কারাগারঃ মুক্তিযোদ্ধা মানস মুখার্জীকে দেশের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান

মানস মুখার্জী একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক; একজন মুক্তিযোদ্ধা। যে-দেশের জন্য তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, যে-দেশের মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য তিনি তাঁর সারা জীবনকে নিবেদন করেছিলেন, সে-দেশ তাঁকে ৭০ বছর বয়সে প্রথমবারের মতো কারাবাস উপহার দিয়েছে। এক মামলায় জামিন পান তো, আরেক মামলায় গ্রেফতার হন।
মানস মুখার্জী গ্রেফতার হয়েছিলেন গত ৫ই মে। যখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ছিলো না। পরে অবশ্য তাঁর বিরুদ্ধে চাদাবাজির মামলা দেয়া হয়। তাঁকে গ্রেফতারের ধরণটা ছিলো অবিকল নিলয় নীলের খুনের মতো। অজ্ঞাত পরিচয় দুই ব্যক্তি বাড়ি ভাড়ার নামে বাসায় খুঁজে গিয়েছেন যে, মানস মুখার্জী বাড়ি আছেন কিনা। এর কিছুক্ষণ পরে ৭-৮ জন ডিবি পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। পুলিশ আর জঙ্গিদের একই ধরণ দেখে আমার তো শঙ্কা হয়, তাহলে কি…….? নিলয়ও তো পুলিশের কাছে জিডি করতে গিয়েছিলো।
মানস মুখার্জীকে গ্রেফতারের কারণ তিনি এল.জি.আর.ডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন-এর সাবেক এপিএস এবং ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের বহিঃস্কৃত সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ মুখার্জীর বাবা, যার নামে ১৫টি মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলোও বহু পুরোনো মামলা না, সম্প্রতিই মন্ত্রীর বিরাগভাজন হওয়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে একে একে ১৫টি মামলা দেয়া হয়। কারণ, মন্ত্রীর এপিএস হয়েও মন্ত্রী কর্তৃক অরুণ গুহের ২০ কোটি টাকার বাড়ি দুই কোটি টাকায় লিখিয়ে নেয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন। মন্ত্রী তো মন্ত্রী, তিনি আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বেয়াই। মন্ত্রীর বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হয়েও মন্ত্রীর কাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মন্ত্রী সাহেব সইবেন কেন? প্রথমে এপিএস থেকে বরখাস্ত হলেন, ১৫টি মামলা খেলেন, দু’দকের নোটিশ পেলেন, ছাত্রলীগের পদ থেকে বহিঃস্কৃত হলেন এবং সবশেষে প্রাণে বাঁচতে আত্মগোপনে চলে গেলেন বা দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিলেন।
সত্যজিৎ মুখার্জী দেশছাড়া হলেও তাতে মন্ত্রীর চলবে না। তাই সত্যজিৎকে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য তাঁর বাবাকে কোন প্রকার মামলা ছাড়াই বাংলা সিনেমা স্টাইলে গ্রেফতার করা হলো। পরে তাকে চাঁদাবাজি মামলা দেখিয়ে একদিনের রিমান্ডেও নেয়া হয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে রিমান্ডে না হলে দেশকে অসম্মান করা হয়ে যায় যে! প্রথমবার ২৬ দিন কারাভোগের পর মুক্ত বাতাসে ফিরে এসে মানস মুখার্জী অনাবিল আনন্দ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আজ ছেলের জন্য আমাকে এই বৃদ্ধ বয়সে জেল খাটতে হলো, বিষয়টি খুব সহজে মেনে নিতে পারছিনা। কারন আমি কেন আমার বংশের কেউ আজ পর্যন্ত জেল খাটেনি। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কারো নেই”। কেমন ছিলেন কারাগারে জানতে চাইলে মানস মুাখর্জী বলেন, “কেমন আর থাকবো। সে এক নতুন পৃথিবী। যেখানে বাইরের আলো বাতাস কিছুই পৌছে না। যারা কখনো জেলে যায়নি তারা বুঝতে পারবে না জেল কি জিনিস”। বাহ! একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য বাংলাদেশের এই নতুন অনুভূতি না দিতে পারলে কিসের বাংলাদেশ। জেল থেকে একাধিকবার জামিন পেলেও নতুন নতুন মামলায় তাঁকে ফের গ্রেফতার করে জেল ঢুকানো হয়। বর্তমানেও এই মুক্তিযোদ্ধা কারাগারেই আছেন।
মন্ত্রী তথা জাতির বেয়াই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বাবা রাজাকার ছিলো, এটা মোটামুটি সবাই জানলেও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বিভিন্ন অযুক্তি কুযুক্তি দিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে, আমরা মেনেই নিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা জানতাম যে, একবারের রাজাকার মানে সারাজীবনের রাজাকার এবং রাজাকারের বাচ্চারাও কোনদিন সংশোধন হয় না। রাজাকারের পুত্র মন্ত্রী মোশাররফও যে তার ব্যতিক্রম হবে না তা জানাই ছিলো। হিন্দু তাড়ানোর একাত্তরের অপূর্ণ বাসনা উথলে উঠেছে ফের।
অরুণ গুহ তাঁর সম্পত্তি মন্ত্রীর জোড়াজুড়িতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন কিনা তদন্তে তিন সদস্যের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তারা যে মন্ত্রীর পক্ষেই তাদের রিপোর্ট দিবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী এবং ফরিদপুরের প্রশাসন তার কথার বাইরে যে যাবে না তা বোঝা যায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রবীন্দ্র ঘোষ তদন্ত করতে গেলে ফরিদপুরের সংশ্লিষ্ঠ থানা থেকে বলেছে, ‘ওই বাড়িতে গেলে তারা তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারবেন না’। এদিকে আজ আমাদের সময় পত্রিকায় অরুণ গুহর উকিল সুবল চন্দ্র সাহা “সংখ্যালঘুর সম্পত্তি কি কেউ কিনতে পারবে না?” শিরোনামে বিরাট এক কলাম লিখেছেন, যেটা পড়লে যে-কেউ বুঝবেন যে এটা মন্ত্রীর চাপে লিখতে বাধ্য হয়েছেন।
সুতরাং যতো তদন্ত বা যাই হোক না কেন, এই সম্পত্তির প্রকৃত মূল্য অরুণ গুহ আর পাচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত, এমনকি অরুণ গুহের উকিল সুবল চন্দ্র সাহার মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাওয়া কলামেও দেখতে পাই অরুণ গুহ সম্পত্তি বিক্রি করে তার কন্যাকে নিয়ে দেশে থাকতে চেয়েছেন, সেটাও আর হচ্ছে না। ভারতে চলে গেছেন সেখানে থাকাই বোধ হয় তাঁর জন্য ভাল; দেশে এসে বাবা-কন্যার জীবন হারানোর ঝুঁকিতে পড়ার দরকার কী?
অরুণ গুহ না হয় সম্পত্তি বিক্রি করে কিছু টাকা অন্তত পেলেন, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মানস মুখার্জী কি জেলেই পঁচবেন? তাঁর ছেলে সত্যজিৎ মুখার্জী কি পালিয়েই বেড়াবেন? মন্ত্রীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অন্যায়(!) যদি কিছু করে থাকেন, সে তো করেছেন সত্যজিৎ মুখার্জী। তাতে তাঁর বাবাকে কেন মিথ্যে মামলা দিয়ে জেল-হাজতে রাখা হবে? এই কি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য? কে এই প্রশ্নের উত্তর দিবে? আমাদের জানা নেই। আমাদের একটাই জায়গা ছিলো আগে, সেটা আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ এখন নষ্টদের অধিকারে গেছে। বাংলাদেশের মাইনরিটি এবং প্রগতিশীলদের আর কোন জায়গা নেই দেশের মঙ্গলের জন্য কিছু দাবি করার, কোন প্রশ্ন করার।

Leave a Comment