প্রবন্ধবাংলাদেশসংখ্যালঘু নির্যাতন

গুজব ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন

দু’দিন আগে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, বাড্ডার এক মন্দিরের পুরোহিত কোরান পুড়েছে। অনলাইন-অফলাইন মিলিয়ে গুজবটি ছড়িয়ে ঢাকাসহ সারা দেশজুড়ে এক উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। উত্তেজিত মুসলমানরা দেশের অনেক স্থানে মিছিলও করেছে জানতে পেলাম। অথচ ফেসবুকে যে ছবিটি দিয়ে এই গুজবটি ছড়ানো হয়, সেটি ২০১০ সালের।
আমরা, ইদানিং কালের ফেসবুকাররা, এরকম গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর উঠলেই পাকিস্তানের উদাহরণ তুলি, অথচ বাংলাদেশের ভূমিতে আমাদের বাঙালি মুসলমানরা যে এরকম হাজারো গুজব ছড়িয়ে এ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছুই বদলে দিয়েছে; এদেশের মানচিত্র থেকেই যে তারা অমুসলিমদের সরিয়ে দিচ্ছে, তার কথা আমরা খুব কমই জানি। অথবা তা উচ্চারণ করার মতো সাহস রাখি না। বাংলাদেশকে বদলে দেয়া সেরকম কয়েকটি গুজবের গল্প শুনুন তবেঃ-
গুজব ১: নোয়াখালী গণহত্যা
স্থানঃ বৃহত্তর নোয়াখালী, ১৯৪৬।
ঘটনাঃ ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগের ‘Direct Action Day’ এবং তৎপরবর্তী কোলকাতা দাঙ্গার সময়ে নোয়াখালী ছিলো শান্ত। কিন্তু এর কয়েকদিন পরেই অগাস্ট মাসের শেষ দিকে গুজব ছড়ানো হয় যে, হিন্দু ও শিখরা তাদের বাড়িতে অস্ত্র মজুদ করছে, তারা যে কোন সময়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমন করবে। এসময় থেকেই হিন্দুদের ওপর ছোটখাট হামলা বা দু-চারটা খুন এবং হিন্দুদের দোকানপাট লুট হতে থাকে। এরই মধ্যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্য গোলাম সারওয়ার হোসেইনী (যিনি একজন পীর ছিলেন এবং তার দরবার শরীফ কুসংষ্কারপ্রিয় বাঙালি মুসলমান-হিন্দু দুই ধর্মের মানুষের কাছেই খুব শ্রদ্ধার বলে বিবেচিত হতো) নির্বাচনে হেরে গেলে সে বিভিন্ন বক্তৃতা-ওয়াজে কোলকাতা দাঙ্গার প্রতিশোধ হিসেবে বৃহত্তর নোয়াখালীতে বাস করা হিন্দু ও শিখদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের উস্কানি দিতে থাকে। এ সময়েও ছোটখাট অত্যাচার বা দু-চারটি হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয় এবং রামগঞ্জ বাজারের হিন্দু দোকানপাট লুট হয়। এরই মাঝে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মুসলিম লীগ ও ঐ পীরের সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও গুজব ছড়ায় যে, হিন্দু ও শিখরা তাদের বাড়িতে অস্ত্র মজুদ করছে, তারা মুসলমানদের ওপর আক্রমন করবে। এদিকে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে কোলকাতায় বাস করা চাকুরীজীবি-ব্যবসায়ীসহ বেশিরভাগ হিন্দুরাই তাদের পরিবারের সাথে দেখা করতে নোয়াখালীতে এসেছিলো। দুর্গাপূজার পরের পূর্ণিমাতে কোজাগরি লক্ষী পূজা বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই বেশ উৎসবের মতো পালিত হয়। ঐ রাতে হিন্দুরা সবাই পূজার আয়োজনে ব্যস্ত ছিলো। এরই মধ্যে সংঘবদ্ধ মুসলমানরা হিন্দু জমিদারের অফিসে হামলা করে। পরে তাকে জীবিত পুড়ে মেরে ফেলা হয়। এরপরে বৃহত্তর নোয়াখালীতে কিছুদিন ধরে হিন্দুদের হত্যা, ধর্ষন ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ চলতেই থাকে। চলতে থাকে বীভৎস ও বিকৃত কর্মকাণ্ডও। রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরী নামে এক জমিদার, তার পরিবার ও সাঙ্গপাঙ্গদের খুন করার পরে হত্যাকারীরা চৌধুরীর রক্তমাখা মাথা বড় খাবারের প্লেটে করে ঐ পীরের সামনে পরিবেশন করে এবং পীরের দুই কন্যাকে পরিবেশন করা হয় আরো দু’জনের মাথা।
ফলাফলঃ প্রায় ৫,০০০ হিন্দু ও শিখের মৃত্যু; অগনিত ধর্ষন; হিন্দুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ। ধর্মান্তরকরণের ব্যাপারে সংসদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এক প্রশ্নের জবাবে মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী প্রায় দশ হাজারের কথা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবে ছিলো তার চেয়ে ঢের বেশি। অমুসলিম নারীদের জোর করে শাখা ভেঙে, সিঁদূর মুছে দিয়ে কলেমা পড়ানো হয়েছিলো; নারী-পুরুষ সবাইকে গরুর মাংস খেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। হিন্দু শিখদের কয়েকমাস ধরে আটকে রাখা হয়েছিলো, যাতে তারা গ্রামের বাইরে গিয়ে ফের হিন্দুত্বে না ফিরতে পারে। মুসলমান না হলে তাদেরকে জোরপূর্বক জিজিয়া কর দিতে বাধ্য করা হয়েছিলো।
গুজব ২: ঢাকায় হিন্দু হত্যা
স্থানঃ ঢাকা শহর ও বৃহত্তর ঢাকা, ১৯৫০।
ঘটনাঃ ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও কোলকাতার মধ্যে চিফ সেক্রেটারি লেভেলে মিটিং হচ্ছিলো। কোলকাতা থেকে এসেছিলেন কোলকাতার চিফ সেক্রেটারি সুকুমার সেন। সকাল দশটার দিকে ভিতরে যখন মিটিং হচ্ছিলো তখন সচিবালয় এলাকায় রক্তমাখা শাড়ি পরা এক নারীকে নিয়ে মিছিল হয় এবং গুজব রটানো হয় যে, পশ্চিমবঙ্গে ঐ নারী হিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। সাথে সাথে সচিবালয়ের সকল কর্মচারীরা বাইরে নেমে আসে এবং হিন্দুবিরোধী মিছিল দিতে থাকে। সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট, পোড়ানো, হত্যা। এরই মধ্যে বরিশাল থেকে আরেকদফা দাঙ্গা শুরু হয়। মার্চ মাস পর্যন্ত এই হত্যা ও নির্যাতনযজ্ঞে বহু হিন্দু প্রাণ হারিয়েছে এবং ঢাকাতে হিন্দুদের প্রায় সব দোকান-পাট লুট হয়েছে। বর্তমান নরসিংদী ও গাজিপুর জেলার বেশিরভাগ হিন্দু বাড়ি, দোকানপাটে এসময় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
ফলাফলঃ ২০০ এর বেশি হিন্দু হত্যা; ৫০-৮০ হাজার হিন্দুদের দেশত্যাগ।
গুজব ৩: বরিশাল গণহত্যা
স্থানঃ বৃহত্তর বরিশাল ও সারা বাংলাদেশ ১৯৫০।
ঘটনাঃ ১৯৫০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকালে দু’জন অচেনা যুবক গুজব রটায় যে, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় হিন্দুরা এ.কে. ফজলুল হককে হত্যা করেছে। ঐ দিন রাতেই বরিশাল শহরে হিন্দুদের দোকান-পাট ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৬ ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ভয়ংকর তাণ্ডব। বৃহত্তর বরিশালের গৌরনদী, আগৈলঝড়া, ঝালকাঠি, নলছিটিসহ পুরো অঞ্চলেই হিন্দুদের হত্য করা হয়, তাদের বাড়ি লুটপাট ও আগুন দেয়া হয়। বরিশাল থেকে ঢাকাগামী লঞ্চে হিন্দুদের কেটে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। বরিশালে মুলাদীতে কয়েকশ হিন্দু মুলাদী থানায় আশ্রয় নিয়ে থানায় আক্রমন করেই তাদেরকে হত্যা করা হয় ও জীবিত পুড়ে ফেলা হয়। হিন্দু শিক্ষককে তার ছাত্ররা জীবিত আগুনে পোড়া দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। মাধবপাশা জমিদার বাড়িতে কয়েকশ হিন্দুদের হত্যা করা হয়। বাবুগঞ্জে শ’দুয়েক হিন্দুকে রামদা দিয়ে একজন একজন করে গলা কাটা হয়। ভোলাতে চট্টগ্রামগামী সীতাকুণ্ড জাহাজ থেকে হিন্দুদের কেটে কেটে জলে ফেলা হয়। বরিশাল থেকে উদ্ভুত এই দাঙ্গা বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ে। সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ঢাকা, সবখানেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু নির্যাতিত হয়, প্রাণ যায় হাজারো মানুষের।
ফলাফলঃ ৬৫০০ নিহত ও ৬৫০,০০০ হিন্দুর দেশত্যাগ। সময়ে বৃহত্তর নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহসহ দেশের বহু জায়গায় হিন্দুদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এসময়ের দাঙ্গাগুলোতে পুলিশ, আনসার বাহিনী নিরাপত্তা তো দেয়ই নি, উল্টো সাহায্য করেছে। দেশত্যাগী হিন্দুদেরকে পথে পথে লুট করা হয়েছে, যাতে তারা বাংলাদেশ থেকে কিছুই না নিয়ে যেতে পারে।
গুজব ৪: খুলনা তথা পূর্ব পাকিস্তান গণহত্যা
স্থানঃ খুলনা ও সারা বাংলাদেশ
ঘটনাঃ ১৯৬৪ সালের ২৭ ডিসেম্বরে গুজব রটে যে, কাশ্মিরে ‘হযরতবাল মসজিদ’-এ রক্ষিত মোহাম্মদের চুল (চুলকে হিন্দিতে বাল বলে, তাই ঐ মসজিদের নাম হযরতবাল মসজিদ) পাওয়া যাচ্ছে না এবং রটানো হয় যে, উক্ত চুলগাছি হিন্দুরা চুরি করেছে। আবদুল হাই নামে এক মুসলিম নেতা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে। ঢাকা বিমানবন্দরে আইয়ুব খান বলে যে, সে পূর্ব পাকিস্তানের কোন কিছু ঘটলে তার দায় নিতে পারবে না। এদিকে ওর কিছু দিন আগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবদুস সবুর খান রূপচাঁদ বিশ্বাস নামে এক হিন্দুর সাথে ৩০ বিঘা জমির মামলায় হেরে যায়। সবুর খান ঐ জমি অবৈধ দখল করে ছিলো। জমির মামলায় হারা ছাড়াও পূর্বে দখল করে থাকা বাবদ আদালত সবুর খানকে ১৩৫,০০০ রুপি জরিমানা করে। সবুর খান হিন্দুদের শিক্ষা দেয়ার একটা বড় সুযোগ পেয়ে যায়। কাশ্মিরে হযরতের চুল হারানোর জন্য ২ জানুয়ারি সকাল থেকে খুলনার হিন্দুদেরকে জুতা খুলে হাঁটা ও ছাতা মাথায় না দেয়ায় বাধ্য করা হয়। বিকেল চারটা থেকে শুরু হয় হিন্দুদের খুন, ধর্ষন, বাড়ি লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। রাত আটটায় কার্ফু জারি করার পূর্বে খুলনাতে বহু হিন্দু হত্যা করা হয়।
৩ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানে কাশ্মির দিবস পালন করা হয়। দৌলতপুরে এক বিশাল জনসভায় সবুর খান হযরতবাল মসজিদে নবী মোহাম্মদের চুল চুরির জন্য হিন্দুদের দোষী করে উত্তেজনা সৃষ্টিমূলক হিন্দুবিরোধী ও ভারতবিরোধী বক্তৃতা দেয়। বক্তৃতা শেষে জনসভার হাজার বিশেষ উত্তেজিত মুসলমান হিন্দু হত্যায় ছড়িয়ে পড়ে। হত্যার সাথে পাল্লা দিয়ে চলে ধর্ষন। সাথে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ তো আছেই। খুলনা দাঙ্গার হত্যাকারীদের মূলে ছিলো বিহারীরা; এর সাথে ছিলো খুলনা শিপইয়ার্ড, দাদা এ্যান্ড কোং ম্যাচ ফ্যাক্টরি, ইস্পাহানি কোম্পানির শ্রমিক ও সাধারণ মুসলমানরা। খুলনা লঞ্চঘাটে একসাথে ২০০-৩০০ হিন্দুদের হত্যা করা হয়। ৪ জানুয়ারি মংলা পোর্টে হত্যা করা হয় প্রায় ৩০০ হিন্দু শ্রমিককে। খুলনার রামপালের মিটিংয়ে আবদুস সবুর খান হিন্দুদের বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। একইদিনে অন্য এক জনসভায় সে হিন্দুদের পিঠের চামড়া দিয়ে জুতা বানাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
যদিও ৪ জানুয়ারি হযরতের চুলগাছি মসজিদেই পাওয়া যায়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের সারা দেশ জুড়েই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং সারা বাংলাদেশের হিন্দুরা হত্যা, ধর্ষন, মালামাল লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের স্বীকার হয়। এই দাঙ্গায় যে কেবল হিন্দুদের অত্যাচার করা হয় তা নয়, সারা দেশের অন্য সকল সংখ্যালঘুদের ওপরও নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এর ফলে হিন্দুদের মতো দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় গারো, হাজং, চাকমাসহ বহু আদিবাসী গোষ্ঠী।
ফলাফলঃ ১৯৬৪ দাঙ্গায় নিহত হওয়া মানুষের কোন পরিসংখ্যন আমি ইন্টারনেট সার্চ করে পাই নি। তবে এই দাঙ্গার পরে এতো বেশি হিন্দু খুলনা থেকে মাইগ্রেট করে যে, দেশের একমাত্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা খুলনা হিন্দু সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে প্রায় ৭৮০০০ বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী ভারতে আশ্রয় নেয়, যাদেরকে ভারত সরকার প্রাথমিকভাবে অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখলেও পরে তারা আর বাংলাদেশে ফেরত আসতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ভারত তাদের বিরাট একটা অংশকে পূনর্বাসন করে।
গুজব ৫: নারায়নগঞ্জে হিন্দু নির্যাতন
স্থানঃ নারায়নগঞ্জ শহর, ১৯৬৪
ঘটনাঃ ১৩ জানুয়ারি খুলনা দাঙ্গা চলাকালীন আদমজী জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার করিম মিল দু’দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে এই বলে যে, কোলকাতায় তার ভাইকে হিন্দুরা হত্যা করেছে। ঐ দিন রাতে আদমজি জুটমিলের শ্রমিকরা কাছেই অবস্থিত ঢাকেশ্বরী কটন মিলস-২ এর হিন্দু শ্রমিকদের আবাসে আক্রমন করে। ১৪ জানুয়ারি ভোর ৫টায় আদমজি জুটমিলের ২০,০০০ মতো শ্রমিক ঢাকেশ্বরী কটন মিলস-২ আক্রমন করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। লক্ষ্মীনারায়ন কটন মিলে আশ্রয় নেয়া শ্রমিকদের আক্রমন করে কয়েকজনকে হত্যাও করে। এরপরে ঢাকেশ্বরী কটন মিলস ও লক্ষ্মীনারায়ন কটন মিলের প্রায় ২৫০০০ হিন্দু শ্রমিককে চার দিন লক্ষ্মীনারায়ন কটন মিলের মধ্যে কোন প্রকার খাবার ছাড়া আটকে রাখে। এই আক্রমনের ছবি তুলতে গিয়েছিলেন নটরডেম কলেজের অধ্যাপক রিচার্ড নোভাক; তাকে ছুড়ি মেরে হত্যা করা হয়।
ফলাফলঃ নারায়নগঞ্জের পানাম নগরীর হিন্দুরা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালায়।
গুজব: ৬ বাবরি মসজিদ ভাঙার গুজব ও বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন
স্থানঃ ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বহু জেলা, ১৯৮৮
ঘটনাঃ যদিও বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রকৃত ঘটনাটি ঘটে ১৯৯০ সালে, ২৯ অক্টোবর ১৯৮৮ তারিখে জামাতি পত্রিকা ইনকিলাব পত্রিকায় গুজব-সংবাদ ছাপানো হয় যে, ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঢাকাতে ঐদিনই কয়েকটি মন্দিরে হামলা করা হয়। পরবর্তী দু’দিন ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কমপক্ষে বারোটি জেলায় হিন্দুদের নির্যাতন করা হয়। এছাড়া হিন্দুদের মারধর, বাড়িঘর ও মন্দিরে লুটপাট ও আগুন দেয়া চলে দেদারছে।
গুজব: ৭ রামু বৌদ্ধ বিহার
স্থানঃ রামু, উখিয়া, কক্সবাজার এবং পটিয়া চট্টগ্রাম, ২০১২
ঘটনাঃ ২৯ সেপ্টেম্বর কোন এক ফেক আইডি থেকে উত্তম কুমার বড়ুয়ার ওয়ালে নবী মোহাম্মদের কথিত অবমাননামূলক একটি পোস্ট দেয়া হয়। এরপরে এটি ওখানকার মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। সন্ধ্যা থেকে তারা বৌদ্ধ পল্লীতে জড়ো হতে থাকে এবং মিছিল দিতে থাকে। রাত দশটার দিকে কয়েক হাজার মুসলিম রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ও বৌদ্ধ বিহারে আক্রমন করে। ৩০ সেপ্টেম্বর ভোর পর্যন্ত এই আক্রমন চলতে থাকে এবং তা রামু থেকে উখিয়া ও পটিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ে। তারা মোট ২০টি বৌদ্ধ বিহার, ২টি বৌদ্ধ মন্দির, ২টি হিন্দু মন্দির এবং বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর বাড়ি ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বৌদ্ধ ও হিন্দুদের নির্যাতনের এই ঘটনাটিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, রোহিঙ্গা সবাই অংশগ্রহণ করে।
গুজব: ৮ দেলু রাজাকারের চান্দে গমন ও হিন্দু নির্যাতন
স্থানঃ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সাতকানিয়া এবং নোয়াখালী ও সাতক্ষীরা জেলা, ২০১৫
যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইবুনাল ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির রায় দিলে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাণ্ডব, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। ৩ মার্চ রাতে বাঁশেরকেল্লা ফেসবুক পেইজে একটি চাঁদের গায়ে সাঈদীর ছবি ভেসে উঠেছে এমন একটি ফটোশপড ছবি প্রকাশ করা হয়। মুহূর্তে ছবিটি মোবাইলে মোবাইলে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ দিন ভোর রাতে দেশের বিভিন্ন এলাকার জামাত নিয়ন্ত্রিত মসজিদে মাইকে প্রচার করা হয় যে, সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো, কুসংস্কাচ্ছন্ন ও প্রযুক্তি-জ্ঞানহীন বাঙালি মুসলমানরা জামাত-অজামাত নির্বিশেষে সাঈদীর চাঁদে দেখা যাওয়াকে বিশ্বাস করেছিলো এবং জামাত অনিয়ন্ত্রিত মসজিদেও এ ধরণের ঘোষণা হয়েছে। বগুড়াতে মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ জড়ো করে শহরের থানাসহ বহু প্রশাসনিক ভবনে তারা হামলা চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। ঐদিন পুলিশসহ অনেক মানুষ নিহত হয়। তবে এই গুজবের জেড়ে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সাতক্ষীরাসহ দেশের অনেক জেলায় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দুদের বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
rrr
এরকম হাজারো গুজব ছড়িয়ে বাঙালি মুসলমানেরা বাংলাদেশী হিন্দু ও পাহাড়ি আদিবাসীদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে আসছে। সে-সব লিপিবদ্ধ করতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। কী লাভ আর তা লিখে! উদ্দেশ্য তো তাদের একটাই – দেশকে শতভাগ মুসলমানের দেশে রূপান্তরিত করা। খুঁজলে হয় তো দেখা যাবে, নোয়াখালীতে যাদের পূর্ব পুরুষদের জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিলো, তাদের সন্তান-সন্তুতিরাই আজ এদেশী হিন্দু-বৌদ্ধ-আদিবাসীদের তাড়াতে হত্যা, ধর্ষন, লুটপাটে নিয়োজিত। এদেশী হিন্দু-আদিবাসীরা আজ নিজ দেশে দেশহীন, নিজ ভূমে ভূমিহীন।

Leave a Comment