গল্পরাজনীতি

ছোটগল্পঃ কুকুর

রহমান সাহেব কুকুরে পরিণত হয়ে গিয়েছেন, শহর জুড়ে এরকম একটা রটনা শোনা যাচ্ছে কদিন ধরে।

ব্যাপারটা কেবল রটনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও হতো, বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে ভিড় করছে আমাদের পাড়ায়। রহমান সাহেব প্রভাবশালী লোক, স্থানীয় এমপির ডান হাত, মানে এমপির বাম হাতের কাজটা তিনিই সামলে থাকেন। তাই বাইরে থেকে কিংবা শহরের অন্য এলাকা থেকে যারা আসছেন, তারা কেউই রহমান সাহেবের বাড়িতে প্রবেশ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না। একে তাকে জিজ্ঞেস করে যেটুকু শুনছেন, সেটুকুই আবার এলাকায় ফিরে গিয়ে বাড়িয়ে-চড়িয়ে বলছেন।

আমরা যারা এই পাড়ায় বাস করি, তাদের জন্য রটনাটা একটা ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ভয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন রামিম মামা। তিনি একজন পশু চিকিৎসক। তিনি বলেছেন, মানুষের পশুতে পরিণত হওয়া নাকি একটি ছোঁয়াছে রোগ এবং এর কোনো চিকিৎসা নেই। তিনি আমাদেরকে কয়েকটি দেশের উদাহরণ উপস্থাপন করে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে গত কয়েক দশকে সেখানে মানুষ কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। রামিম মামার দেয়া তথ্যকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি না।

তবে মামা আমাদের এটা জানাতে পারেননি যে, রোগটা জীবানুবাহিত কিনা। সেরকম হলে আমাদেরও যে রক্ষে নেই, এই ভয়ে আমরা গুটিয়ে থাকি। আমরা রহমান সাহেবের বাড়ির চারপাশেও যাই না। আমাদের দিনগুলি পার হয় এক চূড়ান্ত আতঙ্কের মধ্যে। প্রতিদিন সকালে উঠেই আমরা আয়নায় নিজেদের দেখি – আমাদের চেহারার কোনো পরিবর্তন হলো কিনা। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে পিছনে হাতড়াই লেজ গজিয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য।

আরো দুদিন পার হলে রটনাটি আর রটনা থাকে না, ঘটনা হয়ে যায়। আমরা সকালে ঘুম থেকে জেগে শুনতে পাই রহমান সাহেবের বাড়ির চারপাশে বিশাল পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছে। স্বভাবতই আমরা ভেবে নিই, যেহেতু রহমান সাহেবের কুকুরে পরিণত হওয়ার গুজবে আশেপাশের এলাকা থেকে মানুষ এসে ভিড় করছে, তাই তার ছেলেরা থানায় খবর দিয়ে পুলিশ আনিয়েছে। থানা যেহেতু এমপির হাতে, আর রহমান সাহেব যেহেতু এমপির ডান হাত, পুলিশ প্রহরা পেতে কষ্ট হয়নি তাদের। কিন্তু একটু পরেই দুধওয়ালা এসে আমাদের খবর দেয় যে, রহমান সাহেবের বাড়িতে পুলিশ প্রহরার প্রধান কারণ আসলে মানুষ তাড়ানো নয়, কুকুর তাড়ানো। ঘটনা আরো স্পষ্ট হয় যখন তার কাছ থেকে আরো জানতে পারি গত রাতে রহমান সাহেবের বাড়িতে কুকুর হামলা করেছিল। শহরের যত ল্যাংড়া-খোড়া পথ-কুকুর ছিল, সব নাকি মধ্যরাতে রহমান সাহেবের বাড়ির সামনে চলে এসেছিল এবং এখনও তারা সেখানেই অবস্থান করছে। তাদের ভাবখানা এমন যে তারা রহমান সাহেবকে তাদের দলে ভিড়াতে চায়। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই যে রহমান সাহেব সত্যিই কুকুরে পরিণত হয়েছেন।

আমরা আর ঘরে থাকতে পারি না। মনে ভয় থাকলেও আমাদের অনুসন্ধিৎসু মন আমাদের রহমান সাহেবের বাড়ির কাছে টেনে নিয়ে যায়, সেখানে ততক্ষণে কুকুরগুলোকে তুলে নিতে পৌরসভার ট্রাক এসে গেছে। আমরা দেখতে পাই লাল জ্যাকেট পরা পৌরকর্মীরা একে একে সবগুলো কুকুরকে সাঁড়াশি দিয়ে ধরে মেরে ট্রাকে তুলে নিয়ে চলে যায়। সবশেষে তারা তাদের টিমের একজন সদস্যকে ওখানে রেখে যায় যাতে নতুন করে কুকুর এলে সেগুলোকেও মেরে বস্তাবন্দী করে ফেলতে পারে। বিকেলের দিকে রহমান সাহেবের বাড়ির গেটে আর কোনো কুকুর কিংবা কুকুর-নিধক দেখতে পাই না আমরা। কেবল দুজন পুলিশ দেখতে পাই। আমাদের কাছে সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগে।

সে-রাতে আমরা ঘুমাতে পারি না। আমাদের মনে হয় আমরা ক্ষণে ক্ষণে কেবলই কুকুরের ডাক শুনতে পাই। ভয়ংকর এক ডাক, যেমনটা আমরা পূর্বে আর কোনোদিন শুনিনি। আমাদের কাছে কুকুরটার কণ্ঠটা কেমন যেন রহমান সাহেবের কণ্ঠ বলে মনে হয়।

পরদিন সকালে আমরা আব্বাসকে ফোন দিয়ে তার বাইনোকুলারটি নিয়ে আসতে বলি। আব্বাস আমাদের ক্লাসের ছাত্র হলেও ওকে আমরা একজন ক্ষুদে বিজ্ঞানী মনে করি। বাইনোকুলারটি দিয়ে সে সাধারণত পাখি দেখে থাকে। আমরা ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে রহমান সাহেবের বাড়ির অভ্যন্তরটা দেখার চেষ্টা করি। সেখানে আমরা রহমান সাহেবের খয়েরি পোরশে গাড়িটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না। তবে একটা বিষয় আমাদের খুবই অস্বাভাবিক লাগে। আমরা দেখতে পাই রহমান সাহেবের বাড়ির হুলো বিড়ালটা ভয় পেয়ে দৌড়ে ছাদে ওঠে হাপাতে থাকে। অত বড় বিড়াল আমাদের পাড়ায় আর একটাও নেই, আর সেটাকে আমরা কোনোদিন ভয় পেতেও দেখিনি।

আব্বাসের বাইনোকুলার আমাদেরকে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য না করলেও আব্বাস আমাদের যা জানায় তাতে আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হই। আব্বাস জানায় যে, বিবর্তনীয় বিজ্ঞানের আলোকে মানুষের কুকুর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও, প্রজাতি রূপান্তরবিদ্যার আলোকে তা সম্ভব। তবে এটাতে কেবল সেইসব প্রাণীরই রূপান্তর সম্ভব, যারা অন্য আরেকটি প্রাণীকে অনুকরণ করে ও তার মতো আচরণ করে।

আমরা এবার দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলতে পারি সহজেই। রহমান সাহেবের কুকুরে পরিণত হওয়ার বিষয়ে আমাদের আর একটুও সন্দেহ থাকে না। এতে আমাদের মাঝে রামিম মামার ধরিয়ে দেয়া ভয়েরও খানিকটা প্রশমন হয়।

আব্বাসের কথাই যে সত্য, সেটা আমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে ধরা দেয় তিন দিন পরে, যখন দেখতে পাই রহমান সাহেবের বাড়ির দরজায় পাহারা দেয়া পুলিশগুলো কুকুর তাড়াতে লাঠি ব্যবহার না করে ঘেউ ঘেউ করছে।

Leave a Comment