প্রবন্ধবাংলাদেশসংখ্যালঘু নির্যাতন

বাংলাদেশের হিন্দুঃ একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি (পর্ব-২)

১৯৪১ (অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলা) – ২৮.০%
১৯৫১ (পূর্ব পাকিস্তান) – ২২.০৫%
১৯৬১ (পূর্ব পাকিস্তান) – ১৮.৫০%
১৯৭৪ (বাংলাদেশ) – ১৩.৫০%
১৯৮১ (বাংলাদেশ) – ১২.১৩%
১৯৯১ (বাংলাদেশ) – ১১.৬২%
২০০১ (বাংলাদেশ) – ০৯.২০%
২০১১ (বাংলাদেশ) – ০৮.২০%

এই পরিসংখ্যন পর্যবেক্ষণ করলে আমরা যা দেখতে পাই তাকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা দিয়ে বিচার করা যাক। ১৯৪১ থেকে ১৯৫১ এর মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা বিরাট আকারে হ্রাস পায়। কেন পায়, তার সহজ উত্তর হলো, ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হওয়ার ফলে অনেক হিন্দু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পাড়ি দেয়। তবে পূর্ব পাকিস্তানের নমঃশূদ্র নেতা যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ উচ্চবংশীয়(!) হিন্দুরা দেশ ছাড়লেও বেশিরভাগ নমঃশূদ্ররা তাদের ভূমি ত্যাগ করে নি বা ১৯৪৭-এ ত্যাগ করলেও তাঁর আশ্বাসে পরবর্তীতে ফিরে আসে। তারপরও কেন হিন্দুদের সংখ্যা এতোটা কমে গেলো এবং সে কমে যাওয়ার ধারা পরবর্তী আদমশুমারী ১৯৬১ পর্যন্ত একইরকম থাকলো?

 দেশভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তানে থাকা হিন্দুদের ওপর রাষ্ট্র কর্তৃক সাম্প্রদায়িকতা প্রচার ও নির্যাতন শুরু হয়, যার অন্যতম দুটো উদাহরণ কালশিরা (বাগেরহাটের মোল্লাহাটের কালশিরা গ্রাম) ও নাচোল (রাজশাহী, বর্তমানে চাপাই নবাবগঞ্জ জেলা)। এ দুটি জায়গাতেই পুলিশ ও সেনাবাহিনী কর্তৃক হিন্দু ও সাওতালদের হত্যা ও ধর্ষন করা হয়, বাড়িঘর-ভিটেমাটি পুড়িয়ে দেয়া হয়। কালশিরার ৩৫০টি হিন্দু ঘরের মধ্যে মাত্র তিনটি ঘর অবশিষ্ট ছিলো, যার ফলে একমাসের মধ্যে ঐ গ্রাম ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে ৩০,০০০-এর বেশি মানুষ তাদের সহায় সম্বল সব পরিত্যাগ করে ভারতে পাড়ি জমায়। কালশিরার এই ঘটনা ঘটে ২১ ডিসেম্বর, ১৯৪৯। এর কয়েকদিন পরেই ০৭ জানুয়ারি, ১৯৫০ নাচোলে সাওতাল ও হিন্দুদের মোট একশজনের মতো কৃষককে হত্যা করে পাকিস্তানের পুলিশ ও সেনাবাহিনী।

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চজুড়ে চলে দাঙ্গা, যার শুরু হয় বরিশালে। সত্যিকারার্থে দাঙ্গার আভিধানিক অর্থে পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ব বাংলা/বাংলাদেশে কোন দাঙ্গাই কোনকালে হয় নি, যা হয়েছে তা কেবল হিন্দু নিধন বা হিন্দুদের ধন-সম্পদ লুট। ১৯৫০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রটানো হয় যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা এ.কে. ফজলুল হককে হত্যা করেছে। পুরো উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই অপপ্রচার রটানোর পরেই শুরু হয় হিন্দুদের নির্যাতন ও হত্যা। বরিশালের দাঙ্গায় মোট নিহতের সংখ্যা ৬,৫০০ এবং দেশত্যাগের সংখ্যা ৬৫০,০০০। একই সময়ে বৃহত্তর নোয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহসহ দেশের বহু জায়গায় হিন্দুদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এসময়ের দাঙ্গাগুলোতে পুলিশ, আনসার বাহিনী নিরাপত্তা তো দেয়ই নি, উল্টো সাহায্য করেছে। দেশত্যাগী হিন্দুদেরকে পথে পথে লুট করা হয়েছে, যাতে তারা বাংলাদেশ থেকে কিছুই না নিয়ে যেতে পারে। এগুলো সবই বাঙালি মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র।

পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরা কেন বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছিলো, এ ব্যাপারে আমাদের অনেক সুশীল ব্যক্তিও হিন্দুদের ভারত-প্রেমের যুক্তি তুলে ধরেন। ইতিহাসের ই-ও না-জানা এসব ব্যক্তিদের যুক্তি দেখলে কষ্ট লাগে আবার হাসিও পায়। তবে এ প্রশ্নের উত্তর পাবেন পাকিস্তান আন্দোলনের নেতা জে. এন. মণ্ডল-এর মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগপত্রের চিঠিতে। ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবরে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে লেখা চিঠিটিতে তাঁর পদত্যাগপত্রের জন্য তিনি মোট ৩৬টি কারণ উল্লেখ করেন। পুরো চিঠিটি পড়লে সহজেই আপনি বুঝে নিতে পারবেন কেন পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা দ্রুতহারে কমতে শুরু করেছিলো। পুরো চিঠিটির বাংলা অনুবাদ মুক্তমনা ব্লগে পাবেন। আমার প্রবন্ধের জন্য আমি উক্ত ব্লগ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ কপি-পেস্ট করে তুলে দিলাম।

“২৭। আমি এই প্রসঙ্গে আমি আমার পূর্ণ বিশ্বাস এবং সন্দেহ ব্যক্ত করতে চাই যে পূর্ব বাংলা সরকার এই প্রদেশ থেকে হিন্দুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করতে চায়। এই বিষয়ে আমি আপনাকে একাধিকবার সাক্ষাতে অনেক কথা বলেছি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি পশ্চিম পাকিস্তান হিন্দু নিধনে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রক্রিয়া সফলতার সাথে অগ্রসর হচ্ছে। ডি এন বারারি এর নিয়োগ এবং আমার এই বিষয়ে অসম্মতির পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে তারা কি অর্থে নিজেদের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দাবি করে। পাকিস্তান না হিন্দুদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে না পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। এখন তারা হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মারতে চায় যাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবন তাদের দ্বারা আর প্রভাবিত না হতে পারে।“

“৩২। হিন্দুদের সম্পত্তি চুরি-ডাকাতি এবং হত্যাকাণ্ডও আগের মত চলছে। থানা পুলিশ হিন্দুদের অভিযোগ নিচ্ছে না। অবশ্য হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক অপহরণ এবং ধর্ষণের সংখ্যা আগের থেকে কমে গেছে। এর কারণ হল পূর্ব পাকিস্তানে ১২ থেকে ৩০ বছর বয়সে কোন হিন্দু মেয়ে আর নেই। আর যারা পালাতে পারে নাই তারা মুসলিম গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচে নাই। আমি অনেক খবর পেয়েছি নিম্নবর্ণের হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণের খবর। হিন্দুরা বাজারে পাট এবং কৃষিপণ্য বিক্রি করতে যায়। মুসলিম ক্রেতারা খুব কম সময়ই পুরো দাম দেয়। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে আইনের শাসন নেই, বিশেষ করে হিন্দুদের জন্য।“

“৩৪। উপরের সংক্ষিপ্ত চিত্র থেকে এটা বলাই চলে যে সবদিক দিয়েই পাকিস্তানের হিন্দুরা আজ নিজভূমে পরবাসী। তাদের একমাত্র দোষ হল তারা হিন্দু ধর্মের অনুসারী। মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ বারবার বলছেন পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র আছে এবং থাকবে। ইসলামকে সকল বৈশ্বিক পঙ্কিলতা দূরীকরণের পথ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের পারস্পরিক সাংঘর্ষিক মতবাদের মধ্যে আপনি ইসলামিক গণতন্ত্রের আনন্দজনক সমতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে তুলে ধরছেন। শরীয়ত অনুসারে মুসলিমরা একচ্ছত্র শাসক এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের নিরাপত্তায় বেঁচে থাকা জিমির মত। এর জন্য তাদের আবার দামও দিতে হয়। এবং অন্য সকলের চেয়ে আপনি ভাল করে জানেন প্রধান মন্ত্রী সাহেব এর পরিমাণ কতটুকু। দীর্ঘ বিবেচনার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে পাকিস্তান হিন্দুদের বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত স্থান নয়। এখানে তাদের ভবিষ্যত হল ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। উচ্চ বংশীয় এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগই এর মধ্যে পূর্ব বাংলা ছেড়ে গেছে। যেসকল অভিশপ্ত হিন্দু পাকিস্তানে থেকে যাবে আমার আশঙ্কা ধীরে ধীরে পরিকল্পনামাফিক তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হবে নয়ত ধ্বংস করে দেয়া হবে। এটা আসলেই অবাক করার মত ব্যাপার যে আপনার মত একজন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা, অভিজ্ঞ ব্যক্তি মানবতার প্রতি হুমকিস্বরূপ এবং সকল সমতা ও শুভবোধের ধ্বংসকারী এরূপ মতবাদে পরিপূর্ণ হবার নজির রেখে যাচ্ছেন। আমি আপনাকে এবং আপনার সাথীদের বলতে চাই যে যেরূপ খুশি ব্যবহার করা হোক বা লোভ দেখানো হোক না কেন, হিন্দুরা নিজেদের জন্মভূমিতে নিজেরা জিমি হিসেবে গণ্য হতেও পিছপা হবে না। আজকে হয়ত অনেকে দুঃখে নয় ভয়ে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগামীকাল তারা জীবনের অর্থনীতিতে নিজেদের স্থান আদায় করে নেবার জন্য সংঘর্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কে বলতে পারে ভবিষ্যত কি লুকিয়ে রেখেছে? যখন আমি নিশ্চিত যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে আমার অবস্থান হিন্দুদের কোনো উপকারেই আসছে না তখন নিজের বিবেকের কাছে নিজেকে পরিষ্কার রাখার জন্যই আমি পাকিস্তান এবং বিদেশের হিন্দুদের মনে এমন কোনো মিথ্যে আশার জন্ম দিতে চাই না যে তারা এখানে সম্মান এবং জান-মাল ও সম্পত্তির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সহকারে বসবাস করতে পারবে। হিন্দুদের নিয়ে বলার ছিল এটুকুই।“

যে-দেশে রাষ্ট্র কর্তৃক সংখ্যালঘু নির্যাতিত হয়, সংখ্যালঘু উচ্ছেদ হয়, সেখানে তারা টিকতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার এটাই প্রধান কারণ। মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ভালবাসার মতো সামান্যতম উপাদানও রাষ্ট্র পাকিস্তান হিন্দু জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে নি। যার ফলে হিন্দুরা ক্রমশ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। নিজভূমে পরবাসী হয়ে থাকার চেয়ে পরভূমে পরবাসী হওয়া উত্তম।

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশে কোন আদমশুমারী হয় নি, যা পরে ১৯৭৪ সালে হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে কতোসংখ্যক হিন্দুকে হত্যা করা হয়, তার কোন পরিসংখ্যন নেই। তবে তা যে মুসলমানদের সংখ্যার চেয়ে বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও রাজাকার, আলবদর, আল-শামস কর্তৃক বাংলাদেশে যে গণহত্যা পরিচালিত হয়, তাকে গণহত্যা বলার কারণ মূলত নির্বিচারে হিন্দু হত্যা। মুসলমানদের হত্যার ক্ষেত্রে সবক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগক্ষেত্রেই সে হত্যাগুলো ছিলো ‘সিলেকটিভ’, যা গণহত্যার চরিত্র নয়; কিন্তু হিন্দুদের হত্যার ক্ষেত্রে কোন ‘সিলেকটিভ’ প্রকৃতি ছিলো না, হিন্দু হওয়াটাই যথেষ্ট ছিলো। গণহত্যা এড়াতে সে-সময়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া ১০ মিলিয়ন শরণার্থীদের ৬০ শতাংশের বেশি ছিলো হিন্দু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন হিন্দুদের গণহারে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয়ের সমালোচনার ক্ষেত্রে অনেকেই এটা বলে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হিন্দুরা তো বেশিরভাগই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো! তারা যে সত্যিটা বিচার করে দেখে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর ফরিদপুরের বর্তমান ফরিদপুর ও রাজবাড়ি জেলার প্রায় সকল হিন্দুদের ঘর-বাড়ি লুট করে সাধারণ মুসলমানরা, যার ফলে হিন্দুরা প্রাণ বাঁচাতে সর্বস্ব ফেলে ভারতে পালিয়ে যায়।

১৯৭৪ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় ১৩ বছরে শতাংশ হিসেবে হিন্দু জনসংখ্যা ৫ শতাংশ কমে যায়। এর প্রধান কারণ হিন্দুদের ওপর পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ১৯৬৫ সালের দাঙ্গা, ১৯৭১ সালের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়াদের ফিরে না আসা। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেক্যুলার আওয়ামী লীগের ক্ষমতাগ্রহণের ফলে ভারতে আশ্রয় নেয়া  বেশিরভাগ হিন্দুরাই বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলো। তারা আশ্বস্ত হয়েছিলো, এবার আর তাদের নিজভূমে পরবাসী হবার দুঃখে দেশ ছাড়তে হবে না। কিন্তু তাদের সুখ বেশিদিন সইলো না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সেক্যুলার রাজনীতির বিদায় ঘণ্টা বাজলো। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরেপক্ষতা’ মুছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করলো এবং একাত্তরের গণহত্যাকারীদের পূণরায় বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ প্রদান করলো; আরেক সামরিক শাসক এরশাদ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্টধর্ম ইসলাম সংযুক্ত করলো। কী হাস্যকর যে, এরশাদের মতো লম্পট চরিত্রের একজন শাসকের হাত ধরে দেশে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুক্ত হয়।

তবে বাস্তবতা হলো, শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন (১৯৭১-১৯৭৫) বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সেক্যুলার বলা হলেও, রাষ্ট্রের অনেক কর্মকাণ্ডই তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারাতে থাকে। শেখ মুজিব তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা নিজস্ব সংজ্ঞা দেন, যাকে আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা বলা চলে না, ধর্মীয় জগাখিচুরি টাইপ কিছু বলা যায়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ধর্মনির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষের ধর্মপালনের নিশ্চয়তা দিবে, কিন্তু নিজে কোন ধর্মকে কোনরকম পৃষ্ঠপোষকতা করবে না; ধর্ম কেবল ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকেন্দ্রিক থাকবে, যার সাথে রাষ্ট্র বা রাজনীতির কোন সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গঠন, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রের অনুদান প্রদানসহ অনেক কর্মকাণ্ডই রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলাম ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে, যা বর্তমান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের গোড়াপত্তন হিসেবেই বিবেচনা করা যায়। এছাড়া মুজিব সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’টিও বাতিল করে নি।

১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ এই ১৭ বছরে হিন্দুদের পরিসংখ্যনে বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটে নি। কারণ, এ সময়ে, বিশেষ করে ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলামকে ক্রমাগত প্রিভিলেজ দিয়ে দিয়ে দৃঢ় করা হলেও বড় ধরণের হিন্দু নির্যাতন হয় নি। মূলত ১৯৭২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই সময়টাকে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের প্রস্তুতিকাল বলা যায়; সরকারগুলো একের পর এক ইসলামকে রাষ্ট্র কর্তৃক সুবিধা প্রদান করে করে ক্ষেত্র তৈরি করেছিলো। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় উগ্র হিন্দুত্ববাদি সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের করসেবকদের কর্তৃক অযোধ্যায় বাবড়ি মসজিদে আক্রমন হলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হিন্দু নির্যাতনের স্বীকার হয়। যদিও সে নির্যাতন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, তবে বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলো যে, স্বাধীন বাংলাদেশও তাদের দেশ নয়, তাদের ছুটতে হবে ফের, অন্য কোথাও অন্য কোনখানে।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ, বিজেপির করসেবকদের কর্তৃক অযোধ্যার বাবড়ি মসজিদ ভেঙে ফেলা হলে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এ সময়ে সারা বাংলাদেশেই হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। মৃত্যুর সংখ্যা কম হলেও প্রচুর হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়, যা বাংলাদেশে হিন্দুদের জীবন পাকিস্তান শাসনামলের মতো ফের সংকটময় করে তোলে। এর ফলস্বরূপ প্রচুর হিন্দু নীরবে দেশ ত্যাগ করে ভারতে পাড়ি দেয়, যার প্রভাব দেখা যায় ২০০১-এর আদমশুমারীতে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে বিএনপি-জামাতে ইসলামী জোট সরকার ক্ষমতায় এলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের মতোই হিন্দুরা ফের রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্যাতনের স্বীকার হয়। পুরো বিএনপি-জামাত শাসনামলই তা থেমে থেমে অব্যাহত থাকে।

বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে না হলেও ক্ষমতাসীন তথাকথিত সেক্যুলার আওয়ামী লীগের চেলা-চামুণ্ডা থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত হিন্দু নির্যাতনে মদদ দিয়ে থাকে; ওদিকে জামাত ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন তো রয়েছেই। এছাড়াও ধর্মীয় জলসা, মাহফিল, মসজিদের বয়ান ইত্যাদিতে ইসলাম ধর্মরে প্রচারকরা খোলামেলাই হিন্দুদের আচার-সংস্কৃতি, কাস্টমস, ট্রেডিশন, ইত্যাদির সমালোচনার মাধ্যমে এ্যান্টি হিন্দু মানসিকতাকে উসকে দিচ্ছে, যার ফলে প্রতিনিয়ত হিন্দু নির্যাতন বেড়েই চলছে এবং ২০১৩ সাল থেকে তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে। আজকাল হিন্দু নির্যাতনের সংবাদ ছাড়া একটা দিনও পার করা মুশকিল। পত্রিকাগুলোর কাছে তথা পাঠকের কাছে এসব খবর এমনই গতানুগতিক হয়ে গিয়েছে যে, এখন পাঠকের নজর ফিরাতে পত্রিকাগুলো ‘সাপ্তাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতন সংখ্যা’ খোলার চিন্তা করতে পারে।

২০০১ সাল থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে নতুন ধারাটি শুরু হয়েছে, তা একইভাবে চলছে এবং একইসাথে চলছে হিন্দুদের নীরব-দেশত্যাগ। আপনারা সাথে থাকলে সে-সব নিয়ে পরবর্তী পোস্টগুলোতে আলোচনা করা হবে।

2 Comments

  1. Nayan Bhowmick

Leave a Comment