[লিখেছেন মহিউদ্দীন শরীফ]

আজ ৩০ মার্চ, মুক্তমনা ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৫ সালের আজকের এই দিনে ইসলামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন ওয়াশিকুর। বাংলাদেশে সিরিজ ব্লগার- অনলাইন এক্টিভিস্ট হত্যার তৃতীয় ভিক্টিম ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের জানুয়ারী মাসে ইসলামী সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রথম শিকার হন ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও একমাসের ব্যবধানে তাদের হাতে নিহত হন মুক্তমনা ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার (থাবা বাবা)। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায় ইসলামী সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন এবং নিহত হন। ঐ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা মারাত্মক আহত হন। এই ঘটনার একমাসের ব্যবধানে ইসলামিস্টদের আক্রমনের শিকার হয়েছিলেন ওয়াশিকুর বাবু।

ওয়াশিকুর বাবুর পরিচয়ঃ

ওয়াশিকুর বাবু ১৯৮৮ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম টিপু সুলতান। ২০০০ সালে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটলে বাবু তাঁর বাবা ও বড় বোন শিমুর সাথে বাস করতেন। ২০০৪ সালে স্থানীয় চণ্ডীপুর চরমনসা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করে বাবু ঢাকায় পড়াশুনা করতে আসেন। ২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন এবং ২০১৩ সালে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ থেকে অনার্স শেষ করেন। ওয়াশিকুরের পরিবারে বাবাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই অনার্স শেষ করে ওয়াশিকুর পড়াশুনার পাশাপাশি ছোটখাট একটা চাকুরি নিয়েছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাজধানী মতিঝিলের শাপলা চত্বরের পাশে ফারইস্ট অ্যাভিয়েশন এজেন্সিতে ট্রেনার হিসেবে কাজ করতেন।

নিজের সম্পর্কে সামহোয়্যার ইন ব্লগে বাবু লিখেছিলেন: “আমার নাম মো: ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছরের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। তারপর বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটাতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রন ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতিআধুনিক না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব।”

আরেকটি লেখায় তিনি নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেনঃ “মানুষ হিসেবে আমি খুব ভাল বা মহৎ কেউ নই; কখনো দাবীও করিনি। স্বল্পভাষী এবং অন্তর্মুখীতার কারনে পরিচিতরা সেরকম কিছু ভাবে। আমার অন্তর্মুখীতা ভাল সাজার জন্য না বরং নিজের প্রকাশ করার অপারগতা। আমার ভেতরে স্বার্থপরতা, মোহ, লোভ, প্রেম, কাম, ঘৃণা সব কিছুই বিরাজ করে; তীব্র মাত্রায় বিরাজ করে। যারা খুব কাছাকাছি আসে তারাই তীব্রতার মাত্রা বুঝতে পারে। ফলাফল, আপাত ভদ্র-সুবোধ বালকের ভিতরটার সাথে মিল না পেয়ে অচিরেই দুরত্ব সৃষ্টি।

কিছু মানুষ আছে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী যারা কখনোই কাছাকাছি হয় না। দুরত্ব বজায় রেখে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে চায়। সমস্যা হল আমি সহানুভূতি গ্রহন করিনা; নিজ সমস্যাগুলো নিজেই মোকাবেলা করার চেষ্টা করি। আমার পরিস্থিতির কারনে কেউ বন্ধু হিসেবে গ্রহন করতে না পারলে সমস্যা নেই এবং সহানুভূতি দেখানোর প্রয়োজন নেই।

I hate sympathy.’

লেখালেখিঃ

লেখালেখি ছিল ওয়াশিকুর বাবুর নেশা। ফেসবুকে তাঁর প্রোফাইল নাম ছিল ‘ওয়াশিকুর বাবু‘। এ ছাড়া কয়েকটি ব্লগ সাইটে তিনি ‘কুচ্ছিত হাঁসের ছানা’, ‘গন্ডমুর্খ’, ‘বোকা মানব’ ইত্যাদি একাধিক নামে লিখতেন। ধর্মকারী ব্লগ সাইটে ওয়াশিকুর বাবুর লেখা পোস্টের সংখ্যা শতাধিক। তিনি লিখতেন দু’টি ছদ্মনামে – “অ-বিষ-শ্বাসী” ও “ধর্মবিদ-দেশী” (ঐ ব্লগে তাঁর লেখাগুলো ই-বুক আকারে পোস্ট করা আছে এখানে)। মুক্তচিন্তা, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞান, ধর্মীয় কুসংস্কার বা গোঁড়ামি – ইত্যাদি নানা বিষয়ে খুব তীক্ষ্ম মন্তব্য করতেন ওয়াশিকুর রহমান। লেখালেখিতে তাঁর রসবোধ ছিল অসামান্য; তাই স্যাটায়ার লেখায়ই তিনি সবচেয়ে বেশি দক্ষ ছিলেন। তাঁর স্যাটায়ার সিরিজ ‘নাস্তিকদের কটুক্তির দাঁত ভাঙা জবাব‘-এর সত্যিই কোন জবাব নেই। ওয়াশিকুর বাবুর মৃত্যুর পরে তাঁর লেখালেখি সংগ্রহ করে মুক্তমনা প্রকাশ করে ‘‘ফাল দিয়ে ওঠা কথা’। এই পোস্টের শেষের দিকে তাঁর লেখালেখির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

যেভাবে খুন হলেনঃ

ঢাকার দক্ষিণ বেগুনবাড়ির ৬ তলা ভবন বিসমিল্লাহ মঞ্জিলের দ্বিতীয় তলায় একটি রুম সাবলেট হিসেবে ভাড়া নিয়ে থাকতেন ওয়াশিকুর ও তাঁর বাবা। বাবা টিপু সুলতান দৈনিক বাংলা মোড়ের মোটরপার্টস ব্যবসায়ী।  প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেন ওয়াশিকুর এবং সন্ধ্যার কিছু পরে বাসায় ফিরতেন।

সেদিনও তিনি একই সময়ে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তাঁর বাবা কয়েকঘন্টা আগেই গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্য বের হয়ে যান। ওয়াশিকুর ভাবতে পারেননি তাঁকে হত্যা করার জন্য আততায়ীরা বাসার আসেপাশেই ওঁত পেতে বসে আছে। বাসা থেকে বেরিয়ে কাছের গলিতেই তিনি হামলার শিকার হন। তিনজন ধর্মোম্মাদ সন্ত্রাসী চাপাতি নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়াশিকুরের ওপর। বর্বর খুনীগুলো একের পর এক আঘাত করতে থাকে ওয়াশিকুরের গলার ওপরের অংশে, ঘাড়ে, মুখে ও মাথায়। ওয়াশিকুর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়।

ওয়াশিকুরের খুনিদের পরিচয়ঃ

ওয়াশিকুরকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরে পাষণ্ড খুনীগুলো বরাবরের মতোই  পালানোর চেষ্টা করে। রাজীব হায়দার ও অভিজিৎ রায়ের খুনীগুলো সহজে পালাতে পারলেও এবার ঘটে এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ এই খুনের দৃশ্য দেখতে পেয়ে দ্রুত ছুটে এসে দুই খুনীকে জাপটে ধরে। এগিয়ে আসে স্থানীয় বাসিন্দারাও। পরে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। দুই খুনীকে গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বেগুনবাড়ি এলাকার দীপিকার মোড়ে এই হত্যাকাণ্ডস্থল থেকে তিনটি রক্তাক্ত চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তার হওয়া দুই হামলাকারীর মধ্যে জিকরুল্লাহ নামের একজন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র। আরিফুল নামের অন্যজন  মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র। উল্লেখ্য যে দুটো মাদ্রাসাই হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমেদ শফীর নিয়ন্ত্রণাধীন।

জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পরে পুলিশ জানিয়েছিল যে, হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাটহাজারী থেকে ঢাকায় এসেছিল জিকরুল্লাহ। পত্রিকায় তাদের যে ভাষ্য বেরিয়েছিলো, তা হুবহু তুলে দেয়া হলো-
“ব্লগ কী বুঝি না। আর তার লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরেরা বলেছেন, সে (বাবু) ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব। ইমানি দায়িত্ব পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে। সেই ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।”

হত্যাকারীদের পিছনের সেই হুজুররা কারা আমরা তা আজও জানতে পারিনি। তবে খুনীদের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত যে এই খুনের সাথের ধর্মের সরাসরি সম্পর্ক ছিল। ধর্মীয় কারণেই তারা বাবুকে খুন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। ঘাড়ের উপরে আঘাত করে হত্যার নির্দেশনা কোরানেই রয়েছে। (কোরান ৮:১২) ওয়াশিকুর সহ প্রতিটা মুক্তমনা ব্লগার হত্যার সময়েই আমরা কোরানের সে আয়াতের বাস্তবায়ন দেখেছি।

ওয়াশিকুরের লেখালেখিঃ

ওয়াশিকুর বাবু বহুধা বিষয়ে লিখেছেন। আমরা এখানে তাঁর কিছু উদাহরণ তুলে ধরবো যাতে পাঠক তাঁর লেখার রসবোধ ধরতে পারেন। মৃত্যুর চারদিন আগে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ওয়াশিকুরের স্টাটাস ছিল:

“ আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস।

মোল্লা স্বাধীন, জঙ্গি স্বাধীন, ছাগু স্বাধীন, মুমিন স্বাধীন, দুর্নীতিবাজ স্বাধীন, রাজনৈতিক নেতা স্বাধীন, পাতি নেতা স্বাধীন, ধর্ষক স্বাধীন, সামরিক বাহিনী স্বাধীন, সুশীল সমাজ স্বাধীন, পিনাকী স্বাধীন, শফি হুজুর স্বাধীন, দলদাস স্বাধীন, গার্মেন্টস মালিক স্বাধীন, লঞ্চ মালিক স্বাধীন…

স্বাধীন নয় কৃষক-শ্রমিক,
স্বাধীন নয় কথিত সংখ্যালঘু-আদিবাসী,
স্বাধীন নয় মুক্তচিন্তার মানুষ,
স্বাধীন নয় মানুষ হতে চাওয়া মানুষগুলো…”

পাহাড়িদের উপর জাতিগত নিপীড়ণের প্রতিবাদে ওয়াশিকুরঃ

১। “জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশ এখন পাহাড়িদের উপর জাতিগত নিপীড়ন চালায়,

জাতির মেধাবী সন্তানদের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করা দেশে নিজেরাই মেধাবীদের হত্যা করে,

চারদিকে আঁধার করা অদ্ভুত সময় তবুও

শুভ জন্মদিন প্রিয় বাংলাদেশ।”

২। আদিবাসীদের নিপীড়নের বেলায় বাঙালি ধর্ম ও দল নিরপেক্ষ।

সব ধর্ম, ও দলের বাঙালি মিলেমিশে এই কাজ করে…

৩। আমরা যদি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো বুলি ঝেড়ে আদিবাসী দমন-নিপীড়নে সমর্থন দেই বা নিশ্চুপ থাকি তাহলে বুঝতে হবে আমরা একেকজন অসাম্প্রদায়িক বজ্জাত…

৪। আসুন পাহাড়িদের কেটে সাফ করি,

তারপর পাহাড় কেটে সমান করি,

তারপর জমি দখল নিয়ে বাঙালিরা কাটাকাটি করি…

বাঙ্গালী  মডারেট মুসলমান, সুশীল বুদ্ধিজীবীদের হিপোক্রেসি সম্পর্কে ওয়াশিকুরঃ

বাঙালি মুসলিমরা সবাই সহজ সরল ভাল মানুষ। তারা সাম্প্রদায়িক না, মৌলবাদ লালন করেনা, ধর্মান্ধ না। যেগুলো হয় সব সাম্রাজ্যবাদী মার্কিনীদের চক্রান্তে হয় অথবা ব্রিটিশ ডিভাইডস এন্ড রুলস নীতির কারনে। তারা সহজ সরল মুসলিম বাঙালিকে ভুলিয়ে এসব কাজ করায়। বাঙালি মুসলিম হচ্ছে শিশুর মতো সরল। এদের কোন দোষ নেই, তেমনি গুনও নেই। এরা ভাল মন্দ প্রভেদ করতে পারে না।

তবে আপনি কখনোই তাদের সচেতনতা চাইতে পারবেন না, অন্ধ বিশ্বাস ভাঙতে পারবেন না। তাহলে আপনি তাদের শত্রু হয়ে যাবেন। আপনাকে তাদের শিশু হয়ে থাকতে দিতে হবে। শিশুরা যেমন রাগ করে অনেক কিছু ভাঙে তারাও মাঝে মাঝে বিধর্মীদের ঘর বাড়ি পোড়াবে, নাস্তিকদের কতল করবে। আপনি কিছু বলবেন না বা বললেও ব্যালেন্স করে বলতে হবে। কারন আপনি মডারেট, সুশীল, বুদ্ধিজীবী।

মা যেমন শিশুকে রসগোল্লার ভেতর টেবলেট পুরে খাওয়াতে চায় আপনাকেও তেমনি ইসলামের মোড়কে পুরে নৈতিকতা, মানবতা বাঙালি মুসলিমদের গেলানোর চেষ্টা করতে হবে। শিশুর মত তারাও টেবলেট টুকু ফেলে দিয়ে শুধু ধর্মের রসগোল্লাটাই গিলবে বারবার তারপরও আপনাকে এই প্রক্রিয়াতেই যেতে হবে। সব কিছুর ইসলামী ভার্সন বের করতে হবে। ইসলামী সেক্যুলারিজম, ইসলামী ইতিহাস, ইসলামী নারীবাদ, ইসলামী বিজ্ঞান, ইসলামী বিবর্তন এরকম। এরজন্য নিজেদেরও ঈমানের পরীক্ষা দিতে হবে। মাথায় টুপি পড়তে হবে; প্রয়োজনে খৎনা দেখাতে হবে। এভাবে গিলাতে গিয়ে মূল লক্ষ্যই বাদ পড়ে যাবে। তারপরও ইসলাম থাকা চাই। কোন ভাবেই বলা যাবে না অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই সেক্যুলারিজম প্রয়োজন, নির্মোহ ভাবেই ইতিহাস জানা প্রয়োজন, মানুষ হিসেবেই নারীর সমতা প্রয়োজন, বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে বিজ্ঞান জানা প্রয়োজন। আমেরিকা চাইলেই কেন কিছু মানুষকে নিয়ে যা খুশি করাতে পারবে সেই প্রশ্ন তুলবেন না। সেসব বললেই আপনি নাস্তিক, মুরতাদ হয়ে যাবেন। আপনাকে অবশ্যই ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে আগে। এদের সুশিক্ষা দরকার নেই, বিজ্ঞান দরকার নেই, যুক্তি দরকার নেই। এদের দরকার শুধু ইসলাম। ইসলামের নামে যে কেউ এদের যা খুশি খাইয়ে দিতে পারে।

বাঘ যখন শিকার করে তখন হায়েনা, শিয়াল, শকুন অপেক্ষায় থাকে কখন বাঘ আহার শেষ করবে যাতে তারা কাড়াকাড়ি করে উচ্ছিষ্টটুকু সাবাড় করতে পারে। এদেশের মডারেট, সুশীল, বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছে হায়েনা, শিয়াল, শকুনের দল। তারা সর্বক্ষণ আমেরিকা নামক বাঘটার অপসারন কামনা করে। যাতে নিজেরা মুসলিম নামক ভেড়াদের নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে পারে। তাই কেউ মুসলিমদের অন্ধবিশ্বাস, মূর্খতা ভাঙতে চাইলে তারা সহ্য করতে পারেনা। মূর্খ শিকার সচেতন হয়ে উঠলে তো রুটি রুজি, খ্যাতি সব ভেসে যাবে।”

ছোট ছোট বাক্যে কখনও তিনি খুব গভীর কিছু বুঝাতে চাইতেন। তার একটি পোস্ট- “মানুষ চাই, ফরহাদ মজহার চাই না।”

অভিজিত রায়ের হত্যার প্রতিবাদে ওয়াশিকুর রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরপরই ওয়াশিকুর লিখেছিলেনঃ

“এক থাবা বাবার মৃত্যু হাজার থাবা বাবা জন্ম দিয়েছে,
এক অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু লাখো অভিজিৎ রায়কে জন্ম দিবে।

কলম চলবে, চলতেই থাকবে। তোদের বিশ্বাসের মৃত্যু না ঘটা পর্যন্ত।

ইসলাম ধ্বংস হোক,
ইসলাম ধ্বংস হোক,
ইসলাম ধ্বংস হোক…

#WordsCannotBeKilled [২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫]

তাঁর এই লেখাটিতে অনেকে হয়তো খুব আপত্তিকর কিছু দেখতে পারেন। কিন্তু আপনাকে ঐ সময়কে অনুভব করতে হবে। অন্য একটা পোস্টে তাঁর এমন লেখার পিছনে যুক্তিও খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে তিনি লিখেছিলেন, “ধর্মবিদ্বেষ অপরাধ নয়, কিন্তু মানববিদ্বেষ অপরাধ। পৃথিবীর সব ধর্ম মানববিদ্বেষে পূর্ণ। তাই মানববিদ্বেষী ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পবিত্র দায়িত্ব।”

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে যারা প্রতিবাদ না করে নীরবতা পালন করছিলেন তাদের সমালোচনায়  Martin Niemöller এর বিখ্যাত কবিতা ‘First They Came…’ এর ভাব অনুকরণে তিনি লিখেছিলেন।

“প্রথমে তারা ধর্মবিদ্বেষী কতল করল
আমি হাততালি দিলাম।
কারন আমারো অনুভূতি আছে।

তারপর তারা নাস্তিকদের কতল করল
আমি কলেমা পড়ে নিজের আস্তিকতার প্রমান দিলাম।
কারন আমারো ঈমান আছে।

তারপর তারা বিধর্মীদের কতল করল
আমি লুঙ্গি উঁচিয়ে ঈমানদণ্ড দেখিয়ে দিলাম।
কারন আমারো খৎনা আছে।

তারপর তারা মডারেটদের কতল করল
আমি দাড়ি-টুপি রেখে পাক্কা মুমিন হলাম
কারন আমারো হুরের লোভ আছে।

তারপর তারা ভিন্ন ফেরকার ধার্মিকদের কতল করল
আমি তাদের দলে ভিড়ে কতলে অংশ নিলাম।
কারন আমারো জানের ভয় আছে।

তারপরও তারা আমার হাতের তালু কেটে নিল
কারন প্রথমে হাততালি দিয়েছিলাম যা হারাম।

#WordsCannotBeKilled” [২৮ ফেব্রুআরি, ২০১৮]

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতে তাঁর আরো কয়েকটি লেখাঃ

১. “বাংলাদেশ ধর্মগাধাদের দেশ। এ-দেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির উপর পঞ্চাশ করে ধর্মগাধার বিচরন যারা অমরদের মাটির নিচে ঘুমাতে পাঠিয়ে দেয়।”

২. “অভিজিৎ রায়ের অবদান নিয়ে অনলাইনে ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ রক্ষার একমাত্র ইজারাদার গালিবাজ গ্যাং বার বার প্রশ্ন তুলছে। আপনারা নেতাদের খুদকুঁড়ো খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করা মানুষ। বিজ্ঞান লেখা, বিজ্ঞানমনস্ক হবার গুরুত্ব বুঝতে আপনাদের অপারগতা উপলব্ধি করতে পারি। দলীয় আনুগত্বের জন্য মস্তিষ্কের ব্যাবহার নিস্প্রয়োজন তারপরও আপনারা প্রশ্ন করছেন এতে কিছুটা হলেও মস্তিষ্কের ব্যাবহার হচ্ছে। আপনাদের অভিনন্দন।

তবে যেই সক্রেটিস, ব্রুনোদের সাথে তুলনা করে প্রশ্ন তুলছেন তাদের অবদান বুঝতে মানুষ কয়েক শতাব্দি সময় নিয়েছে। অপেক্ষা করুন; আপনাদের পূর্বসূরী ধর্মরক্ষকরা যাদের কাফের, নাস্তিক বলে ঘৃণা করেছিল তাদের আপনারা মাথায় তুলেছেন। আপনাদের উত্তরসূরীরাও অভিজিৎ রায়ের অবদান ঠিকই বুঝতে পারবে। আশা করি তা স্বচক্ষে দেখার আয়ু পাবেন আপনারা।”

৩. “মেয়েরা পর্দা না করলে তো ধর্ষণ হবেই’

‘লেখায় পর্দা না করলে তো কোপ খাবেই’

আপনি এই দুটি বাক্যের একটি সমর্থন করেন মানেই আপনি বলদা। আর আপনার এই বলদামিকে লাত্থি মেরে অনুভূতি নিহত করাই আমার লক্ষ্য।”

৪. “যে গ্রন্থের ‘ভুল ব্যাখ্যায়’ মানুষ মরে কিন্তু ‘সঠিক ব্যাখ্যার’ কোন প্রয়োগ বা উপযোগীতা থাকে না সেই গ্রন্থ নিষিদ্ধ হোক।”

ধর্মের সাথে বিজ্ঞানে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টারতদের মুসলমানদের হিপোক্রেসী সম্পর্কে ওয়াশিকুরঃ

‘নতুন কোন উপাদান আসলে মুমিনরা প্রথমে তা গ্রহন করতে অস্বীকার করে এবং দাঁত খিচিয়ে বলে, মুসলিমদের ইসলাম থেকে দূরে সরানোর জন্য ইহুদী-নাসারাদের ষড়যন্ত্র।

অনেক পরে গ্রহন করতে বাধ্য হলে দাঁত কেলিয়ে বলে এটা মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান। একান্তই যদি মুসলিম বিজ্ঞানীর সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব না হয় তাহলে বলে, বিজ্ঞানীরা সব কোরান পড়ে আবিষ্কার করে…

ওয়াশিকুরের লেখালেখির প্রধান অস্ত্র ছিল স্যাটায়ার। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তিনি  লিখেছিলেনঃ

“না, আর লিখবোনা যুদ্ধাপরাধ, মৌলবাদ,দেশ, রাজনীতি নিয়ে। এমনিতেও লিখলে কিছুই হয়না শুধু মনের ঝালটা মিটাই। কিন্তু তাতেও নাকি অনুভূতি আহত হয়, দেশের ‘শান্তি’ বিনষ্ট হয়, উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই এমন কিছু নিয়ে লিখতে হবে যাতে কারোই সমস্যা না হয়।

আচ্ছা গাছ-পালা নিয়ে লেখা যাক। আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় গাছের পরিমান অনেক কম। বিভিন্ন কারনে নিয়মিত বৃক্ষনিধন তো হচ্ছেই। গত বছর হেফাজৎ-শিবির আন্দোলনের নামে প্রচুর গাছ কেটেছিলো। সম্ভবত মরুভূমি তাদের পছন্দ বলেই গাছের প্রতি ক্ষোভ। তার উপর রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলে সুন্দরবনের ঝুঁকি…

… একি, এসব কী লিখছি! না না এ লেখা চলবে না। শান্তি বিনষ্ট হবে, উন্নয়ন ব্যাহত হবে। অন্য কিছু নিয়ে লিখতে হবে…

…হুম শিক্ষা নিয়ে লেখা যায়। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। প্রতিবছর পাশের হার বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার কী অবস্থা! ব্যাপক ভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। যেনতেন ভাবে পাশ করাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মেধা মূল্যায়নের বালাই নেই। দেশে ত্রি স্তরের শিক্ষা ব্যাবস্থা প্রচলিত…

…দূর, এ নিয়েও লেখা ঠিক হবে না। শতভাগ শিক্ষিত করার মহাপরিকল্পনা যদি ভেস্তে যায়! তার চেয়ে…

…বরং ভ্রমন কাহিনী লিখি। কয়েকবছর আগে সীতাকুন্ডু গিয়েছিলাম। সেখান থেকে পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়গুলো দেখা যায়। দেশের আদিবাসীদের উল্লেখযোগ্য অংশই সেখানে বাস করে। যদিও সেটেলার আর সেনাবাহিনীর আগ্রাসনে তারা বিপর্যস্ত।এছাড়াও অনেক আগে কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সময় বিশাল এলাকা তলিয়ে গিয়েছিলো…

…সর্বনাশ, এসব লিখলে নির্ঘাত রাষ্ট্রদোহী হয়ে যাবো! নিরাপদ কিছু ভাবতে হবে…

…পেয়েছি চলচ্চিত্র। আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুবই বেহাল। যদিও গুটিকয় মানুষ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন তারেক মাসুদ। দুর্ভাগ্য বসত তাঁকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। দেশের একটা শ্রেণী তাঁকে পছন্দ করে না। কারন তার চলচ্চিত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি, জঙ্গিবাদ স্থান পেয়েছিলো। তাঁর পরিচালিত মাটির ময়না ‘কান চলচ্চিত্র উৎসবে’ পুরস্কৃত হলেও তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার প্রথমে মুক্তি দিতে চায়নি ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে। পরে…

…অসম্ভব! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে লিখবো? বরং…

…প্রেম, হ্যাঁ প্রেম-ভালোবাসা সবচেয়ে নিরাপদ বিষয়। কে না আছে জীবনে একবার হলেও প্রেম করে! অনেক ছেলে আছে যারা একের পর এক প্রেম করে। কিন্তু প্রতিবারই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার পরই সম্পর্ক ভেঙে দেয়। অনেকে আবার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে শুধু মেয়েদেরই দোষারোপ করা হয়। ওই ছেলেগুলো ঠিকই বিয়ের ক্ষেত্রে অক্ষতযোনির মেয়ে খুঁজে। কিন্তু ওই মেয়েরা পরবর্তীতে খুব কমই স্বাভাবিক জীবন যাপন…

…নাহ; নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এসব নিয়ে টু শব্দও করা যাবে না। সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে, ছেলে-মেয়েরা সব উচ্ছন্নে যাবে। সমাজ ঠিক থাক আমি…

…নিজেকে নিয়েই কিছু লেখা যাক। আমার জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য সুবিধাবাদিতা, দোদুল্যমানতা, স্বার্থপরতা সবই আমার মধ্যে আছে। তবু ভালো নিম্নবিত্ত বা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীতে জন্মাইনি। কৃষকরা পায়না ফসলের ন্যায্য মূল্য, শ্রমিকরা পায় না ন্যায্য মজুরী। সবচেয়ে বৃহত শিল্প খাত গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তাও নেই। কখনো ভবন ধ্বস, কখনো আগুন লেগে তারা গণহারে মারা যায়। তারপর লোক দেখানো উদ্ধার তৎপরতা, নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিটি, ক্ষতিপূরনের ভুয়া আশ্বাস, বিচারের নামে অভিযুক্তকে আড়াল করা এগুলো…

…উফ, আমার দ্বারা আসলেই লেখা সম্ভব না। কী সুন্দর করে তরতর করে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আর আমি কিনা বাগড়া দিতে বসেছি! এসব তো লেখে ষড়যন্ত্রকারীরা যারা দেশের শিল্প খাত ধ্বংস করতে চায়, কৃষি উন্নয়ন নশ্চ্যাৎ করতে চায়। বাস্তবতা ছেড়ে নাহয়…

…গল্প লিখি। এক যে ছিলো রাজা। এখন তো আর রাজার যুগ নেই। সর্বশেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত ও নির্মম ভাবে নিহত হয়েছিলেন। অবশ্য মীরজাফর তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করেছিলো অচিরেই। কিন্তু মীরজাফরের চেয়ে শতগুন ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীরা অনেক বছর এ দেশে শান্তিতে বসবাস করেছে। ক্ষমতার স্বাদও নিয়েছে। বর্তমানে যদিও তাদের বিচার চলছে কিন্তু ধীর গতির ট্রাইব্যুনাল, যে কোন দিন রায়, সরকারের সাথে আঁতাতের অভিযোগ, শাহবাগ আন্দোলন…

…মাথা খারাপ! এসব নিয়ে লিখলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যাহত হবে। স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকারের দোসর তিলক পড়বে!

তাহলে কী নিয়ে লিখবো আমি! কেউ কি বলতে পারবেন কী নিয়ে লিখতে সরকার, রাজনৈতিক দল, মৌলবাদী, জনগণ, স্বাধীনতা পক্ষ-বিপক্ষ সব গোষ্ঠী শান্ত থাকবে? আছেন কি কেউ বুদ্ধি দেওয়ার মতো?

হ্যালো…”

নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁত ভাঙা জবাব সিরিজ থেকে কয়েকটি পোস্ট ও এ সম্পর্কে কিছু কথাঃ প্রথমত কটুক্তি শব্দটি ‘উ’-কার দিয়ে হলেও ওয়াশিকুর ‘ঊ’-কার দিয়ে লিখতেন। এই বানানের মধ্যেও কোন কটু্ক্তি ছিল কিনা আমাদের জানা নেই। আমরা তার বানানটাই রেখে দিলাম। এই স্যাটায়ার সিরিজটিতে ওয়াশিকুর মোট ১০৪টি কটূক্তির(!) জবাব দিয়েছেন। প্রতিটি পোস্টে দুটো করে কটুক্তির জবাব থাকতো। শেষের দিকের পোস্টগুলোতে (৮৭ নম্বর থেকে) একটা ডিসক্লেইমার থাকতো, যা আসলে তাঁর সবগুলো পোস্টের জন্যই প্রযোজ্য। ডিসক্লেইমারটি হলোঃ “বি.দ্র. কটূক্তির বদলে দাঁত ভাঙা জবাব গুলো আমার নয়। বিভিন্ন সময়ে মুমিনগণ যে জবাব দিয়েছেন তা ছড়িয়ে দিচ্ছি শুধু। আপনারাও সবাই শেয়ার করে নাস্তিকদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জবাব দিন, ঈমান পোক্ত করুন…”

দাঁত ভাঙা জবাব সিরিজের কয়েকটি পোস্ট তুলে ধরা হলোঃ

কটূক্তি ১- মুহাম্মদ কাবায় স্থাপিত পৌত্তলিকদের মূর্তি ভেঙেছে, পালক সন্তানের বিধান বাতিল করে পালক পুত্রের স্ত্রীকে বিবাহ করেছে, নারীদের উপর পর্দা চাপিয়ে দিয়েছে…

 দাঁত ভাঙা জবাবঃ দেখুন কোন প্রথা বা আচার সমাজে প্রচলিত হলেই তা কল্যাণকর হয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে মুহাম্মদ (সঃ) ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। তিনি অনেক প্রথা বাতিল করে নতুন বিধান দিয়েছিলেন সমাজ পরিবর্তনের স্বার্থে। তার প্রতিটি পদক্ষেপের পিছনেই সুদূরপ্রসারী কল্যান নিহিত…
কটূক্তি ২- মুহাম্মদ যুদ্ধবন্দীনিদের ধর্ষণ করেছিল; একাধিক পত্নী, উপপত্নী, দাসী রেখেছিল; নাবালিকা বিয়ে করেছিল; অমুসলিমদের হত্যা অথবা নির্বাসিত করেছিল…
দাঁত ভাঙা জবাবঃ নাস্তিকরা আসলেই বেকুব। আরে এসব প্রথা তো তৎকালীন আরবেই প্রচলিত ছিল। সময়ের প্রয়োজনে প্রচলিত কোন প্রথা অনুসরণ করলে তাঁর দোষ কোথায়? আসলে ইসলাম বিদ্বেষী হলেও নাস্তিকগুলা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানেনা
………..

কটূক্তি ৮৭ – ইসলামে শুকরের মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ কেন? 

দাঁত ভাঙা জবাবঃ যে যা খায়, সে সেই মত আচরন করে। যেমন অমুসলিমরা শুকরের মাংস খায় বলে তাদের স্বভাব শুকরের মত। খ্রিস্টানদের ডান্স পার্টি গুলোতে নেচে নেচে উত্তেজনার উত্তুঙ্গে উঠে একে অপরের সাথে শোয়া’র জন্য বউ বদল করে নেয়; যেমনটা শুকর করে থাকে। 

কটূক্তি ৮৮ – কোন প্রাণীর মাংস খেলেই যদি সেই প্রাণীর মত আচরন করে কেউ, তাহলে মুসলিমরা গরু-ছাগল খায় কেন? তাদের আচরন কি গরু-ছাগলের মতো? তারা কি গরুর মতো সঙ্গম করে?

দাঁত ভাঙা জবাবঃ কোন প্রাণীর মাংস খেলেই যে সেই প্রাণীর মত আচরন করবে এর পেছনে কোন যুক্তি-প্রমান নেই। মানুষ বেঁচে থাকার জন্যই প্রাণীর মাংস খায়। এটার সাথে আচরনের সম্পর্ক নেই।

 ……….

 

কটূক্তি ১০১ – গুটিকয়েক জঙ্গিরা ইসলামের নামে যেসব সন্ত্রাস করে তা কোরান-হাদীস দ্বারাই স্বীকৃত। তাহলে কেন বলা যাবে না জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডই ইসলামের প্রকৃত রূপ?

দাঁত ভাঙা জবাবঃ সিংহভাগ মুসলিমদের সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক নেই। সেই তুলনায় স্বল্প সংখ্যক সালাফিদের কর্মকাণ্ড যারা সহি ইসলাম বলে প্রচার করতে চায় তারা মূলত মৌলবাদের হাতকে শক্ত করে। এরা সালাফি সেক্যুলার। সালাফি মুসলিমদের সাথে এরাই জঙ্গিবাদের জন্য দায়ী। 

কটূক্তি ১০২ – উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার থাকলেও অধিকাংশই মুসলিমই তা মান্য করে না। তাহলে কি বলতে হবে উত্তরাধীকার সম্পত্তিতে কন্যা শিশুর অধিকার ইসলামের অংশ নয়?

দাঁত ভাঙা জবাবঃ কন্যা শিশু উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে হক আছে তা ইসলাম সম্মত এবং কোরান-হাদিস দ্বারা প্রমানিতে। যদি একজন মুসলিমও তা পালন না করে তার জন্য ইসলাম পরিবর্তিত হয়ে যায় না। 
দাঁত ভাঙা কার্টেসিঃ বামাতি এবং মডারেট।

ওয়াশিকুর বাবুর আরো কিছু উদ্ধৃতিঃ

১. এক সময় সবাই মানুষ ছিল। তারপর ঈশ্বরের আবির্ভাব হল; মানুষ হয়ে গেল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ …

২. যে ধর্ম মানুষকে ঘৃণা করতে শেখায়, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি।

৩. এমন কোন ভালো কাজ নাই, যার জন্যে ধর্ম আবশ্যক। কিন্তু এমন অনেক অপরাধ আছে, যা ধর্ম ছাড়া সম্ভব হতো না।
৪. কোন ধর্মই নারীকে কথিত সম্মানটুকুও দেয়নি। তারা সম্মান দিয়েছে মাকে, বোনকে, স্ত্রীকে, কন্যাকে। যারা নিজেদেরকে এইসব পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রেখেছে- তারা সতী আর যারা মানুষ হতে চেয়েছে, তাদেরকে বেশ্যা উপাধি দিয়েছে ধর্মীয় সমাজ।

৫. ধর্মানুভূতি দিয়ে চাষাবাদ হয় না, উৎপাদন হয় না, শিক্ষা হয় না, গবেষণা হয় না, শিল্প-সাহিত্য হয় না। ধর্মানুভূতি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা হয়, দাঙ্গা হয়, লুটপাট হয়, ধর্ষণ হয়, নোংরা রাজনীতি হয়।

৬. মানব রচিত সবচেয়ে আগ্রাসী কল্পনা হচ্ছে ধর্ম; যা মানুষের কল্পনা শক্তিকে গ্রাস করে। নিজের মত করে একটি স্বর্গ কল্পনা করতেও ধার্মিকেরা অক্ষম।

৭. মৃত্যুতে ভয়ের কিছু নেই, যত ভয় জীবনে

৮. ধর্ম হচ্ছে নিজের অপকর্মকে জায়েজ করার ঐশী বর্ম…

৯. যে পুস্তক পাঠ করিলে বুদ্ধি, বিবেক, বাস্তবতাবোধ বিলুপ্ত হয় তাহাকে ধর্মগ্রন্থ বলে।

১০. মুমিনরা আসলেই ব্যাপক জ্ঞানী। তারা যুদ্ধবন্দিনী ধর্ষণ, দাস প্রথা, বহু বিবাহ, শিশু বিবাহ, হিল্লা এসবে কল্যান খুঁজে পায়।
আর সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্যে অকল্যান খুঁজে পায়…

ওয়াশিকুর বাবুর মৃত্যুর এক বছর পরে ধর্মকরী ব্লগসাইটের মাহমুদুন নবী লিখেছিলেনঃ

‘এতো অল্প বয়সেই পরিপক্ক স্বচ্ছ চিন্তা, স্পষ্ট শাণিত যুক্তি ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে নিজের জাত চেনাতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা তাঁকে করে তুলেছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র। এমনকি মহানবীর মহান বীর অনুসারীরাও বুঝে গিয়েছিল, এই ছেলের ভেতরে আগুন আছে, যা ইছলামের আরোপিত মেকি সৌন্দর্য ঝলসে দিয়ে প্রকৃত কদর্য রূপটি প্রকাশ করতে শুরু করেছে।

যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে মোকাবিলার সামর্থ্য ও ক্ষমতা ইছলামীদের নেই। ক্ষুরধার যুক্তির কাপুরুষোচিত উত্তর ধারালো চাপাতির মাধ্যমে দিয়ে তারা অভ্যস্ত। আর সেটাই তারা করেছে গত বছর এই দিনে। যদিও দুই হত্যাকারী ধরা পড়েছে ঘটনাস্থলেই, তবু এই এক বছরে বিচারকার্যের কোনও অগ্রগতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। এর একমাত্র কারণ – কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব। মদিনা সনদ অনুযায়ী পরিচালিত দেশের সরকারটি এখন দেশজুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসার প্রসারে (পড়ুন, ইছলামী উগ্রবাদের প্রসারে) অন্তপ্রাণ, হেফাজতলেহন ও মোল্লাতোষণকে তা গ্রহণ করেছে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে।”

পরিশেষঃ

ফেসবুকে ওয়াশিকুরের সবশেষ প্রোফাইল ছবিটিই ছিল ‘আই এ্যাম অভিজিৎ’ লেখা একটি পোস্টার। তাতে ইংরেজিতে আরো লেখা আছে ‘শব্দের মৃত্যু নেই’। ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তাঁর আদর্শকে হত্যা করা করা যায় নি, যাবেও না, কারণ ওয়াশিকুর বাবুর লেখা শব্দগুলোকে হত্যা করা সম্ভব হয় নি। ওয়াশিকুর তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মাঝে বেঁচে আছেন, থাকবেন। ওয়াশিকুর বাবুর আত্মদান বৃথা যায়নি।

আজ অসংখ্য ওয়াশিকুর বাবুদের পদচারনায় অনলাইন মুখরিত। কালের ইতিহাসে , মুক্তচিন্তার ইতিহাসে ওয়াশিকুর বাবুর রক্তের অক্ষরে চিরকাল লেখা থাকবে। একদিন না একদিন ওয়াশিকুর বাবুদের স্বপ্নের ধর্মহীন পৃথিবী, মানবিক পৃথিবী আমরা দেখতে পাবো, অমানবিক ধর্মগুলো ইতিহাসের আস্তকূড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। বিজ্ঞান ও মানবতাবাদের জয় হবে এবং সেইদিন আর বেশী দূরে নয়।

……….

[এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে অনলাইনভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় ২৯.০৩.২০১৮ তারিখে পাঠের উদ্দেশ্য। লিখেছেন মহিউদ্দীন শরীফ এবং এডিট করেছেন সন্যাসী রতন]

Leave a Comment