দর্শনপ্রবন্ধশিক্ষামূলক

বাবা-মা বনাম স্ত্রী

উপমহাদেশে নিউক্লিয়ার পরিবার নিয়ে এক প্রকার ঋণাত্মক ধারণা রয়েছে যা আমাদের নাটক-সিনেমার অন্যতম উপাদান। এর পিছনে আসলে কাজ করে আমাদের সেন্টিমেন্ট, বাস্তবতা নয়।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মানব শিশুর পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্তিতে তুলনামূলক অধিক সময় লাগে এবং এ সময়ে যৌথ পরিবার নিউক্লিয়ার পরিবারের চেয়ে অধিকতর সহায়ক হবার কথা। কিন্তু বর্তমানের বাস্তবতাটা একটু ভিন্নরকম।

পূর্বে আমাদের সমাজগুলো ছিল মোটামুটি স্থির। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষ মোটামুটি একই সামাজিক অবকাঠামোতে একই স্থানে বাস করতো, একই কাজ করে যেতো, একই প্রযুক্তি ব্যবহার করতো। তাদের খ্যাদ্যাভাস, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণ সবকিছুই ছিল স্থির। আর পরিবর্তন হলেও তা ছিল এত মৃদু যে মানুষ টেরই পেতো না কখন কোথায় কিভাবে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। এর ফলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের চিন্তায় চেতনায় আচারে তেমন কোন ফারাক ছিল না।

কিন্তু বর্তমান পৃথিবী দ্রুত পরিবর্তনশীল। এখানে কোন কিছুকেই স্থায়ী বলার অবকাশ নেই। পোশাক, প্রযুক্তি, বিনোদন, খাদ্যসহ সবকিছুই এখন ট্রেন্ডের ওপর নির্ভর করছে।

সমস্যাটা ঠিক এখানেও নয়। সমস্যাটা হয়েছে আমরা সাধারণ মানুষেরা এসব পরিবর্তনকে সহজে মেনে নিতে পারি না। তরুণ বয়সে ট্রেন্ড ধরে চললেও একটু বয়স বাড়লে নতুন কিছু নিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। তখন আমরা নস্টালজিক হয়ে পুরোনোকে আঁকড়ে ধরতে বা অতীতে ফিরে যেতে চাই, যা আসলে অসম্ভব। আর এর ফলেই তৈরি হয় ‘জেনারেশন গ্যাপ’।

জেনারেশন গ্যাপকে অস্বীকার করে যারা যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখতে চায়, তাদের সংসারে শুরু হয় অশান্তি। বউ-শাশুড়ি মনোমালিন্য, বাবা-ছেলে মতবিরোধ, ইত্যাদি নিয়ে কিছুদিন কোনরকমে টিকে থেকে যখন ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে যায়, তখন আর পারিবারি সুসম্পর্ক টিকে থাকে না। এর চেয়ে সন্তান যদি বিয়ের পরপরই বা তারও আগে (পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পরে) বাবা-মায়ের থেকে আলাদা বাস করতে শুরু করতো, তাহলে অন্তত পারিবারিক সুসম্পর্কটা বজায় থাকতো।

ঐ যে প্রথমেই বলেছিলাম – মানব শিশুর পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্তিতে তুলনামূলক অধিক সময় লাগে এবং এ সময়ে যৌথ পরিবার নিউক্লিয়ার পরিবারের চেয়ে অধিকতর সহায়ক হবার কথা – এই পরিস্থিতিতে সেটা সহায়ক না হয়ে বরং অসহায়ক হয়ে যায়। অনেক সময় দুই প্রজন্মের টানা-পোড়েনে পিষ্ট হয় শিশুটি। ‘পোস্ত’ চলচ্চিত্র দ্রষ্টব্য।

এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে আরেকটি সেন্টিমেন্ট কাজ করে এমন – দেখো, বাবা-মা তাকে আদর যত্ন করে বড় করলো, আর এখন কিনা ব্যাটা বাবা-মার কথা না শুনে বউয়ের কথায় নাচছে/ বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে বউকে নিয়ে আরেক ঘরে উঠছে/ বাবা-মার কথা না ভেবে পালিয়ে বিয়ে করলো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানে একটু জেনেটিক রসিকতা না করে পারছি না। আমার তো মনে হয়, প্রতিটা পুরুষেরই বাবা-মায়ের চেয়ে স্ত্রীর কথার বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। একমাত্র স্ত্রীই আপনার জেনেটিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে, বাবা-মা নয়। ভেবে দেখুন, আপনি আপনার স্ত্রীর কথা শুনলেন না, আর আপনার স্ত্রী প্রতিশোধপরায়ন হয়ে আরেকজনের কাছ থেকে সন্তান নিয়ে আপনার বলে চালিয়ে দিল। তখন আপনি কাক হয়ে কোকিলের ডিমে তা দিয়ে যাবেন।

এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, আপনি আপনার স্ত্রীর কথা শুনে যে কেবল নিজের স্বার্থই দেখছেন, এমনটা কিন্তু নয়। আপনার জেনেটিক ধারাবাহিকতা মানে আপনার বাবা-মায়েরও জেনেটিক ধারাবাহিকতা। সমাজ আপনাকে স্বার্থপর বলতে পারে, কিন্তু জেনেটিক্যালি আপনি কিন্তু আপনার বাবা-মার উপকারই করছেন।

শেষ কথা হলো, আপনি যদি পুরুষ হোন এবং কাক হয়ে কোকিলের বাচ্চা লালন না করতে চান, তাহলে স্ত্রীর কথা শুনুন। তার কথা মতো উঠুন, বসুন, চলুন।

Leave a Comment