ধর্ম সমালোচনাপ্রবন্ধবাংলাদেশ

মাদ্রাসা শিক্ষার অপ্রয়োজনীয়তাঃ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট

ইংরেজ শাসনামলে মুসলমানরা সরকারী চাকুরীতে বেশ পিছিয়ে ছিলো। এই পিছিয়ে থাকা থেকে উত্তোরণের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষার ওপর জোর দেন এবং ‘মোহামেডান লিটারেল সোসাইটি’ গঠন করেন, যাকে ভারত-ভাগের বীজ বলা যেতে পারে। কিন্তু কেন তারা চাকুরীতে পিছিয়ে ছিলো, তার উত্তরে আমরা সহজেই বলে দিই যে, তারা ইংরেজী শিক্ষায় পিছিয়ে ছিলো বলে চাকুরীতেও পিছিয়ে ছিলো। কিন্তু কেন ইংরেজী শিক্ষায় পিছিয়ে ছিলো? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে কি কখনো?

তখন এমনিতেই খুব কম সংখ্যক মানুষ শিক্ষিত ছিলেন এবং যারা শিক্ষিত ছিলেন তাদের মধ্যে হিন্দুরা ইংরেজ কর্তৃক প্রচলিত শিক্ষা নিলেও বেশিরভাগ মুসলমানই মাদ্রাসা শিক্ষার বাইরে শিক্ষা নিতো না। এমতাবস্থায় মুসলমানদের উন্নতির লক্ষ্যে মাদ্রাসা শিক্ষায়ই ইংরেজী সংযোজনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯১৪ সালে অধ্যক্ষ শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদের নেতৃত্বে গঠিত মোহমেডান এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষাকে দুটো স্কিমে ভাগ করেন। গতানুগতিক ধারার ওল্ড স্কিম এবং বাধ্যতামূলক ইংরেজীসহ নিউ স্কিম। নিউ স্কিমের দুটো ভাগ ছিলো; জুনিয়র ও সিনিয়র মাদ্রাসা। জুনিয়র মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত আর সিনিয়র মাদ্রাসায় মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। সিনিয়র মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সাহায্যভুক্ত করা হয়। সরকারি চাকুরি পেতে মুসলিম শিক্ষার্থীরা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়তে বিশেষ আগ্রহী ছিল।

বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে দাখিল ও আলিম কোর্সে যথাক্রমে এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি-এর পুরো কারিকুলাম থাকার ফলে অনেক ছাত্রই মাদ্রাসায় পড়ে পরবর্তীতে সাধারণ শিক্ষায় আসতে পারে এবং উচ্চতর শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ তথা দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে। কিন্তু তাদের সংখ্যা যে খুবই কম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাকিরা ফাযিল ও কামিল পাশ করে, যা যথাক্রমে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার সমতুল্য। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমমান করার ফলে এরা সাধারণ শিক্ষা থেকে আগতদের সাথে সমানভাবে চাকুরীর ক্ষেত্রে প্রতিযোগীতা করতে পারে। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান শিক্ষার অভাবে এক্ষেত্রেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলো থেকে পাশ করাদের সাথে প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে থাকে। এই বিরাটসংখ্যক মাদ্রাসা-শিক্ষিত মানুষগুলো জাতির কী কাজে আসে? তারা মাদ্রাসার শিক্ষক হয়, ইমাম হয়, অথবা মোয়াজ্জিন হয়। কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা যাকে বলে।

কিন্তু কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার জন্য কেবল আলিয়া মাদ্রাসা থাকলে কথা ছিলো না; আলিয়া মাদ্রাসার বাইরে এর চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে কওমী মাদ্রাসা, যেগুলোতে ইহজাগতিক কোন শিক্ষাই দেয়া হয় না। যুগের সাথে অনুপযোগী, পুরো অপদার্থ তৈরি করে দেয়া এই শিক্ষা থেকে পাশ করাদের একমাত্র কাজ দেশে মসজিদ, মাদ্রাসা তৈরি করে কোন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে পেটের ভাত জোটানো বা বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে-স্টেশনে মসজিদ-মাদ্রাসা-এতিমখানার নামে পরকালের লোভ দেখিয়ে অনুদান সংগ্রহ করা, যা আসলে পেটে ভাত জোটানোর লক্ষ্যেই।

কিন্তু এভাবে কতোদিন চলবে? এই বিপুল সংখ্যক অনুৎপাদনশীল মানুষের পেটে ভাত জোটানোর জন্যে দেশে কতো লক্ষ মসজিদ-মাদ্রাসা তৈরি করা যাবে? বিষয়টা ডেসটিনির সাইকেলের মতো, মানুষের চেয়ে গ্রাহক বেশি; মানে, এই অশিক্ষিতদের কর্মসংস্থানের জন্য দেশের অন্য সবকিছু রেখে মসজিদ-মাদ্রাসা দিয়ে ভরে ফেলতে হবে, যা অবাস্তব। এবং এই অবাস্তবতাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে প্রয়োজন পড়বে শরিয়াহ, যাতে অযোগ্যতাই হবে যোগ্যতার মাপকাঠি।

জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ এমনিতেই ন্যুজ। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ ভাল অবস্থানে আছে, কারণ জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারা গেছে। দেশের তৈরি পোশাক ও নিট ওয়্যার শিল্প অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত নারী-পুরুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে; বিদেশ থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে – সব মিলে একটা ভাল অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। কিন্তু ভবিষ্যতেও যে এমন অবস্থা থাকবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, এই বিপুলসংখ্যক অকর্মন্য আলেমরা, যারা আপনাদের টাকায় তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে, তারাও যদি কোন উৎপাদনশীল কাজ করতো, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে আরো ভাল থাকতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে হারে দেশে মসজিদ-মাদ্রাসা বাড়ছে, তাতে অনুৎপাদনশীল মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে, যা বাংলাদেশের মতো একটা দেশের পক্ষে বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর কোনমতে শরিয়াহ চালু হয়ে গেলে তো কথাই নেই, দেশের সকল নারী, শ্রমিক থেকে কর্মকর্তা, সব বেকার হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে আফগানিস্তানের ইতিহাস পড়ে দেখতে পারেন।

সৌদি আরবসহ যেসব দেশে শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই ধর্মনির্ভর, তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, হাসপাতালসহ সকল প্রযুক্তিগত কার্য সম্পাদন করে বাইরের দেশের মানুষ। যদিও সৌদি আরব সারা পৃথিবীতে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে, তবুও সৌদিতে কওমি মাদ্রাসার মতো শতভাগ ইসলামী শিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠান নেই, সকল শিক্ষার সিলেবাসই ধর্মীয় ও জাগতিক শিক্ষার মিশ্রনে তৈরি, তবে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ইসলামী ডিগ্রি নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি সৌদি আরবের মতো অনুৎপাদনশীল মানুষ উৎপাদন করে, তবে আমরা কি সৌদি আরবের মতো বাইরে থেকে জনশক্তি আমদানী করতে পারবো? এক কথায় এর উত্তর ‘না’। জনসংখ্যার আধিক্য হেতু যদি ধরেও নিই যে, আমাদের বাইরে থেকে জনশক্তি আমদানী করতে হবে না, তবুও বাংলাদেশ কি এতো বেশি অনুৎপাদনশীল মানুষের ভার বইতে পারবে? সৌদির মতো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলে না হয় মাথায় পাগড়ি বেঁধে ঠ্যাঙের তলে বালিশ দিয়ে বাইজি নাচিয়ে পার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের তো প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে কিছুই নেই। আমাদের কী অবস্থা হবে, ভেবে দেখেছেন কি? অশিক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পেট্রোলিয়াম আবিষ্কারের পূর্বে তাদের যে অবস্থা ছিলো, তারও চেয়ে করুণ অবস্থা হবে বাংলাদেশের।

মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জঙ্গিবাদের সুস্পষ্ট সম্পর্ক থাকার পরেও আমি যদি ধরে নিই যে, মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে দেশে একজন জঙ্গিও উৎপাদন হবে না, তবুও দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা থাকার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। দেশের মঙ্গলের লক্ষ্যেই এই শিক্ষার বিলুপ্তি প্রয়োজন। দেশের মসজিদগুলোর জন্য যে পরিমান ইমাম প্রয়োজন হবে, তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগ থেকে ডিগ্রি নেয়াদের নিয়োগ দেয়া যেতে পারে এবং মোয়াজ্জিন হওয়ার জন্য ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজন আছে বলেই আমি মনে করি না, প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। আর বাংলাদেশের মুসলমানরা যদি ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজী শিক্ষা নেয়ার পূর্বে যেরকম পিছিয়ে ছিলো, তেমন পিছিয়ে থাকতে চায়, তবে যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকুক। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেয়া পদক্ষেপ প্রশংসাযোগ্যই বটে!

3 Comments

  1. Mitu

Leave a Comment