খাপছাড়া আড্ডাদর্শনপ্রবন্ধ

লালন ও আমাদের সংস্কৃতি

[লিখেছেনঃ সাইফুল ইসলাম]

সংস্কৃতির ব্যাপকতা ঠিক মহাকাশের মত, দুটোই সৃষ্টি অবধি প্রসারমান এবং কখনোই একই স্থানে স্থির থাকে না। বেঁচে থাকার তাগিদে বা জীবনের প্রয়োজনে মানুষ সদা স্থানান্তরিত জীবনধারণে অভ্যস্ত। সে-কারনে মানুষ প্রাক আধুনিক সভ্যতায় প্রাকৃতিক পরিব্রাজন নীতি গ্রহণ করেছিল, আর বর্তমানে আধুনিক সভ্যতার সুবিধাদি গ্রহনের জন্য প্রতিনিয়ত স্থানান্তরিত হচ্ছে। সেই সাথে সংস্কৃতিও স্থানান্তরিত হয়ে অন্যের সাথে মিশে খিচুড়ি পাকিয়ে নতুন সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা বাঙালি।

কালের গর্ভে বিলিন হয়ে মানুষ কোন একদিন নতুন রূপ পরিগ্রহ করবে। সেদিনের মানুষেরা আমাদের আজকের এই সময়কে মূল্যায়ন করবে তাদের পূর্বসূরি হিসেবে। যান্ত্রিক জীবনে এর প্রয়োজন যে খুব একটা থাকবে, তা হলফ করে বলা যায় না। তবে জীবন যতই যান্ত্রিক হোক, জীবনের ফাঁকেফাঁকে আমাদের মত কিছু মানুষ চিরকালই থাকবে, যারা আত্বসুখের জন্য সময় ও কাজের বলিদান দিয়ে সংস্কৃতি ধরে টানাটানি করে খুঁজতে চাইবে কতদূর তাদের বিস্তৃতি, ঠিক যেন পুকুরভর্তি কলমিলতার এক লতা ধরে নাড়া দিয়ে তার বিস্তৃতি খোঁজার মত। পরিশেষে মনে হবে সমস্ত পুকুর জুড়ে এটার বিস্তৃতি। আপনাদের কাছে এটার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে, তবে আমাদের সংস্কৃতিতে লালনকে খুঁজতে গিয়ে এমনি মনে হয়েছে। এটাও মানুষের আত্বসুখ পাওয়ার একটা উপায় বৈকি।

পরিচয়ঃ
লালনের শৈশব, যৌবন, প্রৌঢ় কোনটারই ঐতিহাসিক প্রমাণপত্র পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায় তা থেকে তাঁর জন্ম তারিখ উদ্ধার সম্ভব নয়, তবে আনুমানিক জন্মসাল আবিষ্কৃত হয়েছে। সেইমতে তাঁর জন্মসাল ধরা হয় ১৭৭৪ এবং মৃত্যু তারিখ ১৭ অক্টোবর ১৮৯০। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ১১৭ বছর, তবে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী বাংলা পহেলা কার্তিক পালন করা হয়ে থাকে।

লালনের সমসাময়িক কালে তাঁর জন্ম পরিচয় নিয়ে যে একধরনের রহস্য ছিল তা তাঁর গানের মধ্যেও পাওয়া যায়। একটা গানে তিনি বলেছেন, ” আমি লালন একই শিরে // ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে// ভেসেছিলাম পক্স জ্বরে// মলম শাহ উদ্ধার করেছিল মোরে।। এ থেকে বোঝা যায় উনি নিজেই তাঁর পরিচর প্রকাশ করেননি অথবা শৈশবকে ভুলে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন লেখকের কল্পনায় যে পরিচয় পাওয়া যায় তার প্রামাণিক ভিত্তি মেলে না। তবে লোকমুখে বা তার গানেও যেটুকু জানা যায়, উনি বসন্ত আক্রান্ত হয়ে ভেলায় ভেসে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে কালিগঙ্গা নদীর ঘাটে আসেন। [সেকালে গুটিবসন্ত রোগের কোন চিকিৎসা ছিল না। এ রোগ হলে তাকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়ার জনশ্রুতি আছে।] সেখানে মলম শাহের স্ত্রী গোসল করতে গেলে উনাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করেন এবং সেবা শুশ্রূষার মাধ্যমে সারিয়ে তোলেন। সেই থেকে মতিজান ফকিরানিকে লালন মা বলে সম্মোধন করতেন। এখানে উল্লেখ্য যে, মলম শাহ তখন কোরানের হাফেজ ছিলেন পরবর্তীতে লালনের শীষ্যত্ব গ্রহন করেন, যার সমাধি লালনের আখড়াতে বিদ্যমান। লালনের পাশে মতিজান ফকিরানিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।

লালনের জীবদ্দশায় তৎকালীন স্বনামধন্য লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকের সাথে তাঁর সখ্যতা ছিল বলে জানা যায়। এবং এই সমস্ত কবি সাহিত্যিকের লেখায় একই ভাবধারা কিছুটা পরিলক্ষিত হয়। তাদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মোশারফ হোসেন ও কাঙ্গাল হরিনাথ উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য লালনের একমাত্র স্কেচটি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

লালন মতবাদঃ
লালন মূলত এই ভূ-ভাগে প্রচলিত লোক ধর্মের ধারক বাহক ছিলেন। তিনি যে কোন নতুন মতবাদের জন্ম দেননি, তা আজ সবার জানা আছে, বিশেষ করে যারা বাংলা ও বাংলার সংস্কৃতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন। গবেষনায় পাওয়া যায় এই ভূখন্ডের মানুষেরা আর্য পূর্বকাল থেকে সাংখ্য ও যোগ ধর্ম বা সংস্কৃতির ধারক ছিল, যার বর্তমান বিবর্তিত রুপ বাউল, সাই, দরবেশ, ফকির, ন্যাড়া- সহজী, কর্তাভজা, স্পষ্টদেখা, সখীভাবুক, খুশিবিশ্বাসী, হরিবালা, সাহেবধনী, বলরামী, বোষ্টম- বোষ্টমী, কিশোরীভজনী, জগন্মোহিনি, ইত্যাদি। এগুলো এখনও সমাজের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ধর্ম হিসেবে টিকে আছে। লালন ফকির এদের একজন। এদের অধিকাংশের ধর্মের উপজীব্য বিষয় গান এবং দেহ সাধনা। এরা সবাই জাতপাত বিচার করে না। সর্বোপরি মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে। ফলে এরা দেশ কাল, জাতি, সংস্কৃতির মধ্যে আটকে থাকা পছন্দ করে না, বা সংস্কৃতির চর্চা করা এদের করন কার্যের মধ্যে পড়ে না। এরা মুলত ধর্ম চর্চা করে, তাই এদের ধর্মে সব ধর্মের থেকে মানুষ আসে।
আর্য পরবর্তিকালে এদেশের মানুষের উপর বৈদিক ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার ঘটে। কিন্তু এদেশের কিছু মানুষ তাদের নিজস্ব রীতি পরিত্যাগ করতে না পেরে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মধ্যে থেকে গোপনে তন্ত্র, মন্ত্র, সাংখ্য, যোগ সাধনার চর্চা করতো। তাই আজও এরা তাদের সাধনা গুপ্তভাবে করে থাকে। সাধন ভোজন শুধু ভক্তদের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এই ধর্মকে বা সংস্কৃতিকে এই অঞ্চলের আদিমতম সংস্কৃতি বললেও অত্যুক্তি হয় না।

লালনের গুরু ছিলেন সিরাজ শাহ। ঠিক লালনের সমসাময়িক আরেকজন খ্যাতনামা ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়, যার নাম পাঞ্জু শাহ্‌। পাঞ্জু শাহের গুরু ছিলেন হেরাজতুল্লা। লালন যে মৌলিক চিন্তার প্রবর্তক নন, তা প্রমানের জন্য এর বেশি দলিল আমার মনে হয় প্রয়োজন নেই।

সাধন পন্থাঃ
গুরু তুমি পতিত পাবন পরম ঈশ্বর // অখন্ড মন্ডলাকরম ব্যক্তম গুরু চরাচর।। লালন বা লোকধর্ম আসলে গুরুকেন্দ্রিক ধর্ম। এখানে গুরুকে পরম ঈশ্বর জ্ঞান করা হয় এবং ব্যক্তির গুপ্ত উন্মুক্ত সকল কর্ম গুরু নামে জ্ঞান করে পরিচালিত হয়ে থাকে। গুরু শিষ্যকে গুপ্তজ্ঞান দান করে, যা অন্য কেউ জানবে না আর শিষ্য কখনো কারো কাছে প্রকাশ করবে না। এরা অখণ্ড জীবন বলতে রতিক্রিয়া মুক্ত নারী পুরুষের মিলন ক্রিয়া বুঝিয়ে থাকে, যাতে সন্তান ধারন হবে না এবং দেহ খন্ডিত হবে না। এই দেহ সাধনায় বাতাসের ভূমিকার প্রাধান্য বেশি দেখিয়ে থাকে। যেমন লালল এক গানে বলছেন, “কে বানাল এমন রঙ মহলখানা// হাওয়া দমে দেখ তার আসল ব্যানা।। ” আবার আরেক গানে বলছেন “সে কি সামান্য চোরা ধরবি কোণা কাঞ্চিতে// ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাদ পেতে।।

এরা দেহবাদি ধর্মের অনুসারী এবং দেহ অভ্যন্তরেই ঈশ্বর খুজে ফেরেন। প্রথাগত ধর্মের মত এরা নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন। লালন তাঁর গানের ভাষায় বলছেন “পাতালে চোরের বহর দেখায় আসমানের উপর।” আরেকটি গানে আরো পরিস্কার উপমা পাওয়া যায়, যেখানে বোঝানো হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা মানুষের মাঝেই বিরাজমান। তিনি বললেন, “আল্লা কে বোঝে তোমার অপার লীলা// তুমি আপনি আল্লা ডাক আল্লা বলে।। নিরাকারে তুমি নূরি// ছিলে ডিম্ব অবতারি।। সকারে সৃজন করলে ত্রিভুবন, সে আকারের চমৎকার ভাব দেখালে।।”

হিন্দুদের মতো এরা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। লালনের ভাষায়- “চিনলাম না-রে গুরু কী ধন//জানলাম না তার সেবা সাধন// ঘুরতে বুঝি হল রে মন জনম চৌরাশি।।” উল্লেখ্য জন্মান্তরবাদে প্রতিটি আত্মা চুরাশি হাজার বার বিভিন্ন প্রাণীর দেহে পরিগ্রহ লাভ করে। কর্মফল ভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই জন্ম চলতে থাকে। সাধন-ভজনে পরিশুদ্ধ হতে পারলেই আত্মা স্বর্গলাভ করতে পারে। পন্ডিতদের বিশ্লেষনে দেখা গেছে যে, এই সমস্ত লোকধর্মের সহিত স্থানিক প্রচলিত ধর্মের কিছু সংমিশ্রণ ঘটে নতুন ধারার সুচনা হয়েছে যা আজও বিদ্যমান। লালনের মতবাদ তাঁর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ।

লালন আখড়ার পার্শ্ববর্তী গ্রামে বাড়ি হবার সুবাদে এবং ধর্ম বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকার দরুন আমার নিজেরও বিভিন্ন লালন শিষ্যদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার সুযোগ হয়েছে। তাদের যে অংশ মুসলমান সম্প্রদায় থেকে এসেছে, তারা বিশ্বাস করে যে লালন মুহম্মদের ধর্ম প্রচার করে গেছেন। আর হিন্দু অংশের ভক্তরা লালনকে চৈতন্য ধর্মের অনুসারী বলে মনে করে থাকে। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে লালনের কিছু গানে ইসলামি শব্দ ব্যবহৃত হলেও কার্যত আচার বিধি চৈতন্য বা বাংলার লোকায়ত ধর্মের অনুরূপ।

লালনের যে বিষয়টা বিশ্বকে আকৃষ্ট করেছে, তা হল তাঁর সুললিত ছন্দময় গানের ভাষা ও সুর। এইরূপ ধর্মভিত্তিক গান পূর্বেও ছিল, কিন্ত তা সংরক্ষণ বা আধুনিক ভাষার কাছাকাছি না হবার জন্য মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু লালন সেদিক দিয়ে সফল হয়েছেন। ফলে আজ তাঁর গান নিয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন পড়েছে। এইখানেই লালন আমাদের সংস্কৃতির ধারক বাহক হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা এই লোকায়ত ধর্মটায় আমাদের এই বাংলার আদিমতম সংস্কৃতি যা অন্য কোন ধর্মে খুজে পাওয়া যায় না।

চলুন এবার একটি লালনের গান শোনা যাক।

সময় ও জ্ঞানের অভাবে অনেক বিষয় এখানে উপস্থাপন করতে পারলাম না। লোকায়ত ধর্ম ও আমাদের সংস্কৃতির সম্পর্কের শিখর এত গভীরে যে এই বিষয় গভীরভাবে জানতে হলে অনেক বই পড়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে সময় বের করা অত্যন্ত দুরুহ ব্যপার। তবুও মনের খোরাকের জন্য কিছু সময় রাখতে হয় বলে আজকে এই বোদ্ধামহলে এবিষয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে আমার এই খুদ্র প্রচেষ্টা।
সাহায্যকারী পুস্তক:
বাংলার বাউল— ডক্টর আনোয়ারুল করিম।
বাংলার ধর্ম দর্শন — সম্পাদনায় রায়হান রাইন
স্বদেশ অন্বেষা– আহম্মদ শরীফ।

…………

[এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে অনলাইনভিত্তিক সাপ্তাহিক পাঠচক্র ‘খাপছাড়া আড্ডা’য় ১৫.০২.২০১৮ তারিখে পাঠের উদ্দেশ্য।]

Leave a Comment