খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটোগল্পঃ নেই জমির জমিদার

লিখেছেনঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল

দীপাঞ্জনা মণ্ডল

আজকাল ঠিক ঠাওর হয় না। কেন সিগারেট ধরায়? খেতে ভালো লাগে? না। খেয়ে ভালো লাগে? উঁহু, তাও নয়। তবে! অথচ ধরায়, ইচ্ছে হয়। তবে কি ভালো লাগে রূপোলী লাইটার যে নীল শিখা ফোটায়! এক সুন্দর ফুল। অমোঘ। ধরিয়ে নেয়। কোনও লেখায় কারোর সিগারেট ধরানোর কথা পড়লে ইচ্ছেটা চাগাড় দেয়। ঠোঁটে চেপে দু-একটা ঝাপসা শব্দ বলা ওর জন্য উদ্দীপক। ঠিক যতোটা রঙচটা জিনসের ওপরের নি-ইস্তিরি পাঞ্জাবি।

একটা আবছায়া জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে ওর মাটির সঙ্গে সমান্তরাল চলা ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছিল। উল্লম্ব হয়ে বাড়ছিল সেই গতাগতি। খুব দ্রুত মাথা উঁচিয়ে ও আলো চাইছিল। আশপাশ থেকে গজিয়ে ওঠা ঘাস-লতা-গুল্ম চেপে ধরছিল। মাটি কামড়ে হু হু করে বেড়ে উঠছিল ও। মা আর বাবার আড়াল এখন ওর দমবন্ধ করে দিচ্ছে। বাবার হাত মাথার উপরে। মা ধরে আছে কাঁধ। এখন ওকে আরও বেশি আলো না পেতে দিলে এই মাটি আর দখলে থাকবে না, যে জন্য এতদিন ওকে আগলেছে দুজনে। সূর্যের ছটায় চোখ পুড়ে যাচ্ছে, তবুও ওই আলোকেই একান্তে চায় ও। ঘাম জমছে বিজবিজে। মায়ের গন্ধ ভালো, বাবার গল্প। তবুও ও বড় হয়ে নিচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে আপাত নিরীহ শাখা প্রশাখার হাতাহাতি, ল্যাং দেওয়া শিকড়ের। পা জড়িয়ে আসছে, হাত ভার বড্ড। একটু জল। একটু বাতাস। ছায়া? ছায়া ছিল। মা আর বাবাকে দেখা যাচ্ছে না। নেই। বৃষ্টি নামলে বেঁচে যাবে। মাথা আর কাঁধ হালকা। ছায়ার স্মৃতি ভালো। হঠাৎ ব্যাঙের ডাক ওঠে কোথাও, বৃষ্টি আসছে তবে। আওয়াজটা যান্ত্রিক।

সকালে মানে ওই ন’টার আশপাশে ঘুম ভাঙল ফোন বাজতে থাকায়। আজ তো কোনও ডেলিভারি আসার কথা নয়। তবে! বালিশের পাশ থেকে কানের কাছে ফোন পৌঁছে যেতে শুনল,
শুনেছ খবর?
— না, কী?
— তোমাদের পাড়ার, শোনোনি?
—উঁহু, কী?

সামান্য বিরক্ত হল। ঘুম নিজে থেকে না ভেঙে এইসব উপদ্রব ঘটলে বিরক্তই হয়। একটা ছায়াছবির চরিত্রের মতো ছিল এতক্ষণ। অবচেতনের অভিক্ষেপণ দেখছিল। তার মধ্যেই ফোনের আওয়াজ, স্বপ্নে যেটাকে বৃষ্টির ঘোষক মনে হয়েছিল। ফোন সাইলেন্ট করে না, যদি তেমন প্রয়োজন পড়ে কারোর ওকে। যদিও এক সকালে বেসরকারি চিকিৎসালয় থেকে গর্ভধারিণীর কমা থেকে পূর্ণযতিতে পৌছনো-স্তরের খবর ফোনে আসার মতো প্রয়োজন জীবনে একবার হয়। আর অন্তত এখন স্পষ্ট, তেমন দরকারে লাগার মতো সে নয়ও, মানে জল, নুন বা বাতাসের মতো অপরিহার্য। তার ব্যবহারিকতা বলতে দুপুর রাতে জাতে মাতালদের আক্ষেপোক্তির নির্বিবাদী শ্রোতা হওয়া আর দিনের বেলা তালে ঠিকদের অফেরৎযোগ্য অর্থসাহায্যের আবেদন শোনা। তবুও ফোনটা নিঃশব্দ করতে পারে না। ততোটা নির্মম নিজের সুখের খাতিরে হতে পারেনা বলে অথবা ভাবমূর্তিকে সুখের থেকেও বেশি বলে মানে বলে। দ্বিতীয়টাই খুব সম্ভব।

ঝেড়ে কাশছে না কেন? মনে মনে ভেবে ক্লান্ত হতে হচ্ছে। আরও জোরাজুরি করে জেনে নেওয়ার পরবর্তী পদক্ষেপগুলোর কথা ভেবেই। চুপ করে রইল। কথা শেষ হলে আরেকটু গড়াগড়ি দেবে।
— সামন্ত মারা গেছে তো!

ছলাত করে উঠল ভেতরে, ঠিক শুনল? বিশ্বাস হতে চায় না। হৃদপিণ্ড বেজায় ইতিউতি শুরু করেছে। সামলে বলল,
— দুর, ভুল হবে। রটে অমন আজেবাজে।

ওদের ছোট শহরের একমাত্র কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ওর ছোটবেলায় প্রত্যেক বড় ছুটির মাঝামাঝি মারা যেতেন, আর কলেজ খোলার দিন তার ভূতটি নিয়মিত যানবাহন বাহিত হয়ে কলেজের পেটে সেঁধিয়ে যেতেন। মনে পড়ল।
— না গো, সকালেই ফট করে মরে গেছে।আগে নিশ্চিত হও, জানিও তারপর।
—কিছু বুঝতে পারছ না?’
—নাহ্‌, সব তো অন্যদিনের মতোই, অন্য কোনও আভাস তো পাচ্ছি না।
—দাঁড়াও, দেখছি।

পাশ ফিরল বিছানায়, পাশ বালিশসহ। ফোনে কোনও মেসেজ নেই কোথাও।
ফোন বাজল।
— খবরটা ঠিক।হুম, কী হয়েছিল।
—করোনা। তবে বলছে স্ট্রোক।
—এ বাবা, এরা তো সচেতন ডিগ্রিধারী। দুর মাধ্যমিক ফেল, উচ্চ মাধ্যমিক ব্যাক।
—তুমি জানো? এ তো বিগত জন্ম।  

মনে মনে ভাবল এখন তো প্রথাগত শিক্ষায় আইনস্টাইন আর রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ শুনলেও ঘ্যাঁক করে কামড়াতে আসত, ইঙ্গিতের লক্ষ্য নিজেকে ধরে নিয়ে। পরীক্ষার পাশফেলের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক কমই সেটাও বিশ্বাসের জোর নেই, অদ্ভুত।
—কিন্তু করোনা লুকোনোর মতো বাড়াবাড়িটা করে ফেলতে পারে ভাবিনি।
পারল।
— আশ্চর্য, এপ্রিলের শুরুতে তো প্রচুর সচেতনতামূলক প্রচার চালাল। নাম বেরল কাগজে।
— কাগজে কী বেরোয় জানো না?
— আচ্ছা, রাখো। নটা পঁয়ত্রিশ, উঠতে হবে।
মনে মনে ভাবছিল, মৃত্যুতে দুঃখ না অনুভব করা অমানবিক? শোক ঠিক কতটা মহৎ?

… … …

চা চাপল। দুধ চা ঘন করে ফোটানো। বিস্কুট। পোষ্যদের খ্যাঁটনের বন্দোবস্ত।
— হ্যালো, শুনলি?
— হুম
—  উফস্‌, একটা আপদ গেছে।
— আরে!
— ঘুরে এলাম আমি।
— হুম
— ব্যাচমেট তো
— হুম। ইয়ে মানে স্যানিটাইজেসন?এই বাড়ি ঢুকি, সোজা বাথরুম।
—এখন অভ্যেস হয়ে গেছে।
—সেরে নাও। কাকিমার বয়স হয়েছে, সাবধানে রেখো
—হ্যাঁ, ছাড়ছি

জনসমাগম। ভ্রান্ত মানবক মুখোশ, মৃতের সামনে নতজানু হওয়াকে প্রশ্নাতীত মানে, সেই ভিড় বলছে ইন্দ্রপতন। মুখের রেখা অবিচল, মাথার ভিতরে হাসির হুল্লাট। ইন্দ্রের সামগ্রিক ভাবমূর্তি মনে ভাসছে। স্বার্থপর, ক্ষমতালিপ্সু, অন্যের মেরুদণ্ডে ভর করে টিকে থাকা এক অনুসরণযোগ্য জীবদ্‌দশা। মানুষ কি আসলে যেরকম বলার কথা তা না বুঝেই উচ্চারণ করে?  

ফোনটা লাভার মতো, গড়িয়ে পড়তে থাকে হাত থেকে টেবিলের কানা বেয়ে। দুয়েকটা সতত সঞ্চরণশীল বিড়াল শুঁকে দেখে। নাকে ছ্যাঁকা খায়। চোখের সামনে তারপরই সেটা একটা এনজিও হয়ে উঠতে থাকে, লাফ মেরে পাঁচিলে ওঠে, পাশের বাড়ির হাওয়া বুঝতে যায়। গলতে থাকা ফোনটার যেটুকু সম্ভব দ্রুত কাঁচিয়ে ভরে দেয় ডিপ ফ্রিজে। গলতে থাকা স্থগিত হয়।

— দিদি খোলেইইইন
— যাইইই। আজও দশটা পার করে দিলে! এত দেরি করলে হয় বলো রোজ?
— এত ভিড় কেন দিদি? কী হয়েছে?
— তাড়াতাড়ি সামনেটা ধুয়ে ওদের বাসনগুলো মেজে দাও। খেতে দিতে হবে।
— এই পাড়াতেই কিছু হয়েছে, কত লোকের ভিড়। জানেন না দিদি?
— তোমার চা কখন করব বলে দিও।

… … …

যোগাযোগ জমে যাচ্ছে। ডিপ ফ্রিজে শীতল হচ্ছে। সাঙ্ঘাতিক উষ্ণায়নের এই বর্তমানে কিছু শীতলতা কাম্য।

বাবা নিথর শুয়ে। মাথার পাশে সুগন্ধি পুড়ছে। একা একা ঘণ্টা ছয়ের রেলপথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বাবার বুকে মাথা রাখল। আর তো হবে না কখনও। কাঁদতে কাঁদতে ওর হেঁচকি উঠত, বাবা কোলে করে পিঠে চাপড় দিয়ে শান্ত করতে পারতেন। গত রাতে ফোন ধরেছিল বাবা, এক কথা একাধিকবার বলাচ্ছিল বলে বিরক্ত হয়েছিল, কানে কম শুনত শেষদিকে, ভুল শুনে যা হোক কিছু ধরে নিয়ে কথা চালাতে চাইত। কথা বলতে চাইত বাবা। এক কথা বলত বারবার। যতবার ট্রেনে চেপেছে একসঙ্গে, গোটা পথ এর পরে কোন স্টেশন বলতে বলতে গেছে। বাবার কথা শুনতে শুনতে মনে হত বাবা যেন শ্রুতির আমলের। বারবার আউরে মনে রাখাতে চাইত সব।

 বাবা মারা যাবার পর একেবারে একা এসেছিল আড়াইশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে, ঘণ্টা ছয় পরে। মনে পড়ল, কাজ গুছিয়ে এসেছিল। স্পেশাল পেপারের জন্য পছন্দের ক্রমসহ আবেদনপত্র জমা রেখেছিল মেসের বন্ধুর কাছে। কারণ জানত দিন পনের তো ফিরবে নাই, এর মধ্যে স্পেশাল পেপার পছন্দের তালিকা চেয়ে নোটিশ পড়লে বন্ধু পৌঁছে দেবে তার বিভাগে। শোক কর্তব্যকর্ম ভোলাবেই এমনটা একমাত্র সম্ভব নয়। ট্রেনে চোখে জল নামছিল অঝোরে, আশ্চর্য শূন্যতা। মান ভাঙানোর মানুষটি আর নেই। যথেচ্ছ আঁচড়ানোর কামড়ানোর হতাশা উগড়ে দেবার জায়গায় স্থায়ী কৃষ্ণগহ্বর।

 কাল রাতেই বাবা জানতে চেয়েছিল,
— কবে আসবে তুমি মা?
—  মাস খানেক পরে, মহালয়ার আগে।
—সে তো অনেএএএক দেরি। আগে আসবেই না!

বাবা আর কখনও বাড়ি আসতে বলবে না। সবার সামনে কেঁদে ফেলাটা চাইছিল না। উল্টোদিকের মহিলা বারবার দেখছেন। অথচ জল ঝরছেই। মিক্সচার। গন্ধ পেল। পেটে খিদে। নিল দশ টাকার। কান্নায় গা গোলাচ্ছে বেশি।

বাড়ি ঢুকে দেখল বাবার সেই উষ্ণ আগ্রহ নেই। ঠাণ্ডা সব। বাবার গালে গাল ঠেকাল। হাত রাখল কপালে মাথায়। এত লোক কেন। শুনল কিছু অবাঞ্ছিত রক্তের সম্পর্ক আসবে। কেন, কে বলেছিল জানাতে? জানাল কে? মাথায় আগুন ছুটল। শিরীষ কাগজের মতো সেইসব উপস্থিতি। বাবার নাকে একটা টোকা দিয়ে ঘরে গেল, কাগজপত্র ছড়ানো, আলমারিতে চাবি ঝুলছে। দ্রুত দরকারি কাগজ ভরে চাবি বন্ধ করল, রাখল গোপন জায়গায়। বাইরে বাবা। কে যেন বলছে শরবত খেতে। স্কুল থেকে ফিরলে বাবা শরবতের গেলাস ধরত। গলায় আটকাচ্ছে শরবত। বাইরে কুৎসিত প্রচলিত ঢঙে কান্না শোনা গেল। এসেছে, দেখনদারির পরাকাষ্ঠারা। সুযোগ পেলেই বাড়ির যা পছন্দ হবে চুরি করে হোক বা ঘ্যানঘ্যান করে, হাতিয়ে নেবে। সেই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে যাতে না পড়তে হয়, বাবার স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা যায় তাই ইতিকর্তব্য।

… … …

কাল চুরি করে মাছ খেয়েছিল মার্জারিনী, আজ আবার কিছুটা কাঁচা মাছ সেদ্ধ করতে হবে ওদের জন্য। ওদের এই ঘ্যানঘেনে চুরিতে তেমন গনগনে রাগ হয় না। ভালোবাসে বলে? ভালবাসা কি খায় না গায়ে মাখে? বোধহয় দুটোই।

সেই যাকে বলে মড়াকান্না তাই লহরী তুলছে এখন কানে, মৃদু স্পষ্ট। সেদিনেরটা জোরে বেজেছিল, যেন গলার জোর দেখানোর প্রতিযোগিতা। ভালো লাগেনি সেদিন একেবারেই, আজও লাগে না। তবু মহৎ শোকের নামে মেনে নেওয়ার দক্ষতা কিছুটা বেড়েছে।  ভেতরটা শান্ত অনেকটা।

ফ্রিজ খুলে মাছ বের করে। ফোনটাও। জমেছে। অন করল। এনজিও তৈরির প্রক্রিয়ায় কিছু নাম্বার উড়ে গেছে। সব গুলো দেখল না। দরকার না পড়া অব্দি হারিয়ে যাওয়া নাম্বার নিয়ে কোনও অভাববোধ তৈরি হওয়া অসম্ভব। আগে হত। ল্যাপটপ বা ফোনের ফরম্যাটের সময়ে তখন ওয়ান ড্রাইভ বা ড্রপবক্সের প্রতিস্থাপন ছিল না। মৃত্যুসম হারানোর শোক সামলাতে সামলাতে স্থিত হয় এই ভেবে যে ওই সব জমানো ছবি আর গান কতদিন ছোঁয়নি। আজ নিশ্চিতভাবে নেই বলেই হুতাশ। বুঝতে পেরে কেমন শান্তি মিলেছিল। ফলে কিছু যোগাযোগ নেই হল ব্যাপারটা ততোটা আক্ষেপের নয়। যারা আছে যোগাযোগে বা থাকতে চায় পারস্পরিক তারা থাকবে।

—শুনছ?
—বল
—আমার সঙ্গেই এমন হয় জানো
—আবার কী
—তুমি বিরক্ত হবে
—আরে বল্‌
—চিঠিটা আজও পাইনি
—পাবি, এখন তো পরিবহণ ব্যবস্থা কোমর ভাঙা
—আরও তো অনেকে পেয়েছে, শুধু আমি
—সময় বেশি লাগছে একটু, অপেক্ষা কর, ঠিক পাবি। আমি রান্না সারি রে
—হ্যাঁ, মা আজ বিরিয়ানি করছে, তাই মন কেমন একটু কম

সামাজিক মাধ্যমে হুল্লাট। মৃত্যুর পক্ষে বিপক্ষে। শোকের পক্ষে বিপক্ষে। স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষে বিপক্ষে। মৃত্যুতে প্ররোচনার পক্ষে বিপক্ষে। যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। ধুম মাচিয়ে রবিবারে খাসির মাংস খেয়ে ঢেকুর তুলে পিএনপিসি। শনিবার রাতে পরিমিত চাট অবৈধযাপনের আর রঙিন জীবনকল্পনা কাচের গেলাসে।

… … …

— হ্যাঁ দিদি জানেন, ওই যে পেছনের বাড়িটা, ওর মোটা লোকটা মরেছে।
— চা নাও গ্যাসের পাশে রাখা আছে। বিস্কুট খাবে না মুড়ি?
— বিস্কুট। হ্যাঁ দিদি, কি হয়েছিল করোনা?
— হুম। বলছে হার্ট ফেইল।
— এত লোক আসছে কেন দিদি!
— চা খেয়ে ওদের থালা ক’টা ধুয়ে দাও।

ফোনটা হাতে নিল। জমজমাট বানান বিতর্ক। কী খিল্লি! পাশে নামিয়ে রাখল। আজ খিচুড়ি হোক। রংধনু। গাজর, বিন্‌স, ফুলকপি, টম্যাটো, কাঁচালংকা, মুসুরি ডাল, মুগ ডাল, গোবিন্দভোগ চাল। সঙ্গে বেগুন ভাজা, ডিমের অমলেট আর আমের চাটনি। অল্প বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ শুরু হয়েছে। কয়েকটা মেসেজ বৃষ্টিতে ভিজল, কয়েকটা ফোনালাপ মুখ চিতিয়ে দু’হাত মেলল উঠোনে। বৃষ্টির জোর বাড়ছে।

সেদিন গঙ্গার পাড়ে এক তুমুল বৃষ্টি। এলোমেলো বাতাস। সবাই ভিজে চুপ্পুস। কুচো বরফ ছিটকোচ্ছে যথেচ্ছ। শীতে কাঁপছে হি হি করে। কেন অসময়ে এমন বৃষ্টি যে নামল, বৃষ্টি না নামলে সবার দৃষ্টির সামনে কাঁদতে পারত না বলে! এখনও অনেক কাজ। মাস দেড়েকের অস্থায়ী বসবাস গুটিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। ক্লান্তি, অতৃপ্তি, ব্যর্থতা সব হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আসলে দেড়মাস আগেই শেষ হয়ে গেছিল সব। পরের সময়টুকু আত্মতুষ্টি। দৌড়ঝাঁপ। দিনরাত এক করে ফেলা, জলের মতো সঞ্চয় খোয়ানো। কী অদ্ভুত সেই দেড়মাস। এক নিকষ নৈরাশ্যের সুবহশাম। কতশত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ক্রিয়া। জীবনযাপন, জীবিকারক্ষা, কতিপয় দাসখত। কাটাছেড়া হল। অশ্লীল। কবিতার বই লিখিয়ে বললেন,
—গলাটা কেঁপে গেল কেন! যেন অবদমিত কান্না? কানে লাগল।

একটা কিডনি বেরিয়ে যাচ্ছে ওই এক সময়ে, মায়ের শরীর থেকে। অসাড় শরীর। কিন্তু গলা কাঁপবে কেন। সমানুভূতি কি গোমুত্র নাকি যে চাইলেই পাওয়া যায়! আবেগের কারবারিরা বলে থাকবেন, দ্য শো মাস্ট গো অন। শেষত সেই আত্মতুষ্টি, সাংঘাতিক স্মরণীয় গল্পের নায়কত্বপ্রাপ্তি। অনুসরণকারীদের মুগ্ধ করতে লো ভয়েসে,
—বাবাকে দাহ করে সেদিনই রওনা দিয়েছি বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে।

মহত্ত্বের নির্মাণ করে যেতে হয়। পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য শুধু নয়, দেশকালাতীত ফসিল হবার আত্যন্তিকতায়। অথচ ক্কী ক্কাণ্ড! মঞ্চে উঠে গলা কেঁপে গেল শুরুতে। অক্ষমণীয়। অবশ্য তুলনাত্মকভাবে কোনও না কোনও ভাবে উচ্চতর অবস্থানে থাকারা ব্যক্তিগত আবেগ বিসর্জনের নিদান দিয়েই নিজেদের বিয়োগ ব্যথায় সমবেত নীরবতা পালনের আয়োজন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। যাক গে যাক। তারা তো উচ্চতর। তাদের প্ররোচনায়, সক্রিয় অংশগ্রহণে বিদ্যাসাগরের দামোদর সাঁতরানোর গল্প খাবে এমন সামাজিকদের লালন করতে হয়। অথচ এই গলা কাঁপানো আবেগের থেকে আর কোনও গভীর আবেগ ধারণের পরিসর নেই বলে পরিচিত প্রতিবেশে বীতস্পৃহ ঈশ্বরচন্দ্রের কথা তেমন কলকে পায় না।

… … …

বেঁচে থাকার সময়ে খিটিমিটির অন্ত ছিল না। দেরি করে স্নান চলবে না, মেঘ জমলে ছাতে যাওয়া নয় – একজন এরকম প্রতিরক্ষামূলক। অন্যজন ঘরের কোনও কিছুতেই কোনও স্বাধিকার ছাড়তে অপারগ। একজন ভেতরটুকুর গণ্ডি দিতেন, অন্যে বাইরের। ক্রমাগত ঘর্ষণ, নুনছাল ওঠা। কতবার মুক্তি চেয়েছে। ভাতের মধ্যে মিশিয়েছে চোখের জল আর বৃষ্টির জল রয়েছে স্পর্শের দূরত্বে। তারা উচ্চতর অবস্থান থেকে নিদান দিয়েছেন মরে না কেন! বা না পোষালে কাজ ছেড়ে দাও অথবা যেমনটা নির্দেশ সেরকম করতে তুমি বাধ্য। চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম ভূখণ্ডে গণপরিবহণ স্তব্ধ। উচ্চতর অবস্থান চেয়েছে। পরিযায়ী পাখি মরত, এখন মানুষ। কেউ কেউ কাঁদল। কেউ কাঁদতেও ভুলে গেল। কেউ কেউ মেনে নিল এভাবে না মরলে অন্য কোনওভাবে মরত। ওরা মরে যায়। মরার জন্য জীবন পায়।            

 এই সব স্বীকার না করে কোথায় যাবে! অথচ এখন এমন। বড্ড পরাণ পোড়ে। ভোর কুয়াশা শিউলি ঝরায় কিংবা বৃষ্টি রাতে বকুল। মৃত্যুকে মর্যাদা দিতে চাওয়া আসলে প্রত্যেকের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে টেক্কা দেবার অক্ষম প্রয়াস। আসলেই সব ফুরিয়ে যায়, এ কথা জীবনে মেনে নিয়ে স্বীকার করে বর্তমানের সমগ্রে বাঁচা আমাদের শিখতে দেওয়া হয় না। সুতরাং মৃত্যুর পরেও কাজ থাকে এমন অলীক প্রকল্পের সৃষ্টি আর তার সপক্ষে যুক্তিবিস্তার। মৌখিক আর স্মৃতিনির্ভর অভিজ্ঞতা তথা জ্ঞানভাণ্ডার এই প্রকল্পেই হয়ে উঠেছে পুঁজি। শুধু অর্থকেই পুঁজি হিসেবে চিহ্নিত করা নিরর্থক অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

মৃত্যু সম্পর্ককে মহৎ করে রাখে। মানুষ না মরলে সমস্ত আন্তঃসম্পর্ক মরে মরে যায়। রং বদলায়। এত বদলায় যে শুরুয়াত বিস্মৃত হয় সম্পর্কের। আদর্শ মরে, বামপন্থা খোলস ছেড়ে মনুবাদের আলখাল্লা পরে। কেউ কেউ আলখাল্লার ওপর বেঢপ খোলস চাপায়। তখন হয় খোলস নয় আলখাল্লা একটা অন্তত মরে যাক। আকুতি হয়। ভণ্ডামি দেখলেই তার মৃত্যুকামনা জাগরিত হয়। গিরগিটির বামনুবাদ সংস্করণ ছাপা হয়।
মনে পড়ে, স্কুলবেলায় প্রায় ঘটত, সকালে
— বড় হয়েছ যথেষ্ট আর ছোটটি নেই, বায়না করবে না অযথা।

ছলছল চোখে সরে যেত। বিকেলে চা নিয়ে গুছিয়ে বসেছে সবাই। সেও গুটিগুটি সেঁটে যেত।
— এইটুকু বাচ্চা এখানে কী বড়দের মাঝে!

এখনও হয়, কাজের জায়গায়। অধীনস্থদের কিছু ক্ষোভ থাকলে শুনতে হয়,
— তুমি সামলাও, তুমি ওদের বড়, ওদের বোঝানোই তোমার কাজ।

মালিকপক্ষকে অসুবিধে জানালে, ওই একই বস উবাচ,
— মেনে নাও, সংযত থাকতে শেখো। জুনিওর জুনিওরের মতো থাকো।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই সামন্তবাদী ব্যবহারের খোরাক হতে হতে আজকাল মনে মনে খিস্তি করে। আত্মমোক্ষণ। যারা এই দ্বিচারিতা দিয়ে ক্ষমতার ধ্বজা ধরে রাখেন তারা আবার স্বঘোষিত সাম্যবাদী কেউ কেউ। অবচেতনে মৃত্যু চায়। আওতা ছেড়ে বেরতে চায়। মাথা তুলে সরাসরি ঝড় বুঝতে চায়, বৃষ্টি নিতে চায় আর চায় আকাশ ও মাটির দখল। নিজের মতো।

ফলত সামন্তের মৃত্যু তাকে পোশাকি শোকের বদলে হাঁফ ফেলে বাঁচার তৃপ্তি দেয়। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি বলেই জীবিতরা তাকে পোশাকি মহত্ব দেয়। মরণশীল জীবন জানে একদিন তার জীবনের অধিকার যাবেই, উত্তরাধিকার সূত্রে মৃতের প্রতি আচরণের অভ্যাস তার নিজের টিকে থাকার চিন্তার সপক্ষে স্বস্তির। একটি গলিত স্থবির ব্যাঙের থেকে অধিক কোনও তাৎপর্য তার নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ক্ষমতার কেন্দ্রে, যে কোনও ভাবেই হোক না কেন।

… … …

—দিদি, পাথর পড়ছে।

—বেশ বড়

শিলাবৃষ্টি। ছোটবেলার সঙ্গে যোগসূত্র। সবাই শিল কুড়োতে ছুটত উঠোনে বা খোলা মাঠে। অকারণ উল্লাস। একটা শিল ছিটকে বারান্দায় ঢুকল। কোমর থেকে নিচের দিকটা ধোঁয়া ধোঁয়া। নেড়া মাথায় পণ্ডিতের টিকি। জ্বিন। আদাব করে দাঁড়াল।

আপনার হারিয়ে যাওয়া সমস্ত কন্ট্যাক্টসদের ফেরাতে আমরা এনেছি বিশেষ পরিষেবা। আপনার মাথার সামান্য ধূসর কোষের বিনিময়ে আপনি পেতে পারেন আপনার হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কদের।

ফোনটা দ্রুত হাতে নিয়ে ফ্ল্যাশ ঝলকালো। জ্বিনটা গলে জল হয়ে গেছে। আহাম্মক। আজকাল কেবল ধূসর কোষের বিনিময়ের অফার আসে। অধিকাংশ কোনও না কোনও গুরুর চরণে দীক্ষিত তারা সেখানেই সমর্পণ করে ধূসর কোষ। নানাম মতবাদ ও বাদীরা অজান্তে বিনিময়ে হারাচ্ছে তাদের মাথার ধূসরতা। গুরুর নামে সমর্পণে নিশ্চিত। তারা কেবলই সকালে বলছে আমরা মঙ্গলের অবস্থান নিয়েছি, এই একমাত্র সঠিক। দুপুরের রোদ বাড়লে যেই গুরুরা ছায়াশূন্য হয়ে যান তখন নির্দিষ্ট অবস্থানগুলোর অনিশ্চয়তা প্রকাশ পেতে শুরু করে। বেলা গড়ালে ছায়া বিপরীতে, অমনি মঙ্গল অবস্থান চলে যায় শনিতে। শনি তখন সমর্পিত মুণ্ডুদের ভিত্তি। মঙ্গল তখন এক অবাঞ্ছিত ভুল বলে সোচ্চারে ঘোষিত হয়।

কিছু হারিয়ে যাওয়া সে খুবই বাঞ্ছিত মনে করে, কিন্তু ধূসর কোষ সম্পর্কে সে অধিকারপ্রবণ। জ্বিন গলানোর পরে ফোনের ব্যাটারি লো। যেহেতু ফোন চার্জে, তার দুহাত কাজে লেগে পড়ে। স্পেশাল অফার সম্বন্ধে চিরকাল সে অন্ধভাবে সন্দিহান। অন্তত অফারের উদ্দেশ্যের প্রতি না বুঝে ব্যবহৃত হওয়ায় সে রাজি নয়। যে বেড়ালটা ফোনের কিছুটা চেটে খেয়ে এনজিও হয়ে বিদেশ ভ্রমণ সেরে এলো, জলে ভিজে ফিরে গা ঝেড়ে জ্বিন গলা জল শোঁকে। খুবই জিজ্ঞাসু হয়ে পড়ে আচানক অন্যরকম গন্ধে। দু থাবার মধ্যে ঘিরে রাখে জলটুকু, বসে পড়ে কাত হয়ে।

—দরজা খোলো
—আসছি
—ব্যস্ত?
—না, চা করি?
—করো। গোপন খবর আজ ওদের বাড়ির সবার করোনা টেস্ট হবার কথা। তার মধ্যে এই
—হুম

… … …

দুপুরের খাওয়া শেষ। ডুকরে ওঠার আওয়াজ আসে। কাঁদতে হয়। একজন না থাকা মানে তার নিয়ন্ত্রণের থেকে মুক্তি যেমন তেমনি তার ওপর নির্ভরতার শেষও। যারা রইল তাদের কাছে প্রথমটা কাঙ্ক্ষিত, দ্বিতীয়টায় অচেনার প্রতি সংশয়।

ঠিক জায়গায় ঠিক জিনিস নেই কেন আর ঠিক সময়ে ঠিক কাজ হয়নি কেনর কার্কশ্যে প্রায় বড় অনুভূতিহীন মনে হয় পারিবারিক যাপন। বড্ড হাঁফ ধরে। এত হাঁকপাঁক হয় বাতাসের জন্য আকাশের জন্য যে তারিণী মাঝির মতো সুখির গলা টিপে দিতে সাধ যায়। এদিকে গোটা গল্পে ত্রাণকারী তারিণী। কে বিশ্বাস করে কে স্বীকার করতে চায় কে মানে এই টানাপোড়েনের বুনট।

জানলার ফোকর দিয়ে এক চিলতে রোদ। বৃষ্টির পরের। তাতে একটা পরী ভাসছে। ঘরে রোদের সময়টুকু পরী আসে। দেখা যায় ডানা আর জাদুদণ্ড। এসবের সামনে অসহায় লাগে কেবল। একজোড়া ডানা নেই কেন! একটা জাদুদণ্ড নেই কেন! ফোনটা সকালের পর জ্বিন গলিয়ে থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। এখন কথা বলছে পরীটার সঙ্গে। পরীর হাসি আর ঠোঁট নড়া দেখা যাচ্ছে রোদে, ফোনটা কাঁপছে বালিশের পাশে। ওর শিকড় শক্ত করে ধরছে মাটি মাথা আশপাশ ছাড়িয়ে উঠে যাচ্ছে কেবল। বিদ্যুৎ চমকায়, বাজ পড়ার হাত থেকে ওকে বাঁচানোর কেউ থাকে না।

একটু বিশ্রাম নিতে গেলে আজকাল স্মৃতি ভর করে। শেষ একটা বছর মা কেমন দুমড়েমুচড়ে পড়ে যেত থেকে থেকে। উঠতে পারত না নিজে, টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে ধীরে ধীরে জোর পেত পায়ে। শ্লথ হেঁটে যেত। মনে হত গড়িয়ে যাচ্ছে একটা অ্যামিবা। অ্যামিবা, বিস্ময়প্রাণ। অমর। দুই ভাগে ভেঙে ভেঙে বেড়ে চলে অনন্তের পথে। মানুষও বংশরক্ষা করে। প্রবৃত্তির তাড়না। নিজেকে অমরত্বের দিকে এগিয়ে দেওয়া, কারণ তাকে তার শরীরী আয়তনে মরে যেতে হবেই। তার আগে অন্য আধারে নিজকে রক্ষিত করা। পুঁজিসহ। অর্থ, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সমস্ত অমর করে রাখার ক্ষীণ ও সর্বাত্মক আগ্রহ। জৈবিক না হলে শিষ্যপরম্পরা। ঘর বা ঘরানা।

এদিকে পরিসরে নতুনত্বে নিজস্ব হয়ে উঠতে হবে বলে আওতা ছেড়ে বেরতে হয়, কে আর কত নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। শশী গাওদিয়া ছেড়ে চলে যেতে চায়। তার পারা না পারা অন্য প্রসঙ্গ। আসলে প্রত্যেকে তার উৎসের হন্তারক মনে মনে, হন্তারক তার নিয়ন্ত্রকের। হন্তারক সমস্ত নিয়ন্ত্রণ প্রয়াসের।

 সন্ধের চা চাপল। ফিরছে শ্মশানযাত্রীরা। নিমপাতা আর আগুন। যার জন্য কান্না, প্রকারান্তরে তাকেই দূরে রাখার আচার। আবার কান্না। ক্লান্তি। ছেলেটা মায়ের পাশে শোয়। মাকে কাছে টানার আজ কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। উত্তরাধিকার চর্চার পথে আরও এগোলে, সঙ্গিনী এলে, মায়ের না থাকা তাকে ঘিরে হওয়া অন্য এক প্রতিযোগিতা থেকে তাকে মুক্তি দেবে। এবং তার মৃত্যু অবধারিত কিছু সংগোপন স্বস্তির নিঃশ্বাস নির্মাণ করবে, যা স্বীকারের জন্য অস্বস্তিকর। এই পথে বইবে জীবন। তথ্য সংরক্ষণ হবে, অভিজ্ঞতা দিয়ে গল্প হয়ে বাঁচতে চাইবে মানুষ। আরও গল্পের জন্ম দেবে। আসলে ফুরিয়ে যেতে হবে জেনে, প্রপঞ্চের মধ্যে খাপে খাপ অনায়াসে।

……….
পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment