নৈতিকতার সেকাল-একাল

“অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তি তারা মন্দাদরী
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং
মহাপাতক নাশনমঃ।”

কুন্তি, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী ও অহল্যা। এদেরকে পঞ্চসতী বলা হয়। এদের মধ্যে অহল্যা গৌতম মুনীর স্ত্রী, যাকে জোরপূর্বক ধর্ষন করেছিলো দেবরাজ ইন্দ্র।  কুন্তি হলো পাণ্ডুর স্ত্রী এবং যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনের মা। কুন্তি অবিবাহিত থাকা অবস্থায় একটি সন্তানের জন্ম হয়, যার নাম কর্ণ। মহাবীর কর্ণ। কুন্তির চারটি পুত্রের জন্মের মিথটি খুব মজাদার।

অবিবাহিত অবস্থায় কুন্তিকে দুর্বাসা মুনি একটি বর দেয় যে কুন্তি কোন দেবতাকে স্মরণ করলে সেই দেবতা এসে কুন্তিকে যৌনসঙ্গম দ্বারা পরিতৃপ্ত করে পুত্রসন্তান দান করবে। কুন্তি এটা পরীক্ষা করার জন্য দেবতা সূর্যকে কামনা করে এবং সূর্যের সাথে মিলনের ফলে দ্রৌপদীর গর্ভে কর্ণের জন্ম হয়। কুন্তির বাকি তিন পুত্র যথাক্রমে দেবতা ধর্ম, বায়ু ও ইন্দ্রের। দ্রৌপদীর ছিল পাঁচ স্বামী। সে-গল্প আপনারা অনেকেই জানেন। কুন্তি ও মাদ্রি দুজনের পাঁচ সন্তান যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দ্রৌপদীর স্বামী।

প্রতিদিন পঞ্চসতীর নাম উচ্চারণ করলে মহাপাপও নাশ হয়। কী অদ্ভুত সমীকরণ! আমি যে দুজনের ঘটনা বললাম তারা দুজনই ছিলো বহুগামী এবং একইসাথে সতীও। আমাদের বর্তমান নৈতিকতার সাথে একেবারেই বেমানান।

এবার নিচের লাইনগুলো পড়ুন।

হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি, যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল,দয়ালু। (কোরান: ৩৩:৫০)

এরপর আপনার জন্যে কোন নারী হালাল নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয় যদিও তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে দাসীর ব্যাপার ভিন্ন। আল্লাহ সর্ব বিষয়ের উপর সজাগ নজর রাখেন। (কোরান: ৩৩:৫২)

এমন আরো অনেক আয়াত এবং হাদিস পাবেন যেখানে নবীর জীবনে নারীবিষয়ক ঘটনাগুলোর বেশ রগরগে বর্ণনা আছে যা বর্তমান নৈতিকতার আলোকে বিচার করলে স্রেফ অনৈতিক মনে হবে, অপরাধ মনে হওয়াটাও অন্যায় হবে না। কিন্তু কেন এমন অনৈতিক বিষয়কে ধর্মপুস্তকগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা কি ভেবে দেখেছেন?

আমাদের সাধারণদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা যে আমরা সময়কে অতিক্রম করতে চিন্তা করতে পারি না। ধর্মকে যারা সমালোচনা করে তারাও যেমন বর্তমানের আলোকে অতীতকে সমালোচনা করে তেমনি যারা ধর্মকে পালন করে তারাও অতীতকে বিবেচনা না করে সবকিছুর অযৌক্তিক জাস্টিফাই করতে চায়। ফলাফল দুই গ্রুপের মধ্যে অনিবার্য সংঘর্ষ।

সতীত্বের ধারণা অতীতে বর্তমানের মতো ছিল না বলেই হিন্দুধর্মগ্রন্থে বহুগামী নারীকেও সতী বলা হয়েছে; তেমনি মোহাম্মদের বহুগামীতা তখনকার নৈতিকতায় অনৈতিক বা অন্যায় মনে করা হতো না বলেই ইসলাম ধর্মগ্রন্থে সেগুলোর রগরগে বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে।

নৈতিকতাকে কালের সীমানায় আবদ্ধ রাখা যায় না। আজ যা নৈতিক বলে মনে হচ্ছে তা ভবিষ্যতে যে অনৈতিক বিবেচিত হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং নৈতিকতার বিচার হওয়া উচিত কালকে বিবেচনায় রেখে। কোন মহান ব্যক্তিই সর্বকালের জন্য মহান হতে পারেন না; কারণ তিনিও কালের যাত্রী, সর্বকালের যাত্রী নন।

Leave a Comment