জঙ্গিবাদধর্ম সমালোচনাপ্রবন্ধবাংলাদেশরাজনীতি

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ইসলামীকিকরণে অগ্রগতি

বায়ান্ন থেকে একাত্তর। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা। সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে সেক্যুলার বাংলাদেশ। বর্তমানে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাস্তান-এর দ্বারপ্রান্তে। একনজরে দেখে নিই, ইসলামাইজেশনের পথে বাংলাদেশের পথচলা ও তার ফল।

১. সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজনঃ ৭২ এর সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ছিল না। সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতাকে পোক্ত করার জন্য সংবিধানে এটি সংযোজন করেন। একইসাথে তিনি একাত্তরের ঘাতক রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দলের রাজনীতিতে আসারও সুযোগ দেন। এরপর থেকেই জামাত বাংলাদেশকে ইসলামীকরণে তার কার্যক্রম পুরোদস্তুর শুরু করে। আজ বাংলাদেশে ইসলামীকরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগের মত দলও সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম তুলে দিতে পারেনি। আসলে জামায়াতে ইসলামীর ইসলামীকরণে আওয়ামী লীগও বাদ যায় নি। ধর্ম বিষয়ক মানসিকতায় আজ আওয়ামী লীগ আর জামায়াতে ইসলামীর পৃথক করা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২. রাষ্ট্রধর্ম ইসলামঃ আরেক স্বৈরশাসক এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম অন্তর্ভূক্ত করেন। একটা প্রবাদ আছে “ঘরে আগুন লাগলে তাতে খড়কুটো দিয়ে তাড়াতাড়ি পুড়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।” জিয়াউর রহমান বিসমিল্লাহ দিয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের অন্তরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন, আরেক সেনাশাসক বাদ যাবেন কেন? একজনে সংবিধানের সুন্নতে খতনা করলেন আরেকজন রাষ্ট্রের সুন্নতে খতনা করলেন। জামায়াতের পোয়াবারো। বিশ্ববেহায়াদের হাত ধরে শকুনরা এবার তাদের আসন পোক্ত করার সুযোগ পেল। বর্তমান অবস্থা তো জানেনই। আওয়ামী লীগ যথারীতি রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখেছে। রাষ্ট্র আজকাল নামাজ রোজাও করে কিনা কে জানে!

৩. রোজার সার্বজনীনকরণঃ রমজান মাস আসলে দেশ এখন এক মহা ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। দিনমজুর ও নিম্নশ্রেণী ব্যতিত অন্যান্যদের কাছে রোজা হল সওয়াব কামাইয়ের জন্য একটি মহান মাস। ধর্মীয় দৃষ্টিতে যা পাপ বলে বিবেচিত তা দিনমজুর ও নিম্নবিত্তদের মাঝে কম, তাই তাদের রমজান মাস নিয়ে তেমন মাথাব্যথা থাকে না। তাছাড়া রোজা রাখার আনুসঙ্গিক ব্যয় বহন করা এবং রোজা রেখে শারীরিক শ্রম দেয়াও নিম্নবিত্তদের সম্ভব হয় না। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের জন্য সওয়াব কামাইয়ের মাধ্যমে পাপমোচনের অবারিত দ্বার খুলে দেয় রমজান। শিক্ষিত-অশিক্ষিত-ছাত্র-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-জ্ঞানী-অজ্ঞানী-ঘুষখোর-গাঁজাখোর-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই রোজার মাসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে রোজা রাখার জন্য। সোজা কথায় পাপীশ্রেণী পাপমুক্তির মোক্ষম এই সুযোগ মোটেই হাতছাড়া করতে চায় না। ইফতারীর সময়ে যদি রাস্তায় কেউ বের হয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন যে রাস্তা এমন ফাঁকা যে আপনার মনে হতে পারে আপনি কারফিউ এর মধ্যে বাইরে নেমেছেন। সিলেটসহ অনেক জায়গায় রোজার মাসে কোন অমুসলিমের কাছেও খাবার বিক্রি করা হয় না। রোজা শুরুর আগে খাবার দোকান বন্ধ রাখার দাবিতে জঙ্গি টাইপের উক্তি দিয়ে মিছিল করতেও দেখা যায়। আরো ২৫-৩০ বছর পূর্বে ফিরে গেলে দেখা যেতো যে, তখন রোজা ছাত্রদের মাঝে অতটা গুরুত্ব পেত না। তাদের কাছে শিক্ষাটাই প্রধান বিষয় ছিল, ধর্ম অতটা গুরুত্ব পেতনা। শিক্ষকরাও এখনকার মত ধর্মান্ধ ছিল না; এখন যেমন বিজ্ঞানের শিক্ষকও ইসলাম শিক্ষার লেকচার প্রদান করে, এটা একদমই ছিলো না। বরং হুজুর টাইপ শিক্ষকদের অজ্ঞানতা-কুসংষ্কার নিয়ে পিছনে উপহাস করা হতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মভক্তি ছিল কিন্তু ধর্মভয় এতটা ছিল না।

৪. নারীদের হিজাবীকরণঃ দেশে পেশাজীবি নারীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও নারীদের বস্তাবন্দীকরণ (বোরকাকরণ) ও হিজাবীকরন বাড়ছে আরো বেশি আশংকাজনক হারে। ওয়াজ মাহফিল, জুমার নামাজের খুতবাসহ (খুতবা এখন আর রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধানের গুনগান নয়) বিভিন্ন প্রচারে প্রচারে নারীদের বোরকার মধ্যে ঢুকানোর পুরুষালি প্রবণতা বাড়ছে পূর্বের তুলনায় বহু বহু গুন। এ ছাড়াও আযানের সময় মাথায় ওড়না বা কাপড় দেয়াটাও একটা প্রচলিত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আযানের সময় কোন নারীর মাথায় কাপড় না দেখলে আজকাল শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বয়সী পুরুষের মাথা আউলাইয়া যায়। নিয়মিত গাঞ্জাখোড়, ডাইলখোড়, ইভটিজার, ধর্ষক, ঘুষখোর, বদমাশ, লুচ্চা থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম যে কেউ আপনার বা আপনার মা-বোন-স্ত্রীকে রাস্তায় ধমক দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিবে, যদি আপনার বা আপনার মা-বোন-স্ত্রী আযানের সময় মাথায় কাপড় বা ওড়না তুলে না দেয়। এককালের পর্দা ফাটানো নায়িকা শাবানা, ববিতা, শাবনাজ থেকে শুরু করে হালের হ্যাপি পর্যন্ত হিজাবের ছায়াতলে ঢুকেছে।

পপপ

হ্যাপি (হিজাবের আগে)

full_428793972_1426165544

হ্যাপি (হিজাবের পরে)

৫. জঙ্গি উত্থানঃ জঙ্গি সম্পর্কে লুৎফুজ্জামান বাবরের সেই বিখ্যাত ডায়লগটা আপনারা বোধ হয়ে কেউ ভুলেননি-“উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।” বিএনপির আরো একটি বিখ্যাত ডায়লগ ছিল- “বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি।” অবশ্য পরে বাংলা ভাইকে ফাসি দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করে গেছেন যে তাদের বাণী মিথ্যা ছিল, মিডিয়াই সঠিক ছিল। জামায়াতের জঙ্গি সংশ্লিষ্ঠতা বহুবারই প্রমাণ হয়েছে। জামায়াতের অঙ্গসঙ্গঠন ইসলামী ব্যাংককে জঙ্গি সংশ্লিষ্ঠতার জন্য জরিমানাও করা হয়েছিল। এছাড়া ইবনে সিনা হাসপাতালসহ বেশকিছু অঙ্গসঙ্গঠন জঙ্গিদের অর্থায়ন, সেবা-চিকিৎসা প্রদান করে থাকে। এছাড়া বিএনপি শাসনামলে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান বিষয়ে তারেকসহ অনেকেরই সংশ্লিষ্ঠতা আছে বলে বর্তমান তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

৬. জঙ্গিবাদের বিস্তারঃ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জঙ্গিবাদের উত্থান বিএনপির ২০০১-২০০৬ শাসনামলে হলেও এর সার্বজনীন বিস্তার ঘটেছে বর্তমান আওয়ামী শাসনামলে। ২০১৩ সালে হেফাজত উত্থান এবং তৎপরবর্তী আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে হেফাজত-তোষণ দেশের অন্যান্য সকল জঙ্গিদের উত্থানে ধনাত্মক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে দেশে একশটির বেশি ইসলামী সংগঠন রয়েছে, যারা জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত। একদিকে নাস্তিক হত্যার নামে একের পর এক ব্লগার হত্যার পরও সরকারের প্রায় অবিচলিত থাকা, ব্লগারসহ অন্য সকল হত্যাকেই জামাতের ওপর দোষ চাপানোর ব্লেইম-পলিটিকস দেশে সক্রিয় অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পথ করে দিয়েছে। ব্লগার রাজিব হত্যার সাথে জড়িত জঙ্গিদের ও অন্যান্য জঙ্গিদের গ্রেফতার করার পরেও জামিনে ছেড়ে দেয়া জঙ্গিবাদকে ক্রমাগত শক্ত করেছে।

৭. শরিয়াহর স্বপ্নদোষ এবং জঙ্গিবাদের বিপুল সমর্থকগোষ্ঠী তৈরীঃ বাংলাদেশের মানুষ তাদের ব্রাউজারের এক ট্যাবে পর্ন মুভি চালিয়ে, আরেক ট্যাবে ইসলামের পক্ষ নিয়ে নাস্তিকদের গালাগালি করে। শরিয়াহ সম্পর্কে আদৌ কোন জ্ঞান না থেকেও এরা শরিয়াহ নামক স্বপ্নদোষে ভুগে থাকে। শাহবাগ আন্দোলনকে নাস্তিকের আন্দোলন এবং নাস্তিকতাকে ঋণাত্মকভাবে উপস্থাপন করে করে পত্রিকাগুলো দেশে স্বপ্নদোষে ভোগা মুসলমানদের নাস্তিকতার বিরোধিতার নামে জঙ্গিবাদের সমর্থনকারী বানিয়ে ফেলেছে। ফেসবুক ব্লগে জঙ্গিবাদের পক্ষে হাজারো প্রচারণা চলে, অথচ এদের বিরুদ্ধে কখনো আইনি কোন পদক্ষেপ নেয়ার একটি উদাহরণও দেখা যায় নি।

৮. সংখ্যালঘু নির্যাতনকে জাতীয়করণ এবং হিন্দু বিতাড়নঃ ২০০১ সালের আদমশুমারী থেকে ২০১১ সালের আদমশুমারীতে দেশে হিন্দুর সংখ্যা কমেছে। যদিও হিন্দুরা মুসলমানদের চেয়ে সন্তান জন্মদান কম দিয়ে থাকে, তবুও তা কখনোই উন্নত বিশ্বের মতো নেগেটিভ হতে পারে না। দেশে বর্তমানে দুর্গা পূজার আগে মূর্তি-ভাঙাও প্রায় উৎসবে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া সারা বছরব্যাপী বিভিন্ন ছুঁতোয় নাতায় দেশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন চলছে। এখন তা কেবল হিন্দু তাড়নেই থেমে নেই। পাহাড়ি আদিবাসীদের ওপরও সমান হারে নির্যাতন চলছে। ভয় দেখানো, প্রহার, খুন, ধর্ষন, মন্দির-প্যাগোডা ভাঙা বা পুড়ে দেয়া, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, ইত্যাদি এতোই গতানুগতিক হয়ে পড়েছে যে, এগুলো প্রায়শই আর সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় না। আবার এসব কাজে সবসময়ই সরকারী দলের লোকেরাই এগিয়ে থাকে। বর্তমান শাসনামলে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কর্তৃক সংখ্যালঘু নির্যাতন বিগত বিএনপি সরকারের সময়ের নির্যাতনকে বহু আগেই অতিক্রম করে ফেলেছে। অন্য সব বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপি-জামাতের বিরোধ থাকলেও সংখ্যালঘু নির্যাতনে তারা মাসতুতো ভাই। বিএনপি শাসনামলের রেকর্ড রেখে তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী শাসনামলেরটা করেছে বিএনপি; কিন্তু কেউ কারো বিচারের ধারে যাবে না। এই একটি বিষয়ে তারা মুসলমান-মুসলমান ভাই ভাই।

তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। কী দরকার এসব প্যাঁচাল পেড়ে!

Leave a Comment