গল্প

ছোটগল্পঃ পাত্র

“এইডা কী আনছো? এরহম জিনিস তো আগে দেহি নাই।” পাত্রটা হাতে তুলে হাসমতকে জিজ্ঞেস করে আমিনা।
“ক্যামনে কমু ওডা কী। পাইছি, লইয়া আইছি।“ হাসমত উত্তর দেয়।
পাশে দাঁড়িয়ে বাবা-মায়ের কথা শুনছিলো কুমকুম। হাত বাড়িয়ে পাত্রটা নিয়ে সূক্ষ পর্যবেক্ষণ শেষে বলে, “দেখেছো আম্মা, ভেতরটা কী সুন্দর! অন্য কাসা-পিতলের তৈজসপত্রের মতো এটাতে কোন ময়লা নেই। নিশ্চয়ই এটা তারা ব্যবহার করতো।“
“হেইয়াই অইবে।“ আমিনা সমর্থন দেয়। “এই থালগুলো দ্যাক, মোনে অয় যেন ছত্রাক পড়ছে। কতো বচ্ছর ব্যবহার করে না কেডা জানে!”
“এইডা পাইছিও আবার খাডের তলে, অন্যগুলার লগে না। অন্যগুলা আছেলে পাডাত্তনে।“ হাসমতের কথায় মা-কন্যার ধারণার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়।
কুমকুম পাত্রটা নাকের কাছে তুলে গন্ধ শুকে। কেমন একটা মন্দ গন্ধ পায় যেন! নাকি তার নাকেরই ভুল? এমন ঝকঝকে তকতকে একটা পাত্র থেকে কটু গন্ধ পাওয়ার কথা না কিছুতেই। আরো নাকের কাছে নিয়ে সে আবার গন্ধ শুকে। আবারও একই গন্ধ পায়। তার নাকেই নিশ্চয় কোন সমস্যা হয়েছে, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত হয়ে যায়। “আব্বা, আমার নাকের চিকিৎসা করাতে হবে। কাল ডাক্তারের কাছে যাব।“
পরদিন কুমকুম ডাক্তারের কাছে গিয়ে নাকের চিকিৎসা নিয়ে আসে এবং হাসমত পরের সপ্তাহে সবগুলো কাসা-পিতলের তৈজসপত্র বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে আসে। আমিনা বিশেষ পাত্রটিকে বিক্রি করতে দেয় না। ওটার সৌন্দর্য্যই হয় তো ওটাকে বিক্রির হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
কুমকুমকে পরের মাসে আবারও ডাক্তারের কাছে ফিরতি ভিজিটে যেতে হয়। দু’বারে ডাক্তারের ভিজিট, শহরে যাওয়া-আসার খরচ, এন্টিবায়োটিক ও নাসাল ড্রপ মিলে যা খরচ হয়, কাসা-পিতল বিক্রিতে তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আসে। হাসমত বাড়িটিকে নতুন করে রং করে এবং আমিনা পাত্রটিকে ঘষে-মেজে আরো তকতকে করে শো-কেসে সাজিয়ে রাখে। তারা কেউই জানে না পাত্রটি দিয়ে কী করা যেতে পারে, তাই এ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। রং করার পরে বাড়িটি পাত্রটির মতোই ঝকঝক তকতক করে। হাসমত পাত্রটির দিকে তাকায় আর বিড়বিড় করে, “সব আল্লাহর দয়া। তিনি অসীম করুণাময়।“
একদিন হাসমত পাত্রটিকে শো-কেস থেকে বের করে আনে। পাত্রটিকে দিয়ে কী করা যেতে পারে এই ভাবতে ভাবতে পাত্রটির মধ্যে কিছু মুড়ি ঢালে। রান্নাঘর থেকে তার মধ্যে একটু খেঁজুরের ঝোলা গুড় নেয় এবং আমিনাকে বলে, “এট্টু নাহইল কোড়াইয়া দেতে পারো?”
আমিনা নারকেল দেয়। হাসমত নারকেল-মুড়ি খেতে খেতে পুকুরের দিকে যায়। কুমকুমকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “মা, মুড়ি খাবি? নাহইল-মিডাইদ্যা মাখছি।“
“হ্যাঁ, আব্বা। আসছি,“ বলে কুমকুম দৌঁড়ে বাবার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু পাত্রটি দেখেই থমকে যায়, তার সেই বিকট গন্ধের কথা মনে পড়ে যায়। “না, আব্বা। খিদে নেই,“ বলে সে আবার যেদিক থেকে আসছিলো সেদিকে চলে যেতে শুরু করে।
“এ্যাক মুট খা। ভালো লাগে।“
“না, আব্বা। এখন মুড়ি খেলে ভাত খেতে পারব না।“
“দৌঁড়াইয়া আইলি দেহি খাওয়ার লইগ্যা। কী অইলে তোর?”
কুমকুম বলতে পারে না তার বাবা যেদিন প্রথম পাত্রটিকে বাড়িতে এনেছিলো সেদিন সে পাত্রটা থেকে একটা মন্দ গন্ধ পেয়েছিলো। গন্ধটাকে সে চেনে কিন্তু সেটা তার বাবাকে এখন কিছুতেই বলা যাবে না। সে বাবাকে খুশি করার জন্য ভিন্ন পথ নেয়। “আব্বা, তোমার একটা ছবি তুলি?”
হাসমত মুখ হাসি করে পাত্রটির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পোজ দেয় এবং কুমকুম তার মোবাইল দিয়ে বাবার ছবি তোলে। কয়েকটা ছবি তুলে যেটায় তার বাবাকে সবচেয়ে ভাল লাগছে, সেটা বাবাকে দেখায়। “দেখো আব্বা, তোমাকে এখনও কত ইয়াং লাগে।“
হাসমত খুশি হয়। মুড়ি না খেয়েই কুমকুমের চলে যাওয়াতে সে আর কোন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না।
কুমকুম বাবার ছবিটাকে বারবার দেখে। গেঞ্জি গায়ে গামছা কাধে বাবাকে খুবই হ্যান্ডসাম লাগে তার কাছে। সে ছবিটিকে ‘আমার আব্বা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা।’ লিখে ফেসবুকে পোস্ট দেয়।
তার বান্ধবীরা সেখানে তার বাবার হ্যান্ডসাম ফিগার নিয়ে রসিকতা করে। মেহেরজান মেহের নামে একজন লিখে, “তোর বাবাকে দেখে তো অর্জুন রামপালের মতো লাগে।“ কুমকুমের ভাল লাগে। সে-ও রসিকতা করে ইমোটিকন দিয়ে প্রতিমন্তব্য লেখে, “আমার সৎ মা হবি নাকি, মেহের?”
আবদুস সালাম নামে একজন মন্তব্য করে, “আংকেলকে সালাম।“ কুমকুম প্রতিমন্তব্য করে, “সালামের সালাম আব্বাকে পৌঁছে দেয়া হবে।“
এভাবে অনেকের মন্তব্য আসে। কুমকুম তার প্রতিটাতে একটা করে লাইক ও প্রতিমন্তব্য করে। এর মাঝে রজনীকান্ত সাহা নামে তার এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু এসে লেখে, “তোর বাবা পাত্রটায় কী করে?” কুমকুম উত্তর দেয়, “মুড়ি খায়।“ রজনীকান্ত আবার প্রতিমন্তব্য লেখে, “তোর বাবা যে পাত্রটায় মুড়ি খাচ্ছে, ওটাকে আমরা ডাবর বলি। ওটাতে তো হিন্দু বাড়ির বৃদ্ধরা প্রসাব করে। আমাদের বাড়িতেও একটা আছে। ঠাকুমা প্রসাব করতেন। তিনি মরে যাওয়ার পরে আর ব্যবহার করে না কেউ।“
কুমকুমের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। রজনীকান্তের মন্তব্যটি পড়ার পরপরই সে পোস্টটাকে ‘অনলি মি’ করে দেয়। পৌষের দুপুরে সে দরদর করে ঘামতে থাকে। তবে সে যে গন্ধটা পেয়েছিলো সেটাই সত্যি? তার নাকে কোন সমস্যা ছিলো না তবে?
কুমকুম দৌঁড়ে বাড়ি আসে। ঘরের কাছে আসতেই সে পাবলিক টয়লেটের মতো কড়া প্রসাবের গন্ধ পায়। কোনমতে সে ঘরে ঢোকে এবং পাত্রটিকে নিয়ে বাইরে বের হয়—এখনই সে ওটাকে পুকুরে ফেলে দিবে। বিকট গন্ধে তার বমি আসতে চায় এবং কয়েক পা দিতেই সে বমি করতে শুরু করে। তার মা দৌঁড়ে এসে তার হাত থেকে পাত্রটিকে নিয়ে নেয় এবং তার সেবা করে। কিন্তু তার বমি থামে না। বমি করে করে একসময় সে অজ্ঞান হয়ে যায়।
জ্ঞান ফিরে কুমকুম নিজেকে ঘরের মধ্যে দেখেতে পায়, চারপাশে একইরকম বিকট প্রসাবের গন্ধ। সে চীৎকার করে তাকে বাইরে নিয়ে যেতে বলে। “কী অইছে তোর, মা?” তার আব্বা জিজ্ঞেস করে। “কী অইছে তোর, কুমু?” তার মা জিজ্ঞেস করে। কুমকুম কিছু বলতে পারে না। সে চীৎকার করে বাইরে বাগানে ছুটে যায়।
তার বাবা-মা তাকে নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয় এবং ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। অনেক পরীক্ষা করে ডাক্তার তাকে একটামাত্র ওষুধ দেয়, যেটা প্রতিদিন রাতে ঘুমের আগে খেতে হবে। কুমকুম বুঝতে পারে তাকে ঘুমের বড়ি দেয়া হয়েছে।
বাড়ি ফিরে আসতেই আবার গন্ধটা ফিরে আসে, আরো তীব্র হয়ে ফিরে আসে। কুমকুম কিছুতেই আর ঘরে আসতে পারে না, ঘরের কাছেই যেতে পারে না। “আমাকে একটু একা থাকতে দাও,” বলে সে বাগানে চলে যায় এবং সবার অলক্ষ্যে নাক-চেপে ঘরে ঢুকে একটা ওড়নায় কড়া পারফিউম লাগিয়ে নাক বেঁধে ফেলে। পারফিউমের গন্ধে প্রসাবের গন্ধ খানিকটা প্রশমিত হয়ে আসে। সে পাত্রটিকে একটা পুরোনো পত্রিকা দিয়ে ধরে বাগান পেরিয়ে বাড়ির পাশের খালে ছুড়ে দেয় এবং ওড়নাটা নাক থেকে খুলে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে।
ঘরের কাছে আসতেই সে আবার সেই বিশ্রী গন্ধটা পায়। সে বুঝতে পারে না এখনও গন্ধটা কেন আসছে, কোত্থেকে আসছে। অনন্যোপায় হয়ে সে আবার বাগানে ফিরে আসে এবং বারবার ঘরের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে গন্ধটা সরেছে কিনা, কিন্তু প্রতিবারই সে একই ফলাফল পায়।
বাগানে ঘুরতে ঘুরতেই কুমকুম পশ্চিম আকাশে কৃষ্ণ-চতুর্থীর চাঁদ উঠতে দেখে। চাঁদটাকে তার খুব আপন মনে হয়; ওটাকে তার ঈশ্বর মনে হয়। সে দু’হাত জোর করে চাঁদটার কাছে এই দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি চায়। “কুমু, এহন খাবি আয়।“ মার ডাকে তার সম্বিত ফেরে এবং সভয়ে ঘরের দিকে হাঁটে।
চাঁদের কাছে আকুতি তাকে প্রসাবের বিকট গন্ধ থেকে কোন মুক্তি দেয় না। সে ঘরের কাছে আসতে পারে না। “আম্মা, আমি ঘরে যেতে পারবো না। তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলতে না চাও, তবে আমাকে বাগানে ভাত দাও।“
মেয়েকে নিয়ে হাসমত ও আমিনা দু’জনই খুব উদ্বিগ্ন হয়। কন্যার এই পাগলামির কারণ তারা বুঝতে পারে না। হাসমত মসজিদে গিয়ে তার একমাত্র কন্যার রোগমুক্তি কামনায় এশার নামাজের পরে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছিলো। তাতেও কাজ না হতে দেখে সে হতাশ হয়। “আল্লাহ, আল্লাহ গো, তুমি মোরে এ কোন বিপদে ফালাইলা?” সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
গোয়াল থেকে গরু বাইরে সরিয়ে তাদের সকলের রাতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়। ঘুমের ওষুধের ক্রিয়ায়, অথবা প্রসাবের বিকট গন্ধের থেকে গোবর-গোমূত্রের গন্ধ কম তীব্রতর হওয়ায় কুমকুম ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু হাসমত ও আমিনা দু’জনের কেউই সে রাতে ঘুমাতে পারে না।
পরদিন কুমকুমকে ফের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, ফের এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়, নাসাল ড্রপ দেয়া হয়, কিন্তু কিছুতেই তার নাক থেকে প্রসাবের গন্ধ পাওয়াকে সারাতে পারে না কেউ। গোয়ালই তাদের নতুন আবাস হয়ে ওঠে। হাসমত মিস্ত্রি ডেকে গোয়ালটিতে শক্ত বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং নতুন গোয়াল না তৈরি হওয়া পর্যন্ত গরুগুলোকে ঘরে রাখতে বাধ্য হয়।
হাসমত এর মধ্যে একদিন পাত্রটির খোঁজ করে। আমিনা উত্তর দেয়, “মুই ক্যামনে জানমু? মোরা ঘরে থাহি না, এই ফাঁকে চোরে লইয়া গ্যাছে কিনা কেডা জানে।“
হাসমত পাত্রটিকে তন্য তন্য করে খোঁজে এবং পেতে ব্যর্থ হয়। সে তার বউকে দোষারোপ করে। “মাগী, ঐ পাত্তরডা লক্ষ্মীপাত্র আছেলে। ঐডা আরাইয়া যাইয়াই মনে অয় মাইয়াডার এই বিপদ অইছে।“
আমিনা কুঁকড়ে যায়। ‘অইতেও পারে,‘ সে মনে মনে ভাবে।
আমিনার সাথে রাগ করে হাসমত এখন থেকে ঘরে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
নতুন গোয়াল তৈরি হয়। গরুগুলো নতুন ঘর পায়, কিন্তু কুমকুমের নাকের গন্ধ আর সরে না, সে ঘরে ফিরতে পারে না। এভাবে গোয়াল ঘরে থাকতে তার ভাল লাগে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলে দিলে সে হলে চলে যেতো। শীঘ্র যে তা হবে এমন কোন সম্ভাবনা আছে বলে তার মনে হয় না।
ক্রমে ঘরটিকে তার কাছে অভিশাপ মনে হয়। কুমকুম সিদ্ধান্ত নেয় ঘরটিকে সে পুড়ে দিবে। তার বাবা ঘরে থাকে। সে তার বাবাকেও পুড়ে দিবে। যে-বাবার কারণে তার এমন দুঃসহ পরিণতি হয়েছে তাকেও সে বাঁচতে দিবে না।
পরদিন দুপুরে সে বাবা-মাকে না জানিয়ে নুরুর দোকানে যায় এবং দুই লিটার পেট্রোল কিনে আনে। রাতে মা ঘুমানোর পরে সে ওড়নায় পারফিউম মেখে নাক বেঁধে ঘরে ঢুকে ঘরের সকল দাহ্য পদার্থে পেট্রোল ঢালে। একটা বোতল তখনও বাকি। সেটি নিয়ে সে বাবার খাটের পাশে যায়। বাবার বিছানায় পেট্রোল ঢালতেই পেট্রোলের গন্ধে তার বাবার ঘুম ভেঙে যায়। “কেডা? ঘরে কেডা?” বলে হাসমত চীৎকার করে। কুমকুম আর দেরি করে না। ঘ্যাস করে দিশলাইয়ের কাঠিটা জ্বেলে ছুড়ে দেয় হাসমতের বিছানায়। মুহূর্তের মধ্যে তার হাতে ধরে রাখা পেট্রোলের বোতলটিতে বিস্ফোরণ ঘটে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে জানালার কাঁচগুলো ভেঙে যায়। গোয়াল থেকে বেরিয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে আমিনা দুটো আগুনের শরীরকে ঘরের মধ্যে ছুটতে দেখে। শরীর দু’টোকে তার কাছে জ্বিনের মতো মনে হয়।

2 Comments

  1. shumi neel

Leave a Comment