লিখেছেনঃ দূরের পাখি

অন্তর্মুখী, ‘আঙ্গুর ফল টক’ নামক জ্বরে আক্রান্ত পুরুষদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে—মেয়েরা ভালো ছেলেদের পাত্তা দেয় না, লম্পটদের ভালোবাসে আর প্রতারিত হয়ে গোঁ ধরে বসে যে পুরুষ মানুষই খারাপ। সুদীর্ঘকাল চলে আসা এই কথার মধ্যে সারবস্তু একেবারে যে নাই, তা নয়। কিছুদিন আগে কোন একজন জ্বালাময়ী ভদ্রলোক এই কথার আদ্যোপান্ত ছিড়েখুঁড়ে দেখিয়েছেন এটা আসলেই ‘আঙ্গুর ফল টক’ সিনড্রোমের কথন। প্রথমত, এই কথার মধ্যে ভালো ছেলে নামক যে বস্তুর কথা হচ্ছে তার মধ্যে ঠিক নৈতিকতার মানদণ্ডে ভালো-খারাপের কোন ব্যাপার নাই । জ্বালাময়ী ভদ্রলোকের মতে, আসল ব্যাপার হচ্ছে যেসব ছেলেরা আত্নবিশ্বাস ও সামাজিক দক্ষতার মাধ্যমে মেয়েদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না, কেবল গোপনে লালা ঝরাতে পারে, তারাই নিজেদের ভালো ছেলে বলে দাবী করে। এই কথিত ভালো ছেলেরাই আক্ষেপ করে মেয়েরা কেনো তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের সাথে প্রেম ও যৌনতার সম্পর্ক স্থাপন করে না।

Photo: Guardian (Nymphomaniac 2014)


এর সবই আসলে যৌক্তিক। কিন্তু সুদীর্ঘকাল চলে আসা এই কথার মধ্যে সারবস্তুও যে অনেকখানি আছে, সেটাও তো ঠিক। রবার্ট ট্রিভার্স (Robert Trivers) নামের এক তিক্তকথক বিজ্ঞানী গত শতকের শেষ অর্ধাংশের বিবর্তনীয় জীব-সমাজ-মনোবিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে প্রতারক ও প্রতারিতের সম্পর্কের নানান দিক সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন তার The Folly of Fools: The Logic of Deceit and Self-Deception in Human Life বইয়ে। উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের শিকার-শিকারীর যৌথ বিবর্তনে দেখা যায় শিকারীর দক্ষতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে শিকারের পালানো অথবা ধোঁকা দেয়ার দক্ষতা। ধোঁকা দেয়ার দক্ষতার মধ্যে আছে পরিবেশের সাথে গায়ের রং পাল্টানো থেকে শুরু করে নিজের দৌড়ের দিক কোনভাবেই যাতে বুঝা না যায় এমন ধরণের কৌশল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ইঁদুর-বিড়াল খেলার ফলাফলে একসময় দেখা যায় দুইপক্ষেরই নিজস্ব দক্ষতা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে প্রথম দেখায় একেকটা উদ্ভিদ ও প্রাণীকে একেবারে অলৌকিক মনে হয়। কিন্তু এই প্রায়-অলৌকিক জটিলতার গভীরে কেবল নিজস্ব জিনের ধারাবাহিকতা রক্ষার চেষ্টার মত সরল জিনিসের বেশি কিছু নাই।

বিবর্তনীয় বাস্তবতায় মানুষ প্রজাতির নর-নারীর সম্পর্কও একেবারে গভীরে মূলত শিকার ও শিকারীর সম্পর্ক। তবে মানুষের ক্ষেত্রে নর বা নারীতে শিকার-শিকারীর ভেদরেখাটি মুছে গিয়েছে। যৌনতা পরবর্তী সন্তান লালনের ভার নারীর হাতে ফাঁসিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা পুরুষ, শারিরীকভাবে আবেদনহীন পুরুষের কাছ থেকে মনোযোগ ও সম্পদ নিয়ে আবেদনময় পুরুষের ঔরসের সন্তান লালন করার চেষ্টা করা নারী, দুইপক্ষই একই সাথে শিকার এবং শিকারীর ভূমিকায় থাকে। ‘ভালো ছেলেদের মেয়েরা পাত্তা দেয় না’ প্রবাদের ভিতরে যেটুকু সারকথা তা মূলত শিকারী পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের রসায়ন থেকে উদ্ভুত।

মানুষের সুদীর্ঘ বিবর্তনী ইতিহাসের কোন এক সময়ে আত্নবিশ্বাস হয়তো অন্তর্গত যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচায়ক ছিলো। কিন্তু আত্নবিশ্বাসকে পুরুষ বাছাইয়ের জন্য চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করা শুরু হলে অবশ্যাম্ভাবীভাবে একদল প্রতারকের উদ্ভব ঘটে যারা নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসাবে অন্তর্গত দক্ষতা অর্জনের মত কঠিন পথের চাইতে আত্নবিশ্বাস প্রদর্শনের শর্টকাট পথ বেছে নেয়। এই তিক্ত বাস্তবতা কেবল নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে নয়, এমনকি কর্মক্ষেত্রে কাজের দক্ষতা ও আত্নবিশ্বাসের সম্পর্কের মধ্যেও এমনভাবে ঢুকে গেছে যে মেকি আত্নবিশ্বাস বুঝতে পারার দক্ষতার প্রশিক্ষণ নিতে হয় রিক্রুটারদের। একইরকমভাবে নারী যদি সম্পর্ক স্থাপনের আগে সম্পর্ক করতে চাওয়া পুরুষের সিরিয়াসনেস দিয়ে পুরুষ বিচার করতে চায়, সেখানেও সত্যিকারের সিরিয়াস পুরুষের পাশাপাশি আরেকটি গোত্রের অবশ্যাম্ভাবী উদ্ভব ঘটে যারা আসলে সিরিয়াস নয়, কিন্তু সিরিয়াসনেস, কোমলতা, প্রেমভাবালুতার প্রদর্শনে দক্ষ।

এই ধরণের শিকারী পুরুষদের আসল উদ্দেশ্য বুঝার জন্য নারীর বিবর্তনীয় চাপ তাকে চালিত করে অন্য কোন উপায় বের করার দিকে। অন্যদিকে পুরুষের বিবর্তনীয় চাপ তাকে চালিত করে আবার নতুন কোন শর্টকাট বের করার দিকে। এই অনন্ত চোর-পুলিশ খেলা নিয়ন্ত্রিত হয় এক ধরণের গতিশীল ভারসাম্যের মাধ্যমে যার গালভরা বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে পৌনঃপুনিকতা-নির্ভর ভারসাম্য (Frequency-dependent equilibrium)। প্রজাপতি-খোর পাখি ও প্রজাপতিদের মধ্যে এরকম একটা ভারসাম্য দেখা গেছে বিস্তারিতভাবে। পাখির খাবার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য কিছু কিছু প্রজাপতির মধ্যে এক ধরণের জেনেটিক পরিবর্তন হয়ে তাদের মাংসের স্বাদ খুবই জঘন্য হয়ে যায় পাখির কাছে। ফলে ঐ ধরণের প্রজাপতি একবার খাওয়ার চেষ্টা করেছে এমন পাখি আর জীবনে কোনদিন ঐ ধরণের প্রজাপতির ধারেকাছেও ঘেঁষে না। পাখি যেহেতু বিষাক্ত ঐ প্রজাপতি খেয়ে দেখে দেখে জ্ঞানী হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারে না, সেহেতু ঐ ধরণের প্রজাপতির রং, আকার এইসব দিয়ে বিচার করে কোন প্রজাপতি খাওয়া যাবে, কোনটা খাওয়া যাবে না, এটা ঠিক করে। ফলে অবশ্যাম্ভাবীভাবে এক ধরণের প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটে যারা কেবল দেখতেই বিষাক্ত প্রজাপতির মত, অন্য কিছুতে না। কারণ শরীরে সত্যিকারের বিষ উৎপাদন ও বহন করার চাইতে রং ও আকারে ঐরকম দেখা যাওয়া অনেক সহজ, বিবর্তনীয় ও শারীরবৃত্তীয়ভাবে। এই ধরণের কেবল দেখতে বিষাক্ত প্রজাপতি যেহেতু সহজেই পাখির খাওয়া হওয়া থেকে বেঁচে চায়, সেহেতু কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই এদের সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। এখন পাখিদের মধ্যে শুরু হয় আরেক বিবর্তনীয় চাপ। খাবার অনেক কমে আসার ফলে যেসব পাখি ঝুঁকি নিয়ে বিষাক্ত প্রজাপতি খেতে যায় তারা হঠাৎ করে আবিষ্কার করে এগুলো দেখতেই কেবল বিষাক্ত কিন্তু আসলে স্বাভাবিক । ঝুঁকি নিতে পছন্দ করা পাখিরা এবার সংখ্যায় বাড়তে থাকে। ফলে কমতে থাকতে কেবল বর্ণে ও আকারে বিষাক্ত হওয়ার ভান করা প্রজাপতিরা। এদের সংখ্যা কমে আসলে, এবার ঝুঁকি নেয়া পাখিরা আগের মত সুবিধা পায় না, কারণ ঝুঁকি নিতে গেলেই দেখা যায় মুখে সত্যিকারের বিষাক্ত প্রজাপতি ঢুকে গেছে। এবার ঝুঁকিপ্রিয় পাখির সংখ্যা কমতে থাকে। একই চক্র আবার শুরু হয় প্রথম থেকে।

হোমো স্যাপিয়েন্সের নারী পুরুষের ভিতরেও এ ধরণের গতিশীল পৌনঃপুনিকতা নির্ভর ভারসাম্য তৈরী হয়েছে নিশ্চয়ই শিকারী পুরুষ ও শিকার প্রতিরোধ করে দেয়া নারীদের ভিতরে। নারীর নির্ভরশীল পুরুষ বিচারের মানদণ্ডকে ফাঁকি দেয়ার সিস্টেম আবিষ্কার করা পুরুষদের, ধরা যাক এদের নাম দেয়া হলো লম্পট পুরুষ, ফাঁদে পড়ে যাওয়া নারীর সংখ্যা দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিমাণে দেখা যাওয়ার পটভূমিতেই আদতে ভালো ছেলেদের মনোকষ্টের প্রবাদটির উদ্ভব।


এখন এই লম্পট পুরুষ ও লম্পট নারীর দ্বিপক্ষীয় প্রতারণা ও শিকার-শিকারী সম্পর্কের মধ্যে তৃতীয় পক্ষ আপনি বা আমি ঢোকার কারণ কী? একে আপাতভাবে হিংসা, বিদ্বেষ, পরনিন্দার মত একটি উদ্ভট বদভ্যাস মনে হলেও এর গভীরে রয়েছে আপনার আমার জিনের নিজস্ব স্বার্থগত অনেক জটিলতা।

মানুষের সমাজ কেন গড়ে উঠে, এই প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ হলেও সমাজ কিভাবে টিকে থাকে তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীকেই গলদঘর্ম হতে হয়েছে। জীব-বিবর্তন বা আরো নির্দিষ্টভাবে বলতে প্রাকৃতিক নির্বাচনভিত্তিক জীব-বিবর্তন পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের ব্যাখ্যা সুসংহত তত্ত্ব হয়ে উঠার পর থেকে একটি চিন্তা ক্রমশ জোরালো প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিতে থাকে মানুষের সামাজিক দর্শনে। প্রতিটি জীবনরূপের অন্তর্গত চালিকাশক্তি যদি কেবলি নিজের জিনের প্রবাহের ইচ্ছা হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে সেই দুর্বার স্বার্থপর চালিকাশক্তি অগ্রাহ্য করে মানুষ একে অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে, নিজের স্বার্থত্যাগ করে অন্যের উপকার করে, অনেকের বোঝা একজনে কাঁধে নিয়ে অগোছালোভাবে হলেও সমাজ নামক বস্তুটি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যদি নিজের স্বার্থই একমাত্র চালিকাশক্তি হয়, তাহলে কি মেরেকেটে লুটেপুটে যেভাবে হোক নিজের প্যাটচ্যাটপূর্তি করাই মানুষের একমাত্র কাজ হওয়ার কথা নয়? মানুষের সমাজ যেমন চাক্ষুষ বাস্তবতা তেমনি বিবর্তনীয় তত্ত্বের সত্যতাও। কিন্তু দুইটার মাঝে কেমন যেন এক বিরাট ধাঁধা।

প্রথম ধাক্কায় মানুষের এই আপাত অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয় গ্রুপ সিলেকশন বা দল নির্বাচন নামক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ যেহেতু সমাজ ছাড়া কোনভাবেই টিকতে পারে না, সেহেতু নিজের টিকার স্বার্থেই তাকে কোন না কোন একটা সমাজের ভিতরে থাকতে হবে। এখন সমস্যা হচ্ছে বিবর্তনীয় হিসাব অনুযায়ী সমাজের ভিতরে থেকে সমাজের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়ে হাঁড়কিপ্টের মত সর্বনিম্ন যতটুকু দেয়া যায় ততটুকু দিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করাই হওয়া উচিৎ মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু বাস্তবের সমাজে সেটা দেখা যায় না। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সমাজে আসলেই অনেক অনেক মানুষ আছে যারা যতটা নেয় তার চাইতে বেশি দেয়, আরো অনেক বেশি মানুষ আছে যারা যতটা নেয় তার কাছাকাছি পরিমাণেই দেয়। দলগত নির্বাচনের তত্ত্ব অনুযায়ী এই আচরণের রহস্য হচ্ছে, যেসব সমাজে বেশিরভাগ লোক কেবল নিজে খাই খাই করে সমস্ত কিছু নিয়ে সর্বনিম্ন পরিমাণে প্রতিদান দেয়ার চেষ্টায় থাকে, সেই সমাজ পৃথিবীর বুকেই টিকতে পারে না। বাস্তবেও দেখা যায় ঐ ধরণের বেশ কিছু লোক জড়ো হলে আসলে সমাজ নামক কোন বস্তুই গড়ে উঠে না। অর্থাৎ প্রতিটা সমাজ অতি অল্পসংখ্যকই ঐ ধরনের লোক নিয়ে টিকে থাকতে পারে যারা চূড়ান্ত বিবর্তনীয় স্বার্থপরতা দেখায়। এদের সংখ্যা বেশি হলেই যেহেতু সমাজসুদ্ধ বিলুপ্ত হয়ে যায়, সে কারণেই বর্তমানের টিকে থাকা সমাজের মধ্যে আমরা বেশিরভাগ মানুষ দেখি যারা স্বার্থ ও পরার্থের একটা ভারসাম্য বজায় রাখে।

দলগত নির্বাচনের এই ব্যাখ্যাটি কথায় যুক্তিযুক্ত মনে হলেও বৈজ্ঞানিক দিক থেকে সুসংহত নয়, বিশেষত বিবর্তন ও বংশগতির একক হিসাবে ডিএনএ এবং জিনের আবিষ্কারের পর দেখা যাচ্ছে বিবর্তন ঘটে যেই স্তরে সেই স্তরে সমাজ দূরের কথা, ব্যক্তি দূরের কথা, ব্যক্তির অঙ্গ দূরের কথা, ব্যক্তির এক কোষ থেকে আরেক কোষের মধ্যেও কোন সংঘবদ্ধতার চিন্তা নাই। পুরা ব্যাপারটাই ঘটছে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে, অণু ও অণুর ভিতরকার পরমানু গ্রুপের লেভেলে। এইসব আবিষ্কারের ফলে মানুষের সামাজিক বিবর্তনে দলগত নির্বাচনের তত্ত্বটি বাতিল হয়ে যায়। ফলত যে সমস্যার ব্যাখ্যা দিতে এই তত্ত্বের আবির্ভাব সেই সমস্যা আবার নতুন করে দেখা দেয়।

কেন মানুষ সমাজের ভিতরে নিজেদের জিনের সর্বোচ্চ নগ্ন স্বার্থের কথা না ভেবে আপাতভাবে হলেও একটা ভারসাম্যপূর্ণ দেয়া-নেয়ার সিস্টেম তৈরী করে? ই ও উইলসন, রিচার্ড ডকিন্স, ডাব্লিউ ডি হ্যামিলটন, রবার্ট ট্রিভার্স, ফ্রান্স ডি ওয়াল, জেইন গুড্ডাল এর মত বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে ধীরে ধীরে একটি কাঠামো তৈরী করেন এই প্রশ্নের উত্তরের। ইথোলজি (Ethology) নামে জীববিজ্ঞানের নতুন এক শাখারও উদ্ভব ঘটে। নতুন এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী সমাজের ভিতরকার প্রতিটি মানুষ গভীরে কেবল নিজের স্বার্থের কথা ভেবে কাজ করে গেলেও এমন ধরণের কিছু অবস্থা তৈরী হয়, যাতে নিজের জিনের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থই তাকে স্বল্পমেয়াদের কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য করে। তবে এবারের ব্যাখ্যা কেবল কিছু তত্ত্বকথাতে যুক্তি উপস্থাপন করেই শেষ হয়নি। এই ব্যাখ্যা সুসংহত ও সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্নদিকের আরেকজন উদ্ভট মেধাবীর কল্যাণে।

ঠিক এমনসব সময়েই জন ন্যাশ নামের একজন গণিতবিদ তৈরী করেন গেইম থিওরি। আমার মত নাদানের কাছে প্রায় অতিপ্রাকৃতিক মনে হওয়া অনেক গাণিতীক সমীকরণের মাধ্যমে ন্যাশ দেখান যে একসাথে জড়ো হওয়া বেশ কিছু মানুষ সম্পূর্ণ নিজের স্বার্থের জন্য কাজ করে গেলেও তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্যে এমন কিছু কম্বিনেশন সম্ভব যেগুলোতে পৌঁছালে সবাই নিজের স্বার্থ দেখেও একসাথে দীর্ঘমেয়াদে ভারসাম্যে আসতে পারে। এইসব সম্ভাব্য কম্বিনেশনগুলোকে বলা হলো ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম বা ন্যাশ ভারসাম্য। ইথোলজিস্ট ও জীব-বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন সবাই নিজ নিজ স্বার্থের কথা চূড়ান্ত ধরে নিয়ে আচরণ করলেও সমাজ টিকে থাকার কারণ হচ্ছে অনেক রকমের ভাঙা-গড়ার মাধ্যমে কোন না কোন একটা ন্যাশ ভারসাম্যে পৌঁছানো।

ন্যাশ ইকুলিব্রিয়াম কেবল গাণিতীক হিসাব দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। জীববিজ্ঞানীরা অনেক ধরণের পরীক্ষণমূলক গেইমের মাধ্যমে মানুষের সামাজিক আচরণের চালিকা শক্তি বুঝার চেষ্টা করেছেন। ধরা যাক এমন একটা গেইমের কথা। পাঁচজন আলাদা আলাদা মানুষকে একটা খেলার জন্য ডাকা হলো। খেলাটা এরকম যে মাঝে রাখা একটা বাক্সের মধ্যে সবাইকে নিজ পকেট থেকে টাকা ফেলতে হবে। সবার টাকা ফেলা শেষ হলে যিনি পরীক্ষার সঞ্চালক তিনি সম্মিলিত টাকাকে দ্বিগুন করে দেবেন। সেই টাকা সবাই মিলে আবার সমান ভাগ করে নিবে। পাঁচজনের সবাই যদি দশ টাকা করে ফেলে তাহলে সবাই বিশ টাকা করে ফেরত পাবে। কিন্তু মাঝখানে একজন যদি কিছুই না ফেলে তাহলে সবাই ষোল টাকা করে পাবে। যে কিছুই ফেললো না তার লাভ পুরো ষোল টাকা । অন্যদিকে বাকি সবার লাভ মাত্র ছয় টাকা। নিজেকে একজন খেলোয়াড় হিসাবে ভেবে দেখুন। প্রথমবার দশ টাকা দিয়ে বিশ টাকা পেলেন। পরেরবার পেলেন ষোল টাকা। তখনি আপনার মধ্যে সন্দেহ আসবে কেউ না কেউ অন্যায় করছে। পরেরবার আপনি টাকা আরেকটু কমিয়ে দিলেন। আপনার মত অন্যরাও সন্দেহ করলো কেউ না কেউ অন্যায় করছে। তারাও টাকা কমিয়ে দিলো। এক পর্যায়ে দেখা যাবে আপনি পাঁচ টাকা দিলেন সবাই দিলো শূন্য। ফলস্বরূপ পাঁচ টাকা দিয়ে আপনি ফেরত পেলেন দুই টাকা। তখন আপনার মানসিক অবস্থা কিরকম হবে?

এই ধরণের শত শত অনেক চমৎকার, ধুরন্ধর গেইমের আয়োজন করে তার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেলো সামাজিক আচরণে নিজের সর্বোচ্চ স্বার্থের কথা চিন্তা করে মানুষ মূলত সহজ কিছু নীতির মাধ্যমে নিজের করণীয় ঠিক করে। এক, প্রথমত মানুষ সাধারণত অন্যের সদিচ্ছার উপর আস্থা রেখে আগায়; যখন দেখে অন্যপক্ষের সদিচ্ছা নাই তখন নিজেও পিছু হটে। আর যদি অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা থাকে তাহলে নিজের ক্ষতি করে হলেও সেই দিকে যায়। ঠিক এই ধরণের আচরণের সমষ্টির কারণেই মানুষের কোন কোন সমাজ টিকে থাকে আর কোন কোন সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়।

এখন উপরের গেইমে সেই প্রথম ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন, যে নিজে শূন্য টাকা দিয়ে ষোল টাকা বাগিয়ে নিলো তাকে শাস্তি দেয়ার কোন ব্যবস্থা যদি থাকে তাহলে আপনি সেই পথে হাঁটবেন কিনা। মানুষের যা জেনেটিক গড়ন, তাতে প্রায় সবাই সেই পথেই হাঁটবে। কারণ যদি এই গেইম চালিয়ে নিতে চান, আপনাকে এই লোকের বিরুদ্ধে কোন না কোন ব্যবস্থা নিতেই হবে। কোন ব্যবস্থা না নিলে দুই তিন দান পরেই এমন অবস্থায় পৌঁছাবে যেখানে আপনি যা বাক্সে দিবেন সেটাই আপনার লস। অন্যরাও একই চিন্তা করবে। ফলতঃ আপনাদের পুরো খেলাটাই ভেঙ্গে পড়বে।

আমাদের বৃহত্তর সমাজও ঠিক এধরণেরই শত শত গেইমের সম্মিলিত রূপ। ছোট ছোট গেইমগুলোর মত বৃহত্তর সমাজেরও টিকে থাকা এবং বিকশিত হওয়া নির্ভর করে সবার নিজ নিজ স্বার্থকে চূড়ান্ত রেখেও কোন না কোন একটা ন্যাশ ভারসাম্যে পৌঁছানোর উপর। উদাহরণে তুলে ধরা গেইমটির ভেঙে পড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নাজুক যে উপাদানটি সেটি হচ্ছে একজন এমন খেলোয়াড়ের আবির্ভাব যে অন্যদের মাথার উপর কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার প্রথম চেষ্টাটি করে। একে ঠেকানো না গেলে পুরো গেইম, পুরো সমাজ ভেঙে পড়বে। যেহেতু আপনার দীর্ঘমেয়াদি লাভ ও উত্তরণ নির্ভর করে ন্যাশ ভারসাম্যকে রক্ষার উপর সেহেতু আপনার স্বার্থপরতার কারণেই আপনি চাইবেন ঐ কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া খেলোয়াড়টিকে থামানোর, স্বল্পমেয়াদে নিজের ক্ষতি স্বীকার করে হলেও। এই একজনের তৈরী করা সমস্যাকে বলা হয় ফ্রি লোডিং প্রবলেম – মাগনা খেতে চাওয়া লোককে ঠেকানোর সমস্যা।

অর্থনৈতিকভাবে এই সমস্যা তৈরী হয় সমাজের ভিতরে মানুষে মানুষের যোগ্যতা, দক্ষতা, জিনগত উঁচু নীচুর প্রাকৃতিক বিন্যাসের উপর। সমাজের ভিতরে আপনি সবার কাছ থেকে সমান আশা করতে পারেন না। কেউ নির্বোধ হয়ে, কেউ পঙ্গু হয়ে, কেউ অক্ষম হয়ে জন্ম নেয়। সমাজ পুরোপুরি টিকে থাকতে হলে তাদেরকেও আপনার দেখভাল করতে হয়, কারণ কোন একটা দিক থেকে হয়তো দেখা যাবে সে আপনার দীর্ঘমেয়াদী জিনগত বিস্তারের জন্য সহায়ক। এখন সমাজের গেইমগুলো যেরকম, ধরা যাক এক লাখ লোক মিলে এই খেলা খেলছে। সেখানে দুই-দশজন যদি এরকম কাজ করেও থাকে তাকে ধরা বেশ কষ্টকর থেকে প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এর বিস্তার শুরু হয়ে গেলে তাসের ঘরের মত সমাজ ভেঙে পড়বে। সেরকম অবস্থায় পৌঁছালে সবারই ক্ষতি। দশজনকে মেনে নিয়ে চললে যে ক্ষতি, তার চাইতেও বেশি। অর্থাৎ আপনার ভারসাম্য বিন্দু ঠিক হবে ঠিক কতটুকু অংশের ফ্রি লোডিংকে পুরো সমাজ মেনে নিতে পারবে তার উপর। একেবারে আদিতে মানুষ চেষ্টা করেছে ঈশ্বর নামের এক ধরণের কাল্পনিক সর্বময় ক্ষমতাধর সর্বব্যাপী সর্বদ্রষ্টা বস্তুর ভয়ের মাধ্যমে ফ্রি লোডিংকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার। কালের বিবর্তনে সেটা অযোগ্য ব্যবস্থা বলে পরিত্যক্ত হয়েছে। মানুষ চেষ্টা করেছে পূঁজিবাদের, যেখানে আপনার সমস্ত লাভ-ক্ষতি, উত্তরণ ও অবরোহন নির্ভর করে আপনার যোগ্যতার উপর। সেটাও সমাজের ভারসাম্য রক্ষায় অপ্রতুল, কারণ সমাজের ভিতরে দৈব বাস্তবতায় এমন সব লোকের জন্ম হয়েছে, হচ্ছে যাদের ফ্রি লোডিং ছাড়া অন্য উপায় নাই। মানুষ চেষ্টা করেছে সমাজতন্ত্রের, যেখানে সর্বব্যাপী, সর্বক্ষমতাময়, সর্বদ্রষ্টা ঈশ্বরের মতই সর্বব্যাপী রাস্ট্রব্যবস্থা নাগরিকের হাগামুতাযৌনতাশিক্ষাকাজব্যবসা সমস্ত কিছুর উপর নজরদারী করবে যাতে কেউ অন্যায়ভাবে ফ্রি লোডিং করতে না পারে। সেটাও কালক্রমে পর্যবসিত হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছের লোকদের নিজস্ব ফ্রি লোডিং এর অর্জিতে। এখন এক জগাখিচুড়ি ব্যবস্থার মাধ্যমে টিকে আছে তিন ধরণের মিলিত শাসনে।

এখন আপনার লাম্পট্যের সমস্যাটিও উপকথার ‘আমি’র কাছে এক ধরণের ফ্রি লোডিং এর সমস্যা। বৃহত্তর দৃষ্টিতে এর কারণ দুইটা। এক হচ্ছে এক জোড়া নর-নারী যদি ২.১১ সংখ্যক সন্তান রেখে যেতে না পারে তাহলে আজ হোক দশ সহস্রাব্দ পরে হোক সেই সমাজ বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটা আমরা জনসংখ্যার গাণিতীক বিশ্লেষণে অমোঘ সত্য হিসেবে জেনে গেছি। ২ এর চাইতে সামান্য বেশি কারণ কিছু সংখ্যক আন্তঃলিঙ্গ, সমকামী, সন্তান জন্মদানে অক্ষম বা আরো এধরণের অনেক ক্যাটাগরিতে চলে যাবে। দ্বিতীয়ত, অনেক শতাব্দীর ভাঙা-গড়া, ব্যক্তিস্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা, নারীবাদ, নৈরাজ্যবাদসহ অনেক অনেক ধরণের পরীক্ষণমূলক ব্যবস্থার ফলাফল থেকে আমরা জেনেছি জৈবিক বাবা-মায়ের সাথে ২.১১ সংখ্যক সন্তান উৎপাদনের ব্যবস্থা ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে আমাদের সমাজ টিকবে না। এই দুই বড় অভিজ্ঞানের পটভূমিতে সমাজের ন্যাশ ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে আপনার লাম্পট্য সংজ্ঞায়িত হবে এইভাবে যে, আপনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন , তাহলে যৌনতা উপভোগের পরিপ্রেক্ষিতে সন্তানের দায়িত্ব নিতে না চেয়ে যদি আপনি যদি কেবল উপভোগের নিমিত্তে যৌনতার পিছনে আপনার মেকি আত্নবিশ্বাস আর মেকি প্রেমভাবালুতা নিয়ে নারী শিকারে নেমে পড়েন; আর আপনি যদি নারী হয়ে থাকেন তাহলে যদি শারিরীকভাবে আবেদনহীন পুরুষের কাছ থেকে মনোযোগ ও সম্পদ নিয়ে আবেদনময় পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণের প্রবৃত্তিতে মত্ত থাকেন। দুই ক্ষেত্রেই আপনাকে সংজ্ঞায়িত করা হবে ফ্রি লোডার হিসাবে। আপনাকে দমন করা অথবা আপনাদের শতকরা হারকে সহনীয় একটা পর্যায়ে রাখার চেষ্টা, যে হারের নীচে থাকলে পুরো সমাজ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না, আমার সচেতন মনের স্বিদ্ধান্ত নয়, আমার অবচেতন, অচেতন, সম্পূর্ণ রাসায়নিক জিনের প্রবৃত্তি।

এইভাবে বললে ফ্রি লোডিং সমস্যাটিকে হয়তো এক ধরনের মানুষের আরসব বিবর্তনী উত্তরাধিকারের মত একটা কিউট ছোটোখাট সমস্যা বলে মনে হতে পারে। কিন্ত মানুষ সম্ভবত এই সমস্যাটিকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে ধরে নেয়ার মানসিকতাতেই বিবর্তিত হয়েছে। মানুষের কাছে এই সমস্যার এতটাই গুরুত্ব যে এর সমাধানে কোটি কোটি মানুষ হত্যার দিকেও চালিত হয় সে। সমাজতান্ত্রিকতার পথে হাঁটা মানুষ পূঁজির জোরে অন্য মানুষের শ্রমের ফল ভোগ করা লোকদের ফ্রি লোডার হিসাবে দেখার কারণে বুর্জোয়া নামক ফ্রিলোডার শ্রেণীশত্রুর খতমকে কেবল সঠিক ও ন্যায্যই মনে করে না, বরং মানবের বৃহত্তর উপকারের জন্য অবশ্য-কর্তব্য বলে মনে করে। অন্যদিকে সমাজবাদী ব্যবস্থায় অন্যের যোগ্যতা ও শ্রমের ফসল সমানভাবে ভাগ করে অন্যরা নিয়ে যাবে এই ফ্রিলোডিং এর ভয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও ব্যক্তির স্বাধীনতার নামে লড়াই করে যাওয়া পূঁজিবাদীও কোটি কোটি মানুষের হত্যা ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে দেখে কেবল সামান্য কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসাবে।

এই ফ্রিলোডিং এর ভয় মানুষের গভীরে এমনভাবে জেঁকে বসে যে সে নিজে ফ্রি-লোডার হয়েও অন্যের ফ্রিলোডিংকে জগত ধ্বংসকারী উৎপাত বলে চিৎকার করে যাবার মত হিপোক্রেসিও তার চোখে ধরা পড়ে না। গেইম থিওরির বিভিন্ন গেইমে একজন ফ্রিলোডার লাভ করতে পারে কেবলমাত্র যতক্ষণ গেইম চলে ততক্ষণ। সেই হিসেবে নিজে ফ্রি-লোডার হলেও তার অস্তিত্ব টিকে থাকে ঠিক ততক্ষণই যতক্ষণ অন্যরা ফ্রি-লোডিং শুরু করে পুরো ব্যবস্থাকে তাসের ঘরের মত ভেঙে না দিচ্ছে। যেহেতু পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়লে ফ্রি-লোডার ও ন্যায্য খেলোয়াড় দুই পক্ষেরই অবর্ণনীয় ক্ষতি, সেহেতু ফ্রি-লোডারদের এই হিপোক্রেসি বরং পুরো ব্যবস্থার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। একজন নিজে ফ্রিলোডিং করে যদি অন্যের ফ্রিলোডিং এ কোন বাঁধা না দেয় তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রিলোডারদের সংখ্যা সেই ক্রিটিক্যাল সংখ্যার চাইতে বেশী হয়ে যাবে যেখান থেকে সমস্তকিছু ভেঙে পড়ে সবার জন্যই প্রাকৃতিক নরক নেমে আসবে।

অবশ্যাম্ভাবীভাবে বিবর্তনের মত লাখ লাখ বছরের পোড় খাওয়া একটা সিস্টেম কখনোই একটা খুঁটি দিয়ে পুরো তাবু ধরে রাখার মত হঠকারী ব্যবস্থা তৈরী করে না। আপনার ফ্রি লোডিং ঠেকানোর অন্তর্গত ঠেলাই আপনার লাম্প্যট্যের ব্যাপারে আমার ঔৎসুক্য ও তাকে সহনীয় পর্যায়ের রাখার একমাত্র চালিকাশক্তি নয়। আপনার লাম্প্যট্য যদি আমার কাছের কোন পুরুষ বা নারীকে আক্রান্ত করে যাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার সময় ও সম্পদের একটা অংশ আমাকে ব্যয় করতে বাধ্য হতে হয়, সেটা ঠেকানোর চেষ্টা করা আমার জিনের নিজস্ব একান্ত স্বার্থপর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আপনার মত লম্পট পুরুষ যদি সমাজে বিপুল সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ে, তাতে আমার বোনের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বেড়ে যায়, আপনার মত লম্পট নারী যদি সমাজের বিপুল সংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ে তাতে আমার ভাইয়ের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বেড়ে যায়। এই দুই সম্ভাব্যতাকে যতদূর সম্ভব নীচু রাখার চেষ্টা আমার নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টার থেকে খুব বেশী দূরে নেই। আবার অন্যদিকে সেই প্রায় অলৌকিক, প্রায় এবসার্ড কৌতুকের যে মর্মকথা তা-ও তো আছে। প্রবাসী ছেলেকে মা ফোন করে বলছে, বাপজান দুই দেশে আসিস না। তুই যদি দেশে আসিস তাহলে নির্ঘাৎ কাজের মেয়েটার এইডস হবে। কাজের মেয়ের এইডস হলে তোর বাপের হবে। তোর বাপের হলে আমার হবে। আমার হলে তোর চাচার হবে। তোর চাচার হলে তোর চাচীর হবে। আর কোনরকমে একবার যদি তোর চাচীর হয় তাইলে পুরো জেলা-পুরো দেশের সবার এইডস হবে। পুরো দেশের সকলের এইডস হয়ে আমার অন্তরাত্মার আবাসস্থলের সমস্তকিছু বিরাণভূমিতে পরিণত হওয়া ঠেকানোর জন্যও আপনার লাম্প্যট্যের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ ও তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা আমার জিনগত স্বার্থপরতার এখতিয়ারের ভিতরেই পড়ে।

সবশেষে সর্বোচ্চ যে ডিসক্লেইমারের প্রয়োজন পড়ে তা হচ্ছে, অতি অবশ্যই এইসব ব্যাখ্যা ও বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্স শুধুমাত্র মানুষের সমাজের গড়ন ও তার মানসিক গতিপ্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার বৈজ্ঞানিক নির্মোহ প্রচেষ্টা। ব্যক্তিগতভাবে জিনগত উপকথার ‘আমি’কে অনেক আগেই ছাড়িয়ে নির্বাণ ও বোধিপ্রাপ্ত ও আলোকপ্রাপ্ত ‘আমি’ চলে গেছি মেঘেদেরও অনেক ওপরে। সেখানকার ‘আমি’র কাছে আপনার লাম্প্যট্যের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ, ঔৎসুক্য বা ক্ষোভ-দ্বেষ নাই। আমার অবিনশ্বর ‘আমি’র বাহন শরীরকে ম্যানিপুলেট বা ব্যবহার করার প্রচেষ্টা না থাকলে, আপনার লাম্প্যট্য আর সাহারা মরুভূমির একটা একক বালিকণা দুইটার গুরুত্বই সমান আমার কাছে – শূন্য। এমনকি আপনার লাম্প্যট্য যদি গোটা হোমো-স্যাপিয়েন্সকে বিলুপ্ত করে দেয়ার দ্বারপ্রান্তে চলে যায় তাতেও। মানুষের তৈরী করা সমাজ ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও যৌন-স্বাধীনতা তাকে একসময় প্রজাতিসমেত ধ্বংস করে দিতে পারবে না, এমন কোন অমোঘ বৈজ্ঞানিক সূত্র, এমন কোন মাথার দিব্যি কাউকে কেউ দিয়ে রাখেনি। ঘন চিনির দ্রবণে নিজেদের প্রয়োজনের চাইতে হাজারগুনে খাবার পেয়ে যেসব ঈস্ট, ব্যাকটেরিয়া ক্রমাগত উদরপূর্তি ও বংশবিস্তার করে পরে সেসবের ফলাফলে তৈরী হওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইডে শ্বাসরুদ্ধে হয়ে চৌদ্দগুষ্টিসমেত বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাদের সাথে মানুষের পার্থক্য করে কেবল নির্বোধরাই।

………….
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা ৮০তম আসর।

Leave a Comment