খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধবই পর্যালোচনা

চিনুয়া আচেবে’র সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার উপাখ্যান

লিখেছেনঃ দূরের পাখি

চিনুয়া আচেবের (Chinua Achebe) জন্ম নাইজেরিয়ার ঘনশ্যাম দক্ষিণে। মহাকাব্যিক নাইজার নদীর নিম্নাঞ্চলের ইগবো(Igbo) জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত (Ogidi) শহরে। অত্যন্ত ক্ষুরধার মস্তিষ্কের অধিকারী ছাত্র হিসেবে নাইজেরিয়াতে ইংরেজি সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্বের উপর পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা ও মিডিয়ায় কাজ করেন বেশ কিছুদিন। এর পরে আমেরিকায় কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও করেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি আমেরিকাতে কাটান দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যাবার পর। ২০০৭ সালে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ম্যানবুকার পুরষ্কার লাভ করেন সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ।

ইউটিউবে লেখাটির অডিও শুনুন।

Things Fall Apart বা ‘সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে’ চিনুয়া আচেবের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসে আচেবে নাইজেরিয়ার সবুজ দক্ষিণে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের মুখে ভূমিপুত্রদের আদিম সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপাখ্যান বর্ণনা করেছেন দুই স্তরে। উপন্যাসের মূল চরিত্র ওকোনকোর (Okwonko) নিজের জীবনের সমস্তকিছু ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদি কৃষিজীবিদের সমাজ, প্রথা ও সংস্কারের রোমান্টিক দুনিয়ার ভেঙ্গে পড়া।

উপন্যাসটিতে আচেবে গল্পের সময়কাল বোঝার মতো কোন উপকরণ রাখেননি; সম্ভবত মানুষের জীবনের এবং অতীতের রোমান্টিক সমাজের সমস্ত কিছু ভেঙ্গে পড়ার ইতিহাস যে অনাদিকালের এবং সর্বত্রব্যাপী এই বোধ পাঠকের মনে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই। উপন্যাসে নয়টি গ্রাম মিলে বসবাস করে শক্তিশালী যোদ্ধাগোত্র উমুওফিয়া (Umuofia), বর্তমান নাইজেরিয়ার ভূগোলে সনাক্ত করার মতো তেমন সূত্র নেই। শুধু গল্পের একেবারে শেষে গিয়ে বোঝা যায় এইসব অঞ্চল নাইজার নদীর বিশাল ঘনশ্যাম ব-দ্বীপের কোন এক অংশে। উমুওফিয়ার আশেপাশের কয়েকটি গোত্র ও তাদের বাসস্থানের কথাও এসেছে গল্পের বিভিন্ন পরত খোলার সাথে সাথে; সেসবের নামও কাল্পনিক। উমুওফিয়া ও তার আশেপাশের গোত্রগুলো মূলত কৃষিজীবি আদিবাসী। তাদের প্রধান শস্য ইয়াম (Yam,মিষ্টিআলু জাতীয় এক ধরণের ফসল)। গল্পের সূত্র ধরে জানা যায় তারা গরু, মুরগি, ছাগল এধরণের পশুপালনও করত।

300px-Chinua_Achebe_-_Buffalo_25Sep2008_crop
Chinua Achebe (1930-2013)

গল্প অনুযায়ী উমুওফিয়ার ও আশেপাশের গোত্রগুলোর জীবনযাত্রার যেসব বর্ণনা এসেছে, তা বর্তমান আধুনিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে চরমভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও নানান রকমের প্রথা, ভূতপ্রেত, দৈব ও প্রাকৃতধর্মের পুরোহিতদের দ্বারা আগাগোড়া নিয়ন্ত্রিত। কৃষিকাজের উপকরণ হিসেবে কোদাল, যুদ্ধ ও কৃষির দ্বৈত ব্যবহারে চাপাতি (machete) এবং যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে বন্দুক, পিস্তল ও কামানের ব্যবহারের কথাও পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা থেকে সহজেই ধারণা করা যায় খনি থেকে আকরিক সংগ্রহ ও ধাতু নিষ্কাশনের মত বিশাল শিল্প কোনভাবেই তাদের আয়ত্বের মধ্যে ছিলো না। এখান থেকে আন্দাজ করা যায় উমুওফিয়া মূলত প্রাচীন আদিবাসী জীবনযাত্রার মধ্যে আটকে থাকলেও ধাতু নিষ্কাশন ও প্রক্রিয়াজাত করার শিল্প গড়ে উঠার মত আধুনিক সমাজ তার আশেপাশেই ছিলো।

সেইদিক থেকে উমুওফিয়া ও তার পাশের অঞ্চলগুলো আসলে চরমভাবে বদলে যাওয়া ও আধুনিক হতে থাকা নাইজেরিয়ার ভিতরে একখন্ড প্রাচীন রোমান্টিক মরুদ্যান। তাদের বছরের হিসাবের কোন সুসংবদ্ধ ক্যালেন্ডার নাই, ঋতুর পরিবর্তনের মাধ্যমে বছরের হিসাব রাখা হয় কেবলমাত্র নির্দিষ্ট প্রয়োজনের খাতিরে। দিনের সময়কালের হিসাব রাখা হয় তিনবেলা আহারের সময়ের মাধ্যমে। সপ্তাহের সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব নাই। হাটের দিনের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে একটা হিসাব রাখা হয় সপ্তাহের। ভাষার কোন লিখিত ব্যবস্থা নাই। ছোট সংখ্যার হিসাব বিশ ভিত্তিক, বড় সংখ্যার হিসাব চারশ ভিত্তিক। চিকিৎসা ব্যবস্থা বলতে বনজ ও ঔষধি উদ্ভিদের কিছু মিশ্রণের কথা পাওয়া যায় এখানে সেখানে। আর মূলত গুনীন, তাবিজ, যাদু, মন্ত্র এসবের কারবার। ধর্মীয় ব্যবস্থা হিসাবে প্রকৃতির একেকটি প্রকট শক্তির একেকজন দেবতা বা দেবী ও তাদের প্রতিনিধি হিসাবে পুরোহিতরা। আর আছে পূর্বপুরুষ পূজা। মৃত পূর্বপুরুষদের জীবিত প্রতিনিধি হিসাবে আবার নানা রকমের মুখোশ পরে বিভিন্ন রকমের স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিচার কাজ চালায় গোত্রের প্রভাবশালীরা । যৌনতার বিধিনিষেধ খুব একটা প্রকট হিসাবে দেখা যায় না, অন্তত অবিবাহিতদের মধ্যে । যৌনসঙ্গী নির্বাচন প্রক্রিয়া পুরুষতান্ত্রিক; সম্পদশালী ও ক্ষমতাবানের বহুবিবাহ ও ক্ষমতাহীনের একবিবাহ অথবা সঙ্গীহীন থাকা প্রচলিত। সমাজব্যবস্থায় জন্মগত উচ্চ ও নীচ জাতের ভেদাভেদ নাই। কৃষিতে নিজস্ব দক্ষতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে সফলতা পাওয়া যে কেউ ধীরে ধীরে সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার উচ্চস্তরে পৌঁছতে পারে।

গল্পের প্রধান চরিত্র ওকোনকোর জন্ম সম্পদহীন, কর্মস্পৃহাহীন, অলস, ভাবুক, সংগীতানুরাগী মিষ্টভাষী ও বন্ধুবৎসল উনোকার (Unoka) ঘরে। পিতার একেবারে বিপরীত চরিত্রের ওকোনকো শক্তিশালী, উচ্চাভিলাষী, কর্মঠ, বদরাগী ও বৈষয়িক দিক থেকে সফল। তরুণ বয়সে উমুওফিয়ার বিখ্যাত মল্লযুদ্ধের ময়দানে বিগত সাতবারের চ্যাম্পিয়ানকে পরাজিত করে নয় গ্রামে সুখ্যাতি অর্জন করে ওকোনকো। সেই সুনাম ব্যবহার করে গ্রামের এক ধনী লোকের কাছ থেকে প্রথমবারের মত ইয়াম বীজ ধার নিয়ে বর্গাচাষের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করে সে। এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই ও খারাপ সময় পার করে সে সম্পদ সম্মান ও ক্ষমতা অর্জন করে।

সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি আর বস্তুবাদী জ্ঞানে পিছিয়ে থাকলেও, জীব হিসাবে মানুষের গভীর মনস্তত্ত্ব যে আধুনিকে আর প্রাচীনে খুব বেশি ফারাক নেই এই জিনিস নৃতত্ববিদ ও মনোবিদের মতই বুঝেছিলেন আচেবে। যার ফলস্বরূপ ওকোনকোর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের যে চিত্র দেখি তার সাথে আধুনিক মানুষের টানাপোড়েনের খুব বেশি পার্থক্য নেই। ওকোনকোর সফল ও ক্ষমতাবান বাইরের রূপের আড়ালে তাকে ক্রমাগত তাড়া করে ফেরে পিতার ছায়ার ভয়। পিতার মত ব্যর্থ, ক্ষমতাহীন, মর্যাদাহীন, ঋণগ্রস্থ পুরুষে পরিণত হবার ভয় থেকে ছুটতে ছুটতে ওকোনকো হয়ে উঠে বেপরোয়া ও ব্যর্থ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতিহীন, দয়াহীন। নিজের সন্তানদের মধ্যে তাদের পিতামহের বিন্দুমাত্র ছায়া দেখা গেলে সেটাকে কঠোর শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে দূর করার প্রাণান্ত চেষ্টায় সে নিজে হয়ে উঠে পিতা হিসাবে নির্দয় ও ভয়ংকর।

গল্পের প্রথম পর্বের বেশ কিছুদূর ধরে আচেবে ওকোনকোর চরিত্র এবং সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার আগে কী ছিল সেই চিত্রাঙ্কন করতে থাকেন। গল্প বর্ণনার এক পর্যায়ে গিয়ে প্রশ্ন জাগতে থাকে এত এত ঘটনার উপস্থাপন যে করা হল তার সবই কি আসলে শেষতক কোন গুরুত্ব বহন করে। তার কিছুটা উত্তর পাওয়া যায় ইগবো জনগোষ্ঠী ও উমুওফিয়ার জীবনযাত্রার আরেকটি দিক থেকে। আধুনিক বৈদ্যুতিন মাধ্যম বা ছাপার অক্ষরের বিনোদনহীন উমুওফিয়ার বাৎসরিক মল্লযুদ্ধ, টুকটাক বিচার ও ফসল ওঠার উৎসব আর বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া বিনোদনের অন্য কোন উৎস না থাকায় তারা একে অপরকে গল্প বলে যায়। বহুধাবিস্তৃত, খুঁটিনাটি বর্ণনাসহ, বাস্তব ও কাল্পনিকের সীমারেখাহীন অজস্র ও অসংখ্য গল্প। উমুওফিয়ার যৌক্তিক শিশুরা যেমন ধীরে ধীরে সামাজিকীকৃত হয়ে বুঝতে পারে তাদের বেশীরভাগ গল্পের কোন উদ্দেশ্য নেই; গল্প বলাটাই গল্পের উদ্দেশ্য, তেমনি আমরা পাঠকও বেশ কিছুদূর পড়ে ফেলার পর, অথবা একেবারে শেষে গিয়ে বুঝতে পারি গল্পের ভিতরের সমস্ত অনুগল্পের পিছনে আসলে তেমন কোন উদ্দেশ্য নেই।

উমুওফিয়ার সামাজিক জীবনে কথা ও বক্তার গুরুত্ব প্রবল দেখতে পাই আমরা। কারো কাছে টাকা পাওনা আছে, তার কাছে গিয়ে, ‘আমার এমন দরকার পড়েছে, তোমার কাছে যে পাওনা টাকা ছিলো সেটা কি দিতে পারবা এখন?” – এই ধরণের কথোপকথন উমুওফিয়ার ভূগোলে অকল্পনীয়। দেনাদারের কাছ থেকে টাকা চাইতে গেলে তাদের বিস্তারিত রিচুয়ালের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কোলা-বাদাম ভেঙ্গে খাওয়া, সেই বাদাম আর কে ভাঙ্গবে, কে কাকে সম্মানিত করবে বাদাম ভাঙ্গার সুযোগ দিয়ে এই নিয়ে বিস্তর দরকষাকষি করে, তারপর পাম-ওয়াইন পান করে, দেশ, সমাজ, অর্থনীতি, আশেপাশের গোত্রসমূহের হালচাল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়ে গেলে পরে কেবল টাকার প্রসঙ্গ তুলতে হবে। কার্যত টাকাই ঈশ্বর হয়ে উঠা আমাদের আধুনিক দুনিয়ার চোখে এই বিস্তৃত ও ক্লান্তিকর রিচুয়াল উদ্ভট ও অর্থহীন মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু উমুওফিয়ার লোকজন যেই ভূগোল ও সামাজিক বাস্তবতায় বাস করে সেখানে সমাজের অসহযোগীতা থাকলে অঞ্চলের সমস্ত টাকা হাতে থেকেও না খেয়ে মরতে হতে পারে কাউকে। তাই তারা কখনোই মৌখিক ও বাইরের সৌহার্দ্য নষ্ট করতে পারে না একে অপরের সাথে; প্রয়োজন যত গুরুতর আর দেনার পরিমান যত বড় হোক না কেন। আদতে আমাদের আধুনিকতার বড়াই ঠিক অতটা টিকে না যদি আমরা আমাদের আচরণের অন্য দিকে তাকিয়ে দেখি। আমাদের আধুনিক সমাজে যৌনসঙ্গী নির্বাচন ও মেইটিং সিস্টেমে আমরাও উমুওফিয়ার পাওনা টাকা ফেরৎ চাওয়ার মত বিস্তারিত, ক্লান্তিকর ও অর্থহীন রিচুয়ালের মধ্যে দিয়ে যাই।

আধুনিক মানুষের আরেকটি বেশ সূক্ষ্ণ মনস্তাত্ত্বিক দার্শনিক দিকের প্রতিরূপ পাওয়া যায় উমুওফিয়ার ইগবো জনগোষ্ঠীর ভিতরে। আইনের নৈর্ব্যক্তিকতা ও সার্বজনীনতার চর্চা করে উমুওফিয়ার জনগণ, গভীর অর্থ বুঝে হোক অথবা না বুঝে। ওকোনকোর জীবনের সবকিছু ভেঙ্গে পড়ার শুরুর ঘটনাতে এই জিনিসটি খুব চমৎকারভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে; উমুওফিয়ার এক খ্যাতিমান যোদ্ধার মৃত্যুর পরে তার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে। যোদ্ধার মৃত্যুতে যোদ্ধার জন্য উপযোগী শেষকৃত্যের আয়োজন করা হয় যেখানে শোক-প্রকাশকারীরা সবাই পিস্তল, বন্দুক ও কামানের গুলি ফুটিয়ে, বিলাপ করে, প্রয়াত যোদ্ধার সাহস, দক্ষতা ও যুদ্ধক্ষেত্রের সফলতার গল্প বলে অস্তিত্বের অন্য পাড়ে তার যাত্রার ব্যবস্থা করে। এর মধ্যে ওকোনকোর কামার দিয়ে বানানো পিস্তলের ভুলে মৃত্যু ঘটে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওবিএরিকার (Obierika) ছেলের। যদিও এই মৃত্যু সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত, এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই তাই দেখেছে, এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার পরিবারের ব্যক্তিগত কোন অভিযোগ নেই ওকোনকোর বিরুদ্ধে; তারপরও শক্তিশালী, ক্ষমতাবান, মর্যাদাবান ওকোনকো তার ধার্য্য শাস্তি মাথা পেতে নেয়। অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বগোত্রের কাউকে হত্যার অপরাধে তাকে সাত বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হয় নিজের মাতামহের অঞ্চলে, স্ত্রীগণ ও সন্তানসন্ততিসমেত। তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পুড়িয়ে দেয়ার আগে অঞ্চলের সবচেয়ে মূল্যবান ফসল, তার ইয়াম বীজগুলো স্থানান্তরিত করা হয় ওবিএরিকার গুদামে। সেইসব ইয়াম বীজ বিক্রির টাকা, সেগুলো বর্গাচাষে খাটানো থেকে প্রাপ্ত লাভের সমস্তকিছু ওবিএরিকা বিশ্বস্ত বন্ধুর মতোই ওকোনকোর কাছে পৌঁছে দেয়। আমাদের সভ্য সমাজে আইন তৈরি ও প্রতিষ্ঠা করার আদি ও আসল দার্শনিক ভিত্তি ছিল এই যে আইন সবার জন্য অন্ধের মত কাজ করবে; ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আবেগ অনুভূতি এসবের তারা তাড়িত হবে না। উমুওফিয়ার ভূগোলে আইনের প্রয়োগ দেখে এই একটি ক্ষেত্রে আমাদের আধুনিকতম রাষ্ট্রটির চাইতেও তাদের আধুনিক বলা চলে।

শরীরের মত স্নায়ুতেও শক্তিশালী ওকোনকোর জীবনের শত শত বাঁকের মধ্যে দুর্ভাগ্যের ছোবলের পরিমাণও কম নেই। আধুনিক, স্বাধীন ও বস্তুবাদী মানুষের মতই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও ওকোনকোর পরিকল্পনা থাকে সুদূরব্যাপী; কীভাবে এইসব ঝামেলা কাটিয়ে উঠে আবার সম্পদ, খ্যাতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছতে পারবে এই চিন্তায়। মাতুলালয়ে প্রথম কয়েকমাস বিষণ্ণ ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়লেও একমাত্র জীবিত মামার উৎসাহে এবং আত্মীয়দের সহযোগীতায় এমবানতা (Mbanta) তেও সফল ইয়াম চাষী হিসাবে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ওকোনকো। তার উপর উমুওফিয়াতে রেখে আসা বীজের মুনাফাও আসতে থাকে। কিন্তু ওকোনকো যখন নিজের জীবনের ভাঙন প্রতিরোধে ব্যস্ত ঠিক তখনই গোটা দক্ষিণ নাইজেরিয়াসহ তাদের সমাজ ও প্রাচীন জীবন যে ভেঙ্গে পড়ছে সেটা সে টের পায় না, অথবা পেয়েও তার কিছু করার থাকে না।

সাদা চামড়ার খ্রিস্টান মিশনারিদের শ্যামল দক্ষিণে আনাগোনার খবর আসতে থাকে আশেপাশের গ্রাম থেকে। এরই মধ্যে তারা অনেক স্থানীয় অনুসারীও পেয়ে যায়। এই স্থানীয় অনুসারীদের দোভাষী হিসাবে ব্যবহার করে তারা ঈশ্বর, যিশু ও মাতা মেরির দাওয়াত দিতে থাকে প্রাকৃত ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে। ইগবো জনগণ প্রথমে কৌতুকের মত করে নেয় খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্ভট ধর্মের গল্পকে। ভুতপ্রেত অধ্যুষিত বলে পরিচিত জঙ্গলে তাদের জমি দেয়া হয় চার্চ বানানোর জন্য, যাতে দু-একদিনের মধ্যেই প্রেতের আক্রমণে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ওকোনকো ও তার স্বজাতিকে অবাক করে দিয়ে এই মিশনারিরা মরেতো না-ই উল্টে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে থাকে। ইগবো জনগণ যেটা বুঝতে ভুল করে সেটা হচ্ছে এই মিশনারিরা কেবল কৌতুকের পাত্র হতে এখানে আসেনি। উত্তর থেকে নাইজেরিয়াকে এরই মধ্যে ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। কাগজে কলমে এই কৃষিজীবি আদিবাসী অধ্যুষিত নাইজার ব-দ্বীপও মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। এই তিক্ত সত্য তারা টের পায় যখন স্থানীয় খ্রিস্টান একজনের সাথে প্রাকৃত ধর্মের অনুসারী একজনের সংঘর্ষ হয় এবং খ্রিস্টানকে হত্যার দায়ে হত্যাকারীকে অস্ত্রসজ্জিত রক্ষীরা তুলে নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়, স্থানীয় পূর্বপুরুষের আত্মাদের বিচারের তোয়াক্কা না করে।

ধর্মীয় আগ্রাসনের সাথে সাথে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা আরেকটি কার্যকর পদ্ধতি পায় আদিম ও বুনো দক্ষিণের জনগণকে অধীনস্ত করার জন্য; আবামে (Abame) নামের এক গোত্রের হাতে সাদা চামড়ার এক ধর্ম প্রচারকের খুন হওয়ার বদলা হিসাবে বাজারের দিনে পুরো গোত্রকে ঘিরে ধরে গুলি চালিয়ে গণহত্যা করা হয়। হয়তো ঠিক এভাবেই করা হয়, অথবা স্বল্প পরিসরে অথবা আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে অন্যভাবে ঘটনা ঘটে। কিন্তু চারপাশে যেভাবে ঘটনার বর্ণনা ছড়িয়ে পড়ে তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের জন্য লাভজনক হয়ে দেখা দেয় । স্থানীয় প্রাকৃত জনগণের মধ্যে ত্রাস ঢুকে যায়।  গোত্রে গোত্রে ওকোনকো ও তার মত শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী ও যুদ্ধংদেহীরা অন্যদের কোনভাবেই ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে সংঘর্ষে যাবার ব্যাপারে রাজি করাতে পারে না।

নাইজার ব-দ্বীপের শ্যামল অঞ্চলগুলোকে কব্জা করার জন্য ধর্ম আর সন্ত্রাসের বাইরে আরেকটি অন্য ধরণের অস্ত্রের ব্যবহার করে ঔপনিবেশিকরা- আশা। উমুওফিয়া ও তার আশেপাশের শ্যামল অঞ্চলগুলোতে আদিম কৃষিজীবি, রোমান্টিক, অলস ও আপাত শান্ত সমৃদ্ধ জীবনযাত্রার সাথে সাথে চলে কিছু ঘোরতর নির্মমতা ও অন্ধকার, হয়তো সকল রকমের সমাজেই থাকে, যেগুলো স্থানীয়দের বেশিরভাগের কাছে তেমন বড় কিছু বলে মনে হয় না। কিছু কিছু লোককে কোন উদ্ভট কারণে সমাজ অচ্ছ্যুৎ বলে ঘোষণা করে, যারা অপরিচ্ছন্নতা, সম্মানহীনতা ও ন্যূনতম মানবিক মর্যাদাহীনভাবে জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। যমজ বাচ্চাকে অভিশাপের চিহ্ন হিসাবে জন্মের পরপরই জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা হয় মরে যাবার জন্য। পুরোহিত আর কবিরাজের ঝাড়ফুঁকের শক্তির বাইরের বেশিরভাগ রোগের জন্য রোগীকেই দোষী সাব্যস্ত করে দূষণ আটকানোর জন্য তাকে জীবিত অবস্থাতেই জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসা হয়। আত্মীয় পরিজনের মধ্যেকার বন্ধন বেশ শক্তভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করে একটু পরিমাণ সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বটে; কিন্তু জন্মগতভাবে দুর্বল বা সফলতার জন্য অনন্ত ক্ষুধাবিহীন কারো জন্য উমুওফিয়ার সমাজ তেমন একটা সদয় নয়। ওকোনকো নিজেও তার বিভিন্ন আচরণে এইসব লোকজনের জন্য ঘৃণা ও অসম্মান দেখিয়েছে এমনকি সরাসরি অপমানও করেছে। এইসব অচ্ছ্যুৎরা, বারবার একসাথে দুইটা করে বুকের ধন হারানো মায়েরা, বৈষয়িক দুনিয়াতে সাফল্যের ইচ্ছাবিহীন কিন্তু একটু সম্মানের সাথে, শান্তির সাথে সবার সমান হয়ে বাঁচতে চাওয়া ভাবুকরা, জঙ্গলে মরার জন্য ফেলে আসা নিরপরাধ রোগী আর নিষ্পাপ জমজের কান্নার ধার জীবনভর ভুলতে না পারা কোমল হৃদয়ের সমাজ-অযোগ্যরা ধীরে ধীরে আশা ও আত্মবিশ্বাসের দেখা পায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের প্রচারিত ধর্মে, সরকারে, বিচার ব্যবস্থায় ও তাদের নিয়ে আসা যাদুকরি ঔষধে। ওকোনকোর নিজ বড় ছেলেই যোগ দেয় এই ধর্মপ্রচারকদের সাথে।

প্রথা ও ঐতিহ্যের কারণে আজন্ম অত্যাচারিত ও অচ্ছুৎ হতে থাকা লোকজনের বাইরের শক্তির সাহায্য নিয়ে নিজেদের সমাজকে একেবারে মূল থেকে ভেঙ্গে ফেলার উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে কম নয়। তারপর এক এক সমাজ নিজেদের মত করে স্বাদ লাভ করে এই আদিম তিক্ত সত্যের। গল্পের একেবারে শেষের দিকে ওকোনকোসহ আরো পাঁচজন গোত্রনেতাকে যখন ঔপনিবেশিক পুলিশ বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায় তাদের বিচারালায়ে, তখন মর্ত্যের দুনিয়াতে প্রায় ঈশ্বরের মত দাপট, ক্ষমতা, আভিজাত্য ও রাগ নিয়ে চলাচল করা উমুওফিয়ার এইসব গোত্রনেতাদের সাথে ব্রিটিশদের সাহায্যে ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া আজীবনের অচ্ছুৎরা যে ধরণের আচরণ করে তা থেকে বোঝা যায় তাদের ক্ষোভ, হতাশা ও ঘৃণার পরিমাণ কতখানি জমা হয়ে ছিল এত শতাব্দী ধরে।

অপমান ও অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ওকোনকোর জীবনে চরমতম ভাঙন ও পতন নেমে আসে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না নাইজার নদীর শ্যামল ব-দ্বীপের লোকজন আসলে শেষপর্যন্ত ধরতে পেরেছে কিনা যে তাদের সবকিছু ভেঙ্গে পড়েছে সাদা চামড়ার মানুষদের শক্তিশালী ঈশ্বরের বিপরীতে তাদের ঈশ্বরদের ব্যর্থতায় নয়; সমাজ, সংগঠন, প্রকৃতি ও জীবনের গভীর সংযোগানুসন্ধানে তাদের নিজস্ব মানবিক ব্যর্থতার দায়-ও এখানে খুব একটা কম নেই। (এই প্যারার জন্য অবশ্য উপনিবেশবাদের দালাল, ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চর এইসব বিশেষণ জুটলেও জুটতে পারে।)

………………………
প্রবন্ধটি অনলাইন পাঠচক্র খাপছাড়া আড্ডায় পঠিত।

Leave a Comment