খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধশিক্ষামূলক

সুখবিদ্যা – মানুষবিদ্যা

লিখেছেনঃ মাওলানা দূরের পাখি

শেষ পর্যন্ত মানুষের সুখ কিসে ? এই জটিল প্রশ্নের উত্তর এখনো মিলে নাই। বিগত কয়েক সহস্রাব্দ ধরে যেসব উত্তর ও দর্শন মিলেছে, সেগুলো মূলত মানুষের ইন্দ্রিয়ের উপর প্রতারণা। যেমন ধরেন বৌদ্ধ দর্শন বা ধর্মের সুখ সংক্রান্ত ধারণা। এই ধারণামতে মানুষের যাবতীয় দুর্দশার মূলে তার বস্তুগত অবস্থান নয় , বরং তার বস্তুগত অবস্থান তথা বাস্তবের জগতে তার নিজের ও চারপাশের অবস্থান নিয়ে তার নিজের মনের গহীনে যেসব ভাবনা ও ইচ্ছা সেগুলো। এক কথায় বলতে গেলে নিজের মনের আকাংখা হচ্ছে মানুষের সমস্ত অসুখ ও দুর্দশার মূল। বুদ্ধ তাই পরামর্শ দিলেন নিজের আকাংখাকে ভোঁতা থেকে শুরু করে একেবারে নাই করে দিতে হবে। তাহলেই মিলবে পরম সুখ। নির্বাণ নামের ধারণা নির্বাপণ নামক মূল থেকে উৎপন্ন । আগুনকে যেমন করে নির্বাপণ করতে হয়, তেমন করে মনের ভিতরের ইচ্ছার আগুনকে নিভিয়ে দিতে পারলে পরম সুখ পাওয়া যাবে।

কিন্তু ঘটনা হইলো ভিতরের ইচ্ছার আগুনকে নিভিয়ে দেয়া মানুষ কি আর প্রায়োগিক অর্থে ‘মানুষ’ থাকে? পূর্ব এশিয়ার কিছু ফ্রিক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কথা মাঝে মাঝে শোনা যায় যারা নিজেদের স্নায়ুতন্ত্রের উপর এমন সচেতন নিয়ন্ত্রণ তৈরী করতে পেরেছে যে বরফের মধ্যে খালি গায়ে বসে থেকেও তারা শীত অনুভব করে না। এমন না যে তারা নিজেদের প্রবোধ দেয় তাদের শীত লাগছে না। বরং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়েও পরীক্ষা করে নাকি দেখা গেছে তাদের স্নায়ুতন্ত্র শীতের ধারণাই তাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় না। এই অবস্থায় চলে গেলে হোমো স্যাপিয়েন্স এর কোন সদস্যকে কার্যতঃ আর ‘মানুষ’ বলার অবকাশ থাকে না। মানুষের সুখের সন্ধান করতে গিয়ে যদি মানুষকে অন্য কিছু হয়ে যেতে হয়, তাহলে সেই সমাধান আর মানুষের অবস্থার সমাধান হয় না। সেই পরিবর্তীত জীবকে যা-ই বলি না কেনো।

পৃথিবীর শত শত কোটি আটপৌরে জীবন-যাপন করা মানুষের জন্য তাই এই নির্বাণ সুখের পদ্ধতি অকার্যকর। হাড়েগোস্তে বস্তুবাদী আমিও তাই বরং সুখের সন্ধানের জন্য আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত একমাত্র কার্যকর অস্ত্র বিজ্ঞানের দিকেই মুখ করি কিছু উত্তর পাওয়ার আশায়। ঔপনিবেশিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, শোষণ, দুইটা বিশ্বযুদ্ধ ও তারপরের শীতল যুদ্ধ পেরিয়ে পশ্চিমের সাধারণ জনগন অবশেষে বিগত কয়েক দশক জুড়ে একটু থিতু হয়ে বসেছে। আর এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে টেকসই সুখের সন্ধান। কারণ মানুষের মনস্তত্ত্বের গঠনই এমন যে কোন একটা সমস্যা থাকা এবং এই সমস্যার সমাধান করা থেকে মানুষ যে সুখ পায়, তা সর্বোচ্চ। যে মানুষের কোন সত্যিকার সমস্যা নাই, তার আসলে সুখের আশাও নাই। বড় যুদ্ধ, রাজনৈতিক তোলপাড় ও অস্থিরতা শেষ হয়ে এলে তাই সব সভ্যতার মানুষই অন্তর্মুখী হয়ে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ও সুখের সন্ধানের জন্য বিভিন্ন দিকে ইতিউতি বিচরণ শুরু করে।

পশ্চিমের সুখের সন্ধান সম্পর্কিত প্রায় সত্তর বছরব্যাপী চলা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর ব্যক্তিগত সুখের জন্য যে সূত্রগুলো পাওয়া গেলো তা খুবই আশ্চর্য্য রকমের সরল। একটা সূত্র হচ্ছে টাকা সুখ কিনতে পারে, তবে একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত। চরম দরিদ্র লোকজন সুখে থাকে না। সারপ্রাইজ! আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তিগত সুখবোধও বাড়তে থাকে। বছরে বিশ হাজার ডলার আয় করা লোকের চাইতে বছরে চল্লিশ হাজার আয় করা লোক দ্বিগুন সুখী। কিন্তু চল্লিশ হাজার আয় করা লোকের চাইতে আশি হাজার আয় করা লোক তেমন বেশি সুখী নয়। একটা পর্যায়ের পর দেখা যায়, আয় যতই বাড়ুক জীবন নিয়ে তৃপ্তিবোধের আর তেমন হেরফের হয় না। নিজের বস্তুগত চাহিদা পূরণ হবার পর একটু স্থিতিবোধ দেয়ার মত টাকা থাকলে এরপর আর টাকার সাথে সুখের পরিমাণ বাড়ে না।

আরেকটি সরল সূত্র হচ্ছে জীবনভর নিজের জীবন নিয়ে পরিতৃপ্তিবোধ থাকা ও দীর্ঘায়ু পাওয়া সুখী মানুষগুলোর মধ্যে একটি দিকে মিল পাওয়া গেছে। সেটা হচ্ছে এদের সবাই নিজের ঘনিষ্ঠ পরিবার ও বন্ধুদের সাথে অসুখীদের তুলনায় বেশি পরিমাণ কাছাকাছি ও যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। পরিবার ও কাছাকাছি বন্ধুবান্ধবদের সাথে সম্পর্ক যত দৃঢ় ও চলমান তত বেশি জীবন সম্পর্কে পরিতৃপ্তি। এমনকি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া ও অসময়ে মরে যাওয়ার প্রবণতাও কম।

সমস্যা হচ্ছে আধুনিক দুনিয়ার অর্থনীতি যেভাবে বিন্যস্ত তাতে প্রথম সরল সূত্রটির কার্যকর করা সম্ভব হলেও দ্বিতীয়টি প্রায় অসম্ভব। বাজারভিত্তিক ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির কলের চাকা যেখান দিয়ে গিয়েছে সেখান দিয়েই সমস্তকিছুকে ছিন্নভিন্ন করে পণ্যে রুপান্তর করে দিয়ে গেছে। মানুষকে মানব-সম্পদ হিসাবে দেখার প্রক্রিয়াটি হয়তো আদতে অতখানি কালো কোন চিন্তা থেকে শুরু হয়নি। বরং শ্রমজীবি মানুষকে মূল্য দেয়ার বোধ থেকেই তৈরী হয়েছে। তবে প্রায়োগিক দিক থেকে এই ধারণার ফলাফলে অন্য সব সম্পদের মতই মানুষেরও পণ্যায়ন ঘটেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তাই ধনতন্ত্রের অন্যান্য উপকরণের বন্টন ব্যবস্থার মত মানুষেরও উৎপাদন ও ব্যবহার ও ভোগের ক্ষেত্র আলাদা হয়ে গেছে। একটা শার্টের যেমন বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন আলাদা আলাদা জায়গায় তৈরী হয়ে পরে আলাদা এক জায়গায় জোড়া দেয়া হয়, তেমন করে বর্তমানের দুনিয়ায় মানুষও তৈরী হয় মূলত এশিয়া আর আফ্রিকায়। সেই মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি হয়ে সেখানকার স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটায় নিজেদের শ্রম-ঘাম দিয়ে।

এটাকে ঠিক অনুন্নত বিশ্বকে শোষণ করার বৈশ্বিক ধনতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র হিসাবে দেখার কিছু নাই। কারণ, উন্নত বিশ্বের আলাদা আলাদা দেশের তাদের নিজেদের ভিতরেও একই পণ্যচক্র দেখা যায়। প্রত্যন্ত গ্রামে ও পাহাড়ের গভীরে জন্মে ও বেড়ে উঠে শিশুরা। শ্রম বিক্রি করে বড় শহরে। একই চক্র ইংল্যান্ডে , আমেরিকায়, জাপানে, জার্মানিতে। সুবিশাল শহরগুলো যেন ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত চারপাশ থেকে মানুষ নিয়ে এসে জড়ো করে। নগরের এই টানে নিজের মূল ও পরিবার এবং বাল্যের বন্ধুবান্ধব ছেড়ে একেকটা মানুষ কেবল নিজের ব্যবহারযোগ্য দক্ষতার একটা দলা হিসাবে বাঁচে পণ্যের মত। একেকটা বড় শহরের জনসংখ্যা কোটি পেরিয়ে গেলেও কোটি মানুষের ভিতরে তৈরী হয়ে থাকে বিলিয়ন বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা । ইউরোপের সবচে বড় শহর লন্ডন তাই ইউরোপের নিঃসঙ্গতারও রাজধানী।

মূল থেকে সরে গিয়ে জীবিকার জন্য বড় শহরে যাওয়া মানুষের ভিতরে জনারণ্যে নিঃসঙ্গতা তৈরী হওয়ার গভীর কারণটি তার জৈবিক উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে। বাল্যকালে হওয়া বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক শিশুদের কাছে মনে হয় আজীবনের জন্য। সেইসব সম্পর্কে নিজের মনস্তাত্ত্বিক বিনিয়োগ থাকে অনেক বেশি। এরপর থেকে ধাবমান জীবনে যেসব নতুন সম্পর্ক তৈরী হয়, যেসব নতুন মানুষের আগমণ ঘটে তাদের সবাইকেই সে ভাবতে থাকে ক্ষণস্থায়ী হিসাবে। একারণে বড় হওয়ার সাথে সাথে অর্থবহভাবে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরীর ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। কারণ একটা অদ্ভুত ব্যাপার রয়ে গেছে আধুনিক মানুষের ভিতরে তার প্রানীগত উত্তরাধিকার হিসাবে। ডানবার নাম্বার (Dunbar Number)। রবিন ডানবার নামের একজন নৃতাত্ত্বিক এর আবিষ্কারক। তার মতে মানুষ কার্যকরভাবে যোগাযোগ ও মানসিক সম্পর্ক রেখে চলতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা সীমিত। সংখ্যাটা ১৫০ এর কাছাকাছি। মানুষের বিবর্তনীয় ইতিহাসের সবচে দীর্ঘতম পর্যায় হান্টার-গেদারার পর্বে একেকটা গোত্রের জনসংখ্যার পরিমাণ এরকম ছিলো- ১৫০ এর কাছাকাছি। আধুনিক মানুষ তাই যখন বড় শহরে এসে কর্মক্ষেত্র ও অন্যান্য কারণে যখন অনিচ্ছায় অনেকের সাথে সম্পর্ক রাখতে বাধ্য হয় , তখন তার সত্যিকারের অর্থবহ সম্পর্কগুলো থেকে সে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার মস্তিষ্ক ১৫০ জনের বেশি মানুষের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে রাখতে পারে না।

বড় শহরের বড় নিঃসঙ্গতা আরেক দিক থেকে দেখলে সেইসব শহরের টিকে থাকার জন্যও দরকারী বটে। পৃথিবীর ও মানবজাতির ইতিহাসের আর কোন সময়ে একটা ক্ষুদ্র জায়গায় এত মানুষ এক সাথে জড়ো হয়ে বাস করার নজির নাই। মানুষ এমনিতে তার চারপাশ নিয়ে খুবই সংবেদনশীল প্রাণী। হান্টার-গেদারার অতীতে কোথাও অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে বা পাশ দিয়ে অন্য এক মানুষ হেঁটে যাচ্ছে আর তাকে সম্পূর্ণরুপে অগ্রাহ্য করে আরেকটা মানুষ নিজের কাজে মনোনিবেশ করছে, এমন হওয়ার কোন সম্ভাব্যতা ছিলো না। অন্য মানুষের জীবন, তার উদ্দেশ্য ও তার চিন্তাকে বুঝার চেষ্টা না করলে মানুষের পক্ষে অতীতে টিকে থাকা অসম্ভব ছিলো। কিন্তু বড় শহরের কোটি কোটি মানুষের প্রত্যেকের কথা আলাদা আলাদাভাবে চিন্তা করতে গেলে, চলার পথে প্রতিদিন দেখা পাওয়া লাখ লাখ মানুষের প্রত্যেকের ব্যাপারে মনোযোগ খরচ করতে গেলে মানুষ টিকতে পারবে না শহরে। বড় শহরের মানুষের মধ্যে তাই বেঁচে থাকার ও নিজের জীবন চালানোর তাগিদে ভিতর থেকে তৈরী হয় সংবেদনহীনতা। এই সংবেদনহীনতা প্রাকৃতিক ব্যাপার বলেই এর মধ্যে কোন সুস্থ্য ও সচেতন সীমা তৈরী করা যায় না। মানুষ অতখানি মানসিক দক্ষতার সাথে নিজের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পর্কে সংবেদনশীলতা ও অপ্রয়োজনীয় মানুষের ক্ষেত্রে সংবেদনহীনতার চর্চা আলাদা করতে পারে নাই। সুখী জীবনের জন্য পাওয়া সরল সূত্রের প্রয়োগ তাই বাস্তবে আর অত সরল নাই।

রেফারেন্সঃ
1.Stumbling on Hapiness- Daniel Gilbert
2.How did we get into this mess- George Monbiot
3. https://en.wikipedia.org/wiki/Dunbar%27s_number
4. https://www.youtube.com/watch?v=4q1dgn_C0AU

 

………………

প্রবন্ধটি ২৪.০৫.২০১৮ তারিখের সাপাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় পাঠ করেন মাওলানা দূরের পাখি। এটি তাঁর ধারাবাহিক সিরিজ ‘সানডে নাইট ব্লুজ’ থেকে নেয়া। ব্যতিক্রমধর্মী এই প্রবন্ধ সিরিজের অন্য প্রবন্ধগুলো পড়তে পারেন তার ফেসবুক টাইম লাইনে।

 

 

 

 

Leave a Comment