জঙ্গিবাদপ্রবন্ধবাংলাদেশ

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সুপারিশমালা

জঙ্গিবাদ প্রতিকার নিয়ে অগাস্ট মাসে একটি ব্লগ লিখেছিলাম। সেখানে আমি একগুচ্ছ সুপারিশ করেছিলাম। দেশজুড়ে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ প্রতিকারে কিছু পদক্ষেপ নিলেও প্রতিরোধে কোন পদক্ষেপই নিচ্ছে না, উল্টো তাদের অনেক কার্যক্রমেই মনে হয় তারা জঙ্গিবাদকে লালন করছে। মজার বিষয় হলো, সরকারের জঙ্গিবাদ প্রতিকারের দু’একটি পদক্ষেপ আমার সুপারিশের সাথে মিলে গিয়েছে, বিশেষ করে মসজিদে খুতবা তদারকিতে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম, এটি একটি পরিচিত প্রবাদ। জঙ্গিবাদ প্রতিকার বিষয়ে লেখার পরে দীর্ঘ দিন অতিক্রম করলেও প্রতিরোধ বিষয়ে লেখা হয় নি। লেখা না হওয়ার মূল কারণ আমার সুপারিশগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করা সম্ভব কিনা, সে বিষয়ে আমি সন্দিহান। তবুও মনে হলো যে, লিখে রাখি; নিজের তরফ থেকে নিজেকে দায়মুক্ত করা বলা যেতে পারে একে।

এখানে বিষয়ভিত্তিক ভাগ করে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে, যা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সকল মুসলিম বা অমুসলিম দেশেও প্রযোজ্য। আমি যেহেতু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিখেছি, এবং বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বলতে ইসলামী জঙ্গিবাদই বুঝিয়ে থাকে, তাই আমার লেখাটি ইসলাম ধর্মকে কেন্দ্র করেই রচিত; কোন হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য কোন ধর্মের ক্ষেত্রে কেবল ধর্মের নামটি পরিবর্তন করলেই তা সেই ধর্মের জন্য প্রযোজ্য হবে। আপনাদের কোন সুপারিশ থাকলে সেসব যোগ করে লেখাটি ভবিষ্যতে ইংরেজিতে অনুবাদ করারও ইচ্ছে আছে।

 ১. শিক্ষা সংস্কারঃ

শিক্ষা সংস্কারের সুপারিশগুলো একটা আরেকটার সাথে ওভারল্যাপিং হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই একটা বাস্তবায়ন করলে আরেকটার আর প্রয়োজন পড়বে না। তাই সুপারিশগুলোর সবগুলো না হলেও কিছুসংখ্যককে বিকল্প সুপারিশমালা বলা যেতে পারে; তবে একটা অপরটার পুরোপুরি বিকল্প হয়ে ওঠে না বলেই আমি বিভিন্ন শিরোনামে আলোচনা করেছি।

 ক. একমুখী শিক্ষানীতিঃ

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে পাঁচ প্রকার শিক্ষাব্যবস্থা। ১. সরকারী সিলেবাসে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা, ২. সরকারী সিলেবাসের সাথে ইসলামি শিক্ষাসহ আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা, ৩. সরকারী সিলেবাসসহ অধিকতর বই পড়ানো কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা, ৪. ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা, ৫. কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা। মাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েছে সাধারণ শিক্ষা, দুই প্রকারের মাদ্রাসা শিক্ষা এবং O লেভেল। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারী ও বেসরকারী কলেজ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা এবং A লেভেল। উচ্চতর শিক্ষায় রয়েছে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রী (পাশ), চার বছর মেয়াদী সম্মান, মাস্টার্স। এখানেও রয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা (উচ্চতর শিক্ষায় মাদ্রাসা কী পড়ায় আমার জানা নেই। তারা যাই পড়ুক সেটার চেয়েও বড় কথা হলো যে- সরকার একেও সাধারণ শিক্ষার সমতুল্য ঘোষণা করেছে)। উচ্চতর শিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়; রয়েছে দারুল ইহসানের মত নাম-সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, যারা প্রায় প্রতিটি জেলায় তাদের আউটার ক্যাম্পাস নামক অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি করছে। এছাড়া রয়েছে সরকারী এবং ভুঁইফোরের মত জেগে ওঠা বেসরকারী ভোকেশনাল ও টেকনিক্যাল কলেজ।

এসকল শিক্ষাকে একটি শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে এনে দেশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইত্যাদির ওপর জোর আরোপ করে এমন একটি একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা অতি আবশ্যকীয়। পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নত দেশেই মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত একটি মাত্র শিক্ষা ব্যবস্থাই পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানের বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন উপযোগীতা তৈরি করে, যা শিশু বয়সেই দেশের মানুষকে বিভাজিত করতে শুরু করে, যা জঙ্গিবাদের অন্যতম কারণ। পরবর্তী সুপারিশগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

খ. মাদ্রাসা শিক্ষা বাতিল

জঙ্গি প্রতিকার বিষয়ে লেখাটিতে মাদ্রাস শিক্ষা সম্পর্কে ও এর সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত এবং মুসলমানদের উন্নতির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বিবেচনায়ও কেন মাদ্রাসা শিক্ষা বাতিল করা উচিত, সে বিষয়ে লিখেছিলাম ‘মাদ্রাসা শিক্ষার অপ্রয়োজনীয়তাঃ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। পাঠকগণ এসকল বিষয়ে যদিও এমনিতেও অবগত, তবুও চাইলে পড়ে নিতে পারেন।

মাদ্রাসা শিক্ষা একদিকে সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেয়। দ্বিতীয়ত, এই শিক্ষায়, বিশেষ করে কওমি শিক্ষায় যেহেতু একেবারেই জাগতিক শিক্ষা দেয়া হয় না, তাই কর্মজীবনে ভাল আয় করার মতো কোন রোজগার তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। বেশিরভাগই দেশে আরো মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি করে কোনরকমে পেট বাঁচানোর চিন্তা করে। কিন্তু একটি দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বানানোরও একটা সীমা আছে। একদিকে বেহেশতের অপরিসীম লোভের ওপর ভিত্তিতে প্রাপ্ত নৈতিক শিক্ষা, যা তাদেরকে ভোগবাদীতার প্রতি উদাসীন করতে পারে না; অপরদিকে বাস্তব জীবনে তাদের অযোগ্যতা; এই দুই মিলে জীবন সম্পর্কে তারা হতাশ হয়। এর সাথে মাদ্রাসার জিহাদি শিক্ষা যোগ হয়ে তাদেরকে জিহাদে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইহজাগতিক অপূর্ণ সাধ বেহেশতে পূরণের স্বপ্ন দেখায়, যার শেষ পরিণতি জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়া। এছাড়া দেশের অনেক মাদ্রাসায়ই জঙ্গিবাদের শিক্ষাই নয় কেবল, প্রশিক্ষণও দেয়া হয়, যা প্রায়শই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়।

এর বাইরে দেশের সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্যও মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ হওয়া জরুরি। এই শিক্ষা এমনই বিকৃত এক শিক্ষা যে, এখান থেকে শিক্ষিতরা(!) নারীর প্রতি অবমাননামূলক দৃষ্টিভঙ্গির শিক্ষা পায়; এদের কাছে দেশাত্ববোধের চেয়ে আরবিত্ববোধ বেশি হয়; এরা নিজ দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে ঘৃণা করে এবং আরব দেশের শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বড় করে দেখে; এমনকি এদের কাছে নিজ দেশের মাটির চেয়েও আরব দেশের মাটি বড় হয়ে দাঁড়ায়। এরা বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখকে ঘৃণা করে; এরা শহীদ মিনারকে ঘৃণা করে; স্মৃতিসৌধকে ঘৃণা করে; এরা জাতীয় সংগীতকে পর্যন্ত ঘৃণা করে। এসবের সাথে দেশের অন্য ধর্মের মানুষদের ও আদিবাসীদের সকল শিল্প, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকেও ঘৃণা করে। যে শিক্ষাব্যবস্থা দেশের জাতীয় বিষয়গুলোকে ঘৃণা করতে শিখায়, কেবল রাজনীতির জন্য সে শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা যাবতীয় সাহিত্যকেই অপ্রয়োজনীয় মনে করে। সাহিত্য সমাজ ও জীবনের প্রতিফলনস্বরূপ, যা না পড়ে একজন মানুষ তার নিজস্ব বা অপর সমাজকে জানতে পারে না, তার রুচিকে যুগোপযোগী করতে পারে না। অপর সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন না জানলে অপরের প্রতি মমত্ববোধ জন্মায় না, যা তাদেরকে নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ করে এবং তারা নিজ মতবাদ বা দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর হয় এবং তা করতে গিয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে।

গ. বিজ্ঞানভিত্তিক ও কর্মমুখী শিক্ষানীতিঃ

প্রথমে যে একমুখী শিক্ষানীতিটির কথা উল্লেখ করেছি, তা হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক ও কর্মমুখী। বর্তমানে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নবম শ্রেণী থেকে বিজ্ঞান, কলা ও বানিজ্য এরকম তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। শিক্ষানীতিটি এরকম না হয়ে এস.এস.সি পর্যন্ত সবার জন্য একইরকম শিক্ষা হওয়া উচিত, যাতে পর্যাপ্ত বিজ্ঞান শিক্ষা থাকবে। বিজ্ঞান শিক্ষা ছাড়া জঙ্গিবাদকে প্রতিরোধ করা আদৌ সম্ভব নয়। বিজ্ঞান শিক্ষা কেবল বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা নয়, বিজ্ঞান চেতনাকে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে শিক্ষাকে সাজাতে হবে। আমাদের বর্তমান প্রজন্মে দেখা যায়, ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও একজন বলে বসেন যে, কোরানে বা মহাভারতে বিজ্ঞান আছে। তারা সারাজীবন বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করেও বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানে না। তারা জানে না, বিজ্ঞান মানে কোন ভবিষ্যতবাণী নয়; বিজ্ঞান মানে তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্তের মাধ্যমে বিশ্লেষণমূলক জ্ঞান। ধর্মগ্রন্থের কোন লাইনের অর্থকে টুইস্ট করে ভবিষ্যতবাণী জাতীয় কিছু একটা খুঁজে বের করলে সেটা বিজ্ঞান হয় না, আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা যতোদিন এ বিষয়টিকে শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রবেশ না করাতে পারবে, ততোদিন একজন ইমাম একজন ডাক্তার/প্রকৌশলীকেও বিজ্ঞান শিখিয়ে জঙ্গি বানিয়ে ফেলতে পারবে।

একটা দেশের সব মানুষ উচ্চ শিক্ষা পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে ছাত্র/ছাত্রীদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করা বাঞ্চনীয়। দেশে বর্তমানে অনেক বেসরকারী টেকনিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু সেগুলোর শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রন করা খুবই জরুরী। পড়াশুনা শেষে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা থাকলে তরুণরা হতাশ হবে না, যা তাদেরকে জঙ্গিবাদের জড়াতে কম উৎসাহ যোগাবে।

ঘ. বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা বাতিলঃ

পৃথিবীর অনেক দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোন ধর্ম শিক্ষা দেয়া হয় না। জঙ্গিবাদ দমন করতে হলে বাংলাদেশেও এটি গ্রহণ করা অপরিহার্য। আমরা ধর্মগ্রন্থগুলোতে দেখতে পাই, একেক ধর্মের ঈশ্বর একেকরকম, সৃষ্টিতত্ত্ব একেকরকম, ধর্মীয় আরাধানা একেকরকম। এছাড়া ইসলাম ধর্মে কিছু ঘৃণামূলক শিক্ষা দেয়া হয়- ‘আল্লাহ সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র ঈশ্বর’, মূর্তিপূজা হারাম, কাফেরদের (যারা আল্লাহকে অস্বীকার করে, মানে অন্য ধর্মের উপাসক) বিরুদ্ধে জিহাদ (যুদ্ধ ও হত্যা) ফরজ। শৈশব থেকেই শিশুরা এভাবে বিদ্যালয়ে তার সহপাঠীর ঈশ্বরকে, তার সংস্কৃতিকে, সর্বোপরী সহপাঠীকেই ঘৃণা করতে শেখে, যা চূড়ান্তরকম অনভিপ্রেত। নৈতিক শিক্ষার সাথে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল ধর্ম বিষয়ক সাধারণ শিক্ষা দেয়া যেতে পারে, যাতে কেবল ধর্ম বিষয়ক আচার-অনুষ্ঠানগুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থীই ভিন্ন ধর্মের সহপাঠীর ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে পারবে এবং এতে তারা একে অন্যের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগ্রহ বোধ করতে পারে এবং এতে একের প্রতি অপরের ভাল-লাগা ও সহানভূতি তৈরি হতে পারে। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে ধর্মকে ঐচ্ছিক করা যেতে পারে। কারণ, এ সময়ে একজন ছাত্র যে বয়স অর্জন করে, তাতে সে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাপ্ত অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার আলোকে ধর্মশিক্ষার বিভাজনকে বিচার করতে পারবে।

ঙ. সিলেবাস সংশোধনঃ

পাঠ্যসূচীতে পর্যাপ্ত ইতিহাস, শিল্প, সংস্কৃতির মিশেল অত্যন্ত জরুরী। বাংলাদেশের পাঠ্যসূচীতে স্বাধীনতা এবং ভাষা আন্দোলন বিষয়ক কবিতাগুলো মানোত্তীর্ণ হলেও বেশিরভাগ গল্প-প্রবন্ধগুলোতে আবেগের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বাঙালির কাছে এ দুটো বিষয় খুবই আবেগ বহন করে, পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে শিশুদেরকে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেয়া উচিত। এছাড়া বাংলা বইগুলোতে যে জীবনীগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সেখানে আরবের মানুষদের জীবনী বেশি পরিলক্ষিত হয়, যা চরমভাবে হাস্যকর। বাংলাদেশে এতো সাহিত্যিক, কবি, রাজনীতিবিদ থাকতেও জীবনীতে আরবদের অন্তর্ভুক্তি কেন তা টেক্সটবুক প্রণেতারাই ভাল জানেন। কবিতার ক্ষেত্রে কিছু উদ্ভট কবিতা অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়, যেমন, ‘তুলি দুই হাত, করি মোনাজাত, হে রহিম রাহমান’। ধর্মশিক্ষা থাকতেও কেন যে এসকল কবিতা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়, তা বোধগম্য নয়।

চ. বিবিধঃ

বাংলা সাহিত্যে ব্যবহারের জন্য আল্লাহ/ভগবান/গড ইত্যাদির একটা নিরপেক্ষ শব্দ আছে, ঈশ্বর। কিন্তু বর্তমানে অনেক স্কুলেই শপথ পাঠ করানোর ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যবহৃত হচ্ছে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেকেই এটা মানেন না। শিশুদেরকে শৈশব থেকেই, অন্তত বিদ্যালয় থেকে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি শেখানো উচিত। এছাড়া শিক্ষকদেরকে ‘সালামুআলাইকুম’ এবং ‘আদাব’ বলার বিষয়টাও পরিবর্তিত হওয়ার দরকার। ধর্মভেদে এই পার্থক্য দূর করে সবার জন্য একই বাংলা শব্দ ‘শুভ সকাল’ অনুশীলন করানোটা যুক্তিসংগত। আমি এর সাথে ইংরেজী ‘হাই’ বলারও পক্ষপাতি।

২. ধর্ম সংস্কারঃ

হিন্দু ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্রাহ্মণ্যবাদের চরম বর্ণপ্রথা থেকে উত্তোরণে এরকম আরো অনেকের নামই উল্লেখ করা যায়, যদিও তাদেরকে সেভাবে বিবেচনায় নেয়া হয় না। চৈতন্যদেবের মানবতাভিত্তিক বৈষ্ণববাদ, রামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’, বিবেকানন্দর ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’, অনুকুলচন্দ্রের সৎসঙ্গ, এমনকি হরিচাঁদ ঠাকুরের ‘ব্রাহ্মন-বর্জন নীতি’- এগুলোকেও ধর্ম সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কারণ, এগুলো ধর্মকে সহনীয় পর্যায়ে নিতে সাহায্য করেছে বা বর্ণবাদকে অতিক্রম করার সাহস যুগিয়েছে।

 শিক্ষা ছাড়া কোন সমাজ থেকে ধর্মকে হুট করে তুলে দেয়া যায় না। স্ক্যান্ডিনেভিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশে ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, কারণ এখানে শিক্ষা ধর্মকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। সুতরাং দেশের মানুষ সুশিক্ষিত না হওয়া পর্যন্ত ধর্মের মধ্যে থেকে ধর্মসংস্কারকের আবশ্যকতা রয়েই যাবে। ইসলামের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, গত কয়েক শতক ধরে এবং বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে উল্টোটা ঘটেছে। ইমাম গাজ্জালী পরবর্তী ইসলাম বিপরীত দিকে হাঁটছে এবং বাংলাদেশে এর ছোঁয়া আসে পাকিস্তান আন্দোলন ও তৎপরবর্তী পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তান আন্দোলন থেকেই বাংলার সহনশীল সুফিবাদী মুসলমানরা ক্রমে সাম্প্রদায়িক হতে থাকে এবং বর্তমানে তারা কট্টর ওয়াহাবি মৌলবাদী ইসলামে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ধর্মের মধ্যে থেকে ধর্ম সংস্কারের মতো উদ্যোগ নেয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তবুও অনুশীলনে বা আইন করে যেসব বিষয়ে সংস্কার করা যায় সেগুলোতে আলোকপাত করছি।

ক. জিহাদঃ

কোরান অনুসারে জিহাদের যে অর্থই থাক না কেন, সুফিবাদ জিহাদকে অসত্য ও অমঙ্গলের বিরুদ্ধে অন্তরের লড়াই হিসেবে প্রচার করে এসেছে, যা মূলত নিজেকে সংশোধন, অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। ওয়াহাবি মৌলবাদকে হটাতে এই মতবাদের প্রচারকে ফের কতোটা জাগানো সম্ভব, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে ধর্মীয় বইগুলোতে যা-ই থাকুক না কেন, জিহাদ (কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) বিষয়ক যে কোনরকম শিক্ষা, পাঠদান, প্রচার, বক্তৃতা, ইত্যাদি নিষিদ্ধ করতে হবে। যে কোন প্রকার জিহাদি প্রচারণা ও প্ররোচনাকে জঙ্গিবাদ হিসেবে বিবেচনা করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

 খ. ফতোয়াঃ

ফতোয়াকে আইন করে নিষিদ্ধ করা উচিত। একটি দেশের আইন হবে ঐ দেশের সংবিধানের আলোকে, যা  দেশের সব মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। ফতোয়া ধর্মভেদে আলাদা আইন তৈরি করে, যা মানুষকে বিভাজন করে। কোন রাষ্ট্র তা অনুমোদন করতে পারে না। তাই কোন সভ্য দেশে ফতোয়ার কোন স্থান থাকতে পারে না।

গ. মাহফিল, খুতবা নিয়ন্ত্রনঃ

এ বিষয়ে প্রতিকার বিষয়ক পোস্টে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। মাহফিলে বা খুতবায় কোন প্রকার জিহাদি, সাম্প্রদায়িক ও নারী অবমাননামূলক বক্তৃতা আইন করে বন্ধ করতে হবে। এ ধরণের অপরাধকে জঙ্গিবাদ হিসেবে বিবেচনা করে সে আলোকে বিচার করতে হবে।

৩. রাষ্ট্র ধর্ম বাতিলঃ

এটা গবেষণার ব্যাপার যে, বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর এমন কোন রাষ্ট্র আছে কিনা যেখানে সংবিধানে একইসাথে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। রাষ্ট্র ধর্ম মানে দেশের একটি ধর্মের মানুষকে অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান, যা ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। রাষ্ট্রধর্ম রাষ্ট্রের মানুষকে বিভাজিত করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মাধ্যমে বাই ডিফল্ট মুসলমানদেরকে প্রথম শ্রেণির নাগরিক ও অন্য ধর্মাবলম্বীদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের কাছে সব নাগরিক সমান বিবেচিত হওয়া উচিত; ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্র কোন গোষ্ঠিকে সংখ্যালঘু করার অধিকার রাখে না। বাংলাদেশে এর মাধ্যমে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের উগ্র মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। দেশে প্রায় প্রতিদিনের সংখ্যালঘু নির্যাতন মূলতঃ রাষ্ট্রধর্মেরই প্রভাব। এতোদিন ধরে সংখ্যাগুরুরা তাদের মানসিকতাকে লালন করে করে পরিপক্ক করেছে এবং বর্তমানে তার ফল দেখা যাচ্ছে। সুতরাং অবিলম্বে রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করে দেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ক কঠোর আইন প্রণয়ন করে সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ ঠেকানো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যথা, বাংলাদেশ নামটাই কেবল থাকবে, তাতে বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি বলে কিছু থাকবে না।

৪. রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণঃ

সত্যিকারার্থে ব্যক্তিক ধর্মপালন সমাজ বা রাষ্ট্রের তেমন একটা ক্ষতির কারণ হয় না। ব্যক্তি সর্বোচ্চ তার পরিবারকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে। কিন্তু যেখানে কিছু মানুষ একত্রিত হয়, সেখানেই একটা সামগ্রিক শক্তি উৎপন্ন হয় এবং সে একত্রিত হওয়াটা যদি হাজার বছরের পুরোনো কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়, তবে সেই শক্তি সমাজ বা দেশকে হাজার বছর পিছনের দিকেই ঠেলবে, সামনে নয়। কিন্তু কোন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি হাজার/দেড় হাজার বছরের পুরোনো সমাজ ও সংস্কৃতি ধারণ করে, তবে সেই দেশের পক্ষে সামনে আগানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কিছু মানুষ হয় তো ব্যক্তিগতভাবে সমাজ বা দেশকে আগানোর চেষ্টা করে, কিন্তু রাজনীতি তাকে পিছিয়ে দেয়।

বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে জামাতে ইসলামী, বিএনপি, জাতীয় পার্টি কিংবা আওয়ামী লীগের মধ্যে সামান্যতম পার্থক্যও অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। এমনকি বাম দলগুলোও ধর্মকে ব্যবহারে পিছিয়ে থাকছে না; কিছু বামদল তো জিহাদকেই বিপ্লবের আসনে বসাতে চায়। বাংলাদেশের বর্তমান জঙ্গি পরিস্থিতি ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য মূল যে কারণটি দায়ী, তা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শূণ্যে নামিয়ে আনা ছাড়া এই পরিস্থিতির মোকাবেলা সম্ভব নয়।

৫. জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক আইন প্রণয়ন ও দ্রুত বিচারঃ

যে সকল কার্যক্রম জঙ্গিবাদ বলে বিবেচিত হবে, তা নির্দিষ্টকরণ এবং এর অন্তর্ভুক্তির আওতাবৃদ্ধিমূলক এবং বিচারে জামিনের বিষয় ও সাজার মেয়াদ বৃদ্ধিমূলক আইন প্রণয়ন করে যে কোন জঙ্গিবাদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সকল প্রকার জঙ্গি সংশ্লিষ্ঠ অপরাধসমূহ অজামিনযোগ্য ও দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। বর্তমানে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জঙ্গিদের বিচার করতে হলে সরকারের অনুমতি নিয়ে হয়। গত ৭ জুলাই যুগান্তর পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী কেবল ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত ১৩৬টি মামলা স্থবির হয়ে পড়ে আছে সরকারের অনুমোদন না পাওয়ার জন্যে। যে-বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেয়া উচিত ছিলো তাকে স্থবির করে রাখা হয়েছে। আবার আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিন পেয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। ২০১৩ সালে রাজিব হত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বেশ কিছু জঙ্গি গ্রেফতার করা হয়, ২০১৪ সালের শেষ পর্যন্ত এদের মধ্যে সাত জনই জামিনে মুক্তি পায়। সরকার, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ইত্যাদির এমন কার্য একটাই প্রশ্ন তোলে, জঙ্গিবাদ দমনে সরকার কি আদৌ আন্তরিক? নাকি সব লোক দেখানো?

৬. বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ

যে কোন আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা আবশ্যিক। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বেশিরভাগ সময়েই বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে সরকারের হাতের পুতুল হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। বিচার বিভাগ যদি ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক ইশতেহার বাস্তবায়নের কাজ নেয়, সে দেশে কোনদিন আইনের শাসন প্রয়োগ হবে না। আর আইনের শাসন প্রয়োগ না হলে জঙ্গিবাদের আস্ফালন দিন দিন বাড়বে বৈ কমবে না।

৭. গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধিঃ

দেশে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তৎপরতা দমনের লক্ষ্যে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে জঙ্গি দমনের জন্য বিশেষ গোয়েন্দা সেল গঠন করা আবশ্যক। গোয়েন্দাদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অনলাইন ও অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গোয়েন্দা তৎপরতা অধিক বৃদ্ধি করতে হবে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন পেইজে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক হামলার উস্কানীমূলক ব্যক্তিগুলোকে চিহ্নিত করে তাদেরকে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. জঙ্গিবাদে অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ন্ত্রনঃ

এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কার্যক্রম একইরকম। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে ব্যাংকগুলোর প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নজরদারী বৃদ্ধি করলেও কুরিয়ার সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক লেনদেন হয়। এগুলোকে নিয়ন্ত্রনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে অথবা নিয়ন্ত্রনে না আনতে পারলে বন্ধ করে দিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন রিপোর্টিং সফটওয়্যার/এ্যাপস তৈরি করে দেয়া যেতে পারে। এখন যেভাবে সহজে এক মিনিটের মধ্যে কোন রেকর্ড ছাড়াই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অর্থ প্রেরণ করা যায়, এটাকে বন্ধ না করলে অবৈধ অর্থ লেনদেন বন্ধ হবে না। অর্থ প্রেরণ সহজ করতে গিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। এর আগে দেশে জঙ্গি অর্থায়নের সাথে ইসলামী ব্যাংকের সংযোগ পাওয়া গিয়েছিলো। ব্যাংকগুলো ছাড়াও বীমা কোম্পানিগুলোর অর্থ প্রবাহ তদারকি করা বিশেষ আবশ্যক। এছাড়া দেশে প্রচুরসংখ্যক ইসলামী এনজিও রয়েছে, যেগুলো জঙ্গিবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। এগুলো জঙ্গিবাদের সাথে সংযুক্ত প্রমাণিত হলে, সরকারী আত্তীকরণ বা নিবন্ধন বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যিক।

৯. মোবাইল কোম্পানি নিয়ন্ত্রনঃ

মোবাইল কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রনে সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি অপরাধ হয় মোবাইল ব্যবহার করে। প্রতিটি ব্যক্তি যদি তার পার্সোনাল আইডি দিয়ে মোবাইল নম্বর নিতে বাধ্য হয় এবং তা যদি একটা ডাটাবেইজে সংরক্ষিত হয়, তাহলে মোবাইল ব্যবহার করে অপরাধ করা তথা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিনতর হয়ে যাবে।

১০. মিডিয়া নিয়ন্ত্রনঃ

এই অংশটিকে বাকস্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করতে পারেন অনেকেই। কিন্তু মত প্রকাশ আর মানুষ হত্যা বা নির্যাতনের মতবাদ প্রচার এক হতে পারে না। টেলিভিশনে জিহাদ তথা জঙ্গিবাদের সমর্থনমূলক বক্তব্য প্রচারকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জঙ্গিবাদ প্রচারের অভিযোগে পিস টিভির প্রচার পৃথিবীর অনেক দেশে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে এর প্রচার অব্যাহত আছে। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রন যদিও দুঃসাধ্য ব্যাপার, তবুও যে সকল ওয়েবসাইট সরাসরি জঙ্গিবাদ প্রচার করে থাকে, সেগুলোর বাংলাদেশে এ্যাকসেস বন্ধ করতে হবে। এছাড়া যেসকল ডিভিডি, সিডি জঙ্গিবাদে প্ররোচনা দিয়ে থাকে, তা বিক্রি ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলায় ওয়াজাকারী অনেকেরই এ ধরণের ওয়াজ রয়েছে, যাতে জিহাদে অংশগ্রহণের আহবান জানিয়ে ও অমুসলিমদের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদান করে থাকে। এগুলো আইন করে নিষিদ্ধ করে, এসব বক্তব্য প্রদানকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

১১. পৃথক কারাগারঃ

জঙ্গিদের পৃথক কারাগারে রাখার বিধান করা যায় কিনা এ বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে। অনেক জঙ্গিই কারাগারে অন্য অপরাধের দায়ে কারাগারে অবস্থানকারী কয়েদীদের জঙ্গিবাদে দীক্ষিত করে থাকে। সুতরাং জঙ্গিবাদে অভিযুক্তদের আলাদা কারাগারে না রাখলেও, তাদেরকে ভয়ানক ছোঁয়াছে রোগী বিবেচনা করে বিচ্ছিন্ন করে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও জঙ্গিদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক কার্যক্রম একসাথে পরিচালনা করতে হবে। এগুলোর কিছু রয়েছে স্বল্প মেয়াদে ফল দিবে, কিন্তু শিক্ষা সংস্কারের কাজটি দুরুহ ও দীর্ঘমেয়াদী হলেও এটি সম্পন্ন করতে পারলে তা সবচেয়ে ফলপ্রসু হবে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা সংস্কারকে অসম্ভব বলে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে এর কোন বিকল্প নেই।

…………

বিঃ দ্রঃ সরকারের মন্ত্রী পরিষদ, সরকারী কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় চাকুরীরত ব্যক্তিবর্গ, ইত্যাদি মানুষগুলোকে কেবল মানুষ হিসেবে দেশের জন্য কাজ করতে হবে; তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম যা-ই হোক, কর্মক্ষেত্রে তারা মানুষ থেকে মুসলমান হয়ে গেলে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের কোন সুপারিশই বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

Leave a Comment