খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটগল্পঃ অভিধান একটি মানেবই বই নয়

লিখেছেনঃ দীপাঞ্জনা মণ্ডল 

– কেয়ামতে ভগবান আমায় জিজ্ঞেস করলেন, টুমি অ্যাটো দিন খি করিয়াচ?

 চরকা বুড়ি বুড়বুড়ি কাটছিল।

 – মনে মনে খুব শর্মিন্দা হয়ে বললুম, সুতো কাটতুম। তকন সেই আলটপকা ভগবান আমায় কোলে বসিয়ে চুমু খেয়ে বললেন, টুমি ওটি পুণ্যের কাজ করিয়াচ। সুটা না টাকিলে লজ্জানিবাড়ণ হইবে কিসে!

চরকা বুড়ি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চোখে কাজল পরতে থাকে। সরু, মোটা, ধ্যাবড়া। এক ইঞ্চি জায়গায় বিবিধ সরগম। সুতো কাটা যতই পুণ্যের কাজ হোক, চোখের কাজল না দেখালে পাপের খাতে কী জানি কেন জমা বেশি হয়। চরকা বুড়ি হিসেবে কাঁচা। এদিকে দেরিদাবাবু বলেন সাম্য বস্তুতান্ত্রিক নয় আবেগের হবে। প্যাঁচাল।

কিন্তু আবেগ হোক বা গ্লোবাল ভিলেজ, আগুনে ভাজা অথবা সেদ্ধ হতে কে চায়। ফিনিক্সের বাইট কেউ নিতে পারেনি এ বিষয়ে পুরো গ্লোবে। কেবল আবেগ দিয়ে বালের মহত্ত্ব নির্মাণ করেছে। মহত্ত্ব বিষয়টাই অবশ্য নির্মাণ। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি থেকে বাবা রাম-রহিম পর্যন্ত। চরকা বুড়ি ঘাঘু মাল। এখন বাঁ হাতের মণিবন্ধে রক্তকরবী ক্যারি করে। আগে নীলাম্বরী ছিল। ব্যক্তিক বিষাদ থেকে সামাজিক বিপ্লব বেশি টেঁকসই বুঝতে যে কটি শয্যাসঙ্গী বদলাতে হয় তার পরে ছম্মকছল্লো।

বিষয়টা যেহেতু এক্কেবারে একটি গাঁয়ে কেন্দ্রীভূত; স্বাদবদল খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মধ্যেই। আজ এ পাড়ার পটোর কাছে লক্ষ্মীর পা আঁকিয়ে নেওয়া, কাল তারই এক গেলাসের বন্ধু চাষির কাছে এক ছড়া ধানের ধর্না দেওয়া, তাপ্পরে এদের সবার মুরুব্বি কাম দোস্ত বামুন মশায়ের দক্ষিণার বন্দোবস্ত। এক্কেবারে পরস্পর ঘটে গেছে। দক্ষ সব ফিল্ডার ও তাদের বোঝাপড়া। চরকা বুড়ি কেবল পাঁচালী পড়তে চেয়েছিল। এখন সে পাঁচালী পথের ছিল নাকি লক্ষ্মীর তা নিজেই গুলিয়ে ফেলেছে।

এক্কেরে ন্যাংটোবেলানে তার খুব হুজুগ ছিল। কোথাও রামায়ণ গান হচ্ছে শুনলেই দ্দে দৌড়। হরেক রংবেরঙের চিত্তির আঁকা পট, তাতে মানুষ, পাখি, পশু, গাছপালা, নরপশু অব্দি। ফলে তুতো কাকা তার বুকে থাবা দিতে তাকে অবতার টাইপ কিম্ভূত ভাবতে বুড়ির অসুবিধে হয়নি। পটোর ছবিতে হাঁটুর উপরে ফেলে পেট চিরে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এমনই একটা দৃশ্য মনে পড়েছিল এবং নিজের বুকের ওপরে ন্যায়প্রতিষ্ঠা বলতে কী ওর মোট্টে পছন্দ হয়নি। কিন্তু ওই যে সবাই ওই উদরবিদারণ না কী ব্যাপারটাকে ‘দেখ কেমন লাগে’-র তৃপ্তি নিয়ে দেখত ফলে ও সেই চাষির গোঁত্তা না খাওয়া পর্যন্ত ইডা বেমালুম চেপে গেছিল। কেবল পটোর চারপাশে ভিড় হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তেমন সময়ে টুক করে গিয়ে আলের ধারে বসত।

‘কিন্তু জানিস লাতিন, ওই যে পুজোর সব ব্যাপার ফুল তোলা, আসন পাতা, চন্দন, ধুনো, ধোঁয়া আমায় বেবাক ঘোর লাগিয়েছিল। আর ঢাকের বাদ্যি বাজলে ভেতর ভেতর নাচ চলত। উত্তেজনা। নেশার মতো। সুতো সরু-মোটা হয়ে যেত ওসবের সময়ে। নিজের ওপর রাগও হত। সুতো ভালো না হলে বাজার পড়বে, তখন পেট চলে কিসে!’

বোঝা গেল পুজো হচ্ছে একটা সেই ব্যাপার, এটা তাকে পাখি পড়া করে পড়ান হয়েছিল। পড়তে পারলে হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে অরুণ। সব সম্ভব। এদিকে পড়ে জানা গেল পুজো করতে হবে। মানে জানানো হল সে রকম। পদ্ধতিটি বেশ আকর্ষণীয়। ভালো হওয়া ভালো, তুমি হও ভালো, ভালোরা এটাসেটা করে, সেটাসেটা করে না, তুমি ভালো হেতু এটাসেটা করবে, সেটাসেটা করবে না। তো ভালোরা এটাসেটা করেও ভাব করতে পারে সেটাসেটা করার। তাতে তাদের ভালোর বিজ্ঞাপন হয় না। সেটা আরও ভালো। চরকা বুড়ি ঠিক করেছে এ বিষয়ে একটা উদাহরণ দেবে। ধর একটা ছেলে পড়াশোনায় ভালো, চাকরি করল না, শিল্পসাধনার পথে মানব সমাজের উন্নতিতে আত্মদান করল। ফলে বাড়িতে মানে দৈনন্দিন ডাল-চালে হেব্বি ক্যাঁচাল, নেশাও ধর করে, কিন্তু টলতে টলতে রাত্তিরে বাড়ি ফেরার সময়ে ফুটপাথের বুড়োর গায়ে কাশ্মীরি শাল মুড়িয়ে দেয়। তিষ্ঠ, চরকা বুড়ি এক্সপ্লানেসন দেগা, জরুর দেগা। এর কাশ্মীরি শাল উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। বাওয়া তোমার যদি কাশ্মীরি শালের উত্তরাধিকার না থেকে থাকে তবে আত্মত্যাগ করবে কী করে! সেক্ষেত্রে তুমকো উও আত্মত্যাগ করনেওয়ালা কাশ্মীরি শালের উত্তরাধিকারীকো গুরু মাননা পড়েগা। তুম দেখ নেহি পাতা উও তুমহারে লিয়ে ক্যায়সে ক্যায়সে শ্রেণিচ্যুত হো রাহা হ্যায়। জো শ্যাম্পেন পিকে রো সাকতা থা, হে ফুটপাথবাসী পাগলি, উও সিরেফ বাংলা পিকে রোতা হ্যায় রে বাবা। তুম কেবল সন্দেহ করতা তুমহারি জয়সা আরও পাগলি জুটাকে উও ডোনাল্ড ট্রাম্পসে পয়সা আদায় করতা।

তো যাক, ভালো দুই প্রকার সাদা ভালো আর লাল ভালো। সাদা চোখে যারা ভালো তারা হল সাদা ভালো। তো ভালোদের সবার বাড়িতে কলার তুলে বলার মতো জিন, দক্ষতা, সংরক্ষণ নেই। তাদের পুজো করতেই হয়। উপোষ, উপাচার সংগ্রহ করতে হয়। পুজোপলক্ষ্যে একত্রিত হতে হয়। তাপ্পরে বিধিমতে অঞ্জলি প্রদানান্ত আড্ডাতে হয়। লাল চোখের ভালো ব্যাপারটা কঠোর যুক্তিসিদ্ধ। এক্কেবারে পাক করে পাকানো যুক্তি, পাক খেয়ে প্যাঁচানো যুক্তিও বলা যায়। ধর একটা পাকা তালের ওপরে কাক বসল আর তালটা টুপ্‌। তাহলে কাকের যুক্তি হল তালের পাকামিকে সে উসকেছে। যদি তাল না পড়ে? তবে তাল তালকানা। ওজনদারের যথেষ্ট সম্মান করে না। বায়াসড। হাওয়া বুঝে রঙ বদলায়। কখন নীল-সাদা বা গেরুয়া। কাক কেন পাকা তালের ওপরেই ওজন ফলায় সে অবশ্য অন্য রেফারেন্স ফ্রেম থেকে না বিচার করতে পারলে চলবেই না। তো ইয়ে সাবিত হো গ্যয়া কি পুজো-পাঠ অত্যাবশ্যক পণ্য সামিগ্রি।

কিন্তু সে ভারি সমর্পিত হয়ে পুজো করলেও রাতে ফিরে বাপু চরকাটি ঘোরাত। পটোর পটে রঙ ধরানোর সময়ের, চাষির ধান মুঠো করবার বা বামুনের নৈবেদ্য দেবার যে বিহ্বলতা তার সবই বুড়ির চরকার সুতোর। সে সব মুগ্ধতার পরিচ্ছদ না থাকলে আপনা মাংসে হরিণা বৈরি বড্ড খরখর করে। বেশ্যাবৃত্তি বৃত্তি কি না তার ওপরে আলোচনাসভা চণ্ডীমণ্ডপে বসেটসে। তার থেকে বাবা একটু কম ঘুমিয়ে সুতো কেটে রাখা নিরাপদ। বেশ্যা কিনা আক্ষরিকভাবে বিশেষরূপে সজ্জিত। আর সজ্জার অঙ্গ ইয়ে পরিচ্ছদ যা ওই সুতো দিয়েই তৈরি। হরিবল্‌। হরি বলতে কেন নয়ন ঝরে না।

এখন দেখছে সেই সুতো কাটা তাকে কেয়ামতেও উৎরে দিচ্ছে। যাক বাবা। অথচ গ্রামের বাইরে যখন একটু পা রাখল ঝোলা ব্যাগ রঙচটা পাঞ্জাবি বলেছিল জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা। মানে এই মতোই একটা কথা। তাতে খুব চড়া গলায় মানছি না – মানব না, ছিল। আর ছিল পইতে ছিঁড়ে ফেলে নিচু জাতে সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া। কিছু উদ্বৃত্ত পা-চাটার লোক না রেখে দিতে পারলে পালকি বইবে কে!

বুড়ির বুড়বুড়ি বন্ধ হয় না। তার কেবল মনে হয় সুজলা সুফলা যে পৃথিবী তার থেকে নির্বাসিত এক অনুর্বর অধমর্ণ ক্ষয়াটে আলোর দেশে চরকা নিয়ে সে পড়ে আছে। শুনতে পায়, পড়তে পায় কিন্তু স্বপ্নে ছাড়া জেগে কখনও সেই ধাত্রীকে অনুভব করে না। জেগে থাকা একটা কাজ বলে এক সময়ে বনেবাদাড়ে তীর-ধনুক নিয়ে পাহারা দিত। এখন আর ডাকলেও ঘুম আসে না। স্বপ্নও।

সমগ্র পেঁচোয় পাওয়া মানবজাতির লজ্জারক্ষার ভার বর্তেছে বলে চাঁদের বুড়ি কেবল চরকা কেটে গেছে। কখনও শুনেছে পোশাকের অধীনতা নাকি মানা হবে না। তার কাজটি গেল ভেবে শঙ্কিত হত প্রথম প্রথম। পরে বুঝল হুজুগ দেখতেই তো জীবন বয়ে গেল তার। সেরা হুজুগ ওই অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা। ওই করেই যুদ্ধের জন্য ট্যাক্স দিয়ে আম আদমি উলুখাগড়ার মতো অবিশ্রাম মরে যেতে থাকে। যুদ্ধ না থাকলে যুদ্ধ বিরোধীরা করবে কী! ফলে আইন আদালত বিচার ব্যবস্থা সমন্বিত রাষ্ট্র টেঁকাতে কিছুমিছু বেআইনি কাজ না হলেই নয়। এক অবিচ্ছিন্ন পারস্পরিকতা। জীবনে জীবন যোগ করা।

কেয়ামত ব্যাপারটাও বানিয়ে তোলা বইকি। বহমান সময়ের একটি সন্ধি যেখানে শুরুর আগে শেষ। ভগবানের বৈচিত্র্য। আগের জনকে নির্দ্বিধায় নস্যাৎ করা। নতুন এক প্রতিষ্ঠানের গুরু হতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। যে চরকা কাটে সে কেবল জানে আর কিছু নয় কেবল পোশাকের রং বদলায়, ঢং-ও।

Leave a Comment