1971বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রঃ গণহত্যার সাক্ষী চুন্নু ডোম ও পরদেশী ডোম

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্মম গণহত্যা পরিচালনা করে, চুন্নু ডোম ও পরদেশী ডোম তার অন্যতম দুই সাক্ষী। পাক-আর্মির নৃশংসতায় ছিন্ন-ভিন্ন, পচা-গলা-বিকৃত লাশ নিজেদের হাতে ট্রাকে তুলে নিয়ে ধলপুরের ময়লা ডিপোতে ফেলতে হয়েছে তাদের। গোল্ড-ফিস মেমোরির বাঙালিদের মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেয়া সহজ হবে বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে পাকিস্তানী গণহত্যার এই চিত্রটিকে ব্লগে আটকে রাখলাম।

১৯৭১ সনের ২৮ শে মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ উঠাবার জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে, বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গনেশ ডোম ও কানাই কে একটি প্রবেশ পথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়া হয়। আমরা উক্ত পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজ কোর্টের দক্ষিন দিকের প্রবেশ পথের যে রাজপথ শাঁখারী বাজারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার দু’ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, কিশোর-শিশু সহ বহু পচা লাশ। দেখতে পেলাম, বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাঁখারীবাজারের দুদিকে ঘোর বাড়িতে আগুন জ্বলছে । অনেক লোকের লাশ অর্ধ পোড়া লাশ পরে থাকতে দেখলাম। দুই পার্শ্বে অদূরে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সৈন্যদের প্রহরায় মোতায়ন দেখলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষ, আসবাবপত্র জ্বলছে । একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশু সহ বার জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি। পাঞ্জাবীর প্রহরায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের উপর বিহারীদের উদ্যাম উল্লাসে ফেটে পরে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারী জনতাকে মূল্যবান সামগ্রী, দরজা, জানালা, সোনা দানা সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম।

লাশ উঠাতে উঠাতে এক ঘরে প্রবেশ করে এক অসহায়া বৃদ্ধাকে দেখলাম। বৃদ্ধা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করছিল, তাকে আমি পানি দিতে পারি নাই ভয়ে, বৃদ্ধাকে দেখে আমি আরও ভীত হয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমি পানি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পেছনে সশস্ত্র পাঞ্জাবী সেনা প্রহরায় থাকায় আমি সেই বৃদ্ধাকে পানি দিয়ে সাহায্য করতে পারি নাই। আমরা ১৯৭১ সনের ২৮ মার্চ শাঁখারী বাজার থেকে প্রতিবারে একশত লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে তিন শত লাশ উঠিয়ে তৃতীয় বার ট্রাক বোঝাই করে তিন শত লাশ ধলপুর ময়লা ডিপুতে ফেলেছি।

১৯৭১ সনের ২৯ মার্চ সকালে আমি মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘর ও প্রবেশ পথের দুপার্শ্ব থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ী, রমনা কালীবাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। ২৯ শে মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশ পথে যায়। আমরা উক্ত পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙ্গালী যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাটার সাথে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সাথে ছিলেন। এরপর আমরা লাশ ঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি। আর গনেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে ববিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁজরা দেখেছি, মেয়েদের লাশের কারো স্তন পাই নাই,  যোনিপথ ক্ষত-বিক্ষত এবং পেছনের মাংস কাঁটা দেখেছি। মেয়েদের লাশ দেখে মনে হয়েছে, তাদের হত্যা করার পূর্বে তাদের স্তন সজোরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, যোনিপথে লোহার রড কিংবা বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যুবতী মেয়েদের যোনিপথের এবং পিছনের মাংস ধারল চাকু দিয়ে কেটে এসিড দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি যুবতী মেয়ের মাথায় খোঁপা খোঁপা চুল দেখলাম। মিটফোর্ড থেকে আমরা প্রতিবারে একশত লাশ নিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলছি।

১৯৭১ সনের ৩০ মার্চ আমদের উক্ত পাঁচজনের সাথে দক্ষিনা ডোমকে সাহায্য করতে দেয়া হয়। আমাদের ট্রাক সেদিন সাত মসজিদে যায়। আমি সাত মসজিদের সম্মুখ থেকেক যখন বাঙ্গালীর লাশ উঠাচ্ছিলাম তখন অসংখ্য বিহারী জনতা আমাদের চারিদিকে দাঁড়িয়ে হাসছিল। বাঙ্গালীদের পরিণতি দেখে তারা উপহাস করছিল। আমরা সাত মসজিদের সামনে থেকে আটটি যুবকের লাশ তুলেছি। কতিপয় লাশ দেখলাম উপুড় হয়ে আছে। সবার পিঠ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হয়ে আছে। পচা, ফুলা লাশ তুলতে যেয়ে দেখলাম কারো লুঙ্গি পরা কারো পাজামা পরা। আবার কারো দেহে হাওয়াই শার্ট এবং টেট্রনের দামি প্যান্ট।

পানি থেকে বারটি লাশ তুলেছি । প্রতিটি লাশের চোখ এবং হাত পিছন দিকে বাঁধা ছিল। নদীর পাড় থেকে বারটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজরা দেখেছি। লাশ দেখে মনে হল ভদ্রঘরের অভিজাত বাঙ্গালী যুবকদের লাশ। সাত মসজিদের সকল লাশ তুলে আমরা ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ফিরে এসে ট্রাক নিয়ে আমরা মিন্টু রোডে লাশ তুলতে গিয়েছি। মিন্টু রোডের রাস্তার পাশ থেকে প্যান্ট পরা দুটি পচা ফুলা লাশ তুলেছি। ধলপুরে যাবার পথে ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের সম্মুখ থেকে এক বৃদ্ধ ফকিরের লাশ তুলেছি। দেখলাম লাশের পাশেই ভিক্ষার ঝুলি, টিনের ডিবা ও লাঠি পরে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিব বাড়ির সম্মুখ থেকে দুজন রুপসী যুবতী মেয়ে এবং তিনজন যুবকের ক্ষত বিক্ষত লাশ তুলেছি। মুসলিম হলে প্রবেশ করে একটি পচা লাশ পেয়েছি। ঢাকা হলের ভেতর চারজন ছাত্রের লাশ তুলেছি। সেদিন অসুস্থ থাকায় আমি আর লাশ তুলতে যেতে পারি নাই।

চুন্নু ডোম
০৭/০৪/১৯৭৪
ঢাকা পৌরসভা
রেলওয়ে সুইপার কলোনী
২২৩ নং ব্লক, ৩ নং রেলগেট
ফুলবাড়িয়া, ঢাকা ।
——————–

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে রাজধানী ঢাকায় পাক সেনাদের গণহত্যার পর ঢাকা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলি খান শুর, প্রশাসনিক অফিসার ইদ্রিস আরও কয়েকজন অফিসার সঙ্গে নিয়ে একটি ট্রাকে করে পশু হাসপাতালের গেটে এসে চিৎকার করে আমার নাম ‘পরদেশী, পরদেশী’ বলে ডাকাডাকি করতে থাকে। আমি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমার পশু হাসপাতাল কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে আসি। ইদ্রিস সাহেব খুব ক্ষেপা স্বরে বলতে থাকেন, “তোমরা সব ডোম ও সুইপার বের হও। যদি বাঁচতে চাও এক্ষুণি সবাই মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্তূপীকৃত লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলে দাও। নইলে কেউ বাঁচতে পারবে না। পাক আর্মির হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না।”

পৌরসভার সেই ট্রাকে আগে থেকে সুইপার লাডু, কিষণ ও ভরত বসা ছিল। আমি তার নির্দেশ অমান্য করার কোন উপায় না দেখে ট্রাকে উঠে বসলাম। সেই ট্রাকে করে ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে আমাদের প্রায় আঠার জন সুইপার ও ডোমকে একত্রিত করে প্রতি ছয়জনের সঙ্গে দুইজন করে সুইপার ইন্সপেক্টরকে আমাদের সুপারভাইজার নিয়োগ করে তিন ট্রাকে ভাগ করে তিন দলকে মিটফোর্ড, বাংলাবাজার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রেরণ করা হয়। আমি মিটফোর্ডগামী ট্রাকে ছিলাম।

আমাদের ট্রাক সকাল নয়টার সময় মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে উপস্থিত হলে আমরা ট্রাক থেকে নেমে লাশ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে  বুকে এবং পিঠে মেশিন গানের গুলিতে ঝাঁঝরা করা প্রায় একশত যুবক বাঙালির বীভৎস লাশ দেখলাম। আমি আমার সুপারভাইজারের নির্দেশে লাশ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রতি লাশের পা ধরে টেনে বের করে বাইরে দাঁড়ানো অন্যান্য সুইপারের হাতে তুলে দিয়েছি ট্রাকে উঠাবার জন্য। আমি দেখেছি প্রতি লাশের বুক ও পিঠ মেশিন গানের শত শত গুলিতে ঝাঁজড়া। সব লাশ তুলে দিয়ে একপাশে একটা লম্বা টেবিলের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া একটি লাশের উপর থেকে চাদর টেনে উঠিয়ে দেখলাম একটি রূপসী ষোড়শী যুবতীর উলঙ্গ লাশ- লাশের বক্ষ যোনীপথ ক্ষতবিক্ষত, কোমরের পিছনের মাংস কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, বুকের স্তন থেতলে গেছে, কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো চুল, হরিণের মতো মায়াময় চোখ দেখে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকল, আমি কিছুতেই চোখের পানি রাখতে পারলাম না। আমি আমার সুপারভাজারের ভয়াল এবং ভয়ঙ্কর কর্কশ গর্জনের মুখে সেই সুন্দরীর পবিত্র দেহ অত্যন্ত যত্ন সম্ভ্রমের সাথে ট্রাকে উঠিয়ে দিলাম।

মিটফোর্ডের লাশঘরের সকল লাশ ট্রাকে উঠিয়ে আমরা ধলপুরের ময়লা ডিপোতে নিয়ে গিয়ে বিরাট গর্তের মধ্যে ঢেলে দিলাম। দেখলাম বিরাট বিরাট গর্তের মধ্যে সুইপার ও ডোমেরা রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা লাশ ট্রাক থেকে গর্তের মেধ্য ফেলে দিচ্ছে। আমি অধিকাংশ লাশের দেহে কোন কাপড় দেখি নাই, যে সমস্ত যুবতী মেয়ে ও রমণীদের লাশ গর্তের মেধ্য ফেলে দেওয়া হলো তার কোনো লাশের দেহেই আমি কোনো আবরণ দেখি নাই। তাদের পবিত্র দেহ দেখেছি ক্ষতবিক্ষত, তাদের যোনিপথ পিছন দিকসহ আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। দুপুর প্রায় দুইটার সময় আমরা রমনা কালিবাড়ীতে চলে আসি পৌরসভার ট্রাক নিয়ে। লাশ উঠাবার জন্য ট্রাক রমনা কালিবাড়ীর দরজায় দাড় করিয়ে রেখে, দুজন ট্রাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা চারজন কালিবাড়ীর ভিতরে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটানো ৪১টি পোড়া লাশ আমি ট্রাকে তুলেছি। কালিবাড়ীর এ সকল লাশ আমরা ধলপুরের ময়লার ডিপোতে র্গের মধ্যে ফেলেছি। লাশ তুলে তুলে মানুষের পচা চর্বির গন্ধে আমার পাকস্থলি বের হতে চাচ্ছিল। পরের দিন আমি আর লাশ তুলতে যাই নাই, যেতে পারি নাই, সারাদিন ভাত খেতে পারি নাই, ঘৃণায় কোন কিছু স্পর্শ করতে পারি নাই।

পরের দিন ২৯ মার্চ সকালে আমি আবার ঢাকা পৌরসভা অফিসে হাজির হলে আমাকে ট্রাক দিয়ে লাশ তোলার জন্য আরও কয়েকজন সুইপারের সাথে ঢাকা শাঁখারী বাজারে যেতে বলা হয়। জজ কোর্টের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা তখনও জ্বলছিল, আর পাক সেনারা টহলে মোতায়েন ছিল বলে আমরা ট্রাক নিয়ে সে পথ দিয়ে শাঁখারী বাজারে প্রবেশ করতে পারি নাই। পাটুয়াটুলী ঘুরে শাঁখারী বাজারের পশ্চিম দিকে প্রবেশ করে পাটুয়াটুলী পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে আমাদের ট্রাক শাঁখারী বাজারে প্রবেশ করল। ট্রাক থেকে নেমে আমরা শাঁখারী বাজারের প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রবেশ করলাম – দেখলাম মানুষের লাশ, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বালক-বালিকা, শিশু-কিশোরের বীভৎস পচা লাশ, চারদিকে ইমারতসমূহ ভেঙ্গে পড়ে আছে, মেয়েদের অধিকাংশ লাশ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ পড়ে আছে দেখলাম, দেখলাম তাদের বুক থেকে স্তন তুলে নেওয়া হয়েছে। কারও কারও যোনিপথে লাঠি ঢুকানো দেখলাম। বহু পোড়া, ভস্ম লাশ সেখানে দেখলাম। বাইরে সড়কে পাঞ্জাবী সেনারা পাগলা কুকুরের মত লাফাতে লাফাতে গুলিবর্ষণ করছিল। বিহারীরা দলে দলে শাঁখারী বাজারের ঘরে ঘরে প্রবেশ করে মূল্যবান আসবাবপত্র, সোনাদানা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। অবিরাম গুলীবর্ষণের মুখে আমরা সকলে প্রাণের ভয়ে দুই ট্রাক লাশ তোলার পর লাশ তোলার জন্য সেদিন আর শাঁখারী বাজারে যেতে সাহস পাই নাই।

৩০শে মার্চ সকালে আমার দলকে মিলব্যারাক থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি মিলব্যারাক ঘাটে পৌরসভার ট্রাক নিয়ে গিয়ে দেখলাম নদীর গাটে অসংখ্য মানুষের লাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বহু লাাশ রশি দিয়ে বাঁধা দেখলাম, প্রতিটি রশির বন্ধ খুলে প্রতি দলে দশজন পনের জনের লাশ বের করলাম, সব যুবক ছেলে ও স্বাস্থ্যবান বালকদের লাশ দেখলাম। প্রতিটি লাশের চোখ বাঁখা, হাত বাঁধা, শক্ত করে পিছন দিক থেকে। প্রতিটি লাশের মুখমণ্ডল কালো দেখলাম, এসিডে জ্বলে বিকৃত ও বিকট হয়ে আছে। লাশের সামনে গিয়ে ঔষধের অসহ্য গন্ধ পেলাম। লাশের কোন দলকে দেখাম মেশিনগাসের গুলিতে বুক ও পিঠ ঝাঁজড়া হয়ে আছে, অনেক লাশ দেখলাম বেটন ও বেয়নেটের আঘাতে বীভৎস হয়ে আছে, কারো মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মগজ বের হয়ে আছে, কারো কাটা হৃদপিণ্ড বের হয়ে আছে। নদীর পাড়ে ছয়জন রূপসী যুবতীর বীভৎস ক্ষতবিক্ষত, উলঙ্গ লাশ দেখলাম। চোখ বাঁধা, হাত-পা শক্ত করে বাঁধা প্রতিটি লাশ গুলির আঘাতে ঝাঁজড়া, মুখমণ্ডল, বক্ষ ও যোনিপথ রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ও বীভৎস দেখলাম।

দুইবারে দুই ট্রাকে আমি সত্তরটি লাশ উঠিয়ে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। এরপর আমাকে সদরঘাট, শ্যামবাজার, বাদামতলী ঘাট থেকে লাশ তুলতে বলা হয়। আমি উপরোক্ত এলাকার নদীর ঘাট থেকে পচা লাশ তুলে ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। আমি যেদিন কালিবাড়ী থেকে লাশ তুলেছি, সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পিছনের স্টাফ কোয়ার্টারের ভিতরে যেয়ে পুরুষ, নারী ও শিশু সমেত মোট নয়টি লাশ তুলেছি। আর অধ্যাপকের বাসা থেকে সিঁড়ির সামনে লেপের ভিতর প্যাঁচানো এক অধ্যাপকের লাশ তুলে নিয়ে গেছি।

পরদেশী
২১/৩/৭৪
সুইপার, সরকারী পশু হাসপাতাল
ঢাকা

 

Leave a Comment