গল্প

সুলতানার দুঃস্বপ্ন

প্রতিদিনের মতোই সুলতানা রোকেয়া হল থেকে বের হলো। চারপাশে তাকিয়ে তার চোখ ছানাবড়া। তার চারপাশে একটা মেয়েকেও সে হিজাব-বোরকা ছাড়া দেখছে না। ডান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ কচলিয়ে আবার তাকালো সে। রাস্তায় মেয়েদের সংখ্যাও খুব কম। সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। সে নিজেও তার পোষাকের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। না, কোথাও কোন সমস্যা নেই; তবুও সে ওড়নাটা আরেকটু টেনে দিলো।

তার সন্দেহ হলো সে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আছে, নাকি কোন দৈত্য বা পরী তাকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উড়িয়ে নিয়ে এসেছে? রাস্তায় রিক্সা ছুটে চলছে; ওপাশে মামার ভাজা-পোড়ার দোকানে ছেলেদের ভিড়; টিএসসির মোড়ে ডাস রেস্তোরা; ওপাশে টিএসসি; মাঝখানে রাজু ভাস্কর্য। সবই ঠিক আছে। কেবল মেয়েদের কোন স্বাভাবিক পোষাক নেই; সবাই বোরকা-হিজাবাবৃত।

সুলতানার অতসব ভাবার সময় নেই। তাকে টিউশনিতে যেতে হবে। সে ডাস রেস্তোরার দিকে হাঁটা শুরু করলো। ওখান থেকে এক কাপ কফি কিনবে। তারপর তা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগে যাবে। শাহবাগ থেকে শেওড়াপাড়া। তারপর পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ভিতরে এক গলির মধ্যে যেতে হবে। সেটুকু সে হেঁটেই যায়। অন্য অনেকের মতো বিকেলের সময়টায় প্রেমিকের হাত ধরে সময় পার করতে পারে না সে।

বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। শীত পড়তে শুরু করেছে বেশ। কিন্তু এ বছরে তার কোন শীতের পোশাক কেনা হয়নি। গত বছরেরটা শীতের শেষে বাড়িতে রেখে এসেছিলো। টিউশনের ছাত্রীটির স্কুল ফাইনাল হয়নি এখনো; তাই বাড়িতে যাওয়ার সময়ও পাচ্ছে না সে। ওড়নাটা গলায় পেঁচিয়ে দেবে ভাবছিল সে। কিন্তু সবাই যেভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে তাতে সুলতানা ভয় পাচ্ছে।

ডাস রেস্তোরা থেকে কফি নিলো সুলতানা। অর্নামেন্টাল রাবার গাছটার গোড়ায় দাঁড়িয়ে কফির কাপে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় কে যেন ধমকে উঠলো, “এই মেয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে তুমি বেল্লেলাপনা করছো কেনো?” লোকটার গলার স্বারে সুলতানা চমকে উঠলো। প্রথমে ভেবেছিল অন্য কাউকে বলেছে বোধ হয়, কিন্তু দেখলো লোকটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে। লোকটা আবারও ধমক লাগালো, “কী হলো? কথা কানে যাচ্ছে না?”

সুলতানা চটে গেলো। তার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাকে একজন ধমকাচ্ছে। তার রাগও লাগলো যে কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। সে রাগের সাথেই বললো, “কেন? আমার পোষাকে বেল্লেলাপনা দেখলেন কোথায়?”

লোকটা চোখ-মুখ খিঁচে বললো, “তুমি কি এইমাত্র আকাশ থেকে পড়লে নাকি? তুমি জানোনা যে, তিন মাস আগে সংসদে আইন পাশ হয়েছে, যে কোন নারী বাইরে বের হলে অবশ্যই হিজাব বা বোরকা পরে বের হবে। হিজাব-বোরকা ছাড়া কেউ বাইরে বের হলে তার ন্যুনতম এক সপ্তাহের জেল এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না যে, এখানে কোন মেয়ে তোমার মতো বেআব্রু নেই। লজ্জা করছে না তোমার?”

লোকটা তার আইডিকার্ড দেখালো। সেখানে লেখা- ‘নারীদের সম্মানরক্ষার্থে বিশেষ পুলিশ’।
সুলতানা জোরে চীৎকার দিয়ে উঠলো- ‘না, আমি এই আইন মানি না’।
মিতু ও স্নেহা দৌঁড়ে এল তার কাছে। “কিরে, তুই কি স্বপ্ন দেখলি নাকি? এত্তজোড়ে চীৎকার দিলি যে, বাংলা সিনেমার নায়িকা ফেল!”
সুলতানার বুক কাপছে ধড়ফড় করে। সে শুধু বললো, “একটু জল দে তো মিতু।“

২.

সেদিনের পর সুলতানা আর স্থির হতে পারছে না। স্বপ্নটা তাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। ‘নারীদের সম্মানরক্ষার্থে বিশেষ পুলিশ’-এর ধমকটি অনবরত তার কানের মধ্যে বাজতে থাকে- “এই মেয়ে, তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেল্লেলাপনা করছো কেনো?” জেগে থাকাকালীন যতক্ষণ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় ততক্ষন সে ভাল থাকে। কিন্তু একা হলেই সে ভীত হয়ে পড়ে। বই পড়তে বসলেই বইয়ের পাতায় সেই কালো পোশাকের পুলিশটির চেহারা ভেসে ওঠে। ঘুমাতে গেলে প্রথম কয়েক মিনিট সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। চোখ বুঁজলেই সে দেখতে পায় কালো পোষাকাবৃত একটা লোক, একহাতে আরো কুঁচকুচে কালো একটা লাঠি ও অন্যহাতে হাতকড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে; এসেই তাকে বলছে, “জনসমক্ষে বেল্লেলাপণা করার জন্য তোমাকে গ্রেফতার করা হলো।“ আতঙ্কে তার ঘুম ভেঙে যায়, দু-তিনবার এমন হবার পরে তার আর ঘুম আসে না।

দুদিন সে ঘুমাতেই পারেনি। তৃতীয়দিন মিতুকে পাশে নিয়ে শুয়েছিল সে। মিতুটা খুব ভাল। সুলতানা যা বলে তা বেশ যত্নের সাথেই পালন করে; একেবারে ছোট বোনের মতো। কেবল জীবনের প্রথম প্রেমটাই সে ভুলতে পারেনি; আজ চারটি বছর পার হলেও এখনও মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মিতুর আরো একটা বিষয় তার ভাল লাগে না। তার গায়ের রং কালো বলে সে হীনমন্যতায় ভোগে। অথচ সুলতানার মতে ওর মতো ভাল মেয়েই হয় না। মাঝে মাঝে ইয়ার্কি করে বলেও- “আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলে তোকেই বিয়ে করতাম।“ মিতু হেসে গড়িয়ে পড়ে। মিতু এতো সুন্দর করে হাসে যে, কোন ছেলে তা দেখলে নির্ঘাৎ তার প্রেমে পড়ে যেতো। কিন্তু ছেলেদের সামনে মিতুকে কোনদিনই হাসতে দেখেনি সে। দুদিন ঘুমাতে না পারায় মিতুকে সে বলেছিল, রাতে যেন সে তাকে ধরে ঘুমায়। কিন্তু সুলতানার সমস্যা হলো, কেউ তার গায়ে হাত রাখলে, এমনকি পায়ে পা লাগিয়ে রাখলেও সে ঘুমাতে পারে না। তবুও একটা সুবিধা হয়েছে যে, স্বপ্নটা তাকে তাড়া করলেই সে দ্রুত মিতুকে ছুঁয়ে দিতে পারবে।

দুদিন টিউশনিতে যায়নি সে। আজ না গেলেই চলছিল না। আগামীকাল থেকে অনন্যার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। অগত্যা তাকে যেতেই হলো। ফেরার পথে শাহবাগ নেমে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসতে গিয়ে ফ্রয়েডের ‘স্বপ্ন’ বইটা চোখে পড়তেই সে বইটা কিনে আনলো। বইটির কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ে সে বুঝতে পারলো ফ্রয়েডের মতে স্বপ্ন হলো অবচেতন মন (subconcious mind)-এর ভাবনা যা মূলত চেতন অবস্থার কার্য ও চিন্তার প্রতিফলন। সুলতানা ভেবে দেখার চেষ্টা করলো দুঃস্বপ্নটি দেখার আগে সে এমন কিছু ভেবেছিল কিনা। যদিও ঢাকার রাস্তায় বোরকা-হিজাবাবৃত মেয়েদের অভাব নেই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও খুব কম। এমন কিছু অভিজ্ঞতা বা ভাবনার কথা তার মনে পড়ে না। বইটাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো।

এক শুক্রবারের কথা মনে পড়লো তার। সাপ্তাহিক ছুটি বলে সেদিন সে সকালেই টিউশনিতে গিয়েছিল। জুমার নামাজের আগে শেওড়াপাড়ার রাস্তায় একটা মসজিদের মাইকে সে শুনতে পেয়েছিল ভয়ংকর সব কথা। দেশে যত ধর্ষন হয় তার জন্য নাকি নারীই দায়ী। নারীর বেপর্দা চলাচল নাকি পুরুষকে উত্তেজিত করে, পুরুষের দ্বীনকে বিপথে পরিচালিত করে। মসজিদের মাইকে সে আরো শুনেছিল, রাসুলরে বরাত দিয়ে হুজুর বলছে- জাহান্নামের অধিকাংশই নাকি নারী। সেদিন তার মনটা বিষিয়ে উঠেছিল। সে ভেবে পায় না, কেন পুরুষের উত্তেজনা দমাতে নারীকে পর্দা করতে হবে। সে বুঝতে পারে না, শিক্ষা এই সমাজকে আদিমতা থেকে আদৌ সরাতে পেরেছে কিনা। তার খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। তার ভাবনার মধ্যে কাজ করছিল, যে পুরুষগুলো মসজিদে হুজুরের এই বয়ান শুনছিল সেসব পরিবারের নারীদের অবস্থা কী হবে। এই পুরুষগুলো নিশ্চয়ই তাদের বাসার প্রত্যেক নারীকে আদিম বর্বর পর্দার মধ্যে ঢুকাতে চাইবে। বাইরে চলতে গিয়েও এই পুরুষগুলো পূর্বে যতটুকু নারীদের সম্মান করতো, এখন আর তাও করবে না। পথ-চলা নারীদের দিকে লোভনীয় দৃষ্টি, ইভটিজিং, এমনকি বলতে গেলে ধর্ষনও বৈধ করে দিলো এই হুজুর। এসবই যেহেতু নারীদের বেপর্দা হয়ে চলার দোষ, তাই পুরুষটি যদি নিজেকে নির্দোষ ভাবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

এভাবে তার আরো একটি দিনের কথা মনে পড়ে যায়। সেদিন এশার আযানের সময়ে সে একটা মসজিদের পাশ দিয়ে আসছিল। প্রতিদিনকার মতোই সেদিনও সে তার স্বাভাবিক পোষাক পরা ছিল। গার্মেন্টস ছুটি হওয়ায় পশ্চিম শেওড়াপাড়ার রাস্তা জুড়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢল নেমেছিল। আযান হতেই সব মেয়েরা যার যার মাথায় ওড়না-কাপড় টেনে দিয়েছিলো। সুলতানা এসব দেখে মনে মনে হাসছিলো- কী এক আজব বিধান! চুল ঢাকলেই পুরুষের উত্তেজনা দমিত হয়ে যায়! কয়েকজন হুজুর নামাজ পড়তে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। তাদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই সুলতানা বুঝতে পারছিল তারা লোলুপ দৃষ্টিতে গার্মেন্টেস শ্রমিকদের দেখছিল। সুলতানার দিকে চোখ পড়তেই রুক্ষ চেহারার এক হুজুর বলে উঠলো- “এই ছেমড়ি, মাথায় ওড়না দে। আযান পড়ছে, শুনতে পাস না?” চারদিকে এতো মানুষ, তবুও সুলতানা ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। প্রতিবাদ করার কোন সাহস পায়নি সে। মাথায় ওড়নাটা টেনে দিয়ে দ্রুত চলে এসেছিল সেদিন। সুলতানা বুঝতে পারলো এসব ঘটনাই তার অবচেতন মনে স্বপ্ন তৈরি করেছিলো। তার স্বপ্নের হদিস উদঘাটন করতে পেরে সে স্বস্তি পেলো। টেবিল থেকে পত্রিকাটা টেনে নিয়ে তাতে চোখ বুলালো সে।

সুলতানার দুঃস্বপ্নটি যে আর স্বপ্ন থাকছে না, বাস্তব হয়ে উঠছে তা টের পেলো পত্রিকায় চোখ বুলিয়েই। অশান্তির সাদা পায়রারা তাদের ১৩ দফা নিয়ে আবার আসছে মতিঝিলে। হতাশ সুলতানা পত্রিকাটি মেঝেতে সজোড়ে ছুড়ে ফেলে দিলো। বালিশে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেদে উঠলো সে।

মিতু এসে তার পাশে শুয়ে জড়িয়ে ধরলো সুলতানাকে। মিতু বুঝতে পারছে এখন কোন প্রশ্ন করলেও তার উত্তর পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে এভাবে জড়িয়ে শুয়ে থাকাই ভাল; তাতে যদি ওর কষ্টটা কিছু অন্তত কমে।

Leave a Comment