খাপছাড়া আড্ডাপ্রবন্ধ

বাংলা ভূতসমগ্র

লিখেছেনঃ বায়রনিক শুভ্র

প্রথমেই কিছু জনপ্রিয় ভূতের গল্পঃ

১. দুই ভাই সন্ধ্যা রাতে বিলে মাছ ধরছে। সামনে বড় ভাই ফুলকুচি দিয়ে মাছ ধরছে আর নৌকায় রাখছে আর ছোট ভাই পিছনে বসে লগি ঠেলছে। এত মাছ উঠছে যে বড় ভাইয়ের পিছনের দিকে তাকানোর ফুসরত নেই। আলো ফোটার পর বড় ভাই যখন পিছনে তাকালো, তখন দেখল নৌকায় মাছ আছে মাত্র চার পাঁচটা, বাকি মাছ গায়েব এবং ছোট ভাইয়ের মুখে রক্ত লেগে আছে। এই দেখেই বড় ভাই বুঝে গেল  ভূতে ছোট ভাইকে মেরে ছোট ভাইয়ের রূপ ধরে নৌকায় বসে সব মাছ সাবাড় করে দিয়েছে। তারপর বড় ভাই করল কি বক বক বক …

২. আমার আপন মামার খালাতো ভাইয়ের চাচা শ্বশুরের জামাইয়ের বিয়াই একবার পয়সার হাটে গিয়েছিল । ফেরার পথে রাত হয়ে যায় । ফাকা বিলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে । এদিকে রাত বাড়তেই থাকে । হঠাৎ সে দেখে দূরে একবাড়িতে আলো জ্বলছে । রাতের আশ্রয়ের জন্য সে সেই বাড়ি গেল । বাড়ি গিয়ে দেখে শত শত মানুষ । বিশাল খাওয়া দাওয়া , গান বাজনা চলছে । সে গিয়ে আশ্রয় চাইল এবং বাড়ির কর্তা তাকে খুব খাতির যত্ন করে খাওয়ালো, ঘুমানোর জন্য আলিশান ব্যাবস্থা করে দিল । কিন্তু সকাল বেলা সে দেখে বাড়ি ঘর কিছু নেই । শুয়ে আছে মাটির উপর এবং মাথার নিচে পোড়া কাঠ কয়লা । এবং যে জায়গায় আছে সেটা এলাকার বিখ্যাত একটা শ্মশান ।  তারপর বক বক বক …

৩. শোন একদিন কাজ টাজ সেরে ডাঙা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেদিন আবার আমাবশ্যা। এমন অন্ধরাক যে কিছুই দেখা যায় না। হেঁটে হেঁটে ফিরছি । তিন কুয়ার মাঝখানে যখন আসলাম (এখানে বড় বট গাছ হতে পারে, সাত রাস্তার মোড় হতে পারে বা শ্মশান বা গোরস্থানও হতে পারে) তখন হঠাৎ দেখি একটা ঘোড়া ছুটতে ছুটতে আসছে। একটু পর ঘোড়া হয়ে গেল হাতি, এরপর গরু, এরপর বিড়াল । আমি তো ভয়ে শেষ। তারপর বক বক বক …

৪. গত বছর ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছি। এমনিতেই রাত হয়ে গেছে তারপর আবার আমাবশ্যা। কিচ্ছু দেখা যায় না। স্টেশনে এসে দেখি কোন ভ্যান নেই (রিকশা বা নৌকাও হতে পারে)। কি আর করা হেঁটেই রওয়ানা হলাম। যেই বিশ্বাসদের পুরানো গোলা ঘর পর্যন্ত এসেছি অমনি মনে হল কে যেন পিছন পিছন হাঁটছে। আমি ভাবলাম মাইজা ভাই মনে হয়। ডাক দিলাম কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। পিছনে তাকালাম দেখি কেউ নাই। মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটা শুরু করলাম। যেই হাঁটা শুরু করেছি অমনি শুনি পিছনে কার জানি পায়ের শব্দ। আবার পিছনে তাকালাম দেখি কেউ নাই। আমি তো এইবার ভয়ে শেষ। দৌড় দিলাম সাথে সাথে। পিছনে শব্দ শুনলাম কে জানি দৌড়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করছে। তারপর বক বক বক …

৫. তুই জানিস আমাদের এই বাড়ির মাটি কারা কাটছে ????

কারা ??

ভূতে ।

ইস ভূতে আবার মাটি কাটে নাকি ???

তাইলে শোন আসল ঘটনা ——-

আমার দাদুরা ছিল দুই ভাই। দুই ভাইয়ের গায়ে অনেক শক্তি। দাদুর বাবা যখন এই জমি কিনল তখন এই জায়গা অনেক নিচু ছিল। তাই বাড়ি বানানোর জন্য আমার দুই দাদু প্রতিদিন সকাল রাত্রে উঠে মাটি কাটত। একদিন শনি মঙ্গল বার (শনি না মঙ্গলবার পরিস্কার না) আমার দাদু ছোট দাদুকে বলেছে “আজকে একটু তাড়াতাড়ি উঠিস উত্তর পাশ আজকে ভরাট করে ফেলতে হবে।” যাই হোক ছোট দাদু তো ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ রাত দুপুরে অবিকল বড় দাদুর মত গলায় ছোট দাদুকে কেউ একজন ডাকল। ছোট দাদু উঠে দেখে বড় দাদু তাকে ডাকছে। কিন্তু তখনও অনেক রাত। এত রাত্রে যেতে ছোট দাদু আপত্তি করলেও বড় দাদু জোর করে ছোট দাদুকে মাটি কাটতে নিয়ে গেল। কিন্তু বড় দাদু কোদাল ধরে না। কোদালে লোহা আছে তো , ভুতে আবার লোহা ছোঁয় না। যা হোক ছোট দাদু মাটি কাটছে আর বড় দাদু টুকরিতে করে মাটি ফেলছে। কিন্তু মাটি ভরতে দেরি আছে মাটি ফেলতে সময় লাগে না। দাদু পিছনে ফিরে দেখে ২০ হাত দূরে দূরে পা ফেলে খেজুর গাছের মত লম্বা কে যেন মাটি ফেলছে। এই দেখেই তো দাদু বুঝে গেল বড় দাদুর রূপ ধরে ভুত এসেছে। তারপর বক বক বক …

এগুলো আমাদের অঞ্চলের খুবই জনপ্রিয় ভুত বা জীনের গল্পের মধ্যে কয়েকটি। এমন কোন গ্রাম খুঁজে পাবেন না যে গ্রামে এই গল্পের মত গল্প পাবেন না। এবং এগুলো বলার জন্য উৎসাহী কথকও খুজে পাবেন, যারা মুল নায়কের মুখে নিজ কানে শুনেছে।  শুধু গ্রাম ভেদে পাত্র বা পাত্রী বা স্থানের পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু ঘটনা একই। ছোট বেলায়  শীত কালে মামাবাড়ি গিয়ে এই গল্প গুলো শুনতাম রাতের বেলা। কখনও মামা বা কখনও দাদু বা দিদাদের মুখ থেকে। খুব ভয় করত তখন। গল্প শুনে জড় সড় হয়ে থাকতাম, অন্ধকারের দিকে তাকাতাম না। কিন্তু এখন শুধুই হাসি পায়। এখনও মধ্যবয়স্ক কারো কাছে এই গল্প গুলো জিজ্ঞেস করলে খুব উৎসাহ নিয়ে বলে।   আমার এক মামা আছেন নাম “টেক্কা” তার জীবনে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যার সাথে ভৌতিক কিছু জড়িত নেই। আমার ছোট কাকি এমন কোন জায়গা নেই যেখানে ভূত দেখেনি (তিনি শিক্ষিত এবং চাকরিজীবী)। আরেকজনকে চিনি যে কিনা সব জায়গায় ভূতের অস্তিত্ব খুজে পেতে খুব পছন্দ করে। বাস্তবে না থাকলেও এই ধরনের মানুষের মধ্যে আজীবন বেঁচে থাকবে আমাদের বাংলার ঐতিহ্যবাহী ভূত ।

আমার দেখা সত্যি সত্যি ভূতঃ

বাংলাদেশে জন্ম নিয়ে ভূত দেখেনি বা ভূতের ভয় পায়নি এমন কোন বাঙালী খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। অন্তত 90’s kid পর্যন্ত সবাই কম বেশি ভূত দেখেছে এবং কম বেশি ভূতের ভয় পেয়েছে। এই অংশে আমি আমার ভূত দেখার ঘটনাগুলো বর্ণনা করব।

ঘটনা একঃ

ক্লাশ এইটে পড়ি। সবে পাখনা গজাতে শুরু করেছে । বন্ধুদের সাথে বাসা থেকে দূরে ঘুরতে যাওয়া শুরু করেছি। মাসটা সম্ভবত আগস্ট-সেপ্টেম্বর। ওই সময়ে আমরা বন্ধুরা মিলে বিকাল বেলা হয় ডিসি অফিসের ছাদে আড্ডা দিতাম, আর যদি বৃষ্টির কারণে মাঠে জল-কাদা জমে না যেত তাহলে মাঠে ফুটবল খেলতাম। অন্যান্য টিন এজার বাচ্চাদের মত আমরাও সন্ধ্যার আজান দেওয়ার সাথে সাথে যে যার বাসায় দৌড়াতাম।

বাসায় তখন আমার বাবা একটা মোবাইল ফোন কিনেছিল, যা বেশীরভাগ সময়ে আমার কাছেই থাকত। তবে ফোনটা বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আমার ছিল না। আর মোবাইল ফোন তখন এতটাই দুষ্প্রাপ্য ছিল যে আমার বাবা ঢাকা বা শহরের বাইরে না গেলে ওই ফোনে কোন কল আসতো না। তো একদিন বাসায় কেউ ছিল না, সেই ফাঁকে আমি মোবাইলটা নিয়ে বের হলাম এবং আড্ডাস্থল যথারীতি ডিসি অফিসের ছাদ। স্বাভাবিকভাবে আড্ডা শেষ করে বাসায়ও ফিরলাম, কিন্তু মোবাইলটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে খেয়াল হল ছাঁদে মোবাইল ফেলে এসেছি। বাসায় বিষয়টা ধরা খাওয়ার আগেই আবার ছুটলাম ডিসি অফিসের দিকে। আমাদের জেলার ডিসি অফিসটা একটা বিশাল তিন তলা ভবন নিয়ে গঠিত। আশেপাশে সবই সরকারী অফিস হওয়ায় এই এলাকাটা অফিস টাইমের পর থেকেই শুনশান নীরব হয়ে যায়। আর সেদিন ছিল বৃষ্টিবহুল একটি সন্ধ্যা। ঝাপসা অন্ধকার, দমকা বাতাস ও ঝির ঝির বৃষ্টিতে তিন তলার ছাঁদে উঠতে খুব ভয় করছিল। কিন্তু আমাকে তো উঠতেই হবে। কিছু করার নেই। বন্ধুরা সবাই যে যার বাড়িতে চলে গেছে, আশেপাশেও কেউ নেই যে তাকে নিয়ে ছাঁদে উঠব । ভয়ে ভয়ে ধীর পদক্ষেপে অবশেষে ছাঁদে উঠলাম আর মোবাইলটাও খুঁজে পেলাম ।

এবার যত দ্রুত নামা যায় ততই মঙ্গল, তাই দৌড়ে নামা শুরু করলাম। কিন্তু সিঁড়িতে দৌড় শুরু করতেই স্পষ্ট শুনতে পেলাম কেউ একজন আমার পিছনে সিঁড়ি দিয়ে আমার মতই দৌড়ে নামছে। সাথে সাথেই থেমে পিছন ফিরে তাকালাম। সিঁড়ি একদমই ফাকা আর দৌড়ে নামার সে শব্দটাও শুনতে পেলাম না। বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল, নির্ঘাত এটি ভূতের কাজ না হয়ে পারে না। আমি আর এক পা-ও বাড়ানোর সাহস পেলাম না। এদিকে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব না। সময় যত যাচ্ছিল ভয়ের পরিমাণও তত বাড়ছিল, মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। কেউ যেন লোমশ কালো হাত দিয়ে আমার গলা চেপে ধরার জন্য হাত বাড়চ্ছে। আরও অজানা ভয়ে আমি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে আবারও দৌড় শুরু করলাম। কিন্তু সেই একই বিষয়- আবার কেউ পিছনে দৌড়াচ্ছে। আর সহ্য করতে পারলাম না। গলা ছেড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। সম্ভবত আমার কান্নার শব্দ শুনে ডিসি অফিসের নাইট গার্ডদের একজন দৌড়ে আসল। ততক্ষণে আমার জ্ঞান প্রায় লোপ পেয়েছে।

নাইটগার্ড আমার আমাকে চিনতো। সে আমাকে সেদিন রিকশায় করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। এরপরে আমি বেশ কিছুদিন একা রাতে ঘুমাতে পারতাম না। অন্ধকারে যেতাম না এবং আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিল ওইদিন নাইট গার্ড সময় মত না আসলে আমাকে ভূতে মেরে ফেলত। আমার এই ঘটনার জন্যে আমার বন্ধুরাও ওখানে আড্ডা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।

এই ঘটনার ৬-৭ বছর পর সব কিছু যখন প্রায় ভুলে গেছি, ভূতের ভয়ও পুরোপুরি কেটে গেছে, তখন একদিন রাতে ডিসি সাহেব ও সমাজ সেবা কর্মকর্তার সাথে আমাদের জেলার কয়েকটি সেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনের একটা জরুরী মিটিং অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বিষয় এলাকায় ইভ টিজিং প্রতিরোধ করা। একটি সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে আমিও সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে সাতটার সভা শুরু হতে হতে আটটা বেজে গেল এবং শেষ হল ১০ টার দিকে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যে যার নাস্তা নিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমাদের সংগঠনের সভাপতি কী একটা কাজে যেন ডিসির পিএস এর সাথে কথা বলছিলেন। তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি করছিলাম। হঠাৎ কী মনে করে যেন তিন তলায় উঠলাম। এদিক সেদিক ঘুরে তিন তলা থেকে যখন একটু দ্রুত নামতে যাব, তখন আবার সেই একই শব্দ শুনতে পেলাম। পিছন থেকে কে যেন সিঁড়ি বেয়ে আমার পিছন পিছন হেঁটে আসছে। ছোট বেলার সেই বীভৎস স্মৃতি আবার আমার মনে পড়ে গেল। এখানে যখন ভয় পেয়েছিলাম তখন ছিলাম নিতান্ত শিশু, আর এখন আমি একজন যুবক। অনেক আগেই প্রচলিত কুসংস্কারকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। তাই কী কারণে এমনটা হয় তা জানার জন্য মনের মধ্যে একটা জেদ কাজ করছিল। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর খুব জোরে একটা পা নিচের ধাপের সিঁড়িতে ফেললাম। সিঁড়িতে পা ফেলার সাথে সাথে আবারও শুনতে পেলাম কে যেন আমার পিছনে প্রায় একইভাবে সিঁড়িতে পা রাখলো। যতবার আমি আমার পা ফেলছি ঠিক ততবারই পিছনে একই রকম শব্দ হচ্ছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে বড় ভবনে আমার পায়ের শব্দ দেয়ালে ও ছাঁদে লেগে প্রতিধ্বনি হচ্ছে এবং এই শব্দ শুনেই আমি ছোট বেলায় ভয় পেয়েছিলাম। সেদিন নাইটগার্ড সময়মত না এতে হয়তো ভয়ে মরেই যেতাম।

এখন খুব হাসি পায় এই ঘটনার কথা মনে পড়লে। হাসতে হাসতেই এই ঘটনা আমি মানুষকে বলি মাঝে মাঝে । কিন্তু ভূতের ভয় কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেদিন আমি জেনেছিলাম। বিজ্ঞান বইয়ে প্রতিধ্বনি নিয়ে অনেক ছোট ক্লাস থেকেই পড়ানো হয়। অথচ শুধুমাত্র অন্ধ বিশ্বাসের কারণে প্রতিধ্বনির বিষয়টা জেনেও আমি ভয়ে মরে যেতে বসেছিলাম।

ঘটনা দুইঃ

এই ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলা চৈত্র মাসের কোন এক পূর্ণিমা রাতে। সময়টা ২০০৫। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বের হতে তিন মাস লাগবে, আর এই তিন মাসে কোন পড়াশুনার বালাই নেই। আমাকে আর কে পায়। সারাদিন শুধু ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তখন আমাদের গ্রামে চৈত্র মাসে অনেকগুলো বাসন্তী পূজা হত খুব জাঁকজমকের সাথে। পরীক্ষা শেষ আবার পুজা হচ্ছে, তাই গ্রামের বাড়িতে গেলাম পুজা উপলক্ষে। গ্রামে আমার সমবয়সী এক কাকা ছিল সেও এসএসসি  পরীক্ষা দিয়েছে (মৃণাল)  এবং আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে মৌরি, সেও এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আমাদের শহরের বাসায় বেড়াতে এসেছিল। মায়ের সাথে সেও আমাদের গ্রামে গিয়েছিল পুজা দেখতে। সমান তিনজন একসাথে হয়ে গ্রামের এই কোণা থেকে ওই কোণা টই টই করে আমরা ঘুরতাম। খেত থেকে শসা ছিঁড়ে খাই, বড়শী দিয়ে মাছ ধরি, আর প্রতিদিনই সন্ধ্যায় এই পূজা মণ্ডপ থেকে ওই পুজা মণ্ডপে ঘুরে ঘুরে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরি।

সেদিন দশমী, সব পূজা মণ্ডপেই বিদায়ী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পুজা শেষ, আমি শহরের বাড়ীতে ফিরব। মৌরিও ঢাকায় ফিরে যাবে। তাই আমার সেদিন মিশন ঠিক করলাম যত কষ্টই হোক গ্রামের সবগুলো পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখব। আমাদের গ্রামটা সাইজে অনেক ইউনিয়ন পরিষদকেও হার মানাবে। আর ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ তো ছিলই না, পাকা রাস্তা ঘাটও ছিল না।

সব গুলো পুজা মণ্ডপ ঘুরে রাত একটা দেড়টার দিকে আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মৃণালদের বাড়ি আমাদের একটা বাড়ি পরে। তাই অন্যান্য সঙ্গীরা চলে যাওয়ার পর আমরা তিনজন একসাথে ছিলাম।  সেদিন আকাশে এমন জোছনা ছিল যে ইচ্ছা করলে বইও পড়া যায় । তিনজনেই কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে বাড়ীর পথে হাঁটছিলাম। বাড়ীর বেশ কাছে চলে এসেছি এমন সময়ে মৌরি খুব শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। আমি ওর দিকে তাকাতেই ও বলল, “শুভ্র ঐ দেখ কী দাঁড়িয়ে আছে।” তাকিয়ে দেখি রাস্তার পাশে কুকুরের চেয়ে একটু বড় কাটাওয়ালা একটা প্রাণী আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। চাঁদের আলোয় দাঁতগুলো ঝক ঝক করছে এবং গায়ে বড় বড় কাঁটা দেখা যাচ্ছে। গভীর রাতে ফাঁকা রাস্তায় এরকম একটা প্রাণী দেখে তিনজনেই হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি । সামনে যাওয়ার মত সাহস নেই, আবার পিছিয়ে যাওয়ার মত উপায়ও নেই। তিন জনই খুব ঘাবড়ে গেলাম। কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়েও তো থাকা যায় না

মৃণাল ঐ গ্রামেরই ছেলে। স্বভাবতই সে এলাকা সম্পর্কে সব থেকে বেশি ওয়াকিবহাল। আর আমরা একই সাথে এসএসসি পরীক্ষা দিলেও বয়সে সে আমাদের থেকে বড়, বাস্তব জ্ঞানও ওর বেশি। ও আমাদের আশ্বস্ত করার জন্য বলল, “আমি তো এই রাস্তা দিয়ে অনেকবারই রাতে চলাফেরা করেছি কিন্তু কোনদিন তো কিছু দেখি নাই। আয় সামনে এগিয়ে দেখি ওটা কী।” কিন্তু মৃণালের অঙ্গভঙ্গি বা হাবভাবে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ও নিজেও অনেকটা ভয় পেয়েছে। তাই আমি বা মৌরি কেউই ওর কথায় ঠিক ভরসা করতে পারছিলাম না। কিন্তু দাঁড়িয়ে থেকেও তো কোন ফায়দা নেই । কিছু হলে চীৎকার করা যাবে। আর চীৎকার শুনে অবশ্যই মানুষ আসবে। তাই মৌরির তীব্র আপত্তি সত্বেও আমরা হাঁটা শুরু করলাম।

আমরা হেঁটে যতই প্রাণীটার কাছে যেতে থাকলাম, ততই প্রাণীটা ছোট হতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত দেখলাম যেখানে প্রাণীটা বসা ছিল সেখানে একটা ছোট খেজুর গাছ আর তাতে অনেকগুলো খড় জড়ানো আছে। ভয় থেকে এবার অবাক হওয়ার পালা- দেখলাম ভয়ংকর একটা প্রাণী, আর হয়ে গেল খেজুর গাছ! এবার আমরা আবার পিছনে সরে আসলাম এবং আবিষ্কার করলাম নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে দেখলে খড় জড়ানো খেজুর গাছটিকে সত্যিই কোন প্রাণীর মত লাগে। কিন্তু কাছে গেলে আবার খেজুর গাছ বোঝা যায়।

শুধুই ভূতঃ

অস্তিত্বহীন কুসংস্কার মানুষের মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে, তার প্রমাণ এই ভূত। বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ জিন/ভূত। এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে দু’একটা ভূত/জিন খুঁজে পাওয়া যাবে না । যুগ যুগ ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে ভূত/জিন আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভাব ও প্রচার অনেক কুসংস্কার দূর করতে পারলেও এই ভূতের ভয় রোধ করতে পারেনি। ভূত/জিনের ভয় একেবারে শিশুবেলা থেকে মানুষের মনে স্থায়ীভাবে রোপণ করা হয়। ফলে বড় হয়েও মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে।

এখন দেখা যাক ভূত আসলে কী। “মাটি, জল, বাতাস, আলো ও তাপ” এই পাঁচটি প্রাকৃতিক বস্তুকে এক সঙ্গে বলা হয় পঞ্চভূত। মানুষ মারা গেলে তার দেহ এই পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়। আর মিথ অনুযায়ী মানুষ মরেই ভূত হয়। ভূতের ভূত নামেরও উৎপত্তি সম্ভবত এখান থেকে।

বাংলায় প্রধানত  ৫ ধরনের ভূতের অস্তিত্ব পাওয়া যায় । এগুলো হলঃ- শাকচুন্নি, মামদো ভূত, ব্রহ্মদৈত্য, পেত্নী এবং স্কন্ধকাটা। এর বাইরেও এলাকাভেদে কিছু ভূতের কথা মানুষের মুখে শোনা যায়। তবে এগুলোই বাংলার ভূত সমাজের প্রধান ভূত। পুরো বাংলা একসময়ে এই ভূত সমাজের প্রভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্ হয়ে থাকত। সময়ের সাথে সাথে জিন/ভূতের ভয় ও প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছে। এখন দেখা যাক ভূতের এই শ্রেণীবিভাগ কিভাবে করা হয়।

 ১। শাকচুন্নিঃ সধবা মহিলা মারা যাওয়ার পর যদি তার আত্মা প্রেত লোকের অধিবাসী হয় তবে তাকে শাকচুন্নি বলা হয়। এটি স্ত্রী লিঙ্গের ভূত। সাধারণত এই ধরনের ভূত বড় দিঘী সংলগ্ন পুরাতন কোন গাছে বা সরাসরি পুকুরেই বসবাস করে। মাছ এদের খুব প্রিয় খাবার, যদিও কাঁচা মাছ খাওয়ার ঘটনা খুব একটা শোনা যায় না। রাতের বেলা রান্নারত গৃহিণীদের কাছে এরা নাকিসুরে মাছ চেয়েছে, এরকম ঘটনা বিভিন্ন লেখকের লেখায় লিপিবদ্ধ আছে। শাকচুন্নি মাঝে মাঝে মানুষের ঘাড়েও ভর করে। তবে এরা বেছে বেছে শুধুমাত্র অবিবাহিত মেয়েদের ঘাড়েই ভর করে। শাকচুন্নির হাতে মানুষ মারা গিয়েছে, এমন ঘটনা শোনা যায় না।

২। মামদো ভূতঃ কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি মারা যাওয়ার পর প্রেত লোকের বাসিন্দা হয়, তবে তাকে মামদো ভূত বলে। এটি পুরুষ লিঙ্গের ভূত। মামদো ভূত সাধারনত পুরাতন বাড়িসংলগ্ন বড় গাছ বা ফাকা বিলের মধ্যে বড় কোন গাছ বা পুরানো পরিত্যক্ত পাত কুয়ার আশেপাশে বসবাস করে। এরা কিছুটা বদরাগী গোছের হয়। মানুষের ঘর বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি ও ভাঙচুর করে। মামদোভূতের হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনা শোনা যায়।

৩। ব্রহ্মদৈত্যঃ ব্রাহ্মণ বর্নের কেউ যদি মারা যাওয়ার পর প্রেতলোকের অধিবাসী হয়, তবে তাকে ব্রহ্মদৈত্য বলে। এটি পুরুষ লিঙ্গের ভূত। সাধারণত ব্রহ্মদৈত্যরা পুরাতন বাড়িতে বসবাস করে। এমনকি মানুষ এবং ব্রহ্মদৈত্য এর সহবস্থানেরও বিভিন্ন ঘটনা বইতে লিপিবদ্ধ আছে। তবে কাটাওয়ালা গাছে এরা বসবাস করতে পছন্দ পরে।  ব্রহ্মদৈত্যকে কোথাও চুপচাপ লাজুক গোছের ভূত হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে কোথাও খুবই বদরাগী নির্মম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্রহ্মদৈত্যের হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনাও শোনা যায়।

৪। পেত্নীঃ ভূতের মধ্যে সবচেয়ে নিম্নবর্ণের ভূতের নাম পেত্নি। এটি স্ত্রী লিঙ্গের ভূত। এরা সাধারণত শেওড়া গাছে বাস করে। প্রধান খাদ্য কাঁচা মাছ। ইলিশ মাছের প্রতি এদের খুব লোভ। বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে ফেরার সময় পেত্নীর পিছু নেয়ার ঘটনা প্রতিটি গ্রামেই কয়েকবার ঘটেছে। পেত্নী নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার ঘাড়ে ভর করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের উপর বেশি ভর করে। সদ্য বিবাহিতা নারীদের এরা বিশেষভাবে পছন্দ করে । পেত্নীর হাতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনাও শোনা যায় ।

 ৫। স্কন্ধকাটাঃ স্কন্ধকাটা সম্বন্ধে খুব একটা তথ্য জোগাড় করতে পারিনি। এরা সাধারণত বন বা জংলা অঞ্চলের অধিবাসী। এদের দেহ আছে কিন্তু মাথা নেই। এবং মানুষ এদের সামনে পড়লে সাধারণত জীবিত অবস্থায় ফেরে না। এরা মানুষের দেহ বা কোন প্রাণীর দেহ নিয়ে মানুষের সামনে হঠাৎ উদয় হয় এবং কখনও ঘাড় মটকে বা রক্ত চুষে মেরে ফেলে।

এর বাইরেও বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত ভূতের কাহিনী ।

(আমার এই লেখার তথ্য বিভিন্ন লেখকের ভূতের গল্প থেকে সংগ্রহ করা । এর পাশাপাশি গ্রাম্য মানুষের ভূতের প্রতি ধারণা থেকেও কিছু কিছু সংগ্রহ করেছি । ভূত আমাদের লোকজীবন ও সাহিত্যের একটা অংশ। ভূতের উপর এখনও কোন গবেষণা বা বই প্রকাশিত হয়েছে বলে এখনও শুনি নি। কারো খোঁজে যদি এই ধরনের কোন ডকুমেন্ট থাকে তাহলে জানালে উপকৃত হব)

……….

প্রবন্ধটি লিখেছেনঃ বায়রনিক শুভ্র

Leave a Comment