ধর্মগ্রন্থে সমাজবিবর্তনের পাঠ

আক্ষরিক অনুবাদ যেমন বিষয়বস্তুর সঠিক ভাব প্রকাশ করতে পারেনা, তেমনি ধর্মগ্রন্থগুলোরও আক্ষরিক বিশ্লেষণ বিয়ষবস্তুকে প্রকাশ করতে পারে না। একথা অনস্বীকার্য যে ধর্মগ্রন্থগুলোর মূল ভিত্তি মিথ। হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো, বিশেষ করে মহাভারত ও রামায়ন, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মিথিক্যাল সাহিত্য। যে কোন ধর্মগ্রন্থেই প্রচুর উপাখ্যান থাকে, আপাতদৃষ্টিতে যা দিয়ে কাহিনীনির্ভর ঘটনাবলির জাল বোনা হলেও এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক সত্য, রয়েছে ঐ সময়ের সামাজিক বিবর্তনের ইঙ্গিত। তবে সে সত্যকে উদ্ধার করার জন্য আপনাকে বিষয়টির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হবে; কিছুতেই উপাখ্যানটির শাব্দিক-আক্ষরিক ব্যাখ্যা দিয়ে আপনি সে সত্য উদ্ধার করতে পারবেন না। আমি মহাভারত থেকে এমন একটি উপাখ্যান উপস্থাপন করছি।

ভীম কর্তৃক ‘বক’ নামক রাক্ষস নিধনের গল্পটিতে আমরা দেখতে পাই- বক রাক্ষসটি বনে বাস করে, যার জন্য প্রতিদিন একজন মানুষ, দুটি মহিষ এবং অনেক ভাত দিতে হয় এক গ্রামবাসীর। ভীম নিজের জীবন বাজি রেখে ‘বক’ রাক্ষসটিকে বধ করে গ্রামবাসীদের উপকার করে থাকে। পরোপকারের দৃষ্টান্ত হিসেবে গল্পটি হিন্দু ধর্ম বইয়ে শিশুদের পড়ানো হয়। এখানে উল্লেখিত শব্দগুলোর মধ্যে তিনটি শব্দের ওপর আমরা বর্তমানের জ্ঞানের আলোকে ঐতিহাসিক দৃষ্টি ফেলবো। এরই মধ্যে আমরা খাবারের বিষয়টিও তুলবো। ‘বন’, ‘বক’ ‘রাক্ষস’।

প্রথমে রাক্ষস দিয়ে শুরু করা যাক। রাক্ষস শব্দটি আমাদের কাছে মানুষখেকোরূপেই ধরা দিচ্ছে। আমরা যদি মহাভারতের এই গল্পটি সৃষ্টির যুগে ফিরে যাই তাহলে দেখবো যেহেতু রাক্ষসটির খাবারের জন্য মহিষ এবং ভাত দুটোই দিতে হচ্ছে, তাহলে তখনকার সভ্যতা পশুপালন স্তর পার হয়ে কৃষি ও পশুপালন স্তরে বিরাজ করছে। কিন্তু একটি এলাকার সব মানুষের কাছে সভ্যতার স্তর যে সমান ছিল না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই আধুনিক যুগেও আমরা বহু গোষ্ঠীকে বনে বাস করতে দেখেছি বা এখনও দেখি। তখনও এরকম অনগ্রসর গোষ্ঠী ছিল যারা বনে বাস করতো। এসব বনবাসী গোষ্ঠীরা সভ্যতার আদিস্তরে, যাকে সম্ভবত ‘সংগ্রহ’ স্তর বলে, বাস করতো। সংগ্রহ করে খাদ্য সংগ্রহ করা খুবই কষ্টসাধ্য একটি কাজ, কারণ বনে এখানে সেখানে সংগ্রহের জন্য খাদ্য ছড়িয়ে থাকে না। খাদ্য সংকট হোক বা যে কোন কারণেই হোক, এসব গোষ্ঠীগুলো তখন পশুপালন ও কৃষিস্তরের গোষ্ঠীদের ওপর চড়াও হতো। তারা চড়াও হয়ে খাদ্য-পশু-মানুষ ধরে নিয়ে যেতো। হয়তো চরম খাদ্য সংকটের জন্য এ গোষ্ঠীদের মধ্যে মানুষ খাওয়াও প্রচলিত হয়েছিল। ধর্মীয় উপাখ্যানগুলোতে আমরা যে রাক্ষস বা অসুরদের উপস্থিতি দেখি এরা এরকমই এক একটি গোষ্ঠী।

(রাক্ষসগোষ্ঠী মানুষ খেলেও অসুরগোষ্ঠী মানুষ খেতো না। অসুরগোষ্ঠীগুলো লুটের চেয়েও কৃষি ও পশুপালন স্তরের আবাস দখল করতে পছন্দ করতো বেশি। হয়তো জিনগতভাবে তারা এমন শক্তিশালী হয়েছিল যে তারা সহজেই অন্য গোষ্ঠীগুলোকে কাবু করে ফেলে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতো।)

রাক্ষসগোষ্ঠীগুলো ছিল সভ্যতার সংগ্রহ স্তরে। সভ্যতার সকল সংগ্রহকারী গোষ্ঠীর মতো তাদেরও আবাস ছিল বন। সুতরাং ‘বক’ নামক রাক্ষসটি যে বনে বাস করবে সে বিষয়ে দ্বিমত করার কোন অবকাশ থাকতে পারে না।

এবারে আসি ‘বক’ শব্দটি নিয়ে। টোটেম শব্দটির সাথে আমরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। উইকিপিডিয়া থেকেঃ A totem is a being, object, or symbol representing an animal or plant that serves as an emblem of a group of people, such as a family, clan, group, lineage, or tribe, reminding them of their ancestry (or mythic past). ‘বক’ নামক রাক্ষসটি আসলে কোন একক রাক্ষস বা ব্যক্তি নয়, এটি ‘বক’ নামক একটি টোটেম। প্রাণীর নামে এমন বহু টোটেমের অস্তিত্ব রয়েছে মহাভারতে। কৃষ্ণর জ্ঞাতিদের মধ্যে কুকুর নামক একটি টোটেম রয়েছে।

আমরা আগেই দেখেছি রাক্ষস মানে প্রকৃতি থেকে খাদ্যসংগ্রহকারী সভ্যতার একটি অনগ্রসর গোষ্ঠী যারা খাদ্য সংকট বা সহজলভ্যতা বিবেচনায় দস্যুবৃত্তি বেছে নেয়। এই গল্পে সেই অনগ্রসর গোষ্ঠিটির নাম বক। আর এই কোন একক মানুষ নয়, কারণ একজন মানুষকে একটি গ্রামবাসী ভয় পেতে পারে না। প্রতিদিন দুটো মহিষ, একজন মানুষ এবং অনেক ভাতও একটি মানুষের খাদ্য হতে পারে না কিছুতেই। তাহলে এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, ‘বক’ একটি দস্যুবৃত্তিভিত্তিক টোটেম, যারা সভ্যতার অগ্রসর গোষ্ঠীদের খাবার, পশু, মানুষ ইত্যাদি লুঠ করে নিয়ে যেতো এবং যাদেরকে বশে রাখার জন্য অগ্রসর গোষ্ঠীটি একটি চুক্তি করেছিল যে গ্রামবাসীর একটি করে পরিবার প্রতিদিন ‘বক’ টোটেম গোষ্ঠীদের খাদ্য সরবরাহ করবে।

ভীম, একা হোক বা অনেকে মিলেই হোক (ভীমের অতিরিক্ত শক্তিমত্তার প্রচার বা প্রমাণের জন্য গল্পটিতে ভীমকে একা উপস্থাপন করা হতে পারে), এই ‘বক’ গোষ্ঠীদের মেরে ফেলে এবং গ্রামবাসীদের জন্য শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনে।

আমি এখানে মহাভারত থেকে উদাহরণটি দিলাম। প্রত্যেক ধর্মগ্রন্থের মিথগুলোকেই এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আমাদের ধার্মিকজনেরা ধর্মগ্রন্থ থেকে সে-সময়ের সামাজকে না খুঁজে অপবিজ্ঞান খোঁজে যা মানুষকে সঠিক ইতিহাস শিখতে যেমন বাঁধা দিচ্ছে তেমনি নতুন ধর্মান্ধ প্রজন্মও তৈরি করছে।

Leave a Comment