জঙ্গিবাদপ্রবন্ধবাংলাদেশ

আদিবাসী পল্লীতে হামলাঃ জঙ্গিবাদ কি?

আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নাইজেরিয়াসহ অনেক দেশেই দেখা যায় জঙ্গিরা পাহাড় বা বনের মতো দুর্গম এলাকাগুলো দখল করে সেসব এলাকায় ইসলামিক শাসন চালু করেছে। বন বা দুর্গম এলাকার সুবিধা হলো এসব স্থানে পৌঁছার মতো খুব বেশি যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে না। যে দু’চারটা এন্ট্রি-পয়েন্ট থাকে, সেগুলো আয়ত্ত্বে নিয়ে সহজেই দেশের অন্য অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায়। পুলিশ বা সেনাবাহিনী কখনো চেক-পয়েন্টগুলো ভেদ করতে পারলেও পড়তে হয় এ্যামবুশে। সবকিছু অতিক্রম করেও যদিবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রবেশ করতে পারে, জঙ্গিদের পালানোর জন্য রয়েছে গহীন বন বা পাহাড়ী গুহা। বন বা পাহাড় থেকে প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে এসে লোকালয়ে সন্ত্রাসী হামলা করে আবার অভয়াশ্রমে ফিরে যাওয়া অনেক দেশের জঙ্গিদেরই একটি পরিচিত কর্ম।
কিন্তু কোন এলাকা জঙ্গিরা দখল করে নিলেও ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু করা কিন্তু এতো সহজ না। সেখানে বসবাসরত অধিবাসীদের বড় একটা অংশের সমর্থন ও সহায়তা প্রয়োজন। ওপরে যে-কটা দেশের নাম লিখেছি সেগুলোর সবটাতেই যে-সব স্থানগুলো জঙ্গিদের দখলে আছে, সবখানেই জনগণ প্রচণ্ডরকম ধর্মান্ধ, যাদের অনেকেই তালিবানি বা ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন ও সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের জঙ্গিরা সমতলে খুব একটা এগিয়ে উঠতে পারছে না। হোলি আর্টিজানের সন্ত্রাসী হামলার পরে জঙ্গিরা যতবারই তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, পুলিশ-সেনাবাহিনী তা গুড়িয়ে দিয়েছে। যদিও জঙ্গিদের রিক্রুট বা জঙ্গি তৈরির কারখানাগুলো বেশ সগর্বেই, কখনো কখনো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে, পুলিশ-র‍্যাব-সেনাবাহিনীর রেইডে তাদের প্রাণহানীর সংখ্যাও কিন্তু একেবারে কম নয়। এসব প্রতিকূলতাকে এড়াতে জঙ্গিরা কি এখন তবে পার্বত্য জেলাগুলোর দিকে চোখ ফিরিয়েছে? গত কয়েকমাস যাবত আদিবাসীদের ওপর যেভাবে ক্রমাগত দলবদ্ধ হামলা হচ্ছে, এ থেকে আমার কিন্তু এমনটাই মনে হয়।
আপাতদৃষ্টিতে এই হামলাগুলো সাধারণ বাঙালি সেটেলারদের সংঘবদ্ধ হামলা বলে মনে হলেও, হামলাকারীদের বাঙালি বা সেটেলার ছাড়াও আরো একটা পরিচয় রয়েছে। খতিয়ে দেখা উচিত যারা এদেরকে সংঘবদ্ধ করছে তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয়টাকে সামনে আনছে কিনা। এখানে একটা ব্যাপারে বলে রাখা ভালো যে, বাঙালিদের আমরা যতটা অসাম্প্রদায়িক ভাবি, আমাদের অতীত উদাহরণগুলো কিন্তু মোটেই তা সাপোর্ট করে না। পাকিস্তান শাসনামলে বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা পরবর্তীতেও যতো সংখ্যালঘু নির্যাতন বা তথাকথিত দাঙ্গা হয়েছে, তার প্রত্যেকটাই হয়েছে গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে উস্কে দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বৃহত্তর ফরিদপুরের প্রায় সব হিন্দু বাড়িতে হামলাতে মিথ্যা বা গুজবেরও প্রয়োজন হয়নি, কেবল মালামাল লুট করতেই মুসলমান আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা গ্রামের পর গ্রাম, থানার পর থানা হিন্দু বাড়িগুলোকে ছাড়খাড় করে দিয়েছিলো।
পাহাড় থেকে পাহাড়ি-আদিবাসীদের তাড়াতে পারলে জঙ্গিরা যে সেখানে সহজেই অভয়াশ্রম গড়তে পারবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা দেশের মতো ঐসব অঞ্চলেও ধর্মান্ধতা বাড়ছে; সাথে রয়েছে বিরাট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যারা মায়নমারে বৌদ্ধদের তাড়া খেয়ে এসেছে এবং এর ফলে এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর (যাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী) ওপর রাগ থাকারই কথা। মায়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাঙালি মুসলমানদেরও বৌদ্ধদের ওপর রাগ রয়েছে। এদেরকে আদিবাসীদের প্রতি উস্কানো মোটেই কঠিন কাজ নয়।
সব মিলে পরিবেশটা কিন্তু জঙ্গিদের পক্ষেই আছে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হলো, পাহাড় থেকে আদিবাসীদের সংখ্যাটা কমিয়ে আনতে পারা। আর এর জন্য তাদের মাঝে আতংক ছড়ানোই সবচেয়ে সহজ ও প্রমাণিত পন্থা।
লুট ছাড়াও আতংক ছড়ানোর আরেকটা সহজ পন্থা হলো ধর্ষন। মিহির সেনগুপ্ত ‘বিষাদবৃক্ষ’ বইয়ে লিখেছেন কিভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের দিনগুলোতে কোন একটা গ্রামে একটা হিন্দু মেয়ের ধর্ষনের খবর শুনলে আশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রাম থেকে হিন্দুদের ভারতে চলে যাবার হিড়িক পড়ে যেতো। আগেও এসব কাজ করা হতো পরিকল্পিতভাবে, এখনও তাই করা হয়।
আরেকটা বিষয়, জঙ্গিদের কার্যক্রম সল্প ও দীর্ঘ দুই মেয়াদেই সমান্তরালভাবে চলতে থাকে। আমরা এখানে সেখানে দু’চারটা হত্যার যে চিত্র দেখি, এটা সল্পমেয়াদী রূপ; আর এই মাঝে মাঝে সংখ্যালঘু-আদিবাসীদের ওপর হামলা ও ধর্ষন, এগুলো দীর্ঘমেয়াদী রূপ। তাদের আল্টিমেট লক্ষ্য ইসলামী শাসনব্যবস্থা তথা শরিয়াহ চালু করা।
কর্তৃপক্ষ (আসলে কর্তৃপক্ষটা কে?) এসব দিক বিবেচনা করে দেখবে কি?

Leave a Comment