কোনও খেলনা ছিল না। আমি আমার শোবার ঘর থেকে বাঘুকে নিয়ে এলাম। ততদিনে বাঘু খুবই ছেঁড়াখোঁড়া, তাপ্পি আর আঠা দিয়ে জোড় দেওয়া, বছরের পর বছর ধরে আমি আর মা যে জোড় দিয়ে গেছি তারই চিহ্ন শরীরে ধরে রেখেছে। সে আর আগের মতো চটপটে আর মজবুত ছিল না। আমি তাকে কফি-টেবিলের ওপরে বসিয়ে দিলাম। আমি অন্য প্রাণীগুলোর নড়বড়ে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছিলাম পিছনের বড়ঘর থেকে, তারা আস্তে আস্তে বসার ঘরে উঁকি দিচ্ছিল।

“এটা বাঘু,” আমি বলেই থামলাম। তারপরে ইংরেজিতে বললাম। “দিস ইজ টাইগার।” সচেতনভাবে, বাঘু উঠে দাঁড়াল আর মার্কের দিকে চেয়ে তার হাত শুঁকতে শুঁকতে গরগর করতে থাকল।

মার্ক বাঘুর শরীরের যে ছাপ সেটাকে ক্রিস্টমাসের উপহারের মোড়ক হিসেবে চিনতে পারল। “এটা মোটেই বাঘের মতো দেখতে নয়। তোর মা তোর জন্য এরকম আবর্জনা দিয়ে খেলনা তৈরি করে?”

    আমি কখনও বাঘুকে আবর্জনা বলে ভাবিনি। কিন্তু এখন তার দিকে চেয়ে তাকে শুধুই একটা মোড়কের কাগজ মনে হল।

মার্ক তার অবি-ওয়ানের মাথাটা ঠেলল আবার। তার আলোর তলোয়ার ঝলসে উঠল; সে তার অস্ত্র ওপরে নিচে ওঠাল নামাল। “শক্তি ব্যবহার কর!”

বাঘু ঘুরল আর ঝাঁপিয়ে পড়ল, টেবিলের প্লাস্টিকের খেলনায় আঘাত করতে থাকল। খেলনাটা মাটিতে পড়ে গেল আর ভাঙল, এবং অবি-ওয়ানের মাথা কাউচের নিচে গড়িয়ে গেল। “হুউউউম,” বাঘু যেন হেসে উঠল। তার হাসিতে যোগ দিলাম আমিও।

মার্ক আমাকে জোরে ঘুষি মারল, “এটা খুব দামি! এটা এখন আর দোকানে পাওয়াও যায় না। তোর বাবা তোর মাকে যত টাকা দিয়ে পুষছে এটার দাম সম্ভবত তার থেকে বেশি!”

আমার পা পিছলে গেল আর আমি পড়ে গেলাম মেঝের ওপরে। বাঘু গর্জন করে মার্কের মুখে লাফিয়ে উঠল।

মার্ক চেঁচিয়ে উঠল, যতটা তার ব্যথা থেকে তার থেকেও বেশি ভয়ে আর বিস্ময়ে। সব কিছুর পরেও, বাঘু শেষ অব্দি কাগজেরই তৈরি।

মার্ক বাঘুকে পাকড়ে তাকে ভাঁজ করে দু-টুকরো করে দিতে বাঘুর আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। মার্ক কাগজের দুটো টুকরো পাকিয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। “এই নে তোর বোকা বোকা চীনে আবর্জনা।”

মার্ক চলে যাবার পর, আমি অনেকক্ষণ ধরে, টুকরোগুলো জোড়া লাগাবার, কাগজটা সমান করবার, আর আগের ভাঁজে বাঘুকে ফেরাবার, ব্যর্থ চেষ্টা করে গেলাম। আস্তে আস্তে বাকি প্রাণীরা বসার ঘরে এসে আমাকে আর ছেঁড়াখোঁড়া মোড়কের কাগজটা, যেটা বাঘু ছিল, আমাদের ঘিরে দাঁড়াল।

#

মার্কের সঙ্গে আমার বিরোধের কিন্তু শেষ হল না। ও স্কুলে জনপ্রিয় ছিল। পরের দু-সপ্তাহ জুড়ে যা হয়েছিল তা আমি একেবারেই মনে রাখতে চাই না।

অবশেষে দু-সপ্তাহ পর সেই শুক্রবার আমি বাড়ি এলাম। “ইস্কুলে ভালো লাগছে?” মা জিজ্ঞেস করল। আমি কিছু না বলে শোবার ঘরে চলে গেলাম। আমি আয়নায় দেখলাম। আমি আমার মায়ের কোনও ছাপ সেখানে পেলাম না, কিচ্ছু না। রাতের খাবার সময় আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম, “আমার মুখ কি চীনে ছাঁদের?”

বাবা তার চপস্টিক নামিয়ে রাখল। যদিও আমি কিছুই বলিনি, তবু মনে হল স্কুলে কী ঘটেছে বাবা বুঝতে পেরেছে। চোখ বন্ধ করে বাবা নাকের মাঝখান রগড়াতে থাকল। “না, তোর না।” মা বাবার দিকে তাকাল, কিছু বুঝতে না পেরে। তারপর আমার দিকে ঘুরল, “ কী হয়েছে আমাকে বল সোনা?”

“ইংরেজি,” আমি বললাম, “ইংরেজিতে বলো।”

মা চেষ্টা করল। “হোয়াট হ্যাপেন?”

আমার চপস্টিক আর সামনের খাবার পাত্র আমি ঠেলে সরিয়ে দিলাম : পাঁচফোড়ন আর গোলমরিচ দিয়ে সাঁতলানো গোমাংস। “আমাদের আমেরিকান খাবার খাওয়া উচিৎ।”

“অনেক পরিবারই মাঝেসাঝেই চীনা খাবার রান্না করে।” বাবা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করল।

“আমরা অন্য পরিবারগুলোর মতো নই।” আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম। অন্য পরিবারে ভিনদেশি মা নেই।

বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মায়ের কাঁধে হাত রাখল। “আমি তোমায় এদেশি রান্নার একটা বই এনে দেব।”

মা আমার দিকে ঘুরল। “খুব ভালো খেতে হয়নি?”

“ইংরেজি,” আমি চড়া গলায় বললাম, “ইংরেজিতে বলোও!”

মা আমার দিকে এগিয়ে এল আমার কপালে হাত রাখার জন্য, আমার শরীরের তাপমাত্রা বোঝার জন্য। “জ্বর?”

আমি মায়ের হাত এক ঝাপটায় সরিয়ে দিলাম। “আমি ঠিক আছি। তুমি ইংরেজিতে কথা বলো!” আমি চিৎকার করে উঠলাম।

“ওর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলো,” বাবা মাকে বলল। “তুমি জানতে একদিন না একদিন এটাই হবে। আর কী আশা করেছিলে তুমি?”

মার হাত দুটো ঝুলে গেল। মা ধপ করে বসে পড়ল, একবার বাবার দিকে একবার আমার দিকে তাকাতে থাকল। মা কথা বলার চেষ্টা করছিল, থেমে যাচ্ছিল, আবার চেষ্টা করে আবারও থেমে যাচ্ছিল।

“তোমাকে পারতে হবে,” বাবা বলল। আমি তোমার ওপরে কোনও জোর করিনি। কিন্তু জ্যাককে মানিয়ে নিতে সাহায্য করতে হবে।”

মা আমার দিকে তাকাল। “যদি আমি বলি ‘লাভ’ আমি এখান থেকে বলি।” মা নিজের ঠোঁট দেখাল। “যদি আমি বলি, ‘ভালোবাসা’ আমি এখান থেকে বলি।” মা নিজের বুকের ওপর হাত রাখল।

বাবা মায়ের মাথা ঝাঁকাল। “তুমি এখন আমেরিকায়।”

মা নুয়ে পড়ল, তাকে ঠিক সেই মোষের মতো দেখাচ্ছিল যাকে বাঘু ঘায়েল করে তার ভেতরের বাতাস বের করে ফেলে চুপসে দিত।

“আর আমার কিছু সত্যিকারের খেলনা চাই।”

#

বাবা আমায় স্টার ওয়ারের সবকটা চরিত্রের খেলনা এনে দিল। আমি অবি-ওয়ান কেনোবিটা মার্ককে দিয়ে দিলাম। কাগজের প্রাণীগুলো একটা জুতোর বাক্সে ভরে আমি খাটের তলায় পাঠিয়ে দিলাম।

পরদিন সকালে দেখলাম প্রাণীগুলো পালিয়ে আমার ঘরে তাদের পছন্দের পুরনো জায়গায় ফিরে গেছে। আমি তাদের সবাইকে ধরে জুতোর বাক্সে পুরে ঢাকনা ফিতে দিয়ে বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু বাক্সের মধ্যে এরা এত গোলমাল করতে লাগল যে আমি ওদের আমার ঘর থেকে সবচেয়ে দূরে চিলেকোঠার এককোণে পাঠিয়ে দিলাম।

যদি মা চীনেভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলত, আমি তার উত্তর দিতাম না। শিগগিরই মা বেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তার উচ্চারণের টান আর অসম্পূর্ণ বাক্য আমায় লজ্জায় ফেলত। আমি তাকে শুধরে দেবার চেষ্টা করতাম। অবশেষে, আমি আশপাশে থাকলে মা কথা বলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিল।

মা মূকাভিনয় করে আমায় যা বোঝানোর বোঝাত। মা আমেরিকান মায়েদের যেমন করে টিভিতে দেখত তেমন করে আমায় জড়িয়ে ধরতে চাইত। আমার মনে হত তার ধরনধারণ ফাঁপানো, কাঁচা, হাস্যকর, লাবণ্যহীন। মা দেখল আমি বিরক্ত, তাই এ চেষ্টাও থেমে গেল।

“মায়ের সঙ্গে তোর এরকম ব্যবহার করা উচিৎ না,” বাবা বলল। কিন্তু কথাটা বাবা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারল না। ভেতরে ভেতরে বাবাও বুঝত একটা চীনে চাষা মেয়েকে বিয়ে করে এনে, সে আমেরিকার এক শহরতলিতে মানিয়ে যাবে এটা আশা করাই ভুল।

মা আমেরিকান রান্না শিখল। আমার ভিডিও গেম খেলে আর ফরাসী ভাষা শিখে কাটতে লাগল।

কিছু সময় পরে পরেই আমি দেখতাম রান্নাঘরের টেবিলে বসে মোড়কের কাগজের উল্টোদিকটা এক দৃষ্টে দেখতে। পরে আমার বিছানার পাশে নতুন কিছু কাগুজে প্রাণী আমি পেলাম যারা আমার সঙ্গে ভাব করতে চাইছে। আমি তাদের ধরে চেপে তাদের সমস্ত বাতাস বের করে চুপসে সেই চিলেকোঠার বাক্সে বন্ধ করে দিলাম।

আমি উঁচু ক্লাসে উঠে যাবার পর শেষপর্যন্ত মা এই কাগজের প্রাণীগুলো তৈরি করা বন্ধ করল। মায়ের ইংরেজি বলার মান তখন অনেকটা ভালোর দিকে, কিন্তু আমি তো সেই বয়সে পৌঁছে গেছি যখন মা কী বলছে কোন ভাষায় বলছে সে সব সম্বন্ধে আমার আর আগ্রহ নেই।

কখনও আমি বাড়ি ফিরে দেখতাম রান্নাঘরে মা তার চুপসনো শরীরটা নিয়ে এদিক ওদিক করছে আর আপনমনে চীনে ভাষায় গান গাইছে, তখন ওই মহিলাই আমার জন্মদাত্রী এটা কল্পনা করাও আমার পক্ষে কঠিন হতো। আমাদের কোনও মিল ছিল না। মা এক অন্য গ্রহের প্রাণী ছিল। আমি তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে যেতাম, যেখানে আমি আমার সমস্ত আমেরিকান পছন্দের বিষয়ের সঙ্গে থাকতে পারতাম।

#

বাবা আর আমি হাসপাতালে মায়ের বিছানার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মার বয়স চল্লিশও হয়নি, কিন্তু তাকে অনেক বুড়ি দেখাত।

মা বছরের পর বছর নিজের ব্যথার চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে চায়নি কারণ মা মনে করত এটা সামান্য ব্যাপার। শেষ অব্দি অ্যাম্বুলেন্সে চেপে মাকে যেতে হল, ততদিনে ক্যান্সার এত ছড়িয়ে গেছে যে অপারেশন করেও আর কোনও লাভ নেই।

আমার মন ওই ঘরের ভেতরে ছিল না। আমার মাথায় ঘুরছিল কলেজের চাকরির ক্যাম্পাসিং-এর কথা। আমার সমস্ত মনোযোগ তখন আমার বায়োডেটার দিকে, সমস্ত সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি গোছানোতে, আর কৌশলগতভাবে তৈরি হওয়া ইন্টারভিউ-এর তালিকার জন্য। আমি ছক কষছিলাম কীভাবে কর্পোরেট নিয়োগকারীদের সামনে মিথ্যে সাজাবো যাতে তারা আমায় নিয়োগ করে। আমি চালাকি করে বুঝেছিলাম এই সময়ে মাকে মৃত্যুশয্যায় রেখে সেখানে উপস্থিত হওয়া ব্যাপারটাই কতোটা কঠিন। এই বুঝে যাওয়া কিন্তু মার প্রতি আমার অনুভূতিকে পাল্টায়নি।

মা সজ্ঞানেই ছিল। বাবা নিজের দুহাত দিয়ে মায়ের বাঁ হাত ধরে ছিল। মায়ের কপালে চুমো খাবার জন্য বাবা ঝুঁকল। বাবাকে খুব দুর্বল আর বুড়ো মনে হচ্ছিল যেটা আমায় চমকে দিল। আমি বুঝলাম আমি বাবার সম্বন্ধেও ততোটাই কম জানি যতটা কম জানি মায়ের সম্বন্ধে।

মা বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। “আমি ভালো আছি।”

মা আমার দিকে ঘুরল, হাসতে হাসতেই। “আমি জানি তোকে আবার স্কুলে যেতে হবে।” মার গলা খুবই দুর্বল এবং মায়ের আশপাশে লাগানো মেশিনগুলোর একটানা গুনগুন আওয়াজের মধ্যে সে গলা শুনতে পাওয়াই কঠিন। “যা, আমার জন্য চিন্তা করিস না। এমন কিছু হয়নি আমার। যা ভালো করে স্কুলের কাজগুলো মিটিয়ে নে।”

আমি মায়ের হাত ধরবার জন্য এগোলাম, কারণ আমার মনে হচ্ছিল সেটাই আমার তখন করা উচিৎ। আমি স্বস্তি পেলাম। আমি ফিরে যাবার উড়ানের কথাই ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম উজ্জ্বল ক্যালিফোর্নিয়ার সূর্যাস্তের কথা।

মা ফিসফিস করে বাবাকে কিছু বলল। বাবা মাথা নেড়ে ঘর থেকে চলে গেল।

“জ্যাক, যদি …” কাশির দমকে মার কথা আটকে গেল কিছুক্ষণ। “যদি আমি সেরে না উঠি, বেশি মনখারাপ বা শরীরখারাপ কোরো না। নিজের জীবন গড়ে তোলায় মন দিও। যে বাক্সটা চিলেকোঠায় রেখেছিস সেটা তোর সঙ্গে রাখিস, আর প্রতি বছর খিঙ্গমিঙ্গের* দিনে এটা বের করে আমার কথা মনে করিস। আমি সবসময় তোর সঙ্গেই থাকব।”

খিঙ্গমিঙ্গ মৃতদের উদ্দেশ্যে একটি চীনে উৎসব। আমি যখন খুব ছোট, মা তার বাবামায়ের উদ্দেশ্যে এই দিনে একটা করে চিঠি লিখত চীনে, যেখানে আমেরিকার কাটানো তার বিগত বছর কত ভালো ছিল তার বর্ণনা থাকত। মা চিঠিটা জোরে জোরে পড়ে আমায় শোনাত, আর আমি যদি কোনও মন্তব্য করতাম, তবে সেটাও ওই চিঠিতে জুড়ে দিত। তারপরে চিঠিটা একটা সারসের আকারে মুড়ে পশ্চিমদিকে মুখ করে উড়িয়ে দিত। আমরা সারসটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, সেটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে লম্বা রাস্তা পাড়ি দিত, প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে, চীনের দিকে, মায়ের পরিবারের সমাধিক্ষেত্রের দিকে।

আমি অনেক বছর আগে এটা শেষবার মায়ের সঙ্গে পালন করেছি।

“আমি চীনে ক্যালেন্ডার সম্বন্ধে কিছুই জানি না। তুমি বিশ্রাম নাও।” আমি বললাম।

“বাক্সটা তোর সঙ্গে রাখিস। আর কখনওসখনও ওটা খুলিস। শুধু খুলিস ౼ ” মা আবার কাশতে শুরু করল।

“ঠিক আছে, মা।” আমি বেমানানভাবে তার বাহুতে টোকা দিলাম।

“সোনা, আমি তোকে খুব ভালোবাসি ౼” আবার তার কাশিতে কথা আটকালো। অনেক বছর আগের একটা ছবি ভেসে উঠল আমার স্মৃতিতে, এই ভালোবাসি বলার সঙ্গে সঙ্গে মা নিজের বুকে হাত রাখছে।

“ঠিক আছে, মা, এবার চুপ করো।”

বাবা ফিরে এল, আমি বললাম আমায় তাড়াতাড়ি বিমানবন্দরে পৌঁছতে হবে কারণ আমি আমার উড়ান মিস করতে চাই না।

যখন আকাশপথে আমি নেভাদার ওপরে কোথাও তখন আমার মা মারা গেলেন।

#

মা মারা যাবার পড়ে বাবা খুব দ্রুত বুড়িয়ে গেল। বাড়িটা বাবার একার পক্ষে অনেক বড় ছিল বলে সেটা বিক্রির বন্দোবস্ত করা হল। আমার বান্ধবী সুজান আর আমি মিলে গেলাম জিনিসপত্র গোছানো আর বাড়ি পরিষ্কারের কাজে বাবাকে সাহায্য করতে।

সুজান চিলেকোঠায় সেই জুতোর বাক্সটা খুঁজে পেল। কাগজের প্রাণীগুলো চিলেকোঠার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে এতদিন আড়ালে থেকে ভঙ্গুর হয়ে গেছিল আর মলিন হয়ে গেছিল মোড়কগুলোর উজ্জ্বল ছাপগুলো।

“এরকম অরিগ্যামি আমি আগে কখনও দেখিনি,” সুজান বলল, “তোমার মা একজন অসামান্য শিল্পী ছিলেন।”

কাগজের প্রাণীগুলো নড়ছিল না। যে জাদুতে সেগুলো সচল ছিল হয়তো মা মারা যাবার পর তার প্রভাব আর নেই। অথবা আমি কল্পনা করে গেছি যে এগুলো কখনও জীবিত ছিল। একটা শিশুর স্মৃতিকে কখনও ভরসা করা উচিৎ নয়।

#

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহান্তে, মা মারা যাবার দু-বছর পরে, সুজান শহরের বাইরে গেছিল ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে তার একের পর এক চলতে থাকা ট্যুরগুলোর একটায়, এবং আমি বাড়িতে ছিলাম, কুঁড়েমি করে সময় কাটছিল টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

আমি হাঙরদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্রে আটকে গেলাম। হঠাৎ আমি দেখলাম, আমার মনে ভাসছে, মায়ের হাতের কাজ, যেভাবে সেগুলো ভাঁজের পর ভাঁজ করে টিনের মোড়ক দিয়ে আমার জন্য একটা হাঙর তৈরি করে দিয়েছিল, যখন আমি আর বাঘু মাকে দেখছিলাম।

একটা খচমচ আওয়াজ। আমি চোখ তুলে তাকালাম আর দেখলাম মোড়কের কাগজের একটা গোলা এবং ফিতে পড়ে আছে বইয়ের র‍্যাকের পাশের মেঝেতে। আমি আবর্জনার পাত্রে ফেলার জন্য ওই গোলাটা তুললাম।

গোলাটা সামান্য সরে গেল, নিজেই খুলে গেল, আর আমি দেখলাম ওটা বাঘু, যেটার কথা আমি সুদীর্ঘকাল ভাবিওনি। “হুউউউম।” মা নিশ্চয় একে জোড়া দিয়েছিল আমি হাল ছেড়ে দেবার পড়ে।

আমার স্মৃতির বাঘুর থেকে ওকে ছোট মনে হল। অথবা হয়তো সেই সময়ে আমার হাতের মুঠোর মাপই ছোট ছিল। সুজান কাগজের প্রাণীগুলোকে আমাদের ঘর জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে ঘর সাজানোর জন্য। সম্ভবত সুজান একটা লুকনো কোণে বাঘুকে রেখেছিল কারণ এটা দেখতে কুৎসিত।

আমি মেঝের ওপরে বসে পড়লাম, আর একটা আঙুল বাড়িয়ে দিলাম। বাঘু লেজ নাড়াল আর সে বেশ খেলাচ্ছলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি হেসে উঠে তার পিঠে টোকা দিলাম। সে আমার হাতের নিচে গুরগুর করতে থাকল।

“কেমন আছ, বুড়ো?”

বাঘু খেলা থামাল। উঠে দাঁড়িয়ে বেড়ালের মতো ভঙ্গিতে সে আমার কোলে লাফাল, তারপরে নিজের ভাঁজ খুলতে শুরু করল।

আমার কোলের ওপর একটা বর্গাকার কোঁচকান মোড়কের কাগজ পড়ে থাকল, যার উলটোদিকটা ওপরে। এটা চীনে অক্ষরে ভর্তি। আমি কখনও চীনা ভাষা পড়তে শিখিনি, কিন্তু ‘সোনা’ বোঝানোর জন্য যে অক্ষর সেটা আমি চিনি, আর সবচেয়ে ওপরে সেটা অক্ষরটাই ছিল, চিঠির শুরুতে যেখানে সম্বোধন থাকে সেই জায়গায়, হাতের লেখাটা মায়ের, সেই রকম অদ্ভুত বাচ্চাদের ছাঁদে।

আমি কম্পিউটারে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম। আজ খিঙ্গমিঙ্গ।

#

আমি চিঠিটা নিয়ে শহরের সেখানে গেলাম, যেখানে আমি জানতাম চীনা ট্যুরিস্ট বাস থামে। আমি সব ট্যুরিস্টকে থামিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলাম, “আপনারা কেউ চীনা ভাষা পড়তে পারেন?” ক্যান ইউ রিড চাইনিজ? আমি বহুকাল চীনা ভাষায় কথা বলিনি, ফলে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে আমার চীনা ভাষা বোঝার মতো বলা হচ্ছে কিনা।

এক তরুণী আমায় সাহায্য করতে এলেন। আমরা একটা বেঞ্চিতে বসলাম, তিনি চিঠিটা জোরে জোরে পড়ে আমায় শোনালেন। যে ভাষা আমি সচেতনভাবে ভুলে যেতে চেয়েছি এতকাল পরে তা ফিরে এল, আমি অনুভব করলাম শব্দগুলো আমার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, আমার ত্বক ভেদ করে, আমার অস্থির ভেতর দিয়ে, যতক্ষণ না তারা আমার হৃদয় নিংড়নোর জায়গায় না পৌঁছয়।

#

সোনা,

    আমরা দীর্ঘ দিন ধরে কথা বলিনি। আমি তোকে ছুঁতে চাইলেও তুই এত রেগে যাস যে আমি ভয় পেয়ে যাই। আর এখন আমার মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে যে ব্যথায় আমি ভুগছি তা বোধ হয় মারাত্মকরকমের কিছু।

তাই ভাবলাম লিখেই তোকে সব বলে যাই। আমি মোড়ক কাগজ দিয়ে যে প্রাণী তৈরি করে দিয়েছিলাম, যা তুই খুবই ভালবাসতিস সেই কাগজের ওপরে লিখছি।

এই প্রাণীগুলো, আমি মরে যাবার পরে আর নড়াচড়া করবে না। কিন্তু আমি যদি আমার সমস্ত অন্তর দিয়ে লিখতে পারি, তবে আমার আমিত্বের একটা অংশ এই কাগজে রেখে যেতে পারব। আর তারপরে তুই যদি খিঙ্গমিঙ্গের দিন আমার কথা মনে করিস, যে দিন মৃতদের আত্মারা তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করবার অনুমতি পায়, তবে আমি আমার যে অংশ রেখে যাচ্ছি তা-ও প্রাণ ফিরে পাবে। আমি যে প্রাণীগুলো তোর জন্যে তৈরি করেছিলাম সেগুলো আবার লাফিয়ে উঠবে, দৌড়বে আর ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর হয়তো তখন তুই এই চিঠিটা দেখতে পাবি।

যেহেতু আমায় সমস্ত অন্তর দিয়েই লিখতে হবে, তাই আমি এই চীনা ভাষাতেই লিখতে পারব।

আমি কখনও তোকে আমার জীবনের কথা বলিনি। যখন তুই ছোট্ট ছিলি, আমি ভাবতাম বড় হলে তোকে আমার সঅব কথা বলব, যাতে তুই বুঝতে পারিস। কিন্তু সে সুযোগ আর কখনও এল না।

আমার জন্ম ১৯৫৭-তে, সিগুলু নামে গ্রামে, হ্যবেই প্রদেশে। তোর দাদু-দিদা খুব গরীব চাষি ছিল রে, আত্মীয়স্বজনও ছিল কম। আমি জন্মানোর কয়েক বছর পরেই দেশে মহাদুর্ভিক্ষ শুরু হয়, মারা যায় তিরিশ লাখ মানুষ। সবচেয়ে পুরনো যে স্মৃতি আমার মনে পড়ে তা হল ঘুম ভেঙে উঠে আমি দেখছি আমার মা ময়লা খাচ্ছে, যাতে তার পেট ভরা থাকলে আমার জন্য খাবারের শেষটুকু পর্যন্ত রেখে দিতে পারে।

এরপর আস্তে আস্তে ভালো সময় এল। সিগুলু বিখ্যাত ছিল তার নিজস্ব অরিগ্যামির জন্য, আর আমার মা আমায় শিখিয়েছিলেন কীভাবে কাগজের প্রাণীদের ভেতরে প্রাণসঞ্চার করতে হয়। এটা ছিল আমাদের গ্রামের এক সত্যিকারের জাদু। আমরা মাঠের ফসল থেকে পোকা তাড়ানোর জন্য কাগজের জ্যান্ত পাখি তৈরি করতাম, আর মেঠো ইঁদুর তাড়ানোর জন্য তৈরি করতাম কাগজের বাঘ।

আমাদের নববর্ষের সময়ে আমি আর আমার বন্ধুরা তৈরি করতাম লাল কাগজের ড্রাগন। আমি সবসময় এদের মুখ ওপরের দিকে রেখে তাতে আতসবাজি জ্বালিয়ে দিতাম, ওপরের আকাশে সেই আলোর রোশনাই আমাদের বিগত বছরের কোনও কষ্টের স্মৃতিকে কাছে ঘেঁষতে দিত না। এটা দেখলে তোরও দারুণ পছন্দ হত।

তারপর এল ১৯৬৬-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লব। প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর, আর ভায়ের সঙ্গে ভায়ের বিরোধ শুরু হল। কেউ একজন মনে করিয়ে দিল, আমার মামা, সেই ১৯৪৬-এ হংকং চলে গেছিল, আর সেখানে ব্যবসা করছে। হংকং-এ একজন আত্মীয় থাকার মানেই ধরে নেওয়া হল আমরা হলাম গুপ্তচর আর জনগণের শত্রু, আর আমরা একঘরে হয়ে সবরকমের প্রতিকূলতার মধ্যে থাকতে লাগলাম। বেচারি তোর দিদা ౼ এই অসম্মান সইতে না পেরে কুয়োয় ঝাঁপ দিল। তারপরে কিছু ছেলে শিকারের বন্দুকের মুখে রেখে তোর দাদুকে বনের ভেতরে নিয়ে গেল, যেখান থেকে তোর দাদু আর কখনও ফিরে আসেনি।

তখন আমি দশ বছরের অনাথ মেয়ে। পৃথিবীতে আমার একমাত্র আত্মীয় আমার হংকংনিবাসী মামা। এক রাতে আমি লুকিয়ে পালালাম আর দক্ষিণগামী একটা মালগাড়িতে উঠে পড়লাম।

কদিন পরে গুয়াংদোং প্রদেশে কয়েকজন আমায় ধরে ফেলল যখন আমি একটা মাঠ থেকে খাবার চুরি করছিলাম। যখন তারা জানল আমি হংকং যাবার চেষ্টা করছি, তারা হেসে উঠল। “তোমার কপাল ভালো। আমাদের কাজই হচ্ছে মেয়েদের হংকং পাঠানো।”

তারা অন্য আরও মেয়েদের সঙ্গে একটা ট্রাকে পুরে লুকিয়ে সীমান্তপার করে আমায় চোরাচালান করে দিল।

একটা ভূগর্ভস্থ ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাদের দাঁড় করিয়ে বলা হল আমাদের যেন তাগড়া আর চটপটে দেখায়, খদ্দেরদের জন্য। খদ্দের পরিবারগুলো এই গুদামে এসে আমাদের দেখে পছন্দ করবার জন্য কিছু টাকা দিত আর তারপরে আমাদের ‘দত্তক’ নিত।

চিন পরিবার আমায় নিল তাদের দুটি ছেলে দেখভালের জন্য। রোজ ভোর চারটেয় উঠে আমায় সকালের খাবার বানাতে হত। ছেলে দুটোকে আমি খাওয়াতাম এবং স্নান করাতাম। আমি খাবারের জন্য সমস্ত বাজার করতাম। আমি কাপড় কাচতাম আর ঘর মুছতাম। সবসময়ে ছেলেদুটোর সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমি তাদের হুকুম তামিল করতাম। রাতে আমি রান্নাঘরের একটা আলমারিতে বদ্ধ থাকতাম ঘুমনোর জন্য। যদি কোনও কাজ করতে দেরি হত বা কিছু ভুল হত আমি মার খেতাম। ছেলেদুটোর ভুলের শাস্তিও আমি পেতাম। যদি ইংরেজি শিখবার চেষ্টা করতে গিয়েও আমি ধরা পড়তাম আমি মার খেতাম।

“তুই ইংরেজি শিখতে চাস কেন রে?” চিন পরিবারের কর্তা আমায় প্রশ্ন করতেন। “তুই পুলিশকে সব জানাতে চাস? আমরা পুলিশকে বলে দেব তুই চীনের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দা, বেআইনিভাবে হংকং-এ আছিস। ওরা খুশি হবে তোকে জেলে পুরে দিতে পারলে।”

ছ-বছর আমি এভাবেই বেঁচেছি। একদিন, বাজারের মাছওয়ালি আমায় একপাশে টানল।

“শোন, তোদের মতো মেয়েদের অবস্থা আমি জানি। তোর বয়স কত, ষোল? একদিন যে লোকটা তোকে কিনেছে, মাতাল হয়ে তোকে দেখবে আর গায়ে হাত দেবে, তুই ওকে থামাতে পারবি না। তারপরে ওর বউ যখন সব জানবে তোর মনে হবে তুই নরকে পৌঁছে গেছিস। তোকে এই জীবন থেকে বেরতে হবে। আমি এমন লোক জানি যে তোকে সাহায্য করতে পারবে।”

সে-ই আমাকে আমেরিকান লোকেদের কথা বলল যারা নাকি এশিয়ার মেয়েদের বউ করতে চায়। যদি আমি রান্না করি, ঘরদোর পরিষ্কার করি, আমেরিকান স্বামীর দেখভাল করি তবে বিনিময়ে আমি একটা সুস্থ জীবন পেতে পারি। আসল গল্প হল এই, যার ফলে আমি পাত্রী তালিকায় মিথ্যে বৈশিষ্ট্যসহ গৃহীত হয়েছিলাম আর তোর বাবার দেখা পেয়েছিলাম। এটা খুব রোম্যান্টিক গল্প নয়, কিন্তু এটাই আমার গল্প।

এই আমেরিকার শহরতলিতে, আমি খুব একা ছিলাম। তোর বাবা খুব দয়ালু মানুষ, আমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতেন, এবং আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু কেউ আমায় বুঝত না, আমিও কিছুই বুঝতে পারতাম না।

তারপর তুই এলি! তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আহ্লাদে আমার মন ভরে গেল, কারণ তোর মুখে আমি আমার বাবার ছায়া, আমার মায়ের, আমার ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। আমি আমার সমস্ত পরিবার, সিগুলু-র সব-ই, যা কিছু আমি পেয়েছিলাম আর যা কিছুকে আমি ভালবাসতাম, হারিয়েছিলাম। কিন্তু তুই এলি, তোর মুখটাই প্রমাণ করত আমার সমস্ত অস্তিত্বের স্মৃতি বাস্তব ছিল। আমার কল্পনা ছিল না।

এখন আমার কথা বলবার মতো কেউ ছিল। আমি তোকে আমার ভাষা শিখিয়েছিলাম, আর আমরা দুজনে মিলে সেই সব কিছু একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছিলাম যা আমি ভালবাসতাম আর হারিয়েছিলাম। যেদিন তুই প্রথম চীনা ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বললি ঠিক সেই ঢঙ্গে যেমন আমার মা বলত, আমি বলি, আমি আনন্দে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেঁদেছিলাম। যখন আমি তোর জন্য অরিগ্যামি করলাম আর তুই সেগুলো দেখে আনন্দ পেলি, আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু নেই।

তুই একটু বড় হলি, আর আমার সঙ্গে কথা বলতে তোর বাবাকে সাহায্য করতে পারলি। আমার মনে হল সত্যি আমার একটা পরিবার আছে। আমি শেষ পর্যন্ত একটা ভালো জীবন পেয়েছি। আমার মনে হত আমার এই সুখের দিন যদি আমার মা-বাবা দেখতে পেত, আমি তাদের রেঁধেবেড়ে খাওয়াতাম, তাদের ভালো রাখতে পারতাম। কিন্তু তারা তো আর ছিলেন না। তুই জানিস চীনেরা কোন জিনিস এই পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখের বলে মনে করে? যখন সন্তান বুঝতে পারে তার বাবা-মায়ের যত্ন নেবার প্রয়োজন, অথচ বাবা-মা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে।

সোনা, আমি জানি তুই তোর চীনে ধাঁচের চোখ অপছন্দ করিস, যেটা আমার থেকে পেয়েছিস। আমি জানি তুই তোর চীনে ধাঁচের চুল অপছন্দ করিস, যেটা আমার থেকে পেয়েছিস। কিন্তু তুই কি বুঝিস তোর অস্তিত্বের প্রতিটি কণাই আমার জন্য কত আনন্দের? আর তুই বুঝিস কী, সেই তুই কথা বলা বন্ধ করে দিলে, আমায় আর তোর সঙ্গে চীনা ভাষায় কথা বলতে না দিলে আমার ঠিক কী অবস্থা হয়? আমার মনে হয় আমি আবারও আমার সব কিছু হারিয়ে ফেলছি।

তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস না কেন, সোনা? সেই ব্যথাটা আমার লেখায় বাধা দিচ্ছে।

#

তরুণীটি চিঠিটা আমায় ফেরত দিল। আমি তার মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না।

না তাকিয়েই আমি তার সাহায্য চাইলাম, যাতে মায়ের চিঠিতে ভালোবাসা অক্ষরটা সে আমায় দেখিয়ে দেয়। আমি ওই অক্ষরটা বারে বারে ওই কাগজের ওপর লিখলাম, আমার পেনের অক্ষর মায়ের লেখার সঙ্গে পেঁচিয়ে গেল।

তরুণীটি সরে এসে তার একটা হাত আমার কাঁধে রাখল। তারপর উঠে চলে গেল, চলে গেল মায়ের সঙ্গে আমায় একলা ফেলে রেখে। ভাঁজগুলো বুঝে বুঝে সেই মতো আমি আবার বাঘুকে তৈরি করলাম। আমি তাকে কোলে তুললাম, সে গুরগুর করে উঠল, আমরা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

………………………………….
অনলাইন পাঠচক্র খাপছাড়া আড্ডায় পঠিত।

Leave a Comment