বাঙালি কি সাম্প্রদায়িক?

আপনাকে এই প্রশ্নটি করলে আপনি একবাক্যে বলে দেবেন যে- না, বাঙালি সাম্প্রদায়িক না। এবার যদি আরেকটি প্রশ্ন যোগ করা যায়- ইতিহাসে বাঙালির যেসব সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহ পরিলক্ষিত হয়েছে তার প্রধান উপাদান কী? এবার আপনি কী বলবেন জানি না তবে আমি এক বাক্যে বলব- “ধর্ম”। ঠিক ধর্ম নয়, ধর্মাচ্ছন্নতাই বোধ হয় যথার্থ। ইতিহাসের পাতা থেকে ও নিজের ছোট একটি অভিজ্ঞতা থেকে ব্যাপারটিকে যাচাই করে দেখি।

১. প্রথমে ইতিহাসের পাতা থেকে ঘুরে আসি। ইতিহাসের এ অংশটুকু একজন লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বাঙালির সাম্প্রদায়িক ঘটনাসমূহের অন্যতম উদাহরণ। লেখাটি বদ্বীপ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আজহারুল ইসলাম রচিত “বাঙ্গালী জন-চরিত্রঃ কিছু নমুনা বিশ্লেষণ” বইটি থেকে নেয়া হয়েছে।

১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল। বৃহত্তর ফরিদপুরে তখনও পাকবাহিনীর পদার্পন ঘটেনি। ২৫ মার্চের পর থেকেই ফরিদপুরকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য কয়েকজন ই.পি.আর সদস্যরা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে এবং সামান্য অস্ত্রসহ পাহারা দিয়ে আসছিল। এই পাহারাদার দলটিকে স্থানীয় লোকজন বাড়ি বাড়ি থেকে রুটি, ভাত ইত্যাদি সংগ্রহ করে এনে দিচ্ছিল। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান সবাই একত্রিত হয়ে এ কার্যক্রম চালাচ্ছিল। তবে ২১ এপ্রিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনি পদ্মা নদী থেকে গানবোটে গোয়ালন্দ ঘাট থেকে বৃহত্তর ফরিদপুরে প্রবেশ করল। আরেকটা দল মধুখালীতে হেলিকপ্টারযোগে নেমে কামারখালীতে প্রবেশ করল। স্বল্প অস্ত্রে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করা যাবে না এ ভাবনায় কামারখালীর প্রতিরোধকারী দলটি এমনিতেই ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। ২১ এপ্রিল পাকবাহিনীর গুলির শব্দে যে কজন ছিল তারাও পালাল।

সেনাবাহিনী কামারখালীতে ঢুকতেই সাধারন মানুষ প্রাণভয়ে এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করল। মিলিটারীরা ট্রাক থেকে নেমেই ছুটন্ত মানুষগুলোকে হাতের ইশারায় থামানোর চেষ্টা করে, তাদেরকে ইশারায় আশ্বাস দেয়া হয় যে তারা মারবে না। কিছু লোক থেমে দাঁড়ায়। মিলিটারীরা তাদের কাছে জানতে চায়, “হিন্দু কাহা? হিন্দুকা ঘর কাহা?” হিন্দুরা আগেই প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। কেউ কোন হিন্দু লোককে দেখিয়ে দেয়নি অবশ্য দেখিয়ে দেয়ার মত কেউ ছিলও না, কিন্তু হিন্দুদের দোকানঘরগুলো দেখিয়ে দেয়। মিলিটারীরা তালাবদ্ধ ঘরের তালা ভেঙে লোকজনকে মালামাল নিয়ে যেতে বলে। প্রথমে দু’একজন মালামাল নেয়া শুরু করে, ক্রমান্বয়ে উপস্থিত সবাই মালামাল নিতে থাকল। এ খবর সারা বাজারময় এবং আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল এবং সারা বাজারের মানুষ এবং আশেপাশের গ্রামের মানুষ লুটে অংশগ্রহণ করল। তখনকার কামারখালী বাজারের ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু ব্যবসায়ী। লটেরাগণ মুদি, মনোহরী, স্টেশনারী, আটা, ময়দা, ডাল সব লুট করছিল। সবশেষে পাটের বড় বড় গুদামও লুট হয়েছে দুতিন দিন ধরে। কিছু মুসলমান ব্যবসায়ী তখন তাদের আড়তে এসব নামমাত্র মূল্যে কিনতে শুরু করল। লুটেরারা বেশিরভাগই এক সম্প্রদায়ের মহাজনের মালামাল আরেক সম্প্রদায়ের মহাজনের ঘরে তুলে দিয়েছে মালামাল বহনের নাম মাত্র মূল্যের বিনিময়ে। সারা শহরের প্রায় প্রতিটা হিন্দু ঘরই লুট হল কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি ঘরও লুট হয় নি।

এরই মধ্যে মিলিটারীকে সহযোগীতা করার জন্য কিছু লোক জুটে যায়। তাদের কয়েকজনকে নিয়ে মিলিটারীরা বাজার থেকে সিকি কি.মি. দূরে মসলন্দপুর হিন্দু পাড়ার দিকে আগায় এবং কেরোসিন তেল ঢেলে একটি হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়। মিলিটারীদের আগাতে দেখেই হিন্দুরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। এক মাঝ বয়সী মহিলা তখনও পালাতে পারেনি। মিলিটারীরা গুলি করে তার পালানোকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিল।

কয়েক বাড়িতে আগুন দেবার পর কেরোসিন তেল ফুরিয়ে যায়। আগুন দেয়া বন্ধ হল। কিন্তু ততক্ষণে রেললাইনের সামান্য কয়েকগজ ফাঁকা জায়গার পর দক্ষিণের মুসলিম পাড়ার মেয়েপুরুষ, জোয়ান-বুড়া মায় বাচ্চা-কাচ্চা ডাক দিয়ে লুট শুরু করে দেয়। হিন্দু পাড়ার সংলগ্ন মুসলামান পাড়ার লোকজনও একইভাবে লুটে ঝাপিয়ে পড়ে। মিলিটারী চলে গেলে হিন্দুরা ঝোপ জঙ্গল থেকে বাড়িতে ফেরার অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু আড়পাড়ার লোকজন কেবল মালামাল লুট নয়, ঘর ভাঙতেও শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আর ঘরে ফিরতে পারেনি। দেখতে দেখতে পুরো গ্রামের ঘরবাড়ি ভাঙা শুরু হয়ে যায়। অলিখিত সমঝোতা অনুযায়ী যে লুটেরা ব্যক্তি এক ঘর ভাঙা শুরু করল সেটা তার দখলে চলে গেল। দুইদিন ধরে মহালুট উৎসব চলল। দুদিন পর মসলন্দপুর ও গোপালদি গ্রামের একটি হিন্দু ঘরও অবশিষ্ট রইল না।

এভাবে কামারখালী সংলগ্ন ছোট মিস্ত্রী পাড়া, রাজধরপুর, নড়কোনা, গন্ধখালী, সালামতপুর, কোমরপুর, দয়ারামপুর, যারজান নগর, ব্রিহষ নগর, চর কসুন্দী গ্রামগুলোর সকল হিন্দু পরিবারগুলোর ঘরসহ সবকিছু লুট হয়ে গেল। কোন কোন গ্রামের একশভাগ মুসলমানই এ লুটে অংশগ্রহণ করেছে, কোন গ্রামের ৩-৪ টি পরিবার হয়তো লুটে অংশগ্রহণ করেনি। অলিখিত সমঝোতা অনুসারে যে যে-ঘর ভাঙা শুরু করল সেই-ই সে ঘরের মালিকানা বনে গেল। অন্য কেউ তাতে দাবি তুলল না। তবে সাধারণত ঘরদরজা লোকবল সম্পন্ন ব্যক্তিরাই লুট করেছে, দুর্বল লোকেরা সাধারণ মালামাল লুট করেই সন্তুষ্ট থেকেছে।

এভাবে গ্রামের পর গ্রাম লুট হল। জনাব আজহারুল ইসলাম কামারখালিতে ৪ দিন অবস্থানের পর লুটের অবস্থা নিরূপণ করতে বাগাটসহ অন্যান্য এলাকায় ৩ দিনে প্রায় ৫০ কি.মি. হেটেছেন যার আয়তন হবে প্রায় ২৫০ বর্গমাইল। এর মধ্যে লুট হয়নি এমন গ্রাম প্রায় নেই বললেই চলে। এত ব্যাপক লুটপাটের মধ্যে একটি মুসলমান বাড়ি লুট হয়েছে এমন শোনা যায়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, মিলিটারী প্রবেশেকালীন আড়পাড়া গ্রামে অবস্থানরত ইসলামী পণ্ডিত উমর নগরের মাওলানা বলে পরিচিত মাওলানা মোফাজ্জেল হোসেন ফতোয়া দিলেন যে, ‘হিন্দুদের সমস্ত সম্পদ লুট করা জায়েজ, এটা মালে গণিমত।’ এই বক্তব্যের পর লুটকারীদের মনোবল শতগুণ নয়, হাজারগুণ বেড়ে যায়।

২. এক সকালে বরিশালের এক চায়ের দোকানে চা-বিড়ি খাচ্ছিলাম। এক লোক বিড়ি টানতে টানতে গল্প করছিল। লোকটাকে কোন কারখানার শ্রমিক বা দিনমজুর বলে মনে হল। লোকটা বলছে, “দেখছ, আইজকাল হিন্দুগো কী তেজ! সেদিন চকবাজারে দেখলাম এক হিন্দু ব্যবসায়ী চেইত্যা গিয়া এক মুসলমানরে কয়- “তোরে দেইক্যা লমু।” মালাউনরা এত তেজ পায় কই? মুসলমানডাও বোকাচোদা। আমারে কইলে আমি অই জায়গায় ঘাড় ভাইঙা দিতাম। ও নোমোর (হিন্দুর) বাচ্চা কিভাবে দেইক্যা লইবে? দেইক্যা লইলে লইতে পারি আমরা। হালাগো ইন্ডিয়া না পাডাইতে পারলে কাম হইবে না।”

দ্বিতীয় ঘটনাটির মতো ঘটনা আমার জীবনে আমি একবার নয়, বহুবার দেখেছি। আপনিও হয়তো দেখেছেন। যদি নিজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা না থেকে থাকে বা আপনি অমুসলিম হোন তাহলে আপনিও এদের আচরণে বা কথায় আমার মত ব্যথা পেয়েছেন। প্রথম ঘটনাটির উল্টোটা হয়তো ভারতে ঘটেছে। স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রীই কেবল ভিন্ন। ঘটনা মোটেই ভিন্ন নয়।

ঘটনাগুলো বিশ্লেষণের পর বিচারের ভার আপনার উপরই দিলাম। ভাল থাকবেন সবাই।

Leave a Comment