(চিত্রগুপ্তর ডাক পড়েছে ঈশ্বরের দরবারে। চিত্রগুপ্ত তার খাতা-কলম নিয়ে দরবারে প্রবেশ করলে ঈশ্বর তাকে সামনের চেয়ারে বসতে দিলেন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভলিউম কমিয়ে দিলেন।)
চিত্রগুপ্তঃ জ্বী মহামান্য, আমাকে তলব করেছেন?
ঈশ্বরঃ হ্যাঁ, কিন্তু এখানেও খাতা-কলম নিয়ে এসেছো?
চিত্রগুপ্তঃ জ্বী মহামান্য। এটাই তো আমার চাকুরী।
ঈশ্বরঃ তোমার বস কই? টেলিফোনেও তো পেলাম না। তোমাকে দিয়ে কাজ হবে না, তারপরও তোমাকেই ডাকতে হলো।
চিত্রগুপ্তঃ বস বিশ্রাম নিচ্ছেন। তার আবার লাঞ্চের পরে ন্যাপের অভ্যাস আছে তো।
ঈশ্বরঃ তোমার বস নাক ডেকে ঘুমাবেই তো। এই যে চট্টগ্রামে আরমান নামে এক পথচারী শিশু আজ ছাত্রলীগ-ও যুবলীগের সংঘর্ষে মারা গেলো, শিশুটির জন্য মৃত্যুর দূত পাঠানোর অর্ডার দিয়েছিলো কে?
চিত্রগুপ্তঃ মহামান্য, এতো আমার কাজ না। আমি কেবলই যমরাজের পি.এস হিসেবে মৃত্যু পরবর্তী তথ্য ও উপাত্তের হিসাব লিখে থাকি।
ঈশ্বরঃ তুমি কিসের পি.এস। তোমার যা কাজ তার বাইরের খবরও রাখতে হয়। তুমি জান মর্ত্যের বসদের পি.এসরা কত খবর রাখে, বসের জন্যে কত কিছু করে? তোমাদের মতো পুরুষ পি.এস তারা রাখে না অবশ্য।
চিত্রগুপ্তঃ জ্বী, মহামান্য। আমার বসও তাই বলেন। আপনি যদি আমার বসের পি.এস হিসেবে একজন উর্বশী নিয়োগ দিতেন, তাহলে আমিও বাঁচতুম। সেই পৃথিবীর শুরু থেকে নামমাত্রই স্বর্গে পড়ে আছি, কেবল খাতা-কলম; কিছুই দেখা হয়নি। মেনকা, রম্ভাদের কেবল নাম শুনেই যাচ্ছি, একবার চোখেও দেখিনি। ছুটি পেলে ক’দিন ঘুরে দেখতে পারতাম।
ঈশ্বরঃ রাখ তোমার ন্যাকামো। তোমার বসকে ফোন লাগাও। দেখ, তার ন্যাপ ভেঙেছে কিনা। ফোনে পেলে বলো যে তাকে এখানে তলব করা হয়েছে।
(যমরাজকে ফোনে পাওয়া গেল। যমরাজ হাজির। ঈশ্বরকে অভিবাদন জানিয়ে যমরাজ তার নির্ধারিত চেয়ারে বসলেন। চিত্রগুপ্ত তার খাতা-কলম নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।)
যমরাজঃ আমাকে ডেকেছেন বস?
ঈশ্বরঃ হ্যাঁ, আজ চট্টগ্রামে যে দুজন পথচারী মারা গেলো। তারা কেন মারা গেলো তা জানতে চাইছি। নিরাপরাধ দুটি মানুষকে এভাবে মর্ত্য থেকে তুলে আনার মানেটা কী? ওখানে কাকে পাঠিয়েছিলে তা জানতে চাই।
যমরাজঃ হাঃ ঈশ্বর, আপনি এও জানেন না যে, মর্ত্যের বাংলাদেশ নামক দেশে আলাদা যমালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে! পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। আমার আয়ত্ত্বের বাইরে।
ঈশ্বরঃ তাহলে তুমি আছ কেন? ব্যাপারটা খুলে বলো।
যমরাজঃ বস, ওখানে ছাত্রলীগ নামক একটি সংস্থা এতই ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, কোন যম ওখানে কাউকে তুলে আনতে যেতে সাহস পায় না। পথচারী হিসেবে গুলি খেয়ে অক্কা পাওয়ার ভয়ে কোন যম বাংলাদেশে না যেতে চাইলে আমার দপ্তর থেকে ওদের সাথে যোগাযোগ করে ছাত্রলীগকে মর্ত্যের যমালয়ের লিজ দেয়া হয়েছে। ওটা পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমারও লাভ হয়েছে। এখন দুপুরে নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমাতে পারি। আগে তো চিত্রগুপ্তের হাক-ডাকে টিকতে পারতাম না।
ঈশ্বর একটুক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর স্বগতোক্তির মত করে বলেন, “গতকালই নারদ সেক্সপিয়রের একটা ডায়লগ বলেছিল, ‘There happen more things on haven and earth…’। তুমি এখন যাও। আমিও রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে একটু ঘুম দিই।
(যমরাজের প্রস্থান। ঈশ্বর আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে চোখ মুদে দিলেন। প্লেয়ারে জয়তী চক্রবর্তীর গান বাজছে- জননী, তোমার করুণ চরণখানি/হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে …)
(লেখাটি ২০১৩ সালের। ছাত্রলীগের ক্রশফায়ারে একটি শিশুর মৃত্যুর খবরে এটি লিখেছিলাম।)