প্রবাসের কথাবাংলাদেশস্মৃতিচারণ

সালতামামি ২০১৫ঃ আমার জীবন ও বাংলাদেশ

২০১৫ সালের শেষ দিনটিতে এসে ভাবছি এই সালটা আমাকে কী দিলো? নতুন জীবনের সূচনা? নাকি উদ্দেশ্যহীন যাত্রার সূচনা? ২০১৫ সালের শুরুতে আমার একটা চাকুরী ছিলো, অনেক স্বপ্ন ছিলো, সর্বোপরি আমার একটা দেশ ছিলো। আজ আমি চাকুরিহীন, স্বপ্নহীন, সর্বোপরি দেশহীন। নরওয়ে আমাকে তিন বছরের জন্য বাস করার অনুমতি দিয়েছে, বাইরের দেশে ভ্রমন করার জন্য বাংলাদেশের পাসপোর্টের মতোই একটা সবুজ ট্রাভেল ডকুমেন্ট দিয়েছে, যা দিয়ে আমি যে কোন দেশ ঘুরতে যেতে পারবো, তবে…… বাংলাদেশ ছাড়া।

Goodbye-2015-Welcome-2016

১৯৭১ সালে রাজাকাররা ঘর পুড়ে নিঃস্ব করে দিলে স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে আমাদের পরিবার ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা ছেড়ে বরগুনাতে পাড়ি দেয়। রাজাকাররা যখন ঘর পুড়ে দেয় তখন আমাদের তখনকার পরিবারের পাঁচ সদস্য বাবা, মা, কাকা, কাকি, ঠাকুমা কিছুই বাঁচাতে পারেন নি, এমনকি ঘরের সামনের বারান্দার একটা খুটির সাথে একটা সন্তান-সম্ভবা ছাগল বাঁধা ছিলো সেটিকেও না। তবুও ভাল যে, রাজাকাররা কাউকে জীবিত পুড়িয়ে মারে নি; এটা রাজাকারদের মহানুভবতা। আমি নরওয়েতে আসার পূর্বে জামা-কাপড়সহ টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসতে পেরেছি। ৭১-এ নিঃস্ব হওয়া আমাদের পরিবার যদি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, আমাকে এবং আমার ভাইকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে আমি এই উন্নত বিশ্বের দেশে এসে কেন পারবো না? হাল ছাড়ি নি বন্ধু !

তবে নরওয়েতে আসার আসন্ন পূর্বের দিনগুলো যেভাবে কাটিয়েছি, তা দুর্বিসহ। মে ও জুন এই দুই মাস অফিসে আসা-যাওয়া করতাম কমপক্ষে দু’জনকে নিয়ে, যদিও আমার বাসা থেকে অফিসে হেঁটে যেতে দু’মিনিটেরও কম সময় লাগতো। অনেকসময়ই এই পথটুকু হেঁটে না গিয়ে রিক্সায় যেতাম। আমার অফিসে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতেন আমার অফিসের দুই কর্মকর্তা এবং অন্য গার্ড-মেসেঞ্জাররা। শুক্র ও শনিবার বরিশালে পরিবারের কাছে যেতে পারতাম না, গোপালগঞ্জেই কাটাতে হতো। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত একটা রুমে বন্দী থাকতে হতো। হোটেল থেকে নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার, সিগারেট, পানি, ইত্যাদি এনে দিতো গার্ডরা। আমার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাকে এতো ভালবাসতো এবং আমার এই খারাপ সময়টিতে আমাকে এতোভাবে সাহায্য করতো যে তা শব্দবন্ধে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর গোপালগঞ্জে আমার হাসি-আনন্দ-সুখ-দুঃখ সবকিছুতে ছোট ভাই, বন্ধু, পরামর্শদানকারী হিসেবে ছিলো শুভ্র। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে, বাংলাদেশে আপনি কাকে সবচেয়ে বেশি মিস করেন, তাহলে একটা নামই আসবে- সেটি শুভ্র। এছাড়া এই দুঃসময়টিতে অনিক ও শাহিদুর আমাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। আর আমার খারাপ সময়কে উত্তোরণে দেশের বাইরে থেকে যারা সাহায্য করেছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ দিতে চাই না; তাঁদের জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালবাসা।

আমি বাংলাদেশে থাকাকালীন যে ভয়াবহ সময় পার করেছি, অনেকেই এখনও তেমন সময় পার করেছেন। অনেকেই গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশে থাকলে তাদের এই বন্দী দশার শীঘ্র উত্তোরণ ঘটবে এমন সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আমার সামর্থ সীমিত, তবুও যদি কারো সাহায্যে আসতে পারি, নিজেকে ধন্য মনে করবো।

বাংলাদেশের জন্য ২০১৫ সাল শুরু হয়েছিলো মানুষ পোড়ার উৎসবের মধ্য দিয়ে। বিএনপি-জামাত জোট ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে যেভাবে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ পুড়ে মেরেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানুষ-পোড়া রাজনৈতিক আন্দোলন আর কেউ প্রত্যক্ষ করেছে বলে আমার জানা নেই। বীভৎস, নিকৃষ্ট এই আন্দোলন এমন নিত্য-নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো যে, ভেবেছিলাম এ বুঝি আর কোনদিনই শেষ হবে না। পুড়ে যাওয়া মানুষের আর্ত-চীৎকারে ভারি হয়ে উঠেছিলো প্রতিটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, আর বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে করতে মরে যাচ্ছিলো একেকটি স্বপ্ন।

বিএনপি-জামাতের মানুষ-পোড়া আন্দোলনের মধ্যেই বাংলা একাডেমির একুশে বই মেলা শুরু হয়েছিলো। আমার মতো যারা ঢাকার বাইরে থাকে তাদের মধ্যে যাদের বই পড়ার অভ্যাস আছে, তাদের প্রতি বছর একবারের জন্য হলেও বই মেলায় যাওয়াটা অনেকটা অভ্যাসের মতো। এটা যতোটা না বই কিনতে যাওয়া, তার চেয়ে বেশি সমচিন্তার মানুষদের সাথে দেখা করা ও আড্ডা দেয়ার জন্য। ২০১০ সালে ব্লগিং শুরু করার পর থেকে আমি বই কেনার পাশাপাশি বই মেলায় আড্ডা দেয়ার লোভেই বই মেলায় যেতাম। ২০১৫ সালে অনেকেই ফেসবুকে জিজ্ঞেস করেছেন মেলায় আসবো কিনা এবং কবে আসবো। আন্দোলনের আগুনে পুড়ে মরার ভয়ে সবাইকে বলেছিলাম যে, এ বছর আর মেলায় যাওয়া হচ্ছে না, যদি আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করে তবে ভেবে দেখবো।

রাজনৈতিক আন্দোলনে পুড়ে যাওয়া মানুষদের চামড়া ও মাংসের পোড়া গন্ধ ও ঘা না শুকাতে শুকাতেই শুরু হলো ইসলামি সন্ত্রাসীদের রক্তের খেলা তথা বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার জগতের অন্ধকার যুগ।

আমি বাংলাদেশে বাস করেও আগুনে পুড়ে মরার ভয়ে বই মেলায় গেলাম না, আর অভিজিৎদা এবং বন্যা আপু সুদূর আমেরিকা থেকে বই মেলায় এসেছিলেন! এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝেও কেন তিনি এলেন – অভিজিৎদা খুন হওয়ার পরে এটা যে আমি কতোশতবার ভেবেছি আর কেঁদেছি! অভিজিৎদার মৃত্যু আমার যতোটা চোখের জল নিয়েছে, আমার মায়ের মৃত্যুও ততোটা চোখের জল নেয় নি। ব্যক্তি হিসেবে আমি একেবারেই আবেগবর্জিত; ব্যক্তিগত দুঃখে কোন দুঃখবোধ জাগে না। কিন্তু অভিজিৎদার মৃত্যু যে ব্যক্তির ক্ষতি না, সমাজ-রাষ্ট্র তথা গোটা বাঙালি জাতির ক্ষতি। তাই তো অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু আমাকে এখনও কাঁদায়।

অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার প্রথম দেখাও হয়েছিলো বই মেলায়। ২০১১ সালে। রাজিব হায়দার (থাবা বাবা), অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলয় নীল ও অনন্ত বিজয় দাসকে নিয়ে কিছুদিন আগে স্মৃতিচারণমূলক ব্লগ লিখেছিলাম। এছাড়া এই লেখক/ব্লগারদের নিয়ে এবং বাংলাদেশের ফ্রিডম অব স্পিচ নিয়ে সুইডিশ পেন-এর ব্লগ সাইট The Dissident Blog-এ লিখেছিলাম একটি ডিটেইল ইংরেজী ব্লগ লিখেছিলাম। কেউ আগ্রহী হলে পড়ে দেখতে পারেন।

২০১৫ সাল বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার জগতে এক অন্ধকার যুগ নেমে এসেছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের অভাব পূরণ করার মতো যোগ্যতা আমাদের নেই। কারো বিকল্পই কেউ হতে পারে না, তবুও আমাদের প্রচেষ্টারও ঘাটতি আছে বলে মনে করি। বিজ্ঞান নিয়ে আজ আর কেউ লিখছেই না বলতে গেলে। আমি নিজে বিজ্ঞান নিয়ে লেখার মতো যোগ্যতা রাখি না, কারণ আমার ঐ বিষয়ে পড়াশোনা নেই। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে নতুন ভাষা শিক্ষা, নতুন দেশের বিরূপ আবহাওয়ায় এ্যাডাপ্টেশন এবং সংসার ইত্যাদি নিয়ে এতোটাই হুলস্থুল যে, লেখার মতো সময় করে উঠতে পারি না। তবুও বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে সিরিজ আকারে লেখা শুরু করেছি, জানি না কতদূর আগাতে পারবো।

২০১৫ সালে যেসব মুক্তচিন্তার ব্লগারদের হারিয়েছি তাদের সবাই ছিলেন আমার ফেসবুক বন্ধু। এছাড়াও বন্ধু তালিকার যাদের হারানো কষ্ট দিয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন শাহরিয়ার মজুমদার। শাহরিয়ারের মতো একটি স্বতঃসফূর্ত ছেলে আত্মহত্যা করবে এটা ভাবতে পারি না, তাও আবার সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার জানালার সাথে। আরো হারিয়েছি দিবাকর স্যানাল দাদাকে। ব্যক্তিজীবনে হারিয়েছি একমাত্র মামা ও একমাত্র মেশোকে। তারা দু’জনই আমাকে খুব ভালবাসতেন। বস্তুতঃ সারাজীবন আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-পরিচিতদের কেবল ভালবাসা পেয়েই গিয়েছি, কাউকে কিছু দিতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না।

২০১৫ সালটি ছিলো বাংলাদেশের ইসলামী উগ্রপন্থীদের উত্থান ও সংখ্যালঘুদের আতংকের বছর। জামাতের রাজনীতির বিদায় ঘণ্টার সুর শোনা গেলেও ওলামা লীগ নামক আরেক দৈত্য তাদের দাঁত-মুখ খিচিয়ে উপস্থিত হয়েছে, যারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই একটি অঙ্গ সংগঠন। এদিকে এমন দিন খুব কমই পাওয়া গিয়েছে যেদিন পত্রিকায় কোন সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর আসে নি। গত বছরের মতো এ বছরও বিজয় দিবসের দিনে আদিবাসী নারীকে ধর্ষন করেছে বাঙালি সেটেলাররা। বাঙালি হিসেবে আমি লজ্জিত হই, আমি নুয়ে যাই, বাঙালির এই বর্বরতায়। সারা বছর জুড়ে হিন্দুদের মন্দির, পূজা মণ্ডব ভাঙার উৎসবে মেতেছিলো সংখ্যাগুরুরা। হিন্দুদের জমি-জিরাত দখল ও নির্যাতনে এগিয়ে ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ক্ষমতা দখলে যা মাঝে মাঝেই বেয়াই লীগে রূপান্তরিত হয়েছে

২০১৫ সালটি বাংলাদেশ স্বনির্ভরতার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ রেখেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন নিঃসন্দেহে একটি বড় পদক্ষেপ। যে স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন প্রতিটি বাঙালির, সে পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বিদেশী শক্তির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ও তা বাস্তবায়ন। ২০১৬ সালে বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় এবং তা দ্রুত বাস্তবায়ন যাবে, এমনটাই প্রত্যাশা।

আজ থাবা বাবার বিচারের রায় হবে। হয় তো রায়ে আমাদের চাওয়াও পূর্ণ হবে। কিন্তু থাবা বাবার সেই মৃদু স্বরের মিষ্টি বাংলা উচ্চারণ কোনদিনই আর শুনতে পাবো না; আর কোনদিন তাঁর সাথে আমার তর্ক হবে না; আমাকে আর কোনদিন বলবেন না, “দাদা, বরিশাল আসছি, কাঁকড়া খাবো কিন্তু’। অভিজিৎ রায়ের দীর্ঘ বিজ্ঞান প্রবন্ধ আর কোনদিন পড়তে পারবো না; অনন্ত বিজয়ের আর নতুন কোন বই প্রকাশ হবে না; ‘নাস্তিকদের দাঁত ভাঙা জবাব’-এর আর কোন পর্ব লিখবেন না ওয়াশিকুর বাবু; প্রতিটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে আর প্লাকার্ড হাতে দাঁড়াবেন না নিলয় নীল।

স্বপ্ন দেখি, ২০১৬ তথা অনাগত সালগুলোতে বন্ধু তালিকার আর কোন বন্ধুকে হারাবো না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা যে মোটেই তা নয়। মাদ্রাসা শিক্ষা চালু রেখে ও রাজনীতিকে ধর্মের অবাধ ব্যবহার রেখে হাজারটা সন্ত্রাসী তৈরির পথ উন্মুক্ত রেখে দু-চারটা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে কি কোনদিনই সন্ত্রাসবাদকে থামানো বা কমানো যাবে? রাজনীতিকে ধর্মের অবাধ ব্যবহার রেখে একটা ধর্মনিরপেক্ষ শান্তির সমাজ গঠন করা সম্ভব কি? আমাদের সরকার, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো, আমাদের সেনাবাহিনী এগুলো কখন বুঝবে? ২০১৬ সালে তাদের এই বোধোদয় ঘটুক, এটা প্রত্যাশা।

2 Comments

  1. Shagor Biswas

Leave a Comment