[লিখেছেনঃ প্রিয়ংকা গায়েন]

ভারতীয় দর্শন মূলত আধ্যাত্মবাদের দর্শন। ভারতীয় দার্শনিকগণ তত্ত্ব বা সত্যকে অন্তর্জগতে উপলব্ধিকরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেকারণে তাঁরা জড়াতিরিক্ত আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক, কর্মফলবাদ, মুক্তি এইসকল অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস রাখেন। একমাত্র ব্যতিক্রম চার্বাক দর্শন। তাঁরা জগৎ এবং সৃষ্টিতত্ত্বকে জড়বাদ দিয়েই ব্যাখ্যা করেছেন।

ভারতীয় দর্শনঃ
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে ভারতীয় অন্যান্য দর্শন সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা যাক। ‘দৃশ’ ধাতুর সাথে ‘অনট’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে ‘দর্শন’ শদ্বটি সম্পন্ন হয়েছে। সংস্কৃত ‘দৃশ’ ধাতুর অর্থ ‘দেখা’। যে তত্ত্বের সাহায্যে জগত ও জীবনের স্বরূপকে ব্যাখ্যা করা যায় তাই দর্শন। ভারতীয় দর্শন মতে তত্ত্বকে বা সত্যকে উপলব্ধি করতে হয় অন্তর্জগতে; আর অন্তর্জগতের কেন্দ্রে রয়েছে আত্মা, মনকে অন্তর্মুখী করেই যাকে উপলব্ধি করা যায়। তাই ‘আত্মান্য বিদ্ধ’ বা আত্মজ্ঞান ভারতীয় দর্শনের মূল কথা।

অনেকেই ভারতীয় দর্শনকে হিন্দু দর্শন নামে অভিহিত করেন। কারণ, পূর্বে ‘ভারত’ নামক ভূখণ্ডের অধিবাসীদের হিন্দু বলেই চিহ্নিত করা হতো। পাশ্চাত্যে ‘ফিলসফি’ বলতে কেবল জ্ঞানতৃষ্ণা চরিতার্থ করা বুঝালেও ভারতীয় দর্শনের উদ্দেশ্য মননের সাথে আচরণের সমন্বয়সাধান। জীবনের সাথে সম্পর্কচ্যুত জ্ঞানের সমর্থন ভারতীয় দর্শনে নেই। চার্বাক দর্শন ভিন্ন অন্য সকল ভারতীয় দর্শনই মোক্ষ বা মুক্তিকে পরম পুরুষার্থ মনে করে। [ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ—এই চারটি হলো মানুষের জীবনের কাম্যবস্তু বা পুরুষার্থ। এদের মধ্যে চরম কাম্য হলো মোক্ষ। কারণ মোক্ষলাভ হলে মানুষের আর কিছু চাওয়ার থাকে না। তাই মোক্ষই হলো পরম পুরুষার্থ। ]

ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দর্শনের অবস্থানঃ
ভারতীয় দর্শনকে প্রধানত দুটি বৃহৎ ভাগে ভাগ করা হয়েছে- আস্তিক্য দর্শন ও নাস্তিক্য দর্শন। সাধারণভাবে ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের যথাক্রমে আস্তিক ও নাস্তিক বলা হলেও ভারতীয় দর্শনে বেদের প্রামাণ্যে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের যথাক্রমে আস্তিক এবং নাস্তিক বলা হয়। নিচের চিত্রে ভারতীয় দর্শনের বিভাজনসমূহ ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো।

classification

নাস্তিক্য দর্শনের মধ্যে চার্বাককে চরমপন্থী বলা হয় কারণ চার্বাক দর্শন বেদকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়। অন্যদিকে বৌদ্ধ ও জৈনকে নরমপন্থী বলা হয় কারণ, এ দুটি দর্শন নাস্তিক্য দর্শন হলেও বেদকে হেয় প্রতিপন্ন করা তাদের উদ্দেশ্য নয়।

ভারতীয় প্রাচীন দার্শনিকগণ নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য মতের দার্শনিকদের সাথে বিতর্কে অবতীর্ণ হতেন। এই বিতর্কে তিনটি ধাপ ছিল।
১. পূর্বপক্ষঃ প্রতিপক্ষের মত উপস্থাপন।
২. খণ্ডনঃ প্রতিপক্ষের মতের দোষত্রুটি নির্ধারণ।
৩. উত্তরপক্ষঃ নিজমত প্রতিপাদন।

এখানে এই বিতর্কের বিষয়টি অবতারণার কারণ, চার্বাক দর্শন সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানতে পারি তা তাঁদের সমালোচকদের বা বিরোধীদের থেকেই। চার্বাকদের মূল গ্রন্থ কিছুই পাওয়া যায়নি; সম্ভবত বিরোধীরাই তা নষ্ট করেছেন। প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে ও সাহিত্যে, রামায়ণ-মহাভারতে, মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহে এই মতবাদের উল্লেখ মেলে।

চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বিষয়ে প্রবল মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ মনে করেন ‘চার্বাক’ নামক কোনো ঋষি এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। অনেকের অভিমত, চার্বাক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা দেবগুরু বৃহস্পতি। কেউ কেউ মনে করেন ‘চারু+বাক’ শব্দযোগে চার্বাক কথাটি এসেছে। ‘চারু’ কথার অর্থ হলো ‘মধুর’, অর্থাৎ যাঁরা শ্রুতিমধুর কথা বলেন,তাঁরাই চার্বাক। কেউ কেউ মনে করেন ‘চর্ব’ ধাতু থেকে ‘চার্বাক’ নামের উৎপত্তি। ‘চর্ব’ ধাতুর অর্থ হলো ‘চর্বণ করা’। উল্লেখ্য, চার্বাকরা ইন্দ্রিয় সুখকেই পরমপুরুষার্থ বলেছেন। সাধারণ মানুষের ভোগসর্বস্ব জীবন এই দর্শনে প্রাধান্য পাওয়ায় চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বলে।

চার্বাকদের সম্প্রদায়ঃ যেহেতু চার্বাক দর্শন সম্পর্কে সবকিছুই পাওয়া যায় তাঁদের সমালোচকদের সাহিত্য থেকে। তাই চার্বাকদের এই বিভাগকে এবং অন্য সকলকিছুকেই সেই আলোকে দেখার অনুরোধ রইলো।

১. বৈতণ্ডিক সম্প্রদায়ঃ কেবলমাত্র বিতণ্ডা তথা বিতর্কে জড়ানো যাদের কর্ম ছিল। এই সম্প্রদায়ভুক্ত চার্বাকদের কোনো গঠনমূলক কাজ ছিল না। এঁদের নিজস্ব মত কিছু ছিল না। সকলকিছুতে সংশয় প্রকাশ করাই ছিল এঁদের বৈশিষ্ট্য।

২. ধূর্ত সম্প্রদায়ঃ এই সম্প্রদায় কেবল ভোগবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এঁরা ঈশ্বর ও পুনর্জন্মবাদ মানতেন না।

৩. সুশিক্ষিত সম্প্রদায়ঃ এই সম্প্রদায় প্রয়োজনবোধে অনুমানকেও প্রামাণ্য হিসেবে নিয়েছেন। এছাড়াও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তাঁদের দর্শনের পরিমার্জনে আগ্রহী হয়েছেন।

চার্বাক দর্শনের বৈশিষ্ট্য :-
ক) এটি জড়বাদী দর্শন
ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় দেহাতিরিক্ত আত্মা, পুনর্জন্ম, কর্মবাদে বিশ্বাসী হলেও চার্বাকগণ উক্ত সকলপ্রকার মতকে খণ্ডন করেছেন। চার্বাকগণ ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বাতাস)-এই চারপ্রকার উপাদানকে স্বীকার করেছেন জগতের আদি উপাদান হিসেবে। তাঁদের এই মতবাদ ‘ভূতচতুষ্টয়বাদ’ নামে খ্যাত।

 সাধারণ বিশ্বাস অনুসারে কার্যমাত্রই কারণ প্রসূত। কারণ কার্যের নিয়ত পূর্ববর্তী ঘটনা এবং তাদের মধ্যে অনিবার্য এবং আবশ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। এই অনিবার্য এবং আবশ্যিক সম্পর্ককে বলে অব্যভিচারী সম্পর্ক। চার্বাকগণ কারণ ও কার্যের অব্যভিচারী সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেননি। চার্বাকরা বলেন, কার্যকারণ নিয়ম দ্বারা জগতের বৈচিত্র্য বা অসাম্যকে ব্যাখ্যা করা যায় না। জগতের বৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁরা বস্তুস্বভাববাদ উপস্থাপন করেন। বস্তুর প্রতিনিয়ত শক্তিকে চার্বাকগণ স্বভাব বলেন। এই স্বভাব নিয়মেই বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি হয়েছে। তাঁদের মতে কার্য মাত্রই কারণরূপ কর্তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে, এমন নয়। অগ্নির উষ্ণতা, কণ্টকের তীক্ষ্ণতা, ইত্যাদি কার্যকারণ সাপেক্ষ নয়। চার্বাকদের মতে ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ তাদের স্বভাববশেই পরস্পর সংযুক্ত হয়ে জগতের উদ্ভব ঘটিয়েছে, আবার স্বভাববশেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে জগতের বিনাশ ঘটাবে। এইভাবে চার্বাকগণ যেমন ‘সৃষ্টিকর্তা’র ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন তেমনি কার্যকারণবাদকেও অস্বীকার করেছেন।

 চার্বাক স্বভাববাদের আবার দুটি ভাগ রয়েছে। এঁদের একদল কার্যকারণের সম্পর্ক অস্বীকার করলেও স্বভাবের কারণতাকে স্বীকৃতি দেয়। এঁদেরকে নরমপন্থী স্বভাববাদী বলে। আর চরমপন্থী স্বভাববাদী বা যদৃচ্ছাবাদীদের মতানুসারে জগতের সৃষ্টি আকস্মিক, অহেতুক। অগ্নির উষ্ণতা, জলের শীতলতা সকলকিছুই কর্তাবিহীন, অহেতুক, কর্মবিহীন ও আকষ্মিক।

খ) চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ
চার্বাকগণ অনুমানকে অস্বীকার করেন এবং প্রত্যক্ষ ব্যতীত অন্য কিছুকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন না। তাদের মতে প্রত্যক্ষ দু’প্রকার। মানসপ্রত্যক্ষ ও বাহ্যপ্রত্যক্ষ। সুখ, দুঃখ, বেদনা প্রভৃতি মানস-অবস্থার জ্ঞানকে মানসপ্রত্যক্ষ বলে। এবং চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, ত্বক এই পাঁচটি বাহ্যইন্দ্রিয় দ্বারা বাইরের জগতের সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ পাওয়া যায়।

 ভারতীয় দর্শনে অনুমান ও শব্দকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। অনুমান হলো প্রত্যক্ষগোচর কোনো বস্তুর জ্ঞানের মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষগোচর কোনো বস্তুর জ্ঞানলাভ। আর শব্দ বলতে বোঝায় বিশ্বস্ত ব্যক্তির বাক্য। চার্বাকগণ অনুমানকে অস্বীকার করেন এই বলে যে, অনুমানের সাহায্যে নিঃসন্দিগ্ধ জ্ঞানলাভ অসম্ভব। তাঁরা শব্দকে প্রমাণ হিসেবে অস্বীকার করেন, কারণ ব্যক্তির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রত্যক্ষগোচর নয়, বরং তা অনুমানলব্ধ।

গ) তাঁরা বেদবিরোধী
চার্বাকগণ বেদে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে বেদ অপৌরুষেয় নয়। যারা বেদকে নিত্য বলেন, তাঁদের যুক্তি হলো- যেহেতু বেদস্রষ্টাকে আমরা স্মরণ করতে পারি না, কাজেই তা অপৌরুষেয়। কিন্তু চার্বাকগণ বলেন, কোনো কিছুর স্রষ্টাকে স্মরণে না আনতে পারলে প্রমাণিত হয় না যে সে বস্তুটি নিত্য। প্রাচীন কালের অনেক কূপ বা মন্দিরের স্রষ্টাকে স্মরণ করতে না পারলেও প্রমাণিত হয় না যে তা নিত্য বা কোনো পুরুষসৃষ্ট নয়। 

চার্বাকমতে বেদ হলো ধূর্ত এবং ভণ্ড ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি। এটি কেবল তাদের স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টামাত্র, যার কোনো ব্যবহারিক উপযোগীতা নেই। তাঁরা বলেন, চতুর ব্রাহ্মণরা নিজেরা বেদে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু যজমানকে বিশ্বাস করতে বলেন। তাঁদের যুক্তি – বেদে কথিত জ্যোতিষ্ঠিক যজ্ঞে পশুবলি দিলে সেই পশুর স্বর্গলাভ হয় – ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা একথা সত্য মনে করলে যজ্ঞে পশুবলির পরিবর্তে তাঁদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বলি দিতেন, কারণ স্বর্গলাভই তো তাদের জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সুতরাং ব্রাহ্মণরা কেবল আত্মস্বার্থ রক্ষার্থে বেদ প্রচার করেন, যা প্রতারণা বৈ অন্য কিছু নয়।

চার্বাকরা বলেন, বেদ অশ্লীল এবং অর্থহীন শব্দে পূর্ণ। অশ্বমেধ যজ্ঞের মন্ত্র এতো অশ্লীল যে কোনো রুচিসম্পন্ন ব্যক্তির পাঠের অযোগ্য। বেদে গো-জাতিকে মনুষ্য জাতি অপেক্ষা উন্নত বলা হয়েছে। চার্বাকমতে কেবল নপুংসকরাই বেদে বিশ্বাস করে।

ঘ) তাঁরা আত্মার স্বাতন্ত্র্যতা স্বীকার করেন না
ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের বিপরীতে চার্বাকদের আরেক জোরালো মত হলো দেহাত্মবাদ। অধ্যাত্মবাদীদের মতে দেহের মৃত্যু হয়, কিন্তু আত্মার জন্ম-মৃত্যু নেই – আত্মা শাশ্বত। চার্বাকগণ আত্মার অস্তিত্বই স্বীকার করেন না, কারণ দেহ ব্যতীত আত্মা সত্তাহীন এবং আত্মা প্রত্যক্ষগোচর নয়।

চার্বাকদের মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা; দেহাতিরিক্ত আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাঁরা দেহের একটি বিশিষ্টতা হিসেবে চেতনা বা চৈতন্যকে স্বীকার করেন। চার্বাকমতে ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ–এই চার প্রকার উপাদান মিলে যে দেহ গঠিত হয়, তাতে চেতনা নামক এক নতুন গুণের সঞ্চার হয়। এক্ষেত্রে তাঁরা উদাহরণ দিয়েছেন, পান, সুপারি ও চুনের মধ্যে লাল বর্ণ না থাকলেও এদের একত্রে চর্বন করলে লাল আভা দেখা যায়, তেমনি চতুর্ভূত পৃথকভাবে চৈতন্য ধর্মবিশিষ্ট না হলেও বিশেষ সংমিশ্রণে দেহে চৈতন্যরূপ গুণ আসে। আত্মা সম্পর্কে চার্বাকদের এই মতবাদ দেহাত্মবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদ নামে পরিচিত।

চার্বাকরা বলেন, মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করলে চৈতন্যও পুষ্ট হয়। জীবদেহের স্নায়ুমণ্ডলীর তারতম্য অনুসারে মানসিক শক্তির তারতম্য ঘটে। যেমন- মেষের স্নায়ুর গঠন অপেক্ষা মানুষের স্নায়ুর গঠন উন্নত হওয়ায় মানুষের বুদ্ধি অপেক্ষাকৃত উন্নত। দেহ অসুস্থ হলে বা বার্ধক্য আসলে মানসিক শক্তি বা চৈতন্য হ্রাস পায়। সুতরাং দেহই আত্মা।

ঙ) তাঁরা নিরীশ্বরবাদী
প্রত্যক্ষের বিষয় নয় বলে চার্বাকগণ ঈশ্বরের সত্তা স্বীকার করেন না। যা কিছু অতীন্দ্রিয়, প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের কাছে তা অসৎ। তাঁরা বলেন, দুঃখ-কষ্ট জর্জরিত জগতের কারণরূপে ‘অসীম করুণাময়’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানা যায় না। তাঁরা বলেন, ঈশ্বর প্রকল্পের মাধ্যমে ভণ্ড ও ধূর্ত ব্রাহ্মণেরা অজ্ঞ জনসাধারণকে প্রতারিত করে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

চ) তাঁরা কর্মবাদ এবং জন্মান্তরবাদ অস্বীকার করেন
চার্বাক ব্যতীত ভারতীয় আস্তিক-নাস্তিক উভয় দর্শন সম্প্রদায় কর্মবাদ এবং জন্মান্তরবাদকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। কিন্তু কার্যকারণ নিয়মকে সমর্থন করে বিধায় চার্বাকগণ কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদকে স্বীকার করেন না। চার্বাকমতে জীবনের সুখ-দুঃখ কর্মের ওপর নির্ভরশীল নয়, নির্ভরশীল মানুষের বিচার সামর্থ্য ও পারিপার্শ্বিক অব্স্থার ওপরে। জগতের সবকিছুই যেমন আকস্মিক, সুখ-দুঃখও তেমন আকস্মিক। একইরূপ কর্মসম্পাদনের দ্বারা একজন সুখভোগ করে, অন্যজন হয়তো করে দুঃখভোগ। চার্বাকমতে দেহবিনাশে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না; চতুর্ভূতে তৈরি দেহ চতুর্ভূতেই বিলীন হয়।

ছ) চার্বাক দর্শন ভোগবাদী দর্শন
ভারতীয় দর্শনে ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষের মধ্যে ধর্ম এবং মোক্ষকে মানুষের জীবনের মূল কাম্যবস্তু বা পরম পুরুষার্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও চার্বাকগণ ইন্দ্রিয়সুখকে মনুষ্য জীবনের কাম্যবস্তু বা পরমপুরুষার্থ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

মোক্ষবাদীদের মতে মোক্ষ হলো দেহবন্ধন থেকে আত্মার মুক্তি এবং সেই সঙ্গে আত্যন্তিক নিবৃত্তি। চার্বাকগণ যেহেতু দেহাতিরিক্ত আত্মা স্বীকার করেন না, তাই তাঁদের কাছে আত্মার মুক্তি বিষয়টা ‘নির্মস্তকের শীরঃপীড়ার’ মতোই হাস্যকর। চার্বাকরা ধর্মকেও পুরুষার্থরূপে স্বীকৃতি দেননি, কারণ যাগযজ্ঞ, অনুষ্ঠান, পাপ-পূণ্য, ঈশ্বর উপাসনা সবই প্রচঞ্চনা মাত্র।

চার্বাকদের মতে কাম হলো মুখ্য লক্ষ্য এবং ভোগসুখের সহায়করূপে অর্থ হলো গৌণ লক্ষ্য। তাঁরা বলেন, ইহলোক সত্য, দেহই সর্বস্ব। নিঃশেষে উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কর্তব্য। চার্বাকদের ভোগবাদীতার সমালোচনা করা হয় এ শ্লোকটি দিয়ে – “যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ / ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ। “ যা তর্জমা করলে হয়, যতদিন বাঁচবে ভোগসুখে বাঁচো। প্রয়োজনে ঋণ করে ঘি খাও।

উপসংহারঃ
চার্বাক দর্শন অধ্যাত্মবাদে নিমগ্ন ভারতীয় দর্শন পরিমণ্ডলে স্বাধীন চিন্তার পথিকৃৎ। দর্শন চিন্তার মূল শর্তই হলো স্বাধীন ভাবনা। আর চার্বাকরা সেইভাবেই বেদ এবং অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধাচারণ করেছেন। যদিও প্রকৃত জ্ঞানলাভের উপায় হিসেবে কেবল প্রত্যক্ষকে স্বীকার করা এবং ভোগবাদকে পরম লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা চার্বাক দর্শনের ত্রুটি হিসেবে পরিলক্ষিত হয়, তবুও চার্বাক দর্শন প্রচলিত সবরকম অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ।

………..

[এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে অনলাইনভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় ১৫.০৩.২০১৮ তারিখে পাঠের উদ্দেশ্য। প্রবন্ধটি লিখতে সমরেন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘ভারতীয় দর্শন’ বইটির সাহায্য নেয়া হয়েছে।

Leave a Comment