মিনি প্রবন্ধ সিরিজটি ফেসবুকে লেখা ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের সংকলন। পোস্টগুলো সংকলনের তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। কেবল সময় ও চিন্তাকে ধরে রাখা। বুড়ো বয়সে মানুষ যৌবনের ডায়েরি পড়ে যে সুখ পায়, আমিও হয় তো সেটা পাব এগুলোতে চোখ বুলিয়ে।

………………

১. অজ্ঞতা ও উন্নতি (০২.০৪.১৮)

৫০০ বছর পূর্বে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় খুবই খারাপ ছিলো। ইউরোপের উন্নতির পিছনে ছিল ‘অজ্ঞতা’কে স্বীকার করা। পনের শতক থেকে ইউরোপীয় দর্শনের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ালো ‘I don’t know’. এই অজ্ঞতাকে ভিত্তি করেই তারা পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলো সম্পর্কে জানে না, সেগুলো খুঁজতে বেরিয়ে গেলো। এই দর্শনই ক্রমে তাদেরকে বিজ্ঞানে উৎসাহী করলো। তারা দেখলো যে, প্রকৃতি সম্পর্কে আসলে অনেককিছুই অজানা রয়ে গিয়েছে। আর সে অজানাকে জানতে তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে শুরু করলো।

জেমস কুক অস্ট্রেলিয়া আবিস্কার করেছিলেন পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব নির্ণয় করতে গিয়ে। সেই যাত্রায়ই তারা আরো আবিস্কার করলেন স্কার্ভি রোগের চিকিৎসা। মূলত স্কার্ভি রোগের উপশমই ইউরোপিয়ানদের প্রথম ভাবতে শিখিয়েছিলো যে, ধর্মযাজকরা সব জানে না, খ্রিস্টানিটিকে যেভাবে ভাবা হয়েছিলো যে, এটা সবকিছুর উত্তর জানে, আসলে তা সত্য নয়।

ডারউইন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আবিস্কার করেছিলেন ম্যাপিং জাহাজের জিওলোজিস্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে। ততদিনে ইউরোপিয়ানদের এমন ধারণা হয়েছিলো যে, কোন দেশ আবিস্কারের সাথে সেখানে যা কিছু আমরা নিতে পারি, তার জন্য নাবিক ও নৌবাহিনীর সাথে সাথে বিজ্ঞানীদেরও প্রয়োজন। কারণ, বিজ্ঞানীরাই পারবে নতুন কিছু পেলে তা সম্পর্কে আমাদের ধারণা দিতে।

অজ্ঞতাকে স্বীকার করেই পশ্চিমারা বিদ্যুৎ আবিস্কার করলো, ব্যাকটেরিয়া আবিস্কার করলো, রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার করলো। বিজ্ঞানকে প্রযুক্তিতে ব্যবহার করে ক্রমে তারা শিল্পবিপ্লবের দিকে ধাবিত হলো। তারা বিজ্ঞান গবেষণায় আরো আরো ব্যয় বাড়াতে লাগলো। তারা পৃথিবী থেকে মহাকাশ জয়ের ভাবনা শুরু করলো। তারা মহাশূন্যে লোক পাঠালো, চাঁদে লোক পাঠালো, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার একচেটিয়া রাজত্ব কায়েম করলো।

পশ্চিমারা যখন ‘আমরা কিছুই জানি না’-কে ভিত্তি করে ক্রমে অর্থনৈতিকভাবে ধনী হতে লাগলো, আমরা তখন ‘আমরাই সব জানি’ বা ‘কুরানে/পূরাণে সব আছে’ বলে ক্রমে পিছিয়ে পড়তে থাকলাম। আজ পশ্চিমাদের সাথে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান আকাশ আর পাতালের। কিন্তু আজও আমরা অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে শিখলাম না। আমরা আসলে কিছুই শিখি না।

২. অপরাধপ্রবণ বিশ্ব (০২.০৪.১৮)

বিশ্বে অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে এশিয়ার অবস্থান সবথেকে ভাল। আর সবথেকে খারাপ আমেরিকা। আমেরিকা অঞ্চলে প্রতি এক লাখে ১৬ জন মানুষ হত্যার (intentional homicide) শিকার হয়; এশিয়ায় মাত্র ২.৯, যা ইউরোপ (৩.০) এবং ওশেনিয়া (৩.০) অঞ্চলের থেকেও ভাল।

পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে বেশি ইনটেনশনাল হত্যা হয় ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলোতে। অনেক দেশেই প্রতি লক্ষে এর হার ৫০-এর কাছাকাছি বা ওপরে। মধ্য আমেরিকার দেশগুলো এবং দক্ষিণ আমেরিকার অবস্থাও বেশ ভয়াবহ। দক্ষিণ আমেরিকার ড্রাগ ওয়ার সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই জানি। উত্তর আমেরিকার মধ্যে কানাডায়ই কেবল বাংলাদেশের চেয়ে হত্যার হার কম।

দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো। হানাহানি খুনোখুনিতে আফ্রিকাদের পরিচিতি সবার জানাই। অবাক করার বিষয় হলো নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকাতে (৩৪.২৭) বাংলাদেশের চেয়ে দশগুণেরও বেশি হত্যা হয়।

ওশেনিয়া অঞ্চলে অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে হত্যার হার খুব কম (এক এর নীচে) হলেও মিলেনিশিয়া এবং মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলে হত্যার হার বেশি বলে পুরো অঞ্চলের পরিসংখ্যনে তার প্রভাব ফেলে।

পশ্চিম ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পৃথিবীর সবচেয়ে কম হত্যা হয়। উত্তর ইউরোপে লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া বাদ দিলে তাদের অবস্থাও পশ্চিম ইউরোপের মতো ভাল।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ায় মালদ্বীপই একমাত্র দেশ যেখানে লাখে হত্যার হার (০.৮৫) এক এর নীচে। পাকিস্তান সবার ওপরে (৭.৮)। এরপরে আছে আফগানিস্তান (৬.৫৫) ও ইরান (৪.১২)। বাংলাদেশ এই হার ২.৫১, যা ভারত (৩.২১), ভুটান (২.৭৫) ও শ্রীলঙ্কার (২.৯১) চেয়ে কম। বাংলাদেশের অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (৪.৮৮) চেয়েও ভাল।

যেজন্য এই ঘাটাঘাটি করছিলাম, এখন তা বলি। আমাদের দেশে হত্যার হার এতো কম হলেও হত্যার সংখ্যা খুব বেশি। কারণ বাংলাদেশ অত্যন্ত জনবহুল ও ছোট একটা দেশ। আমেরিকার পত্রিকাগুলো হয় প্রদেশভিত্তিক, ভারতেও তাই। কিন্তু আমাদের পত্রিকা মানেই তা জাতীয় পত্রিকা; স্থানীয় পত্রিকা থাকলেও তাদের তেমন পরিচিতি নেই। আমাদের পত্রিকা সারা দেশেরই সংবাদ করে ও সারা দেশের অপরাধ নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়। আমাদের চোখে তাই অপরাধগুলো খুব বেশি মনে হয়।

বিঃদ্রঃ এই স্ট্যাটাস অপরাধ জায়েজের জন্যে না, জাস্ট সত্যটা তুলে ধরার জন্য।

৩. যৌনশিক্ষা (০৪.০৪.১৮)

মেয়ের স্কুল থেকে ইমেইল দিয়েছে যে, আগামী শুক্রবারে তাদের ক্লাসে শরীর, যৌনতা বিষয়ে পাঠদান করা হবে। তাদেরকে পরে sexual assault এর ওপরে কিছু ভিডিও-ও দেখানো হবে।

যৌনতা বিষয়ক পাঠদান হবে পুরো ক্লাসের সবার জন্য। আর মেয়েদেরকে আলাদা করে আজ ঋতুচক্র বিষয়ে পাঠদান করা হয়েছে। আমি এবং প্রতিভা অবশ্য মেয়েকে এ ব্যাপারে আগেই কিছুটা বলেছি।

আমার মেয়ের বয়স ১১। ওদের ক্লাসের সবার বয়স এরকমই। কারো এগার পূর্ণ হয়েছে, কারো পূর্ণ হবার পথে। মাসিক ঋতুচক্র আসতে হয় তো আরো দু’বছর লাগবে। এরই মধ্যেই ওদেরকে যৌনতা, যৌন অপরাধ, ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশে যৌনতা শব্দটাই যেন ট্যাবু; ওটা উচ্চারণ করাই পাপ। আমাদের সময়ে তো পাঠ্য বইয়ে এ বিষয়ে কিছুই ছিলো না। আমরা যৌনতা শিখতাম বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে, যার অনেকটা জুড়েই থাকতো কল্পনা-জড়ানো মিথ। আমি নিজে কতকটা শিখেছিলাম এক রাখালের কাছ থেকে, কতকটা বন্ধুদের কাছ থেকে। আরেকটু বড় হয়ে শিখেছিলাম চটি পড়ে। আজ বুঝতে পারি সেই শিক্ষা কতটা ভুল ছিল।

বাংলাদেশের ক্লাস সিক্সের বিজ্ঞান বইয়ে শরীরবিজ্ঞান বিষয়ক একটা চ্যাপ্টারে ঋতুচক্র নিয়ে লেখা থাকায় হেফাজতরা সেটা তুলে নেবার দাবি জানিয়েছিলো। জানি না হেফাজতের দাবি মেনে নেয়া হয়েছিলো কিনা। পাঠ্যবই থেকে না তুললেও শিক্ষকরা যে যৌনতা বিষয়ে পড়াতে অস্বস্তি বোধ করেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যৌনতা বিষয়টাতে এমনিতেই ফ্যান্টাসি জড়িয়ে থাকে। তার ওপর যদি তা শিখতে হয় নিজে নিজে কিংবা রসময় গুপ্তের চটি পড়ে, তা যে উদ্ভট ও বিকৃত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে যৌন বিষয়ক অপরাধ কমাতে চাইলে যৌনশিক্ষার বিকল্প নেই। হেফাজতদের কথা শুনে সিলেবাস পাল্টালে তাতে দেশে ধর্ষণ বাড়বে বই কমবে না।

৪. রাষ্ট্র ও ধর্ম (০৮.০৪.১৮)

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পৃথিবীর কোন দেশেই ভাল ফল এনে দেয়নি। হয় তা দেশে গৃহযুদ্ধ ডেকে এনেছে অথবা মানুষের মতপ্রকাশের ও চলাফেরার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এতসব উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কেন সেদিকেই হাঁটছে?

বাংলাদেশে যারা ইসলামী শাসন চায়, মানে যাদের ভোটের জন্য আমাদের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল ইসলাম তোষণ করে, তারা কি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী? ইসলাম কি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে অনুমোদন করে?

না, ইসলাম গণতন্ত্র অনুমোদন করে না। কারণ ইসলামের প্রচারলগ্নে বিশ্বে কোন গণতন্ত্র ছিলো না। ঐ সময়ে বিশ্বে রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিলো। ইসলামের খিলাফত রাজতন্ত্র বৈ কিছু নয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এগুলো খুবই আধুনিক ধারণা। তাই ইসলামে এসবের উল্লেখ বা অনুমোদন না-থাকারই কথা।

ইউরোপের আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্রের সূত্রপাত হয়েছিলো চার্চকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করেই। আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে হলে এর কোন বিকল্প নেই। বিশ্বে আপাতত গণতন্ত্রের চেয়ে ভাল কোন শাসনব্যবস্থা নেই। কল্যানমূখী রাষ্ট্রগুলো গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্রের একটা মিশেল করে গণতন্ত্রের যে মডেল দাঁড় করিয়েছে, সেটাই এখন সবচেয়ে আধুনিক ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। ভবিষ্যতেও যদি এর চেয়ে ভাল কোন শাসনব্যবস্থা আসে, সেটাও যে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে দূরে রাখবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যাত্রাও শুরু হয়েছিল ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আলাদা করে। সেটা ছিল খুবই আধুনিক চিন্তা। তার ফলও আমরা পেয়েছিলাম। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় দুই দশক বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদির কোন অস্তিত্বই ছিলো না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার পর থেকেই বাংলাদেশে এসবের শুরু। দিন দিন যে অবস্থা আরো খারাপ হবে, তার ইঙ্গিত আমরা পেলেও রাজনৈতিক দলগুলো কি পাচ্ছে না? নাকি এতেই তাদের লাভ?

রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্মের ব্যবহার শুরু হয়েছিলো রাজার শাসন ও শোষণ ক্ষমতাকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে। সেটা ছিল এক অসভ্য সময়। আমরা কি সেই অসভ্যতায়ই বেঁচে থাকবো? জন্মলগ্নে আমাদের রাষ্ট্র যে সভ্যতার ইঙ্গিত দিয়েছিল, আমরা কি ফের সেখানে ফিরতে পারি না?

৫. কোটা প্রসঙ্গে (০৯.০৪.১৮)

কোটা সিস্টেমের ব্যাপারে সিরিয়াসলি কিছু বলি। চাকুরিতে নিয়োগের ব্যাপারে কোটা প্রথা চালু আছে পৃথিবীর বহু দেশেই। কিন্তু কেন এই কোটা সিস্টেম? কোটার ব্যাবহার যে কারণেই শুরু হোক, বর্তমানে এটি ব্যবহৃত হয় কোন প্রতিষ্ঠানে বা দেশে কোন বিশেষ পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর রিপ্রেজেন্টেশন বাড়াতে।

নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা চিরকালই নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অবহেলিত। আমরা সভ্যরা তাদের ভূমি কেড়ে নিয়েছি, তাদের সমাজ, সংস্কার, পেশা, সংস্কৃতি সবকিছু কেড়ে নিয়েছি। এজন্য তারা সবসময় চেষ্টা করেছে আমাদের মতো সভ্য জঙ্গিদের থেকে দূরে থাকার। আমাদের প্রবর্তিত একাডেমিক শিক্ষায় তারা অভ্যস্ত হতে পেরেছে কেবলই দু’এক প্রজন্ম হলো। তাই শিক্ষা, চাকুরি সবখানেই তাদের রিপ্রেজেন্টেশন কম। যেহেতু ইতিহাসজুড়ে তাদেরকে আমরা কেবল বঞ্চিতই করে গিয়েছি, তাই তাদেরকে জাগিয়ে তোলার দায়িত্বও আমাদের। আর তাই আদিবাসী কোটা সারা পৃথিবী জুড়ে এখনও খুবই প্রচলিত একটি কোটা পদ্ধতি।

পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের নারীরাও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুদের মতোই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে ছিলেন। শিক্ষায়, প্রফেশনে তাঁদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে একশ বছরের কিছু বেশি হলো। তাই তাদের রিপ্রেজেন্টেশনও একসময় খুব কমই ছিলো। যেসব দেশে সমতা এসেছে, সেখানে বহু আগেই এ ধরণের কোটা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। শিক্ষায় বাংলাদেশে এখন নারী ও পুরুষের হারে খুব পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। ব্যানবেইসের ডাটা অনুশীলন করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরী এখন।

প্রতিবন্ধী কোটাও খুবই প্রচলিত একটি কোটা পদ্ধতি। এটা একটা মানবিক বিষয় এবং বিষয়ে কারো কোন আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। জেলা কোটার আদৌ কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ এতো ছোট একটা দেশ যে, এখানে জেলা আর দেশের পার্থক্য খুবই কম।

কোটা নিয়ে কথা বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি কথা ওঠে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গে, কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার তুলনায় এই কোটাটি খুব বেশি বলেই মনে হয়। সেটাও আসলে বিষয় নয়। এখানে যেটা দেখার দরকার, বাংলাদেশের চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের রিপ্রেজেন্টেশন কি কম আছে? গত আড়াই দশকে তাদের জন্য ৩০% কোটা বরাদ্ধ থাকার পরেও এমনটা হওয়া অসম্ভব। বরং তারা ওভার-রিপ্রেজেন্টেডই হওয়ার কথা। তাহলে তাদের জন্য কোটা রাখা কি তাদের জন্য প্রিভিলেজ দেয়া নয়? হ্যাঁ, নিহত বা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য বিশেষ কোটা রাখা যেতে পারে, তবে সুস্থ-সামর্থ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য আর কোটা থাকার আবশ্যকতা একদমই নেই বলে মনে করি।

মোদ্দা কথা, চাকুরিতে কোটা প্রথার খুব বড় ধরণের সংস্কার প্রয়োজন। সেই সাথে প্রয়োজন বিসিএস পরীক্ষাটাও তুলে দেয়া। এটা একটা ব্রিটিশ আমলি সিস্টেম, যা ব্রিটিশরা বহু আগে ত্যাগ করলেও উপমহাদেশে যে এটা কেন জিইয়ে রাখা হয়েছে, তা বোধগম্য নয়।

৬. ছাত্রলীগের ছাত্র রাজনীতি (১০.০৪.১৮)

বাংলদেশের ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি করে বলেই কোন তরুণ রাজনীতিবিদ উঠে আসে না। দলীয় নেতারা মনে করে এই পা-চাটা কুত্তাবৃত্তির মানুষ দিয়ে বাড়ি পাহারা দেয়া সম্ভব, বড় জোড় শিকার করানো সম্ভব, রাজনীতি সম্ভব না। আর তাই আমাদের রাজনীতি দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়ী ও বুড়োরা।

রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হওয়ার অব্যবহিত পরে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কোন বিরোধী রাজনৈতিক দল ছিলো না। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগই তাদের প্যারেন্ট সংগঠনের নেতাদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করতো। ভাষা আন্দোলন বিষয়ে ছাত্রলীগের অবস্থানকে পাল্টে দিতে, আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে মুসলিম লীগের নেতারা ছাত্র নেতাদের মন্ত্রীত্ব দেয়ার লোভও দেখিয়েছিলেন, কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

সেইসব ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক, আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, প্রভৃতি।

বঙ্গবন্ধু যদি বর্তমান ছাত্রলীগের মতো পা-চাটা রাজনীতি করতেন, তিনি কোনদিন বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না; তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ-প্রদর্শক হতে পারতেন না। তাদেরকে থাকতে হতো অন্যদের পদতলে, অথবা হারিয়ে যেতেন কোন অতলে কেউ নামই জানতো না।

কোটা বাতিল আন্দোলন ছাত্রদের প্রাণের আন্দোলন। ছাত্রলীগ যদি সত্যিই ছাত্রদের জন্য রাজনীতি করতো, তাহলে আন্দোলনকারীদের ওপরে হামলা বা হুমকি-দামকি দিতো না, বরং আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতো। আর তাহলে যে জামাত-শিবির এই আন্দোলনে ভাগ বসানো দূরের কথা, নাক গলানোরই সুযোগ পেতো না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ছাত্রলীগ মুখে বঙ্গবন্ধু শব্দটা অহরহ উচ্চারণ করে বটে, বঙ্গবন্ধুকে প্রাণে ধারণ করার যোগ্যতা তারা রাখে না, বা রাখার চিন্তাও করে না।

৭. শান্ত পৃথিবী (১১.০৪.১৮)

পরিসংখ্যান বলছে দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের পরও বিংশ শতাব্দী ছিল মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তির শতাব্দী। আর একবিংশ শতাব্দী তো একেবারেই নিরামিষ। কয়েকটা যুদ্ধ হয়েছিল বটে, তবে তাতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা আত্মহত্যায় মৃতের সংখ্যার চেয়ে অনেক কম।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা পৃথিবীতে যত মানুষ খুন হয়, তার চেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা মোটেই আমাদের জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নয়, এটা ক্যাপিটালিজমের কনসিকোয়েন্স।

এমতাবস্থায় আমাদের প্রজাতিগত ঐতিহ্য, মানে হানাহানি খুনোখুনি বজায় রাখতে আমাদের আরো বেশি বেশি মৌলবাদকে জাগিয়ে তুলতে হবে ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে হবে।

সৌদি আরব এ ব্যাপারে রিটায়ার্ড করছে, আমেরিকা ট্রাম্পকে নির্বাচিত করে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, ইউরোপ তো সেই ১৯৪৫ থেকেই নীরব। মনুষ্য প্রজাতির এই দুর্দিনে এরদোগান আর শেখ হাসিনাই আমাদের ভরসা। তারাই আমাদের বাপ-মা। আশা করি তাঁরা মানুষকে আশাহত করবেন না।

৮. ইসলাম সংস্কার (১৫.০৪.১৮)

ইসলামকে সংস্কারের একটা ‘শয়তানি’ বুদ্ধি মাথায় এলো। এটাকে শয়তানি বুদ্ধি নামকরণ করা হয়েছে, কারণ এর সাথে শয়তান জড়িত। যেহেতু মোহাম্মদ নিজেই এটা অনুসরণ করেছিলেন, তাই এটা অনৈসলামিক বিবেচিত হওয়ারও কথা না।

সুরা আন-নাজম (সুরা নং ৫৩) যখন প্রথম নাজিল হয়েছিল, তখন এতে তিনটি আয়াত (১৯, ২০ এবং ২১) ছিল কাবার তিন দেবী লাত, উজ্জা ও মানত সম্পর্কে, যারা কুরাইশ দেবতা আল্লাহর কন্যা। প্রথম দুটি আয়াতে কেবল তিন দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছিল যা এখনও অবিকৃত আছে, কিন্তু তৃতীয় আয়াতটিতে আল্লাহর কন্যাদের প্রশংসা করা হয়েছিলো। এই আয়াতটি পরবর্তীতে বাতিল করা হয়েছিল এই বলে যে, আয়াতটি ফেরেশতা জিব্রাইল নয়, বরং শয়তান দিয়েছিল। মোহাম্মদ শয়তানকে চিনতে পারেননি।

মূল বিষয়ে যাওয়ার আগে ঐ আয়াতটি সম্পর্কে আরো একটু বলি। পূর্বের আয়াতটি যে বাক্যটি দিয়ে পরিবর্তন করা হয়েছিল, সেটা খুবই ইন্টারেস্টিং। “পুত্র-সন্তান কি তোমাদের জন্যে এবং কন্যা-সন্তান আল্লাহর জন্য?” আল্লাহ যে একজন পৌত্তলিক দেবতা যাকে আরবে পূর্ব থেকেই পূজা করা হতো, তার প্রমাণ কোরানের এই আয়াত। পরের আয়াতটা আরো ফানি। “এমতাবস্থায় এটা তো হবে খুবই অসংগত বণ্টন। (২২)” মোহাম্মদ ঠিকই বলেছেন, তোমাদের নিজেদের পুত্র আছে, অথচ আল্লাহর কেবল তিন মেয়ে, এটা খুবই অসংগত বণ্টন।

যা বলতে চাচ্ছিলাম, সেই প্রসঙ্গে আসি। মোহাম্মদ নিজেই শয়তানের দোহাই দিয়ে কোরানের আয়াত বাদ দিতে পারলে এ যুগের ইসলামী চিন্তাবিদরা বসে কোরানের জঙ্গি আয়াতগুলো বাদ দিতে পারবে না কেন? কোরানে যে-সব আয়াতে মানুষ হত্যা করতে বলা হয়েছে এবং অন্যদের ঘৃণা করতে বলা হয়েছে, সেগুলোও তো শয়তানের আয়াত হতে পারে।

একটা উদাহরণ থাকা মানেই অন্যগুলোর জন্যও তা প্রযোজ্য হওয়া স্বাভাবিক। মোহাম্মদ যে কেবল একবারই শয়তানকে জিব্রাইল ভেবেছিল, এমন ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ আছে কি? হয় তো শয়তান চেয়েছে মোহাম্মদের উম্মতেরা সারা জীবন মারামারি-কাটাকাটি করে কাটাক। আর তাই সে ছদ্মবেশে জঙ্গি আয়াত ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

যেসকল মুসলমানগণ ইসলামকে জঙ্গিমুক্ত করে শান্তির ধর্ম হিসেবে প্রচার করতে চান, তারা ঐ আয়াতগুলোকে শয়তানের আয়াত হিসেবে যুক্তি দেখাতে পারেন খুব সহজেই। ঐ আয়াতগুলো এবং জঙ্গি হাদিসগুলো ব্যবহার করেই মুসলমানদেরকে সন্ত্রাসী বানানো হচ্ছে। মুহম্মদ ও আল্লাহর শত্রু শয়তান তো এটাই চেয়েছিল যে মুসলমানরা মারামারি কাটাকাটি করে বিলীন হয়ে যাক।

‘ভাল’ মুসলিমদের উচিত শয়তানের আয়াতগুলো বেছে বেছে বের করে ইসলামকে শয়তানের কবল থেকে মুক্ত করা। নইলে সারা জীবন খুনোখুনি করেই মরতে হবে।

৯. বাংলা বর্ষপঞ্জি (১৫.০৪.১৮)

উপমহাদেশে ক্যালেন্ডার প্রচলনের ইতিহাস ইউরোপিয়ানদের থেকেও পুরোনো। বার চান্দ্রমাসে বছর হিসেব করলেও সে ক্যালেন্ডারে কয়েক বছর পরে পরে এক মাস বাড়িয়ে দিয়ে সৌর বছরের সাথে সমন্বয় করা হতো। তাদের হিসেব-নিকেশ এমন সূক্ষ্ণ ছিল যে, তারা লিপ-ইয়ারকেও এভাবে সমন্বয় করতো। পরবর্তীতে এটাকে পুরোপুরি সৌর ক্যালেন্ডারে রূপান্তরিত করা হয়।

উপমহাদেশের যে ক্যালেন্ডারটি সেই ৫৬/৫৭ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে আজও চালু আছে, তার নাম ‘বিক্রম সম্বাদ’ বা বিক্রমী বর্ষপঞ্জি। এটির নামকরণ করা হয়েছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের নামানুসরণে। আজও নেপালে এটিকে অফিসিয়াল ক্যালেন্ডার ধরে সেখানে অনুষ্ঠানাদি পরিচালিত হয়। গতকাল সেখানে ২০৭৫ সাল শুরু হয়েছে। বিক্রমী বর্ষপঞ্জিতে আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারের মতোই বারো মাসে বছর হিসাব করা হয় এবং তাদের বার মাসের নাম বাংলার মতোই বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য … চৈত্র; কেবল অগ্রহায়নকে ওরা মংসির বলে।

সম্রাট আকবর বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেছিলেন, এমন ধারণা আসলে সত্য নয়। আকবরের শাসনের পূর্বে তৈরি এমন দুটি মন্দিরে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটি পাওয়া গিয়েছে। আকবরের রাজত্বকালীন সময়ে প্রচলিত বাংলা সৌর ক্যালেন্ডারের সাথে হিজরি চান্দ্র ক্যালেন্ডারের সমন্বয় করা হয়েছিল।

সারা বিশ্বে প্রচলিত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি তুলনামূলকভাবে খুবই নতুন। এটা চালু করা হয়েছিল ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে সমন্বয় করে। আর এটা করেছিলেন তখনকার পোপ।

বাংলা ক্যালেন্ডারে রয়েছে হিন্দুয়ানি গন্ধ, গ্রেগরিয়ানে খ্রিষ্টানিটির। অতএব এ দুটোই হারাম। আসুন মুমিন ভাইরা, আমরা দেড় হাজার বছর পূর্বে চালুকৃত এবং সৌর বছরের সাথে অসমন্বয়কৃত হিজরী ক্যালেন্ডারে ফিরে চাই। চিন্তা-চেতনায় ওখানে পড়ে থাকলে, কেবল ক্যালেন্ডারে আধুনিক হয়ে লাভ আছে কি কিছু?

১০. নববর্ষ ও মৌলবাদ (১৮.০৪.১৫)

অনেকের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে অবগত হলাম যে, এ বছর নববর্ষ উদযাপনকে লক্ষ্য করে দেশের মুসলিম সমাজের একাংশ একাট্টা হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল। অনেক মসজিদের ইমামরা শুক্রবারের জুমার নামাজ পূর্ববর্তী আলোচনায় নববর্ষ উদযাপনকে অনৈসলামিক ও হারাম দাবি করে নামাজীদের শপথ করিয়েছিল যাতে কেউ বৈশাখী মেলায় না যায়।

বাংলাদেশে যতগুলো উৎসব রয়েছে, তার মধ্যে বর্ষবরণই একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এই দিন মানুষ ঘরের বাইরে নেমে আসে। মঙ্গল শোভাযাত্রা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো শহরকেন্দ্রিক হলেও গ্রামে গ্রামে এই দিনে মেলা হয়। একটা দিনের জন্য মানুষ ভেদাভেদ ভুলে আনন্দ উদযাপনে কাটায়। এতেই মৌলবাদী মুসলিমদের আপত্তি। মানুষ আনন্দ করবে কেন? ইসলামে আনন্দ-ফূর্তির অনুমোদন নেই।

মুসলিম হলে আপনাকে সারাদিন মুখ-গোমড়া করে বসে থাকতে হবে। আর যতদিন দেশটাকে দারুল-ইসলামে পরিণত করতে না পারছেন, ততদিন আপনাকে জেহাদের কথা ভাবতে হবে ও জেহাদ করে যেতে হবে। আপনি তখনই হাসবেন, যখন দেশে আর কোন অমুসলিম থাকবে না, কোন মূর্তি থাকবে না, কোরানিক শিক্ষা ছাড়া আর কোন শিক্ষা থাকবে না, দেশে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠিত হবে, নারীরা বোরকাবৃত হয়ে চলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ও ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবগুলোকে রক্ষা করা রাষ্ট্রের অবশ্য দায়িত্ব। আমাদের রাষ্ট্র তা পালন করতে ব্যর্থ। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে উল্টো অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিতে দেখা যায়। সরকারী উদ্যোগে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে তিনি মোল্লাদের, ইমামদের ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি বিষেদগার করার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছেন।

সত্যিকারার্থে আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ধর্মনিরপেক্ষ নন। অবচেতনে তিনিও বাংলাদেশে দারুল-ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। আর তাই সংবিধানকে জলাঞ্জলি দিয়ে বারবার ‘আমার ধর্ম’ ‘আমার ধর্ম’ কথাগুলো উচ্চারণ করেন। তিনি বুঝতে পারেন না যে, ব্যক্তি শেখ হাসিনার ধর্ম থাকতে পারে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোন ধর্ম হয় না।

Leave a Comment