ধর্ম সমালোচনাপ্রবন্ধসমালোচনা

একজন জাকারিয়া ও ইসলামবিদ্বেষ

সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হলে সে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষকে বেছে নিতে হয় শরণার্থী জীবন। তাদের একটা বিরাট অংশ চোরাই পথে বিভিন্ন বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে তুরস্ক, গ্রীস হয়ে জামার্নিতে প্রবেশ করেন। ২০১৫ সালে জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেল জার্মানির বর্ডার উন্মুক্ত করে দিয়ে শরণার্থীদের স্বাগতম জানালে প্রায় এক মিলিয়ন শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করেন, যাদের বৃহত্তর অংশটি ছিল সিরিয়ার।

সিরিয়ান শরণার্থীরা যখন জার্মানিতে প্রবেশ করেছিল, তখন তাদের দু’চোখে ছিল নতুন জীবনের স্বপ্ন। কিন্তু দুই বছর পেরুতেই তাদের আশাভঙ্গ হয়। তারা মনে করছেন, জার্মানিতে অনেক দিন থাকলেও সেখানকার সমাজের সাথে তারা মিশতে পারছেন না। অনেক সিরিয়ান তাই এখন জার্মানি থেকে সেই একই চোরাই পথে অবৈধভাবে বিপদসংকুল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে সিরিয়াতে ফেরত যাচ্ছেন। এমনই একজন জাকারিয়া। বিবিসির অনুসন্ধানী টিম জাকারিয়াসহ প্রায় ৫০ জনের একটি দলের সিরিয়া ফেরত যাওয়ার ওপর একটি রিপোর্ট করে। রিপোর্টটিতে জাকারিয়ার একটি সাক্ষাৎকার রয়েছে, যার কিছু অংশ ইউরোপে বসবাসরত সকল মুসলিমদের কাছে গুঢ় অর্থ বহন করে।

জাকারিয়া বলেন, “আমি ভেবেছিলাম, এখানেই থাকবো জীবনে উন্নতি করবো, এবং জার্মানদের দেখিয়ে দেবো যে আমরা শুধু শরণার্থী নই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি এখানে একজন বহিরাগত। জার্মান সমাজের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ তৈরি হয় নি। আমরা এ সমাজে মিশতে চেষ্টা করেছি – কিন্তু সত্যি বলতে কি জার্মানরা খুবই শীতল, তারা আমাদেরকে গ্রহণ করার চেষ্টাও করতে চায় না।”

গ্রীস পার হয়ে তুরস্কের সীমান্তে প্রবেশের আগে জার্মানীর উদ্দেশ্যে জাকারিয়ার শেষ বার্তাটি ছিল এরকমঃ “আমার জন্য জার্মানি বা অন্য কোনো ইউরোপীয় দেশে ফিরে যাওয়া অসম্ভব। আমরা মুসলিম, কিন্তু ওরা বলে আমরা সন্ত্রাসী। আমাদের দেখলে তারা ভয় পায় – যেন আমরা কোন দানব, মানুষ নই। ”

জাকারিয়ার এই বক্তব্যে রয়েছে হতাশা। তিনি স্পষ্টরূপে জার্মানদের দোষ দিতে চেয়েছেন এই বলে যে, তারা মুসলিমদের মানুষ মনে করে না, দানব মনে করে। জাকারিয়া মনে করেন জার্মানরা কিংবা ইউরোপীয়রা ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামবিদ্বেষে আক্রান্ত। তারা মুসলিমদের দেখতে পারে না, সহ্য করতে পারে না। সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি জার্মানরা মুসলিমদের দানব মনে করে? যদি মনেই করে, তবে সেটা কি ইসলামিবিদ্বেষ, নাকি অন্য কিছু?

ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ কাজ করে না, কাজ করে আতঙ্ক। আতংকের পিছনে রয়েছে অবিশ্বাস। আর অবিশ্বাসের উৎপত্তি সমাজে-দেশে-রাষ্ট্রে ঘটা উদাহরণ থেকে।

বর্তমানে সারা বিশ্বেই মুসলিমদের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি জার্মানদের মতোই। অনেকেই তা মুখ ফুটে বলে না। বাইরে দেখায় যে তার মুসলিম বিষয়ে এ্যালার্জি নেই, কিন্তু নিজ গ্রুপের মধ্যে যখন কথা বলে তখন ঠিকই প্রকাশ করে। আমি এরকম বহু দেখেছি। কারো কারো অবস্থা এমন যে, মুসলিম পরিবার থেকে আসা নাস্তিকদেরও বিশ্বাস করতে পারে না কখন ইউ-টার্ন নিবে এই সন্দেহে। আমি এমন অনেকের সাথে তর্কও করেছি। তাদের কথা হলো, এমন উদাহরণ তো আছে, আর তখন তুমি হবে তার হাতের কাছের ব্যক্তি। কেউ কেউ আছে সন্দেহ ভয় করলেও এগুলোকে পুঁজি করেই রাজনীতি করে কিংবা জীবিকা নির্বাহ করে।

মুসলিমদের দানবায়িত করার কাজটা কারা করলো? আইসিস? তালিবান? না, তারা করেনি। সন্ত্রাস পৃথিবীর জন্য একটি চলমান সংকট। পৃথিবীতে বহুকাল ধরেই এটা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আইসিস, তালিবান পৃথিবীর জন্য বড় সমস্যা না। সমস্যাটা হলো তাদের আদর্শের বিশ্বায়ন।

পৃথিবীর বেশিরভাগ সন্ত্রাসী সংগঠন একটা নির্দিষ্ট এলাকায় তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে। মানুষের যা কিছু ভয় আতঙ্ক, তা ঐ নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। আর তাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের মূল টার্গেট থাকে সরকারী নিরাপত্তাবাহিনী অথবা প্রতিপক্ষ, মানে তাদের মতোই আরেকটি গ্যাং বা সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু জিহাদের বেলায় এ কথা প্রযোজ্য নয়। একজন অমুসলিম, এমনকি একজন অমৌলবাদী মুসলিম হলেও আপনি তাদের শিকার হতে পারেন। আর হত্যার ব্যাপারে তারা শিশু, নারী, বৃদ্ধ কিছুই বাচবিচার করে না।

ধরুন, জিহাদিরা যদি কেবল নিরাপত্তারক্ষীদের মারতো, তাহলে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত বোধ করতো না। জার্মান সমাজের মানুষ উপরোক্ত জাকারিয়ার দিকে দানব-ভাবনাসুলভ দৃষ্টিতে তাকানো দূরে থাক, তাকাতো কিনা সন্দেহ।

মুসলিমদের অবিশ্বাসের আরেকটা ব্যাপার হলো অনিশ্চয়তাবোধ। আজ যাকে লোকে মডারেট দেখছে, মদে মাতাল হয়ে নাচতে দেখছে, কদিন পরেই তাকে বোমা হামলা, গাড়ি উঠিয়ে দেয়া, গুলি করা কিংবা ছুড়ি মারা, ইত্যাদি করতে দেখছে। কে যে কখন সাধারণ মুসলিম থেকে জিহাদি হয়ে যাবে, মানুষ সে সম্পর্কে পূর্ব থেকে ধারণা করতে পারছে না। তাই সবাইকে অবিশ্বাস করতে হচ্ছে তাদের।

এমন না যে এসব জিহাদিরা ইউরোপে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে, কিন্তু হত্যাগুলো বাচ-বিচারহীন হওয়ায় পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা অমুসলিম নিজের জীবন, সন্তানের জীবন নিয়ে উদ্বীগ্ন। যে ব্যক্তিটা ইউরোপে মুসলিমদের পূনর্বাসনে সাহায্য করছে, চাঁদা তুলছে, অনুদান দিচ্ছে, কেউ এই আতঙ্কের বাইরে নেই।

এসবের সাথে আরো কিছুর যোগ আছে। তার মধ্যে অন্যতম ইসলামে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, মডারেটদের সন্ত্রাসের সাফাই গাওয়ার প্রবণতা ও মুসলিমদের সিলেকটিভ মানবতা।

জার্মান অর্থনীতিকে সচল রাখতে ইমিগ্রান্ট প্রয়োজন, এটা একজন সাধারণ জার্মানও বোঝে। কিন্তু এতসব বিবেচনায় তারা একজন মুসলিমকে সহজে নিতে পারে না। ওপরে জাকারিয়া যা বলেছে, তা যেমন মিথ্যে নয়, তার পিছনের কারণগুলোও মিথ্যে নয়। একমাত্র ইসলামের সংস্কারই পারে মুসলিমদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করাতে। আর তার জন্য মুসলিমদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় জাকারিয়ার পথ ধরতে হবে প্রতিটি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তিকে।

Leave a Comment