খাপছাড়া আড্ডাগল্প

ছোটগল্পঃ গদ্যের কুচো ও কুচোর গদ্য

                লিখেছেনঃ  দীপাঞ্জনা মণ্ডল

আগামী কাল পায়ের নিচ থেকে সরে গেছিল মাটি, গতকাল মাথার ওপর থেকে সরে যাবে ছাত। কুচো নেই হয়ে এর মধ্যেই ছিল। সামনে রুপোর পানপাত্রে মামদো আঙুরের রস ঢালছিল। ইঁটচাপা ঘাসগুলোর হাতে হাতে ঘুরছিল বিড়ি। ব্রহ্মদৈত্য কুশাসনে বসে পাইপ টানছিল। ক্যামেরায় চোখ রেখে স্কন্ধকাটাকে শাঁকচুন্নি চোখ টিপল। স্কন্ধকাটা পরের সমাবেশের কর্মসূচী মেলে দিল ব্রহ্মদৈত্য সাহেবের সামনে।

Art: Sarah Zar

উদ্বোধনী সঙ্গীত(গাঁ- মেরে দাও, গাঁ- মেরে দাও, গাঁ- মেরে দাও, মাআআআআরো) পরিবেশনে ব্রহ্মদৈত্যের ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের তৃতীয় রক্ষিতার নিম্নস্থ ত্রয়োদশ পুরুষের পিসতুতো ভায়রার দত্তক মেয়ে। কুচো ঘাড় গুঁজে দিতে যাচ্ছিল কর্মসূচীর ওপরে এবং বুঝল ঘাড়ের ওপরে মাথাটা যেন নড়বড়ে।

‘নে নে, আর উঁকি মারতে হবে না! তোর চোখ তো উড়াল পুলের ন’নম্বর থামের নিচে কাঁকড় গেঁথে পড়ে আছে।’

কুচো ধরা পড়ে থতমত খেয়ে ঘাসগুলোর ওপর থেবড়ে বসে। শুনতে পায় মামদো হবে বিশেষ অতিথি, সংখ্যালঘুদের পক্ষে। ঘাসগুলো পাপোষ আর ওয়াল হ্যাঙ্গিং হিসেবে নান্দনিকতা রক্ষা করবে। ওদের থাকাটা একইসঙ্গে পায়ের নিচে আরামদায়ক ও চোখের সামনে আত্মশুদ্ধির কাজ করবে। ঘাসেরা বেজায় খুশি। মঞ্চে জায়গা বলে কথা, আর কেউ অচ্ছুৎ বলবে! বলবে, ঘাসে পা পড়লে সংক্রমণের সম্ভাবনা!

পূর্বরাগ

ছোটবেলার স্কুলে, মনে পড়ে কুচোর স্বাস্থ্যসচেতনতার পাঠ দিতেন হেডস্যার। দাঁত মাজা, নখ কাটা, পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি। তখনই ফিতেকৃমির জীবনচক্র ছুঁয়েছিল কুচোকে, ভয়ও। তখন বিকেলের মরে আসা আলো রোজ কুচোকে অবসন্ন করে যেত। তার সমস্ত অবস্থান যেন সংক্রমণ শোষণ করছে মনে হত এমন।

অথচ সমস্ত রিকশাওয়ালা, রাজমিস্ত্রি, ছুতোর, ঠিকে ঝি, দুধওয়ালি সবাই এক থালা থেকে খাবার ভাগ করে নেবার মতো আপন ছিল। ছানাপোনা নিয়ে হিমসিম ছাগলের মায়ের মুখে মাকে লুকিয়ে গোলাপ পাতা তুলে দেওয়া, সকালের বিস্কুট খাটের তলায় ফেলে রেখে সুযোগ বুঝে রাস্তার কুকুর ডেকে খাওয়ানোর জন্য বিশেষ তত্ত্ব বা তথ্যের সমাহার ঘটাতে হয়নি। ঘুরন্ত ফ্যানের পাশ দিয়ে উড়তে থাকা এক টুকরো চড়ুই-এর জন্য সংলগ্নতা আসত সহজিয়া।

ওদিকে চলছে নবকল্লোল, জেমস বণ্ড অথবা জেমস হ্যাডলি চেজ পাড়ার লাইব্রেরি থেকে পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে, কখনও শীতের চাদরের ওমে অথবা কলঘরে। মাথা খেল বিশু পাগল। অল্প কিছুর বিনিময়ে সমস্ত না বিলনোর ধারনা চেপে বসল সেই। কিন্তু যে সর্বগ্রাসী ভুল রয়ে গেল তা হল ‘বিনিময়’কে তার মূল্যে লক্ষ্য না করা আর কেবলই সর্বস্ব উজাড় করবার একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজে চলা।

ফলত অন্ধকার গলি, টিউশনে সন্ধ্যের পরে পিছিয়ে পড়া, পাড়ার হিরোর ঘরে অতর্কিতে ঢুকে পড়বার সংস্ক্রিয়া ঘটলই না। কোনও এক কল্পিত পূর্ণের উদ্দেশ্যে সর্বস্ব গচ্ছিত রইল। চোখ পড়ল সরস্বতী পুজোর পাঞ্জাবি অথবা দুর্গাষ্টমীর অঞ্জলি কিংবা বাড়ির সামনের রাস্তায় এক সাইকেলের কসরতের রকমফের।

সূর্য ডুবল, সূর্য ডুবল, সূর্য ডুবল। কখনও মেঘের মধ্যে ছবি খুঁজে কখনও মেঘের ওপরে বসতে চেয়ে কতকগুলো অপ্রয়োজনীয় নিয়মিত হাফইয়ারলি আর অ্যানুয়াল এল গেল।

কুচো মাধবীলতার ঝাড়ের আওতায় বসে নিজেকে সুন্দর হয়ে উঠতে দেখে। দাম্পত্য কলহ জানিয়ে দিয়ে যায় সে জন্মমুহূর্তে অবাঞ্ছিত, আসলে অপরিকল্পিত, আকস্মিক। যে সূর্য ডুবে গেল সে আর কখনও ওঠেনা। কুচোর নিয়মিত পরীক্ষার মধ্যে এবার অবাঞ্ছিত হয়েও অস্তিত্ববান থাকার ঠাণ্ডা লড়াই থানা গাড়ল।

একটা সোজা রাস্তা দুপাশে গাছের ছায়া দিয়ে সাজগোজ সারে, আর তার সামনের যতদূরে দেখা শেষ, একটা জমাট বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। চরৈবেতি কানে নিলে রাস্তাটার বাড়ির খোঁজ মেলে না, সারারাত ধরে চাঁদের সঙ্গ নিয়ে এগোলে তার গাছের আড়ালে লুকোনোর ঠাঁই পিছোতে থাকে। লুকোচুরি খেলে কখনও জেতা হয়নি কুচোর।

ইউক্যালিপটাস ভালবাসলে আর বনসাই ভালো লাগে না। টাইগনও। বাবলা গাছটার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বড় আঁকড়ে ধরে, জবা ফুল ভেঙ্গে পরাগ, আর কলকের মধু খেতে দেখলে পূজারিণীরা হেই হ্যাট করে। কেটে ছড়ে গেলে তালুতে ডলা হয় গাঁদা অথবা দূর্বা। ক্ষত পূরণ করতে গিয়ে কেউ না কেউ ক্ষতি স্বীকারে শহিদ হয়।

বড় হচ্ছে, আড়ে-বহরে। এক পঁচিশে বৈশাখে ধুম জ্বরের মধ্যে দিয়ে জননাঙ্গের সক্রিয় হয়ে ওঠার খবর পাওয়া গেল। বড় সাবধানতা, সংকোচ, বিচ্ছিন্নতাও।

পাশের বাড়ির বাল্যকাল ডাকে ‘বাইরে বেরো’। কিন্তু তখন আড়াল শুধু একার জন্য কান্না মাপে। কিশোর হলেই না চাইতে প্রতিযোগী হতে হয় জন্মদাতাদের। কে বেশি আকর্ষক, কে নিল সব মনোযোগ, মধ্যবয়েস হোঁচট খেয়ে মান খোয়ায়। মাঠ ছেড়ে রিজার্ভ বেঞ্চে বসা অথবা নির্দিষ্ট ভাগাভাগি যে সব চায় সে জায়ে তত সহজ নয়।

‘খুব ভালো চিঠি লিখিস তুই, ঠিক যেন কথা শুনছি সামনে বসে।’

বাবার বদলি চাকরির জন্য স্কুল বদলেছে যে কৈশোরের তার স্বীকৃতি। আবিশ্ব ‘তুমি অনুপ্রবেশকারী।’ চোখ ঠারাঠারি, ছটফটানি। কুচো একটু ছাদ খুঁজে যায়।

                     মান

অপয়া আর আলটপকা বিপর্যয়ে দ্বৈরথ সেই। খুব ভালো এক সামাজিকের থাবার মধ্যে নখ লুকোনো; কুচো দেখে। কেউ মানেনা। দিনের পরে রাতের পরে নিয়ম মানা ভালো থেকেও পরখ করা শেষ হয়নি। অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ কে কবে আর নিরুদ্বিগ্ন মানতে পারে সহজ মতো!

ইস্কুলে আর পাড়ার ক্লাবে গীতিআলেখ্য, স্ক্রিপ্টের হাত এমনি পাকে! গান আর নাচকে জোড়ো বিনি সুতোর কথামালায়। কুচো তখন কলার তোলে, বীরপুরুষের ঘোড়া ছোটেই। ঝোপের ওপর কোপই পড়ে। ঠিক যখন চেয়ার ভরে নাচ দেখে আর আবৃত্তিতে, বক্তৃতা দেন সভাপতি। বিধায়ক বা সাংসদ বা বিজনেসম্যান। তার বাড়ির সদস্যরা যোগ্যতম, সংস্কৃতি রাজনীতি আর ক্ষমতায়ন একই বৃন্তে সফল ফলে।

আবার ঘাঁটো লাইব্রেরি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চকচকে এক রচনাবলী, তালা বন্ধ। করুণ চোখ আর সীমিত পাঠক যুগলবন্দী তালা খোলায়। দুয়েকটুকরো বিভূতিভূষণ আর তারাশঙ্কর, মুজতবা আলী, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ। সংস্কৃতির মঞ্চ ছাড়তে দুঃখ তেমন বেগ দিল না।

‘কাল আমরা পিকনিকে যাব, চল না মজা হবে!’

‘রাতে বেরব ঠাকুর দেখতে, বন্ধুরাই! যাবি?’

যাবার অনুমতি না পাবার ক্ষোভ কমতো ফেরার পরে, সবাই সবার নিন্দেমন্দ করত শুনে। ফাঁকি দেখে।

বই বাড়ল। বই থাকল। সূর্যদীঘল বাড়ি, চিলেকোঠার সেপাই, দু-এক কলি কমলকুমার, অমিয়ভূষণ।

কুচো ডায়েরি টানে, ‘প্রায় দেখা হয় আজকাল ওর সঙ্গে। ট্রেন লেট করলে, ল্যাপটপ হ্যাং করলে, ভিখিরি বাচ্চাকে কেউ ‘হেই হ্যাট’ করলে, বৃষ্টি না হলে, শিয়ালদা স্টেশনের ভিড় মস্তিষ্কবিহীন হাত হয়ে উঠলে ও ঠিক হাজির হয় আমার পাশে। কখনও ওর এক পাশ কখনও ছায়া কখনও উঁকি কখনও অনুসরণ আমি বুঝতে পারি। বুঝতে পারার আগেই তবু আমার ক্লান্তির মধ্যে অসহায়তার জলপথে ও ঢুকে পড়ে আমার ভেতরে। কত যন্ত্রণার আর্তনাদ এ পৃথিবীর উত্তরাধিকার বহন করে আসছে, তেমনই প্রেমের মতো ছদ্ম ও জাঁকিয়ে বসে। আমি ব্যস্ত হতে চাই। আমার আকাশদের ডাকি। মানুষের চোখে-ঠোঁটে অপলক অকপট চেয়ে থাকার আমার যাপনে ফিরতে চাই। দেখি আকাশ একটা গরাদছাপ ধূসর জামা পড়েছে। আকাশ আমার আমার মাঝে অনেক শর্ত, রাজনৈতিক। এমনকি আকাশও চেপে বসছে বুকের ওপরে দমবন্ধ করে দিতে, বলছে আমায় আকাশ হতে। আমি অথচ অনবকাশের ছুতোনাতায় কেবলই পালাচ্ছি। ডুব দিচ্ছি জলে। বাতাস নিজের ঘরকন্না বজায় রাখতে কেবলই আকাশের সঙ্গে সেলফি তুলছে হাসিমুখে। এই সময়ে ওকে ঠেকাব কী করে। সত্যি বলতে সাঁতার তো শিখিনি কখনও জলে বা বাতাসে, মাটির সঙ্গে যা আমার সখ্য। এবং এই ,মাটির ওপরে ও সাবলীল। কিলবিল করতে থাকে। সরসর করে এগোয়। পেশি টান রাখে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। আমি বিনা কারণেই হেসে উঠতে থাকি, ফাঁপা শোনায়, কোনও এক অপূর্ব অর্ধনারীশ্বরের শাড়ি গুটিয়ে অনায়াস রেললাইন থেকে প্ল্যাটফর্মে উঠে যাওয়ার স্মৃতিতে মুগ্ধ মনোনিবেশ করতে থাকি। কোনও এক অকিঞ্চিতে আমার, বন্ধুর আগ্রহ মনে করে শান্তি পেতে চাই। তারপরেও ভালো বাসা না-বৃষ্টির এই সংকটে, যখন কিছুতেই আকাশ প্রিয় মানুষের আশ্বাস হয়ে ওঠে না, এমনই সময়ে ‘কিচ্ছু ভাল লাগছে নাআআআ’ আমাকে আমার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে নিপুণভাবে।

আদ্দেক ঘুমের পর গাঢ় অন্ধকার কিছু তরল হয়ে এলে, ব্যর্থতা উপগত হয়। অচল হাজার টাকার দুঃখ পড়ে ফেলতে পারি। একটা রূপকথা শুরু হয়েছিল যেমন হয়, কিন্তু প্রাণভোমরা মারা পড়েনি। ফলে আয়নাবাড়ি থেকে অমলা কক্ষনও বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আমার ডুবে থাকা ছুঁয়ে দেখি। বাতাস থেকে দূরে মাটি থেকে সরে রুদ্ধশ্বাস, ডানা নেই, শিকড়ও। নান্দনিক অর্কিড ও প্রবাল প্রাচীরেরা চড়া দামে বিক্রি তো হয়, বিকৃত-ও। শিকড় মেলে ওড়ে অথবা ডানা চারিয়ে আঁকড়ায় সাবলীল দেখানেপনা। পাখা হোক বা পাখনা, অনৈশ্বরিক নৈসর্গিক কিছু জ্বলেপুড়ে গেছে বলেই আমার মাটি নেয় না, বাতাসও। চুপসনো ফুসফুস আর অনুভূমিক পায়ের নিস্ক্রিয়তায় শুধু স্রোতে ভাসা। পচতে থাকা নরম মাংসের খসে পড়ার পর আমার কঙ্কালের অলিগলি বেয়ে জল বইবে? হয়ে আসছে ওরকমটাই বলে ধরে নিচ্ছ হবেই! আমি তো এদিকে আমার স্তূপাকার মেদমাংসের চুম্বকে টেনে আনছি বিষ। চেরা জিভ অথবা বাঁকা হুল ইন্দ্রিয়ের ছদ্মবেশে রাখা। আসলে চুমুও ছোবল ছিল, উত্তেজক সূচ্যগ্রে মাপা।’

 মিলন

ঘর ছেড়ে কুচো এরপর এল বাইরে। কুয়োর ব্যাঙ পড়ল এক সাগরে। অবশ্য সেই সাগর চিনতে চিনতে কমতে কমতে পচা ডোবা বুঝবে পরে। ঘাড়ের ওপর পড়বে আকাশ ভেঙেচুরে ঘুমের ঘোরে।

একটা গোটা অচেনা শহর, তার বাড়ি, রাস্তা, মানুষ সমস্ত আনকোরা। প্রতিটা বাঁক ঘোরার মুখে কুচোর মনে হয় এর পরেই সেই ছোটবেলার চেনা বাড়ির ছাত, সামনের গেট দেখা যাবে।

আর সারি সারি বন্ধ দরজা পেরিয়ে পৌঁছতে হয় একটা চৌকি একটা টেবিল একটা র‍্যাকের সাম্রাজ্য একচিলতে মেস বাড়িতে।

বাড়ির কথাই মনে পড়ে, চিলেকোঠা। সূর্যাস্ত। রাতের তারা। দিনের আলোর মুনশিয়ানা।

এখন দিনেও আলো জ্বেলে তবেই চলে এই শহরে। বাথরুমে ভাগ, খাবার টেবিল, লাইন লাগাও, খাবার জলের।

কুচোর ডায়েরির পাতায়, ‘এবং আমরা জানি হে মহান স্বপ্ন আসলে আফিমের সঙ্গে পোশাক পালটেছে কখনও কখনও। সেই বদলের শপিং মলে সমস্ত মৃত্তিকাপালিত কন্দের গা থেকে মুছে ফেলা গেছে মাটি, চালের গা থেকে ফ্যান। ফলে ভেবে দেখা যায় আবার একটা মন্বন্তর এলে গেরস্ত বাড়ির ফেলে দেওয়া ফ্যান পাত্রে সংগ্রহ করবার কোনও অসুন্দর চলচ্চিত্র ঘটবে না। এদিকে মন্বন্তর দরজায় ঘা দিচ্ছে, স্বপ্ন এমন হবার কথা ছিল। হুম। মনুসংহিতার প্রতি কোনও দুর্বলতা রাখার ইচ্ছে নয় আমার। মন্বন্তর স্বপ্ন।

এই শহর এই দেশ এই দুনিয়া, যেখানে যে কোনও মুহূর্তে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়, সেটাই আমার পৃথিবী। আরও আশ্চর্য এই মনুষ্যসৃষ্ট বন্যা- ঘর ওড়ানো ঝড় – ধ্বসে নিশ্চিহ্ন হতে থাকা উদ্বাস্তুদের পৃথিবীর মধ্যে কারা যেন নিজেদের সেফ বলে মার্ক করতে পারেন।

যখন ভিড়ে আর কম আলোয় নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নিরাপত্তা দেবার চেষ্টা আমার স্বাভাবিক প্রতিবর্ত হয়ে উঠছে। তবু বুকে ব্যাগ চেপে ভিড়ের মধ্যে গড়াতে গড়াতে আমার সন্দেহ আমার সংশয়ে আমি এখনও লজ্জা পাই। হ্যাঁ, মনে হয় কেমন একঢালা থাবা ভেবে নিচ্ছি পুরো ভিড়টাকেই, কিংবা বাতি নিভে থাকা রাস্তায় গলা খুলে গানের বদলে আসছে নিজের হৃদপিণ্ডের আতংক, নিজেকেই ততোটা স্বাভাবিক মনে হয় না।

এসবের মধ্যেও নিজেকে মার্ক সেফ করা যায় কিনা বুঝিনা। শুধু সেই দিন সাজাই যেদিন আর মার্ক সেফের পরিকল্পিত মস্তকমুণ্ডন থাকবে না। সেফ হবে মাটি-জল-বাতাস, সবার সবার মতো করে। যখন আমার কোনও প্রিয় মানুষের সঙ্গও অনুমোদন করতে হবে না আমাকে যে কোনও সময়ে যে কোনও রাস্তায় হাঁটতে; এবং অনুমোদনের জন্য বিশেষ সুযোগের যে প্রত্যাশা তৈরি হবে তা আমার কাঁধ অথবা আর কোথাও স্বচ্ছন্দ প্রশ্রয় চাইবে না, সে সবের বাইরে এক স্বচ্ছন্দ গতায়াত থাকতে পারবে আমার।

প্রত্যেক দিন বাড়ি থেকে বেরনোর পরে ফেরা পর্যন্ত নিশ্চিত থাকব আমার ও আমাদের পরিচয় রাষ্ট্রের কাছে বদলে গেছে এমন হবে না। মরে যাওয়া মানুষ শুধু সংখ্যা হবে না। ক্ষতিপূরণের দায় এড়াতে মৃতদেহ নেই হয়ে যাবে না। আমাদের কার বাড়িতে বাড়িতে কী বই আছে, কোন ইস্তেহার তার খতিয়ান দিতে হবে না প্রশাসনকে। ধর্মগুরু বানিয়ে তোলা কোনও সমাজসংস্কারকের বা রাজনীতিবিদের সমালোচনা করলে প্রাণনাশের হুমকির মধ্যে পড়তে হবে না।

এগুলো চাইতে হচ্ছে এমন এক আনসেফের মধ্যে থাকছিই যখন, অন্তত সেই থাকার স্বীকৃতি দিই, দিয়ে যাই। নইলে জলজ্যান্ত ভূত হয়ে এমন অদ্ভুত টিকে থাকা ভবিষ্যৎ বড্ড নিচু চোখে দেখবে যে।

আজ আবিষ্কার করলাম দিনের পর দিন আমি বাগান থেকে বাগানে ঘুরিফিরি। অটোকে জিজ্ঞেস করি ‘ফুলবাগান?’ অটোকে জিজ্ঞেস করি ‘চালতাবাগান?‘ এই স্থানচ্যুত হবার বর্তমানে আমি শূন্যোদ্যানের খপ্পরে পড়ি। বাগানের আগাছা সরানো আর ফুল ফোটানোর মধ্যে কাঁটার খোঁচা আছে, ছোবলও। সেফ থাকলে আগাছা নিয়েই থাকা চলছে কিন্তু, বিষাক্ত।

এমন নয় যে মহৎ হয়না। কল্পনায় হয়। যেমন নিখুঁত হয়। নিখুঁত ব্যাপারটা আসলে কল্পনার সীমাবদ্ধতা। একটা দিগন্ত। অন্তিম। সেই অন্তিম অতিক্রম করে চাইতে পারলে, চলতে পারলে এই নিখুঁত খুঁতো হয়ে যায়। সময়, পারিপার্শ্বিক আর আমি – তুমি- সে তে নিখুঁতের খুঁতো হওয়া বা না হওয়ার তলানি পড়ে থাকে। পাত্র কুঁজোর মতো হলে সারস আর থালার মতো হলে শেয়াল সে তলানি চেটেপুটে নেয়। সে নান্দনিক লেহন ক্ষুধাকে মহত্ব দেয়। মনে হয় টেবল ম্যানার্স আদরণীয়।  মনে হয় আর কিছু খাব না চামচের ভাষায় বলা হোক।

চিঠি লেখা জমা হচ্ছে। ব্যক্তিগত। অথচ সেই স্বহস্তলিখিত ঠিকানাদের ডায়েরি কোনও এক সিন্দুকে ঘুমোচ্ছে যার লোহা দিয়ে মোবাইল ফোনের টাওয়ার তৈরি হয়েছে। বিস্তর কথা, একটানা বলতে হবে। হ্যাঁ-এর পরে না, না-এর পরে ঠিকাছে, ঠিকাছে-র পরে তাহলে দেখা হচ্ছে এমন নয়। বলা দিয়ে যা তৈরি হচ্ছে, ঠিক বা ভুল, অনর্গল হতে থাকা। শোনা থেকে যে প্রতিরোধ হচ্ছে তার না বলতে পারা জনিত ভেঙে যাওয়া, ভাঙতে ভাঙতে ভেসে যাওয়া, ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যাওয়া। এবং হারিয়ে যাবার পরেও সমুদ্রমন্থনের প্রত্যাশা। সেই মানুষগুলোকে বোবায় ধরতে পারে, যারা পোস্টকার্ডের পিছনের অর্ধেক ‘আমি ভালো আছি। তুমি কবে আসবে? আমার ‘ক্ষীরের পুতুল’ এনো। টুনটুনির বাসাটা কাল ঝড়ে ভেঙে গেছে।’ লিখে শুরু করেছিল; পরে ইনল্যান্ড লেটার, খুদে অক্ষর, এমনকি মার্জিনে আঠা না লাগার মতো জায়গায় পুনশ্চ; সাবালক হয়ে খাম, আঠা দিয়ে সারারাত অভিধান চাপা দেওয়া, একটু শেপে আনতে; তাদের কথাবার্তা সব সেই লাল ডাকবাক্সের মধ্যে যেটার পেটে একটা ম্যাজিক ইরেজার, যে সমস্ত পোস্টাল অ্যাড্রেস কেবলই মুছে চলে। ফলত ওই পাঁচশো-হাজার শব্দের মিছিল কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঘ্যানঘ্যান করে, হেই-হ্যাটের অভ্যর্থনা পায়। কেন চিঠি নেই হল, নিয়ে আলোচনা হয়, কি কি ক্ষতি তার হিসেব, অথচ চিঠি আর ফিরবে না। অন্তত তার শব্দের সারি টুকরো টুকরো করে অনেক ভুল মানের খেসারৎ চুকিয়ে যাবে। মোবাইল টাওয়ারের আশ্বাস অন্তর্জাল সহযোগে আপাতত শান্তিকল্যাণ বজায় রাখবে। প্রচুর শব্দ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে সমঝোতা করবে। অভিধান সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু চিঠিকে চেপেচুপে শেপে আনবার তার বিশেষ দায়িত্বপালনের ক্ষমতা তার আর কখনও হবে না।’

মাথুর

আসলে স্থানান্তরণ-ই ভবিতব্য। কুচো এর মধ্যেই ছবি আঁকছিল। মাটির তাল ডলছিল হাতে, পায়েও। ছেনিতে ধার রাখছিল, পাথরে খুঁজছিল অবয়ব। ছবিগুলো জুড়ছিল, মাটি আর পাথরের সব আকারদের সাজাচ্ছিল নানান পটভূমিতে। এদের জুড়ে দিতে চাইছিল শব্দ দিয়ে, সংলাপে।

শূন্যতা আর নৈঃশব্দের মিথোস্ক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি আসমানে গাঁথা তারাদের তখন সবচেয়ে কাছের মনে হতে পারে। যাদের কেউ কেউ অনেক আগেই নেই হয়ে গেছে আলোটুকু ছুঁড়ে দিয়ে প্রাণপণে। স্তব্ধতা ভর করে, ভিড় করে। মস্ত আকাশ, সমুদ্র, পাহাড়, ঝড় দেখলে উদারতার বিযুক্তি আসে। সন্দেশের ভাগ ছেড়ে বুঝদার বড় হয়ে ওঠা লাগে। এসবের পরেও এবং, কিছু কিছু মাপজোক বেমানান মননের। ফলত বন্ধুকে অচেনা লাগে, কিংবা চেনা মনে হয় নীচতাকে, গা বাঁচিয়ে চলা মতো সাবধানী। বাস্তবিক মাধুকরী নামে ডাকলেও ভিক্ষার চালে কাড়া-আকাঁড়া হয় না। অধিকারের অর্জনে যেমন চিলতে হাসি লেগে থাকে শান্তির, তৃপ্তির, আনন্দের। দিনান্তের পাত্রে নিজেকে খুদের মতো আবিষ্কার করতে অপছন্দ হয় না, যদি তা স্বর্ণ হয়ে উদ্ভাসিত হয়। অথবা আজকাল কষ্টিপাথরের অভাবজনিত পারিপার্শ্বিক সৃষ্টি করে ঘোলা জলে মাছ ধরিয়েদের আঁশটে গন্ধ ধুয়ে নিতে হয় গোলাপজলে। এর মাঝখানে শূন্যতা খোলা ঘাড়ে-পিঠে চমক বুলিয়ে দিয়ে যায়। এমনকি শিহরণ চুপ থাকে বিষক্রিয়ায়, মিথোস্ক্রিয়ায়।

    পচা পাঁকের মধ্যে কলম ডুবিয়ে কুচোর গন্ধ উৎসারী লেখা,

‘ইএমআই তে ডানা ও পাখনা কেনার পরবর্তী অবধারিতরা

১.

ঝিলমিল নিচ্ছিল চোখে। কড়া রোদ। দিঘির বাঁধানো ঘাটের শেষ ধাপে বসে একদৃষ্টে চেয়ে চেয়ে বিভ্রান্তি ধারণ করছিল। সচরাচর জোরালো আলোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ধান, সারা শীত রোদ মাখে পিঠ বরাবর। কিছু অন্যমনস্ক ঝোঁকা মাথায় গুটগুটিয়ে হাঁটে। মাটি থেকে আলো উঠে আসেনা। বাকি ন’দিকের যে দিক থেকেই আসুক সে আলো ধানের ওপর তেরছা পড়ে। অথচ এখন দিঘির পাড়ে উথলে ওঠা আলোর দিকে চাওয়া মেলে বসেছিল ও।

    মাঝে মাঝে এক নাছোড় নিষ্ক্রিয়তা ওকে পিউপার গুটির মতো আবৃত করে। তখন নিজস্ব অস্তিত্বের সপক্ষে ওর যত নির্মাণ তারা টুপটাপ ঝরে পড়ে হেমন্তের পাতাদের মতো। ঝরে পড়ে অথচ ঘিরে থাকে, যতক্ষণ এক মৌসুমি হাওয়া তাকে স্থানান্তরিত না করে। ফলে ও বুঝতে পারতে থাকে এমনটা ও করে না। অথচ ঠিক যা ও করে থাকে তাকে আর নাগালে পায় না।

    দিঘির পাড়টা এই দুপুর জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের দখলে থাকে। খুনসুটি, গান, মতাদর্শ। এখন পরীক্ষা। বিভিন্নতার ধার কমিয়ে ফেলার মগজধোলাই ঘরে ঢুকেছে সব। যার মায়ের ক্যান্সার, যার বাবার দোকান ভাঙা পড়ছে, যার প্রেমিকার বিয়ে, যার নেতৃত্বে কলেজে স্লোগানের ধুয়ো ধরে বাকিরা সবাই বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও তথ্য সহ সেক্সপিয়র ও ডাইনোসরের জিনের তুলনামূলক গঠন আলোচনা করছে।

    অথচ জল থেকে আলোর আড়াল দিয়ে এক সার পরী উঠে আসার কথা। মাকড়সার জাল বেয়ে উঠে যাবে লাইটপোস্টের মাথায়। তারপরে আলোর বাতির মধ্যে জমা করবে স্বপ্নের বাষ্প। সমস্ত শহরে সারারাত জুড়ে সে সব স্বপ্নেরা উত্তাপে ভাসবে। কখনও বৃষ্টির ফোঁটা কখনও দমকা বাতাসে সে সব সেঁধিয়ে যাবে কংক্রিটে। ধান অপেক্ষা করছিল। পরীগুলো আসেনি।

    ব্যাপারটা সদরদপ্তরে জানানোর মতো। কিন্তু জানানোর জন্য যা যা সে সব ভেবে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না ওর পক্ষে। কাঁচের মতো যান্ত্রিক দৃষ্টি তখনও। একটা নিম্নচাপ ঘনিয়ে উঠেছে এ শহরের শহিদমিনার ঘিরে। ঝড়। ধুলো। অন্ধ সব। যেহেতু শহর ঝড় ট্র্যাফিক মানতে বড়ো উদগ্রীব। ফাইন দিতে দিতে এ শহরের ইতিহাস আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ফলে ফসলের মাঠের সঙ্গে, ধূসর বালির সঙ্গে, রুক্ষ মাটির সঙ্গে ঝড়ের যে বোঝাপড়া তার ছিটেফোঁটাও শহরের নয়।

    তবু শহিদমিনার ঘিরে ঘনিয়ে ওঠা নিম্নচাপের খবর বেসরকারি; তাই সতর্কবার্তা মনে রাখতে হয়। যদি আজ সমস্ত বহুতল বিন্ধ্যপর্বতের মতো নত হয় ঝড়ের সামনে এই ঝিলমিল লাগা চোখ বন্ধ করতে হবে। পরী মরে যাবে দম আটকে। স্বপ্ন না থাকলে কংক্রিটের বালি-সিমেন্ট ঝুরঝুর করে খসে পড়বে।

    ২. 

পানা থেবড়ে বসেছিল পুকুর পাড়ে। কোথাও যাবার নেই কিচ্ছু করার স্পৃহা নেই মতো। জলের মধ্যে বুজকুড়ি কাটছিল ব্যাঙাচি। পানা জানে ওখানে জলকন্যেরা ঘোরেফেরে। পুকুরের এদিকে কেউ প্রাতঃকৃত্য করে না, আবডাল নেই, নেড়া। ফলে নাকের বা চোখের কষ্ট কম ওদিক থেকে। পানা এমনিতে বেশ জোড়ে হাঁটে, কিন্তু পুকুরের পাশের রাস্তায় ওর গতি আপনা থেকেই শ্লথ হয়। নদীর পাড় ওর বাড়ি থেকে কিছু দূরে, হেঁটে যাবার নয়। আর এই তিরিশ পেরনো জীবনে ওর এখনও সমুদ্রস্নানের সুযোগ ঘটেনি। ওর সমুদ্রদুঃখ কমিয়েছে, আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ের-একাত্মতা।

আসলে মানুষ বলে, জীবন বলে, ওর যাপনে কোনও স্থিরতা নেই; সেই স্থিরতা ও জলে খোঁজে। আগে আগে বাথরুমে জলের চৌবাচ্চায় বসে ঘণ্টা পার করত, কিন্তু শরীরটা বড় হবার পর চৌবাচ্চাটা ছোট্ট হয়ে গেছে। পানা সাঁতার জানে না, স্রোতে ভাসে। ফলে পুকুর কখনও ওর চৌবাচ্চা হবে না। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল অবদি পুকুরের পাড়ে হরেক কাজ, রবি সে সব বাঙালিকে খুব জানিয়ে গেছে। বিকেলে এক হিন্দিভাষী গোয়ালা তার দুধের বড় পাত্রগুলো খড় দিয়ে মাঝে ঘাটে বসে। পুকুরটা তার পরে একটু টান হবার সুযোগ পায়।

তখন ব্যাঙাচি, তখন কচুরিপানার ফুল, তখন সরু সবজে সাপ। কখনও কাঁকড়া উঠে আসে; ওর মনে পড়ে ‘জার্নি’ সিনেমায় কেমন উদ্বাস্তু স্রোতের এক মা তার ছেলেকে কাঁকড়া, বক আর মাছেদের গল্প বলে চলে। গল্পটা পানার ছোটবেলায় ওর সংস্কৃতির উপকথার অন্তর্গত হয়ে এসেছিল। সেই গল্প কী করে পাকিস্তান, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের উদ্বাস্তুদের হয়ে গেল! আসলে এত এক ওরা, অথচ কাঁটাতার বেঁধেছে কেউ; তারা সীমানাশূন্য আকাশপথে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায়, আর পানার মতো খুদকুঁড়োর জীবন কাঁটাতারে বিঁধে পরনের একমাত্র পোশাক ছিঁড়ে ফেলে।

৩.

ধান হঠাৎ দেখতে পায় খুব করুণ এক পানা চেয়ে রয়েছে জলের ভেতর। অশুভ মনে হয় ঘটনাটা। ওরকম অপেক্ষা। অপেক্ষা পরিণতি না পেলে সূর্য শীতল হয়ে যাবে মতো। একবার ঘাড় তুলে ল্যাম্পপোস্ট দেখে। নাহ্‌ কিচ্ছু পতপত করছে না সেখানে। ঘাটের ওপরে লক্ষ্মীর আলপনা ছাপ। দ্রুত মিলিয়ে যাচ্ছে। কে উঠে এল জল পায়ে। কোথায় গেল। জলের ভেতর অমন করুণ চাওয়া কেন। একটা কাক ডেকে যাচ্ছে খামোকা। গুলতির মতো হাত পাকিয়ে সেটাকে উড়িয়ে দেবে ভেবেও ধান নিঃস্পন্দ বসে থাকে। যেন স্বপ্নের মধ্যে আছে। যা করবে ভাবছে সেরকম কিছু করছেই না আসলে।

একটা মৃদু হাওয়া খেলে যায় ওর মাথা ছুঁয়ে। কাঁপুনি। পুকুরের জল শান্ত। গভীর ষড়যন্ত্রের মতো। নারকেল পাতার ফাঁক গলে আসা রোদ দিয়ে যেন হিরের চিক। অথচ কোনও অবয়ব উঠে আসছে না। অস্থির হচ্ছে ধান।’

কুচো শেষ করে, ‘প্রতিক্রিয়া দেখানো ভালো না কি প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠা! আসলে কিছু রাগ লিখতে চাইছি, কিছু অসম্মান। কিন্তু শব্দেরা কেমন জম্বির মতো আচরণ করছে। আভিধানে ভরাভরতি নড়েচড়ে। অথচ আবেগের পৃথিবীতে পারলৌকিক। যেন শব্দেরা শব। যেন হৃদয়হীন। অতএব নিরক্ত। অতএব বিবর্ণ। অতএব আবেগকে ভয় দেখায়। ভয় পেতে পেতে সিনিক আবেগ প্রেম শব্দের উচ্চারণ করে সাইবেরিয়া। অথবা একটা সজীব দানব কলসপত্রী প্রতারণাকে শোনে সংঘং শরণং। কখনও বৃষ্টিকেই বলে আত্মহত্যা।’

আক্ষেপানুরাগ

কী সব দু-পেয়ে হাঁটে, চলে এবং বলে। কেবল বলে। মুখে ফেনা তুলে আকাশে হাত তুলে শব্দদূষণে অংশ নেয়। যা ভাবে বলে না, যা বলে করে না, যা করে তা বোঝে না। যা তা। নিজেদের না বদলে দুনিয়া বদলায়। যুক্তি বলে যা ঢাল করে ছায়াবাজি করে, তা আসলে আগে নেওয়া সিদ্ধান্তের সপক্ষে রাখা কিছু অবলম্বন। ছোটবেলার উত্তর দেখে অঙ্ক করার বিপ্রতীপ প্রক্রিয়া, কখনও জানেনি ঠিক কোন মঞ্জিলে যেতে হবে। অথচ হয়ে উঠেছে পথপ্রদর্শক। হাজারো পথের অস্তিত্ব না মেনে মৌলবাদের জোদ্দার প্রতিবাদ করে চলে। বাড়ি ফিরে ই.এম.আই হিসেব করে সন্তানকে একত্রে আইনস্টাইন, রবীন্দ্রনাথ, মার্ক্স বানানোর ছক কষে ঘুমোতে যায়। শনিবার বিকেলে ব্রহ্মদৈত্যের সমাবেশে যোগ দেয়, রাতে ঘাসেদের মধ্যে ট্যাঁস বাঁশেদের সঙ্গে পান-ভোজন সেরে রবি সকালে অবস্থান বিক্ষোভে বসে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বদলে শ্যালিকার বিবাহবার্ষিকীতে যোগ দেয়।

কুচো আসলে এতটা করিতকর্মা হতে পারেনি, ফলে বিভ্রান্ত, অরা বলে দেবে হিংসে, কুচোর তাতে বালও ছেঁড়া যায় না। কুচো ‘ইচ্ছেপুরণ’ নামে ময়ূরকণ্ঠী রঙের হ্যান্ডমেড পেপারের ডায়েরি টানে,

‘খুব করে মনে হচ্ছে আমি এক হঠকারী আগন্তুক, জোর করে আমার অবস্থানগুলো জবরদখল করছি। অথচ সেটা দখলে নেই আমার এ কথা আমার থেকে ভালো তারাও জানে যারা অভিজাত ঔদাসীন্যে আমাকে সহ্য করে নিচ্ছে তাদের আশেপাশে। ফুটপাথের সংসারের পাশে এবং চলমান সিঁড়ির নাগালে আমার যে সময়ানুগ পা তোলা তারা কে কোথায় ফেরে তার স্থিরতা থাকে না। তবু এ কথা স্থির কোনও মধ্যরাতে তারা ফুটপাথ বদল করবে না। অতএব আমার শিকড় নেই এ কথার আগে আসে আমার কোনও মাটি নেই। মাটির ভেতরে চারিয়ে যাবার অক্ষমতা বাতাস শুষে নেবার থেকেও আমায় প্রতিহত করে। বাতাসের সেই না হয়ে থাকার জন্য আমার কোনও আকাশ হয় না, দেখবার অথবা উড়বার।

    একটা ফাঁপা পুতুলের মতো আমি শুধুই সময় বেয়ে সামনে এগোই, আমার কোনও ফিরতে পারা থাকে না। দুপুরের স্বপ্নের শেষে মেঘের বিকেলে ধড়কতে হুয়ে দিল শান্ত হতে হতে বলতে থাকে আমি কোনও পুনরুত্থান চাই না। জীবনের প্রিয়তম মানুষটিকেও আমি তার কবরে পৌঁছে দিতে চাই ডেথ সার্টিফিকেটের প্রামাণিকতায়। অথচ তার মৃতদেহের সামনে, আমার খুব তাকে আমার জন্য চাওয়ার সময়ে আমি তো তার ফিরে আসা চেয়েছি। হঠাৎ বৃষ্টির ভুলে যাওয়া ছাতা ধরে, আচমকা উত্তুরে হাওয়ার কাঁপুনি আটকানো চাদর করে আমি তাকে চেয়েছি। চেয়েছি এক থালা থেকে দলা করে ডাল ভাত অন্যের মুখে তুলে দেবার জন্যই। ভোকাট্টার কাড়াকাড়িতে কিংবা রক্তকরবী পড়বার সময়ে। একটা স্বপ্নের সাময়িকী এ সমস্ত চাওয়ার সত্যিকে নির্দ্বিধায় মিথ্যে সাব্যস্ত করে দিয়ে যায়।

    একা আর না-একা দুটো থাকাই না হয়ে গেলে আমি সরষে আর কারি পাতার ফোড়নের গন্ধ বানাই। একটা সুস্বাদ নিজেকে বহুর স্বীকৃতিতে হয়ে উঠতে দেখতে ব্যাকুল। অথচ মেলাগুলো খুঁজে পেতে শহরে একটা আমুন্ডসেন বা পিয়েরি নামাতে হয়। এবং সূর্যহীন এক শীতলতায় ময়দান, নন্দন রক্ষিত হয়, আম্রপালি হয় না। এ অবস্থায় একটা নদীকে নির্বিকার বয়ে যেতে হয়। ছবি, গান, গল্প নিয়ে তার ঘাটে ঘাটে পসরা নামে। বিনিময়মূল্য না থাকা আমি নদীর মধ্যে ভেসে বেড়ানো মূর্তি থেকে কাঠামো হতে থাকা ঈশ্বরের ডিঙি বেঁধে জল মাপি। মেপে যাই।

দুপুরের স্বপ্নে পেটের মধ্যে ডিমের চাকা ভরা এক প্লেট ভাজা ইলিশ কুটকুট করে খাচ্ছি, অন্তত কেজি দুই সাইজের মাছের চাকা তারা। শেষ দিকটায় দেখলাম চোখ কম্পিউটার স্ক্রিনে থাকায় প্লেট কখন নেই-মাছ হয়েছে টের পাইনি, হাতড়াচ্ছি। বানানো স্বপ্নগুলো নামাতে পারছি না, খুব একটা পারা যায়না সেগুলো কখনোই; ফেনিয়ে ওঠা স্বপ্নগুলোই সান্ত্বনা।

ঘোলাটে হলেই শীতকে বেশি বেশি ভালো লাগে আমার। কুয়াশা খুঁজতে ছাতে উঠেছিলাম। হাত পকেটে। আঙুলের ডগায় মসৃণ বালি পেলাম। সমুদ্রের কাছে কখনোর চিহ্ন। বালি পেতে তার অনুষঙ্গদের সারি এল। কর্কশতা, ক্ষণস্থায়িত্ব, যন্ত্রণাময় আহ্নিক ও বার্ষিক গতি, মরুভূমি, মরীচিকা, মরূদ্যান। কয়েক চিমটে বালি রয়ে গেছে। রয়ে যায়। যত মসৃণ হোক, শেষ পর্যন্ত বালি-ই। মরূদ্যানের আবহমানের ভিটে-মাটি। মনে পড়তে থাকে পকেটটা উল্টে পালটে অনেক ঝাড়াঝুড়ি করেছি, বালি-পাথর ঘরবন্দী করার পরে। আঙুলের ডগায় তবু এখন চিকচিকে বালি লেপটে। মণিবন্ধে জিভ ছোঁয়ালে মনে হয় এই মাত্র নোনা জল বয়ে গেছে। কিসের ভাঁজ থেকে যে কি উঠে আসে। ফসিলের ইতিবৃত্তান্তের মতোই। চোরাবালি অতীত উগরোয়। কতো কিছু কড়কড় করায় বালি, ক্রমশ ভোঁতা করে দিতে।

আমি নিশ্চিত জেনে ফেলতে চাই না আমাদের আর কখনও দেখা হবে না, আমার ঘুমের মধ্যে কখনও আর কেউ ক্রমাগত ডেকে চলবে না দরজা খুলে দেবার জন্য। আমি আমার ঘুমের মধ্যে, জেগে থাকার সময়ে বারেবারে অপেক্ষা করে ফেলব। আমি স্বপ্ন দেখব একটা উঁচু ছাত থেকে ওকে কারা ফেলে দিয়ে হা হা করে হাসছে। ঘুম ভেঙে একদিন আমিও নিশ্চয় আর ঘেমেনেয়ে উঠব না, কারণ ওদের ফোবিয়া-ট্রমা-শারীরিক আঘাত-উচ্ছেদ-জীবনসংশয়-নিরাপত্তার অভাব হয় না, ওরা তো আমরা নয়।

হারিয়ে ফেলা, হারিয়ে যাওয়া সব মেনে নিতে শিখি। পরিণত হওয়া, অভিজ্ঞ হওয়া ঠেকিয়ে তো রাখা যায় না। জ্বর হলে প্রত্যেকবার কিছুটা সময় হারিয়ে যায়। শনিবার জ্বর এল, মাথা তোলা গেল তিনদিন পরে। অথচ মাঝখানে কোনও রবি-সোম নেই। কিছুতেই মনে পড়ে না কখন সকাল, কখন খিদে, কখন ঘুম, কখন তুমি। ঘষা কাঁচ, ওয়াইপারের শত চেষ্টার পরেও চোখের পাতা ভারি। হারিয়ে ফেলা লেপেচুপে এক হওয়া মুহূর্তদের স্বকীয়তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

এই খোদ কলকাতায় আমার একটা নিজস্ব তেলেনাপোতা ছিল। তেলেনাপোতারা নিজস্বই হয়। জ্বরের তিনদিন কাটলে হারিয়ে যাও তেলেনাপোতা। ছাতে গিয়ে আলসে ধরে দেখলাম আমার পরাবাস্তব একঢালা তিনদিনের অতিবাস্তব  বিচ্ছিন্ন দীর্ঘতার অবলম্বনে আমার আর তোমার মাঝে এক বহুতলের তিনতলার ছাত বাঁধা হয়েছে। হারিয়ে যাচ্ছ ক্রমশ।

হয়ত হারিয়েই থাকবে।’

অভিসার

তলপেটের ওপরে মাথা ও পেটের নিচে পা আছে জনিত  –  অথচ প্রত্যেকটা দিন ঘুমের ঠিক মাঝ বরাবর কুচোর মাথা থেঁতো হয়ে যায়। ও যখন উঠে বসে তখন ওর ঘাড়ের ওপরে কিচ্ছুটি নেই। দেখবার অভ্যেসে ঘাড় কাঁধ ঘুরিয়ে বসে মাথাটাকে চৌচির মাটিতে মিশে থাকা অবস্থায় অনুভব করে। চোখের মণি দুটো ওর শরীর আর থেঁতলে পড়ে থাকা করোটী-ঘিলু- রক্তের মাঝামাঝি ভেসে বেড়ায়। থিকথিকে পিঁপড়ের দল একটু একটু করে চেটেপুটে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে সব দলাপাকানো তরল-কঠিন। এর মধ্যে থেকে বাষ্প হয়ে উঠতে থাকে কুচোর অতীত; ধোঁয়াটে।

    ছোটবেলায় কোথাও কেটে-ছড়ে গেলে জিভ দিয়ে জায়গাটা চাটত, বড়রা কেউ শিখিয়েছিল। লালা জীবাণুনাশক। কুচোর প্রবল ইচ্ছে হয় ধুলো যে রক্ত শুষে নিচ্ছে ক্রমশ, তাতে জিভ ছোঁয়াতে। অথচ জিভও ওখানেই মিলেমিশে পড়ে। জিভ না থাকায় উচ্চারিত শব্দ সহযোগে প্রভুত্বকামিতা বাধা পায় ওর। এদিকে লিখতে গেলে মাথা লাগে বলে সংবিধান। ফলে সক্রিয় আঙুলগুলো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে এক্কেবারে প্রাক্‌-কথনের সময়ে। তারপর স্বয়ংক্রিয় যান্ত্রিক প্রযুক্তির দক্ষতায় নিভাঁজ লেখা পাটে পাটে তৈরি হতে থাকে। তৈরি হয় না কি তৈরি করতে হয়, সে নিয়ে বিতণ্ডা থাকে।

মাথা বিচ্ছিন্ন কুচোর কিন্তু লেখা চলে।

‘শস্ত্র-শাস্ত্র  –  আমার নিজস্ব বলতে এই অ থেকে ৺ । অথচ নিয়ত খাঁচা ভেঙে পাখি আমার কোন বনে পালায়। সহজ যতই হোক জল বাতাস মাটি সম্পর্ক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ নির্বিকল্প। সুতরাং বর্ণ শব্দ পদ প্রত্যয় উপ-অনুসর্গ সমাস কারক ক্রিয়া বিভক্তিতে সতত ভক্তি ধরে রাখা ন্যূনতম যোগ্যতা। এদিকে প্রায়শ বলতে অপছন্দ আমার। কংক্রিটে শয়ান ফুল এবং শিশুদের নির্ঝঞ্ঝাট ঘুমের কপালে চাঁদমামার টি ডাকা দরকার মনে হয়। তখন অ-এর পায়ে পড়ি, ৺-কে তুলে আনি বিশ্রাম থেকেই। অ গম্ভীর নাকের ওপরে চশমা নামিয়ে ঘাড় না পাতবার যুক্তি শানায়। ৺ ধুপুস করে বসে পড়ে নামপদের সামনে। আমার সমস্ত যত্ন আমার সকল নিয়ে বসে থাকা কেবল ট্রেন ফেল করে ফেলে আনন্দবাবু। কেবল তার সমস্ত টিকিট ঝাপসা হয়ে যায়।

দুপুরের খাওয়ার পরে মাথা একটা ভাতঘুম শুরু করে। সেই ভাতঘুম একটা লম্বা করিডোর ধরে দিগন্তের গুহায় কড়া নাড়তে চায়। আর ঠিক রাতের চাঁদের মতো সে গুহা হাতছানি দেয়, এবং না ছোঁয়ার দূরত্বে সম্মোহন জারি রাখে। এই সময়ে পায়ের নিচে একটা খাদ দরকার। গভীর পরিত্যক্ত কুঁয়ো, অথবা দূরে রূপোলী নদীর দৃশ্যপট এঁকে অপেক্ষমান বিপদজনক পাহাড়ি চাতাল, অথবা অন্ধকার অচেনা সিঁড়ির অসমঞ্জসতা, অথবা চেনা ন্যাড়া ছাতের কিনারে কিম্বা চলন্ত রেলের দরজায় ঝুঁকলে মাটির আয় আয় – যে কেউ যা কিছুর একটা আশিরনখ ঝাঁকুনি পাখিদের ব্যস্ততায় ফেরাতে পারে। ঘরে ফেরার অথবা জাগরণে।

ক্রমাগত পাক খাচ্ছে, খাচ্ছে। একটার পরে একটা গান বেজে চলেছে। এতবার চলেছে যে কার পরে কে আসছে মুখস্থ। এরকম হলেই কি তা একঘেয়ে! আর একঘেয়ে মানেই কি বৈচিত্র্যের দায়ে নতুন সিকোয়েন্স খোঁজা! কে জানে কেন ছেঁড়া রিল খুব নৈপুণ্যের সঙ্গে জুড়তে চাওয়া ছিল। অনেকবার বেজে ক্লান্ত হয়ে পিনে বিশ্রাম নিতে বসে পড়া ফিতে খুলে মুছে শুকোনো, যথাসম্ভব কম অংশ বাদ দিয়ে দিয়ে, চেনা সুর বাঁচানো। রিফিল দুহাতের অথবা মোমের পরিমিত উষ্ণতায় গলিয়ে নেওয়া। এমন ইউজ অ্যান্ড থ্রো তখনও কোথায়, নীল মাথা আর সাদা গায়ের রেনল্ডসের সাদা, ময়লাটে হত কত কত রি-ফিলে! এমনকি লিক হওয়া কালির পেন এপাশ- ওপাশ বদলে চালিয়ে যাওয়া, সোনার টুপি পরা সে সব যত্ন। যত্ন হারিয়ে যাচ্ছে। অথবা যত্ন ক্যারেটের রেটে। নিক্তিতে মাপা। ধরে নেওয়া যাক ওরকম। মাপা হলেও আছে। থাকুক। যত্ন নেই হলে পাক খাওয়া থামবে কখনও। আসলে এ ব্রহ্মাণ্ড কিছু পাকেই বাঁধা। যত্নের। যা একঘেয়েকে নতুন করে পায়। আহ্নিক-বার্ষিকের নিয়ম জেনেও আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বাদলদিনের কদম ফোটার তিরতির। এবং অবশ্যই খুব পুরনো চর্চায় প্রতিষ্ঠানকে ‘না’ বলে চলা। বলাটা চালিয়ে যাওয়া আন্তরিক যত্নে। ‘না’-এর বেশিটাই ক্ষমতা অগ্রাহ্য করবে, করেছে, করছে দেখে দেখেও। খুব হিসেব কষেই হোক, হোক তবু। বৃষ্টির গান অথবা পাতার নাচন উপভোগের যতটুকু উত্তরাধিকার বইয়ে দেওয়া যায় যাক। উপভোগের সংবেদন শুধু নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা গড়ে তোলার যত্ন নিয়ে হোক সব দৈনন্দিন।

শীতার্ততার রাতকেও ফুরিয়ে যেতে হয়। রোদে যাবতীয় ‘না’, খুলে ফেলা সোয়েটারের মতো প্রান্তবর্তী। যা না বললে চলতোই না মতো ডাকাবুকো ছিল সে ফসল তোলা মাঠের মতো নিস্তরঙ্গ, এক মাপে ছাঁটা – ভালো আছি ভালো থেকো, হ্যাঁ, না, কিন্তু, অথবা,এবং ইত্যাদি।

একটু একটু গেঁথে যেতে যেতে এগোনো। চোরাবালির ভিতর দিয়ে। উপভোগ্যই। যতক্ষণ একগাছি আমি-ও আলো-বাতাস পাচ্ছি স্বাদ নিতে থাকা, স্বনির্বাচিত। ক্রমশ কমে আসা ক্ষমতা দিয়ে ঠেলে যাওয়া অপ্রতিরোধ্য জঙ্গম গিলে ফেলাদের। পুরোপুরি জঠরস্থ হওয়ার পরে মাটি আছে, আগুন অথবা এবং জলও।
মোদ্দা কথাটা হল অবাধ্যতা খুব চর্চা করা দরকার। তবে কিনা তার আগে শৃঙ্খলাও। ভালবেসেই। হ্যাঁ, ওই গদ্য কবিতা লেখার আগে যেমন ছন্দের সঙ্গে ঘর করতে হয়, সেরকম।’

বাঁশ পেকে উঠে ট্যাঁস হয়েছে বলে ইঁটচাপা দুবলাগুলোর একই বংশের বলে পরিচয় দিতে চায় না। ব্রহ্মদৈত্য, মামদো এতে বেশ মদত দেয়। বাঁশকে আরও উদ্ধত হতে উৎসাহিত করে। বাঁশ সংক্রান্ত নানা প্রবাদ বহুউল্লেখিত। ফলে প্রশ্রয়দাতারা জানে শেয়াল রাজাকে ঘুষ দিয়ে ডোম ঠিক পরের প্রজন্মের কাঁচা বাঁশ  নুইয়ে নিতে পারবে। আপাতত তার প্রচ্ছন্নতম কৌলীন্যতন্ত্রের ধারক উত্তরাধিকারীরা ঘাসেদের পাপোষ আর ঘরের দেওয়ালে চোখের স্বাস্থ্যের স্বার্থে জাতে তুলুক। বাজার যখন আছে, তাকেই ব্যবহারের ছল করে ওই গুপ্ত কুলীনরা বিপ্লবের নামে অন্তর্ঘাত করে যাবে অনায়াসে। বাকি মগজ ঘিলু হয়ে আপাতত ধুলো চাটছে।

পাতা ভরে উঠছে ময়ূরকণ্ঠী ডায়েরির।

…………………

পরিবেশনাঃ খাপছাড়া আড্ডা

Leave a Comment