কবিতাঃ শিশু

বৃষ্টি শেষের জোছনা রাতে উঠোনে নেমে ঠাকুমা বলতেন-
বউমা, কাল ধান সিদ্ধ করতে পারো; চাঁদের গায়ে রোদ দেখা যাচ্ছে।
পরদিন আমরাও ছাতা ছাড়াই পাঠশালায় যেতাম।
দুদিন পরেই আবার হয়তো বলতেন-
দেখো দাদু, চাঁদের গায়ে কত বড় জল চাক! আগামী কয়েকদিন ধুমছে বৃষ্টি হবে।
সেদিন পাঠশালা শেষে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে
বাবার হালের পিছনে পিছনে দৌঁড়ে টেংরা-পুটি-কই-চিংড়ি
আরো কত মাছ!

কতদিন মাছ ধরতে গিয়ে চালুনি ভেঙেছি!
মা পোরোলের খোসায় বল সাবান মেখে
গায়ের কাদা ঘষে ঘষে তুলতেন আর বলতেন-
ঘরে যে মাছ আছে তা-ই খাবার মানুষ নেই,
আর কতগুলো চ্যালা-পুটি ধরতে গিয়ে আমার চালুনিটা খোয়ালি!

এমনটা খুব কমই ঘটতো;
বেশিরভাগ দিনই মাছ ধরে কোনমতে পুকুরে দু-তিনটা ডুব দিয়ে
ভেজা প্যান্টটা পুকুর পাড়ে রেখে
ন্যাংটা আমি দূয়ারে গিয়ে হাজির হতাম- মা, প্যান্ট দাও।
ঘরে ঢুকেই সোজা রান্না ঘরে-
পেটের মধ্যে তখন জীবন্ত কুমিড়;
ভাত হয়নি বললে চলবে না, অর্ধসিদ্ধ ভাতই হাড়ি থেকে তুলে দিতে হবে।
খেতে বসে আবিষ্কার করতাম সারা শরীর জুড়ে শুকনো কাদার সাদা সাদা ছোপ
ঠাকুমা এসে সরিষার তেলে ঢেকে দিতেন সেসব।
সরিষার তেলের প্রতি ঠাকুমার দুর্বলতা একটু বেশিই ছিল
কানের পাশ দিয়ে তেল বেয়ে না পড়লে
মাথায় তেল দেয়া হয়েছে এমনটা মনেই করতেন না তিনি;
পেটে ব্যাথা বলো, আর গিটে ব্যাথা বলো-
হয় গিলো, নয় মাজো- সরিষার তেলই ছিল ঠাকুমার ওষুধ।

ঠাকুমার কাছে আমরাও চাঁদ দেখে বৃষ্টির পূর্বাভাস শিখে নিয়েছিলাম
বাবার কাছ থেকে শিখেছিলাম পঞ্জিকা দেখা।
পাড়ার সবাইকে তখন আর বাবার অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো না।
যাত্রার শুভাশুভতা- মহেন্দ্র-অমৃতযোগ, অশ্লেষা-মঘা
কিংবা ত্রিপক্ষের কথা আমি যখন বলতাম-
গ্রামের বুড়োরা অবাক হয়ে যেতো;
আর আমি অবাক হতাম তাদের অবাক মুখে তাকিয়ে।
আরো পরে বুঝেছিলাম- আমার বাবা, বোন ও আমি ছাড়া
ও পাড়ায় আর কেউ তেমন পড়তেই পারতো না।

কেবল পঞ্জিকাই নয়, শিখেছিলাম খনার বচন
জেনেছিলাম খনার জিহ্বা ভোজন করেছিল টিকটিকি
তাই টিকটিকিও সত্য-মিথ্যা নিরূপণ করে টিকটিক শব্দ করে ঘরের কোণায়।
ঠাকুমা শিখিয়েছিলেন- টিকটিকির টিকটিক শব্দের সাথে ‘সত্য সত্য’ বলতে হয়।
কতশতবার টিকটিকি দেখলেই ওর দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে মনে মনে সত্য উচ্চারণ করেছি!
একবারের জন্যও ওকে টিকটিক করতে দেখিনি।

সেই শৈশবেই প্রশ্ন তুলেছি এসবের যথার্থতা নিয়ে।
সেই শৈশবেই খনার বচনের সাথে প্রাকৃতিক যোগসূত্র খুঁজেছি।
খুঁজে খুঁজে সেই শৈশবেই বিশ্বাস হারিয়েছি ভবিষ্যৎবাণীতে।
ঈশ্বরের অক্ষমতা দেখিয়ে ঠাকুমাকে কাঁত করেছি কতবার!
বিজয়া দশমীর রাতে ধান-দূর্বা দিয়ে ঠাকুমা যখন বলতেন-
আমার মাথায় যত চুল আছে দাদুর আয়ু তত বছর বৃদ্ধি পাক-
তখন তাকে দেখিয়েই বলতাম- তোমার মাথার চুলের মত আয়ু বৃদ্ধি হয়ে
তোমার মত বুড়ো হয়ে থাকি আর কী!
যুক্তিতে ঠাকুমার আশীর্বাদতত্ত্ব তখন কাঁত।
পরের বছর ধান-দূর্বার আগে আমি উধাও
রাতে ফিরে এলে সবাই বকতো- আমি বড় হচ্ছি আর নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
গোয়াড়ের মতো বলতাম- তোমাদের ওসব আশীর্বাদে কিছু হয় না।
মা জিভ কাটতেন, খেতে বসলে ঠাকুমা জোর করেই মাথায় কিছু ধান-দূর্বা দিয়ে দিতেন
আমি রাগে এমনভাবে মাথা ঝাকাতাম যে সব আমার ভাতের থালায়
তারপর- ভাত পাল্টে দাও, নইলে খাবো না।
পরের বছর আমার জন্য আশীর্বাদের ডালা নিয়ে আর কেউ অপেক্ষা করতো না।

আজও যখন দেখি কেউ দোয়া-আশীর্বাদ চায়
আমি কেবল ফ্যাল-ফ্যাল করে শুনি, কিছু বলতে পারি না
সেই শৈশবে যার অসারতা প্রমাণ করেছি আজও তার পিছনে মানুষ ছোটে দিন-রাত!
ভাবি আর অবাক হই।
আশে পাশের মানুষগুলোকে আমার কেবলই শিশু মনে হয়
আমার শৈশবের শিশুটির থেকেও আরো বেশি শিশু।

Leave a Comment