গল্প

বকফুল

কয়েক হাজার বড় কালো পিঁপড়া দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধে নেমেছে। কে কাকে কামড়াচ্ছে তার ঠিক নেই, তবুও শহর আলী ধরে নিয়েছে এখানেও নিশ্চয়ই দুটো দল রয়েছে। গ্রাম্য প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা শহর আলী এরকম প্রাকৃতিক অনেক চিত্রকে ধারণ করেই বড় হয়েছে। তবুও আজও এরকম কোন দৃশ্য দেখলে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির সাথে নিজেকে এক ঝলক মিলিয়ে নেয়।
দ্বীপচন্দ্রপুরের চারদিক জুড়েই রয়েছে শঙ্খমিত্রার প্রবাহ। পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত শঙ্খমিত্রার উত্তর দিকের প্রবাহই কেবল এখনও সদর্পে বেঁচে আছে। দক্ষিণ দিকে নদীটা মরে গিয়ে আকারে প্রায় একটা খালে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে। বর্ষা ভিন্ন অন্য মৌসুমে যার স্থির পানিতে শ্যাওলা জন্মায়, কাপড়ের মত চ্যাপ্টা-লম্বা একপ্রকার শ্যাওলা। চরের এবং দক্ষিণের হৃদয়পুর গ্রামের ছেলেমেয়েরা তখন এসব শ্যাওলা একে অপরের গায়ে পেঁচিয়ে দিয়ে বলে-‘তোর বউর লইগ্যা এই শাড়ি’।
শহর আলী দেখেছে এই দ্বীপচন্দ্রপুরে মানুষের আবাসের সাথে সাথে এসেছে অন্যান্য হাজারো প্রজাতি। এই পিঁপড়ে তার মধ্যে অন্যতম। লাল-কালো-বাদামী-ছোট-বড় অনেক প্রজাতির পিপড়েদের বাস এই দ্বীপে। নদী যখন আরো বড় ছিল, শঙ্খমিত্রার প্রবাহে যখন একটি পাতা পড়লেও মুহূর্তে কয়েকফুট ভাটিতে নেমে যেত তখনই কীভাবে যে এই পিঁপড়েরা এই দ্বীপে এসে আবাস গড়েছিল শহর আলীর ছোট্ট মস্তিস্কে তা বুঝে উঠতে পারে না।
শহর আলী কেবল এটাই বুঝতে পারে এক নিরন্তর প্রতিযোগীতা রয়েছে এই প্রকৃতিতে। এখানে এই পিঁপড়েদের যুদ্ধে কয়েক হাজার পিঁপড়ে মারা যাবে, কাল সকালে এসে দেখা যাবে সারি সারি লাশ, দু’একটা অর্ধকাটা হয়ে জীবিতও হয়তো থাকবে কিন্তু তাদেরকে বাঁচাবার বা তাদের জন্য হা-পিত্যেশ করার জন্য একটা সুস্থ পিঁপড়েকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না এই যুদ্ধমঞ্চের চারপাশে।
মানুষগুলো ঠিক এই পিঁপড়েদের মত নয়, তবুও বেঁচে থাকার মানে যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম আর প্রতিযোগিতা তা শহর আলীর মত মানুষেরাই বুঝতে পারে, মন্তাজ ব্যাপারীর মত মধ্যস্বত্বভোগী, কিংবা শহুরে মানুষগুলো যারা টাকার বিনিময়ে শহর আলীর নিজ হাতের ফসলকে তাদের মুখের খাদ্যে রূপান্তরিত করে তারা বুঝবে না।
কিছুক্ষণ পিঁপড়েগুলোর যুদ্ধ দেখে হঠাৎই মন খারাপ হয়ে যায় শহর আলীর। করিমনের মুখে তার বাপ হওয়ার খবরটা শোনার পর থেকেই সে যেন হাওয়ায় ভাসছে। শম্ভুগঞ্জের হাট থেকে করিমনের জন্য দুটো চুল বাধার ফিতে ও একটি আলতা কিনেছে। একটা লিপস্টিকও কিনতে ইচ্ছে হয়েছিল কিন্তু সলিমটা সবসময় সাথে সাথে ছিল, কী আবার মনে করে বসে তাই লজ্জায় কেনা হয়নি। বাসুদেব ডাক্তারের ফার্মেসী থেকে করিমনের জন্য ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট কিনে এনেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করলে নাকি সেখান থেকে ফ্রি আয়রণ ট্যাবলেট দেয় গর্ভবতীদের জন্য, তাছাড়া হৃদয়পুর গ্রামে নাকি পুষ্টি প্রকল্প নামে কী এক সরকারী প্রকল্প রয়েছে যারা গর্ভবতী ও প্রসূতিদের পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। শহর আলী মনে মনে ভেবে নিয়েছে কবে কখন এসব স্থানে খবর নিয়ে করিমনের জন্য সম্ভাব্য সকল পুষ্টির ব্যবস্থা করতে পারে। যে অনাগত জীবনের জন্য শহর আলীর এ আয়োজন, এই পিঁপড়েগুলোর যুদ্ধ যেন সে জীবনকে থামিয়ে দিতে চাইছে। পিঁপড়েগুলো যেন শহরের কানে ভুভুজেলার চিৎকারে জানিয়ে দিচ্ছে, “ওকে এখানে নিয়ে এসো না, দেখছ না আমরা বাঁচার জন্য কীভাবে মরছি!”
শহরের রাগ ধরে যায় পিঁপড়েগুলোর ওপর। যুদ্ধরত পিঁপড়েগুলোকে পা দিয়ে মাড়িয়ে থেতলে দেয় গোটা পঞ্চাশেক পিঁপড়েকে। তারপর হাটা শুরু করে ঘরের দিকে। গাই দুটোকে নদীতে নিয়ে গোসল করাবে বলে বের হয়েছিল, কিন্তু আরেকবার করিমনকে না দেখে আসলে তার মনটা কিছুতেই ভাল হবে না।
ঘরের দূয়ারে বালতিটাকে ঠকাশ শব্দে ফেলে দিয়ে এক দৌঁড়ে ছুটে যায় রান্নাঘরে। ’অ শহর, গরুরে পানি না খাইয়েই চলে আইলি নাকি বাপ?’ বাতলির ঠকাশ শব্দেই বুড়ি বুঝতে পারে শহর আলীর ফিরে আসা। তারপর আরো কী বিড়বিড় করে বলতে থাকে। শহরের তা শোনার মত সময় নেই।
করিমন বকফুলের বড়া ভাজছে। চুলায় বকফুল আর করিমনের নাকের নাকফুল- এ দুয়ের ধ্বনি দ্যোতনার মতই শহর আলীর শরীরে তৃতীয় এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। করিমনের কোমরের উপরিভাগের পেটের খোলা অংশটাকে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে শহর আলী। তারপর অনুভব করার চেষ্টা করে করিমনের পেটের মধ্যে তার সত্ত্বাটির অস্তিত্ব। শহর আলীর তৃতীয় অনুভূতি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে করিমনের মাঝেও। তারপর বকফুলের বড়াকে তুলে রেখে ঘাসফুলের ঘ্রাণে মাতাল হতে তারা ছুটে চলে শঙ্খমিত্রার কোলে জন্ম নেয়া এই দ্বীপচন্দ্রপুরের প্রকৃতির ভাজে। যেখানে প্রকৃতি আর জীবন চলে সমান্তরালে।
————-
* চতুর্মাত্রিক ব্লগে একটা বারোয়ারি উপন্যাস লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কবি ও ব্লগার ‘নির্ঝর নৈশব্দ্য’ হয়েছিলো। অনেকে মিলে একটি উপন্যাস লেখার সেই প্রকল্পটি সম্ভবত পূর্ণতা পায় নি। এই লেখাটি সেই উপন্যাসের জন্য আমি লিখেছিলাম। আজ অনেকদিন পরে পড়তে গিয়ে দেখলাম লেখাটা নিজেই একটা গল্পের মতো হয়েছে। তাই এর নাম দিলাম ‘বকফুল’।

Leave a Comment